005898
Total Users : 5898
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

অভাব ও আমাদের অভাববোধ

বর্তমানে আমাদের মিডিয়াগুলোতে দুর্নীতি বা দুর্নীতির প্রসঙ্গ খুবই আলোচিত এক বিষয়। অবশ্য বর্তমানে বলছি কেনো, সবসময়ই তা আমাদের মিডিয়াগুলোর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিলো এবং আছে। নিউজের স্বভাব অনুযায়ী হয়তো এটাই স্বাভাবিক। অন্তত আমরা সেভাবেই তৈরি হয়ে গেছি বা আমাদেরকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। ফলে আমরা যে যেই পত্রিকাই পড়ি না কেনো, চোখের সামনে মেলে ধরলে প্রথমেই চোখ আটকে যায় পত্রিকার প্রধান শিরোনামটিতে। আকারে আঙ্গিকে পত্রিকার প্রধান শিরোনামটিকে এমনভাবেই তৈরি বা উপস্থাপন করা হয় যেনো আমাদের চোখ আটকানোর ঘটনাটা পত্রিকার চাহিদা অনুযায়ীই ঘটতে পারে। এবং ঘটছেও তাই। শিরোনামের বিষয়, প্রকার বা দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে, প্রসঙ্গ কিন্তু একটাই, ব্যাপক অর্থে দুর্নীতি। ফলে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিকদের, যাঁরা দিনের কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতিটা নেন হাতের কাছে রাখা পত্রিকাটিতে একটিবার চোখ বুলিয়ে, তাঁদের দিনটা বস্তুত শুরুই হয় একটা নেতিবাচক চৈতন্যকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে। ফলে আমাদের দিনের পরবর্তী কর্মকান্ডগুলোর প্রকৃতি ও প্রভাব যেহেতু আমাদের মানসিক অবস্থার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, তাই আমাদের কাজের গতিপ্রকৃতিও বস্তুত লক্ষ্যনিষ্ঠ দিক ছেড়ে কোনো অনাকাক্সিক্ষত দিকে যে মোড় নিতে পারে তার একটা সমূহ আশংকা আগেই তৈরি হয়ে যায়।

পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যে গতিবিদ্যা বলে একটা বিষয় আছে। তবে গতিবিদ্যা বুঝতে হলে যে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজন হয় না সেটা আমরা সেই দুরন্ত কৈশোরেই বুঝে ফেলেছিলাম, যখন পদার্থবিদ্যা আসলে কী সেটাই জানতাম না। ভরা বর্ষায় খরস্রোতা সুরমার এপার থেকে ঠিক নাক-সোজা ওপারে যাবার লক্ষ্যে নাক-মুখ গুঁজে ভোঁ সাঁতার দিয়ে ওপারে পৌঁছে যেতাম ঠিকই। কিন্তু যখন আবিষ্কার করলাম যে লক্ষ্যবিন্দু থেকে অনেক ভাটিতে চলে এসেছি, তখন ফের যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছার উপায়টাও আবিষ্কৃত হয়ে গেছে আমাদের ব্যবহারিক জ্ঞানের মাধ্যমে। লক্ষ্যবিন্দু থেকে যতোটা ভাটিতে চলে এসেছি, এবার লক্ষ্যবিন্দু থেকে ঠিক ততোটা উজানে গিয়ে ফের নাক-মুখ গুঁজে সোজাসুজি সাঁতরে সত্যি সত্যি যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ার আনন্দ এতোসব অহেতুক বেগার খাটার কষ্টের চেয়ে ঢের বেশি উপাদেয় ছিলো। পদার্থবিজ্ঞান না পড়েও খেয়ানৌকার মাঝিরা প্রতিনিয়ত গতিবিদ্যায় যে পারদর্শীতা দেখান তাও তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানেরই ফলাফল। তবে স্রোতের আড়াআড়ি দূরত্ব অতিক্রম করতে বা বিভিন্নমুখী বলের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে লব্ধ বেগ ও অতিক্রান্ত দূরত্বের অভিমুখীনতা বুঝতে এবং কোন্ ক্ষেত্রে কতোটুকু কৌণিক বিচ্যুতি ঘটে এসব তাত্তি¡ক বিষয় জানতে হলে শুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় গতিবিদ্যা পাঠের আবশ্যকতা রয়েছে অবশ্যই। কিন্তু প্রশ্ন, পদার্থবিজ্ঞানের এই বস্তুগত প্রক্রিয়ার মতো সেরকম কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলাফল কি আমাদের মনোজগতে ঘটতে পারে না? মনের মতো এমন তীব্র সংবেদনশীল আখড়ায় যে-কোনো অনাহুত ঘটনার প্রভাব পড়াটাই তো খুব স্বাভাবিক। অর্থাৎ আমাদের অনেক কিছুর সম্ভাবনাময় একটা দিনের শুরু হচ্ছে নেতিবাচক একটা মানসিক বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রশ্ন হতে পারে, শুধু কি মধ্যবিত্তরাই দিন শুরু করেন? অন্যরা করেন না? তা হবে কেনো! দিন সবাই-ই শুরু করেন। তবে এখনো আমাদের সমাজের নৈতিক ও সামাজিক চেতনা, জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উৎসাহ, উদ্যোগ ও সংরক্ষণের দায়ভারটা প্রাকৃতিক বা সামাজিকভাবেই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিরই অধিকারে। যদিও রাজনৈতিক দর্শনের পরিভাষায় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়টিকে আদৌ শ্রেণি বলা যায় কি-না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। সে বিতর্কে না গিয়ে এখানে ভাষার মাধুর্য্য হিসেবেই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে ধরে নেই আমরা। প্রাকৃতিক নিয়মে দিন সবারই শুরু হয়। নিম্নবিত্ত বা একান্ত কর্মজীবী শ্রেণির সদস্যদের দিন শুরু হয় এক বিরক্তিকর কিন্তু অনিবার্য ক্ষুধা ও অভাবের চিরাচরিত উপলব্ধির মধ্য দিয়ে, যাকে শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে দৈনন্দিন প্রতিরোধ ও নিরসনের উপায়ের খোঁজেই স্বাগত জানাতে হয় তাঁদের। এই ক্ষুধা ও অভাবের কাছে পত্রিকার শিরোনাম বা গোটা পত্রিকাটিই আসলে তাঁদের জন্য এক অর্থহীন বাতুলতাই হয়তো।

অন্যদিকে উচ্চবিত্ত বা এদের কাছাকাছি পর্যায়ের উচ্চমধ্যবিত্ত জীবনযাত্রায় অভ্যস্তদের দিনের শুরুর হিসাবটাই হয়তো ভিন্ন। কেনো ভিন্ন, আপাতত সে ব্যবচ্ছেদে আলাদাভাবে যাওয়ার দরকার পড়বে না মনে হয়। কারণ এই দুর্নীতির প্রসঙ্গটা মূলত এই শ্রেণিটার সাথেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়ানো একটা বিষয়। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত দুর্নীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামাজিক অবস্থানটা কোথায়। এরা পেটেভাতের চিন্তায় কাহিল পর্যায়ের অভাবী কেউ বলে কি মনে হয়? এখানেই প্রশ্ন, তাহলে প্রতিনিয়ত এদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাবার কারণ কী? কেউ কেউ হয়তো বলবেন লোভ। তাহলেও পাল্টা প্রশ্ন আসবে, এই লোভের উৎস কী এবং কেনো? খুব সহজে এর উত্তর পাওয়া যাবে এমন আশা করাটা হয়তো ভুল হবে। কিন্তু বিভিন্ন আঙ্গিক ও দৃষ্টিকোণ থেকে এর কারণ খোঁজার চেষ্টাটা নিশ্চয়ই ভুল কিছু নয়।

 

২.
মানুষের জীবনে প্রত্যেকেরই যেমন কোনো না কোনো অভাব রয়েছে, তেমনি অভাববোধ বলেও একটা কথা আছে। এই অভাব আর অভাববোধ কি এক? এ দুটো আসলে কখনোই এক নয়। বিষয়টা বোঝার সুবিধার্থে এখানে আরেকটি সহায়ক প্রসঙ্গের উদাহরণ আনতে পারি। যেমন, আমাদের ভারতীয় দর্শনে বিশেষ করে প্রশস্তপাদের বৈশেষিক দর্শনে জগতের সমস্ত পদার্থকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে আছে ‘ভাবপদার্থ’ আর অন্যভাগে ‘অভাবপদার্থ’। বৈশেষিকদের এই মতের সাথে অবশ্য নৈয়ায়িকদেরও স্বীকৃতি থাকায় আমরা এটাকে ন্যায়-বৈশেষিক মতও বলতে পারি। আলোচনায় হঠাৎ এমন দর্শন সংশ্লিষ্টতা দেখে আবার কেউ ভাববেন না যেন, এই বুঝি দর্শনের ক্লাস শুরু হলো। মোটেও তা নয়। তবে বায়ুর সমুদ্রে ডুবে থেকে আমৃত্যু বাতাসের কথা ভুলে থাকা গেলেও আমাদের প্রতি মুহূর্তের বাস্তবতায় বাতাসের অনিবার্যতা অস্বীকারের যেমন কোনো উপায় নেই, তেমনি আমাদের জীবন-বাস্তবতার প্রতিটা মানসিক পদক্ষেপেই কিন্তু জান্তে বা অজান্তে দর্শনের একটা অবিচ্ছেদ্য প্রভাব আমাদের মধ্যে অবিরল কাজ করে যায়। আমরা চাইলেও এর বাইরে যেতে পারি না। বিজ্ঞানযুগের এই তুমুল সময়ে কেউ হয়তো আড়চোখে কথাটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন। সে প্রেক্ষিতে আমাদেরকে আবার পাল্টা প্রশ্ন করতে হবে, বিজ্ঞান আর দর্শনে কি আদৌ কোনো বিরোধ আছে?

আমরা গর্বের সাথে এটা স্বীকার করি যে, আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণাটা বহু প্রাচীন। কতোটুকু প্রাচীন তা নির্ণয়ের দায়ভাগ না হয় সমাজতাত্তি¡ক গবেষকদের ঘাড়েই থাকুক। আমরা বরং এটুকু জেনে আপাত তৃপ্ত থাকি যে, বর্তমানে বিজ্ঞানের চেহারাটা যে আঙ্গিকে দেখছি বা উপলব্ধি করছি, আজ থেকে আড়াই-তিন হাজার বছর আগে বর্তমানের এই চেহারাটা ধারণা করা কারো কল্পনায়ও সম্ভব ছিলো না। থাকবে কী করে! কল্পনারও একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে। আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাগুলো এই দুয়েকশ’ বছর আগেও মানুষের কল্পনার অগম্য ছিলো। আর দু-তিন হাজার বছর আগের মানুষের কল্পজগত কেমন ছিলো সেটা তো এখন আমাদেরই কল্পনার বিষয়! তাই সেকালের বিজ্ঞান বলতে আসলে তখনকার জ্ঞানের ধারাটাকেই বুঝতে হবে। সেই ধারাটা কী? জ্ঞান অন্বেষণের এক বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা, যাকে এখন আমরা দর্শন বা ফিলোসফি নামে চিনি।

মূলত দর্শন হলো জগতের তাবৎ ঘটনাবলীকে একটা কাল্পনিক কার্য-কারণের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যুক্তিনিষ্ঠতার মাধ্যমে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা। জগতের রহস্য উদ্ঘাটনের চলমান সেই প্রক্রিয়াকেই বলা হতো উপলব্ধি বা জ্ঞান। আর সেই জ্ঞান-সাধকদেরকে আমরা দার্শনিক নামে আখ্যায়িত করি। এখনকার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতো শাখা-উপশাখা আর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও উপকরণের জন্ম হয়নি তখনো। তাই তখনকার জ্ঞান অন্বেষণের একমাত্র মাধ্যমই ছিলো এই বিশ্বপ্রকৃতি আর তার প্রাকৃতিক রহস্য ও শৃঙ্খলাকে মানবচিন্তার জগতে যুক্তি-শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রকাশের বুদ্ধিবৃত্তিক তাড়না। এই তাড়না থেকেই পাগলাটে দার্শনিকেরা জগতের অদৃশ্য রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে তার চেয়েও রহস্যময় কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণার জন্ম দিয়েছেন! কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের বর্তমান হলো সেই অতীত চিন্তার ধারাবাহিকতারই অংশ মাত্র।
তাই আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানজগতকে আমরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেনো, এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, জ্ঞানের ধারাটা কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে, সেই অন্বেষণেরই ধারা। যদিও আমরা জানি না সেই কোন্ সুদূরকালে আমাদের কোন্ সে বহুদূরবর্তী পূর্ব-পুরুষের চিন্তায় প্রথম প্রশ্নটা এসেছিলো-এই জগত কিভাবে হলো, কী এর রহস্য ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুত প্রশ্নগুলো কারো না কারো মাথায় তো এসেছিলোই। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমাদের এই মানব সভ্যতা হাজার হাজার বছর অতিক্রম করে কখন যে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে গেছে, কিন্তু সেই অনুসন্ধান থামেনি এখনো। এটা থামার বিষয়ও নয়। একালের বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে হালের সাড়া জাগানো সার্ন গবেষণায় জগতের আদি কণা হিসেবে সম্ভাব্য হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব খোঁজা সেই প্রক্রিয়ারই সাম্প্রতিক নমুনা বলতে পারি। তাই এখন যাদেরকে আমরা বিজ্ঞানী নামে অভিহিত করি, মূলত তাঁরাও একেকজন দার্শনিকই। বিজ্ঞানের দার্শনিক। ফলে প্রাচীন ভারতীয় প্রশস্তপাদ কিংবা আলবেনীয় ডেমোক্রিটাস কিংবা প্রাচীন গ্রীসের সক্রেটিস বা জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিংবা বাঙালী পদার্থবিদ অধ্যাপক সত্যেন বোস কিংবা সাম্প্রতিকতম স্টিফেন হকিং বা পিটার হিগস প্রভৃতি জ্ঞান তাপসরা সবাই-ই একেকজন দার্শনিকই। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের সমকালীন জ্ঞানস্তরের যাবতীয় জ্ঞান-উপকরণকে ভিত্তি করে যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞান-শৃঙ্খলার মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে পরবর্তী জ্ঞানস্রোতে এগিয়ে দিয়েছেন। সভ্যতার এই চিরায়ত জ্ঞানস্রোতে তাই কাউকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই কারো। কেবল সময়ের ব্যবধান তাঁদের অস্তিত্বকে ভিন্ন করেছে শুধু।

প্রপিতামহের অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে যেমন নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হবে, তেমনি আমাদের প্রাচীন দার্শনিকদের অবদানকেও কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। সেকালের আর একালের জ্ঞানস্রোতের পার্থক্যটা কেবল গুণে, মানে ও অবস্থায় ভিন্ন, কিন্তু অন্বেষণের ভঙ্গিটা সেই একই, চিরায়ত জ্ঞানতৃষ্ণা বা রহস্য উদ্ঘাটন। সভ্যতার এমন এক চমৎকার অবস্থানে এসে আমাদের বর্তমান জীবনধারার উৎকর্ষ ও স্বচ্ছন্দ অস্তিত্বের জন্য অতীত ও বর্তমানের সকল জ্ঞানতাপসকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ না করাটা অকৃতজ্ঞতার সামিল হবে। পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানের সমস্ত সম্ভাবনা বা ধারণা যুক্তিনিষ্ঠ দর্শনতাত্তি¡ক ধারণার পর্যায়েই থেকে যায়। ফলে শুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় জ্ঞানের প্রাচীন বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসগুলোকে, যতো পুরনোই হোক, কখনোই এক ধাক্কায় বাতিলযোগ্য ভাবার সুযোগ নেই। আর তাই বিষয় বিশ্লেষণের যুক্তি নির্মাণে সেসব যুক্তিসঙ্গত ধারণার সহায়ক ব্যবহারে আমাদেরও কুণ্ঠা থাকার কথা নয়। অতএব কুণ্ঠাহীনভাবেই আমরা আমাদের আলোচনার সূত্রে ফিরে আসতে পারি।

 

৩.
দর্শনের ওই প্রাচীন জ্ঞানসূত্র মতে জগতের সমস্ত পদার্থকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে-ভাবপদার্থ ও অভাবপদার্থ। সে অনুযায়ী আমরা যা কিছু দেখছি শুনছি তার সবই ভাবপদার্থ। অর্থাৎ জগতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও উপলব্ধিজাত যতো পদার্থ আছে সবই এই ভাবপদার্থের মধ্যে পড়ে। এই মতে শব্দও একটা পদার্থ, কেননা আমরা তা কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্রাহ্য বা উপলব্ধি করছি। এবং সে কারণে আলোও একটি পদার্থ, যেহেতু তা দর্শনেন্দ্রিয়ের অর্থাৎ চক্ষুর মাধ্যমে জ্ঞাত হচ্ছি। একইভাবে ত্বক বা স্পর্শ দ্বারা বুঝতে পারছি যে বায়ুও পদার্থ। তাহলে ফুলের ঘ্রাণ আর রসগোল্লার স্বাদই বা বাদ যাবে কেন! ইট পাথর বই টেবিল ঘর গেরস্থালী এগুলোর কথা আর নাই বললাম। মোটকথা আমাদের জ্ঞান-গম্যির মধ্যে যা কিছু পড়ছে সবই এই ভাবপদার্থের মধ্যে পড়ে। সুন্দরী রমণী দেখে প্রেমিক পুরুষ কাতর হয়ে পড়ছেন, এই সৌন্দর্য্যকেও প্রাচীন দার্শনিকেরা পদার্থের বাইরে রাখছেন না। সৌন্দর্য্য, রঙ বা ঘ্রাণ এগুলোকে আমরা সাধারণ বিবেচনায় গুণ বলে জানি। কিন্তু দর্শনের দৃষ্টিতে এই গুণও পদার্থ এবং তা অবশ্যই ভাবপদার্থ।

আমাদের প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান পাঠে শব্দ ও আলোককে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় শক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছি আমরা। অথচ প্রাচীন দার্শনিকেরা এই শক্তিকেও দার্শনিক যুক্তি অনুষঙ্গ ব্যবহার করে ভাবপদার্থের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় যা কিছুই দেখছি তার সবই ভাবপদার্থের অংশ। তাহলে অভাবপদার্থটা কী? বর্তমান বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান কাঠামোয় বস্তু বা পদার্থের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ যে আঙ্গিকেই অবস্থান করুক, বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় অভাবপদার্থ বলে কিছুর অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু অপার বিস্ময়ে খেয়াল করি যে, সেই প্রাচীন দার্শনিকদের চিন্তায় কী করে এমন এক অভূতপূর্ব ধারণার জন্ম হলো! এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো জ্ঞানতাত্তি¡ক উদ্দেশ্য ছিলো। তবুও দর্শনচিন্তা যে কতো আকর্ষণীয় ও কৌতুহলোদ্দীপক হতে পারে, এই অভাবপদার্থের ধারণাটাই এর একটা মজার উদাহরণ। কী সেটা?
ন্যায়-বৈশেষিক মতে জ্ঞান কখনো নির্বিষয়ক হতে পারে না। অর্থাৎ বিষয়কে ভিত্তি করেই জ্ঞানের উন্মেষ। যেখানে বিষয় নেই সেখানে জ্ঞানও নেই। একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সামনে একটা বৃক্ষ নজরে আসা মানে ওখানে বৃক্ষের অস্তিত্ব বিষয়ক জ্ঞান বা উপলব্ধির জন্ম হওয়া। দেখা গেলো যে গাছের ডালে একটা পাখি বসে আছে। সাথে সাথে আমাদের জ্ঞানের বিষয় হিসেবে পাখিও চলে এলো। পাশে একটা ভাঙা কুঠার পড়ে আছে, অর্থাৎ কুঠার বিষয়ক জ্ঞানও সেই স্থানের অভিজ্ঞতার অংশ হলো। এভাবে একটা সুদৃশ্য বাড়ির প্রশস্ত আঙিনায় ঢুকে দেখা গেলো মনে গেঁথে যাওয়ার মতোই কী দারুণ একটা শানবাঁধানো দীঘি। চারপাশে বিচিত্র সব গাছপালা। দীঘির পাশেই মর্মর নির্মিত সাজানো বাড়িটার একটা ঘরে ঢুকে দেখা গেলো ঘরটির মধ্যে একপাশের দেয়াল জুড়ে বইভর্তি চমৎকার কয়েকটি বুকসেলফ। অন্যপাশে একটা সাজানো সুদৃশ্য টেবিল। আরেক পাশে দারুণ কারুকার্যময় একটা বক্স খাট। সোফাও রয়েছে গোটা দুয়েক। আরো হেনতেন বস্তুবিশেষ রয়েছে বেশ কিছু। উপরে একটা শিল্পমÐিত ঝাড়বাতি তার সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে ঘরটিকে যেন আলোকিত করে রেখেছে। দর্শনের দৃষ্টিতে এই ঘর এবং অস্তিত্ববান সবকিছুই ভাবপদার্থের অংশ। এভাবে জগতের যাবতীয় ভাবপদার্থের তালিকা করতে গেলে একজন ব্যক্তির পক্ষে খুব সঙ্গত কারণেই একটি মাত্র জীবনে তা সম্পন্ন করা কখনোই সম্ভব হবে না। যদি তা নাই হয়, তাহলে আর পÐশ্রমে কাজ কী! তারচেয়ে আমরা ফিরেই আসি।

সেখান থেকে বেরিয়ে ধরুন আরো কতো কতো বিচিত্র সব ভাবপদার্থের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে মসৃণ রাস্তা ধরে হাঁটছি। রাস্তার পাশে নান্দনিক দৃশ্য-পরিপূর্ণ বিরাট খালি জায়গাটা দেখে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে মনে একটা দুঃখবোধ জেগে উঠলো, ইশ্, যদি এই জায়গায় আমার সেরকম একটা বাড়ি হতো! কল্পনায় জেগে উঠলো কিছুক্ষণ আগের দেখে আসা সুদৃশ্য বাড়িটির স্মৃতি। কিন্তু এটা তো কল্পনাই। বাস্তবে জায়গাটা খালিই। কেনো খালি? কারণ জায়গাটাতে সেই বাড়িটির অভাব রয়েছে অর্থাৎ এখানে বাড়িটির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। বুদ্ধিমান পাঠকের মনে একটা তীর্যক প্রশ্ন এসে যাবে নিশ্চয়ই, কারণ যাবার সময়ও তো এই জায়গাটি খালিই ছিলো। এখন ফিরে আসার সময় কেনো জায়গাটিতে সেই বাড়ির অভাব অনুভূত হচ্ছে? যাবার সময় কেনো তা অনুভূত হয় নি? আসলে প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর নিহিত। কারণ যাবার সময় সেই বাড়িটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের উদয় হয়নি, কেননা তখনও বাড়িটি আমাদের জ্ঞানের বিষয় হয়নি। আগেই বলা হয়েছে জ্ঞান নির্বিষয়ক হয় না। যখনই ভাবপদার্থ হিসেবে বাড়িটি আমাদের জ্ঞানের বিষয় হয়েছে, এরপরই অন্যত্র সেই বাড়ির একটা অভাববোধক জ্ঞানও আমাদের উপলব্ধির বিষয় হয়ে গেছে। দর্শনের ভাষায় এটাকেই বলে অভাবপদার্থ।

নিজের ঘরে ফিরে দেয়ালের পাশে সেই দেখে আসা চমৎকার গুটিকয় বুকসেলফের অভাববোধক জ্ঞানের সম্মুখীন হবো। অর্থাৎ নিজের ঘরে একটা বুকসেলফ বিষয়ক অভাবপদার্থের অস্তিত্ব টের পাবো। ঘাঁড় বাকিয়ে উপরে তাকাতেই একটা ঝাড়বাতি নেই বিষয়ক অভাবপদার্থের জ্ঞান হবে। এরকম আরো অভাবপদার্থের জ্ঞান হয়তো হতে থাকবে যা ইতোপূর্বে আমাদের জ্ঞানের বিষয় হয়েছে। কিন্তু কোনক্রমেই তখন মেঝেতে সর্প নেই বা ভাঙা কাচ নেই জাতীয় কোন অভাবপদার্থের জ্ঞান হবে না, কারণ জ্ঞানের বিষয় হিসেবে মেঝেতে সর্প আছে বা ভাঙা কাচ আছে জাতীয় কোন বিষয় আমাদের জ্ঞান বা উপলব্ধিতে ছিলো না বা সে মুহূর্তে নেই। যে বিষয়টির অস্তিত্ব বিষয়ক জ্ঞান আমাদের হয় নি, সে বিষয়ের অভাব বিষয়ক জ্ঞানও আমাদের হয় না। দর্শনের ভাষায় অভাব হচ্ছে ভাব ভিন্ন পদার্থ। ‘টেবিলে কলমটি আছে’ এরকম যেমন আমাদের ভাববস্তুর জ্ঞান হয়, তেমনি ‘টেবিলে কলমটি নেই’ এরকম আমাদের অভাবপদার্থের জ্ঞান হয়। দার্শনিকদের মতে জ্ঞান যেহেতু কখনো নির্বিষয়ক হয় না, তাই ভাবপদার্থ হলো সদর্থক জ্ঞানের বিষয়। আর দর্শন মানলে ভাববোধক সদর্থক জ্ঞানের বিষয়ের মতো বিপরীতক্রমে নঞর্থক জ্ঞানের বিষয়ও স্বীকার করতে হয়। সেক্ষেত্রে অভাব হলো নঞর্থক জ্ঞানের বিষয়। আছে জাতীয় বিষয় হচ্ছে ভাববোধক সদর্থক জ্ঞান, আর নাই জাতীয় বিষয় হচ্ছে অভাববোধক নঞর্থক জ্ঞান। অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে বিষয়ের সম্পর্কটি অবিচ্ছেদ্য, এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এপর্যায়ে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটলে খুব প্রাসঙ্গিক হিসেবে খুব ছোট্ট একটা গল্পের উদাহরণ টানি। এতে করে এই অভাবপদার্থ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে আশা করি। গল্পটি যখন আমি শুনি তখনও এই দর্শনগত অভাবপদার্থ বিষয়ক জ্ঞানটি আমার অভাবপদার্থে ছিলো না, কারণ তখনও ভাবপদার্থ হিসেবে এই দর্শনজ্ঞান আমার অভিজ্ঞতায় ছিলো না। গল্পটার সাথে এই অভাবপদার্থ বিষয়ক জ্ঞানই শুধু নয়, মানুষের মনোজাগতিক বিষয়ের ভয়ংকর সংশ্লিষ্টতা দেখেও গল্পস্রষ্টার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না। একেবারেই ছোট্ট গল্প, অণুগল্প বলা যায়। গ্যারান্টি দিয়ে সর্বরোগ সারানোর নিশ্চয়তাদানকারী এক নামফাটানো কবিরাজের কাছে সব ঘাট মেরে আসা মুমূর্ষু এক রোগীকে বয়ে নিয়ে এলো তার পরিজনেরা শেষ চেষ্টা হিসেবে। সঙ্গত কারণে কবিরাজের ভিজিটও বেশি। কেননা, রোগী যত মুমূর্ষু ভিজিট তত বেশি। রোগী দেখে কবিরাজ যা বললেন তা শুনে সবাই হতবাক, তাঁর চিকিৎসায় এক সপ্তার মধ্যেই রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে প্রাণবন্ত যুবকের মতো নাচতে নাচতে এখানে আসবে! মরণাপন্ন রোগীকে একমাত্র দাওয়াই হিসেবে দেয়া হলো একটি রহস্যময় তাবিজ। সেবনের নিয়মও অত্যন্ত সোজা। এক গ্লাস পানি নিয়ে তাতে তাবিজটিকে তিনবার চুবিয়ে পানিটুকু পান করবে সকাল বিকাল। তবে শর্ত একটিই, যা কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। শর্তের বিন্দুমাত্র হেরফের হলেই তাবিজের গুণ নষ্ট হয়ে রোগসারানোর ক্ষমতাশূন্য হয়ে যাবে। তবে শর্তটিও কঠিন কিছুই নয়, কেবল পানিতে তাবিজ চুবানোর সময় কিছুতেই কোনো বানরের কথা মনে আনা যাবে না। গাছ পাথর ইট পক্ষী গরু শিয়াল হাড়ি পাতিল যা ইচ্ছে মনে হোক কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বানরের কথা মনে হওয়া চলবে না। এ আর এমন কী! রোগীর পরিজন এমন ধন্বন্তরী ওঝার চিকিৎসায় ভালো হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে চলে যাবার সময় আবারও কবিরাজের সহকারী ভালো করে খেয়াল করিয়ে দিলেন শর্তটির গুরুত্বের কথা। কেননা বানরই হচ্ছে এই তাবিজের একমাত্র গুণহরণকারী। সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে রোগী কবিরাজের কথা যথাসাধ্য মান্য করার তাগিদে কবিরাজের উপদেশ সারাক্ষণ মাথার মধ্যে রাখলেন যাতে ভুল না হয়ে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! যখনই পানি সেবনের জন্য তাবিজ পানিতে চুবান, ঠিক তখনই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে বানরের চেহারা! যতই ভুলতে চান ততই বেশি করে বানরের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় কবিরাজের আর দোষ কী! তিনি তো বারবার সাবধান করেই দিয়েছিলেন। অবশেষে রোগের সাথে উন্মাদনা যুক্ত হয়ে রোগীর এক সপ্তাও পেরোলো না। চারদিকে ফের কবিরাজের আরো সুনাম ছড়িয়ে পড়লো, দেখেছো কবিরাজের সাবধানবাণী না মানার কী পরিণাম!

বিষয় থাকলেই যে কেবল জ্ঞান বা উপলব্ধির প্রশ্ন আসে, সেটি আমরা চাইলে পরীক্ষাও করে নিতে পারি। কিভাবে? পরীক্ষাটা অত্যন্ত সহজ এবং কৌতুহলোদ্দীপকও। কোনো ব্যক্তিকে বলা হলো, আপনার কী কী নেই তার একটি তালিকা বানান। দেখা যাবে, যে বস্তুটি ওই ব্যক্তির পূর্ব অভিজ্ঞতায় বা জ্ঞানের মধ্যে কোনোভাবে আসেনি কখনো, সেটি তাঁর তালিকায়ও আসবে না। আসার সম্ভাবনাও নেই। ধরা যাক ‘ই-বুক রিডার’ নামে যে একটি বস্তু আছে তা যিনি জানেনই না বা তাঁর জ্ঞানের বিষয় হিসেবে ভাবপদার্থের মধ্যেই আসেনি কখনো, তিনি এর অভাব বুঝবেন কী করে? ফলে তাঁর জ্ঞানের বিষয়ে এই অভাবপদার্থটিও নেই। এভাবে কয়েকজন ব্যক্তির উপর এই পরীক্ষাটি চালালে একেকজনের নেই-বিষয়ক অভাবের তালিকা যে একেকরকম হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং তা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখাবে। এই ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল জগতের প্রতিটা ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং তা প্রতিটি ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানাবস্থারই পরিচায়ক। বিষয়ভিত্তিক যুক্তির পরিক্রমায় সংশ্লিষ্ট দার্শনিকেরা তাই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যে বস্তুটি আছে বলে জ্ঞান হচ্ছে সেটি ভাবপদার্থ। অন্যদিকে যে বস্তুটি নেই বলে জ্ঞান হচ্ছে সেটি অভাবপদার্থ। এবং অভাবপদার্থের জ্ঞান সর্বদা ভাবপদার্থের জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল। যে বস্তুর বা ভাবপদার্থের অস্তিত্ববিষয়ক সদর্থক জ্ঞান হবে না, সেই বস্তুর অভাববিষয়ক নঞর্থক জ্ঞান হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে এসে অভাবপদার্থ নামক এই অদ্ভুত দার্শনিক প্রপঞ্চের বস্তুগত অবাস্তবতা আমাদের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিতে যতোই আজগুবী মনে হোক না কেনো, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটিকে যদি এই দৃশ্যমান বস্তুজগত অতিক্রম করে মানুষের অদৃশ্য মনোজগতের এক রহস্যময় জটিলতায় নিবদ্ধ করে নেয়া যায়, তাহলে এই অভাবপদার্থের ধারণাটিই আরেক ভিন্নমাত্রিক উপযোগিতা নিয়ে হাজির হয়ে যায় আমাদের সামনে। এ নিবন্ধের উদ্দেশ্যও মূলত তা-ই এবং সেটাই আমাদের আলোচনারও মূল বিষয়। বিষয়টির আর কিছু না, অভাব ও অভাববোধ। এই অভাব ও অভাববোধের মধ্যকার যে সম্পর্ক ও ভিন্নতা, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজের বহমান সর্বগ্রাসী জটিলতার নিয়ন্ত্রণকারী মনোজাগতিক কারণ ও এর প্রভাবটুকু। দুর্নীতি তো এই সর্বগ্রাসী জটিলতার একটি প্রপঞ্চ মাত্র।

 

৪.
আমরা যদি আমাদের স্বাভাবিক যুক্তিবোধটুকুই ব্যবহার করতে পারি তাহলেও দেখবো যে, আমাদের বাস্তব জীবনে অভাব আর অভাববোধ আসলে এক নয়। অভাব বলতে কী বুঝি? এর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে না পারলেও অভাব বলতে আমরা সেই ঘাটতিকে বুঝি, যে ঘাটতির কারণে ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে মৌলিক ও যুক্তিসঙ্গত আনুষঙ্গিক চাহিদাগুলো পরিপূর্ণ হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা-এই পাঁচটিকে আমরা মৌলিক চাহিদা হিসেবে জানি। আসলে এই পাঁচটি উপাদান একজন মানুষ নামক প্রাণীর কেবলমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বনই হতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। যদিও আমাদের দেশে এই অনিবার্য পাঁচটি উপাদানের অভাবগ্রস্থ জনসংখ্যার পরিমাণও বিশাল। তবুও একজন বুদ্ধিবৃত্তিধারী ব্যক্তিমানুষের যুক্তিসঙ্গত চাহিদা এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। যেমন এই পাঁচটি উপাদান প্রাপ্তির নিশ্চয়তার জন্যে একজন মানুষের যে কর্মসংস্থানের আবশ্যকতা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। আবার যেহেতু ব্যক্তিটি রক্ত-মাংসে তৈরি একজন চেতনাসম্পন্ন মানুষ, অতএব তার জৈবিক চাহিদা পূরণেরও অধিকার রয়েছে। এজন্যে তাকে পরিবার নামক একটি সামাজিক সংগঠনের সদস্য হতে হয় বিয়ের মাধ্যমে। এছাড়া রয়েছে বিনোদন ও প্রণোদনা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। এগুলো তার যুক্তিসঙ্গত আনুষঙ্গিক চাহিদা। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই চাহিদার পরিমাণও বাড়তে থাকে। যেহেতু প্রত্যেকেই চায় অভাবমুক্ত একটা চমৎকার বাসযোগ্য জীবন যাপন করতে, সেক্ষেত্রে তার আনুষঙ্গিক চাহিদার পরিমাণ বেড়ে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু চাহিদা যতোই বাড়–ক, তারও একটা যৌক্তিক সীমা রয়েছে। এই যৌক্তিক সীমা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান প্রাপ্তির ঘাটতি ওই ব্যক্তির জন্য অভাব হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। অর্থাৎ অভাবকে আমরা যৌক্তিক প্রয়োজন হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।

কিন্তু ব্যক্তির চাহিদা যখন যৌক্তিক সীমা লঙ্ঘন করে? একজন ব্যক্তির বাৎসরিক যেটুকু খাবারের প্রয়োজন তার দশগুণ চাহিদা নিশ্চয়ই যৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে না। হতে পারে তাত্তি¡কভাবে সারাজীবনে তার যে খাবারের যোগান দরকার ছিলো আগাম নিরাপত্তার বিবেচনায় তা আগেভাগে নিশ্চিত করা হলো। এরপরও যদি তার অতিরিক্ত যোগানের চাহিদা থেকে যায় সেটা কি যৌক্তিক সীমা লঙ্ঘন নয়? বর্তমান সমাজে একজন ব্যক্তির বসবাসের জন্য কতোগুলো বাড়ি, ফ্ল্যাট, জায়গা-জমির দরকার হয়? বাহুল্য প্রয়োজনেরও একটা যুক্তিসঙ্গত সীমা থাকে। তারপরও মানুষ যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদার নেশায় আক্রান্ত হয় সেটাকে আর অভাব পদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা সেটা অভাব নয়, এটা হচ্ছে অভাববোধ। যুক্তি হারিয়ে ফেললে এই অভাববোধের তাড়না সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। অভাব সীমিত, কিন্তু অভাববোধ ক্রমবর্ধমান ও অসীম। তাহলে এই অভাববোধের ব্যাখ্যা কী? তা বিশ্লেষণের জন্যেই আসলে ইতোপূর্বে আলোচিত দর্শন-উপাত্ত হিসেবে সেই অভাবপদার্থের ধারণাটির প্রয়োজন স্বীকার করা হয়েছে।

ইদানিং আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়ায় নানান রকমের বিজ্ঞাপনচিত্র দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আসলে কী করা হয়? নতুন নতুন প্রয়োজন সৃষ্টি করার মাধ্যমে ভোক্তা তৈরির চেষ্টা করা হয়। প্রয়োজন মানে চাহিদা। যেমন আমাদের সংস্কৃতিতে শিল-পাটা-নূড়ি দিয়ে হালকা কোনো মশলা গুঁড়ো করা বা শরবত বানানোর প্রথাগত প্রক্রিয়ায় আমাদের মাসি-পিসিরা অভ্যস্ত ছিলেন সবসময়। একদিন কোনো এক বিজ্ঞাপনচিত্রে এমন একটা যন্ত্র দেখানো হলো যেখানে মুহূর্তের মধ্যেই কী সুন্দর করে মশলাগুলো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে বা কয়েকটা ফলের টুকরো আর পানি ওটাতে ছেড়ে দিয়ে সুইচ টিপতেই ঘরর ঘরর দুয়েকটা শব্দ করেই পরিবেশনযোগ্য শরবত তৈরি হয়ে গেলো। প্রায় পরিশ্রমহীন প্রক্রিয়ায় সময় সাশ্রয়ী এই যন্ত্রটির নাম নাকি বেøন্ডার! যেহেতু এর আগে এই বেøন্ডার বস্তুটি আমরা দেখিনি তাই এই বিজ্ঞাপনচিত্র দেখার আগ পর্যন্ত এটি আমাদের জ্ঞানের বিষয় ছিলো না। এরকম একটি বস্তুর আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে সেটাই জানতাম না। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি বেøন্ডার নামক একটি ভাবপদার্থ আমাদের জ্ঞানের বিষয় করে ফেলায় আমাদের ঘরে বেøন্ডার নেই জাতীয় অভাবপদার্থ বিষয়ক একটা জ্ঞানেরও সৃষ্টি হয়ে গেলো।

এরপর একদিন বাড়িতে ফের শরবত বানানোর সময় এবার প্রক্রিয়াটাকে একটু ঝামেলাপূর্ণই মনে হলো। কেননা আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞায় বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখানো বেøন্ডারের স্মৃতিটা তৈরি আছে বলে তুলনামূলক বিচারে সেই অভাববস্তুটিকে অধিকতর সুবিধাজনক মনে হতে লাগলো। এবং আমাদের ভাবনার অভ্যস্ততায় ক্রমেই বিষয়টি এরকম প্রয়োজনের আকার ধারণ করতে লাগলো যে, ইশ্, যদি একটা বেøন্ডার থাকতো! আর তখনই মনের মধ্যে একটা বেøন্ডারের অভাববোধ দানা বেঁধে উঠলো। একটা বেøন্ডারের অধিকারী না হলেও যেহেতু আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে তেমন কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে না অর্থাৎ জীবন-যাপনের জন্য একটি বেøন্ডার তেমন অপরিহার্য কিছু নয়, তাই বেøন্ডার না-থাকাকে আমরা অভাব বলতে পারি না। কিন্তু সংগ্রহের মাধ্যমে একটি বেøন্ডারের অভাববোধ নিরসন করা গেলে হয়তো এটি জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কিছুটা অবদান রাখতে পারতো এরকম আকাক্সক্ষা থেকে আমরা একটি বেøন্ডার সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে ওঠি। আমরা এটাকে আকাক্সক্ষা নামেও চিহ্নিত করতে পারি। অর্থাৎ অভাব হলো যৌক্তিক চাহিদার অপরিহার্যতা, আর অভাববোধ হলো পাওয়ার আকাক্সক্ষা। আকাক্সক্ষা পূরণ না হলে জীবনযাত্রা থেমে যায় না বা বাধাগ্রস্ত হয় না। মানে আকাক্সক্ষা অপরিহার্য নয়।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যক্তিমানুষের কি আকাক্সক্ষা থাকতে নেই? মানুষ যেহেতু স্বাধীন সত্তাবিশিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী, তার স্বাধীন আকাক্সক্ষা থাকতেই পারে। তবে তারও একটি যৌক্তিক সীমা থাকা চাই। ঘরে সুন্দরী ও সক্ষম স্ত্রী রেখে অন্যত্র সুন্দরী রমণী দেখলেই পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী মানসিকতায় তাকে যেকোন মূল্যে অধিকার করতেই হবে এরকম অপরিহার্য আকাক্সক্ষা শুধু যৌক্তিক সীমালঙ্ঘনই নয়, অমানবিক অপরাধও। সীমাহীনতা আদতে কোন সীমা নয়। গোল বাঁধে তখনই যখন আমাদের সীমাহীন আকাক্সক্ষা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ অভাববোধ-কে অভাব বানিয়ে ফেললেই সমস্যার সূত্রপাত। প্রকৃত অর্থে অভাব স্ব-সৃষ্ট নয় এবং সীমিত বলে তা পূরণের লক্ষ্যে মানবমনে একটা যৌক্তিক উদ্যম কার্যকর থাকে। বৈধ প্রক্রিয়ায় একসময় হয়তো তাতে একধরনের সাফল্য ও অভাবজয়ের তৃপ্তিও আসে। অন্যদিকে ভাববস্তুর জ্ঞান থেকে অভাববস্তুর আকাক্সক্ষা সৃষ্ট হয় বলে এই অভাববোধ মানুষের স্ব-সৃষ্ট এবং তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তেই থাকে। এবং এই অভাববোধ-কে অভাবের পর্যায়ে নিয়ে গেলে তা ক্রমেই যুক্তিসীমা ছাড়িয়ে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। কেননা এই অভাববোধ একটি বেøন্ডার না হয়ে তা হতে পারে গাড়ি, বাড়ি, জায়গা-জমি, মিল-ইন্ডাস্ট্রি, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি অনেককিছুই। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ আয়ের সাথে ব্যয়ের সাযুজ্য রেখে কোন ব্যক্তির পক্ষেই তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে অস্বাভাবিক উপায়ের অনৈতিক রাস্তাগুলো একে একে আবিষ্কৃত হতে থাকে, যাকে আমরা দুর্নীতি নামে আখ্যায়িত করে থাকি। একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে এই প্রবণতা যদি অসুস্থ প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে অনেকের মধ্যেই ক্রিয়াশীল হয় তখনই শুরু হয় সামাজিক অস্থিরতা আর ভারসাম্যহীনতা। তখন আর কোনো নিয়ম-নীতির বালাই থাকে না সমাজে। এই অসুস্থ প্রতিযোগীতাই যদি সমাজে মানুষের যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে যায় তখন আরেকটি বিপত্তি দেখা দেয় বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে। প্রতিযোগীতায় সমর্থ মানুষগুলো যে-কোন-মূল্যে জয়ের জন্য হয়ে যায় অপরাধপ্রবণ, আর প্রতিযোগিতায় অনাগ্রহী কিংবা ছিটকে পড়া মানুষগুলো পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক কারণে পতিত হয় হীনম্মন্যতার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এই সমাজ বা রাষ্ট্র তখন আর মানুষের অপার সম্ভাবনার সৌন্দর্য্যকে ধরে রাখতে পারে না।

শেয়ার করুন: