শিল্প আর যাই হোক, নৈতিক শিক্ষার একঘেয়ে কথন নয়। গোগোল জুকোভস্কি, ১৯৪৮
তোমার অপসৃয়মাণ শাড়ির আড়াল থেকে ক্রমশ উন্মোচিত সৌন্দর্যের দীপ্তিতে
ঝলমল করে উঠেছিলো যে রাজসভা, রাজন্য, পাত্রমিত্র এবং সভাসদগণ
আমি তাদের ভেতর থেকে তোমার বিষাদমাখা মুখের মোমকে
একটু একটু করে গলে যেতে দেখে
বিস্ময়ে আপন সৌভাগ্যকে কুর্নিশ করেছি।
১.
মূলত প্রেমেই ফিরে আসেন তিনি। স্পর্ধিত, দর্পিত, দ্বিধাহীন। শব্দের অন্বেষায় যোজন যোজন পথ হাঁটেন, বাঁক নেন। নিজস্ব অবস্থানে বার্তা রটনা করেন। চিনিয়ে দেন নিজেকে। রাজনৈতিক সচেতনতা, ক্ষুদ্ধ, আশাহত, উদ্বাস্তু জীবন বয়ে বেড়ানো কবি অসীম সাহা মন ও চেতনার মনোভূমিতে প্রচণ্ড আঘাত হানতে চান, হানেন এবং নিজ স্বাতন্ত্রকে স্পষ্ট চিনিয়ে দেন আর দশজন কবির চাইতে। রাজনৈতিক ভাষ্য মহাভারত-রামায়ণ চরিত্রের আড়ালে রূপকের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তেমনি তাঁর অস্তিত্ব-অস্তিত্বসংকট, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিস্ফুটিত হয় কবিতায়। দেশভাগ, দেশভাগজনিত বিচ্ছিন্নতা তার কবি মানসে স্থায়ী অক্ষয় ছাপ রেখে যায়, যা তাঁর কবিতার পরতে পরতে ঘুঙিয়ে ঘুঙিয়ে বিষন্ন ভাবে কাঁদে, শৈল্পিকদ্যোতনা স্থায়ী রূপ পায় অমর পঙ্ক্তিমালায়। হতাশা-বিচ্ছিন্নতা-ক্রোধ-দ্রোহতার আড়ালে প্রেমকোমল কবি হারিয়ে যান, আমরা তাঁকে মূলত রাজনৈতিক-উদ্বাস্তু কবি হিসেবে ভাবতে ভালবাসি, যিনি প্রেমের জন্য লালায়িত, প্রেমিকার ছোঁয়া-উষ্ণতায় উদ্দীপিত হতে চান, তাঁকে বুঝতে পারি না।
নর্তকীর পায়ের ঘুঙুরগুলো খসে গেলো
মধ্যরাতে অন্ধকার সমুদ্রের পাশে;
বেদমন্ত্র উচ্চারিত হলো যেন
মেঘমন্দ্র আকাশে আকাশে।
ছুটলো নক্ষত্রপুঞ্জ জ্যোৎস্নার তরঙ্গিত রথে
একটি হৃদয় একা পড়ে থাকে
ব্যর্থ ভিখিরির মতো শূন্য পথে পথে;
এই পথে তোমার যাত্রা শুরু হাজার বছর-
আকাশ ফেরাবে কেন নক্ষত্রের নীলিমার ঘোর!
হৃদয় কি পুঞ্জপুঞ্জ নৈঃশব্দের চেয়ে আরো দূর?
এই প্রশ্নে একটি আকাশ কাঁপে
কেঁপে ওঠে নর্তকীর পায়ের ঘুঙুর।
ঘুঙুর/মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি
২
কবিতা হল শব্দের কারুকাজ। আর কবিরা হলেন শব্দশিল্পী। শব্দ তারা প্রয়োজনমত ইচ্ছামাফিক নিজস্ব তাগিদ থেকে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে সময়োপযোগী করে গড়ে নেন। একটা সময় ধারণা করা হত কবিতামাত্রই প্রচলিত ছন্দের ছকে ছকে হবে। ছন্দবিহীন কোন কবিতাকে কবিতা বলতে, স্বীকার করতে অনেকেরই কষ্ট হত।-সহজে স্বীকার করতে চাইতেন না, স্বীকৃতি দিতে অনীহা প্রকাশ করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মানুষের একরৈখিক চিন্তা-চেতনায়ও পরিবর্তন আসে। সে উলটে পালটে দেখতে চায় জীবনের জটিলতা। গ্রন্থিল জীবনের জটিলতাগুলো এক-আধটু নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোন ফর্মে চিন্তাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করবে সেটি আদৌ ভাবছে না। সে প্রতিবাদ করতে চায়, অস্বীকার করতে চায়। জীবনে ট্রাজিক পরিণতির জন্য আদৌ তার প্রস্তুতি থাকে না, কিন্তু একটা সময়ে তাকে সমাজ-সংসারের গ্যাঁড়াকলে ট্রাজিক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেই হয় স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। স্বেচ্ছা অনিচ্ছার এই দোলাচল তাকে ভাবায়, সে ভাবতে চায় জীবন এমন কেন, অন্যরকম হল না কেন ? প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশার এই যে বৈপরীত্ব, তাই একসময় তাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করে, সে এক আশাবাদী জগৎ বিনির্মাণ করে নিজের মনেই, যেখানে সে একাই নায়ক, অন্য কেউ নয়। বিশুদ্ধ চিন্তা তাহলে কবিতার একটা উলেখযোগ্য বিষয়, কিংবা মৌলিকত্ব-এটা স্বীকার করতেই হচ্ছে। ফর্ম কিংবা কবিতার যে গণিত সবকিছু অস্বীকার করলেও জীবনকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কবিতায় জীবনই আসছে ঘুরেফিরে।
আমরা মৃত্যুর ভেতরে আরো মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকা সলিমের পাখি
বেদনার ভেতরে আরো বেদনার চিরস্থায়ী চিতা
উন্মুক্ত বাতাসের প্রেরণায় বেঁচে থাকবার আনন্দে উদ্বেল সবুজ পত্রালি
সকালবেলার সূর্যের আলোতে শান্ত সমুদ্রের মতো
ধীরে ধীরে জেগে উঠছি যেন।
গন্তব্য
৩
১৮৮৬ সালে ‘লে ফিগারো’ পত্রিকা সিমবলিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাতে গিয়ে জঁ মোরেস বলেছিলেন, ‘শব্দসমসূহ ব্যবহৃত হওয়া উচিত মানসিক স্থিতি প্রকাশ করার জন্য’। বর্তমান সময়ে সবকিছুতে সেই মানসিক স্থিতির বড্ড অভাব। কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা; তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে যেতে কবিতা হচ্ছে ব্যর্থ। সিমবলিস্ট আন্দোলনের আগের দু’দশক ছিল প্রথাবিরোধী কাব্য আন্দোলনের সূচনা পর্ব। যাকে বলা হয়েছে-ডেকাডেন্স যুগ। প্রকারান্তরে, ডেকাডেন্স যুগেরই প্রতিনিধিত্ব করছি কি আমরা, ফিরে যাচ্ছি সেই আদিতে? তবে একথা অস্বীকার করার জো নেই যে, ‘একজন মানুষ নিজের মধ্যে যতোটুকু ডুব দিয়ে দেখুক না কেন, কবিতা তার আত্মাকে জেরা করে, তার উৎসাহের স্মৃতিকে ফিরে পেতে চায়, নিজেকে বাদ দিয়ে কবিতার আর অন্য কোন কাজ নেই; এছাড়া অন্যকোন কারণ হতে পারে না, এবং কোন কবিতাকেই অনন্য বলা যাবে না, বলা যাবে না মহৎ, সত্যিই কবিতা নামের যোগ্য বলা যাবে না, যদি না তা কবিতা লেখার আনন্দের জন্যই রচিত হয়ে থাকে।’ তাহলে, কবিতা কি? যুতসই চিন্তন সংস্থাপনই কি কবিতা? আত্মকেন্দ্রিকতাই কবিতার মূলভিত্তি? নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, সংশয়, যন্ত্রণা কবির পাথেয়? বলা হয়ে থাকে সাম্রাজ্যবাদ পতনের পর বাজার অর্থনীতির বিকাশে প্রতিস্থাপিত হয়েছি বিশুদ্ধ ‘ব্রান্ড যুগে’ অবচেতনে। উনিশ শতকে যে আদর্শবাদিতা ও রোমান্টিসিজমের আবছা প্রবাহে নিও-প্লেটোসিজমের স্রোত শুরু হয়েছিল জগৎ সম্পর্কীত অতীন্দ্রিয়বাদী ধারণা কিছুটা হলেও পিছিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানবিক সভ্যতার বিপর্যয় সন্দেহ নেই আমাদের অনেক বেশী ভাবাচ্ছে, কবিতা হয়ে উঠেছে আরো বেশী ব্যক্তি-নির্ভর, আত্মকেন্দ্রিক অথবা মানবিক। ‘শিল্প’ শব্দটি এই অল্প কিছুদিন হল আমাদের মননে চিন্তায় আশ্রয় পেয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে যতদিন না প্রগাঢ় সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে, ততদিন এই শব্দটি পরিচিত জগতের বাইরেই ছিল। পাশ্চাত্য চিন্তা-পরিচিতির সাথে সাথে মৌলিকত্বের জগৎ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। তার মানে এই নয় যে ‘শিল্প’ শব্দটির সাথে পরিচিতি না ঘটলেও এখানে শিল্প ছিল না, শিল্পী ছিলেন না। দুভার্গ্যজনকভাবে সহজ-সরল জীবনযাত্রার অনেকটা হারিয়ে গেছে যান্ত্রিক সভ্যতার আগমনের সাথে সাথে। কাউকেই দোষারূপ না করেও যা বলার, বলবার কথা হলো তত্ত¡ এবং তথ্যের সাগরে ডুবে গেছি অনেকটাই অজান্তে।
আমাকে জাগাতে চায়-পৃথিবীকে বসতির যোগ্য ভেবে দৃঢ় কথা বলে:
আবার নতুন ক’রে সহস্র ঝড়ের বেগ তছনছ করে দেয় স্বপ্নের সব আয়োজন;
অবশেষে মানুষেরা পাতালপুরীতে গিয়ে হয়ে ওঠে জলেরই স্বজন;
আর আমি তোমাকেই খুঁজে খুঁজে চলে যাই অন্তহীন জলের অতলে।
৪
সচেতনভাবে রবীন্দ্র বিরোধীতা থেকে কবিতার যে বাঁকবদল সূচিত হয়েছিল, তিরিশের দশকের কবিরা প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার যে চেষ্টা করেছিলেন তাতে তারা কতটুকু সফল কিংবা ব্যর্থ সেই বিবেচনায় আমরা যাবো না, তবে তার ধারাবাহিতকতার রেশ আজো চলছে সেটি অস্বীকার করা যাচ্ছে না, এই মুহূর্তে। এরই আলোকে আরেকটু পিছিয়ে যাব আলোচনাকে গতিশীল করার জন্য। এই সময়েই কবিতায় বিজ্ঞানকরণের চেষ্টাও হয়েছিল, দার্শনিকতা তো বরাবরই ছিল। জাঁ আর্তুর র্যাবো বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে কবিতায় তাৎক্ষণিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করেন। ভের্লেন অস্বীকার করেন শব্দের স্পষ্টতার প্রয়োজনীয়তা; স্তেফান মালার্মে বাক্যবিন্যাসকে বিপর্যস্ত করে জটিল চিন্তা প্রক্রিয়া এবং রূপকল্পে আনেন স্থিতিস্থাপকতা। বলা হয় মালার্মেই কবিতাকে করে তুলেন জনসাধারণের পক্ষে দুর্বোধ্য; কবিতার শরীরে চাপিয়ে দেন অতিরিক্ত কাজ। ভের্লেন, লে কার্দোনেল, সামায়াঁ, মিখায়েল, রদেনবাখ, মাতেরলিঙ্ক-এরা বিষাদাচ্ছন্ন, খামখেয়ালী কিন্তু সচরাচর প্রত্যক্ষ ও অনায়াস এবং সঠিক প্রতীক প্রয়োগ করে মনের অস্পষ্ট স্থিতি ও অবচেতন ধারণাকে রূপায়িত করেন কবিতায়। অপরদিকে ছিলেন মালার্মে, লাফোর্গ, ঘিল, দুবুস, মকেল, মাউক্লেয়ার, মেরিল, ভেরহারেন, কল, ভিলে গ্রিফিন, দুজারদাঁ, রেতে অঁরি দ্য রেনিয়ে। এদের প্রতীক নির্বাচন ব্যক্তিগত, যেগুলি পাঠকের পক্ষে কবির ইচ্ছানুযায়ী অনুসরণ করা অনেক সময়ই কঠিন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের উপনিবেশগুলোতে যদিও শেলি, কিটস, ওয়র্ডওয়র্থ, ব্রাউনিং, টেনিসন আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠছিল। রোমান্টিসিজমের কিয়দংশ ছিল এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপ্রাপ্তির যুগ। রোমান্টিকরা দার্শনিকস্তরে মুক্ত মনের গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা মনে করতেন, নিসর্গ প্রকৃতি হলো মানবাত্মার আয়না। রোমান্টিসিজম চেয়েছে স্বতঃস্ফুর্ততা, কল্পনার মুক্তি, আবেগের স্থায়ী স্বাধীনতা। র্যাঁবো কবিতা এবং জীবন দুটোকেই জটিল করে তোলেন। জীবনযাত্রায় জটিলতা ছিল না মালার্মের, কিন্তু কবিতাকে করে তোলেন দুর্বোধ্য। ভের্লেন নিজের জীবন থেকে সমস্ত আবেগ নিঙড়ে বের করে কবিতাকে করতে চেয়েছিলেন সঙ্গীতময়। তিনি বলতেন, শব্দেরা সন্দেহবাতিকগ্রস্থ; তাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে। মালার্মে বিশ্বাস করতেন, কবিতা হচ্ছে সঙ্কটাবস্থার ভাষা। শব্দকে শব্দের জন্যে প্রয়োগ করা যায় না কবিতায়। তবে, অভিযোগও কম নয়। বলা হয়, এরা স্রেফ শব্দ নিয়ে খেলেছেন; ভাষার মারপ্যাঁচে এঁকেছেন ছবি। খেলো করেছেন ট্রাডিশন; নস্যাৎ করেছেন ইউরোপীয় সাহিত্য মানদণ্ড; অপপ্রয়োগ করেছেন শব্দের; সাহিত্যকে করেছেন দুর্বোধ্য এবং গোষ্ঠিনির্ভর। যে কথা বলছিলাম রবীন্দ্রনাথই কিন্তু বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিক কবি নন। তার আগেও যারা লিখেছিলেন প্রত্যেকেই ছিলেন তাদের সময়ের জন্য আধুনিক। মধ্যযুগের কবিরা যখন কবিতা রচনা করেন তারা সে সময়ের জন্য আধুনিকতার বার্তা নিয়েই হাজির হয়েছিলেন। তবে, প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ এমন এক বৃক্ষ বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ডে তাঁকে অস্বীকার করে যে ভিন্ন একটা ধারার সূচনা করলেন তিরিশি কবিরা তা নানা কারণেই সাহসী পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রবিরোধিতা থেকে বাংলা কবিতার যে ভিন্নস্রোতের সৃষ্টি হল বুদ্ধদেব বসুরা করলেন তার ধারাবাহিকতার রেশ আজো বাংলাসাহিত্যকে শাসন করছে সম্ভ্রমে। রাহমান, দিলওয়ার কিংবা মাহমুদের সাথে সুস্পষ্ট বিরোধ কিংবা ভিন্নতা আছে অসীম সাহার। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ কিংবা শহীদ কাদরী যেভাবে প্রেমকে দেখেন অসীম সাহা দেখেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে, শরীরী প্রেমে অসীমে জড়তা, দ্বিধা কিংবা লজ্জ্বা কাজ করে; প্রেমের ক্ষেত্রে মাহমুদ যতটা স্বেচ্ছাচারী অসীম তা নন। তিনি প্রেয়সীকে কল্পনায় যতটা রাখতে পছন্দ করেন, সরাসরি শারীরিকভাবে ততটা আগ্রাসী হতে চাননা, বিনম্র ধ্যানে কল্পনায় কিংবা নারীকে পুরোপুরি মর্যাদায় স্বাতন্ত্র্যের আসনে অধিষ্ঠিত করাই যেন তাঁর ধ্যান।
৫
কবি অসীম সাহা জীবনকে দেখেন অপেক্ষাকৃত নঞর্থক দৃষ্টিতে, জীবন ও মৃত্যুকে একই পরিমাপে মাপেন। মানুষকে এতটা আমল দেন না যেখানে সে মনুষ্যত্ব হারিয়ে দেবতায় পর্যবসিত হয়। সকল পশুত্ব-প্রতিহিংসাপরায়নতা, বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা গুণথাকাসত্তে¡ও মানুষ তার পশুত্বের কারণেই বড়। মানুষকে বিশ্লেষণ করতে যেয়ে তার ভেতরকার সমস্ত আবরণ নিরাবরণ করে চিনতে চান পরম মমতায়।
কালো বেড়ালের মতো চুপি চুপি নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার;
এই রাতে কোথাও নক্ষত্র নেই, আলোকেরা হয়েছে ফেরার।
দীর্ঘশ্বাস চেপে আছে বুকের ভেতরে-যেন কোনো অলীক পাথর।
… … …
অজ্ঞানেরা কিছুই জানে না- বোধিবৃক্ষ ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়;
আত্মার মৃত্যু নেই। পাথরের বুক চিরে চিরকাল ঝর্নাধারা বয়।
নিখাঁদ গদ্য বয়ানে অসীম তুলে ধরেন জীবনের বিকৃতি। নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেন নিজেরই আয়নায়। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দেন, আর উৎরে যান বাধা বিপত্তি ছাড়াই। নিজেকে আবিস্কার করেন কঠিন সত্যের মাঝে। শিমবরস্কা’র ’আমার øাতক পরীক্ষার স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে’ অসীমের কবিতাতেও অনেকটা সেই সুরেরই বয়ান, কিন্তু তিনি পরিবেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন ভিন্ন আঙ্গিকে।
এই তো সেই নদী, এই তো উজানচকের খাঁ-খাঁ শূন্যতায় বয়ে যাচ্ছে উদাসিনী হাওয়া, দূরে ভাঙা নাটমন্দিরে মহামায়া আর আমি শেষ বিদায়ের আগে এখানে মিলিত হতে এসেছি। তোমার কি মনে আছে সেই বৃষ্টির রাত, সেই বিহবল হাওয়া, তোমার শরীরের সেই কম্পিত আবেগ-অন্ধকারের ভেতরে তোমার জ্লজ্বলে চোখ? আজ যখন ঘন নীল অন্ধকারে নদীর তীর ধরে ছুটে যাচ্ছো একা, উত্তাল ঢেউ প্রবল গর্জনে তোমাকে প্রশ্ন করছে: কোথায় যাচ্ছ তুমি? শূন্যতায় সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ফিরে আসছে বাতাসের সাথে। আর আমি তোমার চলমান ছায়া অনুসরণ করে ছুটে যাচ্ছি অজানার উদ্দেশ্যে। তুমি কি বুঝতে পারছো, এই অন্ধকারে আমরা প্রকৃতই ছুটে যাচ্ছি পরস্পর পরস্পরের দিকে। তোমার একদিকে উদ্যত ছুরির ফলা, অন্যদিকে তৃষ্ণার্ত হৃদয়; তুমি কাকে গ্রহণ করবে-অন্ধকারকে, আমাকে, নাকি এই শূন্য নদীতীরের ব্যথিত বৃক্ষের চাপা দীর্ঘশ্বাসকে?
পৃথিবীতে বিশ্বাস হারানোর মতো প্রতিদিনকার ঘটনা এতবেশী যা কবিকে আলোড়িত করে কিন্তু তিনি নিজের উপর আস্থা রাখতে চান। রাহাজানি-ছিনতাই-খুন-ধর্ষণ যেখানে নিত্যকার ব্যাপার প্রত্যেক দিনের দিনগোজরান, প্রতিকারবিহীন সময়ে রাষ্ট্র-সমাজ কেউ নিরাপত্তা দিতে পারছে না, ব্যর্থ সেখানে কবি যেমন বিদ্রোহী হতে পারেন না,
আবার মেনেও নিতে পারেন না। তার বিশ্বাসে ফাটল ধরে। কবি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, এত হতাশা, এত অস্তিত্বসংকট কিন্তু কবি প্রেমের মধ্যেই, তার প্রেয়সীর মধ্যেই সবকিছু ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন। প্রচণ্ড রোমান্টিক এই কবির কবিতার সাথে তার অনেক কবিতাকেই মেলানো যায় না। হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেছে তার জীবনদর্শন, নাকি জীবনের গতিপথ। প্রেমেই মুক্তির বৈতরণী এই দীক্ষা অলখে দূর হতে টানছে যেন তাকে।
ঋষ্যশৃঙ্গের মতো আজ আমি মেনে নিই স্বেচ্ছা-পরাজয়,
তোমার প্রেমের কাছে পরাজিত হতে আমি
উন্মোচিত করে দিই আমার যৌবন।
অথবা
পর্দার আড়ালে নিজেকে অমন করে
ঢেকে রেখেছো কেন?
অচেনা মানুষের কাছে নিজের সৌন্দর্যকে
কখনো উন্মোচিত করতে নেই বুঝি?
আমার কথায় তুমি মৃদু হাসলে
এবং মুহূর্তেই সবটুকু আবরণ খুলে ফেলে
নিজেকে তুলে ধরলে ভেনাসের মতো।
উন্মোচন
অথবা
শৃঙ্গের মতো দুই পাহাড়ের মাঝখানে
ডুবে যাই আমি।
শুধু জানি সমুদ্র ও পাহাড়ের মাঝখানে আমার মরণ!
মানুষ নিজস্ব অবস্থানে সময়কে বুঝতে চায়, ব্যাখ্যা করতে চায়। পারিপার্শ্বিক অবস্থান অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা সৃষ্টি করে। শিশুকালীন সময়ে যে শিশু মায়ের হাত ধরে চাঁদের পিছু পিছু ছুটে ভাবত চাঁদও বুঝি তার পিছু পিছু ছুটছে, জীবনের বীভৎসতায়, অভিজ্ঞতার সমারোহে চাঁদের মৃত্যু কল্পনা করতে পারে সেই, তার চোখের তারায় জানালার শার্শিতে নগ্ন-নৃত্যে চাঁদকে মেতে উঠতে দেখে। ভাঙা-গড়ার মাঝেও অনাগত দিনের স্বপ্ন মরে যায় না তার শিল্পরূপের সাধনা অসীম সাহার কবিতার পরতে পরতে। তিনি নিরাশাবাদ দিয়ে শুরু করেছিলেন, দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ কবি নিরাশাবাদী থাকছেন না, ক্রমেই আশাবাদীতা তাকে গ্রাস করছে, তিনি আশাবাদী হতে চাইছেন, প্রেমসত্তা তাঁকে গ্রাস করে নিচ্ছে। প্রেমের কবিতায় সত্যিকার অর্থেই অন্যরকম অসীমের খোঁজ পাওয়া যায়, ভিন্নার্থে-অন্যত্র রাজনৈতিক সচেতনতা, উদ্বাস্তুজীবন সবকিছু যেখানে আড়াল হয়ে যায়।