004745
Total Users : 4745
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

উত্তর-আধুনিকতা: একবিংশ শতাব্দীর ভাববাদ

অ্যালান সোকোল নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর কিঞ্চিৎ নামডাক আছে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির ব্যাপারে। হঠাৎ পদার্থবিদ্যা-অন্তঃপ্রাণ এই অধ্যাপক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ পাঠিয়ে বসেন সোস্যাল টেক্সট (Social Text) নামক ম্যাগাজিনে। সোস্যাল টেক্সট কোনো হেঁজিপেঁজি কাগজ না। মার্কিন মুল্লুকে উত্তর-আধুনিক (Postmodernist) সংস্কৃতি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্তি¡ক মুখপত্র এটি, এই কাগজের সম্পাদকমন্ডলীতে আছেন যারা, তাদের দুনিয়ায় তাত্তি¡ক জগৎ এক ডাকে চেনে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে অধ্যাপক সোকোলের ৩৯ পৃষ্ঠার দীর্ঘ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম ‘Transgressing the Boundaries: Towards a Transformative Hermeneutics of Quantam Gravity’ এর সঠিক বাংলা করা বর্তমান লেখকের ক্ষমতার বাইরে। Hermeneutics কথাটির অর্থ বাইবেল বা ধর্মগ্রন্থের বাণী সম্পর্কে বিভিন্ন টিকা নিয়ে চর্চা করে ধর্মশাস্ত্রের যে শাখা, কোয়ান্টাম গ্রাভিটি কোয়ান্টাম তত্তে¡র সেই জটিল শাখা, যেখানে শক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভিন্নতা প্রমাণের লক্ষ্যে মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হয়। Transgressing অর্থাৎ নিজের সীমা অতিক্রম করে যাবার পাপ। মোদ্দা কথা সোকোল যেটা বলার চেষ্টা করেন, তাহলো কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির কোনো আলাদা বিষয়গত অস্তিত্ব নেই। এটিও আসলে একটি সামাজিক এবং ভাষাগত নির্মাণ (Construct)। ঠিক যেদিন সোস্যাল টেক্সট-এর ১৯৯৬ সালের মে সংখ্যা প্রকাশিত হয়, ঠিক সেদিন এলান সোকোলের আর একটি লেখা প্রকাশিত হয় Linguna Franca-তে। সেখানে সোকোল ফাঁস করেন, সোস্যাল টেক্সট-এর তার প্রকাশিত লেখাটি আসলে একটি বিশুদ্ধ ভাঁওতা ছাড়া কিছু না। গোটা লেখাটাই আসলে ‘pastiche of left-wing cant’ (বামপন্থী কথাবার্তার অনুকরণ), ‘Fawning references’ (তোষামোদ করার মতো প্রসঙ্গ), ‘grandiosc quatations’ (জাঁকজমকপূর্ণ উদ্ধৃতি), an outwrite nonsence, structued around silliest quatations [by postmodernist academics he could find about mathmatics and Physics]। নিজের লেখা সম্বন্ধে উদ্ধৃতি লেখক অ্যালান সোকোলের নিজের।
কেনো লেখাটি সোকোলের মতো একজন পন্ডিত লিখলেন এবং ছাপালেন তা খুব পরিষ্কার-তিনি বেআব্রু করতে চেয়েছিলেন তথাকথিত উত্তর-আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের। কোয়ান্টাম তত্তে¡র সাথে জ্যাক লাঁকার মনস্তত্তে¡র তত্তে¡র সম্পর্ক স্থাপন, জ্যাক দেরিদার বিনির্মাণের (deconstruction) মধ্যে আপেক্ষিকতার তত্ত¡কে খুঁজে পাওয়া যায়-এগুলো দেখেও সোস্যাল টেক্সট-এর সম্পাদকদের মনে হয়নি যে, কেউ তাদের সাথে রসিকতা করছে। প্রবন্ধটি যা বলছে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে কি-না তা একবার কোনো পদার্থবিদকে দেখিয়ে নেবার প্রয়োজনও বোধ করেননি এরা। অথচ সোস্যাল টেক্সট-এর ঐ সংখ্যাটির বিষয়বস্তু ছিল ‘বিজ্ঞান যুদ্ধ’।
সোকোলে তীব্র আক্রমণ করেন তার ভাষার তথাকথিত ‘উত্তর দীপায়ন’ (Post-Enlightenment) অন্ধবিশ্বাসকে, যা পশ্চিমের বুদ্ধিজীবী জগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যা বাস্তব জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। এই বামপন্থী হাবভাব করা উত্তর-আধুনিকতার বিরুদ্ধে সোকোলের যুদ্ধ। তাঁর ভাষায়, ‘বামপন্থাকে রক্ষা করার জন্য’।
সোকোল বলেছেন কেনো তিনি এই কাজ করলেন-But why did I do it? I confess that I’m an unabashed old Leftist who never quite understood how deconstruction was supposed to help the working class. And I’m stodgy old scientiest who believes, nairvly, that there exists an external world, that there exists objective truths about that world, and that my job is to discover some of them.
সোকোল কোনো অর্থেই দার্শনিক বা সমাজবিজ্ঞানী নন। কিন্তু একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি যে জিনিসগুলো বুঝেছিলেন, তাহলো-উত্তর-আধুনিকতা এমন একটি মতবাদ যা বামপন্থা হিসেবে নিজেকে দাবি করলেও আসলে বামপন্থাদের শত্রু। মতাদর্শগত সোকোল একে বলেছেন, ‘epistemic relativism’. যার অর্থ জ্ঞানতত্ত¡ হিসেবে তা আপেক্ষিকতায় বিশ্বাসী অর্থাৎ কোনো কিছুরই স্থির অর্থ আছে বিশ্বাস করে না। বাস্তব বা সত্য তা কখনও অনুধাবন করা যায় বলে মনে করে না।
উত্তর আধুনিকতা আসলে কি? উত্তর-আধুনিকতাকে মতাদর্শ হিসেবে আলোচনা করতে গেলে তার একটি উৎপত্তিগত বৈশিষ্ট্য আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার। উত্তর-আধুনিকতার জন্ম মার্কিন মুল্লুকে হলেও এর বিস্তারের যুগটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী সমাজ। যাদের উত্তর-আধুনিক তাত্তি¡ক হিসেবে দুনিয়াজোড়া স্বীকৃতি, তারা প্রায় সবাই ফরাসি। যদিও তারা একই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। যেমন মিশেল ফুকো সেই অর্থে কাজ করেছেন ইতিহাস নিয়ে। দেরিদা ভাষাতত্ত্ব, লাঁকা মনস্তত্ত্ব, লিওতার দর্শন এবং সাহিত্য ও কলা সমালোচক। প্রধান তাত্ত্বিকদের ভিত্তিভূমি আলাদা হবার কারণে হয়তো উত্তর-আধুনিকতা বলতে কোনো সংজ্ঞাবদ্ধ ধারণা পাওয়া যায় না। বলা যায়, একগুচ্ছ ধারণা, যার অনেকগুলো একে অন্যের পরিপূরক, কিছু চূড়ান্ত ক্ষেত্রে এমনকি পরস্পরবিরোধীও। বরং অনেক সহজে বলা যায়-উত্তর-আধুনিকতা আসলে কিসের বিরোধী, উত্তর-আধুনিকতা আসলে কাকে নস্যাৎ করতে চায়। অনেকগুলো না-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে উত্তর-আধুনিকতা।
উত্তর-আধুনিকতার রমরমা ১৯৬৮ সালের পরের ফ্রান্সে, কিন্তু এর সূত্রপাত ’৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নামেই পরিষ্কার, এর চরিত্রের সাথে ঘনিষ্ঠতম যোগাযোগ যে বিষয়টি, তা হলো আধুনিকতা। উত্তর-আধুনিকতা কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘আধুনিকতাকে অতিক্রম করে’, কিন্তু মর্মবস্তুতে উত্তর-আধুনিকতা হলো আধুনিকতার সর্বাত্মক বিরোধিতা। আধুনিকতা বা ইংরেজিতে modernism কথাটি অর্থের দিক থেকে ব্যাপক। মার্কসীয় ইতিহাসবিদ আইজাজ আহমেদ আধুনিকতাকে এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে-আধুনিকতা বলতে ইউরোপ এবং আমেরিকার বুকে একটি নির্দিষ্ট যুগ যা সৃষ্টি হয়েছিলো (ক) চিন্তার ক্ষেত্রে আলোকপ্রাপ্তি (enlightenment), (খ) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব এবং (গ) শিল্প বিপ্লবের ফলে সামাজিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে। এই নির্দিষ্ট যুগের দর্শন, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক কাঠামো, শিল্প অর্থনীতি, বুর্জোয়া সমাজ এবং এর বুকে উত্থিত বিপ্লবী মতাদর্শের মধ্য দিয়েই আধুনিকতা প্রকাশিত হয়েছে।
আধুনিকতা সেই প্রশ্নে মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। কেউ মনে করে এই পর্যায় এখনও প্রসারমান, কেউ মনে করে এই পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রশ্নে এ এক নজিরবিহীন সময়। সম্পদ, সংস্কৃতি, সৃষ্টি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক দীর্ঘ উল্লম্ফন। কিন্তু এই সব কিছুর উৎসে আছে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তি। যার ভিত্তি যুক্তিবাদ এবং মানবিকতা। যুক্তিবাদের এক পথ ধরে বিকশিত দর্শন, সমাজতত্ত¡ আর এক পথ ধরে বিজ্ঞান। স্পিনোজা আর নিউটন দু’জনই। ফরাসি বিপ্লবের মানবমুক্তি এবং সমানাধিকারের প্রশ্নটির বাস্তবায়নের দু’টি পথ, বুর্জোয়া উদারনীতি অথবা সমাজতন্ত্র। হয় জন স্টুয়ার্ট মিল অথবা কার্ল মার্কস।
কিন্তু এই সব কিছুকে অতিক্রম করে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে-এই আধুনিকতা কি মানুষকে তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নের দেশে পৌঁছে দিতে পেরেছে। আধুনিকতার স্বপ্নের পথে বারবার কেনো দুঃস্বপ্ন হানা দেয়। এই আধুনিকতা সভ্যতাকে অহংকার করার মতো জ্ঞান-অগ্রগতি দিয়েছে, আবার ফ্যাসিবাদেরও জন্ম দিয়েছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, হিরোশিমা, বিশ্বায়ন, সাম্রাজ্যবাদ এগুলোও তো আধুনিকতার ‘দান’। তাহলে কেন মানবসভ্যতা এই আধুনিকতায় সন্তুষ্ট থাকবে?
মার্কসবাদ এই আধুনিকতারই সৃষ্টি। যুক্তিবাদ, মানবিকতা, সমানাধিকারের এক চূড়ান্ত প্রকাশ মার্কসবাদ। আধুনিকতা জন্ম দিয়েছে পুঁজিবাদের, আর পুঁজিবাদই আধুনিকতাকে বহন করেছে তার অগ্রগতির পথে। কিন্তু যেকোনো ব্যবস্থার মতো পুঁজিবাদের উত্থান ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়া থাকে। থাকে প্রগতির যৌবন এবং পচনের বার্ধক্য। আধুনিকতা আর পুঁজিবাদ অনেক সময়েই সমার্থক হয়েছে, ফলত পুঁজিবাদের পচনের দায়ও বর্তেছে আধুনিকতার উপর। আধুনিকতা যে রকম পুঁজিবাদের জন্মবৃত্তান্ত সে রকম পুঁজিবাদের মৃত্যুবাদের হদিস। মার্কসবাদও আধুনিকতা, শ্রমিকশ্রেণির জন্মদাতাও আধুনিকতা, পৃথিবীর ইতিহাস যে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস, সেই বোধও আধুনিকতা। আধুনিকতার পথ জুড়ে কেনো আলো এবং অন্ধকারের খেলা তার উত্তর জানে মার্কসবাদীরা-কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও এটা সত্যি, পৃথিবীর সবাই মার্কসবাদী না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের The Decline of the West প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্র অতলান্তিকের দুই পার জুড়েই ঝড় তোলে এই বইটি। জার্মান দার্শনিক স্পেঙ্গলারের মোদ্দা বক্তব্য ছিলো, পশ্চিমী সভ্যতা তার যৌবন অতিক্রম করে বার্ধক্যের কোলে ঢলে পড়েছে। এই সভ্যতার যে মূল কাঠামো তা ধ্বংসের মুখে। যে বন্ধনগুলো এই সমাজকে ধরে রেখেছে তাতে পচন ধরেছে। যেকোনো সভ্যতার উত্থান ও পতনের একটি প্রাকৃতিক চক্রের মধ্যে দিয়ে যায়। স্পেঙ্গলারের অভিমত, পশ্চিমী সভ্যতা তার আলোকপ্রাপ্তির হেমন্ত অতিক্রম করে স্বার্থপরতা এবং সাংস্কৃতিক nihilism-এর শীতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, স্পেঙ্গলার মার্কসবাদী ছিলেন না। সেই সময়কার আর পাঁচজন জার্মান বুদ্ধিজীবীর মতোই বিশ্বাস করতেন মার্কসবাদ না, সমাধান জার্মান জাতীয় চরিত্র সংবলিত এক সমাজতন্ত্র। যদিও স্পেঙ্গলারের জাতীয় সমাজতন্ত্র নাৎসিদের জাতীয় সমাজতন্ত্রের থেকে, আলাদা ছিলো। ইহুদি বিরোধিতায় কখনও বিশ্বাস করেননি তিনি। প্রশ্নটা এক্ষেত্রে স্পেঙ্গলার কি লিখেছিলেন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তার লেখার তৎকালীন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। স্পেঙ্গলার আসলে আধুনিকতার অবসানের কথা বলেছিলেন-তার সেই সময়ের পৃথিবীর কাছে কথাটি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছিলো। কারণ, সেই সময় ছিলো পুঁজিবাদী সভ্যতার এক তীব্র সংকটের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে গ্রেট ডিপ্রেশন-কোথাও কোনো আশার আলো নেই। আলো যেখানে পড়ছে তা সমাজের একদম তলার অংশ-উৎস ১৯১৭’র পরের রাশিয়া। বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণি আর সংকটে নিমজ্জিত আগ্রাসী বুর্জোয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অসহায় সোস্যাল ডেমোক্রাট নিয়ন্ত্রিত ওয়াইমার রিপাবলিক। প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থা ছুটে যাবার মতোই পরিস্থিতি।
কিন্তু চার দশক পরে প্রায় একই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন আমেরিকান সমাজতত্ত¡বিদ চার্লস রাইট মিলস। সোসিওলজিকাল ইমাজিনেশন (Sociological Imagination), প্রকাশিত ১৯৫৯-রাইট মিলস এর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। মিলস বললেন, ‘যাকে আমরা আধুনিক যুগ বলি, তা শেষ হচ্ছে আমরা প্রবেশ করছি এক উত্তর-আধুনিক যুগে। আর আলোকপ্রাপ্তির ধারণাগুলো প্রাসঙ্গিক না। যুক্তিবাদ এবং মুক্তির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীলতারও অবসান ঘটেছে। আজকের পৃথিবীর ব্যাখ্যা সেই ধারণাগুলো আর দিতে পারছে না। একই সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে জন স্টুয়ার্ড মিল এবং কার্ল মার্কস।
স্পেঙ্গলার এবং রাইট মিল একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কিন্তু ১৯১৯-এর পৃথিবী আর ১৯৫৯-এর পৃথিবীর মধ্যে ফারাক আকাশ পাতাল। বিশেষত, পুঁজিবাদের প্রশ্নে। ১৯১৯ যদি পুঁজিবাদের সরকারের এতো করুণ চিত্র হয়, ১৯৫৯-এ সেই প্রশ্নে পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ। অন্তত, এরিক হবস্ম্যান একে Golden Age অমব-ই বলেছেন। বিশ্বযুদ্ধের পরের টানা তিন দশকের সংকটহীন পুঁজিবাদী সমৃদ্ধির শীর্ষে তখন পৃথিবী, পশ্চিমী পুঁজিবাদ। আর মার্কিন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি তখন একুল ওকুল ছাপিয়ে। বিশ্বযুদ্ধে বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি অথচ বিজয়ীর সব সুবিধা লাভ। হাতে পারমাণবিক বোমা, আকাশে মহাকাশযান। মার্শাল প্ল্যানের দৌলতে গোটা ইউরোপ হাতের মুঠোয় বা পায়ের তলায়। ভিয়েতনাম নামক একটি ছোটো কালো মেঘ ছাড়া মার্কিনী এবং পুঁজিবাদের আকাশ আলোকিত। মার্কিন সমাজ তখন গলব্রেখের ভাষায় ‘সমৃদ্ধ সমাজ’ (Affluent Society)। ‘সব সমস্যা সমাধানের’ যন্ত্র কম্পিউটার ঘরে ঢুকেছে।
স্পেঙ্গলার আধুনিকতার প্রতি আস্থাহীন হয়েছিলেন হতাশা থেকে, পুঁজিবাদের করুণ দশা দেখে। কিন্তু রাইট মিলের উত্তর-আধুনিকতার উৎসে পুঁজিবাদ সম্পর্কে কোন হতাশা নেই, বরং আছে এই আশাবাদ-যে পুঁজিবাদ অবশেষে সংকটহীন স্তরে পৌঁছে গেছে। আধুনিকতাবাদ যে পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে তার অস্তিত্বের প্রতিপদে সংকট। আধুনিকতা থেকে উত্তর-আধুনিকতার যুগের পরিবর্তন মর্মবস্তুর দিক থেকে আসলে পুঁজিবাদের চরিত্র পরিবর্তন। পুঁজিবাদের পরিবর্তন করতে পারে সমাজবিপ্লব-মার্কিন মুল্লুকে মার্কসবাদী গণ-আন্দোলন কখনোই তীব্র ছিলো না। ফলত এই সম্ভাবনা কখনোই খুব বাস্তব মনে হয়নি। পুঁজিবাদের যা যা খারাপ গুণ পুরানো পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য, আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য-উত্তর-আধুনিকতা এইগুলোকে নির্মূল করবে, কিন্তু পুঁজিবাদকে নির্মূল করবে না।
উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের বক্তব্য ১৯৪৫-এর পর পুঁজিবাদের চরিত্রের একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যুগকে তারা বর্ণনা করছেন কখনো উত্তর ফোর্ডিজম (Post Fordism), কখনো উত্তর শিল্প যুগ (Post-Industrial), কখনো তথ্যের যুগ (Information Era)-হাজার নতুন বিশেষণ, হাজার নতুন বিশ্লেষণ।
১৯৪৫ থেকে আজ পর্যন্ত প্রসারিত যে যুগ তা নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদের নিরবচ্ছিন্ন স্বর্ণযুগ না। তা শেষ হয়ে গেছে ১৯৭৩-এ। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার যে চেহারা পৃথিবী আজ চেনে তার জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও তার বিস্তার আর তাত্তি¡ক কলেবর লাভ প্রধানত হয়েছে ফ্রান্সে। এবং সময়টা ১৯৬৮-র পর, স্বর্ণযুগ তখনও অব্যাহত। কিন্তু ’৫০-এর দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ’৭০-এর দশকের গোড়ার ফ্রান্স পটভূমিকা হিসেবে এক না। অর্থনৈতিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউরোপের যে সমৃদ্ধি তার ভাগিদার ফ্রান্স। ঠান্ডা যুদ্ধের দৌলতে কয়েক লাখ মার্কিনী সৈন্য এবং মার্শাল প্ল্যানের দয়ায় অঢেল মার্কিনী ডলার। বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে পুঁজিবাদি কাঠামোয় পুনর্নির্মাণ বললে কম-প্রকৃতপক্ষে বিপুল শিল্পায়ন ফ্রান্সের সামাজিক বিন্যাসকে নতুনভাবে নির্মাণ করছিলো। যতোই সাম্রাজ্যবাদী হোক, বিশ্বযুদ্ধের আগেও ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রামীণ। ঝড়ের গতিতে এই জায়গা থেকে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হচ্ছে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে একটি নতুন বিপুল মধ্যবিত্ত অংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে। আর্থিক সমৃদ্ধি, কল্যাণমূলক অর্থনীতি এবং সোস্যাল ডেমোক্রাটিক রাজনৈতিক পরিমÐলে একটা বড় অংশের কাছে পৌঁছেছিলো। এটাই ছিলো ফ্রান্সে উত্তর-আধুনিকতার বিস্তারের অর্থনৈতিক পটভূমি। পুঁজিবাদের কোনো সংকট না, বরং পুঁজিবাদের সুখের দিনই ছিলো পটভূমিকায়।
এই অর্থনৈতিক পটভূমিকা এক্ষেত্রে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তৎকালীন ফ্রান্সের রাজনৈতিক পটভূমিকা। আমেরিকার থেকে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পটভূমিকার প্রধান ফারাক একটি শক্তিশালী বামপন্থী ঐতিহ্য। এমনকি একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি। সমাজতান্ত্রিক দেশের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি দু’টি ছিলো ইতালি ও ফ্রান্সে। ছিলো বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বিপুল সমাহার। ছিলো দুই শতাব্দীর বৈপ্লবিক প্রগতিশীলতার ঐতিহ্য। চিন্তার জগতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণার জন্ম দিয়েছে প্যারিসের ক্যাফেটেরিয়াগুলো, সাধারণ ফরাসিদের এই গর্ববোধ একদম অমূলক ছিলো না।
উত্তর-আধুনিকতার প্রধান পুরুষেরা প্রায় সবাই ফরাসি। এবং প্রায় সবারই উৎসে আছে বামপন্থী রাজনীতি। উত্তর-আধুনিকতার প্রধান দার্শনিক ভিত্তি যিনি দিয়েছেন সেই মিশেল ফুকো, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। জাক দেরিদা চিরকাল নিজেকে মার্কসের ভক্ত বলে দাবি করেছেন। নিজের মতো করে মার্কসের ভাষ্য দিয়েছেন তার ‘স্পেকটার অব মার্কস’-এ। যদিও তার সাথে মার্কসবাদীরা একমত নন। ফরাসি মার্কসবাদী লুই আলতুসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন (এবং সারাজীবন তাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন)। উত্তর-আধুনিকতার মহাভাষ্যকার জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার ছিলেন ট্রটস্কিপন্থী; আর এক উত্তর-আধুনিক তাত্তি¡ক জুলিয়া খৃশ্চেভা ছিলেন কট্টর মাওবাদী। কিন্তু এদের সবার উৎসে আছে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তাহলো ১৯৬৮-র ছাত্র-বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের মর্মবস্তুতে লুকিয়ে আছে উত্তর-আধুনিকতার উৎস।
এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তাত্তি¡কভাবে ফরাসি বামপন্থার চূড়ান্ত বিভাজন ঘটে। এই বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে সমাজ বিপ্লবে প্রোলেতারিয়েতের ভূমিকাকে অস্বীকার করার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। এই বিদ্রোহের মধ্য থেকে অনেকগুলো তাত্তি¡ক প্রবণতার জন্ম হয়-এর মধ্যে প্রধান উত্তর-আধুনিকতা। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম মার্কসবাদী তাত্তি¡ক হার্বাট মার্কেস এই তত্ত¡ হাজির করেন যে, শ্রমিকশ্রেণি তার বিপ্লবী চরিত্র হারিয়েছে। এখন বিপ্লব আনবে ছাত্র এবং শহুরে লুম্পেনদের বিপ্লবী বাহিনী। প্রয়োজন নেই বিপ্লবী বাহিনীর সংগঠন বা শৃঙ্খলার। বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রধান ভিত্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত নয়া-বামের (ঘবি খবভঃ) জনক মার্কেস। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা উত্তর-মার্কসবাদ (চড়ংঃ গধৎীরংস)। যার প্রধান মুখপত্র আর্নেস্ট লাকলা এবং সান্টাল মুফো এবং তাদের এই হেজিমনি অ্যান্ড সোস্যালিস্ট স্ট্রাটেজি। এদেরও প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজ বিপ্লবে শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রমিকশ্রেণির অপ্রাসঙ্গিকতা। সাধারণভাবেই এই ছাত্রবিপ্লবীর কাছে আদর্শ মার্কস বা লেনিন না, এদের উজ্জীবিত করে মাও এবং চে গুয়েভারা। বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় না রেখেই বিপ্লবের স্বপ্ন এ দু’জনই দেখাতে পারেন। সমাজ বিপ্লবের মতো একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার পেছনে লাগে শ্রেণিসমূহের অনুকূল জোট, লাগে ধৈর্য্য, ত্যাগ, তিতীক্ষা। লাগে বিপ্লবী সংগঠন। এর পেছনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিপ্লব সম্পর্কে একটি বাস্তবজ্ঞানহীন রোমান্টিক ধারণা তরুণ মধ্যবিত্ত বিপ্লবীদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বাদ দিয়ে একটি বিপ্লবী তত্তে¡র খোঁজ শুরু হয় এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে।
ছাত্রবিদ্রোহের শুরুতে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্রদের সাথেই ছিলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যারিকেড তৈরি করে সশস্ত্র লড়াই-এর প্রস্তুতিতে পার্টি ছাত্রদের সতর্ক করে-এটি হবে চূড়ান্ত হটকারী কাজ। ফরাসি সরকারি বাহিনী কেবল না, ইউরোপের উপস্থিত মার্কিন বাহিনীও নিরপেক্ষ থাকবে না, ফ্রান্সে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখলে। কমিউনিস্ট পার্টিকে আপসকামী এবং সংশোধনবাদী আখ্যা দিয়ে বিভাজন ডেকে আনা হয়। ছাত্র বিদ্রোহের নেতৃত্বে চলে আসে ট্রটস্কিপন্থী, মাওবাদী এবং নৈরাজ্যবাদীরা।
এই বিদ্রোহ ছিলো প্রধানত মধ্যবিত্ত যুব বিদ্রোহ। ফ্রান্সে কোনো পুঁজিবাদী সংকট এর জন্ম দেয়নি। মধ্যবিত্তের সামনেও ছিলো না কোনো বড় অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যাও বিশেষ ছিলো না। মধ্যবিত্ত আর্থিকভাবে খুশিই ছিলো। সমস্যা হয়েছিলো ফরাসি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার। যা ছিলো অতীতের মতো অভিজাততান্ত্রিক; কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির হঠাৎ স্ফীতি এই ব্যবস্থার ভেতরে সংঘাত তৈরি করেছিলো। আইজাজ আহমেদ দেখাচ্ছেন ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮-এর মধ্যে উচ্চশিক্ষায় আসা ছাত্রের সংখ্যা ৩ গুণ হয়ে গিয়েছিলো ফ্রান্সে।
কিন্তু মালিক-শ্রমিক শ্রেণিদ্বন্দ্বে বাইরেও মধ্যবিত্তের সাথে শ্রমিকশ্রেণির দূরত্ব বাড়ছিলো। পশ্চিম ইউরোপে শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিনিধি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো না, প্রতিনিধি সোস্যাল ডেমোক্রাটিক বা সোস্যালিস্ট পার্টিগুলো। পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে বড় পার্টি এরা। জনকল্যাণমূলক অর্থনীতির প্রবক্তা এরা। যুদ্ধ পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান স্রষ্টা এরাই। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা দূরে থাক, এরাই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশ্বযুদ্ধের আগে এই সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিগুলো মুখে অন্তত মার্কসবাদ বলতো, বিশ্বযুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সেটাও শেষ করে দিয়েছিলো। বিপ্লবী পার্টি হিসেবে শ্রমিকদের পার্টিকে বুঝবার কোনো সুযোগ সোস্যাল ডেমোক্রাটরা দেয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও দূরত্ব বাড়ছিলো অন্য কারণে। ফ্রান্স বিশ্বযুদ্ধের পর দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশিক যুদ্ধে হেরে যায়, এক ইন্দোচিন আর একটি আলজিরিয়া। তাদের কাছে আলজিরিয়ার হারের ধাক্কাটা ছিলো ফরাসি জীবনে সুদূরপ্রসারী। কমিউনিস্ট পার্টি খুব স্বাভাবিকভাবেই উপনিবেশের মুক্তির পক্ষে মত দিয়েছিলো। মধ্যবিত্তের ‘আহত জাতীয়তাবোধ’ এতে খুশি হয়নি। কমিউনিস্টরা মার্শাল প্ল্যানের বিরোধিতা করেছিলো অথচ মার্শাল প্ল্যানে মধ্যবিত্ত উপকৃত হচ্ছিলো।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই গোটা ইউরোপ জুড়ে কমিউনিস্টদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়েছিলো। ফ্যাসিবিরোধী পার্টি জান লড়াইয়ের নেতৃত্বেও ছিলো কমিউনিস্টরা। ফ্যাসিবিরোধী গণতান্ত্রিক ঐক্যের যে আহবান ডিমিট্রভের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক দিয়েছিলো তার ফলশ্রæতিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গোটা ইউরোপের প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক শক্তি একজোট হয়েছিলো-মার্কসবাদের প্রতি বেড়েছিলো আকর্ষণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মত্যাগ এবং পরবর্তী সময়ে লালফৌজের বিজয় এই শ্রদ্ধার মনোভাবকে আরো বাড়িয়েছিলো। ইউরোপিয় মণীষার জগতে সে ছিলো মার্কসবাদের এক স্বর্ণযুগ। (এর চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন এরিক হবস্বাম তার How to change the world বইয়ে)।
কিন্তু এই স্বর্ণযুগ স্থায়ী হয়নি। কারণ অনেকগুলো-এক, ঠান্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত। মিডিয়া আজকের মতো শক্তিশালী না থাকলেও তীব্র সোভিয়েত এবং কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারের ঝড়। দুই, পশ্চিম ইউরোপের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মার্কিনী প্রভাবের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। তিন, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের সময় যে উদারতা নিয়ে কমিউনিস্টরা অন্য মতের প্রতি সহনশীলতা দেখাচ্ছিলো ঠান্ডা যুদ্ধের শুরুতেই সেটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
মার্কসবাদ সম্পর্কে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির যা ভাষ্য সেটাই একমাত্র মার্কসবাদ-এই ধারণা, যা প্রকাশিত হচ্ছিলো সোভিয়েত এবং অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্য দিয়ে, তা কমিউনিস্টদের তাত্তি¡ক বিচ্ছিন্নতা বাড়াচ্ছিলো। ইউরোপে এক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মার্কসবাদের জন্ম হচ্ছিলো যার সাথে ব্যবহারিক মার্কসবাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে চিন এবং সোভিয়েতের বিরোধ ক্রমশ তীব্র হচ্ছিলো। পরবর্তী স্তরে তথাকথিত ‘মাওবাদী’ ধারণা-যার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো সোভিয়েত বিরোধিতা এবং তা কালে কালে মার্কসবাদী হাবভাব করা নৈরাজ্যবাদে পরিণত হয়।
১৯৫৬-তে হাঙ্গেরি এবং ১৯৬৮-র চেকোস্লোভাকিয়ার ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে জনমানসে বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছিলো।
একটি আন্দোলন-যা হবে বামপন্থী, অথচ মার্কসবাদী না। যা হবে সোভিয়েত বিরোধী (অন্তত ১৯৮৯ পর্যন্ত) এবং সাধারণভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী। পুঁজিবাদের দীর্ঘায়ু কামনায় ঠিক এরকম একটি আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে মার্কসবাদ বিরোধী কথা বললে কাক্সিক্ষত ফল আসবে না। মুখে মার্কসবাদ বলে আক্রমণ করতে হবে মার্কসবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে। এক, পুঁজিবাদের অবসান ঘটানোর বিপ্লবী সম্ভাবনাকে নাকচ করতে হবে। এ কাজ হবে দু’ভাবে-এক, পুঁজিবাদ পাল্টে গেছে। শোষণ আর নেই, আর যদি থাকেও সেটা অগ্রাহ্য করা যায়। এর জন্য এই তত্ত¡গুলোর উদ্ভবের আদর্শ সময় পুঁজিবাদের প্রসারের সময়, সংকটের সময় না। দুই, সমাজ পরিবর্তনের বিজ্ঞানটাই ভুল। ভুল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই। ফলত পুঁজিবাদের অবসানের কোনো ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা নেই।
পুঁজিবাদের স্থায়ীত্ব দিতে গেলে মার্কস বর্ণিত পুঁজিবাদের কবর খননকারীদের নাকচ করতে হবে। নাকচ করতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে, নাকচ করতে হবে তার ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকাকে। ইতিহাসের চালিকাশক্তি শ্রেণিসংগ্রাম, তার ফলশ্রæতিতেই সমাজ বিপ্লব। শ্রেণিসংগ্রাম অপ্রয়োজনীয়। সম্ভব হলে শ্রেণি নামক সত্তাটিকেই অস্বীকার করা। আর শ্রমিকশ্রেণির প্রধান হাতিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার বিপ্লবী শৃঙ্খলা এগুলো পরিত্যাজ্য তো বটেই।
মার্কসবাদ ও শ্রমিকশ্রেণির উপর এই তাত্তি¡ক আক্রমণগুলো নতুন না। মার্কসবাদের জন্ম মুহূর্ত থেকেই এই আক্রমণগুলো চলছে আর এই আক্রমণগুলোর মোকাবিলা করেই মার্কসবাদ এগিয়েছে। কিন্তু এই সামগ্রিকতা নিয়ে আক্রমণটা ছিলো নতুন। উত্তর মার্কসবাদ বা নয়া বামের আক্রমণ নির্দিষ্টভাবেই ছিলো শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির উপর। এই অতি বিপ্লবিদের অধিকাংশই শেষবেলায় আশ্রয় নিয়েছে পোস্ট-মডার্নিজম-এর ছাতার তলায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উত্তর-আধুনিকতার জনকরা অধিকাংশই প্রাক্তন ট্রটস্কিপন্থী। শেষ বিচারে এরা সবাই মার্কসবাদকে নস্যাৎ করার কাজে হাত লাগিয়েছে। ফরাসি ছাত্র বিদ্রোহের মধ্য থেকে যে উত্তর-আধুনিকতার যাত্রা শুরু, তা চূড়ান্ত গতি পেলো ইউরোপের বুকে সমাজতন্ত্রের অবসানে। সূচিত হলো পুঁজিবাদের ‘চূড়ান্ত বিজয়’। উল্লাসের বহর দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই বিয়ে কার-পুঁজিবাদের না উত্তর-আধুনিকতার।
সোভিয়েতের পতনের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া নব্য হেগেলিয়ান ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার End of History। বুর্জোয়া উদারনীতি সমাজতন্ত্রের উপর চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করলো। উত্তর-আধুনিকতার উল্লাস-অবশেষে আধুনিকতা, যুক্তিবাদ, কার্য ও কারণের সম্পর্কের অবসান ঘটলো। প্রমাণ হলো ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই, ইতিহাস সম্পর্কহীন ঘটনার একটি বিশৃঙ্খলা।
কিন্তু এটিও পুঁজিবাদকে রক্ষা করার পক্ষে যথেষ্ঠ না। চোখের সামনে ‘পুঁজিবাদের বিজয়ের’ কুৎসিত চেহারা দেখে মানুষ চিরকাল হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এটা হয় না। উত্তর-আধুনিকতা পুঁজিবাদের কুৎসিত বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধে মুখর হয়, কিন্তু এর উৎসে যে পুঁজিবাদ সেটিকে সযতেœ আড়াল করে। আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মার্কসবাদী পথটিকে সর্বাংশে পরিহার করে।
উত্তর-আধুনিকতা সূত্রপাতটি দাঁড়িয়ে আছে দুটি প্রধান ভিত্তির উপর-পুঁজিবাদের চরিত্রের পরিবর্তন এবং সেই সূত্রে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সম্ভাবনার অবসান। এ বিষয়ে প্রথম এবং প্রধান ভাষ্যটি আসে মার্কিন সমাজতত্ত¡বিদ ডানিয়েল বেলের কাছ থেকে তার উত্তর-শিল্পযুগের ধারণায় (Post Industrialism) ডানিয়েল বেল তিনটে যুগের উল্লেখ করেন-চিরায়ত (traditional), শিল্পযুগ এবং উত্তর শিল্পযুগ। তার চিরায়ত যুগ আসলে সামন্ততন্ত্র। আর পুঁজিবাদকে বেল ভেঙেছেন শিল্প এবং উত্তর শিল্প এই দুটি ভাগে। বেলের এই ধারণার পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা আছে অ্যালেক্স ক্যালিনিকোসের Against Postmodernism: A Marxist Critique বইয়ে। বেল উত্তর-শিল্প যুগের যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলেছেন তা কতোটা অসার তা ক্যালিনিকোস দেখিয়েছেন। বেল এবং যে সূত্রে পোস্ট মডার্নিস্টদের রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য যেহেতু কারখানাভিত্তিক শিল্প উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং)-এর সাথে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। আর শ্রমিকদের মধ্যে বাড়ছে কায়িকশ্রম বিযুক্ত উচ্চ আয়ের কাজ (white Colour)-এর ফলে শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকদের রাজনৈতিক গুরুত্ব¡ ক্রমশ কমছে। এবং এরা আর সর্বহারা না, এরাও ভোগবাদী সমাজের অংশ। তাদেরও নিজেদের গাড়ি এবং বাড়ি রয়েছে। ফলত এই শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনা আর নেই।
ডানিয়েল বেল তার The Coming of Post-Industrial Society লেখেন ১৯৭৩ সালে কিন্তু তিনি বিখ্যাত বা কুখ্যাত হন ১৯৬০ সালে The End of Ideology লিখে। যেখানে তিনি বলেন যে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় জন্ম নিয়েছিলো যে মতাদর্শগুলো সেগুলো সব প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে (ফুকুয়ামার অনেক আগেই বেল কথাটি বলেছিলেন)। আদ্যন্ত হতাশাবাদী বেল বলেন এর বদলে একঝাঁক সংকীর্ণ মতবাদের উত্থান হবে। দু’টি বই মিলেই মার্কিনী উত্তর-আধুনিকতার পূর্ণাঙ্গ চেহারাটি মিলবে। বেল যে উত্তর-শিল্পযুগের বর্ণনা দিয়েছেন তার ভিত্তিতেও আছে-পুঁজিবাদ তার সংকটের স্থায়ীভাবে কাটিয়ে উঠছে এই ভুল ধারণা।
এই যুগের বৈশিষ্ট্য-উৎপাদন আর প্রধান বিষয় না, ভোগই-(Consumption) প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোন পুঁজিপতির সিদ্ধান্ত না, পণ্যের চাহিদার ভিত্তিতেই উৎপাদন বাড়ানো কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। চাহিদাকে কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয় সহজ শর্তে ঋণ পাইয়ে দিয়ে। পরিকল্পনা-উৎপাদন বিপণন প্রতি ক্ষেত্রেই তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠছে। উৎপাদন প্রযুক্তি থেকে তথ্য প্রযুক্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নতুন নতুন কারিগরি কৃৎকৌশলের ফলে শ্রমিকদের উৎপাদিকা শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। ফলত একই কাজ বা তার থেকে বেশি কাজ করছে অনেক কম সংখ্যার শ্রমিক। এই উন্নত কৃৎকৌশল প্রয়োগ করার জন্য শ্রমিকের শিক্ষাগত মান ক্রমশ বাড়ছে। আর অন্যদিকে কম শ্রমিক লাগায় তাদের আয় বাড়ছে। শ্রমিকরা ক্রমশ মধ্যবিত্ত হয়ে উঠছে। ব্যক্তি-মালিকদের ভূমিকা কমছে, বাড়ছে কর্পোরেটের ভূমিকা, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো অনেক বেশি ভূমিকা নিচ্ছে। এরা পুঁজি সংগ্রহ করছে শেয়ার বাজার থেকে, শেয়ারের অসংখ্য ক্রেতাদের থেকে। ফলত পুঁজিরও একটি সামাজিকীকরণ হচ্ছে। একটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যক্তি পুঁজিপতির ভূমিকা ক্রমশ কমছে। তার জায়গায় আসছে উন্নত ম্যানেজারিয়াল এবং টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদাররা। এরাই সিদ্ধান্ত নেয়, মালিক না, আসলে শ্রমিকরা কেবল না, পুঁজিপতি শ্রেণিরও অস্তিত্ব প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। বেল আধুনিক যুগকে চিহ্নিত করেন, ম্যাক্স ওয়েবার বর্ণিত প্রোটেস্টান আদর্শে পরিচালিত একটি সমাজ যার প্রধান প্রবণতা সঞ্চয়। কিন্তু উত্তর-আধুনিক সমাজের প্রধান প্রবণতা হলো খরচ। এই সমাজের কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বেল বলেননি। এই সমাজ তার চোখ বেপরোয়া, মূল্যবোধহীন, আত্মনিমগ্ন এক সমাজ। টেকনোলজির ব্যবহারে সম্পদশালী এই ভোগবাদী সমাজে পুরানো মূল্যবোধের এক বিপর্যয় ঘটে গেছে।
মার্কিন পোস্ট-মডার্নিস্ট এবং ফরাসি পোস্ট-মডার্নিস্টরা একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। বেলের ‘এন্ড অব ইডিওলজি’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু তাই পরিপূর্ণতা পেয়েছে লিওতারের ‘দ্য পোস্টমডার্ন’ কন্ডিশনে। কিন্তু এই উত্তর-আধুনিক যুগ সম্পর্কে মার্কিনী ভাষ্যকাররা কোনো আশার আলো দেখতে পাননি। কিন্তু ফরাসিরা ফেটে পড়েছে মুক্তির আনন্দে। অবশেষে যুক্তি-মানবমুক্তি, কার্যকারণ সম্পর্ক এবং সে সূত্রে মতাদর্শের বন্ধন থেকে চিন্তার মুক্তি। ফরাসি বিপ্লব সঞ্জাত আলোকপ্রাপ্তি, যুক্তিবোধ, মানবমুক্তির ধারণা এদের মতে সাম্রাজ্যবাদী নির্মাণ, যা তারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে গোটা পৃথিবীর উপর। কিন্তু যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তারা মতাদর্শকে নির্বাসনে পাঠালেন, শ্রমিকশ্রেণিকে নির্বিষ করলেন, পুঁজিবাদের পরিবর্তন করে অমরত্ব দান করলেন সেটা পৃথিবীর সর্বত্র গোটা যুগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? গোটা সমাজের বিশ্লেষণটা দাঁড়িয়ে আছে সংকটমুক্ত একটি আদর্শ পুঁজিবাদী সমাজের উপর-এটা কি গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ধরা যাক কলকারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি। এর থেকে সিদ্ধান্ত হলো শ্রমিকশ্রেণি আর বিপ্লব করতে পারবে না। এটা ঠিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিক কমছে। কিন্তু কারখানাতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা তার থেকেও দ্রæতগতিতে বাড়ছে, চিন, পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসময় ছিলো ম্যানুফ্যাকচারিং-এ দুনিয়ার প্রথম সে এই নেতৃত্ব হারাচ্ছে চিনের কাছে। শ্রমিকশ্রেণির আয় ক্রমশ বাড়ছে এবং তারা মধ্যবিত্ত হয়ে উঠছে, গাড়ি-বাড়ির মালিক হচ্ছে। এটা গোটা পৃথিবীর বাস্তবতা? বরং বিশ্বায়ন অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াচ্ছে এটাই তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতা, যারা অনেকক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির থেকেও বঞ্চিত। আর শ্রমিকের বৈষয়িক অবস্থার উপর তার শ্রেণিগত বৈপ্লবিক চরিত্র কতটা নির্ভর করে? দারিদ্র্যের পরিমাণ বিপ্লবের ক্ষেত্রে নির্ধারক হলে তৃতীয় বিশ্বে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কখনই বিপ্লব হয় না। এটা ঠিক, অবস্থাপন্ন শ্রমিকদের মধ্যে সোস্যাল ডেমোক্রেসীর প্রভাব বেশি অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু সেটিও কিছু পশ্চিমী দেশের বাস্তবতা-গোটা পৃথিবীর চিত্র এটা না। আর কারখানায় যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা কমলে বিপ্লব হবে না-এর থেকে হাস্যকর যুক্তি আর কিছু হতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পে উন্নত দেশেও মোট জনসংখ্যার ৫০%-এর কম শ্রমিক। বিপ্লবের সংগঠনের লেনিনীয় নীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে এই সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছায় না। শ্রমিকশ্রেণি এককভাবে বিপ্লব করতে পারে না। শ্রমের অন্য শাখা, কৃষক, মধ্যবিত্তের এক অংশকে নিজের পক্ষে জয় করে আনতে না পারলে বিপ্লব অসম্ভব। মুখে মাও-এর ভক্ত পোস্ট-মডার্নিস্টরা কি জানাবেন চিনের বিপ্লবের প্রশ্নে কলকারখানার শ্রমিকদের ভূমিকা কতোটা ছিলো?
বিপ্লবের কারণ পুঁজিবাদী সমাজের মৌলিক দ্ব›দ্ব। এই কথাটি এড়িয়ে যেতে চান এরা। উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি সামাজিক কিন্তু উদ্বৃত্তের চলনটি ব্যক্তিকেন্দ্রীক। সোভিয়েতের পতন বা বিশ্বায়ন এই প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করেনি বরং তা আরো তীব্র হয়েছে। যতোক্ষণ এই দ্ব›দ্ব, ততোক্ষণ সমাজ বিপ্লবের জন্য প্রহর গোনা চলবেই। আর শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রি চলেই পুঁজির সামাজিক চরিত্র হয়ে যায়, এই সব ছেলে ভোলানো কথা অর্থহীন। মার্কিন মুল্লুকে পুঁজিবাদী শ্রেণিটির অবলুপ্তি ঘটেছে কিনা, তা জানতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না, ফর্বেস ম্যাগাজিনে উঁকি মারলেই বোঝা যায়, ম্যানেজমেন্ট বা উৎপাদনের টেকনোলজিতে যতোই বৈপ্লবিক পরিবর্তন হোক তাতে পুঁজিবাদী শোষণের চরিত্র পাল্টায় না। যতো মুনাফা, ততো উদ্বৃত্ত মূল্য, ততোই শোষণ। আজ থেকে ১৬৪ বছর আগে কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টোতে মার্কস লিখেছিলেন ‘উৎপাদনের উপকরণে অবিরাম বৈপ্লবিক বদল না এনে, এবং তাতে করে উৎপাদন সম্পর্ক ও সেই সঙ্গে সমগ্র সমাজ সম্পর্কে বৈপ্লবিক বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি বাঁচতে পারে না।’ টেকনোলজি বুর্জোয়ার চরিত্রের পরিবর্তন করে না। বরং টেকনোলজির পরিবর্তন করে যাওয়াটাই বুর্জোয়ার চরিত্র। পুঁজিবাদের অবসানের সম্ভাবনা নাকচ করা, শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী ভূমিকা এবং সে সূত্রে মার্কসবাদের সমাজ অগ্রগতির ধারণাকে তাত্তি¡কভাবে নাকচ করা কোনো কঠিন কাজ না। গত দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে নানা মুনি নানা ঋষি এ কাজ করেছেন, কিন্তু তাতে সুবিধা হয়নি। কারণ পুঁজিবাদ এবং তার বহিঃপ্রকাশ চোখের সামনে যেভাবে হয় তাতে পৃথিবীর অভিজ্ঞতার সাথে এই সব তত্ত¡ মেলে না। ফলত ফুকুয়ামার ইতিহাসের অবসানের তত্ত¡ নিয়ে তাত্তি¡ক এবং প্রাজ্ঞমহলে যতোই হইচই হোক, ফুকুয়ামার সমর্থনে আমআদমি কোথাও উৎসব করেনি। বরং পরে ফুকুয়ামাকেই বলতে হয়েছে, যা বলেছি ঠিক না। আর ঠিক এই জায়গাতেই পোস্ট-মডার্নিজম-এর আসল জোর। বিশ্বায়ন, ভোগবাদ, জাতিদাঙ্গা, মৌলবাদ, অপরিসীম দারিদ্র্য, ড্রাগ-একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদের কুৎসিত বৈশিষ্ট্যগুলোর বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিকতা আর পাঁচজনের মতোই মুখর এমনকি আন্দোলনের সামনের সারিতেও থাকে তারা কখনও কখনও। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদীদের সাথে তাদের কোনো ফারাক নেই। ফারাকটা আসে পরবর্তী কথায়-যে সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে তার কোনো একক উৎস বা সেইসূত্রে কোনো সামগ্রিক সমাধান নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবো-কিন্তু বিশ্বায়ন যে এই দুর্নীতির কারণ সেই বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবো না। উত্তর-আধুনিকরা বিশ্বাস করে কোন কিছুরই সামগ্রিক সমাধান নেই, টুকরো টুকরো ইস্যুগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করবো সেগুলোর উপশম করার চেষ্টা করবো এই পর্যন্ত। অসুখ সারানো যাবে না।
সমস্যার সামগ্রিকভাবে অস্বীকার করার এই পথটিই উত্তর-আধুনিকতা। তারা পরিশ্রম করে এর দার্শনিক ভিত্তিটি তৈরি করেছে-সেটাই আসল উত্তর-আধুনিকতা। কিন্তু এর প্রভাব কেবল সমাজতত্ত¡ বা দর্শনের ক্ষেত্রে আবদ্ধ না। উত্তর-আধুনিকতার জন্ম হয়েছে স্থাপত্য শিল্পের (আর্কিটেকচার) মধ্য থেকে সাহিত্য, ভাষা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাচ, গান, মনস্তত্ত¡, এমনকি বিজ্ঞানের নানা ধারায় জন্ম নিয়েছে উত্তর-আধুনিকতার ধারা। আমরা অবশ্য আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখবো দর্শনের ক্ষেত্রেই। প্রয়োগের নানা কেন্দ্র থাকায় নির্দিষ্ট দু’একজন নামের সাথে উত্তর-আধুনিকতাকে যুক্ত করা কঠিন। অনেকের অনেক চিন্তার সমন্বয়েই এই উত্তর-আধুনিকতা। সব মিলিয়ে চিন্তাভাবনায় একটি কাঠামো দাঁড় করানো যেতে পারে।
নামের অর্থে আধুনিকতাকে অতিক্রম করে। কিন্তু প্রকৃত বিষয়ে তা আধুনিকতার বিরুদ্ধে। আধুনিকতা একটি যুগ যার সূত্রপাত রেনেসাঁর মধ্যে। প্রাথমিকভাবেই এই যুগ ইউরোপিয় মধ্যযুগের বিরুদ্ধে। ধর্ম, চার্চ, পুরোহিততন্ত্র সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। ধর্ম এবং তার সাথে যুক্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার যুক্তিবাদ। আর সামন্ততান্ত্রিক জীবনযাত্রার বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ। বিজ্ঞানের প্রসার এবং ব্যবহার উৎপাদনকে নতুন মাত্রায় বাড়াচ্ছিলো কেবল তাই না, যুক্তিবোধের প্রসার ঘটাচ্ছিলো সাধারণ মানুষের জীবনেও। যুক্তিবাদের প্রয়োগের চেষ্টা চলছিলো সমগ্র জীবনের ক্ষেত্রেও। এমন একটি সমাজ গঠন সম্ভব যা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই সমাজই হবে ন্যায় ও সমানাধিকারের পরিপূর্ণ বিকাশ। ফরাসি বিপ্লব এই ধারণার বাস্তবায়নের পথে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। মানুষ এবং মানবসমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি সর্বগ্রাহ্য (Universal) ধারণা গড়ে উঠতে থাকে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের প্রসার এই ধারণাকে বিস্তার দিচ্ছিলো। বর্তমান অর্থনৈতিক ভিত্তিটিকে অক্ষুন্ন রেখেই এই সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়-এটি ছিলো ধারণা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পুরোপুরি এ রকম ঘটছিলো না। বাড়ছিলো সমৃদ্ধি, ছড়িয়ে পড়ছিলো বিজ্ঞান ও সভ্যতার ধারণাগুলো। কিন্তু সমৃদ্ধির প্রদিপের নিচে জমছিলো দারিদ্র্যের অন্ধকার। আদি সমাজতান্ত্রিকরা মার্কস এবং এঙ্গেলস আগেই, এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। শোষণ ভিত্তিক সমাজ কখনও যুক্তি এবং ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত না। মার্কস এবং এঙ্গেলস এই বিষয়টিকেই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেন। আধুনিকতার যুগের সবচেয়ে বড় বিতর্কের সূত্রপাত এখানেই। কিন্তু বিতর্কের ভিত্তি এবং হাতিয়ার যুক্তিবাদই। ব্যক্তি মালিকানা যা অন্যকে শোষণ করার সুযোগ করে দেয়-তা কখনও যুক্তিসম্মত না। প্রগতি এবং সমানাধিকারের সর্বগ্রাহ্য প্রক্রিয়াকে তা রুদ্ধ করে দেয়-মার্কসবাদের মূল প্রতিপাদ্য এটাই আর বুর্জোয়া তাত্তি¡করা তাদের যুক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করার চেষ্টা করে। উপনিবেশিকতা এবং পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান, এগুলোর সাথে বর্ণবৈষম্যবাদ, ফ্যাসিবাদের মাথা চাড়া দেওয়া। বিশ্বযুদ্ধ, নাৎসি গণহত্যা, অ্যাটমবোম, ভিয়েতনাম থেকে আজকের ভোগবাদী বিশ্বায়ন-সবই এই পুঁজিবাদের যুক্তিহীনতার প্রকাশ। আলোকপ্রাপ্তি থেকে যে স্বপ্ন মানুষ দেখছে পুঁজিবাদ তাকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মার্কসবাদ তার যুক্তির মধ্য দিয়ে এর প্রতিটির উৎস হিসেবে পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করেছে এবং সভ্যতার এই অভিশাপগুলোকে নির্মূল করতে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করার লড়াইয়ের আহবান জানায়।
উত্তর আধুনিকতার উৎস ঠিক এখানেই। কিন্তু তাদের বক্তব্য সমস্যাটা আধুনিকতা, আলোকপ্রাপ্তি সঞ্জাত যুক্তিবাদ, প্রগতি, মানবিকতার সর্বগ্রাহ্য ধারণায়। কাজেই নাকচ করতে হবে আধুনিকতার সব ধারণাগুলো। আলোকপ্রাপ্তির থেকে প্রাপ্ত আধুনিকতার প্রধান ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-ইউরোপের ক্ষেত্রে নতুন না। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার সাথে প্রাসঙ্গিক দু’জন জার্মান দার্শনিক-একজন মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger) আর একজন ফ্রেডরিক নিৎসে (Friedrich Nietzsche)। দু’জনের মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে মিল আছে-এক. এই দু’জন মার্কস পরবর্তী সময়ে জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক-নিৎসে ঊনবিংশ শতাব্দীর আর হাইডেগার বিংশ শতাব্দীর। দু’জনের নামই নাৎসিবাদের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। নিৎসে নিজে নাৎসি ছিলেন না, তার ধারণাকে নাৎসিরা ব্যবহার করেছিলো তাদের মতাদর্শগত কাঠামোকে দাঁড় করাতে। আর হাইডেগার নিজে নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন। হিটলার ক্ষমতায় এসে হাইডেগারকে ফ্রেইডবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর করে দেন। নাজি পার্টির শেষ দিন পর্যন্ত হাইডেগার তার সদস্য ছিলেন। যদিও হাইডেগারের নিজস্ব দার্শনিক ধারণা নাৎসি চিন্তাভাবনার সাথে খুব একটা সম্পর্কিত ছিলো না। যদিও বিশ্বযুদ্ধের পর হাইডেগার বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে আধুনিকতার চূড়ান্ত বিকাশ বলে মত দেন। এবং পশ্চিমী আধুনিকতার ধারণার বিরুদ্ধাচারণ করেন। সেই ক্ষেত্রে হাইডেগারই উত্তর-আধুনিকতার প্রথম প্রকাশ। উত্তর-আধুনিকতার ফরাসি চিন্তাবিদরা ব্যক্তিগতভাবে হাইডেগারের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জাক দেরিদার বিনির্মাণের (Deconstruction) ধারণা, এমনকি নামটিও হাইডেগারের থেকে ধার নেওয়া। নিৎসেও আধুনিকতায় প্রতিটি ধারণার প্রায় বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন-পশ্চিমী যুক্তিবাদ, মূল্যবোধ, এমনকি খ্রিস্টান চিন্তাভাবনাগুলোর। উত্তর-আধুনিক দার্শনিকরা নিৎসের প্রভাবকে কখনও অস্বীকার করেন না, বরং গর্বের সাথে ঘোষণা করেন, নিৎসের প্রতি অনুরাগ সবচেয়ে তীব্র মিশেল ফুকোর লেখায়।
আলোকপ্রাপ্তি সঞ্জাত ধারণার বিরোধী সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ-ফ্যাসিবাদ থেকে সা¤প্রদায়িকতা, মৌলবাদ। অধ্যাপক রিচার্ড ওলিনের বই The Scduction of Reoson বইটি এক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। যেখানে ওলিন দেখান ফ্যাসিবাদ এবং উত্তর আধুনিকতার চিন্তার উৎস প্রায় এক। এবং দু’টি চিন্তার কাছাকাছি আসাটাও একটি বাস্তব সম্ভাবনা। যুক্তিবাদ এবং সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপকে পরিহার করে উত্তর আধুনিকতা এবং সব কিছুর উত্তর খোঁজে পরিচয় সত্তায়। নাৎসি ‘রক্ত ও মাটি’র ধারণা আর উত্তর আধুনিকতার সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত (ethnic) পরিচয়ের উপর চূড়ান্ত গুরুত্ব¡ আরোপ, সম্পর্কিত।
তাদের বক্তব্য-তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তি থেকে উঠে আসা ধারণাগুলো আসলে ইউরোপিয় শক্তিগুলোর সৃষ্টি, যা তারা মহত্ব দিয়ে জোর করে চাপিয়েছে গোটা পৃথিবীর উপর। কোনো সর্বগ্রাহ্য ধারণা নেই, গোটা পৃথিবীর মানুষ হাজার ভাগে বিভক্ত, হাজার তাদের পরিচয়-সবার জন্য সাধারণ কোনো সত্য নেই। সমাজ এবং পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে কোনো ধারণা, অর্থাৎ যে কোনো মতাদর্শ আসলে দুর্বলের উপর চাপিয়ে দেওয়া শক্তিশালীর ধারণা। যা শক্তিশালীর ক্ষমতাতে স্থায়ীত্ব দেবে। দুর্বলের, মতাদর্শ? তাও আসলে শক্তিশালীর মতাদর্শকে হঠিয়ে নিজে শক্তিশালী হবার চেষ্টা করে, কাজেই সমানভাবে পরিত্যাজ্য। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার সবচেয়ে বড় দ্বিচারিতা এটাই-এইসব মতাদর্শকে নাকচ করতে গিয়ে তারা একটা না-অর্থক মতাদর্শের জন্ম দেয়। উত্তর-আধুনিকতা কি তার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন উত্তর-আধুনিকতার প্রধান ভাষ্যকার লিওতার তার The Postmodern Condition : A Report on Knowledge-এ-‘incredulity towards metanarratives, যে কোনো ‘মেটান্যারেটিভ সম্পর্কে অবিশ্বাসী’। মেটান্যারেটিভ বস্তু এবং সমাজ এই সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য কোনো সাধারণসূত্র। যে জবানী বা বাচন (Discourse) সব কিছুকে একটি সাধারণ সূত্রে বাঁধতে চায় সেই মহা বাচন (Master Discourse) মাত্র ভ্রান্ত। এর মাধ্যমে যে কোনো বিশ্ববিক্ষাই নাকচ হয়ে যায়। অর্থ দাঁড়ায় এরকম-আদিম সাম্যবাদ, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলাদা আলাদা জবানী থাকতে পারে। কিন্তু সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামক কোনো জবানী সৃষ্টি হলে সেটা হবে ভ্রান্ত।
কিন্তু প্রশ্ন ‘জবানী’ কেনো। উত্তর-আধুনিকতাবাদিরা জবানী নিরপেক্ষ কোনো বাস্তবতাকে স্বীকারই করে না। যে কোনো বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ হয় কারুর না কারুর জবানীতে। এক্ষেত্রে বাস্তবতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ জবানীটি-কারণ বাস্তবতা একেক জনের কাছে একেক রকম। একথা ঠিকই যে বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ জবানীর মধ্যেই ঘটে। এবং এই জবানী সমাজ, শ্রেণি, সময় ব্যক্তি সব কিছুর ছাপ নিয়েই তৈরি হয়। ভাষারওতো শ্রেণিভিত্তি আছে। শাসকশ্রেণি যে ভাষা শেখায়, যে বাচনভঙ্গি শেখায়-তাতে তার প্রতি আনুগত্যই প্রকাশ হবে। আর উল্টোটাও ঠিক। উপরওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভাষায় একজন অধস্তন কথা বলে, সেই উপরওয়ালা সম্পর্কে ইউনিয়ন মিটিং-এ একই ভাষায় কথা বলে না। জবানীতে শ্রেণির ছাপ থাকে, কিন্তু তাতে যে বিষয় সম্পর্কে জবানী তার বাস্তব অস্তিত্ব নাকচ হয়ে যায় না। ‘জবানী’র খাঁচায় গোটা বিশ্ব সংসারকে আটকে ফেলার কৃতিত্ব জ্যাক দেরিদার। যদিও বিংশ শতাব্দির জার্মানির অগ্রগণ্য দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের মূল ধারণাকেই দেরিদা বিকশিত করেছেন তার তত্তে¡। দেরিদা বলেছেন, যে কোনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত জবানী যেটি সেটি আসলে কর্তৃত্বকারি জবানী। কিন্তু যার উপর সে কর্তৃত্ব করে সেই নিম্নবর্গের বা দলিত জবানীও থাকে। একটি জবানিকে ভেঙে বিনির্মাণের মাধ্যমে নিম্নবর্গের জবানীটিকে আবিষ্কার করা যায়। এরকম ক্রমাগত বিনির্মাণের (Diconstruction) মাধ্যমে জবানীর উৎসের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু যে বাস্তবের বর্ণনা জবানীটি দিচ্ছে তা কখনও ধরা যাবে না। অর্থাৎ ‘সূর্য পুব দিকে ওঠে’ এই কর্তৃত্বকারী জবানীটির একটি নিম্নবর্গীয় পাল্টা জবানী আছে-তা হলো-‘সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে’। সত্যি সত্যি সূর্য কোন দিকে ওঠে সেটা অর্থহীন। কে কিভাবে দেখছে সেটাই আসল। অনেক আধুনিক হাবভাব করে উত্তর-আধুনিকতা ফিরে যায় অষ্ঠাদশ শতাব্দীর ভাববাদে।
কর্তৃত্বকারী জবানী এবং পাল্টা নিম্নবর্গীয় জবানীর মধ্যে কোনো দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আবিষ্কার করতে যাওয়াটা অর্থহীন। কারণ এক্ষেত্রে প্রথম দু’টি যদি thesis এবং antithesis হয়, তাহলে একটি Synthesis-ও থাকে-এই Synthesis-এর কোনো অস্তিত্ব পোস্ট-মডার্নিস্টিরা মানে না। দ্বন্দ্বের মধ্য ঐক্য-দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদের এই মৌলিক ধারণার সাথে তাদের বিরোধও মৌলিক। তারা দ্বন্দ্ব মানে কিন্তু ঐক্য মানে না। দু’টি পাল্টা জবানীর দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে তৃতীয় জবানীটি তৈরি হবে-তাদের চোখে সেটি হবে একটি মহা-জবানী (Master Discourse), এমনকি তা কালে কালে মেটান্যারেটিভে পরিণত হতে পারে। অতএব, এই রাস্তা বন্ধ। বিনির্মাণই একমাত্র কাজ, যা কর্তৃত্বকারী জবানীটির আধিপত্যকে ভেঙে দেবে। এর মধ্যে দিয়ে আর একটি আধিপত্যকারী জবানী নয়-বরং জবানীর কুলুজিটি (Genology) ব্যাখ্যা করে দেখা যে সেই কুলুজিতে কি কি বিলুপ্ত বা উপেক্ষিত হয়েছে।
লিঙ্গের প্রশ্নে সমাজে কর্তৃত্বকারী বাচনটি হলো পুরুষবাচন। নারী বাচন এই আধিপত্যকারী বাচনটির বিনির্মাণ ঘটায়। এই বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে নারীর অধিকার। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। প্রশ্ন হলো সমাজে তো অনেকগুলো বাচন আছে-এই সবগুলোর নিম্নবর্গীয় বাচনের মধ্যে দিয়ে কি কোনো সাধারণ ঐক্য গড়ে তোলা যায়-যাতে নিম্নবর্গের অধিকারের বড় একটি ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায়। পোস্ট-মডার্নিস্টদের বক্তব্য হলো-না। নারী জবানী পুরুষ জবানীর বিনির্মাণ ঘটাবে। যদি সেই পুরুষ বাচনটি শ্রমিক হয় তবেও কোনো শ্রমভিত্তিক জবানীগত ঐক্য গড়ে তোলা যাবে না। কারণ সেই ঐক্যের ফলে নারী জবানীতে পুরুষ জবানীর দাসত্ব মেনে নিতে হবে।
আর যেহেতু তারা আলোকপ্রাপ্তি সঞ্জাত যুক্তি এবং কার্যকারণ সম্পর্ক মানেন না তাই সমাজে বিদ্যমান একাধিক বাচনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে বলেও মনে করেন না। কারণ এই সম্পর্কগুলো একমাত্র সৃষ্টি করা যায় যুক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। সমাজে মানুষের হাজারটি পরিচয়-লিঙ্গ জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি সব। মানুষ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। কেন লিঙ্গ ভিত্তিক বিভাজন থাকে, কেন বর্ণবৈষম্যবাদ, কেন এক জাতির দ্বারা আর এক জাতি শোষিত হয়, কেনো শ্রমিকের শোষণের উপর মালিকের সমৃদ্ধি দাঁড়িয়ে থাকে। এই সবগুলো প্রশ্নের একটি সাধারণ উত্তরের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের মতাদর্শ তৈরি হয়। না বিভিন্ন জবানীর মধ্যে সাধারণ সূত্র খোঁজা যাবে না। একজন সচেতন মানুষের কাজ শুধু সেই জবানীর কুলুজি (Geneology) খুঁজে বার করা। কিন্তু লিওতারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবনের কথা উল্লেখ না করলে উত্তর-আধুনিকতার পূর্ণাঙ্গ চেহারা পরিষ্কার হবে না। পোস্ট-মডার্ন কন্ডিশন থেকে লিওতারের এই উদ্ধৃতিটি দেওয়া উচিত।
‘১৯৩০ থেকে ‘৬০ কেনসিয় আরক্ষণের মধ্যে আটকে যাওয়া উন্নত উদারনৈতিক পুঁজিবাদ আবার মাথা তুলছে-প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে উন্নত কৃৎকৌশলের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এবং এর ফলে কমিউনিস্ট বিকল্পটিও খতম হয়েছে এবং মানুষও সাহসের সাথে পণ্য এবং পরিসেবা উপভোগ করতে পারছে।’
নয়া উদারনীতির জয়গান পোস্ট-মডার্নিস্টদের মহাভাষ্যকারের মুখে-এবং সময়টা বিশ্বায়নের যুগের প্রাক্মুহূর্ত।
উত্তর-আধুনিক ধারণার সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হলেন মিশেল ফুকো। নিজে জীবনের প্রথম অর্ধে যুক্ত ছিলেন ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে; ফুকো ইতিহাসবিদ। ফুকো বিচরণ করেছেন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে। কিন্তু এই আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ফুকোর কয়েকটি ধারণা।
এক, শ্রেণি মানুষের প্রধান বা একমাত্র পরিচয় না। অনেক পরিচয়ের মধ্যে একটি। কাজেই শ্রেণি সংগ্রামই ইতিহাসের নির্ধারক-এটাকে ফুকো সরাসরি অস্বীকার করেন।
দুই, অর্থনৈতিক ক্ষমতাই প্রধান না। ক্ষমতারও অনেক রূপ। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা সম্পর্কে ফুকো সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা হাজির করেন। ক্ষমতা সমাজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিরপেক্ষভাবেই থাকে। সেটাকে ব্যবহার করা হয়। ক্ষমতা সমাজে অদৃশ্য স্রোতের মতোই সর্বত্র বিরাজমান। রাষ্ট্র ক্ষমতার একমাত্র আধার না। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি হলো রাষ্ট্র। অর্থাৎ ক্ষমতা মানে সরকার, স্কুল, পাগলা গারদ, জেলখানা সব। কিন্তু এগুলোর মধ্যে দিয়ে সাধারণ কোনো দমনকারী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রকাশিত হয় না এবং এগুলো সম্পর্কহীন। কাজেই সামগ্রিক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় কোনো লাভ নেই। প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা করে লড়তে হবে। তবে লড়েও বা লাভ কি? কারণ ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা শ্রেণির উপর নির্ভরশীল না। এক দলকে তাড়িয়ে দিলে আর একদল এসে একই কাজ করবে। কাজেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বদলে সর্বহারার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কোনো লাভ নেই। অবশ্য সব ক্ষমতাই দমনকারী না, এই কথা বলতে ফুকো ভোলেননি।
ফুকো মার্কসবাদের মৌলিক ভিত্তিকেই সরাসরি আক্রমণ করেছেন। ফুকো শ্রেণি সংগ্রামের গুরুত্বকে নাকচ করেছেন। নাকচ করেছেন রাষ্ট্র এবং সেই সূত্রে বিপ্লবের মার্কসীয় ধারণাকে। সবচেয়ে বড়, ইতিহাসের মার্কসবাদী বিশ্লেষণকে ফুকো অস্বীকার করেন। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুকো মার্কসবাদ বিরোধীদের বড় সম্পদ। এবং ফুকুয়ামার থেকেও বড় সম্পদ। কারণ ফুকুয়ামা যা করেননি ফুকো তাই করেছেন-তার তত্ত¡কে দৈনন্দিন রাজনীতিতে প্রকাশিত করার চেষ্টা করেছেন।
সমাজের মধ্যে নিপীড়িত এবং ক্ষমতাবানের বিরোধকে ফুকো স্বীকার করেন এবং প্রতিটি ইতিহাসের পর্যায়ের মধ্যে এই বিরোধকে খুঁজেও পান। কিন্তু এইগুলোর মধ্যে কোনো সাধারণ সূত্র আছে তাকে অস্বীকার করেন। আদিবাসীদের এবং অনাদিবাসীদের মধ্যেকার বিরোধ ঠিক আছে। কিন্তু আদিবাসীসহ সমস্ত গরিবের অধিকার নিয়ে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা কোনো লড়াইকে ফুকো মনে করেন অপ্রয়োজনীয়, এতে আদিবাসীরা আবার নিপীড়িত হবে। আসলে কেউ অন্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। যদি তা করার চেষ্টা করে তবে তা হবে নিপীড়িতের উপর আধিপত্যের বিস্তার। বড়জোর চেষ্টা করা যেতে পারে তারা যাতে নিজেরাই শক্তি অর্জন করতে পারে নিজেদের জন্য।
এর থেকেই ফুকো রাজনীতির অনুকরণের (atomisation of politics) কথা বলেছেন। পথ একমাত্র micro-politics যা চরিত্রের দিক থেকে হবে স্থানীয়, নির্দিষ্ট ইস্যুভিত্তিক এবং সময়ভিত্তিক। ফুকো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্থানীয়, তাৎক্ষণিক ইস্যুর মধ্যে রাজনীতিকে আবদ্ধ করতে চান। অথচ যে কোনো রাজনীতির মূলে আছে অনেকের ইস্যুকে সম্মিলিত করার প্রচেষ্টা, সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা। ফুকোর রাজনীতি আসলে রাজনীতিহীনতার রাজনীতি। রাষ্ট্র মানে সামরিক বাহিনী-পুলিশ আইন ব্যবস্থা-আমলাতন্ত্র ইত্যাদির কাঠামোটিকে অতিক্রম করে ফুকোর বিচারে রাজনৈতিক দলগুলোও, তারা ক্ষমতাহীন বা বিরোধী যাই হোক তারা এই ক্ষমতার অংশ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের লড়াই সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেও। পুঁজিবাদ সম্পর্কে নীরব, ভোগবাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন, খোলা বাজারের অর্থনীতির প্রতি অনুরাগ-আর যে কোন ধরনের রাজনীতির প্রতি বিরাগ। বিশ্বায়নের প্রভুদের পক্ষে এর থেকে সুবিধাজনক রাজনীতি আর কি হতে পারে।
ভারতের মতো দেশে পোস্ট-মডার্নিজমের বহুল বিকাশ ঘটছে তথাকথিত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিতে। এটা সাধারণ বোধের ব্যাপার, প্রতিপক্ষ বিভক্ত থাকলে শাসকদের সবচেয়ে সুবিধা হয়। বিশ্বায়নের পক্ষে আদর্শ এই উত্তর-আধুনিকতা। উত্তর-আধুনিকতা প্রসারে এই দেশে অগ্রণী ভ‚মিকা কর্পোরেট মিডিয়ার। এমনকি মাওবাদীদের বিকৃত নৈরাজ্যবাদও এদের হাতে পড়ে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিতে পরিণত। বেচারা আদিবাসীদের জন্য দূর থেকে সহানুভ‚তি, ব্যাস। ভারতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো উত্তর আধুনিকতার আর একটি সূতিকাগার। কারণ বিদেশি ফাউন্ডেশনগুলো থেকে অঢেল টাকা আসছে, ইউজিসিও একই পথে চলছে। তথাকথিত এথনিক স্টাডি, মানবীবিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা, মানবাধিকার-এগুলোই এখন হট টপিক। শিক্ষার সামগ্রিক চরিত্রটিকে আড়ালে ফেলার চেষ্টাটি খুবই প্রকট।
কিন্তু তার জীবনের সমস্যা নিয়ে কেউ লড়াই করবে না-মানুষ এটা কেন মেনে নেবে? তার সামনে রাজনীতির বিকল্প পথ দেখাতে হবে। এবং সে পথ এনজিও। ইস্যুভিত্তিক, গোষ্ঠীভিত্তিক, সময়ভিত্তিক সমস্যা সমাধানের আদর্শ সংগঠন এনজিওগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পয়সা লাগে, কিন্তু সঙ্গে লাগে মতাদর্শ, নীতি (মৌখিক হলেও) এনজিও-তে কেবল টাকা লাগে। এনজিও’র সবচেয়ে বড় সুবিধা-তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারুর কাছে তাদের জবাবদিহী করতে হয় না। এটি হচ্ছে পোস্ট-মডার্ন রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর সুবিধা। তাদের উত্থান এবং বিকাশ যেহেতু তাৎক্ষণিক এবং ইস্যুভিত্তিক-তাদের কারোর প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, এমনকি যাদের জন্য তারা কাজ করে তাদের প্রতিও নেই। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে এনজিও অধ্যুষিত দেশ। ফল, বাংলাদেশে দারিদ্র্যও কমছে না, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোন লড়াইও হচ্ছে না। এখন এনজিওগুলো নিজেদের পোস্ট-মডার্ন ইস্যুতে আবদ্ধ থাকে না, তারা সামগ্রিকতা নিয়ে গড়ে ওঠা রাজনীতির সক্রিয় বিরোধিতা করে-এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক পশ্চিমবাংলা।
কিন্তু ফুকো সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো-তিনি ইতিহাসবিদ। ইতিহাস সম্পর্কে পোস্ট-মডার্নিস্টদের বক্তব্য আদ্যন্ত ইতিহাস সম্পর্কে মার্কসবাদী ধারণার বিরুদ্ধে। ফুকো বলেছেন (Power/Knowledge, ১৯৭৭)।
‘এই সময়ে ইতিহাস লেখা মার্কসবাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কোনো ধারণা ছাড়া অসম্ভব। কেউ অবাক হতে পারেন এটা দেখে, ইতিহাসবিদ এবং মার্কসবাদীর মধ্যে প্রায় কোনো ফারাক নেই।’
ইতিহাসের ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করাটাই ইতিহাসবিদের কাজে। আর এর মধ্যে দিয়ে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ গতি বুঝবার চেষ্টা করা। এবং এর মধ্যেই মানবমুক্তির আশাবাদ প্রতিষ্ঠা হয়। ইতিহাসের মধ্যে এই সাধারণসূত্রটি খুঁজে বার করাই ইতিহাসবিদের কাজ। সমালোচক ডিক হেবডিজ-এর বিপরীতে উত্তর-আধুনিকতাকে বর্ণনা করেছেন তিনটি বিরোধিতামূলক বিবৃতি দিয়ে-এটি ১) সামগ্রিকীকরণের বিরুদ্ধে, ২) পরম কারণবাদের (teleology) বিরুদ্ধে, ৩) ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো আশাবাদের বিরুদ্ধে।
ইতিহাস সম্পর্কশূন্য কতোগুলো ঘটনার বিশৃঙ্খল সমাহার, এর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বা কোন সাধারণ সূত্র খুঁজতে যাওয়াটা অর্থহীন শুধু নয়, অন্যায়-এটাই ইতিহাস সম্পর্কে উত্তর-আধুনিক ধারণা। এফ আর অ্যাঙ্কারস্মিড তার হিস্টিরোগ্রাফি অ্যান্ড পোস্ট-মডার্নিজমে বলছেন, মার্কসবাদী বা ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক পরম্পরায় বিশ্বাসী ইতিহাসবিদরা ইতিহাসের চর্চা করেছেন গাছের কান্ডটির দিকে নজর দিয়ে। কারণ তাদের ধারণা প্রতিটি পাতার মধ্যেকার সাধারণ সম্পর্কটি হলো কান্ডটি। কিন্তু উত্তর-আধুনিক ইতিহাসবিদরা তাদের নজরে আবদ্ধ রাখবে আলাদা আলাদা করে প্রতিটি পাতার দিকে। কারণ ঘটনাগুলোর সংযুক্তিকরণ, বিশ্লেষণ এবং সামগ্রিকতাকে আবিষ্কার তাদের কাজ না। তারা ঝড়ে পড়া প্রতিটি পাতার বিশ্লেষণ করবেন তার উৎসের খোঁজ না করেই।
ফুকো বলছেন এই ইতিহাসের সাধারণ সূত্রায়নের মধ্য দিয়ে যে মতাদর্শ তৈরি হয় তা আসলে-‘কেউ চান বা না চান এই মতাদর্শ প্রতিবাদকারী সত্যের ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।’ অর্থাৎ বিষয়গত সত্য (objective truth) অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় এবং অধরা। কোনো একটি ঘটনা সম্পর্কের দু’টি জবানী থাকবে-একটি আধিপত্যকারী আর একটি নিম্নবর্গীয়। কি হয়েছিলো জানতে চাওয়া অর্থহীন। এই পরস্পরবিরোধী জবানীই সস্তা, ইতিহাসের এই ধারণায় এই মুহ‚র্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে সংঘ পরিবার। অযোধ্যায় বিতর্কিত নির্মাণটি আসলে কি ছিলো তা অর্থহীন-ওটি রামজন্মভ‚মি অথবা বাবরী মসজিদ এই দু’টি জবানীই বাস্তব। বিজেপি সরকার আসলে-ওটা রাম জন্মভ‚মি হবে আধিপত্যকারী জবানী-আমরা তার বিরুদ্ধে লড়বো, আর কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সরকার আসলে আধিপত্যকারী জবানীটি হবে-ওটি বাবরী মসজিদ। ওটা বাবরী মসজিদ না এটা প্রমাণ করতে আমাদের লড়তে হবে?
এটাও বাস্তব, ইতিহাসের ক্ষেত্রে উত্তর-আধুনিক বিশেষজ্ঞদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। চমক সৃষ্টিকারী বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের অনুসন্ধানের সূত্রপাত হয়। এই অগ্রাধিকারের ধারণাকে নাকচ করে তারা তাদের বিবেচনায় যে সমস্ত ঘটনাগুলোকে এনেছেন তা সচরাচর প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে গুরুত্ব পায়নি। ফুকোর ‘উন্মাদগ্রস্থতা এবং সভ্যতা’ (Madness and Civilisation) বা ‘শৃঙ্খলা ও শাস্তি: বন্দিত্বের জন্ম’ (Discipline and Punish: The Birth of Prison) এই বিষয়গুলোর উপর অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ রচনা-ফুকোর আগে এভাবে কেউ ভাবেনি। কিন্তু ফুকো জেলখানার সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে করতেন না। সম্পদের আধিপত্যকারীরা কাউকে উন্মাদ বলে বর্ণনা করেছেন এর সাথে সামাজিক ক্ষমতা বিন্যাসের সম্পর্ক আছে এটা ফুকো স্বীকার করতেন না।
ইতিহাসের মার্কসবাদী ধারণা বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে এ অভিযোগ পুরানো-মার্কসবাদ অতি নির্ণয়তাবাদী (Over deterministic) যা প্রায় ভবিতব্যবাদে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরের কথা যা মার্কসবাদ বলেছে ইতিহাস সেভাবেই সরলরেখায় চলবে। এ বিষয়ে মানুষের কিছু করার নেই। উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা এই প্রশ্ন করছে-তাহলে সচেতন মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু করার নেই। আর ইতিহাসে কি হবে তা একদম নির্দিষ্ট, এদিক ওদিক হবার কোনো সম্ভাবনা নেই? ইতিহাসে কি দুর্ঘটনা ঘটে না? মার্কসবাদ অতি নির্ণয়তাবাদী এই অভিযোগ উঠেছিলো কার্ল কাউৎস্কির নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিশ্লেষণের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের পতন এবং সমাজতন্ত্রের উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী-অতএব শ্রমিকশ্রেণির কাজ হলো আপাতত শ্রমিকদের জন্য অর্থনৈতিক দাবি আদায় এবং পার্টির জন্য ভোট জোগাড় করা। সমাজবিপ্লব, তাতো একসময় হবেই। সমাজবিপ্লব আপনা থেকে হয় না, তাকে সংগঠিত করতে হয়-এই মৌলিক ধারণা থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন কাউৎস্কি। এঙ্গেলস ইউটোপিয় এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে এই ধারণার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন।
ইতিহাস সরলরেখায় চলবে এবং সবারই একই ভবিতব্য-এটা মার্কসবাদী ধারণা না। মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ই এইচ কার ‘ইতিহাস কি’ (What is Histroy) এই গ্রন্থে দেখিয়েছেন-পৃথিবী সূর্যের কাছে আসলে গরম পড়বে, দূরে গেলে শীত-এরকম সহজ একমাত্রিক কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে মানবসমাজ চলে না। এখানে বহুসংস্থা, বহু মানুষ, বহু বাস্তব পটভ‚মিকায় একসাথে ক্রিয়াশীল থাকে। ফলত এখানকার কার্যকারণ সম্পর্কটি অনেক জটিল এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের নিজস্ব ভ‚মিকা। মানুষ অচেতনভাবেই ইতিহাস রচনা করে, কিন্তু মানুষই তা করে। আর এই গতিপথ কোন দিকে সভ্যতাকে নিয়ে যাচ্ছে এ প্রশ্নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বিতর্ক থাকবে। ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠাই সভ্যতার চালিকাশক্তি। মার্কস বলেছেন শ্রেণিসংগ্রাম, ইতিহাসের এই সাধারণ সূত্রকে উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা অস্বীকার করছেন। প্রশ্ন, মাননীয় মিশেল ফুকো-আমরা কোথায় যাচ্ছি? না, কোনো গন্তব্য নেই। এই সমস্যাসংকুল জীবনের শেষ কোনো আশার আলো নেই। উত্তর-আধুনিকতা সে সূত্রে একটি সর্বগ্রাসী ‘নেই’ দর্শন। হতাশাই যার প্রধান সিদ্ধান্ত। আর সমাজ অসংখ্য সংঘর্ষ, অসংখ্য পরিচয়, অসংখ্য জবানীর পুনঃনির্মাণ। এখানে সবাই সবার সাথে যুদ্ধে রত। যুদ্ধে জিতেও লাভ নেই। কারণ, আজ যে নিপীড়িত-কাল সে আধিপত্যকারী। উত্তর আধুনিকতা আসলে নৈরাজ্যবাদের সীমা ছাড়িয়ে Nihilism-এ আশ্রয় নিয়েছে।
একথাও স্বীকার্য-মানুষের অর্থনৈতিক অর্থাৎ শ্রেণিগত পরিচয়ই প্রধান কেবল না একমাত্র পরিচয় এই অতি সরলীকরণের ভুল মার্কসবাদীরা অনেক সময়ই করেছেন। উত্তর-আধুনিকতা মানুষের অন্য পরিচয়গুলোর গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছেন। ধর্ম, জাতি, ভাষা, ভ‚গোল, সংস্কৃতি মানুষের কার্যকলাপে তা গভীরভাবে ছাপ ফেলে এটা সবাই বুঝছেন। কিন্তু মানুষের শ্রেণিগত পরিচয়কে হাজারটা পরিচয়ের মধ্যে একটা দেখিয়ে এরা ইতিহাসের প্রশ্নে মানুষের ভ‚মিকাকে নাকচ করেছেন। অনেক সত্তার মধ্য দিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ মানুষ। না, পোস্ট-মডার্নিস্টদের চোখে মানুষ অনেক সত্তার সংঘাতে জর্জরিত একটি দিকশূন্য অস্তিত্ব মাত্র। যার সামনে কোনো আশার আলো নেই।
আর এই ধরনের দর্শনগত মূলে আছে বিষয়গত বাস্তবতার (Objective Reality) অস্বীকার। জগতের অস্তিত্ব কেবল ভাষা বা জবানীতে বা একান্তভাবেই বিষয়ীগত (Subjective), যে বা যারা ব্যবহার করছেন তাদের। কিন্তু বিষয়ীগত ধারণার কোনো স্থিরতা নেই-সেটিও আপেক্ষিক, এটিও হতে পারে, অন্যটিও হতে পারে। জবানী এবং তার বিনির্মাণের অন্তহীন গোলকধাঁধায় কোনোটাই চ‚ড়ান্ত না। সবটাই আপেক্ষিক। আসলে উত্তর-আধুনিকতা-বিষয়ীগত আপেক্ষিকতাবাদের (Subjective Relativism) তত্ত্ব। দর্শন বা তত্ত্ব কোনো স্বর্গীয় বিষয় না যা দ্বৈব প্রেরিত হয়ে দর্শনের সৃষ্টিকারীর মাথায় প্রবেশ করে। সমাজের বাস্তবতা, সমাজে ক্রিয়াশীল দ্ব›দ্ব আর পাঁচটা বিষয়ীগত উপরিকাঠামোর মতো দর্শনেরও জন্ম দেয়। উত্তর-আধুনিকতা সৃষ্টি হয়েছিলো ষাটের দশকের শেষ ভাগে-কিন্তু তার প্রসার হয়েছে তথাকথিত বিশ্বায়নের যুগেই ইউরোপের বুকে এর দাপট কিছুটা স্তিমিত হলেও এটা এখন বাড়ছে অন্য মহাদেশগুলোতে। এবং বিশ্বায়নের ফলে সুবিধাপ্রাপ্ত নব্য মধ্যবিত্তদের মধ্যেই এর জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। যাদের সামনে বিশ্বায়ন একটি কাল্পনিক স্বপ্ন রাজ্যের দরোজা খুলে দিচ্ছে-যে স্বপ্ন আছে মিডিয়া-টেলিভিশনের জগতেই। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, ফিন্যান্স ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিকতার কোনো বক্তব্য নেই। বক্তব্য নেই এগুলোর অবসানের বিরুদ্ধে যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের।
আর পাঁচটি জবানীর মতো উত্তর-আধুনিকতা শ্রেণি এবং শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্বও স্বীকার করে। কিন্তু সেই সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ কিভাবে হবে? সংঘাত যেহেতু জবানীর মধ্যে, তর্কই একমাত্র পথ। যাতে একপক্ষ জয়ী হবে। সংঘাতের এই একটিই ফর্ম। আলাপ-আলোচনা তর্কের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটবে? ফিন্যান্স ক্যাপিটাল তার লোভ বিসর্জন দেবে?
উত্তর-আধুনিকতা বলতে ঠিক কি বোঝায় তা নির্দিষ্টকরণ খুব কঠিন-বলা ভালো এগুলো একগুচ্ছ চিন্তা যার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। যে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে যথা সম্ভব জটিল করে এই তত্ত¡গুলো হাজির করা হয়েছে-ফলত এটা জানতে গিয়ে একটা হীন্মন্যতার জন্ম হতেই পারে। কিন্তু এ বিষয়ে যে কেউ আশ্বস্ত হতে পারেন উত্তর-আধুনিকতা সম্পর্কে নোয়াম চমস্কির বক্তব্য পড়ে। চমস্কি পরিষ্কার জানিয়েছেন তিনি কিছু বোঝেননি। তার বক্তব্য: কোনো একটি জিনিস না বুঝলে তা বুঝবার দুটি রাস্তা আছে। এক. বিশেষজ্ঞ কারুর স্মরণাপন্ন হওয়া, যে বুঝিয়ে দেবে; দুই, নিজে বিষয়টা আরো পড়ে বুঝে নেবো। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতা বুঝতে এই দুটো রাস্তাতেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এবং এই সব নিয়ে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এগুলো ‘ফালতু কথা’ (gibberish) ছাড়া কিছু না।
চমস্কি ‘ফালতু কথা’ বলে নাকচ করলেও আমরা তা করতে পারবো না। ফুকুয়ামাদের দিয়ে যে কাজ হয়নি, বিশ্বায়নের প্রভুরা ফুকোদের দিয়ে সেই কাজটা করতে চায়। আর এই চাওয়ার মধ্যে দিয়েই প্রমাণ হয়, ক্রেমলিন থেকে লাল পতাকা নামানোর দুই দশক পরেও ওরা শ্রেণি সংগ্রাম, সমাজ বিপ্লব, আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে কতোটা ভয় পায়।

গ্রন্থপঞ্জি
১.

  1. Aijaz Ahmad : On Post Modernism, The Marxist, XXVII 1-2, January-June 2011, CPI(M), New Delhi.
  2. Ellen Meiksins Wood : What is the ‘Postmodern’ Agenda, In Defense of History : Marxism And the Post Modern Agenda, Monthly Review Press, New York 1977.
  3. John Bellamy Foster : In Defense of History, ibid.
  4. David McNally : Language, History and Class Struggle, ibid.
  5. Alex Callinicos : Against Postmodernism, A Marxist Critique, Polity Press, Cambridge, UK 1989.
  6. Richard Appignanesi & Chnis Garratt with Zianddin Sardar, Patric Cunny: Introducing Postmodernism, Icon Books, London, UK 2004.
  7. Barry Smart : Michel Foucanlt, Routledge Abingdon, UK, 1985.
  8. Enic Howbsbawm : On History, Abacus, London, 1997.
  9. Wikipedia, Internet Encyclopedia.
  10. Jean-Francois Lyotard : The Postmodern Condition, University of Minnesota Press, Minneapolis, 1979.

11.                  Stanford Encyclopedia of Philosophy: Internet Version.
১২. রতন খাসনবিশ (সম্পাদিত) উত্তর-আধুনিকতা ও মার্কসবাদ, পিপলস বুক সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৯৭.
১৩. সুধীর চক্রবর্তী (সম্পাদিত) : বুদ্ধিজীবীর নোটবই, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০৫.
১৪. পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : পোস্টমডার্ন ভাবনা ও অন্যান্য, র‌্যাডিকাল ইম্প্রেশন, কলকাতা, ১৯৯৭.

শেয়ার করুন: