কুয়াশার গাঢ় আবরণ কেটে কেটে রোদ উঠার চেষ্টা করছে। সকাল থেকে যে ঝাপসা ভাবটা ছিলো তার পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে। হয়তো আরো কিছু সময় পার হলেই চারদিক ঝিকমিক করে রোদ উঠে যাবে। জমিলা বেগম গভীরভাবে এই প্রতিক্ষাই করছেন। ঘুম ভাঙার পর থেকেই তার মনে এই প্রতিক্ষা বিরাজ করে আছে। কারণ রোদ না উঠলে যে হাড় কাঁপানো এই ঠাণ্ডা কমবে না। ফলে বাইরে যাওয়ার যে ইচ্ছা মনে রয়েছে তাও পূরণ হবে না।
পুরোনো দিনের একটি লেপ গায়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে মাথা ঢেকে জমিলা বেগম শুয়ে আছেন। একটু বেশি উষ্ণতার জন্য লেপের উপর মেলে দিয়েছেন একটি কাঁথা। শিতের দিনে রোদ না উঠা পর্যন্ত এভাবেই তিনি শুয়ে থাকেন। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে শরীরটা তার ওম না রাখলেই নয়। কারণ বুড়ো বয়সের এই শরীর ঠাণ্ডাটা একদম সহ্য করতে পারে না। তাই হয়তো তার লেপের নিচে আর কারো অধিকার জন্মাতে দেন না। দশ বছরের নাতনি শেফালি মাঝে মাঝে তার লেপের নিচে শুতে চায়। কিন্তু তার নড়াচড়ায় বাতাস ঢুকে বলে, শেফালি মন খারাপ করলেও এতে তিনি রাজি হন না।
আরও কিছু সময় এভাবে কেটে গেলে জমিলা বেগম শেফালিকে ডাক দেন, ‘এই শেফালি রইদ উঠছেনি’। শেফালি ঘরের মধ্যে চুলার কাছে তার মায়ের সাথে বসা ছিলো। নানির ডাক শুনতে পেলে সাথে সাথেই জবাব দিয়ে দেয়, ‘একটু একটু উঠছে’। তার কথার সুরে জমিলা বেগম বুঝতে পারেন যে পরিমাণ তেজের রোদ উঠলে তার শরীর আরাম পাবে তা এখনও উঠেনি। তাই শেফালিকে বলে দেন, ‘আরেকটু রইদ উঠলে আমারে উঠানে নিয়া বওয়াইয়া দিস’।
আসলে শিতের দিনগুলোতে শেফালি প্রতি সকালেই নানিকে হাতে ধরে নিয়ে রোদের মধ্যে একটা উঁচু পিঁড়ির উপর বসিয়ে দেয়। কারণ চোখ দুটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে একা চলাফেরা করা তার দ্বারা অসম্ভব। বছর চারেক ধরে তার এই অবস্থা চলছে। অবশ্য একটি চোখ নষ্ট হয়েছিলো আরো আগেই। প্রায় সাত বছর আগে শেফালির জন্মের তিন বছর পর তার চোখটি ছানি পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এরপর অন্য চোখটাও ধিরে ধিরে নষ্ট হতে শুরু করে। এ সময় গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কিছু কিছু সাহায্য নিয়ে মাঝে মাঝে এর চিকিৎসা করান। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। অপর চোখের ধারাবাহিকতায় যেন এটিও জ্যোতি হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকেই তিনি মূলত তালাকপ্রাপ্ত যে মেয়েটি তার কাছে থাকে তার উপর নির্ভরশিল হয়ে পড়েন। ফলে বাড়ির বাইরে বের হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। চারদিকের জিবন্ত অথচ নিজের জন্য অন্ধকারময় প্রতিবেশে বসে দিনগুলো কাটিয়ে দিতেন। পরে, শেফালি যখন কিছুটা বড় হয়, তাকে সাথে নিয়ে বাহির হওয়া শুরু করেন। তার নির্দেশ মতো শেফালি তাকে হাত ধরে ধরে এ বাড়ি সে বাড়ি নিয়ে যায়।
মেয়ে আর নাতনিকে নিয়ে জমিলা বেগমের সংসার। বছর খানেক রোগে ভোগে স্বামি মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই। অবশ্য বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তখন। এরপর ছোট মেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করতে থাকেন। সেও একদিন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন সংসার করার পর একটি মেয়ে হলে স্বামি যখন গোপনে আরেকটি বিয়ে করে ফেলে তা জেনে ফেলার পর থেকে তাদের সম্পর্ক ধিরে ধিরে খারাপের দিকে এগুতে থাকে। একসময় তা অসহনিয় হয়ে পড়লে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে পড়ে। অকল্পিত তালাক প্রাপ্ত হয়ে সে এখন মায়ের সাথেই থাকছে। এরপর নিজের সামর্থ্য না থাকলেও জমিলা বেগম মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পুনঃপুন চেষ্টা করলেও সে রাজি হয়নি। এখন যেখানে থাকছেন স্বামির এই পৈত্রিক ভিটেটুকু ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি নেই। স্বামির দিনমজুরি থেকে যা আসতো তাই দিয়ে কোনো রকমে দিন কেটে যেতো। বর্তমানে মেয়ে একটি ঘরে কাজ করে। সংসারের খরচ তার মাসিক বেতনের উপরই নির্ভরশিল। কিন্তু এই অল্প টাকায় তিনজনের খরচ মিটে না বলে মাঝে মাঝে তিনি নাতনিকে নিয়ে গ্রামে বের হন কিছু সাহায্য পাবার আশায়।
পুরো গ্রাম জুড়েই জমিলা বেগমের পরিচিতি। দির্ঘদিন দাইয়ের কাজ করাতেই তার এই পরিচিতি ঘটেছে। একটি চোখ নষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত গ্রামে তিনি একাই দাইয়ের কাজ করতেন। ফলে কারো বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই তার ডাক পড়তো। তার কাজও ছিলো নিপুণ। দির্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হওয়ার ফলে তিনি দক্ষভাবেই বাচ্চা হওয়ার সময়টাতে কাজ করতে পারতেন। এ কারণে সন্তান প্রত্যাশি পরিবারগুলো তার উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারতো। আর এর ফলে কি সন্তান হচ্ছে, এ নিয়ে উৎসুক পরিবারকে তিনিই প্রথম জানিয়ে দিতেন ছেলে না মেয়ে হয়েছে। গ্রামের মানুষ তাই জমিলা বেগমকে কিছুটা অন্য চোখে দেখে থাকে। সেখানে হয়তো মেশানো থাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যুগল স্পর্শ। গ্রামের অনেক মানুষের গায়েই তো লেগে আছে তার হাতের স্পর্শ। এমন ঘটনাও আছে যে, তার হাতে যে সন্তান জন্ম লাভ করেছে তার ছেলে বা মেয়ে হওয়ার সময়ও তিনি পাশে ছিলেন। এ ব্যাপারটি তার খুব ভালো লাগতো। এই ভেবে তিনি খুব পুলক অনুভব করতেন যে, দুটি প্রজন্মের জন্ম মুহূর্ত তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, তার হাতের স্পর্শ লেগেই দুটি প্রজন্মের জীবনপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটলে তিনি ভেসে বেড়াতেন ভালো লাগার আবেশে।
তাই জমিলা বেগম যে বাড়িতে যান সেখান থেকে তিন চার বেলার খাবারের চাল নিয়ে আসতে পারেন। কেউ আবার টাকাও দেয়। তবে এই দেয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা ভিক্ষাবৃত্তির সাথে সম্পর্কিত নয় যেন। তিনি যেমন ভিক্ষা ভেবে কিছু নেন না লোকজনও তেমনি ভিক্ষা দিচ্ছে মনে করে তাকে কিছু দেয় না। তার অবস্থা বিবেচনায়ই তারা তাকে সাহায্য করে। তবে কোনো বাড়িতেই তিনি ঘন ঘন যান না। বাড়ি থেকে বেরই হন পাঁচ-ছয়দিন পর পর। একে তো হেঁটে বেড়ানোটা শরীর সহ্য করতে পারে না। তারপর চক্ষু লজ্জাও তো আছে। কেউ সাহায্য করলো বলে প্রতিদিনই কি তার দুয়ারে গিয়ে বসে থাকতে হবে? বেশ ভালো করেই তিনি এ ব্যাপারটা মেনে চলেন। জমিলা বেগম আবার শেফালিকে ডাক দিলেন, ‘এই শেফালি রইদ উঠছেনি’। ‘একটু উঠছে, আগের থাইক্যা বাড়ছে’। শেফালি বলে। তার কথায় জমিলা বেগম এবার আশ্বস্ত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার কাক্সিক্ষত রোদ উঠে গেছে। তাই শেফালিকে বললেন, ‘পিড়িটা উঠানে দিয়া আমারে রইদে লইয়া যা’ শেফালি কথামতো পিঁড়ি দিয়ে তাকে রোদে বসিয়ে দিলো।
রোদটা বেশ লাগছে জমিলা বেগমের কাছে। শিতের সকালের এ নরম রোদটা বরাবরই তার ভালো লাগে। কারণ এতে যেমন শরীর গরম হয় ভালো তেমনি এতে তিব্রতা মাখানো নেই-যে রোদ শরীরে পড়লে মনে হয় শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় এখন একটি ভাবনা সঞ্চরণশিল রয়েছে। রোদ পোহাতে পোহাতে তিনি ভাবছেন কোন বাড়িতে যাবেন আজকে। এদিক-সেদিক ভেবে অবশেষে মনস্থির করলেন গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় যে বাড়িটা রয়েছে আজকে সেদিকেই যাবেন। অনেক দিনের ভেতর সেখানে যাওয়া হয়নি।
ধিরে ধিরে রোদ বেড়ে উঠছে। একটু একটু করে শিত কেটে যাওয়াতে জমিলা বেগম খুব আরাম অনুভব করছেন। লেপের নিচের উষ্ণতায়ও আরাম ছিলো। কিন্তু দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে। একটা স্বাভাবিক, আরেকটা কৃত্রিম। রোদের উষ্ণতা শিত ছাড়িয়ে শরীরকে যেভাবে ঝরঝরে করে, লেপের উষ্ণতা তা পারে না। এটি যেন চারপাশের শিতল আবহাওয়া থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। জমিলা বেগমের তাই রোদের উষ্ণতাই বেশি পছন্দের। এদিকে রোদ বাড়ার সাথে সাথে বেলাও বাড়ছে।
জমিলা বেগম খিদে অনুভব করলেন। তাই মেয়েকে ডাক দিয়ে বললেন, রেহানা ভাত অইছেনি।
ভাত অইছে, কিন্তু শাকটা এখনও অয় নাই।
খালি শাক রানছস না আর কিছু আছে।
একটু তরকারি আছে। রহমান মিয়ার বউ কালকে একটু তরকারি দিছিল।
আমার তরকারি লাগত না। শাক অইলে আমারে ভাত দিয়া দিস। শেফালিরেও ভাত দিয়া দিস।
শাক ভাজি হয়ে গেলে রেহানা গরম ভাত এনে মাকে দিল। শেফালিও নানির কাছে বসে শাক-ভাত খেয়ে নিলো। উড়ন্ত ধোঁয়ার শাক-ভাত খেয়ে জমিলা বেগম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আরো কিছু সময় জিরিয়ে নিলেন। পরে শেফালি তার লাঠিটা এনে দিলে তিনি তার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন।
‘কোন দিকে যাইমুগো নানি’ শেফালি বলে। ‘দক্ষিণ বাড়ির দিকে যা’ জমিলা বেগম শেফালিকে বলে দিলেন। নানির কথামতো সে তাকে সেদিকে নিয়ে চললো। নানির সাথে বেড়াতে বেড়াতে গ্রামের সব রাস্তাঘাটই তার চেনা হয়ে গেছে। কোন দিকে গেলে তাড়াতাড়ি হবে, সহজে যাওয়া যাবে, সবই তার নখদর্পনে। প্রথম প্রথম ভুল হলে নানিকে বলে ঠিক পথে চলে যেতো। এখন সেটা কেটে গেছে পুরোপুরিভাবেই। নানি দক্ষিণবাড়ির কথা বললে সে বাড়ির পেছন দিকে বের হয়ে আল ধরে কয়েকটা ধানক্ষেত পেরিয়ে নদির পাড়ে উঠে গেলো। এ পথ ধরে কিছু সময় হাঁটলে দক্ষিণবাড়িতে পৌঁছা যাবে।
দক্ষিণবাড়িতে ঘর আছে ছয়টি। তাই বাড়ির কাছাকাছি এসে শেফালি জিজ্ঞেস করলো ‘কোন ঘরে যাইমোগো নানি।’ ‘মন্টু মিয়ার ঘরের দিকে যা’ জমিলা বেগম শেফালিকে বলে দিলেন। শেফালি তাকে হাত ধরে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মন্টু মিয়া উঠানে দাঁড়ানো ছিলো। তাকে দেখে বললো, ‘চাচি দেখি আইছো, বও।’
ভালো আছনি বাবা।
ভালোই আছি গো, তুমি ভালানি।
বুড়া বয়সে আলা যেমন রাখছে আর কি।
ঘরে গিয়া বও।
জমিলা বেগম ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলেন। মন্টু মিয়ার বউ ঘরের ভেতরেই ছিলেন। সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে বাসন কোসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় জমিলা বেগমের কণ্ঠ শুনলেও সাথে সাথে বাইরে আসতে পারলেন না। সবকিছু গুছিয়ে বাইরে এসে জমিলা বেগমের হাত ধরে বললেন, ‘চাচি ভালা আছনি।’
আছি ভালা, তুমি ভালানি।
যেমন দোয়া রাখছ।
মন্টু মিয়ার বউয়ের ধান নেড়ে দেওয়ার তাড়া ছিলো। রোদ উঠার সাথে সাথে ধানগুলো ঘর থেকে বাহিরে আনলেও এখন পর্যন্ত নেড়ে দেওয়া হয়নি। তাই জমিলা বেগমকে বসতে বলে তিনি কাজে চলে গেলেন।
বসে থাকার অবসরে জমিলা বেগম স্মৃতিতে ভেসে বেড়াতে লাগলেন। এ ঘরে আসা যাওয়ার অনেক স্মৃতি তার মনে গেঁথে আছে। মন্টু মিয়ার মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকাতে প্রায়ই এখানে আসতো হতো। মন খুলে অনেক সময় তার সাথে কথা বলে যেতেন। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন রাতে তিনি মারা যাওয়ার পর তার আসা ধিরে ধিরে কমতে থাকে। বিয়ে হয়ে যখন এ গ্রামে আসেন তখন মন্টু মিয়াকে ছোট দেখেছেন। সময়ের সাথে সাথে তার চোখের সামনেই সে বড় হলো। বিয়েও হলো একসময়। তার প্রত্যেকটি বাচ্চাই তার হাত দিয়ে হয়েছে। প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় বউয়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়েছিলো। এরকম পরিস্থিতি তার পরিচিত হলেও তখন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় মনে মনে শুধু দোয়া করেছেন বাচ্চাটা যেন ভালো করে হয়। উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে সময়গুলো তখন খুব কঠিনভাবে কাটছিলো। অবশেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে সুস্থভাবে বাচ্চার জন্ম হলে জমিলা বেগমের ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছিলো। মন্টু মিয়াকে খুব উচ্চস্বরে ডেকে বলেছিলেন, ‘ও মন্টু, তোমার পোলা অইছে।’ প্রথম সন্তান হওয়ার খুশিতে মন্টু মিয়া তাকে দুটি শাড়ি দিয়েছিলো। এখনও তার মনে স্পষ্ট করে সবকিছু লেপ্টে আছে। এতোদিন কেটে গেলে তার মনে হচ্ছে এ যেন সেদিনের ঘটনা। স্মৃতি রোমন্থনে জমিলা বেগমের হয়তো আর কিছু সময় চলে যেতো। কিন্তু মন্টু মিয়ার বউ চলে আসাতে এতে ছেদ পড়ে গেলো। অবশ্য ধান মেলে দিতে তার কিছুটা দেরিই হয়ে গেলো। জমিলা বেগমের কাছে বসে তাকে বললেন, দেরি হইয়া গেছে চাচি, কিছু মনে কইরো না।
না-না কিছু মনে করছি না। কামে লাগলে তো দেরি অইতেই পারে।
ভাত খাও চাচি। আইন্যা দেই।
না গো সকালে খাওয়া দাওয়া কইরাই বাইরাছি। এখন খাইতাম না। বড় পোলারে নাকি বিয়া করাইতাছ। হু, পোলার তো বিয়ার বয়স অইয়া গেছে। বিয়া করানো দরকার। মাইয়া একটা দেখেছি। সবকিছু মিলাইয়া সবারই পছন্দ অইছে। এখন কথাবার্তা চলতাছে। হয়তো কিছুদিনের মইদ্দেই ঠিকঠাক অইয়া যাইবো। দোয়া কইরো বিয়াটা যেন সুন্দরমতো অইয়্যা যায়।
দোয়া আছে। পছন্দ অইলে করাইয়া ফালাও। নাতি আমার কত বড়ো অইয়্যা গেছে। মনে অইতাছে ওইদিন যেন জন্মাইলো।
তোমার আতেই তো অইল। তুমি ওই সময় কি কষ্ট যে করছিলা।
বইয়্যা বইয়্যা আমার এখন এই কথাগুলো মনে অইছে।
জমিলা বেগমের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে মন্টু মিয়ার বউ পুনরায় ধান নাড়তে চলে গেলেন। নিচের ধানগুলো এবার উপরে উঠিয়ে দিতে হবে। জমিলা বেগম পান খেতে খেতে পুনরায় অতীতে চলে গেলেন। একা একা বসে থাকলে এখন তিনি সাধারণত তাই করেন। তার নিজ দেখা দৃশ্যগুলো শুধুই অতীতে প্রোত্থিত বলে, তাই হয়তো কেননা তার বর্তমান তো কেবল কানে শোনা শব্দাবলি। ভালোমন্দ যাই হোক। দাইয়ের কাজ করতে যেয়ে তাকে অনেকগুলো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। এ সময়গুলোতে সন্তান-সম্ভবা বউদের কাছে বসে থেকে তাদের ব্যথার চিৎকার শুনেছেন। তাদের ভিত মনটাকে অভয় দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। পরম স্নেহে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কষ্ট সহ্য করার কথা বলেছেন। এমনও অনেক দিন গিয়েছে তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন, তখন হয়তো কেউ এসে তাকে ডাক দিলো। বউয়ের ব্যথা উঠেছে, তাকে এখনই যেতে হবে। জমিলা বেগম দেরি করতেন না, যে আসতো তার সাথে তিনি গভীর রাত্রে রওনা হয়ে যেতেন। প্রথম সন্তান-সম্ভবা বউদের স্মৃতি জমিলা বেগমের মনে বেশি জ্বলজ্বলে। কারণ একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া হবু মায়েদের অনুভূতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তানের মা হওয়ার চাইতে একটু আলাদা। একদিকে প্রথম মা হওয়ার আনন্দ অন্যদিকে সন্তান জন্ম প্রক্রিয়ার তিব্র ব্যথা। এ দুটির যুগপৎ একটি ভিন্ন আবহ তৈরি করতো। এর গভীরতা যেন একটু বেশি। জমিলা বেগমকে তা ছুঁয়ে যেতো। তাই হয়তো তাদের প্রতি তার স্নেহের পরিমাণটাও ছিলো একটু বেশি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে তিনি এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন যেন হবু মায়েরা তার উপর নিশ্চিন্তির ভর ফেলতে পারে।
ধান নাড়া শেষ করে মন্টু মিয়ার বউ চলে এলেন। জমিলা বেগমের পাশে বসে একটি পান সাজিয়ে তার হাতে দিলেন। নিজেও একটি পান মুখে পুরলেন। পান চিবুতে চিবুতে জমিলা বেগমকে বললেন, কবিরের যে একটা মাইয়া অইছে, শুনছোনি,
না, জানি না তো। শুনছিলাম তার বউয়ের পেটে বাচ্চা আইছে। কোনদিন অইল মাইয়াটা।
দুই সপ্তা অইয়্যা গেছে তো।
ব্যাপারটা জমিলা বেগমের কাছে কেমন যেন লাগলো। আগে গ্রামে কোন মানুষের বাচ্চা হওয়ার খবর তিনিই আগে জানতেন। আর এখন কয়েকদিন কেটে গেলেও বাচ্চা হওয়ার সংবাদ তার কানে আসে না। তিনি অন্ধ হওয়ার পর গ্রামে তো অনেক বাচ্চা জন্মেছে। কই, কয়টা খবর সাথে সাথে তার কানে এসেছে। জমিলা বেগম স্মৃতি হাতড়াতে থাকলেন কোন বাচ্চাটা সর্বশেষ তার হাত দিয়ে হয়েছে। বেশি সময় লাগলো না অবশ্য মনে করতে। একটু চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেলো গ্রামের উত্তরের বাড়ির আলাল মিয়ার ছোট ছেলেটার জন্মমুহূর্ত তিনি পাশে ছিলেন।
মাইয়ার জন্মের সময় রহমতের বউটা খুব কষ্ট পাইছে। মন্টু মিয়ার বউ পুনরায় জমিলা বেগমকে কথায় ফিরিয়ে আনতে চাইলেন।
পরে কেমনে কি অইল।
অনেক ব্যথা উঠছিলো। বউটার যে কি চিৎকার। তুমি ত বুঝই চাচি এ সময়ের কষ্ট। পরে আর সামলাতে না পাইরা হেরা হাসপাতালে লইয়া গেলো। বাচ্চাটা হেইখানেই অইল। হু এখন তো পারলেই হাসপাতালে লইয়া যায়। আগেতো এমন আছিলো না।
ঠিকই কইছো চাচি। আগে হাজার কষ্ট পাইলেও বাড়িতেই পইরা থাকতে অইছে। আমার কথাই কও, বড় পোলাটা অয়ার সময় আমার অবস্থা কি কাহিল অইছিলো।
গত কয়েক বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। জমিলা বেগম খুব ভালো করেই এটা বুঝতে পারছেন। তিনি অন্ধ হওয়ার আগ থেকেই এ পরিবর্তন আসা শুরু করে। গ্রামের অনেক মানুষই এখন সন্তান হওয়ার সময় হাসপাতালে যেতে চায়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা সাধারণত হাসপাতাল ছাড়া বিকল্প চিন্তা করতে চায় না। যাদের সামর্থ্য নেই তারাও হাসপাতালে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর হাসপাতালে যাওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগ সন্তানই হয় পেট কেটে সিজারের মাধ্যমে। জমিলা বেগম আগে শুনতেন শহরের লোকদের এ রকম সন্তান প্রসব করানো হয়। গ্রামে আগে এরকম ছিলো না। অবশ্য আগের চেয়ে শহরের সাথে যোগাযোগও ভালো হয়েছে। মানুষ এখন যতোটা সহজে হাসপাতালে যেতে পারে আগে এ রকম চিন্তাও করতে পারতো না। তবে এখনও সবমানুষই হাসপাতালে যেতে পারে না। তিনি অন্ধ হওয়ার পর গ্রামের যে মহিলা দাইয়ের কাজ শুরু করে মানুষ তারও শরণাপন্ন হয়।
এখন উঠি গো মাই, মন্টু মিয়ার বউয়ের উদ্দেশ্যে জমিলা বেগম বললেন।
আরো কিছু সময় বও। বাড়িতে গিয়া তো কোনো কাম নাই।
না আইজকে উঠি, বেলা বাড়তাছে।
মন্টু মিয়ার বউ তাকে দুই পট চাল এনে দিলে তিনি শেফালির হাত ধরে উঠে পড়লেন। এখন কোন ঘরে যাবেন শেফালি তা জিজ্ঞেস করলে তাকে বাড়ির দিকেই যেতে বললেন। আজ আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা কেমন যেন হয়ে পড়েছে।
জমিলা বেগম শেফালির হাত ধরে হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে তার আগের স্মৃতিগুলো মনে পড়তে লাগলো। মায়ের পেট থেকে সন্তান বেরিয়ে আসার সময় কি যতেœই না দুজনের নাড়ির ছেদ ঘটাতেন। মাটির পাতিলে জ্বলন্ত আংরা নিয়ে কতো উপায়েই না নবাগতকে উষ্ণ রাখা হতো। মায়ের পেটের অদ্বিতীয় উষ্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে সন্তান যে আপাত শৈতল্যে পড়লো তা থেকে উত্তরণ ঘটাবার চেষ্টা; আবার জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে নামার জন্য তাকে প্রস্তুত করাও যেন। তিনি তো এখন এসব থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। মানুষও এখন এ সময়টা ভালোভাবে পার করার জন্য হাসপাতালকেই সর্বাগ্রে বেছে নিতে চায়। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই তার মনটা উদ্দাম পুলকে জেগে ওঠে। যে মানুষগুলোর জন্ম তার হাত দিয়ে হয়েছে তিনি তাদের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক অনুভব করলেন। জমিলা বেগম এটা ভেবে তৃপ্তি পেলেন যে, অনেকগুলো মানুষ তার হাত ধরে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছে; পৃথিবীতে নিজের যাত্রা শুরু করেছে। জীবনে এটা কম পাওয়া কিসের? হাঁটতে হাঁটতে তার অন্ধকার চোখে আলোর স্পর্শ অনুভব করে যেন।