অ্যাডিমেন্টাস জিগ্যেস করলেন: তুমি কোন গল্পের কথা বলছো সক্রেটিস।
আমি বললাম: এর ক্ষুদ্রের নিদর্শন বৃহতের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কারণ ক্ষুদ্র-বৃহৎ এদের চরিত্র অভিন্ন; একই মনোভাব উভয়ের মধ্যে কাজ করছে।
তা হতে পারে। কিন্তু কাকে তুমি বৃহৎ বলছো তা কিন্তু আমার কাছে এখনও বোধগম্য নয়, সক্রেটিস।
আমি বলছি কবিকুলের কথা আর সেই কবিকুলশ্রেষ্ঠ হোমার এবং হিসিয়ডের বর্ণিত কাহিনির কথা। হোমার আর হিসিয়ড যে মানবজাতির কাহিনিকারদের শ্রেষ্ঠ, একথা তো আমরা জানি।
কিন্তু তাদের কোন গল্পের কথা তুমি বলছো আর সে গল্পের ত্র“টিই-বা কি?
তাদের গুরুতর ত্র“টি হচ্ছে এই যে, তাদের ভাষণ মিথ্যা আর কেবল মিথ্যাই নয়, নিকৃষ্ট প্রকারের মিথ্যা।
কিন্তু কখন তারা এরূপ ত্র“টির প্রশ্রয় দিয়েছে বলে তুমি মনে করো?
কেন? যখনই তারা দেবতাদের আর কাহিনির নায়কদের কথা বর্ণনা করেছে তখনই তারা এই মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাদের এ-ত্র“টি তুমি শিল্পির অলিক চিত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পারো। শিল্পি যখন মূল বস্তুর সঙ্গে বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য ব্যতিরেকে তার চিত্র অঙ্কিত করে তখন সে যেমন এক মিথ্যার সৃষ্টি করে, এই কবির দলও তেমনি তাদের কাহিনিতে এক অলিক জগৎ তৈরি করে।
সরদার ফজলুল করিম অনুবাদকৃত প্লেটো’র ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থ থেকে, পৃ. ১১২, ঢাকা
প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এর প্রধান সমস্যা জ্ঞানতাত্ত্বিক। জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শেষতক কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যা তাঁকে নিন্দার শির্ষে নিয়ে যায়, এজন্য বিস্তর কট‚কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে, আবার কেউ কেউ পক্ষ নিয়ে বলবার চেষ্টা করেছেন এগুলো সবই প্রক্ষিপ্ত, মূলের সাথে যার কোনো সংযোগ নেই। প্লেটো নিজেই যেহেতু কবি, তাঁর রিপাবলিকের প্রতি ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে কাব্যের অনুরণন, আবার যৌবনে লিখতেন কবিতা, যার অনেকগুলোই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। তাহলে পরিণত বয়সে কেনো প্লেটো শিল্পিদের প্রতি উষ্মা প্রদর্শন করলেন, হলেন বিরাগভাজন। জ্ঞানতত্ত্বের আপাত জটিল পথ পরিক্রমায় তিনি যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তা কি শুধু তার মস্তিষ্কপ্রসূত ইউটোপিয় চিন্তা, না তার বাস্তবায়নযোগ্য ভিত্তি আছে, কেনই-বা তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্তে নিজেকে করলেন স্থাপন; নির্বাসন দিতে চাইলেন সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে শিল্পিদের, কবিদের। কবি শব্দ দ্বারা আদতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন? কবি বলতে যে তিনি শিল্পের সমজদার শিল্পিদেরই ইঙ্গিত করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ রচনার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন; তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান অথবা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকেই আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তিতে করতে চান সুদৃঢ়। যার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হাজির করেন। ন্যায় বা Justice বলতে কি বোঝায় এমন একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয় ‘রিপাবলিকে’র পথচলা। ন্যায় এমত প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, প্রশ্ন উঠে শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষাই ন্যায় কি-না।
প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ সনে প্লেটো গ্রিসের এথেন্স নগরিতে জন্মগ্রহণ করেন। (জীবনকাল: ৪২৭-৩৪৭ খ্রি.পূ.)। পিতা এরিস্টন প্লেটোর অল্পবয়সেই মারা যান। কেবল পিতার সূত্রে নয়, মাতা পেরিকটিয়নও অভিজাত বংশিয় ছিলেন। ‘রিপাবলিক’-এর সংলাপে অংশগ্রহণকারি অ্যাডিম্যান্টাস এবং গ্লকন প্লেটোর সহোদর। এরিস্টনের মৃত্যুর পরে প্লেটোর মাতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। পেরিকটিয়নের দ্বিতীয় স্বামি পাইরিল্যামপিস যেমন রাষ্ট্রনেতা পেরিক্লিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তেমনি তিনি নিজেও এথেন্সের রাজনীতিক জীবনের এক উলেখযোগ্য নাগরিক ছিলেন। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাসে গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত। প্রাচিনকালের সভ্যতাসমূহের বিকাশ ঘটেছিল সমুদ্র এবং নদিতিরে। সেদিক থেকে ভ‚মধ্যসাগরের তিরবর্তি অঞ্চল এবং দ্বিপের ন্যায় তার উত্তর উপক‚লের গ্রিক উপদ্বিপে বহু প্রাচিনকালেই জনবসতি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এই জনবসতি পাহাড় পর্বত অধ্যুষিত এই উপদ্বিপের প্রাকৃতিক চরিত্রের কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের রূপ লাভ করে। গ্রিকসভ্যতার বিকাশের সময়ে এবং তারও পূর্বে মিশর, সিরিয়া এবং প্রাচ্যে: ভারতবর্ষ এবং চিনে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। কিন্তু উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা প্রাচ্য অঞ্চলের রাষ্ট্রের রূপ সমতটের বিস্তারের কারণে ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের পরিবর্তে বৃহদায়তন রাষ্ট্রের আকার গ্রহণ করে। বৃহদাকার এবং ক্ষুদ্রাকার রাষ্ট্রের পার্থক্য কেবল আয়তনের পার্থক্য নয়। ক্ষুদ্রতর সংখ্যক মানুষের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা অধিকতর সংখ্যক মানুষ এবং বৃহদায়তন সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বহুলাংশে পৃথক। ক্ষুদ্রায়তন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো আধুনিক বৃহৎ রাষ্ট্রের তুলনায় এক-একটি ক্ষুদ্র শহর প্রায় ছিল একথা বলা চলে। এথেন্স নগররাষ্ট্রের মোট অধিবাসির মধ্যে আড়াই লক্ষ ছিল দাস এবং দাসদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। অবশিষ্ট দেড় লক্ষ অধিবাসির মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক অপর সকলেই যে নাগরিক বলে গণ্য হতো তা নয়। অপর দ্বিপ বা নগররাষ্ট্র থেকে যারা ব্যবসা অথবা অন্য কারণে এথেন্সে এসে বসবাস করতো তারাও নাগরিক বলে গণ্য হতো না। ফলে যথার্থভাবে যারা এথেন্সের নাগরিক তাদের সংখ্যা খুবই কম। নাগরিকদের মধ্যে শ্রেণিভেদ ও রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব ছিল। গ্রিসের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব প্রধানত অভিজাততন্ত্রি এবং গণতন্ত্রিদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। গ্রিকদের বসতি এবং সভ্যতা ক্রমান্বয়ে গ্রিক উপদ্বিপ অতিক্রম করে ভ‚মধ্যসাগরের বিভিন্ন দ্বিপে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে অতীতের দৈহিক বিচ্ছিন্নতার স্থলে গ্রিস এবং এশিয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এবং সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ এবং ৪৮০ সনে পরপর দুবার পারস্য সা¤্রাজ্যের স¤্রাট দারায়ুস এবং জারাক্সিস গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোকে বিরাট বাহিনিসহ আক্রমণ করেন। কিন্তু উভয় আক্রমণেই গ্রিক নগররাষ্ট্রের প্রধান দুটি নগররাষ্ট্র এথেন্স এবং স্পার্টা ঐক্যবদ্ধভাবে পারসিক স¤্রাটের বাহিনিকে প্রতিরোধ করে এবং আক্রমণকারি বাহিনি পর্যুদস্ত হয়। পেরিক্লিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৩ সনে এথেন্সের রাষ্ট্রনেতা নির্বাচিত হন। পেরিক্লিসের যুগকে প্রাচিন গ্রিক গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ যুগ বলা হয়। কিন্তু কালক্রমে গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক দ্ব›দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের শেষার্ধে ৪৩১ সনে নগররাষ্ট্র এথেন্স এবং স্পার্টার মধ্যে মারাত্মক ও দির্ঘস্থায়ি আত্মঘাতি যুদ্ধ শুরু হয়, যা পিলোপনেশিয় যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধেই এথেন্সের সংকট ও বিপর্যয়ের শুরু। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৩ সনে গণতন্ত্রিগণ শাসনক্ষমতা দখল করে এবং তাদের প্রতিপক্ষিয়দের বিনাশ করার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার মধ্যে সক্রেটিসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সনে সক্রেটিস হেমলক পান করে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় প্লেটোর বয়স ২৮, প্লেটো সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডে গভিরভাবে আলোড়িত হন। এই হলো ‘রিপাবলিক’ রচনার পটভ‚মি। অর্থাৎ প্লেটো তাঁর সময়ের বিরাজিত বিরাগ এই ‘রিপাবলিক’ নামক গ্রন্থে স্থান দিতে চেয়েছেন, চেয়েছেন একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র এবং সেই আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবি তথা শিল্পিদের নির্বাসন। শ্রমবিভাজনের ভিত্তিতে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সাজাতে চেয়েছেন, কথাটা অনেকটা বর্ণবাদি মনে হতে পারে। তবুও বিশেষ করে শ্রমবিভাজন এই বিষয়টির উপরই আমরা জোর দিতে চাই।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র হবে মূলত কর্মবাদি। কর্মের উপর নির্ভর করে হবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের পদ-পদবি। নাগরিকদের কয়েকটি শ্রেণিতে বিভাজন করেন তিনি। নাগরিকদের সোনার মানুষ, রুপার মানুষ, তামার মানুষ এভাবে দেখতে ভালোবাসেন। আর তা ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত এমনটিই ধারণা তাঁর; অর্থাৎ যে যে কাজের জন্য উপযুক্ত তাকে ঠিক সেই কাজটি করতে দেয়াই উচিত। অবশ্য তিনি নাগরিকদের একেবারে ঈশ্বরিক কৃপার উপর ছেড়ে দিতে নারাজ। তাদের যোগ্য দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবার জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আরোপ করেন। তৈরি করেন শিক্ষার কয়েকটি স্তর। শিক্ষার এই স্তরগুলো অতিক্রম করেই শুধুমাত্র একজন নাগরিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নিত হতে পারবেন। রাষ্ট্রের শাসকদের দার্শনিক হবার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যখন শাসকগণ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, তারা হবেন দার্শনিক তখন রাষ্ট্রের পরিচালনায় আপাত অসামঞ্জস্যগুলো আর থাকবে না, রাষ্ট্র সুচারুভাবে পরিচালিত হবে। জ্ঞানতত্তে¡র আলোচনায় যে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার যাত্রা-শুরু, দার্শনিক শাসনে তার হবে অবসান।
আর আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যুক্তিসম্মত, গ্রাহ্য, পাঠক বোধগম্যতার সিমার মধ্যে আনতে নানা উপমা, রূপক, তৎসময়ের বিভিন্ন দৃষ্টান্তের সাহায্য নেন। কর্মের বা শ্রমের বিভাজনের ভিত্তিতে যে আদর্শ রাষ্ট্র সেখানে শ্রমিক শ্রমের কাজ করবেন, সৈনিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিণ প্রতিরক্ষায় এবং দার্শনিক শাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। অর্থাৎ পূর্ব নির্ধারিত কর্মের শ্রমবিভাজনের মাধ্যমেই এসব সম্পাদিত হবে। তা নির্ধারিত হবে রাষ্ট্রের কতগুলো মৌলিক নীতির ভিত্তিতে। আদর্শ রাষ্ট্রের অনিবার্য বাস্তবতার কারণেই সেখানে কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষপাতি তিনি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের তাদের মানসকাঠামো ঠিক রাখার স্বার্থে তাদের জন্য যা দরকারি শুধুমাত্র সেসব বিষয়ে তাদের জানতে দেয়া হবে। অনিবার্যভাবে তাই শিল্পকলার কতিপয় ক্ষেত্রে তিনি আরোপ করেন নিষেধাজ্ঞা। গান, কবিতা, নাটক হবে শুধুমাত্র নাগরিকদের স্বার্থের পক্ষে, অর্থাৎ তাদের এমন কোনো গান, কবিতা বা নাটক শুনতে/ দেখতে দেয়া যাবে না যাতে তাদের চিত্তবিকার ঘটে। নৈতিকতাকে উন্নত করে এমন গান, কবিতা, নাটক শুনতে/ দেখতে দিতে অবশ্য প্লেটোর আপত্তি নেই। আর এখানেই তিনি কবি/ শিল্পিদের অবাধ যাতায়াতকে সিমিত করে ফেলেন।
আমাদের মনে হয়েছে, একরৈখিকভাবে দেখলে রাষ্ট্রে কবি/ শিল্পিদের নির্বাসন প্লেটোর মতো একজন প্রাজ্ঞ প্রগতিশিল দার্শনিকের কাছ থেকে কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু তিনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির অবতারণা করেছেন সেটি সূ² পর্যালোচনা করলে আপত্তি কিছুটা কমে আসে। পূর্বেই বলেছি প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাজিয়েছেন কর্মের উপর ভিত্তি করে। সেখানে নানা কর্মজীবী ঘরানার লোক থাকবে, তারা যার যার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন, অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে। অন্যভাবে বললে স্থিরিকৃত শ্রেণিসমাজে এক পদবির বা শ্রমের লোক অন্যের কাজে নাক গলাবেন না। প্লেটোর ধারণা যে ভালো জুতো তৈরি করতে সক্ষম সে তার জুতোর তত্ত্বতালাশ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন। যিনি ভালো নকশা করতে পারেন নকশা সম্পর্কিত আলোচনার দায়দায়িত্ব তারই। অর্থাৎ যে যে কাজের জন্য উপযুক্ত তিনি ঠিক সেই কাজটি সম্পাদন করবেন। যে যে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তারই নৈতিক অধিকার সেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহে দেখা যায় যিনি যে বিষয়টি জানেন না তিনি সেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। টিভি টকশো, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের পাতায় সারগর্ভ আলোচনা করছেন। কৃষি নিয়ে যিনি দক্ষতা অর্জন করেছেন, পড়াশোনা করেছেন তার অধিকার কৃষি নিয়ে বলার। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় কৃষি নিয়ে যিনি দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি হয়তো কথা বলছেন রাষ্ট্রে সড়কব্যবস্থা নিয়ে। প্লেটোর মতে যা একেবারেই অনুচিত। আমাদের দেশে তো বিষয়টি লেজেগোবরে। হামেশাই দেখা যায় যিনি যোগ্য নন তিনিও ঠিক সেই বিষয়টি নিয়ে নসিহত খয়রাত করছেন কোনো ধরনের পড়াশোনা ছাড়াই। পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া সেই অনভিপ্রেত ব্যক্তির কথাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, ভালো কাভারেজ দিচ্ছে, যিনি হয়তো ভালো অভিনেতা। অভিনয়ে দক্ষতা তার আছে নিঃসন্দেহে, প্লেটোর ভাষায় বলতে হয়, ওহে অভিনেতাপ্রবর আপনার অভিনয়-দক্ষতা অতিশয় মনোহর, কিন্তু আপনাকে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি রাষ্ট্র-ব্যাপারে আপনার কথা বলার অধিকার তাতে জন্মায় নি, এ বিষয়ে রাজনীতি যিনি করেন, সন্দেহাতিতভাবে যার দক্ষতা অর্জিত হয়েছে সে বিষয়ে তাকেই কথা বলতে দেয়া উচিত। শুনতে যতোই খারাপ শোনাক প্লেটোর কথার মূলে প্রবেশ করলে বিষয়টিকে একেবারে গুরুত্বহীন ভাবার কারণ থাকে না। যার যে বিষয়ে দক্ষতা তাকে সেই বিষয়ে কথা বলতে দিতে হবে।
আবার শিল্পির নির্দেশিত অভিযাত্রাকে মূল থেকে তিন প্রস্থ দূরের বিষয় বলে মনে করেন তিনি। শিল্পির মনোলোক মূল থেকে তিন প্রস্থ তফাতে বলে তার ধারণা। কারণ শিল্পি যে বিষয় নিয়ে লেখেন বা বলেন তা অনুকরণের অনুকরণ। শিল্পি একটি বিড়ালের চিত্র অংকন করলেন, অথবা একজন কবি বিড়াল নিয়ে একটি কবিতা লিখলেন। তখন কবি/শিল্পি একটি বিড়াল কল্পনায় আরেকটি বিড়ালের প্রতিরূপ তৈরি করলেন। আসলে এই বিড়ালটির অস্তিত্ব কোথায়? প্লেটো এখানে চমৎকার দৃষ্টান্ত টানেন। তাহলে এই বিড়ালটি কি অন্য কোথাও অস্তিত্বশিল ছিলো? যখন একজন কাঠমিস্ত্রি একটি টেবিল তৈরি করেন সেই টেবিলটি তার মনে ছিল, নতুবা তিনি টেবিলটি পুনরুৎপাদন করতে পারতেন না। কিন্তু টেবিলটি তার নির্মাণের পূর্বে কোথায় ছিলো? সেটি কি অন্যকোথাও ছিল যেখান থেকে কাঠমিস্ত্রি তাকে পুনআবিষ্কার করেন?
প্লেটো একটি গুহারূপকের উদাহরণ দেন। জ্ঞানতত্তে¡র ক্ষেত্রে রূপকটি মূল্যবান। একটি গুহায় কতিপয় বন্দি রয়েছে যাদের পিঠ পেছন করে বাঁধা। তাদের সামনে একটি দেয়াল রয়েছে। দেয়ালগাত্রে পেছন দিয়ে যাতায়াতকারি একটি রাস্তার প্রতিচিত্র প্রতিফলিত হয়। বন্দিরা সেই দেয়ালে প্রতিফলিত চিত্রগুলোকেই আসল মনে করে। দৈবাৎ সেই গুহা থেকে একজন বন্দি উপরে আসার সুযোগ পেলো। বাইরের চাকচিক্যময় রৌদ্রে প্রথমে তার চোখ ঝলসে গেলেও পরক্ষণে সে স্থিতু হবে এবং ভাববার অবকাশে পাবে, সে বুঝতে পারবে এতোদিন সে যা দেখে এসেছে তা ছিল উপরের আসলের ছায়াই যা সে ওই দেয়ালগাত্রে প্রতিফলিত হতে দেখেছে। সে যদি পুনরায় সেই অন্ধকার গুহায় ফিরে আসে তখন সে উপরে যা দেখে এসেছে-আলোকিত দুনিয়া, তার কারণে অন্ধকার গুহার দেয়ালগাত্রে প্রতিফলিত প্রতিচ্ছবিকে কিছুতেই স্বিকার করবে না। তার ভ্রম কেটে যাবে। রাষ্ট্রিয় দুনিয়ায় আমরা অনেক আলো ঝলমলে ভ্রমের মাঝে ডুবে থাকি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমরা বুঝতেই পারি না আসলে সেগুলো মরিচিকা, আসল নয়। প্লেটো কবি-শিল্পিদের উপর সোয়ার হয়ে ভ্রান্তির এই দিকগুলো চৌকস অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোকন করে রাষ্ট্রিয় স্বেচ্ছাচারিতার মূলোৎপাটন করতে চেয়েছেন। হয়তো কিছুটা সক্ষমও হয়েছেন; নানা সমালোচনা সত্ত্বেও।
বেনজামিন ফ্যারিংটন মনে করেন: ‘প্লেটো, বিকশিত গ্রিক মননের দায়িত্বপূর্ণতা এবং বিজ্ঞতার যথার্থ প্রতিনিধি এমন বলা চলে না। প্লেটো অবশ্যই বিরাট ধি-শক্তি এবং সৃজনক্ষমতার অধিকারি ছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এসকাইলাস, হিপোক্রাটিস এবং থুসিডাইডিসের ন্যায় বিরাট ব্যক্তিদের মননের উচ্চস্তরে প্লেটোর স্থান নির্দিষ্ট করা চলে না। গ্রিক দর্শন তথা গ্রিক মননের ক্ষেত্রে প্লেটোকে আমরা আয়োনিয় মুক্তবুদ্ধির বিরুদ্ধে দাসদের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সংকির্ণতাবাদি ধ্বংসোন্মুখ নগররাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির স্বার্থে একটি রাজনীতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। হোমারের কাব্য, আয়োনিয় প্রকৃতি-দর্শন এবং এথেন্সের নাট্যকলা অর্থাৎ গ্রিক সংস্কৃতির সবচেয়ে মূল্যবান যে সম্পদ, প্লেটো আমরণ সংগ্রাম করেছেন তার বিরুদ্ধে, তার পূর্ণতার বিকাশের জন্য নয়। … প্লেটোর দর্শন হচ্ছে সবরকম উদারনীতির ভাবধারার উপর ইতিহাসে দৃষ্ট সবচেয়ে নির্মম এবং সবচেয়ে গভির আক্রমণ। প্রগতিশিল ভাবনাসূত্র বলতে যা-কিছুই বোঝাক-না কেন এবং আদর্শ হিসেবে এমন চিন্তার আরাধ্য যাই হোক-না কেন সবকিছুই প্লেটোর দর্শন নস্যাৎ করার লক্ষ্যে উদ্যত। প্লেটোর নিকট সাম্য, স্বাধিনতা, স্ব-শাসন-সবই আবেগতাড়িত আদর্শবাদি অবাস্তব মরিচিকা বই আর কিছু নয়।’ এই অভিযোগগুলো প্লেটোর উপর আরোপ করা যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করলে, বাস্তব সমস্যা বিবেচনায় আনলে অভিযোগগুলোকে অসার মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে আদর্শ রাষ্ট্রের পুরোটা বাস্তবায়ন হয়তো অসম্ভব, কিন্তু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রিয় অনুসিদ্ধান্ত এখান থেকে নেয়া যায় অনায়াসে, আর আড়াইশো বছরের বেশি সময় ধরে চিন্তকগণ নানাভাবেই রাষ্ট্রিয় ব্যাপারে তার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন দ্বিধা ছাড়াই। কবি বা শিল্পিদের নির্বাসনের প্রকৃত শারিরিক বিষয়টি বাদ দিয়ে যদি বিষয়টিকে বিবেচনায় আনা হয়, দেখা হয় যোগ্যতা-দক্ষতা অর্থাৎ যিনি যে বিষয়ে দক্ষ তাকে সে বিষয়ে বলবার দেখবার সম্ভাবনা থেকে তাহলে আপাত এই বিরোধ থেকে সম্ভবত প্লেটোকে অব্যাহতি দেয়া যায়। আর বিষয়টিকে সেভাবে ভাবতে বিবেচনায় নিতেই অধিকতর আগ্রহি আমি।