004743
Total Users : 4743
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

এইমে সেজেয়ার, উপনিবেশবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই

‘যে সভ্যতা উপনিবেশবাদকে বৈধ ঘোষণা করে, সে সভ্যতা অসুস্থ, মরণোন্মুখ’— এইমে সেজেয়ার

এইমে সেজেয়ার একজন কবি। রাজনীতিক। তাত্ত্বিক। সেজেয়ার লড়াকু মানুষ, যে মানুষ তার প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যান উপনিবেশবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। লড়াই করে যান ইতিহাসের ‘সাময়িক প্রভুদের বিরুদ্ধে’ মানুষের ইতিহাস নির্মাণের সংগ্রামে। সেজেয়ার তাঁর প্রতিটি রক্তস্পন্দন থেকে তৈরী করেন ধ্বনি, ছন্দ, শব্দতরঙ্গ ও ভাষ্য। ক্যারিবিয় অঞ্চলের এ মানুষটি লড়াই করেন উপনিবেশবাদী জ্ঞানতত্ত্বের বিরুদ্ধে। তার পদ্য, গদ্য ও বক্তৃতামালা তীরের ফলার মতো ফালা ফালা করে দেয়। তার মহৎ কীর্তি ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়েলিজম’ একাই উদোম করে দেয় সাদা চামড়ার শয়তানি, ন্যাংটো করে ফেলে উপনিবেশকারদের খায়খাসলত।
এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপনের পর উপনিবেশকাররা গাঁট বেধে নেমে পড়ে উপনিবেশবাদকে বৈধতা দিতে; খাড়া করে একটি জ্ঞানতত্ত্ব যে জ্ঞানতত্ত্ব উপনিবেশের সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে খাটো করে দেখায়। ঔপনিবেশিক এ জ্ঞানতত্ত্ব মতে আফ্রিকা, আরব এবং এশিয়দের কোনো সভ্যতা নেই, নেই কোনো ইতিহাস; অন্তত ইউরোপের মতো বা এর ধারে-কাছে। উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকরা উপনিবেশের সমাজ-সংস্কৃতি সাফ করে নিজেদের মতো করে নির্মাণ করে এক নতুন সংস্কৃতি ও ইতিহাস, আর বলে, নাও এটাই তোমাদের ইতিহাস। এইমে সেজেয়ার যাকে বলেন ‘thingification’। যে ‘thingification’ দ্বারা উপনিবেশের ইতিহাস বস্তুগত ও অবস্তুগতভাবে জরাগ্রস্ত হয়। এ ‘thingification’-র তাত্ত্বিক হিসেবে আসেন হেগেল। ভারতীয় উপনিবেশের সমাজ সম্পর্কে হেগেল বলেন, ‘হিন্দুদের কোনো ইতিহাস নেই। একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক শর্তে বিস্তৃত হবার মতো বৃদ্ধিও তাদের নেই। ভারতীয় সংস্কৃতির স্বীকৃত পরিব্যাপ্তি হল এক কর্মহীন প্রসারণ।
শুধু ভারত নয়, আফ্রিকা বা অন্যান্য উপনিবেশিত দেশের সমাজ সম্পর্কেও একই ধরনের মতামত দেন হেগেল। তাঁর পর উপনিবেশবাদী জ্ঞানতত্ত্বের আরেকজন দার্শনিক ছিলেন জেমস্ মিল। মিল একটি বইয়ের কল্যাণেই সেলিব্রেটির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, পরিচিতি পেয়েছিলেন ভারতের প্রথম ইতিহাসকার হিসেবেও। হেগেলের তত্ত্ব অনুযায়ী বুনেছিলেন ভারতের ইতিহাস, দেখান ‘সত্যিকার’ কোনো ইতিহাস নেই এখানে— সংস্কৃতি নেই, রাষ্ট্র নেই। এখানকার সমাজ মানেই নিঃশব্দ, কর্মহীন ও জমাট। সমাজ কলুষিত বর্ণপ্রথায়। হেগেলের বয়ানেই যেন পূর্ণ মিলের বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা। মিল জানবাজী রেখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা ছিল ‘বর্বর’। প্রথমে হেগেল, পরে তার কথারই প্রতিধ্বনি করার চেষ্টা করেছেন মিল। ভারতের কোনো দ্বান্দ্বিক পরিবর্তন নেই, কারণ এ সমাজ আটকে ছিল প্রাচ্য-স্বৈরাচার দ্বারা। এটি ডালপালা ছড়ায় মূলত উনিশ শতকিয় ইউটিলিটারিয়ানিজম চিন্তা থেকে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের প্রচারণা তাতে পানি পায়। আর ‘প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের’ এই তত্ত্ব দাঁড়িয়েছে গ্রিক-পারস্য বৈরিতা থেকে। অধিকাংশ গ্রিক লেখাজোখাই পারস্য সরকারের স্বৈরাচারিতা নিয়ে; এশিয়ার সাথে পারস্যের সম্পর্ক যোগসূত্র দেখিয়ে সরকারব্যবস্থাকেও স্বৈরতান্ত্রিক বলবার চেষ্টা করেছেন তারা। একে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য হাজির করা হয়েছে মুঘল আমলে ভারত পরিভ্রমণে আসা বিভিন্ন পর্যটকের লিখিত বয়ান। রো এবং বার্নিয়ের লিখেছেন ভারতীয় সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতির কথা, মঁতেস্কুসহ অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত এই তত্ত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রাচ্য-স্বৈরতন্ত্রের গোড়ার তত্ত্ব হল এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি। এতে সমগ্র সমাজকে
……………………………………………………………………………………………
1 Aime Cesaire; Discourse on Colonialism; Monthly Review; New York 2000
1 Ibid
……………………………………………………………………………………………
ধরা হয়েছে পিরামিডের মতো, যার শিখরে রাজা, তারপর স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রেণী এবং একেবারে নীচে বিচ্ছিন্ন কৃষকসম্প্রদায়। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব সংগ্রহ করা হত আমলা দ্বারা রাজা ও তার রাজদরবার কর্তৃক। কারণ হিসেবে দেখানো হল রাজা ও তার জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভার জন্য প্রচুর অর্থের দরকার। রাজ্যের সেচব্যবস্থা ছিল রাজা ও তার দরবারের অধিনে। এতে করে কৃষকরা রাজদরবারের অধিনতা থেকে কোনোমতেই বের হতে পারত না। কৃষকসম্প্রদায়ের ওপর কর্তৃত্ব শুধুমাত্র শোষণ ও সেচব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই হত না, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত রাজার পরম ও খোদা প্রদত্ত ঐশ্বরিক ক্ষমতা। পাশ্চাত্য-ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিকদের যুক্তি প্রাচ্যে কৃষি, বাজার, সিভিল সোসাইটি কেন্দ্রিভূত শাসন দ্বারা পরিচালিত, তাই প্রাচ্যে বুর্জোয়া ও সিভিল সোসাইটির বিকাশ হয়নি। তাই প্রাচ্যের এই অসভ্য, ধীর-স্থির শান্ত-অবোধ সমাজকে লাথি-গুঁতো লিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছে পাশ্চাত্য। সে এক মহৎ দায়িত্ব! যে দায়িত্বের বোঝা যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিল উপনিবেশকাররা, যাকে দম্ভের সাথে তারা বলেছে ‘হোয়াইট মেনস বার্ডেন’। উপনিবেশকাররা দাবি করেছে তারাই উপনিবেশগুলোতে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, শিক্ষাসংস্কৃতি চালু করে মানুষকে সভ্য করেছে, আলোকায়ন ঘটিয়েছে। এ জ্ঞানতত্ত্ব এত প্রভাবশালি ছিল যে, কার্ল মার্কসকেও তা প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করেছিল:
‘যেসব জাতী পূর্বে ভারতবর্ষে অভিযান করেছে তাদের মধ্যে ব্রিটিশ সভ্যতাই ভারতীয় সভ্যতার চাইতে উন্নত। ব্রিটিশরা ভারতীয় সমাজের ভিত ভেঙে দিয়েছে, শিল্পবাণিজ্য উচ্ছেদ করেছে এবং ভারতীয় সভ্যতার যা কিছু মহৎ ও গৌরবের বস্তু তা সমস্তই প্রায় ধ্বংস করেছে। ভারতে বৃটিশ শাসনের ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলি এই ধ্বংসের কাহিনীতে কলংকিত। বিরাট এই ধ্বংস্তূপের মধ্যে আলোকরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। তাহলেও স্বীকার করতে হবে, ভারতের নবজাগরণ শুরু হয়েছে। ’ [কার্ল মার্কস: ১৮৫৩]

মার্কস তাঁর এ থিসিসকে (হেগেল থেকে প্রাপ্ত) শক্ত ভিতের ওপর খাড়া করার জন্য এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশনের কথা বলেন এবং এ উৎপাদন ব্যবস্থাই এশিয়ার সমাজের পশ্চাৎপদতা ও অনগ্রসরতার জন্য দায়ী মনে করেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস দেখান এই উৎপাদন পদ্ধতিতে এশিয়াতে গ্রাম্যস্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং যুগের পর যুগ একই উৎপাদন ব্যবস্থা বহাল ছিল। পাশ্চাত্যের মতো ডায়নামিক উৎপাদন ব্যবস্থা এশিয়াতে নেই। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পত্তির কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। মার্কস এ ব্যাপারগুলোই চিহ্নিত করেন ‘সিক্রেট অব দ্য আনচেঞ্জিংনেস’ বলে। মার্কস এবং এঙ্গেলস জেমস মিল, ফ্রাসোঁয়া বার্নিয়ের, রিচার্ড জোন্সের বই দ্বারা প্রভাবিত হন। এদের লেখার ওপর নির্ভর করেই মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৮৫৩ সালে ভারতীয় ইতিহাস রচনা শুরু করেন নিউইয়র্ক হেরল্ড ট্রিবিউনের পাতায়।
হেগেল, জেমস মিল, ব্যাডেন পাওয়েল, জোন্স, উইলসন, কোলব্রুক, এলফিস্টোনদের ভারতীয় ইতিহাস প্রকল্প (আসলে ব্রিটিশ ভারতীয়) যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ হয় তাহল এশিয়াটিক সোসাইটি। ১৭৮৩ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষা-সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তুমুল উৎসাহ দেখা যায় বৃটিশদের মধ্যে। ভারতের নাড়ির সন্ধানে তখন এগিয়ে আসেন রিচার্ড জোন্স, কোলব্রুক, উইলসন এবং এলফিনস্টোন। এসময় কর্নওয়ালিশ, মেকলেসহ পাশ্চাত্যবাদীরা খোলাখুলি ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন। কিন্তু বিপদজনক ছিলেন জোন্স ও কোলব্র“ক এবং তাদের এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮০০ সালের আগে ভারতীয়রা এর আঙিনা মাড়াতে পারেনি, প্রবেশের অনুমতি পায় অনেক পরে। কিন্তু কেন? এই সময়ে ভারতীয়রা কেন সোসাইটিতে প্রবেশাধিকার পেল না? হতে পারে পশ্চিমা বিবেচনায় ভারতীয়রা তখনও সোসাইটির সভ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি। কিন্তু সে যুক্তি ধোপে টেকে না। মাত্র তেরো-চৌদ্দ বছরের মধ্যে উপনিবেশিত ভারতীয়রা কোনো চেরাগ পায়নি যে তারা হঠাৎ করেই বুজুর্গ হয়ে ওঠবে? আসলে এই সময় চলছিল ইতিহাস পুনঃনির্মাণের পালা।
সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচার ব্রিটিশ শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে এতদঅঞ্চলে রেনেসাঁস হয়। এবং রেনেসাঁর বদৌলতে এখানে অনেক সংস্কারমুক্ত মানুষ তৈরী হয়। কুসংস্কার, রাষ্ট্র আর ইতিহাসহীনতা থেকে বেরিয়ে উপনিবেশকারদের ইচ্ছামাফিক তারা একটি সংস্কারমুক্ত! ও সভ্য! রাষ্ট্র নির্মাণ করবে এই ছিল বৃটিশ প্রকল্প। এসময় ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীসহ ইংরেজ ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে প্রতিষ্ঠিত হন অনেকে। তৈরী হয় পাশ্চাত্য ভাবধারায় লালিত অনেক ইতিহাসবিদ যারা মেনে নেন ভারতের ইতিহাস আর সভ্যতা মানে পাশ্চাত্যের দান এই মন্ত্র। যে লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিলেন পাশ্চাত্যতাত্ত্বিকরা, যে জ্ঞানতত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিলেন তারা সে কাজকে অনেকটাই এগিয়ে দেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকার থেকে শুরু করে সালাহউদ্দিন আহমেদসহ তৈরী এ ধারার আরও অনেক ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত জাতীয়তাবাদী
…………………………………………………………………………………………………………………………………………….
1 Marx; Future Results of British Rule in India , New York Daily Herald Tribune 1853
4 এই রেনেসাঁস যে কি রকম ছিল তা জানি আমরা। সুধিজনেরা উনিশ শতকে বাংলার যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের কথা বলেন, তা পাশ্চাত্য তাঁবেদারি ও অনুকরণ ছাড়া কিছু নয়। কি রকম এবং কেমন জাগরণ হয়েছিল এবং জেগেছিল কারা? আর এই কথিত জাগরণের ভিত্তিই বা কি ছিল? কথিত নবজাগরণের মহানায়ক রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের ঐতিহাসিক ভ‚মিকা প্রগতিশীল কোন অর্থে? তাঁদের সংস্কার-চিন্তা তো ঔপনিবেশিক অর্থনীতি-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করেনি। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রগতিশীলতার ওপর আস্থা রেখেই তো তাঁদের সংস্কার প্রচেষ্টার সীমা। ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে কোনও মৌলিক প্রশ্ন ‘নবজাগরণ’-এর নায়কেরা তোলেননি, বরং সেই ক্ষমতাবিন্যাসকে অবলম্বন করেই তাঁরা সামাজিক প্রগতি আনার চেষ্টা করেছেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সংগ্রামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ যাদেরকে মনে করা হয়— যারা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও আধুনিকতার তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁরাও ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের ভেতর হন অন্তরীণ এবং কখনো কখনো দ্বিধান্বিত। মহাত্মাজী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ‘মা’ বলে ভক্তি করেছেন, আনুগত্য দিয়ে করেছেন সহযোগিতা। যেভাবে সেবা করা হয় মাকে, সে উপায়ে তা করতে হবে আমাদের। গান্ধিজী রোয়ার যুদ্ধের সময় বলেছিলেন—
আমরা জানি না কিভাবে অস্ত্র চালাতে হয়। এটা আমাদের দোষ নয়, হয়ত দুর্ভাগ্য যে আমরা তা পারি না। কিন্তু আমাদের আরও অনেক কর্তব্য থাকতে পারে, আমরা তো আরও কিছু কাজ করতে পারি… সার্বভৌমের প্রতি কর্তব্য পালনের তীব্র ঐকান্তিকতা রয়েছে আমাদের। আমাদের সার্বভৌম যদি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেকোনো কাজে লাগান, আমরা হয়ত ব্যর্থ হব না।
[গান্ধী :১৯:১০:১৮৯৯ ]

কাকে মহাত্মাজী সার্বভৌম বলছেন আর কাদের কাছ থেকেই-বা স্বাধীনতা চাইছেন। মহাত্মাজীর এই বিনয়ি, অনুগত নিবেদনের একটিই লক্ষ মহামান্য রাণীর কাছে প্রমাণ করা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ভারতীয় জনগণও ব্রিটিশ সার্বভৌমের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে এক পায়ে খাড়া। গান্ধীভাষ্যের এই ছোট্ট অংশই আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিক্ষিতশ্রেণী যারা সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ ও আধুনিকতাবিরোধী তারাও কিভাবে আনুগত্যের ছাঁচে গড়া ছিলেন। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ক্ষমতাকাঠামোটিকে আমরা এভাবে দেখতে পারি:

charbak, PIC 2 UPjpg_Page1                                                                   ক্ষমতার সাধারণ সমীকরণ

ঔপনিবেশিক আমলে ক্ষমতাকাঠামো বিরাজিত ছিল কর্তৃত্ব (Dominance) অধিনস্থতা (Subordination), দমন (Coercion), রাজি (Persuasion), সহযোগিতা (Collaboration), আর প্রতিরোধের সমীকরণে। আর এর সবগুলোই উৎসারিত ছিল কতৃত্ব (Dominance) বা D এবং অধিনস্থতা বা S থেকে, যারা পরস্পর সম্পর্কিত। D এবং S দু’টি স্বতন্ত্রভাবে চলে এবং সৃষ্টি করে নতুন ডায়মেনশন। D যেমন তৈরী করে ক্ষমতার একটি নতুন সমীকরণ, একইভাবে Sও তৈরী করে একটি নতুন সমীকরণ। কর্তৃত্ব (D) পরিচালিত হয় দমন বা (C) এবং পারসুয়েশন বা (P) দ্বারা। অপরদিকে অধিনস্থতা বা S সম্পাদিত হয় সহযোগিতা (Collaboration) বা C* এবং প্রতিরোধ (Resistance) বা R দ্বারা। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তিকাঠামো পরিচালিত হত কর্তৃত্ব ও অধিনস্থতা দ্বারা। কর্তৃত্ব হত একদিকে রাষ্ট্রিয় দমনপীড়ন ও পুলিশ দ্বারা। অন্যদিকে ছিল পারসুয়েশন বা রাজিকরণ। একইভাবে অধিনস্থকরণ (Subordination) বা S চলত দু’ভাবে— সহযোগিতা (Collaboration) বা C* এবং প্রতিরোধ বা R দ্বারা। ঔপনিবেশিক আমলে ‘সহযোগিতা’ কোলাবোরেশন সম্পন্ন হত উচ্চশ্রেণী এবং নবগঠিত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি আর রাজনৈতিক এলিট দ্বারা। প্রতিরোধ হত সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গ থেকেই। এছাড়া কি ভারত, কি আফ্রিকা, কি আরব বিভিন্ন উপনিবেশে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জনমানুষের মুক্তির পক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল এক শ্রেণির অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল।
………………………………………………………………………………………………………………………………
1 Mahatma Gandhi; Collected Works
6 ইতালিয় মার্কসিয় দার্শনিক ও কমিউনিস্ট পার্টির এক সময়ের সভাপতি আন্তনিও গ্রামসি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ প্রিজনার নোটবুকে মূলত দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা বলেন, অর্গানিক ও ট্রাডিশনাল। ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা কখনও জনমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নেন না। আর অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা জনমানুষের কাতারে সামিল হয়ে সবসময় তাদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া গ্রামসি আর এক ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা বলেন যারা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ট্রাডিশনাল থেকে অর্গানিক হয়ে ওঠার পথে চলেন। এদেরকে তিনি ট্রানজিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল নাম দেন।
…………………………………………………………………………………………………………
ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ছিলেন ফকির লালন, নজরুল এবং আরও অনেক পালাকার, যারা ছিলেন নিম্নবর্গীয় বা সেই নীতির আদর্শে আদর্শায়িত। আফ্রিকায় যেমন ছিলেন ফ্রানজ ফানোন, এইমে সেজেয়ার, আমিলকার কাবরাল, লিওপোল্ড সেডর সেংগরসহ আরও অনেকে।
উপনিবেশবাদবিরোধী এইসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে এইমে সেজেয়ার যা করেছেন তা হল ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের খুঁটি ভেঙে দিয়েছেন তিনি। এইমে সেজেয়ার প্রশ্ন তুলেছেন কি ‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে উপনিবেশকাররা? কি আলোকায়ন ঘটিয়েছে তারা। সেজেয়ার একেবারে সোজাসাপ্টা কথায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটার পর একটা প্রমাণ হাজির করে দেখান, উপনিবেশকাররা লুণ্ঠনকারী, ব্যবসায়ী, জাহাজের মালিক, স্বর্ণ-অনুসন্ধানকারী ও খাদক। সেজেয়ার দেখিয়েছেন কিভাবে উপনিবেশকাররা ঔপনিবেশিতদের সভ্যতাহীন, বর্বর এবং অধঃপতিত করেছে। বাধ্য করেছে নিজের চিন্তাচেতনা বলি দিতে; কাজ করেছে শঠতা, সংঘাত, বর্ণবিদ্বেষ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ে। সেজেয়ার দেখিয়েছেন ভিয়েতনামে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ আর মাদাগাস্কারে কী আজব সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তারা। সেজায়ারের বয়ান:
উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশকাররা সভ্যতাকে দাঁড় করিয়েছে মরা বাস্তবতায়। সর্বজনীন আদিমতা সেখানে ভর করেছে, গ্যাংগ্রিনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তা। এবং যেসব মিথ্যা প্রচার করেছে, যেসব মানুষ বন্দী করেছে তারা, যেসব বর্ণবাদী মিথ্যা গৌরব উস্কে দিয়েছে তারা এবং যেসব দাম্ভিকতা দেখানো হয়েছে, সব মিলে ইউরোপের রক্তে বিষের মতো কাজ করেছে তা, যা অনিবার্যভাবে এ সভ্যতাকে অসভ্যতার দিকে নিয়ে যায়। [এইমে সেজেয়ার: ১৯৫৩]

সেজেয়ারের প্রামাণিকতা মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তিনি বলেছেন, ইউরোপে জন্ম নেয়া নাৎসিবাদ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, পশ্চিম প্রচারিত মানবতাবাদের মধ্যেই পয়দা হয় নাৎসিবাদ— এক-একটি হিটলার। সেজেয়ার বলেছেন, হিটলারের উত্থানের আগে ইউরোপীয়রা যে বর্বরতা চালিয়েছিল উপনিবেশের মানুষের ওপর তাকে মোটেই নাৎসিবাদ মনে হয়নি তাদের। নাৎসিবাদকেই তারা এর আগে সহ্য করেছিল, বৈধতা দিয়েছিল, কারণ তখন তাদের এটি আক্রান্ত করেনি। আগে নাৎসিবাদ চালানো হত অ-ইউরোপীয়দের ওপর, যখনই এটি ইউরোপীয় সাদা মানুষদের ওপর চালানো হল, তখনই এটি পরিণত হল নাৎসিবাদে, আর হিটলার হলেন নাৎসিজমের জনক। সেজায়ের প্রমাণ করেছেন, ইউরোপীয় সভ্যতা দাঁড়িয়েছিল এবং আছে নাৎসিজমের ওপর। কী রকম নাৎসিজম, বর্বরতা চালানো হত অ-ইউরোপিয় উপনিবেশের ওপর তা তুলে ধরেছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকোর্স অন কলোনিয়েলিজম-এ :
আলজেরিয়া জয়ী কর্নেল মন্টগনাকের একটি ছোট্ট লাইন উদ্ধৃত করছি: অনেক সময় একটি মেনিয়া আমাকে জেঁকে বসত যে, চারদিক থেকে আমাকে কে যেন ঘিরে রেখেছে। তখন পুঁইশাকের ডগার মতো আমার চারদিকে যে মাথাগুলো পেতাম, সব কেটে ফেলতাম, মানুষের মাথা।’ আমরা কি কাউন্ট হ্যরিসনের কথা অস্বীকার করতে পারব, ‘এটা সত্যি আমরা বন্দী এবং শত্রুদের জোড়ায় জোড়ায় পিপাভর্তি কান কেটে নিয়ে এসেছি। [এইমে সেজেয়ার : ১৯৫৩]

তারা গোটা আফ্রিকাকে পাউরুটির মতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিল নিজেদের সম্পদ হিসেবে। একমুখে মানবতার কথা বলে অন্যমুখে তারা চালু করেছিল দাসব্যবসা। আফ্রিকান, আমেরিকান এবং এশিয় উপনিবেশসহ বিশ্বজুড়ে উপনিবেশগুলো থেকে মানুষ এনে দাস হিসেবে বিক্রি করত। কলম্বাস সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ আবিষ্কার করতে যেয়ে আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা। ক্লান্ত-শ্রান্ত (এবং ব্যর্থ) কলম্বাসের বাহিনীকে আশ্রয় দিলেন আমেরিকার কাল-মানুষেরা। আশ্রয়দাতা এই মানুষদের ভালই উপহার দিয়েছিলেন সভ্য মানতাবাদী মহাদেশের সাহেবরা। আশ্রয়দাতাদের প্রত্যেককে শীত নিবারণের জন্য একটি করে কম্বল দেয় তারা। কি কম্বল দিয়েছিল তারা? প্রত্যেকটি কম্বলে মিশিয়ে দিয়েছিল বসন্তের জীবাণু। আশ্রয়দাতার জন্য ইউরোপীয়দের উপহার বৈকি! মহামারি হয়ে মারা গেল আমেরিকার এই কাল মানুষগুলো, যারা বেঁচে ছিল তাদের গ্রহণ করতে হল দাসত্ব। হেগেল এশীয় ঔপনিবেশিতদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ভারতের পরদেশ জয় করার তাকদ নেই, তাই তারা পরদেশ কর্র্তৃক বিজিত হয়েছে, কিন্তু হেগেলের হেন পরদেশ নেই যারা ঔপনিবেশিত দেশগুলো জয় করতে অসততার আশ্রয় নেয়নি এবং যুদ্ধনীতির ব্যত্যয় ঘটায়নি, সেই যুদ্ধনীতি ছিল তাদেরই তৈরী করা। শক্তি-সামর্থ্যরে জোরে না পেরে উপনিবেশকাররা নানাবিধ কূট-ছলের আশ্রয় নিত ‘পরদেশ’ জয় করতে। হেগেল এই নিয়ে বেশ আহ্লাদিত ছিলেন, আহ্লাদিত ছিল পাশ্চাত্যের অন্যসব মহারথি পণ্ডিতগণ। এতে কোনো অপরাধের খোঁজ পান না হেগেল কিংবা অন্য ইউরোপিয় পণ্ডিতরা।
ইউরোপীয় উপনিবেশ আফ্রিকার গোটা অর্থনীতিকেই ধ্বংস করেছিল। প্রাকৃতিক এবং সমৃদ্ধ যে অর্থনৈতিকব্যবস্থা আফ্রিকায় তারা ভেঙে দিয়েছিল, মার্কসের অনুমান মোতাবেক তা সামন্ত গড়ন ভেঙে পুঁজিবাদী রূপ দেয়নি বরং তা
………………………………………………………………………………………………………………
1 Aime Cesaire; Discourse on Colonialism; Monthly Review ; New york 2000
1 Aime Cesaire; Discourse on Colonialism; Monthly Review; New york 2000
……………………………………………………………………………………………………………………………
অন্তর্ভুক্ত করে লালসাময় এক সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির মধ্যে। ভারতীয় উপমহাদেশে ধ্বংস করা হয় শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য। কৃষকসম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে সীমাহীন শোষণ-নিপীড়ন। ভারত ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী লেখকরা, যেমন দাদাভাই নওরোজি তাঁর ‘Proverty and Un-British Rule in India’ এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত তাঁর ‘Economic History of India’ য় এবং ডব্লিউ বি ডুবইসরা তাঁদের ‘Black Reconstruction’ -এ যে সম্পদ পাচার, অর্থনীতি ধ্বংস এবং কালদের দুরবস্থার কথা বলেছিলেন তা সর্বাংশে সত্য। তবে দাদা ভাই, রমেশ দত্ত এবং ডুবইসরা কেউই সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানতত্ত্বের নিগঢ় থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁদের ভাষাটা ছিল অনেকটা আবেদন-নিবেদনের। একদা যে বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপাদন হত আফ্রিকায় সে আফ্রিকায় এখন শস্য আমদানী করতে হয় অন্য দেশ থেকে। কোকো আর কফি ছাড়া আফ্রিকায় এখন আর তেমন কোনো ফসল উৎপন্ন হয় না। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে আফ্রিকাকে করে ফেলা হয় পঙ্গু, নির্ভরশীল। রয়াল নাইজার আফ্রিকা অঞ্চলে যে পরিমাণ শোষণ চালায় পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল।
এশিয়া-আফ্রিকীয় উপনিবেশ জন্ম দিয়েছে বর্ণবাদের। সৃষ্টি করেছে ‘আমরা’ ‘তোমরা’ অর্থাৎ ‘অপর ধারণার’। উপনিবেশকার এবং উপনিবেশিতদের মধ্যে একটি দুরগম্য ফারাক, যেখানে উপনিবেশকাররা নেন কর্তার ভূমিকা। সকল শুভ এবং
……………………………………………………………………………………………………
1 Naoroji Dada Bhai; Poverty and Un-British Rule in India, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India, 1962
2 Romesh Chandra Dutt; The Economic History of India; Low Price Publication; India 1995
3 W.E. B Dubois; Black Reconstruction
…………………………………………………………………………………………………………………………………
মঙ্গলময়তা এবং সভ্যতার উৎস এই ডিসকোর্সে ইউরোপ, উপনিবেশের মানুষকে দেখা হয় বর্বর আর অসভ্য হিসেবে। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা বিবর্তনবাদকে ভিত্তি করে এমন এক আজগুবি তত্ত্ব খাড়া করেছিল যে বানর থেকে মানুষ এসেছে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ আফ্রিকা অঞ্চলের কাল মানুষ। ইউরোপিয়দের বক্তব্য, কাল মানুষ তাদের চেহারা-সুরত বানরের মতো নয় কি, কেমন কাল। কাল মানুষেরা গাছে থাকে, কী রকম তাদের পোশাক, তাদের খাদ্যও তো কী রকম বুনো। তাদের নখ কেমন, এসব আর কী অর্থাৎ পাশ্চাত্য সভ্যতা যেটা বলতে চাইছে, তা হল আফ্রিকার কাল মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত হলেও পুরো মানুষ হতে পারেনি। তারা মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকদের বক্তব্য, আফ্রিকান কাল মানুষেরা এখনও উপ-মানব। এমন একটা সময় ছিল যখন হলিউডে কাল মানুষদের নিয়ে সিনেমা তৈরী হত এবং সিনেমাগুলোতে কাল মানুষদের চিত্রায়িত করা হত আজব জীব হিসেবে। দেখা গেছে কোনো চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করা কাল শ্রমিকদের, এই কাল শ্রমিকদের হাত-পা-নখের গড়ন, মুখের গড়ন অদ্ভুত রকম। কারো পা দেখানো হয়েছে হাঁসের পায়ের মতো, কারো মুখমণ্ডল দেখানো হয়েছে বানরের মুখের আদলে। আফ্রিকার মানুষ সম্পর্কে তখন ইউরোপ-আমেরিকায় এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় শিশুরা কৌতূহলী হয়ে আজব জীবদের দেখতে আফ্রিকা পর্যন্ত যেতে উদগ্রিব ছিল। এখনও ন্যশনাল জিওগ্রাফি বা ডিসকভারি চ্যানেলগুলোতে আফ্রিকান মানুষেরা উপস্থাপিত হন, পোশাক পরতে না-জানা, আদিম যুগের পোকামাকড় খাওয়া জীব হিসেবে। এখনও আফ্রিকা নিয়ে হলিউড, বৃটিশ কিংবা ফরাসি চলচ্চিত্রগুলোতে বর্ণবাদ লুকিয়ে আছে। এখানে দু’টি চলচ্চিত্রের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, একটি বৃটিশ কাউন্সিল প্রযোজিত স্যুটিং ডগস, আরেকটি হোটেল রুয়ান্ডা। দু’টি চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে রুয়ান্ডার জাতিগত সংঘাত নিয়ে এবং সংঘাত ও হত্যাযজ্ঞ এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে এর চেয়ে আর বর্বরতা জগতে থাকতে পারে না। তাদের হিংস্রতা এবং বন্যতায় দু’টি চলচ্চিত্রেই সাদা মানুষেরা চরম বিকারগ্রস্ত, কারণ এমন পাশবিকতা জীবনে তারা প্রত্যক্ষ করেনি! তাদের কোমল হৃদয় কেঁদে ওঠে, বাঁচাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে বর্ণবাদের শিকার তুতসি মানুষগুলোকে, অভিভূত হতে হয় সাদা সভ্যতার এহেন মানবিকতায়! ‘হোটেল রুয়ান্ডা’ চলচ্চিত্রে একজন পশ্চিমা ত্রাণকর্তা কাল আদমিদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে যখন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন তার শেষ উক্তি— ‘তোমাদের সমস্যা তোমাদেরই সমাধান করতে হবে, বাহির থেকে আমরা এর কিছু করতে পারব না।’ বাহির থেকে পাশ্চাত্য দরদিরা কিছু করতে পারবে না, আফ্রিকার মানুষদের নিজেদের সমস্যা নিজেদের সমাধান করতে হবে, এ কথা একেবারে খাসা। কিন্তু কথা হল, এটি আগে মনে ছিল না? যে সময় বিশ্ব জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন করা হল এবং এখনও একই কথা প্রচার করা হচ্ছে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঔপনিবেশিত দেশগুলোর মানুষকে সভ্য করতে। বর্তমান সময়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে জঘন্য আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। উপনিবেশিকরা কী রকম সভ্য করেছিল ঔপনিবেশিতদের এবং কী রকম সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তা আগেই বলা হয়েছে, সেজেয়ার তাই দেখিয়েছেন ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজমে’। শোষণের সুবিধার্থে এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশে উসকে দেয়া হয়েছিল বর্ণবাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের মূলে কাজ করেছিল বৃটিশ উপনিবেশ। ১৮৭০ সালের দিকে হান্টারের ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলিম’ প্রকাশিত হওয়ার পর এ প্রচেষ্টা আমাদের গোচরে আসে।
এরকম আরও অনেক চলচ্চিত্রের উদাহরণ দেওয়া যায় যাতে পাশ্চাত্যের বর্ণবাদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়, যাতে আফ্রিকার কাল মানুষদের করা হয়েছে চরম অপমান। এরকম একটি চলচ্চিত্রের গল্প লেখেন মার্কিন লেখক এডগার রাইস বারোস (১৮৭৫-১৯৪৯)। গল্পটি সবার পরিচিত এবং বহুল প্রচারিত। অনেকের প্রিয় টার্জান গল্পমালা সিরিজ। গল্পটিতে কাল মানুষদের প্রতি যে নিগ্রহ ছড়ানো তার তুলনা নেই। বারোসের চোখে কাল মানুষদের ছবি কিভাবে আঁকা হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখা যাক:
জনাপঞ্চাশ কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা সামনে এগোচ্ছে, হাতে তাদের সরু সরু কাঠের বল্লম— মাথা অল্প আগুনে অনেকক্ষণ পোড়ানো, শক্ত— সাথে লম্বা ধনুক, বিষমাখা তীর। ডিম্বাকার ঢাল পিঠে, নাকে বিশাল বিশাল নোলক। ওদের মাথার দড়িপাকা পশম ফুঁড়ে বেরুচ্ছে রঙ-বেরঙের পালকের গোছা। কপাল জুড়ে তিনটে করে সমান্তরাল রঙ্গিলা রেখা আর এক একটা দুধের চারপাশে তিন-তিনটা কেন্দ্রমুখি বৃত্তের উল্কি। দাঁতের পাটি হলদে, থরে থরে সাজানো, একেবারে আগায় সূঁচালো। ওদের চেহারা এমনিতেই নিচু, পাশব ও জঘন্য— সামনে ঝুলে থাকা বড় বড় ঠোঁট সে চেহারা আরো জঘন্য করেছে।

এই হল বারোসের চোখে কাল মানুষদের প্রতিকৃতি। শুধু বারোস নয় পুরো পাশ্চাত্যেরই মনোভঙ্গি এটা। বারোস তার এ গল্পমালায় দেখাচ্ছেন জংলি পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে টার্জান— এক জাতীয় দেবদ্বিজের মতো পরিবেশের ঊর্ধ্বে উঠেছে সে। অথচ এই একই পরিবেশের কাছে হার মেনেছে কালরা, পরিণত হয়েছে তারই অংশে। মানে এটা হল কাল মানুষদের ওপর কি বিদ্বেষ এবং ধর্ষকামি ছিল সাদা সভ্যতা তারই প্রমাণ এবং এই বিদ্বেষের প্রচার তারা করেছে তত্ত্ব, উপন্যাস, চলচ্চিত্রসহ তাদের সৃষ্ট বিভিন্ন তাঁবেদার দ্বারা। এই ডিসকোর্সকেই এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ নাম দেন প্রাচ্যবাদ বা অরিয়েন্টালিজম।
পাশ্চাত্য সৃষ্ট তাবেদারশ্রেণীর সাক্ষাৎ আমরা আফ্রিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে পাই এবং এরা আচার-আচরণে শিক্ষিত ভদ্রলোক। ফানোনও বলেছেন, উপনিবেশগুলোতে ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামোয় এমন একটি শ্রেণি তৈরী হয় যারা উপনিবেশ-পরবর্তী সময়েও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুবিধায় কাজ করে এবং তাদের জ্ঞানতত্ত্ব প্রচার করে বেড়ায়। এদের দ্বারা কখনও জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব না বরং এদের সমূলে ধ্বংস করাই জাতীয় সংস্কৃতি ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য জরুরি।
গায়েনার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতা আমিলকার কাবরাল তার ব্যক্তিগত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, উপনিবেশকাররা তাদের স্বার্থে এমন মানুষ ক্ষমতায় বসায় যারা জনসাধারণের মধ্যে কমবেশি জনপ্রিয় কিন্তু তাঁবেদার। উপনিবেশকাররা এই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মানুষদের এজন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়, যেমন তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করে, এদের এমন অবস্থানে বসায় যা তারা আগে কখনও ভোগ করেনি। আফ্রিকার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম প্রসঙ্গে কাবরাল বলছেন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে এমন কিছু মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে (উচ্চ এবং বিবর্তিত) যারা তাদের নিজেদের ও শ্রেণীগত স্বার্থে পুরো শোষিত নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা জলাঞ্জলি দেয়। তিনি বলেছেন যে কোনো জাতীয় মুক্তিরসংগ্রামে ভিত্তি হওয়া উচিত শহর এবং গ্রামের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সংস্কৃতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেটি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী যারা পুনঃআফ্রিকায়ন সংস্কৃতি এবং শ্রমিকশ্রেণীর সংস্কৃতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
উপনিবেশবাদ উপনিবেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে হীনমন্যতা। আমিলকার কাবরালও বলেছেন, উপনিশেকাররা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপনিবেশের ইতিহাসে প্রবেশ করতে চায় এবং সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়, উপনিবেশের সংস্কৃতিকে নিচু ও বর্বর সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন করে। উপনিবেশের অনেক মানুষ নিজেদের খাটো মনে করে হতে চায় উপনিবেশ স্থাপনকারী প্রভুদের মতো। এইমে সেজেয়ারের শিষ্য ফ্রানজ ফানোন তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘কালো চামড়া সাদা মুখোশে’ দেখিয়েছেন, কিভাবে আফ্রিকার কাল মানুষেরা সাদাদের অনুকরণে সাদা হওয়ার চেষ্টা করে। সাদা সংস্কৃতি সভ্যতাকে পরম আরাধ্য মেনে নিয়ে সেই সভ্যতা-সংস্কৃতির অংশ হওয়ার চেষ্টা করে। এটা হল উপনিবেশ-সৃষ্ট এক ধরনের হীনমন্যতা। এইমে সেজেয়ার নেমেছিলেন কালদের এই হীনমন্যতা দূরীকরণের আন্দোলনে। মার্তিনিকসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে জুলিয়াস নায়ার, কেনেথ কুনডা, সেংগরসহ আরও অনেক সহযোদ্ধাদের সাথে সেজেয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেগ্রিচুড আন্দোলনে, কাল মানুষদের আত্মসত্তা আবিষ্কারের লড়াইয়ে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি সেজেয়ারের
……………………………………………………………………………………………………………
1 Burroughs, Edger Rice, Tarzan of the Apes, Newyork 1912
1 John Newsinger, `Lord Greystoke and the Darkest Africa: The Politics of Tarzan Stories’ Race and Class, Vol.18, no. 2 (London 1986) সলিমূল্লাহ খান অনূদিত প্রবন্ধটির বাংলা সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে।
1 Edward W. Said; Orientalism; Penguin; Delhi 2001
1 Frantz Fanon; The wretched of the Earth; Penguin 2001
1 Amilkar Kabral; Natonal Liberation and Culture
1 Frantz Fanon; Black Skin White Mask; Grove Press Inc; Newyork 1968
………………………………………………………………………………………………
নেগ্রিচুড আন্দোলনকে পাল্টা বর্ণবাদ হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা নিছক অপচেষ্টাই। সেজেয়ার কোন জায়গা থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা ভালভাবে তিনি বলেছেন তাঁর ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম’ এবং তাঁর ছাত্র ফ্রানজ ফানোন ‘কালো চামড়া সাদা মুখোশ’-এ। ফানোন তাঁর ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’র শুরুতেই সেজেয়ারের ইশতেহার দিয়ে আরম্ভ করেন। ইশতেহারটি উদ্ধৃত করছি:

আমি সেই মিলিয়ন মানুষের কথা বলছি, যাদের
মনে খুব চতুরভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ভয়, হীনমন্যতা, দ্বিধা, উদ্বেগ
দাস্যবৃত্তি, বিমর্ষতা আর অপমান।

উপনিবেশ স্থাপনকারিরা কালদের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছিল সাদা মানেই শ্রেষ্ঠ, সুন্দর ও মহান। কাল হওয়া আজন্ম পাপ। তখন কাল মানুষেরা ফানোনের মতে, ব্যাকুল হয়ে উঠত সাদা হয়ে ওঠার জন্য, সাদা সভ্যতা স্পর্শের জন্য। ফানোন তার ‘কালো চামড়া সাদা মুখোশের’ একটি অংশে বলেছেন, ‘কাল পুরুষেরা উদগ্রীব থাকে একটি সাদা নারীর সাথে বিছানায় যেতে এবং শেষ পর্যন্ত সাদা সভ্যতা স্পর্শ করতে। অথবা হতে পারে প্রতিশোধের আশায়। বিপরীতে, এখানে আমরা দেখি একজন কাল মানুষকে পাগলের মতো সংগ্রাম করতে— কাল’র পরিচয় খুঁজে বেড়াতে। সাদা সভ্যতা এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতি কাল মানুষদের অস্তিত্ব বিপর্যয় ঘটিয়েছে।’
ফানোন আরও আক্ষেপ নিয়ে বলছেন, ‘আমার কাল ভাইদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে জানি, তারপরও বলব তাদের মনের মধ্যে এমন ধারণা ‘অচেতনে’ তৈরী হয়েছে ‘চেতনে’ আসলে যার অনুবাদ হয়— ‘ব্ল্যাক ইজ নট আ ম্যান।’ কী ভাবে কোনো কিছু মানুষের অ-চেতন থেকে চেতন এবং অজ্ঞান থেকে সজ্ঞানে আসে তা ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফ্রয়েড এবং পরে তার আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন জ্যাক লাকাঁ।
লাকাঁর মতে মনুষ্যশিশু যখন ভাষার দুনিয়ায় ঢোকে— মানুষ হতে শুরু করে তখনই তৈরী হয় তার অচেতন লোক, অচিন দেশ। ভাষার সাথে অচেতনের এই সম্পর্ক থেকে লাকাঁ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, ভাষাহীন প্রাণীর কোনো অচেতন নেই, থাকতে পারে না। অচেতন নিতান্তই ভাষার ব্যাপার। যা ভাষায় ঢুকতে পারে না, সেই ভাবই অচিন দেশে আশ্রয় পায় এবং সময়মতো ভাষায় ফিরে আসার পথ খোঁজে।
এইভাবে সেজেয়ার এবং ফানোন লক্ষ করেছিলেন, উপনিবেশকারদের মূল প্রকল্প— কাল মানুষদের অচেতন দেশ অধিকার করা। অচেতন বা অচিন দেশ আশ্রয় করতে পারলে তা একসময় ভাষা অধিকার করতে পারবে। তখনই কাল মানুষেরা রূপান্তরিত হবে সাদা সভ্যতার চিন্তার গোলামে। তাই কাল মানুষদের আত্মসত্তা আবিষ্কার ও তাদের ইতিহাস থেকে পাশ্চাত্যকে তাড়াতে সেজেয়ারের নেতৃত্বে নেগ্রিচুড আন্দোলন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উপনিবেশের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির ইশতেহার ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়েলিজম’ ও তাঁর অনন্য কাব্যগ্রন্থ ‘দেশে ফেরার খাতা’ দু’টিই সমানে লড়েছিল এবং এখনও লড়ে যাচ্ছে উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে।

বর্ষ ৮, সংখ্যা ১২, ফেব্রুয়ারি ২০০৯

শেয়ার করুন: