আইনস্টাইনের সময় থেকে শুরু হয়ে চলে আসা অনিশ্চয়তাসূত্রটি চিন্তাজগতে বেশ সেঁটে বসেছে। বিজ্ঞান তাবৎ জগৎ সম্পর্কে শেষ কথাটি জানাতে একেবারেই অপারগ, স্থায়ী-নিশ্চিত কোনো কিছুই সে বলতে পারে না। ‘জগৎ সম্পর্কিত শেষ কথাটি আদতেই জানা সম্ভব নয় কোনো অবস্থায়, কখনোই’, আমরা প্রতিনিয়ত এক অনিশ্চয়তাপূর্ণ জগৎ ও জীবনে বাস করি, মুখোমুখি হই অনিশ্চিত সময়ের। কোয়ান্টামতত্ত্ব বলে সাম্প্রতিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে উস্কে দিয়েছে বৈকি। মানুষের স্বভাবধর্ম সে নিশ্চয়তা চায়, অনিশ্চিত কোনো কিছু মেনে নিতে পারে না। আশ্চর্য বিস্ময় মানুষের চোখে যে বিশালতা, তাবৎ পৃথিবীর কোনোটাই ঠিক নিশ্চিত সূত্রকে মেনে চলে না। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সূত্র বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় নিক্ষেপ করছে। হালে মুক্তবাজার অর্থনীতির ব্যাপারটি বিস্ময়কর হলেও অনিশ্চয়তাসূত্রকেই মেনে নিয়েছে। মুক্ত বাতায়নের হাত ধরে এসেছে জগত-কাঁপানো বিষয়-আশয়।
০১ : ০২
মুক্তবাজার অর্থনীতি মানুষের মনোবৈকল্য বৃদ্ধি করেছে, হতাশা-ক্রোধ-অসংযম-একাকিত্ব আমদানি করেছে, স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ততোটা নিশ্চিত করতে পারেনি। বিজ্ঞাপনের বাহ্যিক চমক আর তন্বি নারীদেহের প্রাধান্য অবশ্য বৃদ্ধি পেয়েছে সত্যিকার অর্থেই, হৃদয় ততোটাই পিছিয়ে পড়েছে। বৃহত্তর নগর-বিপনির বিলবোর্ডগুলোর উপচে পড়া যৌবন প্রমাণ করে কতটা এগিয়েছি। ক্রেতার আমাশয় রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে (বদনামটি অবশ্য একতরফা বাঙালিদেরই ছিল— সবজান্তা ও আমাশয় রোগী)। মায় চারদেয়ালের ভেতর যে বাণিজ্য— বিভিন্ন চ্যানেলের দৌরাত্ম্য, …স্মার্ট গৃহিনীর জন্যই শুধু, তখন গৃহিনীরা স্মার্ট হবার জন্যই কপাল ঠুকে নামবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! আর হাত বাড়ালেই বিশ্ব! ইন্টারনেট আছে না? আছে পর্নোগ্রাফির রঙিন ভুবন।
০১ : ০৩
বলছিলাম অনিশ্চয়তার কথা। এত অনিশ্চয়তাপূর্ণতায় সাহিত্য কোথায় স্থিতি পাবে? সাহিত্যও কি অনিশ্চিত হয়ে যাবে? সাহিত্য নিশ্চয়তার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করবে এমন নয়, তবে অনিশ্চয়তার দোলকে পেন্ডুলাম দোলাবে এমন ভাবনা আপাতত আমাদের নেই। সাহিত্য নিজেই পরিপূর্ণ জগৎ, যে জগৎ অনিশ্চয়তাপূর্ণ তো নয়ই, বরং স্বপ্নের জগৎ, শৃঙ্খলার জগৎ। সাহিত্য সেই স্বপ্নময় জগৎ যেখানে পাঠক পরিভ্রমণ শেষে শুদ্ধতা অর্জন করে। তো এতকিছুর মধ্যে কবিতার স্থান কোথায়?
০১ : ০৪
মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশ মানেই ব্রান্ড যুগের সূচনা। একটা সময় ছিল যখন বাংলাকাব্যে কোনো কবি নামের টাইটেল ব্যবহার করতেন না। টাইটেল হোল্ডার হতেন ঈশ্বর অথবা ইষ্টদেবতা, যা রচয়িতা শুরুতেই উল্লেখ করতেন। কিন্তু দিন বদলেছে। আজকে এতবেশি প্রতিযোগিতা কি শিল্প, কি কবিতা বিশ্বদুয়ারে সবাই নিজেকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। বিশ্বায়ন মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা নতুন এবং পরিষ্কার নয় যদিও, তারপরও সাম্প্রতিক কবিতায় এর হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশ্বায়ন ধারণায় মৌলিক ত্রুটি হয়ত আছে , নিছক তাত্ত্বিক ধারণা-কাগুজে চিন্তা হতে পারে এটি, এর দখল হতে পারে ময়লা রাখা ঝুড়িতে, কিন্তু চিন্তায় প্রভাব ফেলছে মানতেই হবে। কবিতা এখন পণ্য, কবি এর বিক্রেতা। ফলে দায় কবিরই কবিতা বিপণনে। সাম্রাজ্যবাদ কথাটি শুনতে খারাপ হলেও আমরা নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের খপ্পরে পড়েছি। যার ভাষা আধুনিক, প্রকাশভঙ্গি আলাদা। সাম্রাজ্যবাদ বদলায় যুগে যুগে, স্বনামে কখনো বেনামে। ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যবাদ তার গতিধারা কোন পথে পরিবর্তন করবে? সাম্রাজ্যবাদ পরিবর্তনের সাথে সাথে কবিতার ভাষা-প্রকাশভঙ্গি পাল্টাবে? কাব্য ইতিহাসে এই নতুন আন্দোলনের নাম কি হবে?— আমরা জানি না।
০১ : ০৫
ফিকে তিরিশ সম্পর্কে বলবার কিছু আছে। এর প্রভাব আজতক এতবেশি যে অনেকেই এখনো অন্ধ-অনুকরণে মত্ত আছেন। আমার বিশ্বাস বাংলাকবিতা পুরো তিরিশি দশকের কবিরা মিলে প্রচণ্ড ক্ষতি করেছেন। নিজস্বতা বলতে আমাদের যা ছিল, নিজস্ব ঘরানা তা আমরা নষ্ট করে ফেলেছি তিরিশি কবিদের কল্যাণে। তবে তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। স্বীকার করি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থ-সামাজিক মানসিক পরিবেশে নৈরাজ্য-একাকিত্ব দ্বারা আলোড়িত হন ত্রিশের কবিরা। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০০-১৯৭৮), বিষ্ণু দে ( ১৯০৯-১৯৮২), অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯), সমর সেন প্রমুখ কবি রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে মন-মননে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে একটি নতুন সাহিত্যিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে ভিন্নধারা অবলম্বন করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইউরোপের সাথে গভীর পরিচয় থাকাসত্ত্বেও তিনি দেশীয় ঐতিহ্য তথা চিন্তায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। উপনিষদ, প্রচলিত লোক ধর্ম-দর্শনের নৈকট্যে আস্থা স্থাপন করেন। প্রথম থেকেই দু’টি বিপরীতমুখী স্রোত কবিতায় ক্রিয়াশিল। একটি বিজ্ঞানমুখী এবং অন্যটি রোমান্টিক ধারায় সিক্ত ঐতিহ্য লালিতগোষ্ঠী।
০১ : ০৬
সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের কালে রচিত হয় রবীন্দ্র-সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সম্ভার। বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তাঁকে বিচলিত করে। অবশ্য কাব্যে তার প্রতিফলন অল্পই ঘটেছে। সুস্থির জীবনধারারই প্রতিনিধি তিনি। শোষিত-বঞ্চিত গোষ্ঠীর সাথে আত্মার সম্পর্ক কখনোই স্থাপিত হয়নি রবীন্দ্রনাথে। সেদিক থেকে নজরুল জনগণের অনেক কাছাকাছি ছিলেন। একথা বলার যুক্তি আছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তি জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হেরে গেছেন, পরাজিত হয়েছেন নিজেরই ঘোষিত ঋষি রবীন্দ্রনাথে। কবিগুরুর স্বাতন্ত্র্য বাংলা কবিতায় অনস্বীকার্য। তিনি তার সময়ের এক সচল মহীরুহ যাকে অতিক্রম করতে বাংলা কবিতার কয়েক যুগ লেগেছে(?), যতদিন-না কবিতা আন্দোলনে সেই সাহসী বিপ্লবের উদয় হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি প্রচণ্ড আত্মিকরণ করতে পারতেন। ইউরোপীয় সাহিত্যে তাঁর দখল যেমন তেমনি পরিচয় ছিল লোকজ জনজীবনের সাথেও। নিয়েছেন ভারতের আদি দর্শন থেকে। লালন থেকে আত্মিকরণ করেছেন অপরিসীম দক্ষতায়। তবু দ্বিধা কাটেনি। নিজের কাব্য সম্পর্কে সংশয়ী ছিলেন। নোবেল কমিটিতে পাঠালেন গীতাঞ্জলি থেকে বাছাই সবচেয়ে দুর্বল কবিতাগুলো। যাকে বলা যায় উপনিষদের কাব্যিক রূপান্তর। বিশ্বকবিতায় রইলেন অপাংক্তেয়, প্রাচ্যের ঋষি হয়ে। মূলের সন্ধান পেল না বিশ্ব। সম্ভবত নিজেও চাননি। রবীন্দ্রপ্রতিভার দীপ্তির মধ্যেই স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রপ্রভাববলয় অতিক্রমের প্রথম সাহসী অভিযাত্রীও এরাই। এদের মধ্যে নজরুল গানকে যতটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন ততোটাই ব্যর্থ হন কবিতায়। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকার কারণেই সম্ভবত তার এই বিচ্যুতি। একই ধারার পরবর্তী কবি সুকান্ত। কিশোর সুকান্ত রাজনৈতিক কারণে প্রয়োজনীয় হলেও বাংলাকাব্যে তার খুব বেশি জায়গা নেই।
০১ : ০৭
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সন্তান রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), হেনরি ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮৩১-১৮৯৮), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৯১) প্রমুখ মনিষী। দেববাদ নির্ভরতার বন্ধন কাটিয়ে যুক্তিবাদের একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। মধ্যযুগের অবসান হয়ে আধুনিকতার সূচনা ঘটে কবিতায়। (আধুনিকতার ধারণা নিয়ে বেশ মত-পার্থক্য আছে। কাকে আধুনিক বলব আর কাকে বলব না, এ নিয়ে বিভ্রান্তি-তে পড়তে হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কুলকিনারা হয়নি। হালের উত্তরাধুনিক কতটুকু পানি পাবে সময়ই হয়ত বলে দেবে।) নবজাগৃতির এই পর্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্প্রসারিত হয় বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক অবধি। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭), বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪), হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) প্রমুখ কবি এসময় লেখনি ধারণ করেন। ঊনিশ শতকের ইংরেজী শিক্ষিত এই কবিকুলের মধ্যে মধুসূদন ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পাশ্চাত্য আদর্শ মনেপ্রাণে গ্রহণ করলেও শেষতক তিনি ছিলেন শেকড়-সন্ধানী। সূচনালগ্নে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত ও উপনিবেশবাদী আধুনিকতার যে ধ্রুপদী স্বরূপ উন্মোচিত হয় মধুসূদনের চেতনায় তা বাঙালি বিদ্ব্যৎসমাজের চোখে স্পষ্ট ছিল না। অগ্রসরমান শিক্ষার সুযোগ নিয়ে বৈষয়িক সমৃদ্ধি অর্জন ও ব্যবসায়িক স্বার্থে ক্রমবিকাশমান বুদ্ধিজীবীসম্প্রদায় প্রায় সবাই নিয়েছিলেন উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর তোষণ-নীতি। সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৪-৫৬), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) থেকে শুরু করে নীলবিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬২), মৌলভীবাজার, বগুড়া, পাবনা জেলার কৃষকবিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৩) ইত্যাদিতে এরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিবেচনা থেকে দেখার ফলে রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের দেশাত্ববোধ হয়েছে সংকীর্ণ-আবেগতাড়িত। এদের রচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে যবন-বিরোধিতা, ব্রিটিশ-বন্দনা, হিন্দু-পুনরুত্থানের স্বপ্ন।
০১ : ০৮
১৯২১ থেকে ১৯৩৫ এই পর্বটি নানা কারণে চিহ্নিত ও বিশিষ্ট। যদিও বলা হয়ে থাকে, সাহিত্য গোষ্ঠীবদ্ধভাবে করা যায় না। কিন্তু গোষ্ঠী-সহযোগিতা সাহিত্য আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত। এই কালপর্বে একে একে প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালি-কলম’ (১৯২৬), ‘প্রগতি’ (১৯২৭), ‘পরিচয়’ (১৯৩১)। বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে এই কাগজগুলোর ভূমিকা রয়েছে। দীনেশরঞ্জন দাশ (১৮৮৮-১৯৪১) সম্পাদিত কল্লোলের পাঁচমিশালি কবিতাসম্ভারের মধ্যে পুরোনো ধাঁচের পাশাপাশি ছাপা হয়েছে অনেক আধুনিক শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা। মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত যেমন এই কাগজকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ তরুণ কবিদের অবাধ বিচরণভূমি ছিল এই কাগজ। কল্লোল-পরবর্তী কালি-কলম কাব্য আন্দোলন সক্রিয় রাখে। মুরলীধর বসু (১৮৯৭-১৯৬০) সম্পাদিত পত্রিকাটি ক্ষুধা ও যৌনতা, স্বপ্ন ও বিদ্রোহকে দেখেছে খোলা চোখে। অনেকেই বলে থাকেন, প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪)-এর আভিজাতিক আবহ থেকে বাংলা কবিতাকে বাস্তবতার নতুন পথে নিয়ে আসে ‘কল্লোল’ ও ‘কালি-কলম’। বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯) সম্পাদিত ‘প্রগতি’ তরুণ লেখকগোষ্ঠীর সাথে ভাববিনিময় ও যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’কেও খাটো করে দেখা যাবে না। এই পত্রিকাকেন্দ্রিক সাহিত্যিকগোষ্ঠী ও শুক্কুরবারের আড্ডায় সমবেতরা ছিলেন উদার ও প্রগতিশীল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীসম্প্রদায়। কল্লোলগোষ্ঠীর বেপরোয়া উদ্দামতা এদের ছিল না। প্রকাশকাল থেকেই পরিচয়ের প্রধান ঝোঁক ছিল বাঙালী পাঠকের মানসভুবনে সর্বমানবীয় ও সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ উপলব্ধিকে প্রবাহিত করা। বঙ্গদর্শন (১৮৯২-১৮৭৬) থেকে সবুজপত্রের কাল অবধি যে অর্জন— কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, পরিচয় পত্রিকাকে ঘিরে নবীন কবিদের যে অভিনবত্ব তা সে সময়ের রক্ষণশীলরা মানতে পারেননি। সবচেয়ে কট্টর ও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সজনীকান্ত দাসের (১৯০০-১৯৬২) ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯৩৪)। আধুনিক কাব্য আন্দোলনে ‘ত্রৈমাসিক কবিতা’ (১৯৩৫) পত্রিকার গুরুত্বও অনেক।
০১ : ০৯
আধুনিক কবিতা আন্দোলনে পথিকৃৎ প্রধান কবিদের ওপর টি.এস. এলিয়টের প্রভাব ছিল অসামান্য। শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭), স্তেফান মালার্মে (১৮৪২-১৮৯৮), আর্তুর র্যাবোঁ, পল ভালেরি প্রমুখ ফরাসি প্রতিকবাদী বা সিমবলিস্ট কবিরা প্রভাব বিস্তার করেন। চিত্রকল্পবাদী কবিতার জনক এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২) ও তার প্রবর্তিত ইংরেজি চিত্রকল্পবাদী কবিতাকে অনেকেই প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেন। ফরাসি পরাবাস্তববাদী কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হন জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে। হ্যেল্ডার্লিন (১৭৭০-১৮৪৩) ও রিলকের (১৮৭৫-১৯২৬) কবিতা আকৃষ্ট করেছিল বুদ্ধদেব বসুকে। রোমান্টিক কবি অ্যাডগার এ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯), ইমপ্রেশনিস্ট কবি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্স (১৮৪৪-১৮৮৯), পল ভের্লেন (১৮৪৪-১৮৯৬), ডব্লিউ বি ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) প্রমুখ কবির প্রভাবকেও স্বীকার করতেই হবে। আঠার শতকে ইংরেজি কবিতা ছিল ক্লাসিকধর্মী। এসময় কবিতা হৃদয় থেকে বিচ্যুত হয়ে যুক্তি বা বুদ্ধি প্রাধান্য পেতে থাকে। কাব্য-প্রকরণের আধিক্যে জর্জরিত মেধা ও প্রকাশভঙ্গীর চাতুর্যে হয় ম্লান, কাব্যভাষা কথ্যভাষা থেকে সরে গিয়ে পরিণত হয় অলংকারভূষিত কৃত্রিমতায়। চতুর্দশ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি রহস্যময় মুগ্ধতা ক্লাসিকধর্মের কাছে হেরে যায়। আবার ক্লাসিকধর্ম রোমান্টিসিজমের কবর রচনা করে। মানুষের অসহায়ত্বকে সম্বল করে একে একে অনেকগুলো মতবাদের আবির্ভাব হয়। রুমানিয় কবি ত্রিস্তান জারার নেতৃত্বে ১৯১৬ সালে জুরিখ শহরে দাদাবাদের আবির্ভাব হয়। দাদাবাদ পরিণতি পায় পরাবাস্তববাদ বা সুররিয়ালিজমে এসে। ১৯২৪ সালে আঁদ্রে ব্রেঁতো পরাবাস্তববাদকে নতুন জীবন দেন। প্রচলিত নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও প্রথার বিধি-নিষেধ ভেঙে দর্শন ও বিজ্ঞানে উজ্জীবিত এই আন্দোলন নতুন মূল্যবোধে দীক্ষিত ছিল। আঁদ্রে ব্রেঁতো, লুই আরাগঁ, সালবাদর দালি, ডিলান, টমাস, হেনরি, মিলার, উইলিয়াম বুরুজ প্রমুখ পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। খণ্ডিত বাক্যের সমাবেশ, যুক্তিহীনতা, স্বপ্নময় ও ভীতিকর পরিবেশ ইত্যাদি চিন্তা স্থান পায় এখানে। এ সময় আরেকটি আন্দোলন অলখে দানা বাঁধে তা হল অস্তিত্ববাদ। অস্তিত্ববাদী আন্দোলনে যাদের অবদান সবচাইতে বেশি তারা হলেন জাঁ পল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০), কিয়ের্কেগার্দ, হোর্সেল। (অনেকদিন থেকেই অস্তিত্ববাদকে একটি দার্শনিক আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা চলেছে। একে দার্শনিক আন্দোলন বলতে আমরা নারাজ, এটি একটি বিশুদ্ধ সাহিত্য আন্দোলন।) ইউরোপ ও আমেরিকায় পুঁজিবাদ বিকাশে শিল্পবিপ্লব একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যন্ত্রের আবির্ভাব, বাষ্পীয় শক্তির উত্থান, বস্ত্রশিল্পের বিকাশ, মেট্রোপলিটান নগর প্রতিষ্ঠা, নতুন শিল্পাঞ্চল, বেকার সমস্যা ইত্যাদি বিষয়গুলো নাগরিক জীবনে প্রভাব ফেলে। বিংশ শতাব্দিতে সংঘটিত দু-দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ইউরোপ-আফ্রিকায় সংঘটিত ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চিন্তাজগতে আমূল পরিবর্তন আনে। ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত হতাশা, একাকিত্ব বরাবরই আমাদের পরিচিতির বাইরে। এই সাহিত্যকে যতই আধুনিক বলা হোক না কেন তা আরোপিতই থেকে যাবে।
০১ : ১০
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, দোভাষী পুঁথি-সাহিত্য, রোমান্টিক-প্রণয়োপাখ্যান, উনিশ শতকের গীতিকবিতা প্রধান। ঐতিহ্যগতভাবেই এই ভূখণ্ড অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম লোকাচারের হাতিয়ার। ঈশ্বর-পূজা কিংবা অন্যগুলো প্রাত্যহিক কর্মের অংশ। জীবনের প্রয়োজনে, জীবন-ধারণের প্রয়োজনে এখানে কর্মের ছদ্মবেশে ঈশ্বরচিন্তার প্রসার ঘটে। বেদ কিংবা অন্য যে চিন্তাগুলো সেগুলোও আসলে প্রাত্যহিক প্রয়োজনেরই অংশ। ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বোঝতে তাই বেশ বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। প্রকৃতিগত কারণে এখানে মানুষ অলস শ্রমবিমুখ। আধ্যাত্মিকতার একটা ব্যাপার গোড়া থেকেই পেয়ে বসেছিল। আবার এই আধ্যাত্মিকতাও পরম মমতারই বহিঃপ্রকাশ। হিংসাত্মক দিকটি বরাবরই উপেক্ষিত। উঁচু এবং নীচু বর্ণের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল সংঘাত ছিল। নির্মোহ আধ্যাত্মিকতা থাকার কারণেই এখানে বেদবিরোধী নাস্তিক্যবাদী চিন্তার উদ্ভব প্রসার হতে পেরেছে। বৌদ্ধযুগের একটা আবেদন হয়ত ছিল, ব্রাহ্মণদের অত্যাচারও সত্য, উপমহাদেশের সত্যিকার পরিবর্তনটা দেখার মতো। আরব বণিকরা যতদিন না ভাগ্যান্বেষণে এখানে আসে এবং পুরো ক্ষমতার অধীশ্বর না হয়ে বসে ততোদিন সত্যিকার পরিবর্তন চোখে লাগেনি। মুসলমান শাসকরা ক্ষমতায় এলেও ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে চায়নি। বৈষ্ণব-বাউলদের স্বর্গরাজ্য এই অঞ্চল। ইসলাম প্রচারও তাই যত-না ক্ষমতার বাণিজ্য তার চাইতেও বেশি আধ্যাত্মিকতার। সুফিসাধকরাই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। লক্ষণীয়, নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা বৌদ্ধরাই ধর্মান্তরিত হয়েছিল। একটি কারণ হতে পারে রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি। অন্যটি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের হাত থেকে নিষ্কৃতি। জাত-পাতের ব্যাপারটি ছিল কঠোর। ধর্মান্তরিত হলেও আরবে যে ইসলাম প্রচার হয়েছিল এখানে ঘটে তার উল্টো। ধর্মান্তরিতরা তাদের পূর্ব-ধর্মের সাথে নতুন-ধর্মের আচার-আচরণ মিলিয়ে অভিনব একটা উপায় বের করে নেয়। কাব্যচর্চায়ও এই ধারাই দীর্ঘদিন অনুসৃত হয়েছে। ইসলামের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, নবী-রসুলদের নিয়ে যে পুঁথি রচিত হয় তাতে মঙ্গলকাব্য এবং হিন্দুরীতির ছাপ স্পষ্ট। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই ভূখণ্ডের যাতায়াত বাইরের দুনিয়ার সাথে খুব একটা ছিল না। বণিক পেশা ছিল নিন্দার। বাণিজ্যকে লক্ষ্মী হিসাবে দেখা হত না। অমঙ্গলের প্রতীক হিসাবে মনে করা হত। গৃহের বাহির মানেই ছিল বনে সন্ন্যাস।
০১ : ১১
বিচ্ছিন্ন হলেও বরাবরই কাব্য-আন্দোলন ছিল প্রচলিত ধারার বিপরীতে। মানতেই হবে লোকজ ঐতিহ্য, প্রথা, সংস্কৃতি প্রত্যেক জাতীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অহংকারের বিষয়। একেবারে শেকড়চ্যুত চর্চা-অনুসন্ধান কেমন যেন ভাবনাকে বিষিয়ে দিতে চায়। সবশিল্পই রহস্যময় আলো-আঁধারের খেলা। আর কবিতা এবং কবিরা যে এই খেলায় মেতে উঠতে চাইবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কবিতা অনিশ্চয়তার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে, দূরে সরে নিশ্চিতের চাইতেও নিশ্চিত যে জীবন তা পাঠককে দেয়, দেয় সুখ। এক স্বপ্নময় জগৎ পরিভ্রমণ শেষে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় সঞ্চয়ের ভাঁড়ার।
বর্ষ ৩, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৪