বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, এই সংকটকালে তুমি মোহগস্ত হ’লে কেন? ক্লিব হয়ো না, ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ কর। অর্জুন বললেন, মধুসূদন, পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণকে আমি কি ক’রে শরাঘাত করব? মহানুভব গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্ষা ভিক্ষান্ন ভোজন করাও শ্রেয়। আমি বিহ্বল হয়েছি, ধর্মাধর্ম বুঝতে পারছি না, আমাকে উপদেশ দাও, আমি তোমার শরণাপন্ন। (ভীষ্মপর্ব/ ভগবদ্গীতা/ মহাভারত, রাজশেখর বসু কৃত সারানুবাদ)

বাংলা আরো ব্যাপক ভালভাবে বললে বাঙালির কোনো দর্শন নেই, (প্রাজ্ঞবাক্য) তাহলে কি আছে— কেহ কেহ কয়েন, কালচার (culture) সংস্কৃতি অর্থে; আর আছে নিম্নবর্গীয় অহং অথবা ধর্মীয়বোধ। আপাত সারল্যে ব্যাপারটা আত্মস্থ-ধ্যানস্থ করা সত্যিই দুরূহ, বলা যায়— ভাবমার্গের সুস্পষ্টতা বাংলা তথা বাঙালীর আপন অধিকার। আলস্য আর কর্মনিস্পৃহতা তার পুরুষ-পৌরুষক্রমে বংশপরম্পরার স্মারক। জাতিগত প্রাপ্য অর্জনকে সে যেমন চেনে না, তেমনি অনুসন্ধান করে না তার শ্রেষ্ঠয়তাকে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নিচুতাকেও সে আপন ঔদার্যে শ্রেষ্ঠ ভাবে (অন্যরা তাকে শিখিয়েছে)। হোমি ভাবা’র ‘আত্ম-পরিচয় অর্জন হল আত্ম-পরিচয়ের প্রতিরূপ নির্মাণ’ অথবা দেকার্তিয় `cogito ergo sum’, ‘আমি আছি তাই আমি অস্তিত্বশীল’ বিষয়টি মোটেও তা নয়। আর্য-অনার্য অথবা হালে প্রাচ্য-প্রতীচ্য বিরোধ রয়েই যায় মননে, পরিচয় সংকট নতুন করে উসকে দেয় যেনবা।
আত্মহনন শব্দবন্ধ আমার প্রিয়, কেননা বাঙালী আপন স্বাধিকারে কৌমার্যে একে নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে স্বগৌরবে। প্রায়শই মনে হয় গ্লানি তার আছে কি-না সন্দেহ, অথবা ঐতিহ্যচেতনা বা অতীত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। আর্যরা এ দেশীয় অনার্যদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যেমন করতে পেরেছে সহজে, তেমনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে। উপনিবেশের মোহনমায়ায় এদেশের আদি অনার্যরা (আর্যরা তাদের আদর করে দাস আখ্যা দিয়েছিল) এমনতর মজেছে যে, আজো তার ছোঁয়াচ টের পাওয়া যায়। তার পরের ইতিহাসতো উপনিবেশেরই। অনন্তর বিদেশীরা এসেছে, বিস্তার করেছে তাদের সাম্রাজ্যের ডালপালা।
বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য তাবৎ ক্রমোন্নতি সভ্যতার গতিমুখ, গতিপথ আমূল পাল্টে দিয়েছে সত্য; আপাত দৃষ্টিতে। বিজ্ঞাননির্ভর হয়েছি আমরা বটে, নিজের নির্ভরতা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি, কিন্তু আচার-আচরণ-ধ্যান চিন্তায় স্থবির-পঙ্গু-জড় চিন্তার ভার বইতে হচ্ছে আজো। ফলে বিজ্ঞানের বাহ্যিক খোলস স্কন্ধে চাপলেও আন্তর-সম্পর্ক বিজ্ঞানবিমুখই রয়ে গেছে; যুক্তিপটু হয়ে যুক্তির শর-জালে নিজেদের সঁপে দিয়েছি মাত্র। নিত্যনতুন চাপিয়ে দেয়া শব্দের ভারে নতজানু আমরা, একটার পর একটা শব্দ আসছে, গলদঘর্ম হচ্ছি নিত্য।
পলাশীর পর ইংরেজরা এদেশের বিস্তর ধনসম্পদ লুঠ করে স্বদেশে নিয়ে যায়, তাদের নানামুখী নীতি ও আইনকানুন এবং শিল্পবিপ্লবের চাপে বাংলার বিখ্যাত বস্ত্রশিল্প লোপ পায়। ঔপনিবেশিক-ব্যবস্থায় এ দেশী বণিক ব্যবসায়ীদের স্বাধীন উদ্যোগ ও সম্প্রসারণের সুযোগসুবিধা দ্রুত কমে আসে। গোড়ায় এ দেশী দোভাষী, দালাল, পাইকার, মহাজনেরা কোম্পানীর সেবা করে এবং অল্প কিছু বণিক ব্যবসায়ী ইংরেজদের সহযোগিতা করে দ্রুত ফুলে ফেঁপে ওঠে, কিন্তু তাদের টাকা মুখ্যত নিযুক্ত হয় জমি কেনায় এবং ব্যয়িত হয় বেহিসেবী ব্যসনে-উৎসবে, আচার-অনুষ্ঠানে। স্বাধীন ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ কম এবং তাতে বিস্তর ঝুঁকি-ঝামেলা দেখে তাদের সন্তানেরা বিশেষ করে ইংরেজী শিক্ষিতরা সরকারী ও বেসরকারী চাকরিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, যা থেকে আজও আমরা বেরুতে পারিনি। অস্তিত্বসংকটের হাত ধরাধরি পরিচয় সংকটও বড় হয়ে ওঠে।
আর্য থেকে মুঘল-আফগান-আরব মুসলমান হয়ে ইংরেজ পর্যন্ত যে বিশাল ভাগ্যান্বেষী অথবা সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক শক্তি এদেশের বিপুল-বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে নিছক ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে এসেছিল তারাই একদিন যখন ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে তখন থেকেই কি পরিচয় সংকটের সূচনা? প্রভাববিস্তারক হিসেবে যদি একে বিবেচনা করা হয়, তবে মনে হয় এগুলো সত্যিকারভাবেই আরো পরের ঘটনা। আর্য কিংবা মুঘল-আফগানরাতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ দেশের সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেছেন। বৃহত্তর অর্থে— জাতী কিংবা রাষ্ট্রনৈতিক রাজনীতির সাথে ভারতবর্ষের পরিচয় আরো পরে। এখানে জাতি-রাষ্ট্র-সাম্রাজ্য সম্পর্কিত ধারণার যেমন অভাব ছিল, তেমনি রাষ্ট্র-পরিচালনায় এ দেশীয়রা বরাবরই অনীহ এমন ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আধ্যাত্মিক-মরমিয়া কিংবা মুনি-ঋষিদের তপোবন প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি এরা। বেদ বা কর্মকাণ্ডে যৌক্তিক কারণে এরা পিছিয়ে পড়ে অথবা আগ্রহের অভাবে বেশি দূর এগোয়নি, পক্ষান্তরে উপনিষদ বা জ্ঞানকাণ্ডে এদের প্রবল উৎসাহ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত উপনিষদ দ্বারা প্রবলভাবে নিমজ্জমান, গানে কবিতায় উপনিষদকে আঁকড়ে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে উপনিষদীয় চিন্তার প্রবল প্রতাপ আমাদের মস্ত ক্ষতির কারণ, আখেরে।
বৃহৎ সাম্রাজ্যবিস্তার কিংবা কিছুটা সাফল্য মনে হয় সম্রাট অশোকের সময়ে সম্ভব হয়েছিল। আর উদার ভারতীয়রাতো বরাবরই আর্যদের যেমন আলাদা একটা জাত হিসেবে মেনে নিয়ে গ্রহণ করেছিল, তেমনি গ্রহণ করেছিল মুসলমানদেরও। ইংরেজদেরও ভেবেছিল বহুজাতিরই একটি, ‘না হয় আর একটা জাত বাড়ল’, এমন ভাবনাও এ দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অসংগত নয়। বিজাতীয় বহিরাগত প্রতিটি শক্তি যেমন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে বড় করে দেখেছে, এ দেশীয়দের হীন করার চেষ্টায় মেতেছে, প্রকৃত আত্মগ্লানি বা পরিচয়সংকট কি তখন থেকেই দানা বেঁধেছে আমাদের মনে? প্রকৃত উদ্দেশ্য আড়াল করতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দোহাই দিয়েছে সভ্যতার; সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটানোই না-কি তাদের উদ্দেশ্য ছিল? মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ যখন অহিংসার বাণী প্রচার করেন, নিম্নবর্গীয় মানুষ যখন দলে দলে বুদ্ধের বাণীর শীতল ছায়ায় শরণ নিল, বহু জাত-পাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজে প্রবল আলোড়ন তুলল তা। উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শক্তি সহজে মেনে নিতে পারল না, যতদিন রাজশক্তির ছায়ায় বুদ্ধধর্ম ততদিন বড় ধরনের কোনো সংঘাত মোকাবেলা করতে হয়নি তাদের, কিন্তু যখন ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গীয়দের প্রভাব-প্রতাপ বাড়ল, তখন নির্মমভাবে বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করা হল, অত্যাচার করা হল অকথ্যভাবে। ইসলামের আগমনে অত্যাচারিত নিম্নবর্গের মানুষ এবং বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে সে ধর্ম গ্রহণ করল নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে। এ-ও তো পরিচয় সংকটেরই ভিন্ন রূপ। ইসলাম গ্রহণ করলেও আত্মপরিচয় সংকট সহজে নিষ্কৃতি দিল না তাদের। আশরাফ-আতরাফে মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে গেল। আবার কেউ কেউ নিজেদের পরিচয় এদেশের বাইরে আরবের মাটিতে খুঁজে নিতে চেষ্টা চালালেন। ইংরেজরা এ দেশীয়দের পরিচয়সংকটকে আরো তীব্রতা দিল নানা কায়দায়, নানা কেরামতিতে। ধর্মীয় পরিচয়ে স্বতন্ত্র্য জাতিসত্তায় চিহ্নিত করবার প্রবণতা প্রবল হয়ে দেখা দিল। ঔপনিবেশিক মগজ ধোলাইয়ে বিপন্ন এক নতুন জাতিসত্তা, নতুন ভাবনা জারক-রসে জারিত হল। প্রভুদের শেখানো বুলিতে আস্থা স্থাপন করতে শিখল।
বুদ্ধের সময় থেকে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের বিলোপকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণদের ঘাত-প্রতিঘাতের বিস্তর সাক্ষ্য বিদ্যমান। হিন্দুদের ওপর বৌদ্ধদের প্রভাব অথবা বৌদ্ধদের ওপরে হিন্দুদের প্রভাব যতখানিই পড়ে থাক না কেন, দুঃখবাদ, সংসারবিমুখতা এবং সন্ন্যাসী অথবা ভিক্ষুর আদর্শের জন্য কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে ঋণী ছিলেন একথা ধোপে টেকে না। এই ধারাটি ভারতবর্ষে সম্ভবত ইতিহাসের সূচনা থেকেই ছিল, কখনো বেশি কখনো কম প্রাধান্য পেয়েছে। ঐতিহাসিকের মতে জৈনদের আদি তীর্থঙ্কর ঋষভ ছিলেন নবম খ্রিস্টপূর্ব শতকের মানুষ। তবে সংঘ জাতীয় সংগঠনের পরিকল্পনা সম্ভবত বুদ্ধ থেকেই শুরু হয়।
বিশুদ্ধ পরিচয়সংকট নাগরিক তথা নগরসভ্যতার দান এমন মনে করার কারণ নেই। কেননা আরো পেছনে তাকালে বিষয়টি টের পাওয়া যায়। সিন্ধুসভ্যতার ভিতরে থেকে কোনো বিবর্তনমুখী শক্তি ঐ সভ্যতাকে কোনো উন্নততর স্তরে নিয়ে যায়নি। আর্যগোষ্ঠীরা বহিরাগত, তারা জোরজবরদস্তি করে নতুন নতুন অঞ্চল দখল করেছিল। তবে এদেশে আর্য নামে খ্যাত গোষ্ঠীদের প্রবেশের আগেই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল। বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান-ব্রিটিশ আমলেও এখানে নগর গড়ে ওঠেছে। তবে নগরের সাথে পরিচয়-সংকটের কিছুটা যোগসূত্র আছে তা হয়ত অস্বীকার করা যাবে না। ইংরেজরা নিজেদের শাসন-শোষণ নিরবচ্ছিন্ন করতে অনেক কৌশলের জন্ম দিয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পাতল রেল-লাইন, করল ডাক-ব্যবস্থার প্রবর্তন, আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোর সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় তখনই, অস্বীকার করা যাবে না। প্রবল জাত্যাভিমানে ইংরেজদের সাথে সাথে ইংরেজ হয়ে উঠবার কসরত দেখায় কেউ কেউ। তবে প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। উনিশ-শতকের বাঙালীর সাধনার বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল জাতী-বৈষম্য। ব্রিটিশরা চেয়েছিল এমনভাবে শিক্ষিত করতে যাতে করে আমরা তাদের অধিনস্থ হয়ে থাকি চিরকাল। বিদ্যাবুদ্ধি ও পদমর্যাদায় বাঙালী তখন ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হয়ে ওঠেছিল কিন্তু সম-মর্যাদার স্বীকৃতি তারা পাননি। শুধু সম-মর্যাদা নয়, ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে বেতন-বৈষম্য ছিল। জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র এই বেতন-বৈষম্যের কবলে পড়েছিলেন। শিক্ষা ও গবেষণার মানের তুল্যমূল্যে জগদীশচন্দ্র বসু সেই সময় উচ্চে থাকাসত্ত্বেও উচ্চতর গ্রেডের বেতন দেয়া হয়নি তাঁকে। প্রতিবাদে দীর্ঘদিন বেতন নেননি তিনি। এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে উনিশ শতকের শেষের দিকে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেন অনেকেই। উনিশ-শতকের বাঙালী প্রতিকূলতার মধ্যে জাতী হিসেবে আত্ম-পরিচয় খুঁজে নিতে সচেষ্ট হয়।
আপাত উপনিবেশের অবসান ঘটেছে দীর্ঘদিন। স্বশাসনের স্বাদ আস্বাদনে নিমগ্ন বাঙালী। উত্তর-ঔপনিবেশিককালেও মগজ থেকে বিষ পুরোপুরি বিতাড়ন সম্ভব হয়নি। নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। নিত্য নতুন নামে নিত্য মগজ ধোলাইয়ে আচ্ছন্ন আমরা। বিশ্বায়নের নামে ব্যক্তিকে করে ফেলা হয়েছে একক, স্বতন্ত্র, পর-নির্ভরশীল। প্রথমবিশ্ব, দ্বিতীয়বিশ্ব, তৃতীয়বিশ্ব বা উন্নয়নশিল দেশের তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে ললাটে। সন্ত্রাসবাদের নামে পুরোনো ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। (সম্প্রতি শাহরুখ খানের আমেরিকা গ্লানিতো পুরোনো নাটকেরই নতুন মঞ্চায়ন।) বহুজাতিক কোম্পানির বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ-বাণিজ্যে মানুষকে আরেক ধাপ পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। বিস্মৃত করা হচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, অথবা বাণিজ্যিকতার বাতাবরণে ঢেকে দেয়া হচ্ছে নিজস্ব বোধ কিংবা বিবেচনাশক্তি।
ঔপনিবেশিক শাসনের কালেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনেই এই শ্রেণীর বিকাশে সহায়তা দিয়েছিল। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই বিভিন্ন ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। আবার রেনেসাঁস থেকেই ইউরোপিয় মানস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এদেশে। আঠার-শতকের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে এটি সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করে। যন্ত্র-প্রচার-মারণাস্ত্রের সাহায্যে সারাবিশ্বকে নিজস্ব প্রভাববলয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় তারা। লজ্জার কথা, রেনেসাঁসের মানুষই সাম্রাজ্যবাদী ও বিকৃত চেহারায় পরিণত হয়। বুর্জোয়াতন্ত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সহায়তায় পৃথিবীর ক্ষুদ্র-প্রান্তিয় দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর উপর আর্থিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। সর্বগ্রাসী পণ্য ও বাজার দখলের স্বার্থে গড়ে তুলেছে বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। ফলে স্বাভাবিক কারণেই মানুষের পরিচয় বেঁকেচুরে যাচ্ছে প্রতিক্ষণ।
আবার ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে ওঠে স্থানীয় সংস্কৃতি ও পারিবারিক জীবনের ওপর ভিত্তি করে। আবেগ, অনুভূতি সমাজের আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সময় সামাজিক যে পরিচয় গড়ে ওঠে তা বিস্তৃত হয় আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা তথা গ্লোবালাইজেশন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তিক দেশকে হয় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে, নয় জুড়ে দিচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে। বিশ্বায়নের চাপে-তাপে শহর ও গ্রামের সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। রাজনীতি, নয়া-ঔপনিবেশিক স্রোত, মুক্তবাজার, বহুজাতিক আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদী সবকে মানুষ দিশেহারা। আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রথাগত মানে বদলে যাচ্ছে। কৌশলে বিলুপ্ত করে দেয়া হচ্ছে ব্যক্তিসত্তাকে, সমষ্টির আড়ালে। ব্যক্তিকে করে ফেলা হচ্ছে একক, স্থবির, পঙ্গু, অথর্ব, চিন্তাশূন্য। বিপ্লব বা চিন্তার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চলছে নানা আয়োজন। বিশ্বব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানি, প্রতিদিনের দৈনিক, বিনোদন চ্যানেল লাগাতার সেবা করে যাচ্ছে। এ এক ভারচুয়াল রিয়্যালিটির জগৎ যেখানে লক্ষ-লক্ষ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে নতুন এক সংস্কৃতির, যেখানে ব্যক্তির প্রাথমিক পরিচয়, প্রতিষ্ঠান, জাতিরাষ্ট্র ধারণা নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।
বিশ্বায়নের নামে আমরা কি এক নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না ক্রমশ? বিশ্বায়নের পাল্লায় মানবসভ্যতার ১৫,০০০ বছরের ইতিহাস পাল্টে যাচ্ছে, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রশ্নের সম্মুখীন। অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড হিউমের পণ্যভিত্তিক সমাজচিন্তাভাবনার মধ্যেই বিশ্বায়নের বীজ নিহিত ছিল। এরা এমন এক সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করেন যেখানে ব্যক্তিমালিকানা তার পুঁজির সঞ্চারণ সর্বত্রই অবাধ হবে। পুঁজির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা বা কর্তৃত্ব থাকবে না। রাষ্ট্র ও বাজার পরস্পর নির্ভরশীল সুসংহত একটা ধারণা হয়ে ওঠবে। মুক্তবাজার, মুক্তবাণিজ্যের ফলে ধীরে-ধীরে সমাজের বিশেষত অনগ্রসর জাতিসত্তার শিল্পসংস্কৃতি, জীবনধারা পাল্টে যাবে, যাচ্ছে।
ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ক্রমেই তার ডালপালা বিস্তার করছে গৌরবে। বিশ্বায়নে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভাষার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করছে প্রথমবিশ্ব বলে দাবিদার সাম্রাজ্যবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটছে নানাভাবেই। উন্মুক্ত-উদার আকাশসাম্রাজ্যে টিকতে পারছে না স্বদেশী কিছু। আন্তর্জাল ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এমনভাবে ভোক্তা অনেক সময়ই জানে না কি সে নিচ্ছে, গ্রহণ করছে। মোবাইল ফোন সহজিকরণের মাধ্যমে মানুষকে আরেক ধাপ বিপর্যয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, জীবন সাজাবার জীবন বাঁচাবার নামে। নগ্ন অযাচার নগ্ন শরীরী তোয়াজে জীবন নানাভাবেই অস্থির। ভোগের উপকরণ বেড়েছে। কৌশলে মানুষকে ভোগবাদী করে ফেলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। অজান্তেই মানুষ হচ্ছে অবস্থার শিকার। সে জানে না ভোগ উপকরণের পেছনে ছুটতে ছুটতে সে নিজেই হয়ে ওঠছে জীবন্ত পণ্য। অস্থিরতা বাড়ছে, পণ্যদুনিয়া কনজিউমারিজম কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে মানুষকে এই মুহূর্তে আমরা জানি না। সাথে সাথে নিরাপত্তাসংকট বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিভিত্তিক, এথনিক, ধর্মীয়, যৌনতা, লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়সত্তা যেকোনো ব্যক্তির মধ্যে অবচেতনে থাকে। তাকে সে খুঁজে পেতে চায় আপন ভুবনে। তার ভেতরে কৌমবোধ, কোমলতা নিঃশেষিত করে ফেলা গেলে, অনুভূতির ধ্বংস সাধন করা গেলে, অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। উত্তর-ঔপনিবেশিক জামানায় বহুজাতিক আগ্রাসন চলছে কনজিউমারিজমের নামে। ঔপনিবেশিক প্রভু, মিশনারী, ব্যবসায়ী, নৃতাত্ত্বিকদের সংস্পর্শে এসে এখানে বহু নামে পরিচিত হচ্ছে অনেকেই। ঔপনিবেশিক যুগে প্রভু অর্থাৎ দাস ব্যবসায়ীরা যাতে নিজেদের দাসদের চিনতে পারে তার জন্য একটি আইডেন্টিটি দিয়ে দিত। অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে জাহাজ বোঝাই সমুদ্রপথে তাদের উপনিবেশগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত শ্রমের জন্য তাদের পরিচয় ছিল শুধুই ‘দাস’ বা ‘ক্রিতদাস’ হিসেবে। আজকের আধুনিক দাস রাষ্ট্রের পরিচয়ে পরিচিত হয়। তাকে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর ধারণ করতে হয় যার কেতাবী নাম পাসপোর্ট। তৃতীয়বিশ্ব থেকে যখন শ্রমিক নিয়ে যাওয়া হয় উন্নত দেশে তখন তাদের পরিচয় কি? জাতিরাষ্ট্রের উত্থানে রাষ্ট্রের নিজস্ব আইডেন্টিটি গড়ে উঠল, রাষ্ট্র থেকেই ব্যক্তিকে দেয়া হয় পরিচয়পত্র। দেশিয় পরিচয়ে সে এখন পরিচিত হয়। পরিচয় ধর্মভিত্তিকও হয়, যেমন এখন শুধু মুসলিম নাম ধারণ করার কারণেও হেনস্তা হতে হয় উন্নত দেশগুলোতে। পরিচয় অন্য রকমেরও হয়, সাদা মানুষ, কাল মানুষ। সামাজিক স্বীকৃতির প্রশ্নও এসে যায় এই সব পরিচয়ে। ভারতে শুধু জন্মসূত্রিতার কারণেও অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় নিম্নবর্গের, নিম্ন-শ্রেণীর মানুষদের। আবার আধুনিক শ্রমিক নিজের সামাজিক আইডেন্টিটি খোঁজেন লেবার মার্কেটে তার অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। যে লেবার মার্কেট ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আবার ডিজিটাল ইকোনমি যে ইনফরমেশন সোসাইটি তৈরি করছে সেখানে ব্যক্তির সামাজিক পরিচয় ক্রমশ অদৃশ্য। গড়ে উঠছে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক পরিচয়। সমাজে মেলামেশার সুযোগ কমে যাচ্ছে, দূরত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে। শিল্পসমাজে একজন শ্রমিকের যে পরিচয় ছিল তথ্যপ্রযুক্তিসমাজে তাও নেই। আধুনিক শিল্পসমাহারে ৮ ঘণ্টা কাজের যে অধিকার শ্রম আইনে বাঁধা এখানে তা নেই। বিশ্বায়ন শ্রমজীবীদের পরিচয় হয় ইন্টারনেট জালে বন্দি আধুনিক ক্রিতদাস। শৃঙ্খলাহীন মানুষকে কিভাবে একটি সিস্টেমে ধরে রাখা যায় সে সম্পর্কে মিশেল ফুকোর বয়ান: To describe a formulation quo statement does not consist in analysing the relations between the author and what he says (or wanted to say, or said without wanting to); but indetermining what position can and must be occupied by any individual if he is to be the subject of it.
পশ্চিমের দীর্ঘকালিন সাংস্কৃতিক আধিপত্য সম্ভব হয়েছিল উপনিবেশের প্রভাবেই। উপনিবেশিক চর্চা ও সংস্কৃতি তথা ইউরো-আমেরিকান প্রচার মানুষকে আদর্শায়িত করার চেষ্টা চালায় নানা ভাবেই— সাদামানুষ, আদর্শ মানুষ, আলোকিত মানুষের সবক দেয়া হয় কৌশলে। প্রচারক মেলে, বাহবা মেলে প্রচার কৌশলে। আর সোভিয়েত রাশিয়ার পতনে পৃথিবীর এখন একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা। আমেরিকা তার রুচি, ইচ্ছা, মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা, কৌশল চাপিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বের ওপর। সবকিছুই হচ্ছে মানবতার দোহাই দিয়ে, সভ্যতার নামে।
আত্মপরিচয় অর্জন বা সংকটের পর পরই মানুষকে গ্রাস করে অনিশ্চয়তা। বিজ্ঞানের মোহিনি থাবা যতই চমৎকৃত করুক না কেন, বিজ্ঞান মানুষের নিশ্চয়তার আকাঙ্ক্ষায় নির্ভরতা দিতে পারে না। অনিশ্চয়তার প্লাবনে মানুষ দুমড়েমুচড়ে একাকার। ফলত— চাকরি, পদোন্নতি, মামলা, পরীক্ষা, বিয়ে, রোগমুক্তি, নানা আশাতেই মসজিদ-মন্দিরে মানত পড়ে। জিনস, সালোয়ার, কামিজ থেকে সোফা, রঙিন টিভি, ভিডিও, কতভাবেই-না বিশিষ্টতা আর সাফল্য অর্জনের ভরসা যোগায় বিজ্ঞাপন। মুগ্ধ নারী-পুরুষ প্রাণপাত করে অর্থব্যয় করে। শোষিত ও বঞ্চিতদের দুঃখ ঘোচাবার প্রতিশ্রুতি দেয় নানা দল, বুলির উদ্দিপকে মস্ত মস্ত মিছিল বেরোয়, ভোটের জোরে এ দল সে দল ক্ষমতায় আসে। বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলে। চাষি-মজুর দিনে দিনে আরো দরিদ্র হয়ে তার শেষ চাষযোগ্য জমিটিও হারায় (এক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকের গণি মিয়ার গল্প স্মর্তব্য), বস্তির মানুষ ঠেঙিয়ে বিতাড়িত করে বানানো হয় মধ্যবিত্তের ফ্লাট। ক্ষমতার দালালরা পায় কন্ট্রাক্ট, ফ্লাট পায়, জমি পায়। জনসেবার নামে আসে নানা তহবিল থেকে সরকারি টাকা। বিশ্বব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানী হাত ধরাধরি করে চলে। ব্যবসায়ী চায় মুনাফা, রাজনৈতিক দল ক্ষমতা। এতসব অসূয়া বৈরিতা প্রতিক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ছুটে আসছে পিছু পিছু। তবে কি একমাত্র কুম্ভকর্ণের নিদ্রাই শেষ সমাধান সব থেকে মুক্তির? না। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, বহুজাতিক নয়া-ঔপনিবেশিক হামলা, অসম কর্পোরেট-পুঁজি, বিশ্বায়নের গোলক ধাঁধা-চমক, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ কাহিনীর যত অবিশ্বাস্য গল্পই শোনাক না কেন আত্মনিশ্চয়তা বা পরিচয় সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়— ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের রুপালী গাঁথায় প্রত্যাবর্তন, সেই সব সোনালী দিনগুলোকে সামনে নিয়ে প্রভুদের শেখানো বুলি বা ইতিহাস নয়, বরং নিজস্ব বোধে ফিরে যাওয়া।

বর্ষ ৯, সংখ্যা ১৩, ফেব্রুয়ারি ২০১০