জন্ম নেবার পর প্রত্যেক মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। অথচ বিভিন্ন উপায়ে সে স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়। গোষ্ঠি বা ব্যক্তিস্বার্থ, দলাদলি, হিংসা-লোভ, বিকারগ্রস্ত মানসিকতার কারণে মানুষ এমনটি করে। বাংলাদেশে এখন নিত্যনৈমিত্তিক পদ্ধতিতে কিংবা গা-সওয়া হয়ে যাওয়া পন্থায়, যেমন, যানবাহন-দুর্ঘটনা, বন্দুক-যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, পারিবারিক কলহের কারণে সংঘটিত হত্যা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না। হয়তো সে কারণেই আজকাল অভিনব কায়দায় মানুষ হত্যা চলছে। আর তাই হত্যার সঙ্গে জড়িত ও ভুক্তভোগি, উভয়ের মুখ টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসছে।
যে দেশে আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, নেতা, মন্ত্রি চাপাচাপি করে টেলিভিশন কিংবা পত্রিকার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, সে দেশের সাধারণ মানুষ কেন এমন সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার থেকে বাদ যাবেন? হঠাৎ জেঁকে বসা মিডিয়া-ফোবিয়ায় আসক্ত পুরো বাংলাদেশ। হয়তো আরও কিছুদিন চলবে এই নেশা। মোদ্দা কথা হলো, এই নেশা হত্যাকারিকেও বশ করে ফেলেছে।
অনেকে হয়তো ভুলেই গেছে যে, কিছুদিন আগেও গ্রামে কিংবা মফস্বলের মানুষ ঘরের দরজা-জানালা খুলে ঘুমুতেন। নিরাপত্তা এতোটাই ছিলো যে, শহরের মানুষও তা করতে পারতেন, কিন্তু সভ্যতার বাধা-নিষেধের কারণে অনেকে সেটা করতেন না। এখন তো গ্রিলবন্দি হয়ে থাকেন সংসার-সদস্যরা। মৃত্যু-আতঙ্ক যার অন্যতম কারণ। এই আতঙ্ক যে অচিরে বন্ধ হবে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে নরহত্যা অনেক কারণে হয়ে থাকে. তবে একটি ক্ষেত্র থেকে সহজেই এই নরহত্যা বন্ধ করা সম্ভব। সেটা হলো, আস্তিক-নাস্তিকের লড়াই। যেকোনো দ্ব›েদ্ব লিপ্ত পক্ষগুলোকে আগেভাগে চিহ্নিত করতে পারলে সমস্যা নিরসন সহজ হয়। সে দিক থেকে বিচার করলে আস্তিক আর নাস্তিকদের পরিচয় অনেকটা খোলা বইয়ের মতো। গুপ্তদল বলে কিছু নেই, দুজনেই মুখোমুখি হয়ে একই সমাজে বসবাস করছেন। রাতের অন্ধকারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কিংবা নদি পার হয়ে একজন অন্যজনকে আক্রমণ করছেন না, বরং বিচার-বুদ্ধি নিয়েই তারা এগুচ্ছেন। এদের আক্রমণ-ধারা দুরকম। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একপক্ষ হত্যার মতো নিষ্ঠুর পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যপক্ষ নিরস্ত্র অবস্থায় নিরব আক্রমণ করছেন।
মানবজাতির ইতিহাসে এ যাবৎ অনেক যুদ্ধ হয়েছে। সে সমস্ত যুদ্ধকে বৃহৎ, মাঝারি, ছোট অথবা স্বল্পমেয়াদি ও দির্ঘমেয়াদিভাবে ভাগ করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, অতীতের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে আলোচনার মাধ্যমে। এমনকি একশ বছর ধর চলা যুদ্ধও বন্ধ করা গেছে। সংলাপ হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বাংলাদেশের আস্তিক-নাস্তিকের মধ্যে যে দ্ব›দ্ব, সে দ্ব›দ্ব এখনও যুদ্ধ পর্যায়ে গড়ায়নি। কথা হলো, সমস্যাটা যখন যুদ্ধ নয়, শুধুই দ্ব›দ্ব, তাহলে সেটা বন্ধ হবে না কেন?
দুঃখের বিষয়, এই দুপক্ষকে এক টেবিলে বসানোর কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। যাদের কাছে আত্মসমর্পণ করানোর মতো হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ নেই তাদের সঙ্গে আলোচনা করা কি খুব কঠিন কাজ? অবশ্য যারা ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে পছন্দ করেন কিংবা মনে মনে ভাবেন আমার কি লাভ, বা যারা ভিতু প্রকৃতির লোক, তাদের দিয়ে হয়তো এ কাজ আশা করা যায় না। কিন্তু তারাই কি সব? বাংলাদেশে সাহসি ও সৎলোকের কি এতো অভাব?
আগামিতে যদি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এমন উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত থাকেন তাদের জন্য দু’একটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, আস্তিক-নাস্তিকের দ্ব›দ্ব অনেক পুরাতন হলেও জটিল নয়। জটিল হলে পুরনো প্রতিহিংসা থেমে থেমে না এসে বিরতিহীনভাবে চলতে থাকত। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্য করতে হবে বিশ্বাসিরা অবিশ্বাসিদের কোন বিশ্বাসকে অবিশ্বাস করেন। একইভাবে অবিশ্বাসিদের মধ্যে বিশ্বাসিদের কোন প্রকাশটা মনোঃপুত নয়। এরপর উভয়পক্ষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাজুক জায়গাগুলো তালিকাভুক্ত করতে হবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে অবশ্যই বাইরের ইন্ধন নিরুৎসাহিত করতে হবে। নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দেওয়া, অন্যের অধিকার রক্ষা এবং সর্বোপরি বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার পক্ষে সফলতা অর্জন করতে হবে। এ সমস্ত বিষয় সামনে রেখে ভাই-ভাইয়ের দ্ব›দ্ব মিটিয়ে দিতে যিনি এগিয়ে আসবেন জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমরা সাধারণ মানুষ ভালো করেই জানি যে, আস্তিক-নাস্তিকের মধ্যে বিভেদের মূলকারণ হল চিন্তার ভিন্নতা। দু’পক্ষেই চিন্তাশিল ব্যক্তি রয়েছেন। তবে একপক্ষ অন্যপক্ষের কথা মানতে চান না। এতটুকুই শুধু মেটাতে হবে। মানা না-মানার ব্যাপার। দল মাত্র দুটি। একপক্ষ পরম শক্তির কাছে অন্ধভাবে বিশ্বস্ত ও অনুগত। অন্যপক্ষ তথ্য-উপাত্ত থেকে উদ্ভুত যুক্তিনির্ভর। যে জায়গাটিতে উভয়ের মিল রয়েছে সেটা হলো, নির্ভরতা। যে নির্ভরতা ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে শক্তির কাছে গিয়ে ঠেকেছে। মজার ব্যাপার হলো, উভয়ের শক্তিই নিরাকার। কাজেই আকার সমস্যা নয়, বিবাদের মূলকারণ হলো একে অন্যকে মানা না-মানা।
একটা উদাহরণ দিলে হয়তো পরিষ্কার হবে। ধরুন, সূর্য পূর্ব দিক থেকে ওঠে, সে কারণে পূর্ব প্রান্তের জনপদ দাবি করছে সূর্যটা তাদের। আবার পশ্চিমে যারা থাকে তারা বলছে, দিনের ক্লান্তি শেষে সূর্য পশ্চিমে ফিরে আসে, তাই সূর্য তাদের। এক্ষেত্রে সূর্যের প্রকৃত দাবিদার কে সেটা নিয়েই বিতর্ক, অতঃপর দ্ব›দ্ব। যেদল পূর্ব দিককে সমর্থন করে, সেদল কিছুতেই পশ্চিমের দলকে মানবে না। কেননা এতে অধিকার চলে যাবে পশ্চিমের দিকে। তাহলে পশ্চিমের নির্দেশ মেনেই সারাজীবন তাদের চলতে হবে। একই অবস্থা পশ্চিমের লোকদের জন্যও প্রযোজ্য।
সভ্যতার বেশিরভাগ লড়াই এই অধিনস্থ থাকার বিষয়টি অস্বিকার করেই শুরু হয়েছে। যারা জ্ঞানভারে কুঁজো হয়ে আছেন তারা বলবেন, ফাঁপা বেলুনের সুতো ধরে উড়ে চলায় আনন্দ কোথায়? অন্যদিকে, মহান শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকা মানুষও চাইবেন না সমর্পণ থেকে বেরিয়ে আসতে। দু’পক্ষই জ্ঞানি, অথচ একপক্ষের জ্ঞান অন্যপক্ষের কোনো কাজে আসছে না। এখানেই জ্ঞানের সংজ্ঞা মারাত্মকভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের আলোতে যদি কেউ আলোকিত না হয় তবে জ্ঞানের উৎস উন্মোচন করে দেখতে হবে কিসের ঘাটতি সেখানে।
সভ্যতার পুরনো দ্ব›দ্ব, পুরনো এই বেদনা থেকে বেরিযে আসার উপায় তো আজ খুঁজতে হবে মানবজাতিকে, বৃহত্তর স্বার্থেই। নয়তো পরস্পরের হানাহানিতে ধ্বংসই কি অনিবার্য হয়ে উঠবে না?



Total Users : 8108