004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

অসিত বিশ্বাস’র গল্প

উত্তরসূরি

এক অরণ্যে এক আলো-আঁধারে আম জাম হরিতকি কত কি বৃক্ষের জড়াড়ড়ি করে বসত। কারো মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই। একগ্রামে গফুর সলেমান নিমাই রাজেন ভরতসহ আত্মজ-আত্মজায় একপাল মানুষের বাস। এরা এক ঘাটের জল খায়, একঘাটে সিনান করে, একরোদ, এক আঁধার, একঝড়, একবৃষ্টি, এক জোসনা গায়ে মাখে। এক মাঠের ফসল খায়। এক সড়কে চলে, এক দাওয়ায় বসে সুখ দুঃখ হাসি কান্নার গল্প করে। অথচ…

গ্রামখানা রুগ্ণ রমণির মতো নদির ধার ঘেষে। গ্রামের তিন ধার ঘিরে মাঠ, হাট, অরণ্য। অরণ্য ধারে প্রায় শতবর্ষি বিদ্যাপিঠ। এই বিদ্যাপিঠ থেকে গফুর ও বলাই গলাগালি ধরে স্নাতক ডিঙিয়েছে। গফুর এখন পোস্টমাস্টার, বলাই কৃষক। গফুরের স্ত্রি মাধ্যমিক শিক্ষিকা এবং নিজেকে জাতির চাবিকাঠি বলে দাবি করে সর্বক্ষণ ঘষামাজা শরীরে-পোশাকে থাকে। বলাইয়ের স্ত্রি কৃষাণি, খেত-মাঠের ফসল উড়োয়-ঝাড়ে, গা-মাথায় ময়লা মাটিতে থাকে।

বলাই ও গফুরের উঠোনের মাঝে বিঘেখানেক জমিও নয়, দুটো পরিবার যেন এক। বারো সন আগে বিয়ে করে বলাই এক আত্মজা শেফালির জনক। গফুর তেরসনে তিন তনয়া ও এক তনয়ের আব্বু। বলাইয়ের কন্যা ও গফুরের তনয়া এক বয়সি, একজোড়। দুটিতে একবৃন্তে দুই ফুলের মতো হেসে খেলে নেচে বেড়ায়, শিক্ষালয়ে যায়। এছাড়া বলাই-তনয়া শেফালি গৃহশিক্ষকের কাছে সংগিত শেখে। গফুরকন্যা বিলকিসও শিখতে চায় কিন্তু বাপ-মায়ের অনুমতি মেলে না। তারপরও কখনো কখনো শেফালির সাথে কণ্ঠ মেলায়। যা শুনে মায়ের কলিজা খচমচ করে এবং চোখ ধারালো খোন্তা কোদাল করে মেয়ের প্রতি তাকায়। মেয়ে তখন ভেজা ইঁদুরের মতো চুপ।

শেফালি গান গায় এবং এক সকাল-সন্ধ্যা কণ্ঠ না সাধলে মা ক্রোধে তেরিয়া হয়ে ওঠে।
সব হাতে-কোছে তথ্য প্রযুক্তির জয়োগান
আর অন্তরে বিষবৃক্ষের কলোতান
ট্যারা কাশু বলে

ট্যারা কাশু আরো কয়, যেন নেচে নেচে কয়, আজ লেখাপড়া শিক্ষার অভাব নেই, তয় শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব। এই জনসমুদ্রে শত ডুবুরি নামালে দু’চারজন শিক্ষিত হয়তো মিলবে।

এ শুনে উঁচু সার্টিফিকেটধারিরা জ্বলে, পোড়ে। কেউ কেউ কাশুর পরে তেড়েও আসে। কাশু তখন হাসে। হাসে আর কয়, আমরা ছাওয়াল মেয়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বাবু সায়েব বানাই, শিক্ষিত করিনে। করতি চাইওনে। এ শুনে অন্যরা বলে, শোনো, ছাগলের কথা শোনো। এ সময় কাশু আরো হাসে। কাশু যত হাসে তত ওদের অন্তর চিতাগুনের মতো জ্বলে, পোড়ে, আর তিড়িং বিড়িং করে লাফায়। তারপরও কাশু হাসে। পরম তৃপ্তিতে হাসে। যেমন বানরনাচ দেখে অন্যরা হাসে।

শেফালি সংগিতের পাশাপাশি নৃত্যের তালিম নিতে শুরু করলো। এই নৃত্য শিখতে শেফালির যত-না ইচ্ছে, নৃত শেখাতে তার অধিক ইচ্ছে শেফালির মা-বাবার।

এখন নিয়মিত নৃত্যের তালিম নেয় শেফালি। এ দেখে বিলকিসের গভিরেও ঢেউ খেলে, সে নৃত্য শিখতে চায়। শেফালি একা একা নাচের মুদ্রা অভ্যাস করে। বিলকিস বসে বসে তা দেখে। দেখতে দেখতে সে-ও ওই মুদ্রার মধ্যে ডুবে যায়।
আজ শান্ত-সবুজ বিকেল, বিলকিস তার ঘরে একা একা নৃত্য অভ্যাস করছে। মা স্কুল থেকে ফিরে ছোটছেলের মুখে মেয়ের নাচের কথা শুনে ঘরপোড়া আগুনের মতো জ্বলে উঠে মেয়ের চুলের মুঠি ধরে পেটায়, শেষে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে বাঘিনির মতো হাঁফায়, আর মুখে যা আসে বলে চলে। এক প্রতিবেশি প্রতিবাদ করলে বলে, মেয়ে যে দোজকে নেমে যাচ্ছে এ খবর কেউ রাখে! প্রতিবেশি চুপ। এরপর সন্ধ্যা গড়িয়ে গফুর বাইরে থেকে ঘরে ফিরলে বউ যা শোনায়, গফুর তা চুপচাপ শুনে শুধু ছোট্ট স্বরে একবার বলে, সারা জাহানটাই এখন এই-গোনায় গিলে নিচ্ছে।
বউ হাঁকে, তা যদি বোঝো তা নিজের ঘর সামলাও।

গফুর এখন মেয়েকে পাক-নাপাক অনেক কিছু বোঝায়, শেখায়। আর চলাফেরা ও খাওয়ার কিছু গণ্ডি দেয়। মেয়ে একপিণ্ড মাংসের মতো বসে বসে তা শোনে।
চারিদিকে এখন লেখাপড়া আর লেখাপড়া। কত লেখাপড়ারে-! তিল, তাল ও লাকড়ির চেয়েও লেখাপড়া এখন বেশি। ফলে লক্ষ লক্ষ মুখের রব-
দিন যত গড়ছে মানুষ তত
আলোকিত হচ্ছে, আলোকিত
হতে হতে চাঁদের পানে ছুটছে।

যে হেগে ছোচে না, সে মুখেও এখন এই কথা।
এ শুনে আবুল খাঁ (যাকে সবাই আবাল কয়!) বলে, চাঁদ না, চাঁদনির পানে ছুটছে সবাই। একখানা চাঁদনি হাতে পেলেই হুররে-সামনে-পিছে কোনদিকে ছুটছে তা মালুম করার ফুসরতও থাকে না।

লেখাপড়া ও নাচ-গানের পাশাপাশি শেফালি এখন নকশি সেলাই-ফোঁড়াই শেখে, ছবি আঁকে। মা-বাবার তত্ত¡াবধানে শেখে, আঁকে। আর পাড়াময় ময়ূরির মতো নেচে বেড়ায়। বিলকিস পাড়ভাঙা নদির মতো চুপচাপ চেয়ে চেয়ে এ দেখে। আর আপন গভিরের সবুজ লতাগুলো দুমড়ে-মুচরে ছেঁড়ে। এ সময় বিলকিসের প্রতি তাকালে এর চোখ-মুখ ভাঙা বাঁশির মতো দেখায়।
শেফালি এখন মাঝে মাঝেই চঞ্চলা পায়ে এসে বিলকিসকে বলে, চল ঘুরে আসি। কখনো কয়, আয় গল্প করি।
বিলকিস এ সময় ভাঙা মালাইয়ের মতো মুখ করে শেফালির প্রতি তাকিয়ে থাকে শুধু-।

আজ পৌষ সংক্রান্তি। হিন্দু ঘরে ঘরে বাস্তু পুজো।

সকালের নিয়মিত গৃহকর্ম সেরে শেফালির মা উঠোন লেপে। মাঝ উঠোনে কুমির, কচ্ছপ, সাপ, কাঁকড়া, গিরগিটির বিগ্রহ তৈরি করে মাটি দিয়ে। দুপুরে পুজো। পুজো শেষে পুজোর মঙ্গলঘট সন্ধ্যায় ঘরে যাবে। ঘট যে পথে ঘরে তুলবে উঠোন থেকে সেই ঘর পর্যন্ত গোলানো পিটুলিতে আল্পনা আঁকবে। গরু, বাছুর, কৃষক, রাখাল, লাঙল, জোয়াল, দা, কাঁচি, খোন্তা, কোদাল, গাছ, পাতা, নদি, লক্ষ্নী, নারায়ণ কত কি আল্পনা করবে।
মা শেফালিকে বলে, আল্পনা দিতে হবে।
শেফালি খুশিতে আটখানা হয়।
আল্পনা এদের শেখাতে হয় না। এ এদের রক্তের অণু-পরমাণুতে জড়ানো। দিদি, ঠাকুমা, মা, মাসি, পিসি, কাকিমা, জ্যাঠাইমাদের দেখে দেখে শেখা হয়ে যায়। এরা গোলানো পিটুলিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে সেই ভেজানো রসে মাঝ আঙুলের টানে টানে গাছ, গরু, রাখাল, নদি কত কি ছবি ফুটিয়ে তোলে। এ সময় এই রেখা যেমন বিস্ময়কর দেখায়, তেমনি গভির নিমগ্ন দেখায় রেখাটানা ওয়ালিকে।

কিশোরি বিকেল। শেফালির পড়ার ঘরে বিলকিস ও শেফালি কথা বলাবলি করছে। মা শেফালিকে আল্পনা দিতে বলে। এ শুনে শেফালি যেন নেচে ওঠে এবং বিলকিসকে বলে, চল আল্পনা দেই। বিলকিসের গভিরে এখন তার মা ও বাবার মুখখানা ভেসে ওঠে। সে কিছুই বলে না।

শেফালি পিটুলি গোলায়, আল্পনা দিতে বসে। বিলকিস পাশে দাঁড়ায়। কোমলাঙুলের সংক্ষিপ্ত টানেটানে ছবি ফুটে উঠতে শুরু করলে গভির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বিলকিস যেন এক ঝাঁকা খেয়ে-ঘনপায়ে আপন ঘরমুখো পা বাড়ায়। শেফালি ডাকে, বিলকিস শোন। বিলকিস এদিকে ফিরেও তাকায় না। সোজা হাঁটে আর তার গভিরের সবুজ বৃক্ষটির লকলকে ডালপালা

মড়মড় করে ভাঙে। যা তার মা দাদি খালা ফুফুরাও ভেঙেছে।

সূর্য এখন বুড়িবৃক্ষের মতো পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। এই ম্রিয়মাণ মুহূর্তে নরম হাতের কোমল রেখায় রেখায় উঠোনজুড়ে ফুটে উঠছে অনাবিল মনের মাধুরি।

 

যে গল্পটি নোনাজলে তলিয়ে গেল

নদি মাঠ ক্ষেত অরণ্য গাছপালা গিলতে গিলতে এখন বাগদিপাড়া ধরেছে, সাপ বাঘ কুমিরের মতো সব গিলছে। হচা-পচা ডোবা-নালা খানা-খন্দও এই হা-মুখের থেকে রেহাই নেই। মুখখানা শহরের। সব চুরমার করে গিলে চলেছে। যত গিলছে তত এর মুখ, বুক, পেট প্রসারিত হচ্ছে। এই প্রসারে একদল মুখ কোঁছের নুনু বুকে তুলে খুশিতে নেচে-কুঁদে ফিরছে। আরেকদল সব হারিয়ে ¯্রােতের শ্যাওলা হয়ে ভাসছে। এদের দেহশক্তি খুচরো বাদামভাজার মতো লুট করে অন্যরা বোগল বাজাচ্ছে। শুধু লুটই করছে না, খুনও করছে।

এটা বাগদিপাড়া। শতাধিক বাগদির বসত। এদের পূর্ব-পুরুষ কবে কখন এখানে বসত গেড়েছে তা এদের বোধের বাইরে। এরা এত্ত কাজ করে খায়, পরে। কমবেশি খাওয়া-পরায় এদের কোনো আহা-উহু নেই। কিছু জুটলেই এদের পেট শিতল। ঘরদোর বিষয়েও এদের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, শরীর স্বাস্থ্যও অগোছালো, মন কাঁচা লতার মতো। এই সুযোগ গ্রহণ করে দুজন প্রভাষক, যারা-নিজেদের প্রফেসর বলে। বলে, আমরা জাতির চাবিকাঠি। এরা অল্প অর্থে এদের কয়েক শতক জমি দখলে নেয়। যা দেখে প্রৌঢ় নাথু বাগদি প্রথমদিনই চোখ কুচিমুচি করে বলেছিল, একি হলোরে! খাল কেটে কুমির আনা হলো। এ পাড়ার কেউ সেদিন একথায় কান করেনি। নাথু বাগদি আবার বলে, একদিন এই কুমিরই এপাড়া খায়ে কয়োমাল করে ছাড়বি। এরপর আরো দু’জন প্রভাষক এপাড়ার জমি গ্রহণ করে। এবং এরা চারটি দালানগৃহ নির্মাণ করে, অতপর এক বিকেলে এ-পাড়া থেকে শহরে ঢুকতে-বেরোতে প্রধান যে গলিপথ সেখানে ‘প্রফেসর পাড়া’ নামক বিশাল এক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়।
এ দেখে কেউ হাসে। কেউ থুথু ফেলে। কেউ বলে, বাগদিদের ভাগ্যে এই বুঝি কষ্টের বাসা বাঁধতে শুরু করলো। কেউ কেউ প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে বলে, প্রফেসর কে? প্রফেসর কি? ওরা কি তা জানে? বোঝে? না চেনে!

আরেকজন বলে, ওরা চাকু-ছোরায় খানকয় পাশ দিয়ে কলেজশিক্ষক সেজে নিজেদের প্রফেসর বলে বেড়ায়। শ্রেণিকক্ষে এরা উরত-বোগল চুলকিয়ে পাঠদান কর্ম সারে। এবং নিজে যা নয়, তার অধিক বলে বেড়ানো এদের কর্ম। আর সুযোগ বুঝে থলে ধরা-।

সাইনবোর্ড টানানোর পর নাথু বাগদি যখন শোনে এটা প্রফেসরপাড়া, তখনি নাথু সাইনবোর্ডটির কাছে যায়, চোখ-গ্রিবা চিৎ-কাত করে বোর্ডটি দেখে। নাথু পড়তে পারে না। পড়া শেখেনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবে, ওই বস্তুখানা পাড়ায়ে ভেঙে চুরমার করি। কিন্তু তা সে করতে পারে না। শুকনো তালের আঁটির মতো মুখ করে ফিরে এসে তার ছাপড়ার সামনে ষড়াগাছটির নিচে বাঁশের মাচাঙের উপর বসে ঠোঁটে বিড়ি জ্বালে। এ সময় রঘু মাঠে যাচ্ছিল, নাথু ডাকে। রঘু কাছে এলে নাথু কয়, পেরফেসাররা কি করেছে দেখছিস? এ না-কি পেরফেসার পাড়া এখন। হয়, তাইতো শুনতিছি। রঘু বলে।

বৃদ্ধের হাড়-পাঁজরের রক্ত ক্ষ্যাপা শুয়োরের মতো নড়ে ওঠে। সে বলে, তয় আমরা সব পেরফেসার অয়ে গেলাম।
তাইতো মনে হচ্ছে। বলে রঘু তার কাজে যায়। নাথু রঘুর চলে যাওয়ার প্রতি তাকিয়ে থাকে আর তার মগজের ভেতর তোলপাড় করে-বাগদিরা এবার সত্যিই বুঝি নোনাজলে ডুবে গেল।

চারখানা প্রভাষক-গৃহের সাথে আরো একখানা করে টানা লম্বা ঘর উঠলো। যে ঘরগুলো থেকে প্রতি সকাল-সন্ধ্যা পুঁথিবিদ্যা রফতানি হয়। আর তা খরিদ করে কিশোর-কিশোরিরা। যাদের বয়স এখন হাঁসের মতো সব কিছু গ্রহণ ও হজম করবার। এরা খাঁচার পাখির মতো এখানে পচা গলা বাসি টাটকা গ্রহণ, হজম করে। হজম করতে হয়। তা না করলে এদের শ্রেণি-বৈতরণি ডিঙোনো দুষ্কর হয়।

এই প্রভাষকরা গর্দান উঁচিয়ে শিক্ষার্থিদের শোনায়, আমার গৃহপাঠ যে নেবে না সে কি করে আমার সাবজেক্ট টপকায় তা দেখে ছাড়বো।

এ কথা রাষ্ট্রিয় শিক্ষা-সিপাহসালার সহ তার পিয়ন পর্যন্ত জানে, শোনে। এ জানে, শোনে আর দন্ত আলগা করে নুনু চুলকায় ও গ্রিবা উঁচু করে বলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগোচ্ছে। দ্রুত এগোচ্ছে।

প্রভাষকদের গৃহে এখন সকাল-সন্ধ্যা শিক্ষার্থি গিজগিজ করে। ফলে, এই গৃহগুলোকে কেউ কেউ বলে, বিদ্যার গ্যারেজ। স্যারদের বলে বিদ্যার মেকার। কেউ কেউ এই স্যারদের বিদ্যা-ধর্ষকও বলে।

এখানে একই শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রি, কিন্তু যে যেমন পয়সা দেয়, সে তেমন শিক্ষা পায়। তা শুনে, বদর সেখ বলে, পচা, ঘেয়ো, টাটকা সব বিদ্যাই এখানে বেচা বিক্রি হয়, যেমন অর্থ, তেমন মাল-।

এখানে শুধু বিদ্যা বেচাকেনাই চলে না। আর কারবার চলে। সন্ধ্যার পর এখানে ডাল (ফেনসিডিল)ও মেলে। যে স্যার এটা আমদানি করেন, তিনি বলেন, অর্থই সকল সুখের মূল। সে অর্থ যে পথেই আসুক। এনার প্রিয়তমা বধূ বলেন, টাকা থাকলে সব ফর্সা, ধর্ষকও ধার্মিক হয়।

এপাড়া টাকা বেচাকেনার ব্যবসাও চলে। পাঁচশ টাকার নোট দেড়শ টাকায় বিক্রি হয়। হাজার টাকার নোট তিনশ টাকায়-। ব্যবসাখানা ফল্গুধারার মতো চলে। যিনি ব্যবসাখানা করেন, শহর-স¤্রাটদের সাথে তার খুব সখ্যতা। এনার বাসায় মাঝে মাঝে জব্বর খানাপিনাও চলে। এছাড়া আরো আরো বাণিজ্য এপাড়া হয় এবং তা আভিজাত্যময় সমৃদ্ধির সাথে।

আরো দু’জন প্রভাষক এপাড়া বসত গাড়লো। এরা পাড়ার একেবারে উত্তরে। বৃদ্ধ নাথু বাগদির ছাপড়া থেকে কিছু দূরে। দু’জনের একজন চিত্রকর, একজন সাহিত্যের স্যার। এদের প্রফেসর বললে, এরা মুখ ঘুমোট করে। নাথু বাগদির গভিরে এখন এক ঝড় ভাঙে, ভাবে-পেরফেসাররা আস্তে আস্তে যে কলজের পর উঠে আসতি লাগলো!
নাথু বাগদি এখন ষড়াতলা মাচাঙে বসে রয়েছে। চিত্রকর ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। নাথুর কাছে দাঁড়ায়।
বৃদ্ধ নাথু নেংটি ঝাড়তে ঝাড়তে মাচাং থেকে উঠে যায়।
চিত্রকর দাঁড়িয়েই থাকে।
নাথুর বেটা রঘুর বউ দুলা, পালানে ছাগলের খুঁটো পুঁতছিল, সে এগিয়ে আসে। চিত্রকরকে বলে, কিছু কবা?
না।
বুড়াহাকে দরকার?
না।
বুড়হা তোমাধের দেখতে পারে লা।
অপরাধ?
তোমরা বুড়হার চৌদ্দপুরুষের মাটি লিয়ে লিচ্ছো।
চিত্রকরের মুখখানা মাটিমুখো হয়ে যায়।

এপাড়া এখন লাকি পেরফেসার পাড়া। তাইকি হয় বাবু? আমরা কতকতদিন এখানে আছি। আর দু’দিন যেতেই পাড়াটা তোমাদের করে লিলে! একি কেউ মেনে লেয়। এ তোমরা কেমুন মানুষ? তোমরা লাকি ভদ্দরনোক!
চিত্রকর পচাঘায়ের মতো নিরব।
এ সময় ধুলো মাটিমাখা উলঙ্গ শিশু দৌড়ে এসে দুলার বুকের কাপড়া উল্টে স্তনে মুখ গোঁজে। চিত্রকর চুপ।
বুড়হা তোমাদের পরে নেগে আছে।
আচ্ছা যাই, বলে চিত্রকর পিছন ফেরে।

দেখতে দেখতে এ পাড়ার আরো কয়েকখণ্ড জমি প্রভাষক ও উকিলদের হাতে চলে গেল। যাদের গেল, ওরা এখন ভাসমান। যারা এলো, এরা শিকড় গাড়লো। পৌরপিতার মোটা খাতায় এদের নাম পাকাপোক্ত হলো। এদের সুখ দুঃখ কষ্ট দুর্দশা এখন শহর-পিতার খাতায়। আর যারা ভেসে গেল ওরা এখন এ শহরের আবর্জনা।
এপাড়া এবার যারা এলো এরা কেউ প্রভাষক, কেউ উকিল, কেউ দারোগা। দারোগা ও উকিল-বধূরা এ পাড়া ঢুকতেই প্রভাষক-বধূদের অন্তরদাহ শুরু হয়। এরা একে অপরে বলাবলি করে, দেখ, ওই বউদের শাড়ি-গহনা দেখ! কেউ কেউ আপন বরকেও এ দেখতে বলে।
বর কয়, কি দেখবো?
চোখে কি ছানি পড়ে গেছে?
কেন? বর বলে।
ওই বউদের শাড়ি-গহনা দেখো?
তা কেন দেখতে হবে!
তা ঠিক, চলোতো ঘাসে মুখ দিয়ে।
কেন, আমি কি দারোগা?
না, তুমি দারোগা না, তুমি ফেনসিডিল ব্যবসায়ি। ফেরেস্তা।
চুপ করোতো।
প্রত্যেক প্রভাষক-ঘরে এখন এই একই যন্ত্রণা।

বাগদিরা এখন স্ব-ভ‚মে পরবাসি। প্রভাষক, উকিল, দারোগা এরা এদের দেখে নাক সিটকায়। ধমক দেয়। যা দেখে-শুনে নাথু বাগদির কলজে জ্বলে। ভেতরটা গর্জায়। আর অন্তরে কয়, গায়-গতরে সেই সামর্থ্য থাকলে আরেকবার হাসোখানা উঁচিয়ে দাঁড়াতাম। একদা বিকেলে ষাঁড়ের মতো মেঘ গর্জে উঠলে এক বাগদি-বউ মাঠ থেকে ছাগল নিয়ে হুড়পাড় করে ঘরে ফিরছে, সেখেদের বড় বাগানের ধারে এলে গোলদার বাবুর মেজোছেলে খপ করে বউয়ের হাত টেনে ধরে। তা দেখে নাথু হাসো নিয়ে ছোটে এবং গোলদার ছেলেকে যেখানে ধরে সেখানেই আসমান, জমিন তোরা সাক্ষি, বলে হাসোখানা চালিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ধড়ের উপর ছেলেটার মুণ্ডু ঝুলে পড়ে।

নাথুর সেই দিন আজ নেই। নাথু এখন কুঁজো পক্ষির মতো আপন বুকে গ্রিবা গুঁজে বসে থাকে আর সব দেখে-শোনে।
আজ বিকেলে প্রভাষক-বউদের মধ্যে বেঁধে গেল। প্রথম দুই মুখ থেকে যেন দুর্গন্ধময় বমি গলতে শুরু করলো। এরপর সংক্রামক রোগের ন্যায় এও বউয়ের মুখে তা ছড়িয়ে যায়। এক বউ আরেক বউকে বলে, তুই ও তোর ভাতারের কত ক্ষমতা তা আমার জানা আছে।

সঙ্গে সঙ্গে বিপরিত বউ বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে কয়, আমার একগাছ- ছেঁড়ার ক্ষমতাও তোর নেই। বউয়ের বর নির্বাক বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ শোনে। এ দেখে দারোগা ও উকিল বউয়েরা হাসে।
নাথুর বেটার বউ দুলা এ শুনে কাপড়ে মুখ ঢেকে সরে যায় আর মনে মনে কয়, এই অলো শিক্ষিস্ত পেরফেসার। এরা শিক্ষিস্ত, না কড়ারকালি।

বৈশাখি বিকেল। চিত্রকর তার বারান্দায় ছবি আঁকছে। সাহিত্যের স্যার পাশে বোবার মতো চুপ। ছবি থেকে চোখ তুলে চিত্রকর ডাকে, দিদি-, দিদি কই? দুলা আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে সামনে এসে দাঁড়ায়। চিত্রকর পছন্দমতো জায়গায় ছবিখানা টাঙিয়ে বলে, দিদি, দেখতো ছবিখানা কেমন?
দুলা একটু তাকিয়ে থেকে হেসে ওঠে।
কেমন? বলো?
ভারি চমেৎকার।

চিত্রকর আরো একখানা ছবি ঘর থেকে এনে দুলার সামনে ধরে। দুলা ছবি দুখানা দেখে মিটমিটিয়ে হাসে। আর আপন গভিরে খুশি উছলায়।
ছবি দেখা শেষ হলে চিত্রকর বলে, এখন চা-বিস্কিট হলে ভালো হয়।
আমি নিয়ে আসি, বলে দুলা পিছন ফেরে।
দিদি, টাকা-?
লা, টাকা আমি দেব।
শোনো। শোনো।
লা, শুনবোলাই, বলে দুলা ছুটে।
চা খেতে খেতে দুলা ছবি দু’খানা আবার দেখতে চায়, দেখে। দেখে আর গুড়িগুড়ি হাসে।
ছবি দু’খানার একজন নেংটিপরা নাথু শূন্যে দৃষ্টি ছড়িয়ে নিথর জড়োসড়ো।
ষড়াগাছতলা বসে রয়েছে। দ্বিতীয়া, দুলা, বুড়ি বিকেলে মাঠ থেকে ছাগল নিয়ে ফিরছে। ছবি দু’খানায় দুলার মন খুব মজেছে। সে মনভরা চোখে ছবি দু’খানা দেখে।

পরদিন দুলা ও নাথুর ছবির কথা এ-পাড়ার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলে প্রভাষক- বধূরা-যারা-স্বামিকে মাকড়শা ছাড়া মানুষ ভাবে না, এরা বলাবলি করে, ওই বেটা বাগদি মাগির ছবি কি খালি খালি এঁকেছে? এর ভেতর গুড় আছে। দেখনা, ওই মাগির যেমন পাথর খোদাই শরীর, তেমন মুখে কলকলে ছলছলে কথা। আর ওর সোয়ামি এক খটানি। বউ এ-পাশ হলে ওপাশে গড়াতে পারে না। এ বলে আর খলবল করে হাসে। শেষে কয়, ওই শিল্পি এখনো বিয়ে করেনি। খালি খালি কি বাগদি মাগির ছবি আঁকে!
আরেকজন বলে, তলে তলে বাগদি মাগির সাথে শিল্পির সব কর্ম চলে। দু’দিনের মধ্যে এ কথাও সারাপাড়া ছড়িয়ে যায়। দুলার বরের কানেও পৌঁছে। শিল্পির কানেও-। শিল্পি এখন বারান্দায় বসতে পারে না, ঘরে বসে। আজ বিকেলে দরজায় গিয়ে দুলা ডাকে, দাদা শুয়ে লয়ছো? শরীল লরম? চিত্রকর উঠে বসে এবং কিছু বলার আগেই দুলা কয়, চা-উ খাবা-না?
না, দরকার নেই।

দরকার আছে, খাওয়া নাগবি। কেনে খাবা না আমি জানি, বলে দুলা চা আনতে ছোটে।
চা খেতে খেতে দুলা কয়, দাদা তুমি আমারে এখোন ডাকো লা কেনে?
প্রয়োজন হলেতো ডাকবো।
লা লা, কেনে ডাকো না আমি কতি পারি।
কেন?
পেরফেসার বউয়েরা কি কয়েছে তাই।
তা শুনে তোমার মনে কিছু হয়নি?
লা, তা হবি ক্যা? আমরাকি ওগের মতো লস্ট? লা ওগের মতো বারোভাতারি?
চিত্রকর চুপ।
যাই দাদা, ভাত লাততি অবি। বলে দুলা উঠে পড়ে, ওই চলে যাওয়ার প্রতি চিত্রকর নির্বাক তাকিয়ে থাকে-, আর ভাবে দুলার থেকে কত ছোট আমি, আমরা-।

শহর-যুদ্ধে হার মেনে এ পাড়া থেকে আরো কয়েকঘর বাগদি উঠে গেল। পাড়ার উত্তরকোণে নাথুরা এখন ঘরতিনেক মুখ জোঁক-কেঁচোর মতো জড়াজড়ি করে কিলবিল করছে। বাকি সব ভদ্রলোক আর ভদ্রলোক। দূর থেকেও এদের কণ্ঠের ঝাঁঝ শুনে বোঝা যায় এরা ভদ্রলোক। আগে যখন এপাড়া শুধুই বাগদি ছিল তাদেরও কণ্ঠ শোনা যেতো, তারাও ঝগড়াঝাটি করতো, কিন্তু বোঝা যেতো না, ওরা কারা।

নাথু এখন মাঝে মাঝে কুঁদে উঠে কয়, পাড়ায় একি ভর করেছেরে! দিন-রাত শিয়েল-শুহারের মতো হাইলো-মাইলো করে।
রঘু কয়, ওরা ভদ্দরনোকতো, ওটাই ওদের কাজ।
রাখ তোর ভদ্দরনোক।
হ্যাঁ, হ্যাঁ খানকয় ভদ্দরনোক এক হলে এমনি হয়, রঘু বলে।

আজ বিকেলে যেন তাণ্ডব শুরু হলো দুই প্রভাষকের গৃহসিমানা নিয়ে। এক পর্যায়ে দুই প্রভাষক-বউয়ের মধ্যে শাক তুলতে কেঁচো নয়, সাপ বেরোতে শুরু করলো, ও দেখতে দেখতে যেন এই সাপ এদের সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে গেল।
প্রফেসরপাড়া এখন এক ময়লাগলা ড্রেন। যে মুখে যা আসে সে তাই উগড়াতে থাকে। কবে কোন প্রভাষক-বউ ছাত্র ঘরে ডেকে তার দিয়ে আপন শরীর জুড়িয়েছে, কোন স্যার কোন ছাত্রিকে, কোন উকিল বাদি-বিবাদি দু’পক্ষ থেকেই টাকা খায়, সন্ধ্যা হলে কার ঘরে কে ঢোকে, এসব কথা উচ্চস্বরে সর্পফণা হয়ে এক-এক মুখ থেকে বেরোতে থাকে। বাগদিরা এ শোনে আর বলে, গুয়ের গাদায় ঢিল পড়েছে। ফলে গন্ধ আর গন্ধ ছড়াচ্ছে।

এখন মাঝে মাঝে এ পাড়ায় মাস্তানও ঢোকে। ঢোকে না, নিয়ে আসা হয়। মাস্তানরা পাড়ায় ঢুকে এদের কুত্তা-শিয়াল মুখে যা আসে তাই বলে খিস্তি-খেউড় করে। এ শুনে কেউ হাসে, কেউ বোগল বাজায়, কেউ মুখ কিজিবিজি করে। চিত্রকর ও সাহিত্যের স্যার প্রভাষকদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা তুললে তারা বলে, তোমরা জীবনের কি বোঝো? জীবন থাকলে এমন ঘটবেই।
চিত্রকর এ শুনে ভাবে, জীবন তাহলে শৃগাল-কুকুরের মতো পুঁজ-রক্ত বাসি-পচা নিয়ে কামড়া-কামড়ি করার বস্তু!
দু’দিন আগে এক প্রভাষক সাহিত্যের স্যারকে শোনালো, বাগদি আর আপনার মধ্যে কোনো পৃথকতা নেই। মান-ইজ্জত বলে কিছু বোঝেন? বোঝেন না। জীবনের চেয়ে মান-ইজ্জত অনেক বড়। এ বোঝেন না। যদি বুঝতেন, তা অত উঁচু লেখাপড়া শিখে ওই আগদি-বাগদিদের সাথে মিশতেন না। একসঙ্গে বসে চা-বিস্কিট খেতেন না।

স্যার এ শুনে মিটমিটিয়ে হাসে, আর কফ্্ থুথুর প্রতি তাকানোর মতো ওই মুখের প্রতি তাকিয়ে থাকে।

সামনে ভোট, প্রভাষকরা নাচতে শুরু করেছে। রঘু বাগদির সঙ্গে শিতল বাগদির বেশদিন পর দেখা আজ।
রঘু বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কয়, শেতল দা ভোট দেবা কারে?
ভোট! কার ভোট!
কও কি!
হয়, আমরা কি আর মানুষ আছি!
কি কও শেতল দা!

গরমেন্টের টেকশো খাতায় নাম না থাকলি তারা মানুষ না। সেদিন পৌর অফিসি গেলি এই কতা কয়ে দিলো।
রঘুর অন্তরপর্দার উপর প্রভাষকরা এখন উঠে আসে, এরাও রঘুদের মানুষ ভাবে না; ভাবে আবর্জনা।

আজ সন্ধ্যায় এপাড়ায় পিস্তল প্রদর্শন চললো। কারণ উকিলদের দাবি, এ পাড়ার নাম হবে উকিলপাড়া। তাই জনাকয়েক মাস্তান উকিলপক্ষ নিয়ে এই প্রদর্শন চালালো। প্রভাষকরা বকের মতো চুপচাপ এ দেখলো। শেষে মাস্তানরা বেরিয়ে গেলে প্রভাষক মুখ থেকে পাহাড়ি পাহাড়ি ঔদ্ধত্য গড়াতে থাকলো, যা ফসকা গেরোর মতো।

উকিল-প্রভাষক এখন সাপ-নেউল। বউয়েরা আরো উগ্র। আজ বিকেলে ছাদ থেকে পড়ে এক উকিলপুত্র মরে মরে, প্রভাষকরা ওদিকে ফিরেও তাকায় না। এ কথা নাথুর কানে চড়লে নাথু পাথরের মতো চুপ-। এ সময় চিত্রকর ও সাহিত্যের স্যার বারান্দায় বসে গল্প করছে, দুলার মুখ থেকে এ শোনামাত্র এরা এগিয়ে যায় এবং ফিরে এসে যখন নির্দিষ্ট স্থানে বসে তখন দুলা কয়, দাদা চা-উ খাবা না?
সাহিত্যের স্যার বলে, হলেতো ভাল হয়।
লিয়ে আসি।
দাঁড়াও, দাঁড়াও, চিত্রকর বলে।
লা দাদা, লা আমি শুনবো না।
একটু পর দুলা চা-মুড়ি নিয়ে ফেরে। এবং চা খেতে খেতে দুলা বলে, তোমরা কেমুন মানুষগো দাদা?
কেন?
তোমরা নেকা-পড়া জানা বিদ্দেন মানুষ, তা কেমুন বিদ্দেন! কেউ কেরুর কতা সহ্যি করতি পারো লা! কেউ কেরুর লিজের ভাবতি পারো লা, তোমাদের সত্যি মিথ্যে বোঝা যায় লা! এ সময় দুলার বর কাজ থেকে ফিরে ডাকে, দুলা ব্যস্ত উঠে যায়।

প্রফেসরপাড়া এখন পাল­া দিয়ে বিদ্যা বিতরণ চলছে। কেউ কেউ বলে, এ পাড়া এখন বিদ্যার ঘাঁটি। আর প্রভাষকরা আঙুল উঁচিয়ে কয়, সপ্তাহে আমার ৩০ হাজার টাকা আয় হতে হবে।
এই অর্থের দেমাগ এদের বউ-মেয়ে-সন্তানদের প্রতি তাকালে বোঝা যায়। যাদের ঝোলাবুক তারাও টাইট করে বুক বেঁধে রাখে। এ দেখে অন্যরা হাসে, রঙ্গ করে, এরা তা কিছুই মনে করে না।
পাড়াটাকে এখন উকিলপাড়া নামে খ্যাত করতে উকিলেরা উঠে পড়ে লেগেছে। সাইনবোর্ডও করতে দিয়েছে। এ শোনামাত্র প্রভাষকদের কলিজা যেন বিষফোঁড়া হয়ে ওঠে। এরাও এর বিরুদ্ধে খোন্তা কোদাল হয়ে লেগে যায়।
আজ মেঘলা বিকেল। বনমহিষের মতো মেঘে গুংড়ে গুংড়ে প্রবল অন্ধকার করে ঝড়বৃষ্টি এলো। দুলা ও বকুলদের ছাপড়া উড়ে গেল, এসময় দুলা শৃগালভেজা হয়ে দৌড়তে দৌড়তে চিত্রকরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ডাকে, দাদা- দাদা-
চিত্রকর দরজা খোলে। ঝড়বৃষ্টি সমানে চলছে।
চিত্রকর দুলাকে বলে, তোমার কোলে কে?
ছাওয়াল, বকুলের ছাওয়ালগো।

আজ সকালে বকুলের সঙ্গে দুলার চুল ছেঁড়াছিঁড়ির মতো একচোট হয়ে গেল। বকুল বারবার বললো, মাগি তোর চিতা জ্বলুক। চিতা জ্বলুক।
সেই দুলার কোলে এখন বকুলের জালিছেলে। চিত্রকরের চোখ বিস্মিত। সে বলে, ভেতরে এসো।
দুলা ভেতরে যায়।
ঝড়বৃষ্টি ক্রমেই উগ্র। এক পর্যায়ে বকুল, পার্বতি, ল²ি, রুহিনি সবাই দুলার কাছে চলে আসে।
বেশ ক্ষণ ধরে ঝড়বৃষ্টি চলে। এরপর শান্ত হলে চিত্রকর ও সাহিত্যের স্যার রঘুর উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ভাঙা ঘরগুলো মৃত কচ্ছপের মতো পড়ে রয়েছে। পাড়ার মরদগুলো রঘুর রান্না করা ঝুপড়ির উনোন ঘিরে বসে। চিত্রকর এখানে এসে উঁকি দিতেই এরা নড়ে ওঠে, রঘু বলে, আপনেরা!
একি অবস্থা হয়েছে তোমাদের।
ঝড় আঁদলের কাণ্ডতো।
তাতো দেখছি।
আবার গড়ে লেবো।
দুলা এখন এখানে এসে দাঁড়ায়। চিত্রকর দুলার মুখের প্রতি তাকায়, দুলা বলে, আমার কোলে এ ছাওয়াল দেখে কি য্যান কইছিলেন দাদা?
না, কিছু না।

কইছিলেন। ওটা বিদ্যেনরা পারে, আমরা পারি লা। বেপদ-আপদে কারো কিছু কি মনে রাখতে হয়? লা, সেটা মানুষের কাজ? চিত্রকরের মুখখানা মাটিতে ঝুলে পড়ে।

রঘুরা ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া ছাপড়াগুলো গোছাতে শুরু করে। এরপর সন্ধ্যা, রাত। রাতশেষে সকাল ফুটে সূর্য ঝকমকে হলে এ পাড়া থেকে শহরে যাবার প্রধান গলিমুখে একখানা সাইনবোর্ড নিয়ে প্রভাষক ও উকিলদের মধ্যে শোরগোল বেঁধে যায়, সেই সাথে কুকুরের ঘেউঘেউ। যা দেখে পথচারিদের মুখে মুখে বাগদিপাড়া এখন কত সারমেয়রে!
রঘুরা ষড়াতলা নাথু বুড়োর পাশে চুপচাপ বসে এদেখে আর শোনে।

শেয়ার করুন: