005898
Total Users : 5898
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে রবীন্দ্রপাঠ: অদ্বৈতের সন্ধানে দ্বন্দ্বমুখর রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এবং এ-পর্যšত নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করেছেন সাহিত্যরসিক ও বিদ্দৎজনেরা। কেউ তাঁকে পাঠ করেছেন পূর্ব-পশ্চিমের পূর্বাপর পাঠের আলোকে( যেমন- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং প্রমথনাথবিশী)। কেউ তাঁকে পাঠ করেছেন বৈদিক-ঔপনিষদিক ঋষিবাক্যের মানবিক রূপকার হিসেবে ( যেমন- সৈয়দ আলী আহসান)। কেউ তাঁকে পাঠ করেছেন রোমান্টিকতা ও আধুনিকতার আলোকে ( যেমন- আবু সয়ীদ আইয়ুব)। কেউ কেউ রবীন্দ্রনন্দনভাবনার আলোকেই আপন আরশিতে মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন চেনা রবীন্দ্রবিম্বের সঙ্গে অধরা রবীন্দ্রপ্রতিবিম্বকে। কিন্তু নিরেট ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে রবীন্দ্রপাঠ একেবারেই হয় নি বলা যায়। প্রশ্ন জাগতে পারে, বিশুদ্ধভাবে কোনো তত্ত্বের আলোকে আদৌ সাহিত্যপাঠ সম্ভব কি-না? এ-প্রবন্ধে সেই অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে মরার চেষ্টাই করা হয়েছে। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যেভাবে বিপরীতের সন্নিবেশ ও বিপরীতের ঐক্যের কথা বলে; গুণ ও পরিমাণের কথা বলে এবং নিরাকরণের নিরাকরণকে বিশ্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়; সেই তিনসূত্রের (সূত্র১: বৈপরীত্বের ঐক্য ও দ্বন্দ্ব – দ্বন্দ্ববাদের অন্যতম প্রধান নিয়ম, যা বিষয়বস্তুর ও ঘটনাবলীর বিকাশের উৎস উদ্ঘাটন করে। এ নিয়মের মূলকথা নিম্নরূপ। আমাদের চতুর্পাশ্বের ইচ্ছানিরপেক্ষ বিশ্ব ও তার প্রতিফলন ঘটায় যে-চেতনা তা চিরকাল গতিশীল অবস্থায়, বিকাশের অবস্থায় বিদ্যমান। বস্তু ও ঘটনার উদ্ভব ঘটে, তা বিকশিত ও পরস্পরের মধ্যে রূপান্তরিত হয়। এ বিকাশের মূলে রয়েছে দ্বান্দ্বিক বিরোধ, অর্থাৎ এক ( বস্তু, ঘটনা) থেকে দুটি পরস্পরকে অস্বীকারী এবং পরস্পর নির্ভরশীল বিরোধে পরিণত হওয়া।সূত্র২: গুণ ও পরিমাণ – দার্শনিক প্রত্যয়, চেতনানিরপেক্ষ বাস্তবতার দ্বন্দ্বমূলক পারসপরিক সম্পর্কযুক্ত বৈশিষ্ট্য। গুণ – বিষয়ের ধর্ম ও লক্ষণাদিও অবিচ্ছিন্ন সমষ্টি। এটি তার যাবতীয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও স্বকীয় বৈচিত্র্য সহ বস্তুর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে প্রকটিত করে। গুণ অন্যসব বস্তুর সঙ্গে কেবল বস্তুর সম্পর্কের প্রণালীর মধ্যেই প্রকটিত হয়। পরিমাণ – প্রধানত বস্তুর স্থানকাল বিধৃত গুণাবলী, যেগুলি শুধু অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যেই ব্যক্ত হয়।সূত্র৩: নৈয়াকরণের নৈয়াকরণ – দ্বন্দ্বতত্ত্বের অন্যতম প্রধান নিয়ম। দ্বান্দ্বিক নৈয়াকরণ – এমন ঘটনার রূপান্তর যা স্বরূপে তাকে ধ্বংস করে ও ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ উন্মোচন করে। এটা সাধারণভাবে ধ্বংস নয়। এখানে নৈয়াকরণ বিকাশের বা সংযোগের এমন একটি পর্যায় যেখানে প্রাক্তণ পর্যায়গুলোর ইতিবাচক আধেয় সংরক্ষিত হয়েছে। ) আলোকে রবীন্দ্রপাঠের চেষ্টা করা হবে এ-প্রবন্ধে। এছাড়া শ্রেণীদ্ব›দ্ব; সমাজবিকাশের দ্ব›দ্ব;নবীণ-প্রবীণের দ্ব›দ্ব;ব্যষ্টি ও সমষ্টির দ্ব›দ্ব; ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিকের দ্ব›দ্ব; চেতন-অচেতনের দ্বন্দ্ব; মন ও মননের দ্বন্দ্ব; বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব কীভাবে রবীন্দ্রপ্রতিভাকে দ্বন্দ্বমুখর নন্দনপ্রয়াসের দিকে ধাবিত করেছে তার তত্ত্বানুসন্ধান এবং উপরিতল ও গভীরতল তুলে ধরাই এ-প্রবন্ধের অন্বিষ্ট।


‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের শেষে অরুণকুমার সরকার-এর সমালোচনার জবাবে ‘লেখকের উত্তর’ অংশে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছিলেন, “ তার মানে দুই ভিন্ন প্রতিমান(ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) দ্বারা আমরা কাব্যের মূল্য যাচাই করে থাকি।” এছাড়া তিনি আরও বলেছিলেন, “ রুদ্রের দক্ষিণ মুখ ও বাম মুখ, দুই বিপরীত মুখের রেখাচিত্রই চোখের সামনে রাখা ভালো- যেমন রাখেন সব মহাকবি ও মহাজ্ঞানী। কেবল একটা মুখ দেখেই বন্দনা বা বিলাপ করা অর্বাচীনতা অথবা মনোবিকারের লক্ষণ।”ঐতিহাসিকভাবে কবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক ব¯তুবাদের প্রবক্তাদের ( কার্ল মার্কস-ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস) পরবর্তী পুরুষ। যেকোনো চিন্তাপদ্ধতি চেতনে-অচেতনে উত্তরপুরুষে বর্তায় এবং বিকশিত হয়। অন্তত, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি সূত্রের একটি ‘নিরাকরণের নিরাকরণ’ তাই বলে। চিন্তার ক্রমবিকাশে রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রথম প্রত্যুষে নানা বিভক্তি ও বিরোধসত্ত্বেও যাঁরা সমাজ-সংস্কার, ধর্মতত্ত্ব-তাত্ত্বিকতা এবং প্রগতির প্রতিভ‚ তাঁদের অনেকের এবং পূর্ব-পশ্চিমের মিলিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রমানস গঠিত। অগ্রজ অনেকের অর্জন, বিশেলষ-সংশ্লেষ, গ্রহণ-বর্জন, যোজন-বিয়োজন, আহরণ-জারণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় ভারতীয় তথা বাঙালি তথা বিশ্বসভ্যতার এক অবিস্মরণীয় সৌধ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও সুনিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, রবীন্দ্রনাথ সরাসরি ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সংশ্লিষ্ট টেক্সটের নিবিড় পাঠক ছিলেন। কিন্তু সব পাঠ চক্ষুনির্ভর হতে হবে এমন নয়। পাঠ শ্রুতিনির্ভরও হতে পারে। আবার এওতো ঐতিহাসিক সত্য যে, অক্টোবর-বিপ্লব রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সংঘটিত সত্য। সমান সত্য, আইরিশ বিপ্লব, আলজেরিয়ার বিপ্লব, চীনা বিপ্লবের সমকালেই রবীন্দ্রপ্রতিভাবিকাশ। অšতত, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, জাপান যাত্রীর ডায়েরি, রাশিয়ার চিঠি ইত্যাকার রচনা বহন করে সেই যুগচিহ্ন। মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা এবং রবীন্দ্রবিশ্ববীক্ষা মানবচৈতন্যের অন্যতম দ্বান্দ্বিক ফল। জন স্টুয়ার্ট মিলের চিন্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন, তা সুনিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। এ-সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফের মন্তব্য তুলে ধরছি-
“রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও একজন গৃহী ও বিষয় সচেতন ব্যক্তি। কাজেই কবি ও গৃহী মানুষ হিসেবে বাহ্যত তিনি দ্বৈত সত্তার এবং ক্বচিৎ কখনো চেতনার গভীরে অদ্বৈত সত্তার মানুষ। অতএব তাঁকে প্রয়োজন মতো দ্বৈতাদ্বৈত রূপে জানতে বুঝতে হবে। আর এও মানতে হবে যে তিনি মুখ্যত উনিশ শতকের মানুষ ও কবি, কেন না তাঁর মন-মানস পাকাপোক্ত হয়েছে ঊনিশ শতকী প্রতিবেশে।” ১
. . . . . . . . . . .
. . . . . . . . . . .
“ওই পৌরাণিক দেবদেবীর প্রতীকী ভূমিকায় আস্থাবান আমৃত্যু নিষ্ঠ ব্রাহ্ম পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার-প্রাপ্তি উত্তর জীবনে বৈশ্বিক ও বিশ্ব-মানবিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন ভাষণে-বক্তৃতায়-বিবৃতিতে স্ব-উপলব্ধি এক মানস বা মানব ধর্মের কথা উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন, তখন তাঁর চিন্তায় ও আচরণে বুকের ও মুখের সত্যে অসঙ্গতি সর্তক সচেতন মানুষের চোখের অগোচরে থাকেনি। ভূতে-ভগবানে ছিল তাঁর সমান বিশ্বাস। আমৃত্যু ভৌতিক প্লানশেটে ছিল তাঁর গভীর আস্থা। আর কেনা জানে এ ধরনের আত্মিকতা মানস মুক্তির একটি বড়ো অন্তরায়। আবার রক্ত-মাংসের-মানুষ রবীন্দ্রনাথ কামে-প্রেমেও উদাসীন ছিলেন না কখনো।” ২
. . . . . . . . . . .
. . . . . . . . . . .
“এ সুবিশাল রচনায় কিছু কৃত্রিম কিছু অকৃত্রিম, কিছু বুকের কিছু মুখের, অনেকটা আবেগের কিয়দংশ স্থির মননের, বক্তব্যের বহুলাংশ তত্ত্বের, অনেকাংশ আবেগের এবং বেশ খানিকটা বাস্তবের দান।” ৩
. . . . . . . . . . .
. . . . . . . . . . .
“রবীন্দ্রনাথ জন স্টুয়ার্ট মিলের (১৮০৬-৭৩) পঞ্চান্ন বছর এবং কার্লমার্কস এর (১৮১৮-৮৩) তেতাল্লিশ বছর পরে জন্মেছিলেন, কৌতুহল থাকলে কৈশোরে লন্ডনে তাঁকে দেখতেও পেতেন। তবু এঁদের কোন প্রভাব পড়েনি তাঁর ওপর। যদিও রবীন্দ্রনাথ ‘সামান্য ক্ষতির গভীরতা, চন্ডালিকার অপমান, উপেনের সর্বনাশ, পাতালপুরীর মজুরদের দুঃখ, রথের রশিওয়ালাদের গণদাবি, অচলায়তনের ক্ষতি, মুক্তধারার প্রয়োজন জানতেন ও বুঝতেন, এবং বুয়র যুদ্ধে ব্রিটিশ বর্বরতায় ক্ষুব্ধ হয়েও, চীনের আফিম যুদ্ধের নিন্দা করেও রাশিয়ার রুশ-বিপ্লবের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেও মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষেত্রে ক্ষুৎ-পিপাসার সাম্য কিংবা ক্ষুধা-তৃষ্ণা পূরণের মৌল মানবিক অধিকার না হোক, জৈবিক প্রয়োজনও উপলব্ধি করেন নি। তাই তিনি যখন চাষী মজুরের চাষী-মজুর কবির জন্যে, যে আছে মাটির কাছাকাছি কবির বাণীর জন্যে কান পেতে অপেক্ষা করেন, তখন তা বিদ্রƒপ কি সৌজন্য বোঝা যায় না।” ৪
ড. আহমদ শরীফের উল্লিখিত উক্তিসমূহের সমান্তরালে প্রত্যুত্তরকারী সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মাত্র একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-
“রবীন্দ্রনাথ মার্ক্সবাদী শিল্পী ছিলেন না, কিন্তু তিনি কলাকৈবল্যবাদীও ছিলেন না। তিনি গভীরভাবে জীবনবাদী কবি ছিলেন, জীবনঘনিষ্ঠ না হয়েও। জীবন ও মহাজীবন তার সাহিত্যের উপজীব্য।” ৫
এখানে থেকেই আমাদের পর্যালোচনা শুরু হওয়া সম্ভব। তবে, বলে নেয়া ভালো, বিশ শতকের পরে যেহেতু নতুন সহস্রাব্দের সূচনা সেহেতু একার্থে রবীন্দ্রনাথও যুগসন্ধিক্ষণের কবি। কারণ, একজন কার্লমার্কস বা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মানবজীবনের তথা মানবসমাজের পরিবর্তনের বড়কালখন্ড নিয়ে ভাবেন। অন্যদিকে, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিকে ভাবতে হয় একইসঙ্গে বড়কালখন্ড এবং ক্ষণমুহ‚র্ত নিয়ে। একজন রবীন্দ্রনাথ মানুষের দৈনন্দিনতাদীর্ণ বক্ষপিঞ্জরের পাখিটিকে একবার গার্হস্থ্য খাঁচায়, আরেকবার বনে বনে বনবিহারিণী ক’রে মুক্তি দিতে চান। ফলে, কবিকে মতবাদের অচলায়তনে আটকা পড়লে চলে না। তাই, আমরা ঐতিহাসিক দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তাদের প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যকে ধরে নেব বড়কালখন্ডে বা ম্যাক্রো লেভেলে এবং রবীন্দ্রনাথকে রাখবো দৈনন্দিনতায় দীর্ণ পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ শোনানো কবির কর্তব্যকারী মাইক্রো লেভেলে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদও চিরায়ত জার্মান দর্শনের ধারাবাহিকতার ফল। আর এই মহাযজ্ঞে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, নিউটনের সূত্রসমূহ, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, দ্বন্দ্বের সর্বজনীনতা, সেমেটিক একত্ববাদী ধর্মতত্ত্ব, সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতা-ক্রমবিকাশ, শ্রেণীসংগ্রাম এবং গণিত-বলবিদ্যা-পদার্থবিদ্যা-রসায়ন-জীববিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান-এককথায় মানবজাতির সম¯ত অর্জনের সারোৎসার সাঙ্গীকৃত। আর বিশ্বধাতার এই যজ্ঞশালায় কবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ আবহসঙ্গীত সৃষ্টিকারী বাঁশি বাজানো …। আর এই বংশীবাদন বিশ্বমূর্ছনার সঙ্গে, পরমের সঙ্গে সালোক্যে সমীকৃত করে ব্যক্তি মানুষকে।

 

১.১
ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি সূত্রের একটি হলো ‘বিপরীতের ঐক্য।’ রবীন্দ্রকাব্যে দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য নানা মাত্রার। এই মাত্রা ‘পরিমাণ ও গুণের‘ সূত্রে সমন্বিত। কখনো সচেতনভাবে, কখনো সচেতন অসচেতনে, কখনো অবচেতনে দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের ব্যবহারে তাঁর স্বকীয় ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য সুচিহ্নিত। যেমন ক. একটি বিপরীত ও বিপ্রতীপ ভাবসম্পন্ন কবিতা। খ. একটি কবিতার কোনো একটি স্তবকে বিপরীতের সন্নিবেশ। ঘ. একটি পূর্ণবাক্যবৈপরীত্য। ঙ. অর্ধবাক্যবৈপরীত্য। চ. শব্দবৈপরীত্যযুগল। ছ. যুগ্মবৈপরীত্য …।

১.২
অনেকানেক রবীন্দ্র-গবেষকই মনে করেন ‘মানসী’ কাব্য সমগ্ররবীন্দ্রকাব্যের অণুবিশ্ব বা ভ‚মিকা বা সূচীপত্র। দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় মানসীর পূর্ব-পর্যন্ত রবীন্দ্রকাব্যের বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব ভাবগত বা থিমেটিক। কবিতার নামকরণই বিপরীত ও বিপ্রতীপ শব্দযুগলে, কিন্তু শব্দবন্ধ ও শব্দযুগল কাব্যাংশে নাই বললেই চলে। যেমন- ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যের ‘আশার নৈরাশ্য’, ‘সুখের বিলাপ’ ‘অসহ্য ভালোবাসা’ ‘হলাহল‘ কবিতাগুলি। কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে চোখে পড়ে- ‘ভাবহীন বজ্রে গড়া হাসি’, স্ফটিককঠিন অশ্রুজল, ‘সম্পদের স্বর্ণকারগারে’ ইত্যাদি দুর্লভ বিপরীত বাক্যবন্ধ ও বৈপরীত্যযুগল। ‘প্রভাত সংগীত’ কাব্যের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি বদ্ধজীব ও মুক্তজীবের বৈপরীত্যকে ধারণ করে। কিন্তু বিস্ময় জাগায় একটি যুগ্মবৈপরীত্যযুগল। তা হলো- ‘প্রলয়বিষাণ’। কিন্তু শিবের শিঙ্গা ঐতিহ্যবাহী। ‘ছবি ও গান’ কাব্যে ‘জাগ্রত স্বপ্ন’ কবিতাটি ছাড়া অন্য কোনো কবিতায় ভাবগত বৈপরীত্য দুর্লক্ষণীয়। ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-তে ‘মরণে রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’ বাকবন্ধ-বৈপরীত্য ছাড়া অন্যকোনো বৈপরীত্য নাই। মিলন বিরহের ভাবগত বৈপরীত্য অšতঃসলিলারূপে এই কাব্যে বহমান। এছাড়া ‘কড়ি ও কোমল‘ এর দ্বন্দ্বও ভাবগত। কিন্তু মানসীতে এসে ভূমিকাংশে ‘উপহার’ কবিতায় পাই-
“এ চিরজীবন তাই আর কিছু কাজ নাই
রচি শুধু অসীমের সীমা।
আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে তাহে ভালোবাসা দিয়ে
গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা।”

সীমা-অসীমের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য রবীন্দ্রমানসে উম্মোচিত হয়েছিল মানসী পর্বেই। পরবর্তী জীবনে পাই তার বিচিত্র বিকাশ। ‘বিরহানন্দ’ কবিতায় ভাবগত বৈপরীত্যের সঙ্গে পাই, ‘বিরহ সমধুর’, ‘মিলনদাবানলে’ এবং ‘শ্মশানবিলাসিনী’ এই তিনটি বৈপরীত্য যুগল। যেমন-
“চোখে চোখে থেকে কাছে নহ তবু,
দূরেতে থেকেও দূর নহ কভু,
সৃষ্টি ব্যাপিয়া রয়েছ তবুও
আপন অন্তঃপুরে।

‘নিষ্ফল কামনা’ বাংলা কবিতায় প্লেটোনিক প্রেমের অনন্য দৃষ্টাšত। সকাম ও নিষ্কাম প্রেমের দ্বন্দ্বমুখরতাই এই কবিতার প্রধান উপজীব্য। ‘বিচ্ছেদের শান্তি’, ‘একাল ও সেকাল’ কবিতাদু’টিও ভাববৈপরীত্যের। ‘নিষ্ঠুর সৃষ্টি‘ কবিতায় আছে সর্বজনীন দ্বন্দ্বের পর্যবেক্ষণ। যেমন-
“এই ভাঙে, এই গড়ে
এই উঠে, এই পড়ে
কেহ নাহি চেয়ে দেখে কার কোথা বাজিছে বেদনা।”
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
“এই ডুবি, এই উঠি,
ঘুরে ঘুরে পড়ি লুটি-
এই যারা কাছে আসে এই তারা কাছাকাছি নাই।”
‘প্রকৃতির প্রতি’ কবিতায় পাই ‘স্নেহহীন-আলিঙ্গন’ বৈপরীত্যযুগল। হয়তো উত্তরপুরুষে এটিই ‘ঘৃণালিঙ্গন‘ যুগ্মবৈপরীত্যে বর্তেছে। ‘সিন্ধুতরঙ্গ‘ কবিতায় আমরা দেখতে পাই, বস্তুর অন্তর্গ ত দ্বন্দ্ব ( টীকা ১ দ্রষ্টব্য)।

‘নিষ্ফল প্রয়াস’ কবিতায় পাই, মানবদেহে বস্তুর গতি। সিন্ধুতরঙ্গে বস্তুজগতের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং প্রত্যেক বস্তুর স্ব-সত্তায় আলাদা থাকার দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে জীবদেহে কোষের উপচিতি-অপচিতিসহ সৌন্দর্যের বিকাশ। ‘নিষ্ফল প্রয়াস’ কবিতায় কবি বলেছেন,
“ওই-যে সৌন্দর্য লাগি পাগল ভুবন,
ফুটন্ত অধরপ্রান্তে হাসির বিলাস,
গভীর তিমির মগ্ন আঁখির কিরণ,
লাবণ্যতরঙ্গ ভঙ্গ গতির উচ্ছ্বাস,”

‘লাবণ্যতরঙ্গ ভঙ্গ,/‘গভীর তিমির মগ্ন আঁখির কিরণ’/‘উৎসব ভীষণ’/‘জড়ের নর্তন’/‘নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ এবং বিপরীতার্থক বাক্যবন্ধ পর্যালোচনা করলে আমরা জীব ও জড়ের ভেতরে সমান ‘গতির উচ্ছ্বাস’ পাই। যা আদতে দ্বান্দ্বিক। নীল মৃত্যুর শ্বেত হয়ে ওঠা শুধু রঙের বিপর্যয় বা বর্ণান্ধতা নয়। বরং একটি রঙ যে অনেকানেক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নিজের আলাদাত্ব বজায় রাখে তার বাণীরূপ। এ-প্রসঙ্গে মাও সেতুঙ বলেছেন,
“প্রথমত : পদার্থের গতির প্রত্যেক রূপের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিজস্ব বিশিষ্টতা রয়েছে। পদার্থ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান হচ্ছে- পদার্থের গতির রূপগুলো সম্পর্কে জ্ঞান, কারণ গতিশীল পদার্থ ছাড়া বিশ্বে অন্য কিছুই নেই এবং গতিকে অবশ্যই কোন রূপ পরিগ্রহ করতে হবে। …। গতির যে কোনো রূপের মধ্যেই অন্তর্নি হিত রয়েছে তার নিজস্ব বিশেষ দ্বন্দ্ব। এই বিশেষ দ্বন্দ্ব বিশেষ সারমর্ম গঠন করে যা একটা বস্তুকে অপর বস্তু থেকে পৃথক করে। এটা হচ্ছে বিশ্বের বস্তু-সমূহের বহু বৈচিত্র্যের আভ্যন্তরীণ কারণ বা বলা যেতে পারে ভিত্তি। প্রকৃতিতে গতির অনেক রূপ আছে, যান্ত্রিক গতি, শব্দ, আলো, তাপ, বিদ্যুৎ, বিযোজন ও সংযোজন প্রভৃতি। পদার্থের এই সমস্ত গতির রূপই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, এবং আবার-সারমর্মে পরস্পর থেকে আলাদা। পদার্থের প্রত্যেক গতির রূপের বিশেষ সারমর্ম নির্ধারিত হয় তার নিজস্ব বিশেষ দ্ব›দ্ব দ্বারা। কেবল প্রকৃতির বেলায় নয় বরং সমাজসংক্রান্ত ও মতাদর্শগত রূপের রয়েছে নিজস্ব বিশেষ দ্বন্দ্ব এবং বিশেষ সারমর্ম।”৬
যেহেতু গতির প্রসঙ্গ এলো সেহেতু একপাক ‘বলাকা’ ঘুরে আসা সমীচীন। আগেই বলেছি, ‘মানসী’কে- অনেকেই রবীন্দ্রকাব্যের ভূমিকা বা সূচীপত্র স্বীকার করেন। তাই, যদি এমন কোনো প্রসঙ্গ বা পংক্তি পাই, যার পরিবর্তন-পরিবর্ধন-বিকাশ ঘটেছে পরবর্তী রবীন্দ্রভুবনে তবে তারও তুলনামূলক আলোচনার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি জনান্তিকে।
মাও সেতুঙের মনীষা ও মনন আমাদের মানতে শেখায়, “প্রতিটি সামাজিক রূপ ও প্রতিটি মতাদর্শগত রূপের রয়েছে নিজস্ব বিশেষ দ্বন্দ্ব এবং বিশেষ সারমর্ম।”
রবীন্দ্রনাথের জন্য সেই সামাজিক রূপ প্রাচ্যীয়, বিশেষত ভারতীয়। সর্বভারতীয়, বিশেষত বাঙালির। তবে কারও কারও মতে, যতটা না বাঙালির, তারও বেশি সর্বভারতীয় (যেমন-যতীন সরকার)৭। মনে রাখা দরকার কার্ল মার্কস প্রতীচ্যপুরুষ হবার পরও ধর্মের প্রসঙ্গটা সকল পর্যালোচনার পূর্বে সেরে নিতে চেয়েছিলেন।৮ সেখানে সনাতন ধর্মের মধ্যে ব্রাহ্মধমের্র বাতাবরণ এবং সেই ধর্মের তত্ত¡চর্চাকারী ঔপনিষদিক ঋষি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ না-মানা অসম্ভব প্রায়। এই সর্বভারতীয় তথা প্রাচ্যীয় মনের সঙ্গে বিশ্বমানবিকতার মিশেলে সৃষ্ট এক রবীন্দ্রমন। এই রবীন্দ্রমনকে মোকাবিলা করতে হয়েছে মায়াবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ, জন্মাšতরবাদ, বস্তুবাদ, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, বাস্তববাদ, উপযোগবাদ, আধুনিকতাবাদ/আধুনিকবাদ, ব্রাহ্মবাদ, শাক্তমতবাদ, বাউলবাদ, সাম্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ, বুদ্ধবাদ, কলাকৈবল্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, সুফিবাদ, জড়থ্রুস্টবাদ, গতিবাদ এবং গান্ধীবাদ …। আরও কতনা আপদের আস্বাদন ঘটেছে তাঁর। পুরো বিশ শতকে একের পর এক ‘সিন্ধুতরঙ্গ’ আছড়ে পড়েছে রবীন্দ্রতটে। তাই রবীন্দ্রভুবনের দ্বন্দ্ব সামাজিক রূপ ও মতাদর্শগত রূপের এবং অন্তর্গ ত দ্বন্দ্বের বহুমাত্রিক দ্ব›দ্বই বটে। কাজেই, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ একমাত্রিক মার্কসানুসারী হবেন এমনটা ভাবাই ভুল। বরং যে যে সত্যের সমন্বয়ে মানবসৃষ্ট সময় তৈরি করেছেন একজন কার্ল মার্কস-ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-লেলিন-স্টালিন-মাও সেতুঙ-গান্ধী এবং হঠাৎ হিটলার- মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কোকে সেই সেই সত্যের অন্যতর সারবান সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছেন একজন রবীন্দ্রনাথ। তাত্ত্বিকতা কাজ যতটা তথ্য-বিজ্ঞান এবং সমন্বয়নির্ভর, সৃষ্টিশীলকাজ ততটাই ঊনতথ্য নিমবিজ্ঞান এবং অনন্বয়নির্ভর। অন্তত অন্তর্ভেদী কবিতা, গানে ও ভাষায় …। একার্থে, মার্কসীয় মেথডলজি মানবা¯িতত্বের সমদীর্ঘ হবে। ভিন্নার্থে, মানবজীবন যুক্তাযুক্তির অভেদবিন্দু। আর এই অভেদের অন্বেষণে রবীন্দ্রনাথ অন্যমাত্রার সূচক। যদি, ডায়লেকটিক্যাল মেথডলজির ভিন্নমাত্রার সূচনা হয়, তবে এক্ষেত্রে কার্ল মার্কস ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস এবং একজন রবীন্দ্রনাথ সমদাগে দাগী ও কলঙ্কভাগী হবেন যুক্তিতে ও প্রেমে। যে অভেদবিন্দুর অন্বেষণে এই পর্যালোচনা, তাতে যুক্তিশালী মানুষ এবং যুক্তাযুক্তির ‘কান্না-হাসির দোল-দোলানো’ কথাও সমান উপযোগী।

১.৩
‘সিন্ধুতরঙ্গ‘ এবং ‘নিষ্ফল প্রয়াস’ কবিতাদুটির প্রসঙ্গে গতিবাদ এবং ‘বলাকা’-র বাণী মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। প্রথমেই ‘বলাকা’-কাব্যের কয়েকটি কবিতার প্রসঙ্গ টানছি। এই কবিতাগুলো ‘ছবি’ ‘শাহজাহান’ ‘চঞ্চলা’ এবং ‘বলাকা’ নামকরণে কীর্তিমান। যা ‘বলাকা’ কাব্যের যথাক্রমে ৬,৭,৮ এবং ৩৬ সংখ্যক কবিতা (টীকা ২ দ্রষ্টব্য) ।
উপরের উদাহরণগুলি অনুপুুঙ্খ অনুসরণ করলে শুধু গতিবাদই গোচরীভূত হয় না, বরং গতিজাড্যের দ্বন্দ্বমুখর বিম্ব-প্রতিবিম্ব মুকুরিত হয় মানসপটে। এই গতিজাড্যের বিপরীত-বিপ্রতীপ সন্নিবেশ কখনো বৈপরীত্য শব্দযুগলে, বাক্যবন্ধে, ভাবপ্রকল্পে, বিপরীত বস্তুপুঞ্জে এবং আলঙ্কারিক বিরোধাভাসে ব্যাপ্ত। বলাকার ১ সংখ্যক কবিতার ( ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা) দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে প্রমথনাথবিশী বলেছেন, “ এক দিকে আমাদের দেশের জীবনপ্রবাহের মরানদী অপর দিকে পাশ্চাত্য জীবনের ভরানদী, এই দুয়ের দ্বন্দ্বে কবিতাটির সৃষ্টি ।”৯ এছাড়া আমরা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অর্ন্ত দ্বন্দ্বকেও তাঁর চিঠিপত্র থেকে মিলিয়ে নিতে পারি ।“ এখন এক একবার মনে হয়, আমার মধ্যে দুটো বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। একটা আমাকে সর্বদা বিশ্রাম ও পরিসমাপ্তির দিকে আহবান করেছে; আর একটা আমাকে কিছুতেই বিশ্রাম করতে দিচ্ছে না।আমার ভারতবর্ষীয় শান্ত প্রকৃতিকে য়ুরোপের চাঞ্চল্য সর্বদা আঘাত করছে- সেই জন্যে একদিকে বেদনা আর একদিকে বৈরাগ্য।একদিকে কবিতা আর একদিকে ফিলজফি । একদিকে দেশের প্রতি ভালবাসা আর একদিকে দেশহিতৈষিতার প্রতি উপহাস । একদিকে কর্মের প্রতি আসক্তি আর একদিকে চিšতার প্রতি আকর্ষণ। এই জন্য সবসুদ্ধ জড়িয়ে একটা নিষ্ফলতা এবং ঔদাস্য।” চিঠিপত্র, পঞ্চম খন্ড : পৃ: ১৫০-৫১। এবার, বলাকার ২৮ সংখ্যক কবিতাটিকে ব্যবচ্ছেদ করা যাক(টীকা ৩ দ্রষ্টব্য)।এই কবিতাটিতে সীমা-অসীমের, জীব ও পরমের, সৃষ্টি ও স্রষ্টার দ্বন্দ্বই শুধু নয়, বরং অভেদের অনুসন্ধান আছে। একই সঙ্গে আছে প্রকৃতি ও পুরুষের মোকাবিলা ও কথোপকথন। এই কবিতাটিকে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি, মহাকবি আল্লামা ইকবাল-এর ‘শিকওয়া’ এবং ‘জওয়াবে শিকওয়া’ কাব্যের যুগলরূপের সঙ্গে। রবীন্দ্রভুবনের দ্বান্দ্বিকতার বহুমাত্রিকতা ও বিচিত্রমুখী বিচরণকে আমরা পরে ব্যাখ্যা করবো। আগে সেরে নিতে হবে তাঁর তন্বিষ্ট-গতিবাদ অর্থাৎ গতির ভেতরের স্থিতি, স্থিতির ভেতরের গতি, এবং গতি ও স্থিতির পারস্পরিক ‘আবেশী আবেগ’-কে পর্যালোচনার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আমাদের প্রধান উপজীব্য। পর্যালোচনার শুরুতে বলেছিলাম,অন্যান্য অনুষঙ্গী অনুভবের মতোই গতিবাদের সূচনাও ‘মানসী’ কাব্যে। আর গতির প্রসঙ্গ এলে স্থিতির প্রসঙ্গও আসে। আসে গতিজড়তা এবং স্থিতিজড়তার প্রসঙ্গের প্রস্তাব। গতিবিদ্যা এবং স্থিতিবিদ্যা আজ সমান-বিপরীত-বিপ্রতীপ বিজ্ঞান। ‘মানসী’-পর্বেই যে গতিচিন্তার উন্মেষ তাতে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাক্ষ্য মেলে।
“আকৈশোর বহু কবিতায় এই গতিবাদের দৃষ্টাšত মিলিবে।
বলাকার যুগে এই গতিবাদ ভাব-কল্পনার গভীরতা ও ঐশ্বর্যে এক নূতন রূপ লাভ করিয়াছে মাত্র।”১০

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় রবীন্দ্রভুবনের ক্রমবিকাশ এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে। আর, গতি ও স্থিতি যেহেতু দুই বিপরীত প্রত্যয় সেহেতু রবীন্দ্রনাথের ভাষাকেও সেই বৈপরীত্যকে ধারণক্ষম হতে হয়েছে। পূর্ববর্তী পংক্তিগুলি, শব্দবন্ধ এবং বাক্যবন্ধগুলি তারই চরম পরাকাষ্ঠা। এবার গতিবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব বোঝা যাক উপেন্দ্রনাথের জবানিতে।
“বলাকা’- রচনার কয়েক বৎসর পূর্বে বের্গসঁর বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ Creative Evolution প্রকাশিত হয়। তাঁহার মতে জগতের মধ্যে নিরন্তর পরিবর্তন চলিতেছে। “We change without ceasing, and the state itself is nothing but change this is no feeling no idea, no volition, which is not undergoing change at every moment; if a mental state ceased to vary, its duration would cease to flow.”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গতিবাদ বুঝিতে হইলে বের্গসঁর বা হিন্দু বা বৌদ্ধ দর্শনের কোনো গতিবাদের উল্লেখ প্রয়োজন করে না। প্রতিভার অঙ্কুরোদগম হইতে এই গতি-মাহাত্ম্য কবি মানসের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া আছে, ইহা রবীন্দ্র-কাব্য-যাঁহারা কিছু পড়িয়াছেন, তাহারাই জানেন”। ১১
এরপর উপেনবাবু রবীন্দ্রনাথ এবং বের্গসঁর গতিবাদ সম্পর্কে তুলনামূলক মšতব্য করেছেন। উপেনবাবুর তুলনামূলক পর্যালোচনার পর মৎপ্রণীত ‘আবেশীআবেগ’ তত্ত্বটি তুলে ধরবো রবীন্দ্র গতিবাদের প্রেক্ষিতে।
“তারপর বের্গসঁর সহিত রবীন্দ্রনাথের অনুভ‚তি ও চিšতার একটা মিল থাকিলেও মৌলিক অ-মিল আছে অনেকখানি। বের্গসঁ দেখিয়াছেন, একটা অফুরন্ত গতির বেগ, একটা নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের স্রোত। সৃষ্টির এই নিরন্তর পরিবর্তন বা রূপান্তর, এই becoming , একটা প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক ধারামাত্র। এই গতির মধ্যেই বের্গসঁ সত্যের চরম রূপ দেখিয়াছেন। কিন্তু মিস্টিক ও লালীতত্ত্বরসিক রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন এই গতির একটা উদ্দেশ্য ও পরিণাম। নিরবচ্ছিন্ন গতি সত্যের একটা রূপমাত্র, কিন্তু তাহাই চরম রূপ নয়। স্থিতি ও গতির মিলনেই চরম রূপ …। নটরাজের লীলার ধ্বংস নবতর সৃষ্টির জন্য, মৃত্যু অমৃতের জন্য, বিচ্ছেদ নব মিলনের জন্য।”১২
এবার আসা যাক ‘আবেশীআবেগ’ প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন- “পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ”,
কিংবা “তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
মাটির বন্ধ ফেলি
ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,
আকাশের খুঁজিতে কিনারা।”

তখন পর্বত এবং তরুশ্রেণীর বাসনাকে বাণীবদ্ধ করতে চান তিনি। আর এই পর্বত (জড়পদার্থ) এবং তরু (জীব) গতিপ্রাপ্ত হতে চাচ্ছে বলাকার পাখার শব্দে। আর এই আবেগের ধরন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘পুলকিত নিশ্চলের অšতরে অšতরে বেগের আবেগ।’ এই ‘বেগের আবেগ’ কেই আমরা বলতে চাচ্ছি ‘আবেশীআবেগ’। কারণ ‘আবেশীআবেগ’, ‘বেগের আবেগ’ও হতে পারে, আবার ‘স্থিরতার আবেগ’ বা ‘স্থৈর্যের আবেগ’-ও হতে পারে। কারণ গতি এবং স্থিতি দুই অবস্থাই আবেশ সৃষ্টি করতে পারে। যা গতিজড়তা এবং স্থিতিজড়তায় সিদ্ধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- এই ‘আবেশীআবেগ’ কিংবা ‘বেগের আবেগ’ ‘শুধু পলকের তরে’ অর্থাৎ অনুভব্যতায় আপেক্ষিক। কিন্তু মিথ্যা নয়। কবির সংবেদনশীলতার স্বাভাবিকমাত্রা সাধারণ মানুষের অস্বাভাবিক মাত্রার অনেকাধিক হবে, এটাই স্বাভাবিক। যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করলে, পর্বতের বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হওয়া অস্বাভাবিক বা অবা¯তব নয়। কারণ, পর্বতের ধূলিকণা এবং সমুদ্রের জলীয় বাষ্প মিলেই মেঘ। কিন্তু তরুশ্রেণীর পাখামেলা বাসনা বৈকি। সেদিক থেকে বস্তুজগতের ভেতরের গতি এবং রূপাšতর সহজ। কিন্তু জীবজগতের বাসনাবাঞ্ছিত রূপান্তর অনেকটাই অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের এমত উপলব্ধি- অনুভ‚তি সত্যকে সর্বপ্রাণবাদিতার দিকে ধাবিত কোরেও ধরে রাখে বস্তু ও চৈতন্যের দ্বান্দ্বিকতায় এবং অভেদ অবস্থানে। এ-প্রসঙ্গে প্রমথনাথবিশীর মন্তব্য মিলিয়ে নিতে পারি আমরা। তিনি বলেছেন,“ শিল্পসৃষ্টির এক প্রান্তে সৃষ্টি, অপর প্রান্তে শিল্পীর চিত্তের ক্রিয়া, মাঝখানে এই পরিবর্তনশীল গতি ও স্থিতির লীলা। আমরা সাধারণত সৃষ্টি ও ক্রিয়া সম্বন্ধেই সচেতন, অধিকাংশ লোকেই সূ²ভাবে মাঝখানকার প্রক্রিয়াটিকে অনুধাবন করি না।”১৩ জড়-উদ্ভিদ-চৈতন্যের অভেদ অনুসন্ধানী বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয়ের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন,
“তাই জড়কে, উদ্ভিদকে, সচেতনকে তাঁহারা অলঙ্ঘ্যভাবে বিভক্ত করিয়াছেন। কিন্তু এই বিভাগকে দেখাই যে বৈজ্ঞানিক দেখা, একথা আমি স্বীকার করি না। কক্ষে কক্ষে সুবিধার জন্য যত দেয়াল তোলাই যাক না, সকল মহলেরই এক অধিষ্ঠাতা। সকল বিজ্ঞানই পরিশেষে এই সত্যকে আবিষ্কার করিবে বলিয়া ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া যাত্রা করিয়াছে। সকল পথই যেখানে একত্রে মিলিয়াছে সেইখানেই পূর্ণ সত্য। সত্য খন্ড খন্ড হইয়া আপনার মধ্যে অসংখ্য বিরোধ ঘটাইয়া অবস্থিত নহে। সেইজন্য প্রতিদিনই দেখিতে পাই জীবতত্ত¡, রসায়নতত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব আপন আপন সীমা হারাইয়া ফেলিতেছে।
বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্ব চনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপক্ষো করেন না। কবিকে সর্ব দা আত্মহারা হইতে হয়, আত্মসম্বরণ করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য। কিন্তু কবির কবিত্ব নিজের আবেগের মধ্যে হইতে তো প্রমাণ বাহির করিতে পারে না! এজন্য তাঁহাকে উপমার ভাষা ব্যবহার করিতে হয়। সকল কথায় তাঁহাকে ‘যেন’ যোগ করিয়া দিতে হয়।”১৪
বসু মহাশয়ের এই মšতব্যগুলি থেকে আমরা ‘অভেদ’, ‘অখন্ডমন্ডলাকারং’, ‘অসংখ্য বিরোধ’ ‘আত্মহারা ও আত্মসম্বরণ’ এবং অনিশ্চয়াত্মক ‘যেন’ পাই। ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধের শেষে তিনি বলেছেন-‘যেন নহে-এই সেই।’ ‘যেন’ বলেন কবি এবং ‘এই সেই’ বলেন বিজ্ঞানী। ‘অভেদ’ ‘অখন্ডমন্ডলাকারং’ এবং ‘আত্মহারা ও আত্মসম্বরণ’ নিয়েও আপত্তি নাই। আংশিক আপত্তি ‘অসংখ্য বিরোধ’ শব্দবন্ধে। সে আপত্তিও মিটে যায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। কারণ ‘অসংখ্য বিরোধ’ প্রধান দুটি বিরোধ ও বৈপরীত্যের ডালপালা মাত্র। বিজ্ঞানীকে মোটামুটি বস্তু-বিশ্লেষণ করলেই চলে। কিন্তু কবিকে বস্তু-সমাজ-সৃষ্টিকর্তা এবং মানব মন নিয়ে কারবার করতে হয়। ফলে বিরোধের ব্যাপ্তিও বিশাল। এ সম্পর্কে মাও সেতুঙ বলেন,
“কোন বড় বস্তু বা বিষয়ের বিকাশের ধারায় বহু দ্বন্দ্ব থাকে। …..। শুধু যে এই সব দ্বন্দ্বের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বিশিষ্টতা থাকে এবং একইভাবে তাদেরকে মোকাবিলা করা যায় না তাই নয়, প্রত্যেক দ্বন্দ্বের দু’টি দিকের প্রত্যেকটিরও নিজস্ব বিশিষ্টতা থাকে এবং একইভাবে তাদেরকে মোকাবিলা করা যায় না।”১৫
বসু মহাশয়ের ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধের প্রায় পুরোটাই তুলে ধরা হলো বৈকি। তবু প্রসঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যাক আরো কিছুটা।
“কবি এই বিশ্বজগতে তাঁহার হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়া একটি অরূপকে দেখিতে পান, তাহাদের তিনি রূপের মধ্যে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করেন। অন্যের দেখা যেখানে ফুরাইয়া যায় সেখানেও তাঁহার ভাবের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয়না। সেই অপরূপ দেশের বার্তা তাঁহার কাব্যের ছন্দে ছন্দে নানা অভ্যাসে বাজিয়া উঠিতে থাকে। বৈজ্ঞানিকের পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব সাধনার সহিত তাঁহার সাধনার ঐক্য আছে। দৃষ্টির আলোকে যেখানে শেষ হইয়া যায় সেখানেও তিনি আলোকের অনুসরণ করিতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায় পৌঁছায় সেখান হইতেও তিনি কম্পমান বাণী আহরণ করিয়া আনেন।”১৬
বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই এই যে, একটি আবিষ্কার অতিক্রম ক’রে অন্য আবিষ্কার অসম্ভব। রাষ্ট্র-বিপ্লব সমাজ বিকাশের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু কবির উপলব্ধ সংবেদনা সমসাময়িক প্রমায় যুক্ত না-থাকলেও ভ‚মায় যুক্ত। কোনো পংক্তি এক পরিস্থিতিতে প্রমায় যুক্ত নাই হতে পারে। কিন্তু ভিন্নতর পরিস্থিতিতে তাই হতে পারে প্রকৃষ্ট ও প্রামাণিক। এজন্য আবার আচার্য বসু মহাশয়ের কথাগুলি উপলব্ধি করতে হবে।
“বৈজ্ঞানিককে যে পথ অনুসরণ করিতে হয় তাহা একান্ত বন্ধুর এবং পর্য্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের কঠোর পথে তাঁহাকে সর্ব্বদা আত্মসম্বরণ করিয়া চলিতে হয়। সর্ব্বদা তাঁহার ভাবনা, পাছে নিজের মন নিজেকে ফাঁকি দেয়। এজন্য পদে পদে মনের কথাটা বাহিরের সঙ্গে মিলাইয়া চলিতে হয়। দুই দিক হইতে যেখানে না মিলে সেখানে তিনি একদিকের কথা কোন মতেই গ্রহণ করিতে পারেন না। ……

এইরূপ হঠাৎ চক্ষুর আবরণ অপসারিত হইয়া এক অচিন্ত্যনীয় রাজ্যের দৃশ্য যখন বৈজ্ঞানিককে অভিভূত করে তখন মুহূর্তের জন্য তিনিও আপনার স্বাভাবিক আত্মসম্বরণ করিতে বিস্মৃত হন এবং বলিয়া উঠেন, ‘যেন নহে-এই সেই’।”১৭


আমরা আলোচনা করছিলাম ‘মানসী’-র উপলব্ধির উন্মেষের পাশাপাশি ‘বলাকার’গতিবাদ এবং দ্বন্দ্ব মুখরতার ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশ নিয়ে। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “ ‘মানসী’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ পর্যšত অনেক কবিতারই লক্ষণ এই দ্বিমুখিতা বা বহুমুখিতা, সেগুলির বিষয় মানবিক অর্থে প্রেম, না ঐশ্বরিক অর্থে ভক্তি, সে-বিষয়ে আমরা মনস্থির করতে পারি না;  নারী ও প্রকৃতি, কবিতা ও বিশ্ব, প্রেমিক ও ভগবান, এঁরা যেন একই দেহে অবস্থিত হয়ে দেখা দিয়েও দেখা দিচ্ছেন না, আর তারই ফলে কবিতাটির বর্ণবিভা ক্ষণে-ক্ষণে বদলে যাচ্ছে ।”১৮
রবীন্দ্র-মানসের দ্বন্দ্ব রাজা ও ঋষির দ্বন্দ্ব; একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসী মানুষের দ্বন্দ্ব; বস্তুভিখারীর সঙ্গে আত্মানুসন্ধানের দ্বন্দ্ব। সে-কারণে সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে নিজের জমিদারী জীবন ও বাউলের বোধি মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন বার বার। ‘রাজর্ষি’, ‘রাজা’ ‘বিসর্জন’, রথের রশি’, ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘রক্তকরবী’, ‘গোরা’, ‘দুইবোন, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ইচ্ছাপূরণ’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘আপদ’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘স্ত্রীর পত্র,’ ‘শেষের কবিতা’, ‘সঙ্গীত চিšতা’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘সভ্যতার সংকট’, ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ ইত্যাদি রচনায় এবং বহুবিচিত্র কবিতা ও অবিনাশী গানে দেখতে পাই, রাজা ও ঋষির দ্ব›দ্ব; প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার দ্বন্দ্ব; প্রকৃতি ও মানব মনের দ্বন্দ্ব; দস্যুতা ও দীক্ষার দ্বন্দ্ব; যন্ত্রসভ্যতা ও প্রেমের দ্বন্দ্ব; নারীভাব ও পুরুষভাবের দ্বন্দ্ব; চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব; নিষ্কাম ও সকামের দ্বন্দ্ব; শৈশব ও বার্ধক্যের দ্বন্দ্ব; জীবাত্মা ও পরমাত্মার দ্বন্দ্ব; স্বপ্ন-কল্পনা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব; বাস্তব ও আধিভৌতিকতার দ্বন্দ্ব; নারীমুক্তি ও অবরোধবাসিনীর দ্বন্দ্ব; রোমান্টিকতা ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব; আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ও কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছার দ্বন্দ্ব; ধাতু ও মাতুর দ্বন্দ্ব; বিশেষ ও নির্বিশেষের দ্বন্দ্ব; কলেছাঁটা-ছাঁচে ঢালা মানুষ ও সৃষ্টিশীল মানুষের দ্বন্দ্ব; প্রাচ্য ও প্রচীত্যের দ্বন্দ্ব; সীমা-অসীমের দ্বন্দ্ব; যা গড়ে তুলেছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য সন্ধানী, অভেদান্বেষী, অন্য এক অভিমুখ। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি । তিনি বলেছেন, “ রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলি সূত্র বেরিয়ে আসে: ঔপনিষদিক ও বাউল-বৈষ্ণবের দৃষ্টিভঙ্গি, অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ, উনিশ-শতকী পাশ্চাত্য মানবধর্ম ও রোমান্টিকতা, এমনকি আঠারো-শতকী যুক্তিবাদ; বলা বাহুল্য এর কোনো-কোনোটি পরস্পরবিরোধী । কিন্তু তিনি তাঁর কবিতার মধ্যে বিরোধগুলিকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে যা বিশেষভাবে মনোজ্ঞ, তা তাঁর নম্যতা ও গতিধর্ম- এক ও অনেকের মধ্যে, রূপ ও অরূপের মধ্যে তাঁর নিরন্তর ভ্রমণ ।”১৯

২.১
রবীন্দ্রকাব্যের এই অন্যতর অভিমুখের আশ্রয় বিচিত্র বিরোধমূলক অলঙ্কার। বিশেষভাবে বিবেচ্য বিরোধাভাস, বিভাবনা, বিশেষোক্তি, অসঙ্গতি, বিষম, দীপক, শ্লেষ, পরিবৃত্তি, ভাবিক, অনুক‚ল, ব্যাজোক্তি, অপ্রস্তুত-প্রশংসা, অর্থান্তরন্যাস, ব্যাজস্তুতি(!), আপেক্ষ, তুল্যযোগিতা, সহোক্তি ইত্যাদি অলঙ্কার স্বকপোলকল্পিত রবীন্দ্রসৌধে সনাতন ও সমকালীনতার সংক্ষুব্ধ নানা ‘সঙ্কর ও সংসৃষ্টি অলঙ্কার’। কোনো মহৎ কবিই সনাতনে সীমাবদ্ধ থাকেন না। আর সেই কবি যদি হন যুগপ্রবর্তক (রবীন্দ্রযুগ), তবে তো তাঁকে তন্বিষ্ট তথাগত তপোবলে তারোধিক সত্যনির্মাণ করতেই হয়। সে-কারণেই নিরাকরণের নিয়মে রবীন্দ্র-অলঙ্কারে আছে সনাতন ও সম্মুখের সমাবেশ। আছে বিবিধ বিপরীতের ঐক্য। এ-প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, “এর ফলে কাব্য বিচারের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল এবং পার্টিকুলার-এর মধ্যে যে বিবদমান অবস্থা তা থেকে কবি মুক্ত ছিলেন।”২০ এমনকিছু অভ‚তপূর্ব অলঙ্কার রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন যেগুলোকে নতুনতর নামকরণ করা যেতে পারে। হতে পারে তা, যুগ্মবৈপরীত্য রীতির( যেমন- গার্হস্থ্যসন্ন্যাস,ঘৃণাতিথ্য,হিমদাহ ইত্যাদি যুগ্মবৈপরীত্য রীতির শব্দযুগল) পূর্বপুরুষ। যা, উত্তরপুরুষে নতুন সত্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচনে উন্মুখ। যা, ‘সঙ্কর ও সংসৃষ্টি অলঙ্কার’ নামে নামাঙ্কিত হতে পারে। এ-প্রসঙ্গে শ্যামাপদ চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের মন্তব্যে মনোনিবেশ করা যাক,
“তিল আর চাল মিশিয়ে দিলে তাদের পৃথক করা যায়। দুধ আর জল মিশলে ওদের পৃথক করা যায় না। এই দুটি ব্যাপারকে ন্যায়শাস্ত্রে যথাক্রমে ‘তিলতন্ডুলন্যায়’ এবং ‘ক্ষীরনীরন্যায়’ বলা হয়েছে।
অলঙ্কারকে অমিশ্রভাবে পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু বেশী পাওয়া যায় মিশ্রভাবে। এই মিশ্রণ তিলতন্ডুলন্যায় বা ক্ষীরনীরন্যায় অনুসারে হ’য়ে থাকে। প্রথম প্রকারে মিলিতি থাকলে হয় সংসৃষ্টি এবং দ্বিতীয় প্রকারে, সঙ্কর …….। শুধু একটি অলঙ্কারের চেয়ে সংসৃষ্টি বা সঙ্কর অথবা সংসৃষ্টি সঙ্করের মিলিত রূপ ভাবকে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলে। কবিরা এসব সৃষ্টি সচেতনভাবে করেন না, আপনা হ’তে এরা এসে পড়ে।”২১

২.২
আমরা ‘মানসী’-র উন্মেষ থেকে বলাকার বিকাশ পর্যালোচনা করতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছি রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রমুখী দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের। এর একটি বিশেষ দ্বন্দ্ব শ্রেণীদ্ব›দ্ব। অর্থাৎ জমিদার মন এবং ‘আমি তোমাদের লোক’ সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য। সত্তর বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ‘পরিশেষ’ কাব্যের ‘বাঁশি কবিতায় বলেছেন,
“হঠাৎ খবর পাই মনে,
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।’

ঠিক এমন কথাই আছে ‘শা-জাহান’ কবিতায়। বলেছেন,
“একথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান
কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান।”

একইভাবে ঘুঁটেকুড়ানি আর রাজরাণীর প্রভেদ মুছে যায় ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায়। একথা সত্য যে, রবীন্দ্রমন সামন্তযুগ ও পুঁজিবাদী যুগের যৌগনির্যাস। তাই তার মনের গভীরে সামন্ত অবশেষ রয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফলে জমিদার পরিবারের জমিদার কবিমনে আকবর-শা-জাহান তথা মোগলযুগ-রাজরাজরার যুগ প্রভাব ফেলবে না, তা অকল্পনীয়। ঠাকুর পরিবারের আরও একজন সদস্য, শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যে এই মন্তব্যের সত্যতা সুনিশ্চিত হবে। যদিও যেকোনো ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে একজন ঐতিহাসিকতায়সিদ্ধ মানুষ শুধু তাঁর পূর্ববর্তী মানুষ ও বিষয় নিয়েই ভাবতে ও লিখতে পারেন। পরবর্তী মানুষ সম্পর্কে পারেন না। বড়জোর পরিকল্পনা করতে, নির্দেশনা ও ধারণা দিতে পারেন মাত্র। অবন ঠাকুরের ভাষায়,
“আকবর বাদশাহের সয়মকার শিল্পে এর সুস্পষ্ট আভাস দেখা যায়, ভারতশিল্প মিলতে চলেছে মোগল শিল্পে, খাঁটি তুর্কশিল্প ধরতে চলেছে ভারতীয় ছন্দ, ফতেপুর শিকরীয় স্থাপত্য, সূফী কবিদের কবিতা এবং কবীরের সমস্ত চিন্তা এই অভিসারে চলেছে, রাজপুতের মেয়ে বসতে চলেছে দিল্লীশ্বরের পাশে। …. এই সঙ্কট পেরিয়ে গিয়েছিল এদেশের শিল্প একদিন আকবরের আমলে, মিলন হল গিয়ে সার্থক সাজাহানের সময়ে যখন সত্যকার মোগল শিল্প দেখা দিলে-তাজমহল। সঙ্গীত কলার দিক দিয়েও তখন এই মিলন ঘটে গেলো, …”২২

নীরদ চৌধুরী তাঁর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ পুস্তকে লিখেছেন,
“রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁর অভ্যাসমত অপ্রচুর পোষাক পরিয়া পিতার কাছে গেলেন, তখন তাহাকে চাপকান ও টুপি পরিয়া আসিতে বলা হইল।” ২৩

‘রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি’ গ্রন্থে কামাল উদ্দিন হোসেন লিখেছেন,
“রবীন্দ্রনাথ মাছ, মাংস তো খেতেনই, মোগলাই খানায় তাঁর যে একটা বিশেষ রুচি ছিল তা তাঁর অনেক লেখা থেকে জানা যায়। তাঁর শখের খামখেয়ালী সভায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভোগ্যবস্তু থাকত মোগলাই খানা, যে সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন একজন সদস্য। ঠাকুরবাড়ীর মেয়েরাও হিন্দুর বাছবিচার থেকে মুক্ত ছিলেন, তাঁরা নানা প্রকার মাছ-মাংসের রান্নায় পটু ছিলেন, যা আমরা পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা থেকে জানতে পারি, যিনি স্বয়ং ঠাকুর পরিবারের মেয়ে। নানা প্রকার পোলাও রান্নার মধ্যে ছিল ‘রামমোহন পোলাও।” ২৪
আমাদের পর্যালোচনা বিষয় রবীন্দ্রনাথ ও ‘রোমমোহন পোলাও’-এর তুলনামূলক আলোচনা নয়। বরং একজন ভোগী ও ত্যাগী মানুষের দ্ব›দ্ব; একজন জমিদার ও বাউলমনের দ্বন্দ্ব; একজন জাতীয়তাবাদী ও বিশ্বমানবিক মনের দ্বন্দ্ব তুলে ধরা। এবং এই ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতায় সৃষ্ট ‘সঙ্কর ও সংসৃষ্টি অলঙ্কার’ অন্বেষা। যে অন্বেষা আমাদের অনুপ্রাণিত করে উত্তরপুরুষে কীভাবে সেইসব শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধ, বিপরীত ভাববন্ধ যুগ্মরূপ ধারণ করে তার সুলুকসন্ধানে। এই ঐতিহাসিক অভিমুখ শুধু অবচেতনের ইতিহাস নয়, বরং বিকাশমান সমাজ-দর্শন-রাজনীতি এবং মানব মনের ক্রমবিবর্তিত রূপ। দ্ব›দ্ব ছিল বলেই একজন জাতপেশার জমিদার রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
“আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই।”
এ প্রসঙ্গে বলা উচিত, যদি রবীন্দ্রনাথের বস্তুজ্ঞান ও আত্মজ্ঞান সুর ও বাণীর মতো সমান-সমান না-হতো তবে হয়তো তাঁর দশা তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ গল্পের জমিদারের মতোই হতো। কারণ, জমিদারি রক্ষার জন্য একটু আধটু জমিদারি ঠাঁট বজায় রাখতে হয়। রবীন্দ্রমানসে অন্যান্য যে দ্বন্দ্বগুলি ক্রিয়মান ছিল তা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন শুধু ঐসব বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্বের (রবীন্দ্রকথিত) শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা, আকাশের (তত্ত্বের) খুঁজিতে কিনারা’ রবীন্দ্রভুবনে বিকশিত বিপরীত শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধ, যুগ্মবৈপরীত্য যুগলের সন্ধানে রবীন্দ্রশব্দমন্থনে ব্রতী হবো (টীকা ৪ দ্রষ্টব্য)।

২.৩
রবীন্দ্রভুবনে বৈপরীত্যানুসন্ধানের এ-পর্যায়ে আমরা পাই, ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থটি। পুরো পুস্তিকাই প্রতিবস্তুপোমায় ভরপুর। ফলে উদ্ধৃতি দিতে গেলে তুলে ধরতে হবে পুরো গ্রন্থটিই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবস্তু প্রতিমার ঘট স্থাপন দুটি দ্বা›িদ্বক বিল্পপত্রের পুরোভাগে তৃতীয় বিল্পপত্রের উদ্ভাসে। অর্থাৎ, দু’টি বিপরীত সত্যের থিসিস এ্যান্টিথিসিসে তৃতীয় সত্যে উত্তরণ। যা মূলত রবীন্দ্রমানসের সিনথিসিস। এইসব প্রতিবস্তু প্রকল্পে বিপরীত বিশ্বাসও অপ্রতুল নয়। রবীন্দ্রমনের নানাবিধ মনোবাঁকে একই বিষয় বিবিধবিন্যাসে ধরা পড়েছে এই পুস্তিকায়। নিজের পক্ষের যুক্তিগুলিকে কিছুটা জোড়াতালির জোয়ালে সংস্থাপনার্থে প্রতিটি প্রতিবস্তু হয়েছে তার হাল আমলের হালের বলদ। কখনো কখনো ভিন্ন দুটি কবিতায় একই বক্তব্যের দ্বিরাচারকে দূষণীয় মনে করেন নি তিনি। তবু এই দ্বান্দ্বিকতা বস্তুর দৃশ্যমান ও ভেতরগত আখ্যানকে আধেয় করতে পেরেছে ব’লে মনে হয়। সেই সঙ্গে সুস্পষ্ট আধার হয়েছে রুবাই-লিমেরিক-হাইকু-দ্বিপদীর মতো মিতবাকিতায়। এই মিতব্যয়িতা যেমন মর্মস্পশী তেমনি তুরীয় ও তথাগত। বস্তুর ভেতরে চৈতন্যারোপ একদিকে চৈতন্য ও বস্তুর ব্যবধান কমায়, অন্যদিকে বস্তুগত বৈপরীত্যে বস্তুর ভেতর দিয়ে, বস্তুবিশ্বের আলোকে চৈতন্যকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় এই ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থটি। বস্তুর ভেতরের গুপ্ত রহস্যাখ্যান উন্মোচিত করেছেন কবি আরোপিত আলাপে সংলাপে। ডায়লজিক পোলিফোনির মাধ্যমে সাংঘর্ষিক সত্যগুলি বিপরীত-বিপ্রতীপ বোঝাপড়ার মাধ্যমে চিন্তার যে চূড়া স্পর্শ করেছে তা হয়তো সর্বমান্য সত্য বা স্বতঃসিদ্ধ নয়, কিন্তু দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সংলাপের অন্য এক অবরোহী অধ্যায় বটে। ‘শিশু’ কাব্যে এসে আমাদের চোখ আটকে যায় একটি বিশেষ বৈপরীত্যে। একটি বিশেষ দ্বন্দ্ব, যা প্রতিটি মানুষের জীবন পরিক্রমায় প্রযুক্ত একটি নির্বিশেষ দ্বন্দ্ব। তা হলো মানুষের শৈশব। শৈশবের সারবত্তা পরিচালিত করে প্রতিটি মানুষকে। যে যৌবন যুক্তিশীলতাকে বৈধতা দেয় তার পূর্বসূরি শৈশবের অযৌক্তিকতার অনির্বচনীয় অধ্যায়। তাই ‘শিশু’ কাব্যের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যে যুক্তি ও অযুক্তির দ্বন্দ্ব। কোনো কার্য-কারণ নয়, বরং অকার্য-অকারণের মুক্তাঞ্চল এই শিশু মনোভুমি। যে কারণে রবীন্দ্র ভুবনের সবচে প্রধান মুদ্রাদোষিক শব্দ ‘অকারণ’। ফলে ‘বীরপুরুষ’, ‘মাঝি’, ‘সমালোচক’, ‘জ্যোতিষ-শাস্ত্র’, ‘বনবাস’, ‘খোকার রাজ্য’, ‘জন্মকথা’, প্রভৃতি ছড়া তাই শেষ পর্যšত ছড়ার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে বয়স্ক পরিণত শিশুদের কবিতা। এই কাব্যের অন্যান্য প্রধান দ্বন্দ্বগুলি হলো বুদ্ধি ও নির্বুদ্ধিতার দ্বন্দ্ব; বিষয়বুদ্ধি ও আলাভোলার দ্বন্দ্ব; নিদয়া ও সদয়া মায়ের (মাতৃন্বেষণী) দ্বন্দ্ব; শিশুর বস্তু ও আত্মজ্ঞানের সঙ্গে বয়স্কের বস্তু ও আত্মজ্ঞানের দ্বন্দ্ব; পরিণত ও অপরিণত মনের আপাত বিরোধ ও বিচারিক প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্ব; যা মানবসভ্যতাকে লজ্জায় ফেলে দেয় শিশুতোষ প্রশ্নে। অন্য কোনো উদ্ধতি না দিয়ে ‘শিশু’ কাব্যের শুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার বিশ্ববিখ্যাত স্তবকটি তুলে দিচ্ছি।
“জানে না তারা সাঁতার দেওয়া,
জানে না জাল ফেলা।
ডুবরি ডুবে মুকুতা চেয়ে,
বনিক ধায় তরণী বেয়ে,
ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে
সাজায় বসি ঢেলা।
রতন ধন খোঁজে না তারা,
জানে না জাল ফেলা।”

বিশ্বজাগতিকতার ভিতর মানবসভ্যতার এই দ্বন্দ্ব বিরোধ ও বৈপরীত্য চিরন্তন এবং চিরপ্রশ্নদীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসর্গ’ কাব্যের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য শব্দবন্ধে খুব বেশি নয়। বরং লীলায় লিপ্ত। এক ধরনের একাকারান্বেষী। অল্প কিছু বাক্যবন্ধে এর বৈপরীত্য বিন্যস্ত।যেমন-
‘বাহিরে যবে হাসির ছটা/ভিতরে থাকে আঁখির জল/; যে কথা তুমি বলিতে চাও/ সে কথা তুমি বল না/; সে কহিল, ‘আমি যারে চাই, তার/নাম না কহিতে পারি/; পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই/তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই/; পাশে আছে যারা তাদেরই হারায়ে/ফিরে প্রাণ সারা গগনে/;পর ভাবি যারে তারা বারে বারে/ সবাই আমাদের টানিছে/;আছে যাহা চিরপুরাতন/ তারে পায় যেন হারাধন/;কবিরে খুঁজিছ যেখায় সেথা সে নাহিরে/ যাহারে কাঁপায় স্তুতি নিন্দার জ্বরে/ কবিরে পাবে না তাহার জীবন চরিতে/; ভাষাহারা মহাবার্তা; বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি; দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান; সব সুখজালে বজ্র জ্বালালে;
এই কাব্যের ১নং কবিতায় যে প্রশ্নদীর্ণ বৈপরীত্য, তারই পূর্ণতা ১৭ সংখ্যক কবিতায়। কাব্যের শুরুতে কবি বলেছেন,
“ভোরের পাখি ডাকে কোথায়
ভোরের পাখি ডাকে।
ভোর না হতে ভোরের খবর
কেমন করে রাখে।”

এই অতিজীবিত অনুভ‚তি যে লীলারসের জন্ম দেয় তা শুধু লীন হওয়া নয়, বরং কোনো প্রাণের আগাম আভাস পাবার অতিন্দ্রিয় ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে। সেই সংবেদনশীলতা অবশ্যই অনুভ‚তি সাপেক্ষ। পরমব্রহ্মের স্বাদ অনুভূতি সাপেক্ষ; এই ব্রহ্মজ্ঞান একজন নিষ্ঠ ব্রাহ্ম তাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরতে ভুলে যান নি। ১৭ সংখ্যক কবিতায় দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য আকারপ্রাপ্ত হয়েছে রূপ-রস-গন্ধসহ। পুরো কবিতাটিই তুলে ধরছি।
“ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে,
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার মুক্তি,
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা,
বন্ধ ফিরিয়ে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।”

এ-যেন এককথায় পুরো রবীন্দ্রনন্দনবিশ্ব। ‘উৎসর্গ’ কাব্যের কাব্যিক উৎকর্ষ উল্লেখ করবার মতো নয়। কিন্তু এই ১ সংখ্যক এবং ১৭ সংখ্যক কবিতাদুটির জন্যেই যেন বা এই কাব্যের কীর্তি অসামান্য।

রবীন্দ্রভুবনের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যকে পর্যালোচনা করতে হলে পুরো রবীন্দ্রসিন্ধু মন্থন আবশ্যক। তাতে হলাহল দুইই উঠতে পারে। তাতে বিচলিত হবার কিছু নাই। কারণ রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, ‘মন্দ যদি তিনচল্লিশ ভালো তবে সাতান্ন’। রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠি এবং বিচিত্র ধরনের নাটকে ন্যস্ত দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে কাজ শুরু করেছি । সেই সঙ্গে তাঁর অবিনাশী গানে উচ্চারিত বিচিত্র বৈপরীত্যযুগল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার আশাবাদ জারি রেখে আপাতত সত্যের জাল গুটিয়ে নিচ্ছি।

 

টীকাঃ

১। “দোলে রে প্রলয় দোলে অকূল সমুদ্র-কোলে
উৎসব ভীষণ।
.. .. .. .. .. .. .. ..
“নাই সুর, নাই ছন্দ, অর্থহীন, নিরানন্দ
জড়ের নর্তন।”
.. .. .. .. .. .. .. .. ..
“বিলম্ব দেখিয়া রোষে ফেনায়ে ফেনায়ে ফোঁসে
নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে।”
.. .. .. .. .. ..
“পাশাপাশি এক ঠাঁই দয়া আছে, দয়া নাই
বিষম সংশয়।
মহাশঙ্কা মহা-আশা একত্র বেঁধেছে বাসা
এক সাথে রয়।
কেবা সত্য, কেবা মিছে নিশিদিন আকুলিছে,
কভু ঊর্ধ্বে কভু নীচে টানিছে হৃদয়।
জড় দৈত্য শক্তি হানে, মিনতি নাহিক মানে-
প্রেম এসে কোলে টানে, দূর করে ভয়।
একি দুই দেবতার দ্যূতখেলা অনিবার
ভাঙাগড়াময়?
চিরদিন অন্তহীন জয়পরাজয়?

২। (ক) চিরচঞ্চলের মাঝে তুমি কেন শান্ত হয়ে রও।
(খ) নয়নসম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই;
(গ) এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে।
(ঘ) যেই ক্ষণে দেয় ভরি
মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল,
বিদায়-গোধূলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল।
(ঙ) হায়রে হৃদয়,
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
(চ) রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে।
(ছ) তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে
চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে।
(জ) তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি
এড়াইয়া কালের প্রহরী
চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া
“ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।”
(ঝ) সমাধি মন্দির
এক ঠাঁই রহে চিরস্থির;
স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি।
(ঞ) তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।
(ট) শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও
উদ্দাম উধাও;
ফিরে নাহি চাও,
যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।
(ঠ) যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই,
তুমি তাই
পবিত্র সদাই।
(ড) যুগে যুগে এসেছি চলিয়া,
স্খলিয়া স্খলিয়া
চুপে চুপে
রূপ হতে রূপে
প্রাণ হতে প্রাণে
নিশীথে প্রভাতে
যা-কিছু পেয়েছি হাতে
এসেছি করিয়া ক্ষয় দান হতে দানে,
গান হতে গানে।
(ঢ) অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।
(ণ) মনে হল এ পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অšতরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
মাটির বন্ধন ফেলি
ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশেহারা,
আকাশের খুঁজিতে কিনারা।
এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
সুদূরের লাগি,
হে পাখা বিবাগী।
বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে-
“হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্খানে।”
(ত) তৃণদল।
মাটির আকাশ-‘পরে ঝাপটিছে ডানা;
মাটির আধার নীচে, কে জানে ঠিকানা,
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।

৩। “পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,
তার বেশি করে না সে দান।
আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,
আমি গাই গান।
বাতাসেরে করেছ স্বাধীন,
সহজে সে ভৃত্য তব বন্ধনবিহীন,
আমারে দিয়েছ যত বোঝা,
তাই নিয়ে চলি পথে কভু বাঁকা কভু সোজা।
একে একে ফেলে ভার মরণে মরণে
নিয়ে যাই তোমার চরণে
একদিন রিক্ত হস্ত সেবায় স্বাধীন;
বন্ধন যা দিলে মোরে করি তারে মুক্তিতে বিলীন।
পূর্ণিমারে দিলে হাসি;
সুখস্বপ্ন-রসরাশি
ঢালে তাই, ধরণীর করপুট সুধায় উচ্ছ্বাসি।
দুঃখখানি দিলে মোর তপ্ত ভালে থুয়ে,
অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে
আনন্দ করিয়া তারে ফিরায়ে আনিয়া দেই হাতে
দিনশেষে মিলনের রাতে।
তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোকে আঁধার।
শুন্যহাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
দিয়েছ আমার ’পরে ভার
তোমার স্বর্গটি রচিবার।

আর সকলেরে তুমি দাও,
শুধু মোর কাছে তুমি চাও।
আমি যাহা দিতে পারি আপনার প্রেমে,
সিংহাসন হতে নেমে
হাসিমুখে বক্ষে তুলে নাও।
মোর হাতে যাহা দাও
তোমার আপন হাতে তার বেশি ফিরে তুমি পাও।”

 

৪। আলস্যহীন অবসর; দেহহীন স্বপ্ন-আলিঙ্গনে; প্রেমের কারাগার; মাথায় ছোটো বহরে বড়ো; অহর্নিশি হেলার হাসি; ভদ্রতার বাণী, ভব্যতার গন্ডিমাঝে; মরণভয় চরণতলে; নির্বাণহীন অঙ্গার; ঘৃণা জ’¡লে মরে আপনার বিষে; রুদ্ধ মনোরথ; বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা; সোনার বাঁধন; শেষ হয়ে হইল না শেষ; ভুঁইফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভ‚মিতলে খোঁজে; যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে; স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়; আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস; দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা; দুই পাখি; ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-ছোট সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি; বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়;- ‘যেতে নাহি দিব’/ হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়; অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা; দিয়েছি সম¯ত মোর করিতে ধারণা, তাই মোরে বুঝিতে পার না?; ব্যর্থ সাধনখানি; করুন রোদন কঠিন হাস্য; ‘দুরাকাক্সক্ষা; গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে; মাঝখানে বসে আছি আমি পরবাসী; তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও; কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে; নিত্যসুখ দীনবেশে বনে গেল ফিরে,/ স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে; মুকুটবিহীন রাজা; মিলনের মরীচিকা; বালিকা ব্যথিল তারে আদরে আদরে; মর্তে কলঙ্কিনী, স্বর্গে সতীশিরোমণি; যেথায় রতন আছে অথবা মরণ; অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা; স্নেহের লেহন; মা বলিয়া ভুলাইব তোমারে পিশাচী; বীণস্বরে রুচি দিলে মহা নীরবতা; সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে; অলিখিত মহাশাস্ত্র; বিষে তুমি হার মানো, মধুতে যে জিত;…

তথ্যনির্দেশঃ

১। খেয়া, রবীন্দ্র-সংকলন, ৫৩তম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৪১৯, আহমদ শরীফ, রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন, ৪২ পৃষ্ঠা।
২। ঐ
৩। ঐ
৪। ঐ
৫। ঐ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন’, ৪৪৭ পৃষ্ঠা।
৬। মাও সেতুঙের রচনাবলীর নির্বাচিত অংশ, ‘দ্বন্দ্ব সম্পর্কে’, ‘দ্ব›েদ্বর বিশিষ্টতা’, ৯১ পৃষ্ঠা।
৭। যতীন সরকার,সাক্ষাৎকার, নতুন ধারা, সংখ্যা ৩৬।
৮। ধর্ম প্রসঙ্গে, মার্কস-এঙ্গেলস, প্রগতি প্রকাশন. মস্কো।
৯। রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ, প্রমথনাথবিশী, ২৬ পৃষ্ঠা।
১০। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র-কাব্য-পরিক্রমা।
১১। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র-কাব্য-পরিক্রমা, ৫৭৭ পৃষ্ঠা।
১২। ঐ, ৫৭৮ পৃষ্ঠা।
১৩। রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ, প্রমথনাথবিশী, ২৬ পৃষ্ঠা।
১৪। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত, বিজ্ঞানে সাহিত্য, কবিতা ও বিজ্ঞান, ৪৮ পৃষ্ঠা।
১৫। মাও সেতুঙের রচনাবলীর নির্বাচিত অংশ, দ্বন্দ্ব সম্পর্কে, দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতা, ৯৫ পৃষ্ঠা।
১৬। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত, বিজ্ঞানে সাহিত্য, কবিতা ও বিজ্ঞান, ৪৭ পৃষ্ঠা।
১৭। ঐ, ৪৮ পৃষ্ঠা।
১৮। কবি রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, ৩৩ পৃষ্ঠা।
১৯। ঐ, ৬১-৬২ পৃষ্ঠা।
২০। রবীন্দ্রনাথ কাব্য বিচারের ভূমিকা, সৈয়দ আলী আহসান, ৬ পৃষ্ঠা।
২১। শ্যামাপদ চক্রবর্ত্তী, অলঙ্কার-চন্দ্রিকা, ২১৬ পৃষ্ঠা।
২২। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী, ১৮৩ পৃষ্ঠা।
২৩। নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় খন্ড, ১৫ পৃষ্ঠা।
২৪। কামাল উদ্দিন হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি, ২৩৫ পৃষ্ঠা।
২৫। রবীন্দ্র-রচনাবলী, ঐতিহ্য, (প্রকাশনা সংস্থা)।

শেয়ার করুন: