দেখবার বিষয় মহামতি প্লেটো কোন প্রেক্ষাপটে তার আদর্শ রাষ্ট্র নামক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, তার পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিলো, নিছক কল্পনাবিলাস-আবেগ তাড়িত হয়েই কি তিনি এমন স্বপ্নে নিজেকে করেছিলেন সমর্পিত? আদর্শ রাষ্ট্রের চিন্তা প্লেটো কখন থেকে শুরু করেছিলেন, অন্যভাবে বললে প্লেটোর বিবেচনায় একটি রাষ্ট্রে কি কি গুণ বিদ্যমান থাকলে রাষ্ট্রটি আদর্শ বলে বিবেচিত হবে। প্রত্যুৎপন্নমতিতা, ন্যায়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামোগত সৌন্দর্য, শাসক, ভূমি, ভৌগোলিক অবস্থান কতটা বিবেচ্য সেখানে। গুরু সক্রেটিসের মৃত্যু এবং তৎকালিন এথেন্স নগরির শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপর্যয় প্লেটোর চিন্তায় ক্রিয়াশিল ছিল, তিনি কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন। সংক্ষোভ-স্বপ্ন, নাগরিক মননের উৎকর্ষতা, সম্মিলিত রাষ্ট্রের সার্থকতা তার চিন্তায় প্রবল ছিল। তিনি রাষ্ট্রে ন্যায়ের তত্ত¡তালাশ করেছেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেকখানি স্থিতু, পূর্ণতা পায় এমত সিদ্ধান্ত তার ছিলো। দেখার বিষয় রাষ্ট্রে কি ন্যায় বা নৈতিকতা এমনি এমনি প্রতিষ্ঠিত হয়, না তার জন্য কিছু আয়োজন-উপাচারের দরকার পড়ে বৈকি! প্লেটো তাই তার ‘রিপাবলিক’ নামক গ্রন্থে ন্যায়ের অনুসন্ধান দিয়ে যাত্রা করে একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার পূর্ণতার দিকে ধাবিত হন। ‘রিপাবলিক’-এর প্রথম অনুসন্ধানই ছিলো-ন্যায় কি, অথবা শক্তিমানের স্বার্থরক্ষাই ন্যায় কি-না। রাষ্ট্র প্রবল শক্তি ও সামর্থ্যরে বিচারে। এই রাষ্ট্র তার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ নাগরিকের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রয়োগ করার অধিকার রাখে? ন্যায় দিয়ে শুরু করলেও প্লেটো তার বিবেচনায় রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনায় নিয়োজিত শাসকদের অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে এমত সিদ্ধান্তে উপনিত হন। তিনি মনে করেন, একমাত্র দার্শনিক শাসকরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের আপাত অসামঞ্জস্যতাগুলো থাকবে না।
এই যে দার্শনিক-জ্ঞানবান শাসক অন্যকথায় বিবেকবান শাসক তার জন্য কয়েকটি ধাপ অবশ্যই তাকে অতিক্রম করতে হবে। সমতার প্রশ্নটি এখানে উত্থাপিত হয় জোরেসোরে। প্লেটো আদৌ সমতায় বিশ্বাস করেন কি? আপাতদৃষ্টিতে ‘রিপাবলিক’ বিশ্লেষণ করলে একথা বলার যুক্তি থাকে না, প্লেটো সমতায় বিশ্বাসি। ক্লাস বা শ্রেণি প্লেটোর চিন্তায় ছিলো। তিনি কখনোই মনে করতেন না সকল মানুষ সমান গুরুত্ব পাওয়ার অধিকারি। জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মনন-মেধা সকলের একই কাঠামোয় বিরাজ করে না। শ্রেণি বা বর্ণপ্রথার আওয়াজ ছিলো তার চিন্তায়। তিনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্মবিভাজনের সুবিধার্থে সোনার মানুষ, রুপার মানুষ, লোহার মানুষ, তামার মানুষ এমত শ্রেণিকরণ করেছেন। তবে এই শ্রেণিবিভাজন একটি যুক্তিতে ধোপে টিকতে পারে আর তাহলো শ্রেণিকরণ না বলে যদি আমরা বলি যোগ্য লোকের যোগ্য জায়গায় প্রতিস্থাপন। অর্থাৎ যার যা যোগ্যতা তাকে দিয়ে ঠিক সেই কাজটি করানো বা করতে দেয়া। যিনি যে বিষয়ে যোগ্যতা-দক্ষতা-কর্মব্যবস্থাপনায় এগিয়ে গেছেন সেই ব্যাপারে তার কাছ থেকেই পরামর্শ নেয়া।
প্রায়শই আমাদের মতো অনুন্নত দেশে দেখা যায় যিনি যে বিষয়ে কথা বলছেন সেই বিষয়ে তা কোনো যোগ্যতা-দক্ষতা নেই। সেই বিষয় তার কোনো ধরনের যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ ছিল না কখনো। রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় হয়তো দেখা যাবে একজন কৃষিবিদ রাষ্ট্র বিষয়ে তার মতামত দিয়ে দিলেন। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানি দিচ্ছেন কৃষির ওপর ছবক। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্লেটো বলেন আদর্শ রাষ্ট্রে এই সুযোগ রহিত করা হবে, কোনো বিষয়ে যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করতে হলে তাকে সেই বিষয়ে যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করে তবে সেই বিষয়ে কথা বলতে হবে।
আর রাষ্ট্রের অনিবার্য প্রয়োজনেই শিক্ষা জরুরি। শিক্ষাকে কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। রাষ্ট্রের নাগরিকরা সেই পর্যায়গুলো অতিক্রম করবেন, এবং সবশেষ পর্যায়ে তারা দার্শনিক হিসেবে পরিগণিত হবেন। বাস্তবতায় প্লেটোর রিপাবলিকের অনেক কিছুই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গ্রহণ করা যায়নি কিন্তু গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে অনেকখানিই যে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা সম্ভব তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এসব আলোচনার পেছনে প্লেটোর একটি গোপন ইচ্ছা প্রচ্ছন্ন ছিলো, তাহলো আদর্শ রাষ্ট্রের আড়ালে জ্ঞানতত্ত্বের বিশ্লেষণ। উপমা, বিশ্লেষণ, রূপকের আড়ালে তিনি জ্ঞানতত্ত¡কে পরিণতির দিকে নিয়ে যান। গুহার বিখ্যাত রূপক, অশ্বত্বের ব্যাখ্যা, অনুকরণের অনুকরণ ইত্যাদি দ্বারা একটি রাষ্ট্রের পর্যায়ক্রমিক বিভাজন এবং নাগরিক সমাজকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। যিনি নিজে সৌন্দর্যের পূজারি, সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলেছেন।
রিপাবলিকের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে ছন্দের কারুকাজ, কাব্যিকতা। সেই প্লেটো শিল্পি বিশেষ করে কবিদের উপর কেন হলেন বিরাগভাজন, খড়গহস্ত? নির্বাসন দিতে চাইলেন কবিদের তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে। কবিদের প্রতি তার ক্ষোভের কারণ কি? অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই তিনি এমন সিদ্ধান্তে উপনিত হন সন্দেহ নেই। আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শিল্পিরা অন্তরায় হিসেবে উপস্থিত হতে পারে এমন মনে হওয়ার কারণ কি?
তার প্রধান যুক্তি শিল্পিরা অনুকরণ করেন। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুকরণের অনুকরণে পর্যবসিত হয়। প্লেটোর ভাষায় যা সত্য থেকে তিন প্রস্থ তফাতে অবস্থিত। মেকি, আবেগপূর্ণ এবং ভ্রান্ত ধারণার উপর যা প্রতিষ্ঠিত। আবার কবিরা একেক সময় একেক কথা বলেন, অর্থাৎ কবিদের প্রয়োজনে কবিরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেন। তারা লোভি, লম্পট, আদর্শশূন্য। তাই যতোই সৌন্দর্য তারা সৃষ্টি করুক না কেনো প্লেটোর বিবেচনায় তা গুরুত্ব পেতে পারে না। প্লেটো বিখ্যাত হোমারের পরস্পরবিরোধি অনেক উক্তি দিয়ে তার বক্তব্যকে প্রমাণ-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। গুহার রূপকের মাধ্যমে বলবার চেষ্টা করছেন যতোই সৌন্দর্যময় প্রতিষ্ঠা তাতে থাকুন না কেনো যখন ভ্রান্তির দিক উন্মোচিত হয়ে যায় তখনই তার অসারতা সামনে চলে আসে। আবার শিল্পি যা সৃষ্টি করলেন বলে দাবি করছেন তা তো আসলে অনুকরণ। তিনি একটি বিড়ালের কবিতা অথবা চিত্রকর্ম আঁকলেন, সেটা তো আসল বিড়াল নয়। আসল বিড়ালটি অন্য কোথাও রয়েছে, যাকে তিনি নাম দেন বিড়ালত্ব বলে। তবে তিনি এক জায়গায় কবিদের প্রশংসা করেছেন তাহলো সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে। কিন্তু পরক্ষণে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এই বলে যে, কবিবর হোমার আপনি যতোই সৌন্দর্য সৃষ্টি করুন না কেনো, রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কেনো আপনার কাজকে গুরুত্ব দেবে, আপনি কি কোনো রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, না এমন কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে যেখানে আপনার নেতৃত্ব ছিলো।
প্লেটো শিল্পি-কবিদের নিয়ে যেসব অভিযোগ করেছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে তার আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা থেকে বাইরে রেখেছেন, তা যুক্তিপূর্ণ ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং অনেকটা আবেগপ্রসূত, প্লেটোর মতো প্রতিভাধর একজন বড় মাপের দার্শনিক কবির খেয়াল বলেই ভাবা যেতে পারে। আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তায় প্লেটো স্বৈরাচারি ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে যোগ্য লোকের যোগ্য প্রতিস্থাপন সময়ের বিবেচনায় বেশ উৎরে গেছে। বাংলাদেশ তার এই একটি নীতিতে আস্থা রাখলে আখেরে ভালো ফল ফলতে পারে। বাস্তবতায় জ্ঞানের সিমানা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ব্যপ্তির জায়গা ক্ষুদ্র হয়ে গেছে সেটা স্বিকার করে নিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।