ছবি
জোছনা নেই- জলসার আসরও নেই; বাতাসে
ছিটকে পড়া গজলের সুর ও তাল বেজে চলেছে
জলছোঁয়া শঙ্খচিলের ডানায়
আকাশের চেতনা ছুঁয়ে বয়ে চলা সে-সুরের পিঠে
নৈঃশব্দের যাত্রী-
ঢেউ ঢেউ নদী নদী একগুচ্ছ লিরিক্যাল শব্দ।
ঝুলে আছে সঙ্গমোত্তর নীরবতা-ডানে
অনেকটা চাহিদারেখার মতো
ঠিক তার নিচে-যেখানে মাঠের মতো ছবি-
সেখানে মাতাল ঠোঁটের চুমু নিয়ে চোখে
এখনও সে ঘুমিয়ে-
দু’পাশে বিছিয়ে আব-ই রওয়ানের মতো ডানা
সাদা ও নীল, নীল ও সাদা।
লোনা আলিঙ্গনে আবিষ্ট দুটি পায়ের উজ্জ্বল নগ্নতা ছুঁয়ে
নীলজল সুইমিং পুল..
চুমু মাখা চোখে সাড়া জাগিয়ে ঘুম তো ভাঙবেই;
প্রথমেই জোছনা-ধোওয়া স্নান
অতঃপর স্নানশেষে সে জড়িয়ে নেবে গায়ে
দুগ্ধ-ফেনায় ধোওয়া-
মেঘের চুমকি আঁকা প্রভাতীরঙের জামা-
যারা ইতিহাসেরও অধিক পাঠক-তারা জানেন-
এই জামা পরেছিলেন আনারকলি
কোনো এক মোগল জোছনায়
একরাত অন্ধকার ঢেলে- মহামতি সম্রাটের চোখে !
বিশ্বায়ন
পুঁটি মাছের ধরলাকে রেখে পেছনে
উজানে গেছিল বক
বছর তিনেক পর
ফিরে এসেছে সে ভাটির ভিটায়
সঙ্গে এনেছে-
ভাইয়ের জন্য হোমোসেক্সুয়াল দিন
বোনের জন্য লেসবিয়ান রাত
আর নিজের জন্য-
মিঠাপানি বিষয়ে বমিবমি বিতৃষ্ণা !
মাপ
বিগ বি-র বেশি হাইট, তবু আপনি
দাঁড়িপাল্লায় ওঠা চেয়ার;
আর সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা নিয়েও
বিদ্রোহী কবি স্যালুট পায় হিমাদ্রীর।
ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে এই সত্য
চেয়ে চেয়ে দ্যাখে—
বিশ্বরোডের মুদিখানার চোখ,
ইলামিত্রের শ্বশুরবাড়ি ঘেঁষে
রামচন্দ্রপুর হাটের–
ডিগ্রীবিহীন গোরুর দালালের দৃষ্টি।
মহাবিশ্ব
অথচ তোমার জন্য বসে থাকি অজুহাতের স্টেশনে- ইচ্ছাকৃত ফেল করে
আহ্নিকগতির ট্রেন! তুমি আসতে চেয়েছো অথবা চাও-এর বেশি কোনো
কিছুই তো ঘটেনি; তোমার আসতে চাওয়াটা কেন এত ব্যঞ্জনা রচে আমার
এলোমেলো ভাবনায়- আমি সেও বুঝি না! তুমি যদিবা আসোই-সেও তো
নিজ কক্ষপথে ফিরে যাওয়ার জন্যই আসবে-এতটুকুও রয়ে যাবে না-রেখে
যাওয়ার মতো কিছুই আনবে না সাথে,-তারপরও তোমার জন্য কেন এই
অদ্ভুত অপেক্ষা?
আমি তো গ্রহ-নক্ষত্রের ভিড়ের মধ্যেই থাকি যে ভিড়ে অংশ রয়েছে
আমারও; এমনিতেই ঝালাপালা কান; তো কীসের আবার নতুন ডাক!
অথচ তোমার কণ্ঠ শোনামাত্র কানদুটো ভারকেন্দ্র হয়ে ওঠে! মনে হয়-
মেঘলাকণ্ঠের সিক্তমাধুরী বাড়িয়ে দেয় তোমার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের পরিধি-
যা ছুঁয়ে ফেলে আমার অন্তরঙ্গ অস্তিত্বের আঙিনা,-বাকি সারাটা সময়
যা রাষ্ট্রীয় ভূগোলের মতো স্থির থাকে বেড়াহীন সীমান্তে ও সীমানায়!
আমি স্বতঃসিদ্ধের হৃদয় নিয়ে ভেবে দেখি-নিপাতনে সিদ্ধির টিকেট নিয়ে
যদিবা তুমি এসেও যাও, আমার কোনো শূন্যতাই ভরে দিতে আসবে না,
আর আমার তো কোনো শূন্যতাই নেই; সবখানেই থই থই জল; ভদ্র বাতাসের
টোকাও সয় না! তারপরও ভরা নদীটি নিয়ে কেন আমি অপেক্ষায় থাকি-
একখানা মেঘলা আকাশের, কিংবা উজান-উপচানো নবীন ঢলের? আমি কি
নিজের পাড় ভেঙ্গে ছড়িয়ে যেতে চাই-অগন্তব্যের বিস্তারে,-যেখানে যুক্তি-
হীনতার অবাধপ্রান্তর,-অসংসারের হরিণ-উপবন? আমার মধ্যে কে সঞ্চার
করছে এই অগন্তব্যগামী মুক্তির বেগ? আমি তো চাই না এ উড়াল; অথচ
আমার এ প্রার্থনাতেও খাদ রয়ে যায়-‘হে পৃথিবী, হে আমার ডাঙা ও জলের
সবখানি ভালোবাসা, আমাকে ধরে রাখো-বাড়িয়ে দিয়ে তোমার অভিকর্ষীয় টান!’
পাথর নিয়তি
পাথরের ঘাটে বসে পা উঠিয়ে পা ঘষে রজনী
খসে পড়ে অন্ধকার
পাথরের ঘাটে বসে জামা খুলে নাভি মাজে দিন
ধুলোবালি জল হয়ে যায়
পাথরের ঘাটে বসে বুক খুলে প্রেম করে সাঁঝ
মুছে যায় বেদনার উল্কি;
অথচ পাথরের দুর্নাম ঘোচে না! শালা পাথর!
পাথর তো নই-তথাপি পাথর হয়ে আছি
ঘষা..ঘষা..ঘষা…
ক্ষয়ে যাওয়া..ক্ষয়ে যাওয়া.. এবং ক্ষয়ে যাওয়া..
অসম্পূর্ণ হালখাতা
এখনো চৌদিকে ছড়ানো ছিটানো প্রেম
এখনো ইশারা চোখে পড়া কোনো চোখ
এখনো রয়েছে ইনজিনে অকটেন
এখনো নদীতে জাগেনি চরের শোক।
এখনো বিকেল অর্ধ-রোমান্টিক
এখনো সন্ধ্যা মিলনাত্বক মোড়
এখনো রাত্রি দু’কাঁটাতে টিকটিক
এখনো কামনা নতুন দিনের ভোর।
এখনো কবিতা রাতজাগা অজুহাত
এখনো আকাশ হাজারো চিত্রকল্প
এখনো হঠাৎ হাত ছুঁয়ে কোনো হাত
এখনো জীবন সহসায় কোনো গল্প।
এখনও পারি রাঙাতে নারাজ মন
এখনও পারি টানিতে দোদুল ভোট
একচুমুতেই ফ্লাশব্যাক যৌবন
যে চায়নি কাল, সেও পেতে দেয় ঠোঁট।
এখনো তুলনা ছুঁয়ে যায় ফলাফল
এখনো ঈর্ষা ছুঁয়ে যায় এই নাম
এখনো ভূমিকা ফুটে ওঠা শতদল
এখনো স্বপন জানায় ওয়েলকাম।
এখনো স্বভাব খেয়ালের ঘোড়দৌড়
এখনো মনটা লোভের বাতাসে দোল
এখনো মধুর খুঁজিছে মধুর ওড়
এখনো তোমাকে ভালোবেসে উতরোল।
কুয়াশামাখা সমুদ্র
আব্বা বলতেন, আদার বেপারী হয়ে
জাহাজের খবর নিতে যাওয়া
আর পানতে টাকা ফেলা একই কথা!
জেনেছিলাম, জাহাজ চলে সমুদ্রে–
পাগলায় যেমন চলতো ভাদুচাচার গুজরঘাটের লা;
তখন আমি গাজী গাজী বলে নৌকা চালানো
মতলব মিয়ার মেঘনাও দেখিনি
অথচ আই এ সিক্স্থ স্ট্যান্ড করায়
একবার জাহাজে চড়ে সমুদ্র দেখার
আমন্ত্রণ জুটেছিল;
সেও আবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে!
এ যেন লাফ দিয়ে এভারেস্টে ওঠার স্বপ্ন!
কিন্তু গ্রামীণ পোস্টাপিসের সিস্টেম লস সহ
যখন হাতে পৌঁছে সেই দাওয়াতপত্র,
তখন সেই জাহাজ গভীর সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে
ফিরে এসেছে পতেঙ্গা বন্দরে;
তার চিমনী উদগীরণ করছে তৃপ্তির ঢেঁকুর
আর তিন কুড়ি মেধাবী স্বপ্ন আকাশের
সাদামেঘ চুমে ছড়িয়ে পড়ছে–
জলজ বাতাসে দোলা সামুদ্রিক শেওলায়,
মৃত্তিকার পেটে
এবং ভবিষ্যতের সুবেহ-সাদিক মাখা দিগন্তে !
আমি কি অভিশাপ দিয়েছিলাম?মনে নেই।
কিন্তু সেই পোস্টাপিস আজ মরা তিস্তা;
বৃষ্টির ভর্তুকি আর মৌসুমের বরাদ্দও
তাকে শ্রাবণের ইছামতী করে তুলতে পারে না
কেবল চতুর আড়ালে হাঙর হয়ে উঠতে চায়
কতিপয় ছদ্মবেশী বোয়াল।
আমার কি আর সমুদ্র দেখা হয়নি এজীবনে?
সেকথায় পরে আসি;
পদ্মাপাড়ের ছেলে এই আমার যখন
নদীতে ঝাপ দেয়ার সাহস ফুরিয়ে এসেছে,
আলতাদিঘিতেও নামতে চায় না পা,
তখন আবার সমুদ্র ভ্রমণের আমন্ত্রণ !
পোস্টাপিস নয়, তাই এবার আর মিস হওয়ার ঘটনা ঘটেনি;
কুয়াশার আব-ই রাওয়ান ঢেকে আছে
প্রশান্ত সমুদ্রের নিতম্ব
কিন্তু সকালের সোনালি আলোয়
উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে
অনুদ্বোধিত সৌন্দর্যের আয়নামহল;
দেখা যায়– চোখ যায় যতদূর
দুপাশের ঝাউবন নাচবে বলে অপেক্ষায় আছে
লক্ষ্যভেদী ঝড়বাতাসের;
উদ্বোধিত হবে বলে প্রস্তুতিমাখা সিগন্যাল দিচ্ছে
একটি বন্দর;
মগ্নচূড়া থেকে ভেসে আসা
পরমানন্দের সুর
মুখরিত করে তুলতে চায় মহীসোপানের পাড়।
এই সমুদ্রে কোনো জাহাজ এখন অবধি
জল ভেঙেছে কি?
শান্তজলের চাতাল বুঝতে দেয় না সেও;
এবং কোনো চিহ্নও নেই সিডর আইলা মহাসেনের;
আমি এমভি ঈসা খাঁন নিয়ে ঢুকে পড়বো কি না,
সেই ভাবনায় মনোযোগ দিতে —
সমুদ্রের নাভি থেকে ভেসে আসে
হামাব্যাক তিমির মহামিলনের গান !
অনুপস্থিতির বাগানে
বেডরুমে- করিডোরে, ডাইনিঙে ড্রয়িংরুমে
সর্বত্র মউ মউ করছে তোমার অনুপস্থিতি
যেন তুমি যাওয়ার সময়
ঘুরে ঘুরে স্প্রে করে গেছো
ঘর-দোর বারান্দা বাহির
আমি নাক ডুবিয়ে শুঁকছি নিবিড় সে-সৌরভ।
চোখ কান ইচ্ছে ও অভ্যাস স্থগিত রেখেছে
অন্তরঙ্গ সিলেবাসের কতিপয় বাধ্যতামূলক অধ্যায়;
শাহবাগে আড্ডা, সাতকাহনে কবিতা
রমনায় কফি, টিএসসি-তে ভালোবাসার হাট
কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
নিরুঙ্কুশ মালি হয়ে বসে আছি তোমার অনুপস্থিতির বাগানে।