সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয় এক বৈশাখের অনুষ্ঠানে। অফিস তখনো এখনকার পরিবাগের ঠিকানায় আসেনি। সেন্ট্রাল রোডের কোনো বাসায়-বোধ হয় কেন্দ্রের তখনকার অফিসে-বৈশাখি আয়োজন হয়েছিল। টুটুল ভাই ঢাকার ছেলে। এ ধরনের ঠেকগুলোর সাথে তার নিবিড় পরিচয়। আমি ঘোর গ্রাম থেকে আসা মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ি। বিভিন্ন পাঠচক্রে ঢু মেরে বাড়তি রকমের গ্রাম্যতা আর ততোধিক দ্বিধা নিয়ে ভাবসাব বুঝার চেষ্টা করি। তো, সেই বৈশাখে ভিড় আর রোদে ঘোরাঘুরি করছি। টুটুল ভাই বলল, চল, এক জায়গায় নিয়া যাই তোমারে। খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত আছে। খাওয়া-দাওয়ার কথায় ভড়কে যাই। উটকো লোক হিসেবে যেতে মনের সায় পাচ্ছিলাম না। টুটুল ভাই অভয় দিলেন-আরে, লিয়াকত ভাইয়ের অনুষ্ঠান সবার জন্য খোলা। সেই প্রথম লিয়াকত ভাইয়ের নাম শুনি। তাঁকে ঐ দিনই প্রথম দেখেছিলাম। তো, অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেখি, দোতলায় সম্ভবত, একটা বড় ঘরে সাদা কাপড় পেতে বসার আয়োজন হয়েছে। আমরা ঢুকতে ঢুকতে শুননাম মিতা হক গান গাইছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে ধরনের বৈশাখি উৎসব দেখে আমি অভ্যস্ত, এই এনতেজামের সাথে তার কোনো মিল ছিল না। হৈ-হুলোড় নাই। ভিড়ভাট্টা বা গা-ঘেঁষাঘেঁষি নাই। চোখে পড়ে এমন মাত্রার ছিমছাম নিরিবিলি অনুষ্ঠান। উপস্থিত লোকদের অনেকেই পরস্পরের পরিচিত। ফলে পুরো অনুষ্ঠানটির মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতা ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেটে প্লেটে খাবার দেয়া হল। আমরা খেলাম। গান-কবিতা-আলাপ শুনলাম। চলে এলাম।
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের সাথে পরে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এর বহু আয়োজনে নিয়মিত গেছি। অনেকগুলোতে বক্তা হিসেবেও শরিক ছিলাম। সবগুলোতেই এই কেন্দ্রের নিজস্ব ঐ বৈশিষ্ট্য-গোছগাছ আর আন্তরিকতা-লক্ষ করেছি। লিয়াকত ভাইয়ের জন্যই বোধ হয় এমনটা হয়েছে। তিনি কাজ করেন প্রচুর, কিন্তু উচ্চবাচ্য করেন কম। চিন্তা ও কাজের শৃঙ্খলা তাঁর বৈশিষ্ট্য। বলা যায়, এই কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্যও তাই। অবশ্য গোছানো আর ছিমছাম হওয়াটা সবসময় খুব ভাল বৈশিষ্ট্য-এমন প্রপাগান্ডা আমার উদ্দেশ্য নয়। হট্টগোলের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। গোছগাছের কমতির মধ্যে অনেক সময় সৃজনশিলতার পরিসর অনেক বেশি পাওয়া যায়। এসব জানি ও মানি। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের একটা মোটা দাগের বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম। আর বলতে চাইলাম, সম্ভবত লিয়াকত ভাইয়ের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য এতে সঞ্চারিত হয়ে থাকবে। লিয়াকত ভাই তো তরুণদের এই জিনিস শেখাতেও চেয়েছেন। নিবিষ্টভাবে বহুদিন ধরে চিন্তার ইতিহাসের যে পাঠচক্রটি তিনি চালাচ্ছেন, তাতে তিনি শেখাতে চেয়েছেন চিন্তার প্রণালি-পদ্ধতি।
পরিবাগ মাজারের কাছে এক জায়গায় দর্শন পড়ানো হয়-এই সংবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমার কাছে আগেও পৌঁছেছিল। রোমেলের কাছে শুনেছিলাম হয়তো। হয়তো টুটুল ভাইয়ের কাছে। তবে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে মনে আছে নিজারের কথা। নিজার তখন সবে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছে। সে কমার্সের ছাত্র। কিন্তু বিলাত যেতে চায় দর্শন পড়তে। খায়েশের এই ধরনের সাথে আমাদের বিশেষ পরিচয় না থাকায় আমরা তার দিকে বেশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলাম। সে তখন বার্ট্রান্ড রাসেল পড়ে শেষ করেছে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘোরে। যার-তার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়। আর তর্কের এক পর্যায়ে পদ্ধতিমাফিক তর্কের সুবিধার্থে কাঁধের ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করে আঁকাআঁকি শুরু করে। আমাদের তুমুল ওরাল ডিসকোর্সে সৈয়দ বংশের পোলা সিলডি নিজার আলম এভাবে মূর্তিমান ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তো, নিজারের নানান জায়গায় গতায়াত। লিয়াকত ভাইয়ের ক্লাসেও সে দুইচারবার গেছে। তার নিজের বোধ হয় খুব পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমাকে সে ফুসলায় ওখানে যাওয়ার জন্য। বলে, আপনার জন্য ভাল হবে। অবশ্য সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের এই পাঠচক্রের খবর কেউ না জানালেও আমার জেনে যাওয়ার কথা। শাহবাগ, আজিজ মার্কেট আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ বাবদ বিস্তর পোস্টার পড়ে। জমকালো উদ্বোধনি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে কিছু কথাবার্তা, কোর্স পরিচিতি আর খাওয়া-দাওয়া। তো, খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি সেবার ‘চিন্তার ইতিহাস’ কোর্সে দাখিল হয়ে গেলাম। সপ্তাহে একদিন ক্লাস। কড়াকড়ি ধরাধরি নাই। যার ইচ্ছা এলো, যখন ইচ্ছা গেল। লিয়াকত ভাই সাধারণত একটা ইংরেজি বই থেকে পড়ে শোনাতেন। ব্যাখ্যা করে দিতেন। তাতে তাঁর নিজের পক্ষপাত চাপা থাকত না। তিনি পশ্চিমা চিন্তার মূলধারার পক্ষপাতি। রেনেসাঁ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, ফরাসি বিপ্লব হয়ে যে ‘আধুনিক’ ধারা বিকশিত হয়েছে-তিনি সংক্ষেপে সেই পথটি বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। যাদেরকে মোটা দাগে ‘ভাববাদি’ বলে চেনা হয়-প্লেটো থেকে রুশো, হেগেল বা মার্ক্স পর্যন্ত-তাদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ দেখিনি। চিন্তার যে ধারাকে আমরা ‘পোস্টমডার্নিজম’ বা ‘পোস্টকলোনিয়ালিজম’ বলে চিনি, তার প্রতি কখনো তাঁর বিরাগ দেখেছি। যাই হোক, আমি এক বছরের বেশিরভাগ ক্লাস করেছিলাম। যে বই থেকে তিনি পড়াতেন, সেটা কপি করে নেয়ার বন্দোবস্ত ছিল। আমি অবশ্য ঐ পরিশ্রমের দিকে যাইনি।
তখন আমার বয়স অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তখনো ‘জ্ঞান’ অর্জনকে লাভজনক মনে হত। এই অজ্ঞতাবশত আমি অনেকগুলো পাঠচক্রে যোগ দিয়েছি। নিজেরাও অনেক চক্র করেছি। এর মধ্যে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের পাঠচক্র সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি সুবিধাজনক মনে হয়েছে। এই অর্থে যে, এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে যে টাকা-পয়সারও দরকার পড়ে, ব্যবস্থাপনার একটা বেশ বড় ঝক্কি সামলাতে হয়-সেসব কথা কখনো না ভেবে এখানে যাতায়াত করা যেত। অথচ, সুশৃঙ্খলভাবে একটা কাঠামো চললে, তার কিছু আনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি থাকে, বিধিবিধানের কড়াকড়ি থাকে-এই কেন্দ্রে তা-ও ছিল না। কেবল আলোটুকু ছিল, তেজের জ্বালাটা ছিল না। আমরা যারা এক-আধটু সাহিত্য করতাম, তাদের জন্য এই কেন্দ্রের সবচেয়ে আকর্ষণিয় এনতেজাম ছিল সাহিত্যের পাঠচক্রে। সপ্তাহে একটা বই নির্ধারণ করে দেয়া থাকত। কেন্দ্র থেকেই সে বইয়ের কপি ধার নেয়া যেত। সপ্তাহান্তে সেই বইয়ের উপর আলোচনা। এখানে কথা বলার এবং নিজেকে জাহির করার সুযোগ থাকায় আমাদের মধ্যে বাচালদের এ ব্যাপারে উৎসাহ ছিল সীমাহীন। এই চক্র সাধারণত পারভেজ ভাই পরিচালনা করতেন। নিয়মিত থাকত রিসি দলাই, মাজহার ভাই, আদনান, নাইমা, মুজিব মহমমদ। এক আপা আসতেন নিয়মিত। সরলভাবে আন্তরিকতার সাথে আলোচনা করতেন। কারো আলোচনা ভাল লাগলে মন খুলে প্রশংসা করতেন। আরো অনেকে আসতেন তখন। অনেকের নাম মনে নাই। লিয়াকত ভাইও প্রায়ই বসতেন। কথাও বলতেন নিয়মিত। তাঁর সাহিত্যপাঠের একটা ছক তাতে ফুটে উঠত-চিরন্তন মানবিক ব্যাপার-স্যাপার, বিশ্বজনিনতা আর ‘উঁচু’ শিল্পের জন্য জরুরি ‘বিষয়-আঙ্গিকে’র নিপুণ মোলাকাত। নানান মন-মেজাজের আর ক্ষমতার লোক জড়ো হত বলে মতের ভিন্নতাও পাওয়া যেত। যেমন, একবার আল মাহমুদের চারটি গল্প পাঠ্য ছিল। আমরা সবাই খুব প্রশংসা করলাম। কিন্তু রিসি দলাই গাইল একেবারে উলটা গীত। তার মতে, এত দুর্বল রচনা এই চক্রে পাঠ্য করাই উচিত হয়নি। আরেকবার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পাঠ্য। আমার খুবই প্রিয় বই। আমি রীতিমতো সপ্তমে চড়লাম। কিন্তু লিয়াকত ভাই-সম্ভবত আমাকে লক্ষ করেই-বললেন, তরুণরা ছফার হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উৎসাহ আর বাড়াবাড়ির হদিস বোধ হয় খুব একটা রাখে না। রাখলে এই বইয়ের লাগামহীন নানা মন্তব্য আরো সাবধানে পড়ত। এ রকম কিছু তিনি বলেছিলেন। কথাগুলো মনে নাই। কিন্তু আমার আর তাঁর টোনের ফারাক ছিল-এটা বেশ মনে আছে।
তখন আমাদের একটা পাঠচক্র মৌসুম গেছে। আহমদ শরীফের বাসায় স্বদেশ চিন্তা সংঘের পাঠচক্রে নিয়মিত যেতাম। ওখানেও মাঝে মাঝে বই নির্ধারিত থাকত-পড়ে এসে আলোচনার জন্য। আমরা নিজেরাও বহু পাঠচক্র করেছি-মিরপুর, লালমাটিয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কোণাকাঞ্চিতে আর আজিজ মার্কেটের তিনতলায় করিডোরে। এর বেশির ভাগই ছিল স্বল্পায়ু। কিন্তু কোনো কোনোটি বেশ কাজের হয়েছিল। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের চক্রটি ছিল আমার জন্য সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি আর গোছানো। বইগুলো সরবরাহ করা হত, বসার জায়গাটা গোছানো আর ছিমছাম। চা-পানিরও কিছু আয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা এসব আনুষ্ঠানিক আয়োজন পাঠচক্রটিকে আনুষ্ঠানিক করে তোলেনি। শিথিল গেরোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ-সুবিধা-এই কম্বিনেশনের মজাই আলাদা।
এই সাপ্তাহিক পাঠচক্র থেকেই একটা শাখা বের নিলেন পারভেজ ভাই। মাসে একটা বই নিয়ে বিশেষ আলোচনা। সাধারণত তরুণ লেখকই নির্বাচিত হয়েছেন এই আলোচনায়। তাতে লেখক হাজির থাকতেন। আর পারভেজ ভাইয়ের কল্যাণে বা লেখকের উপস্থিতিহেতু তরুণ লেখকদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছে এসব আলোচনায়। এরকম যে কয়টি সভায় উপস্থিত ছিলাম, তার সব কটিই জমজমাট দেখেছি। এই আলোচনায় অংশ নেয়ার সুবাদে পরে বইগুলো নিয়ে লিখতেও পেরেছিলাম। সমকালিন সাহিত্য নিয়ে এই তাজা আলাপ কেবল উপভোগ্যই নয়, উপকারিও বটে। তবে ভাল জিনিস বলেই বোধ করি এই ধরনের সভা বসেছে অপেক্ষাকৃত কম।
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রকে ঘিরে আরো নানা আয়োজন চলে। তার সবগুলো আমি জানিও না। সংগিতের বোধ হয় এক ধরনের উদ্যাপন হয়। সারা রাত বা রাতের অনেকখানি সময় জুড়ে গান-বাজনা চলে। আমি এ ধরনের অনুষ্ঠানে দু-একবার কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত ছিলাম। তাই ভাল বলতে পারবো না। কয়েকটি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছে কেন্দ্র। যুগপূর্তি উপলক্ষে সমকালিন সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটি সেমিনার হল। কেন্দ্রের সেমিনারগুলোর একটা বিশেষ দিক তরুণদের প্রবন্ধ পড়া বা আলোচনার সুযোগ করে দেয়া। তাতে সবসময় ভাল ফল ফলেছে, এমন বলা যাবে না। কিন্তু ঢাকার বৃদ্ধপ্রীতির প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজের কথা মাথায় রাখলে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের তরুণপ্রীতির একটা বিশেষ তাৎপর্য তো দাঁড়িয়ে যায়। কেন্দ্রের নিয়মিত ছাত্রদের কেউ কেউ নিজেরাও ধারাবাহিক লেকচার দিয়েছে কোনো কোনো নির্বাচিত বিষয়ে। যেমন, সামিও শীশ একবার অর্থনীতির পাঠচক্র চালালো। এই কেন্দ্রের শিথিল বেষ্টনির মধ্যে এ ধরনের কাজের আবহ আছে। তবে আমাকে খানিকটা বিস্মিত করেছে রিসি দলাই ও তার বন্ধুবান্ধবদের ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’। দশক জুড়ে সাহিত্যের একটা আড্ডা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কী পরিমাণ গায়ের আর মনের জোর দরকার তা আমি খানিকটা বুঝি; কারণ, এসব কাজ স্বল্পমেয়াদি স্কিমে আমি বিস্তর করেছি। এই সভায় আমি বিশেষ যাইনি। আমি তখন থাকতাম মিরপুরে। ফলে সকালবেলা শাহবাগ অঞ্চলে এসে পড়া আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। আর একটা কারণ, এটা সৃজনশিল লেখকদের সভা। আমি এ লেখক-তালিকায় পড়ি না বলে বন্ধুদের এ ধরনের সভাগুলো সাধারণত এড়িয়ে চলি। কিন্তু কেন্দ্রে যাতায়াতের ফলে ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র নানা খোঁজখবর কানে এসেই যেত। মাঝে মাঝেই হাতে আসতো তাদের নানা ধরনের প্রকাশনা। এই থেকেই যদ্দুর জানি, বের হওয়া শুরু হল চারবাক। পত্রিকাটি সম্পর্কে দুই কথা বলা দরকার।
শিল্পসাহিত্য করে এমন পোলাপাইনের একটা কাগজের নাম যে ‘চারবাক’ হল, আমার ধারণা, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের চর্চার একটা ফল তাতে ফলেছে। লিয়াকত ভাই তাঁর ক্লাসে চারবাক নিয়ে কথা বলেন, আর উঠতি বয়সের শ্রোতারা তাদের উদিয়মান নাস্তিক্য আর অস্পষ্ট প্রাচ্যপ্রীতি মিশিয়ে চারবাক গোষ্ঠির নাম পত্রিকার প্রথম পাতায় এঁকে দিল-এ কথা সত্য হতেও পারে; কিন্তু আমার আগ্রহের জায়গা সেখানে না। এই পত্রিকায় গত প্রায় এক দশক ধরে যা ছাপা হচ্ছে, তাতেই আমি বারবার আগ্রহ বোধ করেছি। দেখা গেছে, এই পত্রিকার আগ্রহ চিন্তামূলক প্রবন্ধের দিকে। লেখাগুলো বিশেষভাবে নজর রাখতে চায় ঔপনিবেশিক আর নব্য-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির দিকে। অথচ সৃষ্টিশিল রচনার প্রাধান্য তাতে মোটেই ক্ষুণœ হয়নি। এক দিক থেকে এটা অস্বাভাবিক নয়। সৃজনশিলতা আর মননশিলতার মেলবন্ধন তো আমরা বহুবার দেখেছি-আর এক অর্থে এ দুটো আলাদা কিছু নয়। কিন্তু ঢাকার গত তিন-চার দশকের লিটলম্যাগ আর সৃষ্টিশিল চর্চা যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করেন, তো দেখবেন, কি অনায়াসে এখানে সৃষ্টিশিলতার সাথে রাজনীতির বা এমনকি চিন্তার বিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। খুব সচেতনভাবে তৈরি হয়েছে কি-না জানি না। কিন্তু আমরা সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় যখন আজিজ মার্কেটে যেতাম সমকালিন সাহিত্যের টাটকা খবরগুলোর সন্ধানে, তখন এই অবস্থাই দেখেছি। মূর্খ কবি-লেখকদের আস্ফালন আর চিন্তাশিলতা ও রাজনীতির ছোঁয়া থেকে মুক্ত বিশুদ্ধ সাহিত্যের এক রমরমা ছিল তখন। ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়। কিন্তু এই জিনিসেরই প্রতাপ দেখেছি। গত এক দশক হল, এই অবস্থার কিছু বদল হয়েছে। নানা কারণে হয়েছে। তা ভাল কি মন্দ, বা এই বদল কতটা ফল ফলাবে-তা বলতে পারবো না। কিন্তু তথাকথিত সৃষ্টিশিলতার দাপট আজিজ মার্কেটে-আজিজ মার্কেট কথাটি নতুন লেখকদের আড্ডাস্থল হিসেবে প্রতিকি অর্থে লিখলাম-কিছু কমেছে, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। তরুণদের পত্র-পত্রিকায় এর কিছু প্রতিফলন দেখা গেছে। লেখার বিষয়-আশয়ে উলেখ করার মতো পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিশিল লেখালেখিতেই মূলত যুক্ত, এমন গ্র“প আর পত্রিকার মধ্যে চারবাকের মতো চিন্তা-মনন-রাজনীতি নিয়ে লিপ্ত পত্রিকা আর বিশেষ দেখি না। পারিপার্শ্বিক প্রভাবের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক নিষ্ঠা না থাকলে এমন ধারাবাহিক চর্চা সম্ভব হত না। আমার মূল্যায়ন হল, চারবাকের এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের সার্বিক আবহের একটা গভীর প্রভাব পড়েছে। চিন্তার ইতিহাসকে কেন্দ্রে রেখে দীর্ঘদিন ধরে এখানে যে পঠনপাঠন চলে এসেছে, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তার প্রভাব পড়েছে চারবাকওয়ালাদের চিন্তায়। তারা সৃজনশিলতার সাথে মননচর্চার বিরোধ তৈরি করেনি। কেন্দ্রের একটা প্রবণতার সাথে তাদের সক্রিয়তার পার্থক্যও অবশ্য পরিষ্কার। কেন্দ্রের পাঠচক্রটি-এবং লিয়াকত ভাইও-যদ্দুর সম্ভব ‘অরাজনৈতিক’। চারবাকের সাথে রাজনীতিটাও মিলেছে। এতে হয়তো সমকালিন প্রবণতার প্রভাবটা কাজ করেছে।
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের কথা বলতে গেলে এর কেন্টিনের কথা বলতে হয়, সামনের ছোট বারান্দার কথা বলতে হয়, যে রুমগুলো নানা প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া দেয়া হয় সেগুলোর কথাও বাদ দেয়া যায় না। আর একুশ ফেব্র“য়ারির রাতের কথাই বা বাদ যায় কি করে? সেখানে সায়ানের লম্বা গানের আসর? আড্ডা আর খাওয়া শেষে শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া আর ফিরে এসে আবার আড্ডা? আমাদের স্মৃতি আর প্রাত্যহিকতার সাথে এর সব কটিই একটা সময়ে খুব জড়িয়ে-প্যাঁচিয়ে ছিল। ঐ কেন্টিনে খেতে যেতাম মাঝে মাঝে। আর ভিতরের রুমে সিগারেট খাওয়া যেত না বলে বসতাম বাইরের ছোট বারান্দায়। কত ঘণ্টা যে এখানে আড্ডা মেরে কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একবার মনে আছে, মেহেদি মাহমুদ চৌধুরীর সাথে তিন ঘণ্টার এক গুছানো-নিরুত্তেজ তর্কে লিপ্ত ছিলাম এই বারান্দায়। আদনান বা কামরুল ভাই বা টুটুল ভাই বা শিমূল বা রোমেলের সাথে বহু ‘সিরিয়াস’ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এখানে। আর কত কত নতুন লোকের সাথে যে পরিচয় হল। কেন্দ্রের রুম ভাড়া করে যারা নিজেদের প্রোগ্রাম করত, তাদের অনেক অনুষ্ঠানেও শরিক হয়েছি। কখনো বক্তা কখনো কখনো শ্রোতা হয়ে। এর মধ্যে ফারুক ওয়াসিফের একাধিক প্রোগ্রাম, জনসংস্কৃতি মঞ্চের আলোচনা, বেনজিন খানের বছরব্যাপি বক্তৃতা-অনুষ্ঠান, শোয়াইব জিবরানের কমলকুমারের প্রোগ্রাম কিংবা রিসি দলাইয়ের আহমদ ছফাকে নিয়ে আলোচনার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। কিন্তু এ কথাগুলো নিছক স্মৃতি-তর্পণের জন্য লিখিনি। অন্য মরতবা আছে। আমার দীর্ঘদিন ধরে মনে হয়েছে, আজিজ মার্কেটের লম্বা ইতিহাসে এখানে যে আড্ডা মারার জন্য একটা জায়গা গড়ে উঠল না-এমন কোনো চায়ের দোকান যেখানে দুই টাকার চা খেয়ে ঘণ্টা কয়েক প্যাঁচাল পাড়া যাবে, উঠে পড়ার তাগাদা থাকবে না, বা এমন কোনো জায়গা, যেখানে প্যাঁচালিরা অন্য প্যাঁচালির খোঁজে যাবে এবং পেয়েও যাবে, তা আসলে ঢাকার সাংস্কৃতিক দৈন্যের এক প্রতিকি প্রমাণ। কেউ খুব পরিকল্পনা করে এসব করে না। ঘটনাপ্রবাহের আপন তালে তৈরি হয়ে যায়। আজিজ মার্কেটে গত বিশ বছরে এরকম কিছু হল না, আর এখন তো সেই মার্কেটটাই উঠে গেল। তো এই অভাব আশির দশকে বোধ হয় খানিকটা মিটিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ। আমি সাহিত্যিক-নাট্যকর্মি-পরিচালক অনেককেই বলতে শুনেছি-তাদের সৃষ্টিশিল মেলামেশাটা ঐ ছাদেই হয়েছে। আমাদের কাছে এরকম একটা জায়গা ছিল সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র। শাহবাগ থেকে খুব দূরে নয়। লোকজন পাওয়া যায়। আড্ডার বারণ নাই। কিছু নিয়মিত আয়োজন চলছে। মাঝে মাঝে বিশেষ আয়োজন। সভা-সেমিনার করার জন্য অন্যরাও রুম ভাড়া নিতে পারে বলে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কথাবার্তা শুনতে চাইলে বা বলতে চাইলে যাওয়া যায়। নগরির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এ ধরনের এনতেজাম থাকতে হয়। আমাদের বেশি নাই। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রকে এবং এর সংগঠকদের কাজকে সে কারণে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
লেখক তালিকা
জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক
এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →
সম্পূর্ণ লেখক তালিকা





