005294
Total Users : 5294
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

উরাং ভাষা ও সংস্কৃতি

চা বাংলাদেশের অন্যতম কৃষিজ শিল্প। এই শিল্পের পত্তন ব্রিটিশ ভারতে এবং এই শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠীর অবস্থান ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। চা শিল্পে কর্মে যুক্ত দেড় লক্ষেরও বেশি শ্রমিক এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল আরো ছয় লক্ষের মতো। তাদের জীবন ও জীবিকা চা শিল্পকে ঘিরে হলেও এদের বিচিত্র জীবন ব্যবস্থায় বিচিত্র সংস্কৃতি ও ভাষার বিচিত্র ব্যবহার-যার অনেক কিছুই আমাদের অজানা। এছাড়া জাতপাতের মতো বাগানে ‘পানি চল; পানি অচল’ এর ব্যবস্থাও তৈরি করে রেখেছে। চা বাগানে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এগুলো চর্চার অভাবে বিলীন হওয়ার পথে কিংবা বাগানে বিভিন্ন ভাষার প্রভাবে নিজস্ব ভাষার বিকৃতি ঘটিয়ে মিশ্ররূপ নিয়েছে। যার ফলে অনেক জায়গায় চা জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি ‘বাগানিয়া’ শব্দেও চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উরাং ভাষা ও সংস্কৃতির জীবনধারার মাঠ পর্যায়ের তথ্যানুযায়ী সংক্ষিপ্ত পরিচিতির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

কমলগঞ্জ উপজেলার চা-বাগানগুলোতে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো উরাং জাতিগোষ্ঠীকেও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার চা উৎপাদনের কাজে এনেছিলো। ঠিক কোন সালে উরাং জাতি এ অঞ্চলে এসেছিলো তা বর্তমান উরাংদের জানা নেই। তবে যে সময়েই তাদের আগমন হোক না কেনো, এদেশে আগমনের পর থেকে তাদের জীবনযাত্রা সুখকর হয়নি। সেই সময় থেকেই তারা গভীর অরণ্যবাসী। জঙ্গল আবাদ করে চা-চাষসহ নিজেদের বাসস্থান তৈরি করে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোম্পানির নির্দেশ মতে আজ পর্যন্তই তারা কোম্পানির সেবাদাস হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। দরিদ্রতা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ হাজার সমস্যা তাদের নিত্য সঙ্গী। কমলগঞ্জ উপজেলার ০৪ (চার) টি বাগানে উরাং জাতির বসবাস রয়েছে। এরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একটি জাতি। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি।

উরাং জাতি গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সামাজিকভাবে জীবন-যাপন করে। এ জাতি বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হলো: কেরকাটা, কালকো, কাকা, খেশ, কুজুর, টপ্প, তিরকি, তিগ্গা, মিঞ্জি ,এক্কা, লাকরা, বাঘোয়া, লেন্ডা, পান্না, বাকলা, বারোয়া, কইয়া ইত্যাদি। সামাজিকভাবেই এদের বিবাহ হয়ে থাকে। স্ব-সমাজের স্ব-গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। স্ব-সমাজের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত। অর্থাৎ মিনজি গোত্রের সাথে মিনজি গোত্রের বিবাহ হবে না। (মিনজি + টপ্প বা অন্য গোত্র = বিবাহ।)। পাত্র-পাত্রী নিজেদের পছন্দেও বিয়ে করতে পারে। তবে গোত্র প্রথা মানতে হয়। আর্থিক অবস্থা ভালো না হলে সমাজপতিগণের উপস্থিতিতে পাত্র কন্যাকে সিঁদুর পরিয়ে দিলেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাদের পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। এই জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কঠোর পরিশ্রমী। উরাংদের ধর্মের নাম ‘সারনা ধর্ম’। সৃষ্টিকর্তাকে তারা ‘ধার্মেশ’ নামে ডাকে। প্রকৃতি পূজাই এই ধর্মের মূল কথা। যে প্রকৃতি মানুষের বেঁচে থাকার সকল উপকরণ সরবরাহ করে পূজার মাধ্যমে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তাদের দ্বারা যদি প্রকৃতির কোনো ক্ষতি সাধিত হয় তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তবে ধর্মীয় দিক থেকে তারা বর্তমানে হিন্দু ধর্ম পালন করলেও তাদের নিজস্ব কিছু পূজাপার্বণ রয়েছে। করমপূজা (একজাতীয় বৃক্ষের পূজা) তাদের আদি পূজা। এছাড়া তুশঘ বা তুসো পূজার প্রচলন আছে- যা বংশ পরম্পরায় করা হয়ে থাকে। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি এই পূজার অধিকারী। এ পূজাকে কেউ বলে মোরগ পূজা, কেউ বলে ছাগল পূজা, কেউ বলে ভেড়া পূজা ইত্যাদি। তবে মূলত এটি নবান্ন উৎসব। এই পূজা উৎসবে মোরগ, ছাগল বা ভেড়া বলি দেওয়া হয়। অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মতো জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে উপলক্ষ্যে তারা পৃথক পৃথক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও করে থাকে। বর্তমানে হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ গ্রহণ করে স্থানীয় সমাজ-সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে চলার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরেও তাদের প্রথা ও বিশ্বাস অনুযায়ী করমপূজা, তুশঘ পূজা, বনদেবীর পূজা, সারুল, ফাগুয়া, জাল্লি নড়না ইত্যাদি আরব্ধ ব্রত সম্পাদন করে। তাদের সাথে মিশে একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা গেল যে, অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির আগ্রাসনে তারা নিজেদের সংস্কৃতির কিছুটা পরিবর্তন আনলেও করমপূজা ও তুশঘ পূজা ত্যাগ করতে পারবে না। মৃতদেহ দাহ করা এবং সমাধিস্থ করা উভয় ব্যবস্থাই কার্যকর আছে। মৃত আত্মার শান্তি কামনায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও করা হয়। মিনজিরা মৃতদেহ দাহ করে। সামাজিক রীতিনীতি কেউ ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। বৈদিক সমাজভুক্ত নয় বলে তাদের ব্রাহ্মণ নেই। তারা নিজেদের পূজা নিজেরাই করে। তাদের অভিবাদনসূচক শব্দ ‘গড়লাগি’। ‘গড়লাগি’ শব্দের অর্থ সালাম, আদাব, নমষ্কার বা প্রণাম। আত্মীয়, বন্ধু বা সম্পর্কীয় ব্যক্তির সাথে দেখা হলে ডান হাত কপালে স্পর্শ করে বলবে ‘গড়লাগি’। ক্ষেত্রবিশেষে জোড়হাত কপালে স্পর্শ করে ‘গড়লাগি’ শব্দ উচ্চারণ করা আন্তঃসামাজিক শিষ্টাচার।

প্রতি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্যকে বাগানের কাজ করতে হয়। বাগানের কাজে তাদের দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা। এছাড়া কোম্পানি প্রদত্ত রেশন তাদের আয়ের উৎস। বাড়তি আয়ের জন্য তারা গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, কবুতর এবং যাদের দখলে কৃষিজমি আছে, তারা কৃষিকাজ করে। এরা মূলত কৃষিজীবী। এজন্য তাদের নবান্ন উৎসব বা তুসো পূজা বাধ্যতামূলক।

উরাংদের মাতৃভাষার নাম কুরুখ। কুরুখ দ্রাবিড় ভাষা বংশের একটি ভাষা। স্থানীয়ভাবে এদের ভাষাকে উরাং ভাষা বলা হয়। তবে আশঙ্কার কথা যে, বর্তমান প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষা সম্পর্কে উদাসীন। যে এলাকায় উরাংরা সংখ্যায় বেশি সেখানে মাতৃভাষায় কথা বলে। যেখানে সংখ্যায় কম সেখানে বয়ষ্ক ছাড়া ছোটদের মধ্যে এ ভাষার ব্যবহার নেই। যারা মাতৃভাষা জানে তারা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বললেও অন্য ভাষার লোকের সামনে (তাদের ভাষায়) কথা বলতে লজ্জাবোধ করে।

এ ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা ছিলো না। উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে সম্প্রতি ডা. নারায়ণ উরাং ‘তুলং সিকি’ নামে কুরুখ ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছেন। অনেক বই এবং সাময়িকী তুলং সিকি লিপিতে প্রকাশিত হয়েছে। অতীতের লিখিত কোনো নিদর্শন নেই। তবে তাদের ভাষা লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ। অনেক গল্প, কেচ্ছাকাহিনী, ছেলে ভুলানো ছড়া, গান, ধাঁধাঁ ইত্যাদি রয়েছে। এগুলো মুখে মুখে প্রচলিত।
সর্বস্তরের লোকের মতো এ জনগোষ্ঠীতেও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের শিশুরা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থী কলেজে পড়াশোনা করছে। বেশিরভাগ লোকের কাছে তাদের ভাষার অর্থনৈতিক মূল্য নেই বলে তারা তাদের মাতৃভাষায় বলতে লিখতে আগ্রহী নয়। যতোটি পরিবারে স্কুলগামী শিশু রয়েছে তারা তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছে।

উরাং সমাজে আমোদ উৎসবের মধ্যে ‘জাল্লি নড়না’ বা ‘বনভোজন’ প্রচলিত আছে। ছোট-বড় সবাই এই উৎসবে সামিল হতে পারে। বনভোজনের আগে অংশগ্রহণকারীরা যেমনি খুশি তেমনি সেজে কেউ একজন বাঁকা লাঠি হাতে নিয়ে মুরুব্বি সেজে মিছিলের আগে আগে, কেউ মাথায় ঝুড়ি বা টুকরি নিয়ে গানবাজনা করতে করতে বাড়ি বাড়ি যাবে এবং খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করবে। বনের উপযুক্ত স্থানে রান্না করে সবাই মিলে ভোজন করবে। নাচ-গান-বাজনা ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করবে। ‘জাল্লি নড়না’র একটি গান এরূপ:
“বাবু চেড্ডাস কোঙ্ক ডান্ডা
মায়ো খুমিয়া বুঝি টংখি
তেনে নেনে ঝুড়ি ঝঙ্গার।”
ভাবানুবাদ
বাঁকা লাঠি খোকার হাতে
ফলার ঝুড়ি খুকির মাথে
হেলে-দোলে গাইছে যে গান
খুশিতে সব টলটলায়মান।

উড়াং ভাষার অনেক পুরাতন গানের মধ্যে এমন সব শব্দ রয়েছে যার অর্থ বর্তমান প্রজন্মের কেউ বলতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, “গোছায় মায়ো তুসা আম্মু অন্দ্রায় কালোত”-এই বাক্যে ‘তুসা’ শব্দের অর্থ খোঁজতে গিয়ে প্রায় শ’খানেক লোকের দারস্থ হয়েও তার অর্থ জানা গেল না। অবশেষে এক বৃদ্ধ উরাং সমাধান দিলেন। ‘তুসা’ শব্দের অর্থ ‘কুয়া’ বা কূপ বা ‘ইন্দারা’। বাক্যটির অর্থ “চল খুকি ইঁদারায় পানি আনতে যাই।” বিভিন্ন কারণে অনেক উরাং লোক মাতৃভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এবং অনেক শব্দও হারিয়ে যাচ্ছে।
উরাং ভাষার আরও একটি গান:
কহা বাডগিনো কেসারি পুইদা
গহলান আড্ড নে এলচালিহ।
কহা বাডগিনো কেসারি পুইদা
গহলান আড্ড নে এলচালি।
হিরে হিরে বাদান
ফিরে ফিরে বাদান,
গহলান আড্ড নে এলচালিহ
গহলান আড্ড নে এলচালি।

বাংলা অনুবাদ

বড় বনে ফুটেছে কাশফুল
হাল গরুকে ভয় করে।
হিরে হিরে বলছি,
ফিরে ফিরে বলছি,
হাল গরুকে ভয় করে
হাল গরুকে ভয় করে।

ভাবার্থ: শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়। প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর লক্ষণ বিরাজমান। বনেজঙ্গলে কাশফুল ফুটেছে। হাল গরুকে ভয় পাচ্ছে। শাস্ত্রানুসারে দুর্গাপূজার সময় ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে গরু দিয়ে হাল বাওয়া নিষিদ্ধ। গানে গানে এই কথাটিই কৃষকদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রবাদবাক্য
উরাং: বারনুং বারনুং বেচানা পেল্লার বেজান মাখা রি।
বাগানি বাংলা: ধীরে ধীরে নাচ বুহরিয়া বেজান রাইত আহে।
প্রমিত বাংলা প্রবাদ: সবুরে মেওয়া ফলে।

নমুনা ভাষা: এড়কে ইন্নাতি কারাম মান্নু গাড়াদান যাহাতে এঙগহায় এড়পানু নাগুত নাগুত চালর। ইসতেতি ভুল মা মান।
বাংলা: দেখ! আজকে করমগাছ গেড়ে দিয়েছি যাতে আমার বাড়ি ভালোয় ভালোয় চলে। এখন থেকে আমি সবকিছু মানতেছি বুঝতেছি। আজ থেকে আর ভুল হবে না।

বাংলাদেশে উরাং জাতিগোষ্ঠী বা উরাং ভাষীর সংখ্যা কত তা জানা নেই। তবে কমলগঞ্জ উপজেলায় এ জাতিগোষ্ঠীর ৯২০টি পরিবার রয়েছে এবং জনসংখ্যা প্রায় ৬৫০৬ জন। সরকারিভাবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারোভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। হয়তো অচিরেই উরাং (কুরুখ) ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কেবল চর্চার মধ্য দিয়েই উরাং ভাষার ঠিক-ঠিকানা, গতি-প্রকৃতি ও বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বিস্তৃতি বা আকার প্রকারের বিষয় জানা বোঝার সুযোগ ঘটবে।

শেয়ার করুন: