শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা করি না আমরা। ‘চারবাক’ বরাবরই রাজনৈতিক চেতনা বিশ্লেষী কাগজ। বিপ্রতীপ চিন্তার কাগজ। দেশজ আকাক্সক্ষার সাথে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে নিজস্ব অবস্থানে বোধ ও বোধির সংশ্লেষ ঘটাতে আগ্রহী আমরা। অস্থির সময়ের নির্বাক দর্শক হতে পারি না। রক্তক্ষরণ, ক্লেদ, জুগুপ্সা, একাকিত্বের অদ্ভুত পুঁজিবাদী সভ্যতায় স্নাত মনন ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও বাঁশি বাজাতে চায়। পুঁজির ক্রমস্ফীতি লক্ষ করে বেকন বলেছিলেন, জ্ঞানই শক্তি। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তিনি জ্ঞানের শক্তি যার হাতে আগামী পৃথিবী হবে তাদেরই করায়ত্ব। অপরদিকে গ্রীক দার্শনিক বলেছিলেন, মানুষই সবকিছু নির্ণয়ের মাপকাঠি। তো মানুষ ও জ্ঞানের পরম্পরা, মানুষের উপর মানুষের পুঁজিবাদী বলাৎকার সহজভাবে নিতে পারিনি, বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছি। ‘চারবাক’ প্রকাশের আগেও আমাদের আরো কয়েকটি কাগজ ছিল। ‘অঙ্গিকার’, ‘তরুণকণ্ঠ’, ‘নান্দী’, বুলেটিন ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’। পরবর্তীতে প্রকাশ করছি ‘অযান্ত্রিক’, ‘সরলরেখা’। সবগুলো কাগজই প্রকাশিত হচ্ছে মূলত সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’ অথবা আমাদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘জনঅধিকার আন্দোলন’কে কেন্দ্র করেই। আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’ ২৪ বছরে পদার্পণ করলো। এই দীর্ঘসময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক যে বিষয়গুলো নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, তর্ক-বিতর্ক, আপত্তি-অনুরাগ অর্থাৎ পাঠচক্রে যে বিষয়গুলো আলোচনা করেছি তার একটি প্রকাশনারূপ দেয়ার তাগিদেই। সেই তাগিদ থেকেই সংখ্যাগুলোর প্রকাশ।
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় শক্তি-ভারসাম্য নানা কারণেই বিপর্যস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত। মানবিক মূল্যবোধ ক্ষয়প্রাপ্ত। রক্তনেশার উন্মাদনা মানুষকে পেয়ে বসেছে, ছলচাতুরী, আগ্রাসন, অস্ত্র-পেশির সীমাহীন বিস্তারে বিবেকের ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটছে অবিশ্বাস্য ক্ষীপ্রতায়। এতো গেল মানবিক বিপর্যয়। অন্যদিকে পুঁজির সীমাহীন লাম্পট্য ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে একক, নিঃসঙ্গ করছে। রুদ্রপ্রলয় তান্ডবে ব্যতিব্যস্ত রাখছে। এরজন্য নানা ভোগের আয়োজন মহাসমারোহ চলছে উৎসবের মেজাজেই। কর্পোরেট পুঁজির অঢেল প্রাচুর্য বিস্তার ছড়িয়ে দেয়া অর্থ, মেধা, শ্রম কাজে লাগছে ভালোভাবেই। আকাশসংস্কৃতিকে তাবে রাখতে যেমন আকাশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে অন্তর্জাল, ভূ-উপগ্রহ প্রযুক্তিকে কব্জা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে প্রযুক্তিগত ফাঁস, নানা কায়দা কৌশলে মুদ্রণ-তথ্য-কম্পিউটারকে কাজে লাগানো যাচ্ছে। ছাপার হরফে মানুষের বিশ্বাস-আস্থা দীর্ঘকালীন। ইন্টারনেট, রেডিও, টিভি চ্যানেল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক কর্পোরেট-পুঁজির প্রচারের ভূমিকায় সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। কর্পোরেট পুঁজির প্রধান বিষয়ই ভোক্তা। সম্মানিত ভোক্তাকে ঠঁকাতে, আরেকটু ভদ্রভাবে বললে গছিয়ে দিতে চেষ্টা চলে নিরন্তর। প্রচার প্রচারণা গুণে আশাব্যঞ্জক সাড়াও মেলে। পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে উন্নতবিশ্বের খেতাবে তৃতীয়বিশ্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী এইসব দেশগুলোর উপর শ্যেনদৃষ্টি সেতো অনেকদিনের। পশ্চিমা দেশগুলো কখনো কৌশলে, কখনো সভ্যতার দোহাইয়ে, কখনোবা স্রেফ মারণাস্ত্রের সাহায্যে দখল-লুণ্ঠন সম্পদের পাচার আকছার ঘটনা। সাম্প্রতিক উদাহরণ কম নয়। তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে যেমন বোমা-গুলি খেতে হচ্ছে, তেমনি হত্যা করা হচ্ছে শিশু-নর-নারী। ধ্বংস করা হচ্ছে প্রকৃতি, বিশাল প্রাকৃতিক ভান্ডার। জিনতত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান স্ফীতির কথা বলে বীজভান্ডার এরই মাঝে তুলে দেয়া হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তেল-গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়েতো নাটকের খামতি নেই। এখেলায় নট যেমন শাসকশ্রেণি, তেমনি শাসনক্ষমতার বাইরে আছেন যারা তারাও। বোমার আঘাতে নিঃস্ব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন সভ্য জনপদ। বিশ্বনাগরিক হিসেবে আপনি চাইলেও এখেলা থেকে রেহাই পাবেন না। কোনো-না-কোনোভাবে আপনাকে এখেলার অংশবাক হয়ে যেতে হচ্ছে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন মানবসভ্যতার জন্য সীমাহীন ক্ষতি। শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির কারণে নয়, অন্য কারণেও। বৈশ্বিক শক্তিসাম্য নষ্ট হওয়ায় একক শক্তির কবলে পড়ে গেছি আমরা। বিশ্ব এখন একক নির্দেশে বাঁদর নাচ নাচছে। এতদঅঞ্চলের দেশগুলো দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ভাবনা-চিন্তা-মনন-শিক্ষায় উপনিবেশিক প্রভাব রয়ে গেছে এখনো। প্রত্যক্ষ পরাধীনতা হয়তো এখন নেই, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাশক্তির দাপট আধিপত্য রয়ে গেছে। স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরেও আমরা অনেককিছুতেই এখনো নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারিনি। চিন্তাচেতনা কর্ম ভাবনা প্রয়োগে। শেকড় সন্ধানে আমাদের প্রত্নখনন আরাধনা চলছে অনেকটা নিরবেই। ‘চারবাক’ এইসব বিষয় নিয়ে ভাবে, দেশজ নিজস্বতা তুলে আনে।
প্রকাশিত সংখ্যার বিষয়: ‘আত্মা ও অস্তিত্বসংকট’, ‘উত্তর-ঔপনিবেশিকতা: তথ্য ও শৃঙ্খল মুক্তির দায়’, ‘রাষ্ট্র, সরকার ও সুশীলসমাজ’, ‘বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা, বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধিজীবীর দায়’, টিপাইমুখ বাঁধ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ কিংবা ক্রসফায়ার, ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকান্ড, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা ইরাক আফগানিস্তান তথা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অথবা ‘ভাষা, বিশ্বায়ন ও ক্ষমতা’, ‘কবির নির্বাসন অথবা প্লেটোর আদর্শ। রাষ্ট্র’, ‘যুদ্ধবিরোধী কবিতা’। চলমান বৈশ্বিক/আভ্যন্তরীণ রাজনীতিও গুরুত্ব পেয়েছে। এটা একটা দীর্ঘভ্রমণ। সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসী শক্তি গোষ্ঠি চিহ্নিত করার তাগিদ, তাগিদ উত্তর-উপনিবেশিক সময়ে দাঁড়িয়ে উপনিবেশিক কলঙ্কগুলো উন্মোচন করার সরল আকাঙ্ক্ষা। একটা নৈতিক দায়িত্বও। জাতি হিসেবে নিজেদের চিনবার জানাবার প্রয়োজনও। কবিতা গল্প অনুবাদ সাক্ষাৎকারও চারবাক প্রকাশ করেছে। আরেকটি কথা নতুনদের আগমন। প্রতি সংখ্যায়ই নতুন নতুন লেখক যোগ দিয়েছেন। অনেকের প্রথম লেখা ‘চারবাক’ ছেপেছে গুরুত্ব দিয়ে। এটাও ‘চারবাক’ এর একটি লক্ষ, নতুনের অনুসন্ধান। ফলে ‘চারবাক’ এ অনেক দুর্বল লেখাও প্রকাশ করতে হয়েছে। আসলে ‘চারবাক’ লেখার বিষয়টাকেই গুরুত্ব দেয়, লেখক কিংবা শিল্পমান নয়। আমাদের বিশ্বাস উন্নত বলে দাবীদার পরাশক্তির যদি পতন ঘটে তবে তা হবে একমাত্র জ্ঞানকেন্দ্রীক বিপর্যয়ে। ফলে জ্ঞানের চর্চার বিকল্প থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশ জ্ঞানের চর্চায় ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি কথা জরুরী অবস্থা চলাকালীন সময়েও চারবাকে কিন্তু আমরা এর বিরোধীতা করেছি। বলবার চেষ্টা করেছি তৃতীয় বা বিকল্প কোন পথ নয় নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়। ‘চারবাক’ গোষ্ঠির কাগজ। চার জন নাহিদ আহসান, মজিব মহমমদ, আরণ্যক টিটো এবং রিসি দলাই বলতে পারেন এর চালিকাশক্তি। প্রতিদিনই এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন চিন্তা তরুণ মনন।
ঢাকায় এসেছি বটে তবে থিতু হয়ে বসা যাকে বলে তেমন হয়নি তখনো। নাগরিক জীবন, কঠিন দেয়াল, তপ্ত উষ্ণতা, যানজট, দুর্গন্ধ অচেনা অচেনা ঠেকে। উন্মুক্ত উদার প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে। কথা বলার কায়দা থমকে যায় আঞ্চলিকতায়। খোয়ারি ভেঙে জেগে থাকা, স্বপ্ন বুনন চলছে সবে। রাত জেগে কবিতার চর্চা হয়। জগন্নাথের কলাভবনের সিঁড়ি নিজস্ব অধিকারে চলে এসেছে যদিও। মধুর কেন্টিনে যাওয়া-আসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সূত্রে ছোট্ট একটি পোস্টারে থমকে যায় চোখ। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের ‘চিন্তার ইতিহাস’ পাঠচক্রের কথা জানতে পারি। চিন্তার ইতিহাস পাঠচক্র কেমন রহস্য রহস্য ঠেকে। নির্দিষ্ট দিনে হাজিরা দেই। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের বারান্দা-ক্যাফে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ, মধুর কেন্টিন, চারুকলা আমাদের নিরাপদ অভয়ারণ্য, ততদিনে বেশ জমিয়ে বসেছি বলা চলে। কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার সুবাদে পরিচয় হয় অনেকের সঙ্গে। নতুন মুখ নতুন স্বপ্ন নতুন আকাক্সক্ষা, দু’একজন লেখক বন্ধুও জুটে যায়। কেউ কেউ আবার নাটক-চলচ্চিত্র বানাবার স্বপ্ননেশায় উন্মাদ। নিজের লেখা অন্যকে শোনানো; কার লেখা হয়নি, কোথায় দুর্বলতা এই সব চলছে আর কি। চমকে দেয়ার মতো শব্দ-বাক্যও শুনি, মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে যায়। আমাদের কেউ কেউ রোমান্টিক, কেউবা অতিমাত্রায় বিপ্লবী। পাল্টে দেবার স্বপ্ন বিশ্বাসে রঙিন, ভরপুর। ঠিক হয় নিজেদের লেখা, বিশ্বসাহিত্যের সেরা বই নিয়ে একটি পাঠচক্র করার। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ নির্ভার মিলনকেন্দ্র। কিছুদিন পাঠচক্র চলার পর মনে হলো একটি কাগজ করা দরকার, নিজেদের মুখপত্র, প্রয়োজনও। আত্মপ্রকাশের উদগ্র আকাক্সক্ষাও হয়তো কাজ করেছে শেষাবধি। ‘নান্দী’ সাতজনের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়। ৩ সংখ্যা মাত্র। এগোয়নি, অনেক ব্যর্থতা অপূর্ণতার সহযোগ। বন্ধু মজিব মহমমদ প্রস্তাব করে ভিন্ন নামে আরেকটি কাগজের। তখনো জানতাম না কিভাবে অর্থ পাব। পাঠচক্র চালিয়ে যাবার পক্ষপাতি ছিলাম আমি। সিদ্ধান্ত হলো পাঠচক্র ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’ নামে চলবে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টায়। সেই থেকে চলছে, ২৩ বছর হলো। ভাবলে অবাক লাগে। নতুন কাগজের নাম, লেখক, বিষয় নিয়ে আলোচনা হরদম। কে কোন বিষয় লিখবে, কাকে কাকে রাখা যায় এইসবও। প্রস্তাব আসে প্রথম বুদ্ধিবাদী দার্শনিক স¤প্রদায় চার্বাক এর নামে পত্রিকা করার। নাহিদ আহসান, আরণ্যক টিটো যুক্ত হয় আরো কিছুদিন পর। শুরুতে চারজন হওয়ায় চার্বাক বানানটা একটু পরিবর্তন করে ‘চারবাক’ নামে পত্রিকার নাম ঠিক হয়। নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতায় আগ্রহ ছিল আমার, আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজস্বতা বিনির্মাণের, স্বতন্ত্র পরিকাঠামোয় চিহ্নিত, সময়ের কণ্ঠস্বর ধারণে। ২১ বছরে ১৬ সংখ্যা বের হয়েছে ‘চারবাক’ এর। একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে ১০বছরের প্রকাশিত সংখ্যা থেকে বাছাই লেখা নিয়ে বের হয়েছে ‘নির্বাচিত চারবাক’।
‘নির্বাচিত চারবাক’ এর সম্পাদকীয় থেকে একটি প্যারা টুকে নেয়া যাক: ‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউর মতো সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভু হয়ে বসেছে, ঋণের বোঝা বাড়ছে তো বাড়ছেই। বিশ্বায়ন গোলোকায়নের ধাঁধায় নিঃস্ব মধ্যবিত্ত। প্রকৃতি, প্রকৃতির সবুজ, বীজ, গাছ-গাছড়া পেটেন্ট রসায়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে অবাধ অবারিত মুক্ত প্রকৃতির মালিক বনে যাচ্ছে রাতারাতি চিহ্নিত বহুজাতিক কোম্পানি। চিরচেনা সবুজ, প্রকৃতি, লালিত স্বপ্ন ফিরিয়ে আনতে হয়ত একদিন ধর্না দিতে হবে এইসব লুটেরাদের কাছে। শত বছরের ঐতিহ্য কৃষি ধ্বংস করা হচ্ছে জিন প্রযুক্তির দোহাইয়ে। উন্নত চাষ, অধিক ফলনের লোভে হারিয়ে যাচ্ছে বিশাল বিজভান্ডার। কৃষি, গাছগাছড়া, প্রাণ ও প্রাণিকুল, নারীর জরায়ু, ডিম, পুরুষের বীর্য মুনাফা কামানোর হাতিয়ার। পুঁজি ক্রমশ চেপে বসছে, বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের উপর; স্বপ্ন উসকে দিয়ে আকাক্সক্ষা ও চাহিদা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অস্পষ্ট, ধ্রুব, আপোসকামী সত্তা অজান্তেই তৈরি হচ্ছে। বহুজাতিক পণ্যায়ন, আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদের নীল-থাবায় সবকিছু এলোমেলো, অসংলগ্ন, আত্মবিনাশক। জীবনযাপনের নিয়ন্ত্রক শক্তি বাড়ছে, অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা মানুষ বিভ্রান্ত, বাস্তুচ্যুত, চিন্তাশূন্য, অথর্ব, জড়। হয়ে পড়ছে কর্পোরেট নিয়মের অধীন। পুঁজির অসম বিকাশ, কর্পোরেট সময়ের নীল থাবায় দাঁড়িয়ে চিহ্নায়ন সম্ভব নয় আসল লড়াই কোথায়, কার বিরুদ্ধে। সস্তা আজগুবী কেচ্ছাকাহিনীসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র-পুঁথি-বইয়ের মাধ্যমে যা করা গেছে, বাঁধ দিতে পারিনি আমরা তাতেও। আধুনিকতার নামে, মিডিয়া ভেল্কিবাজির তোপে-প্রভাবে, প্রতিদিনের মস্তিষ্ক ধোলাই কর্পোরেট পুঁজিবাদীপ্রকল্প শৃঙ্খলে শৃঙ্খলায়িত মানুষের মুক্তিকাক্সক্ষা-মুক্তিস্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। শ্রেণি-সংগ্রাম শ্রেণি-লড়াই যেমন তেমনি পুঁজির অসম বহুজাতিক আগ্রাসন, উত্তর-উপনিবেশিককালেও বর্তমান, উপনিবেশিকতার মায়া অথবা মোহ আজো সমানমাত্রায় ক্রিয়াশীল। আবার, প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট, মানুষের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ফলাবার আকাক্সক্ষা আসলে শুধু ভ্রান্ত-পলিটিক্যাল অর্থনীতি উপজাত নয়। অন্তর্জাল, উন্মুক্ত আকাশসংস্কৃতি, ভোগ মানুষকে গিনিপিগে পরিণত করছে অথবা কৌশলে করানো হচ্ছে, ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নানা উপকরণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সা¤প্রতিক আবিষ্কারগুলোকে সুপরিকল্পিত ও সুচারুভাবে ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবিশ্ব পরিব্যাপ্ত যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে তাতে বিশাল জনসংখ্যার মেরুদন্ডহীন মানসিকতা ও চাহিদাসম্পন্ন এক জনগোষ্ঠি, একক বাজার তৈরি করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। মিডিয়ার আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, ফাস্ট ফুড-এফএম রেডিও-ফেসবুক সংস্কৃতির এই দশকে চিন্তাও ঢেলে সাজাতে হচ্ছে। জরুরি হয়ে পড়েছে পক্ষ প্রতিপক্ষ নির্ধারণ, শত্রু মিত্র চিহ্নিতকরণ।’ সম্পাদকীয় এই অংশটিতে সম্ভবত ‘চারবাক’ এর বৈশিষ্ট্য কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে, লেখার ধরনও। প্রচল স্রোতের বাইরে গিয়ে যারা চিন্তা করেন, অচল ঘূণেধরা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চান তারাই ‘চারবাক’-এর লেখক। ‘চারবাক ইশতেহার ২০১০’ থেকেও জানা যাবে ‘চারবাক’-এর অবস্থান।
লেখকের স্বকীয়তা আছে বলেই তো সে লেখে, অন্য লেখকসত্তার সাথে মিলে যায় না। প্রশ্ন যদি হয় লেখকের লেখায় সম্পাদনা কতটা জরুরী, সেক্ষেত্রে আমি বলব সম্পাদনা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সম্পাদনায় একটি লেখা গুণগত মানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উৎকর্ষতা লাভ করে। সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমি এর বিস্তর প্রমাণ পেয়েছি। লেখক যে দিকগুলো নিয়ে ভাবেননি, অথবা অহেতুক যে প্রসঙ্গগুলোর অবতারণা করলেন সেগুলো তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তিনি সচেতন হন, পাঠক একটি ভাল লেখা পড়ে আনন্দ লাভ করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি এখনো সম্পাদনা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি, যার কারণে ভাল সম্পাদক যেমন নেই, তেমনি বিরল ভাল লেখকও। আরেকটি বিষয় সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত হওয়ার বাসনার অর্থই হলো লেখক প্রত্যাশা করেন তার লেখাটির একটি উত্তম সম্পাদনা। ‘চারবাক’-এ সম্পাদনা ছাড়া কোনো লেখা ছাপা হয় না। ‘চারবাক’-এ প্রকাশিত সকল লেখার দায় সম্পাদকের।
ইতিহাস পাঠ যদিও মুহূর্তের, শুরুর এবং শেষের কয়েকটি পৃষ্ঠা যেখান থেকে বেমালুম গায়েব করে ফেলা হয়। আমি একটু ভিন্নভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতার ৫২ বছর উদ্যাপন করছে। মহাকালের বিবেচনায় ৫২ বছর যেমন খুব বেশি নয়, খুব কমও বলা যাবে না। কচ্ছপ গতিতে হলেও পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। আমার বিশ্বাস যেকোনো পরিবর্তনই রাজনৈতিক, তারপর অর্থনীতি লাগামগুলোকে একটু টেনে ধরে। বাইরের দুনিয়ার একটা প্রভাবতো থাকেই, যেহেতু বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ আগের চাইতে বেড়েছে। যোগ হয়েছে হাওয়াই চ্যানেল, ল্যাপটপ, অন্তর্জাল, ফেসবুক, টুইটার। ছাপাখানার প্রভাবও বেড়েছে। সস্তা শ্রমের শ্রমিক হয়ে যাওয়া কর্মীদের পাঠানো অর্থ জীবন অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। গার্মেন্টস, এনজিও অনেককেই ঘরের বাইরে পা রাখার সাহস জুগিয়েছে। মুঠোফোনে অর্থহীন প্রলাপ কথাবাণিজ্য, এফএম রেডিও অভ্যস্ত জীবনযাত্রাই পাল্টে দিচ্ছে। দীর্ঘসময় কেটেছে বন্দীত্বে, সামরিক শাসনের যাতাকলে। স্বশাসন তথা গণতান্ত্রিক পরিবেশে চিন্তা এতো সেদিনের ঘটনা। স্বভাবতই প্রকাশনা ক্ষেত্রেও এর ছাপ আছে। হাল্কা চটুল উপন্যাস গল্পের যতো কদর চিন্তামূলক সিরিয়াস চর্চায় ততোটাই বিরাগ অনীহা। আশির দশক একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক শিল্পসাহিত্য চিন্তার ইতিহাসে। এসময় চিন্তা চর্চার বেশকিছু সিরিয়াস কাগজ বের হয়। লেখকরা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করার ফুসরত পান। ষাটের দশক ছিল উন্মাদনার, সত্তরের দশক স্বাধীনতার স্বপ্ন আকাক্সক্ষা এবং প্রাপ্তিতে রঙিন। আশিতে এসে আত্মকেন্দ্রিক সত্তা নিজেকে নিয়ে ভাববার ফুসরত পায়। নব্বইয়ে কিছুটা থিতু হয় এবং এই সময়ে পূর্ণতা পাচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। ফলে ভাবনাগুলোও পরিপক্ক হচ্ছে। আরেকটি কথা সামরিক শাসন এবং জরুরি অবস্থাও পিছিয়ে দিয়েছে অনেক। এখন অনেক বিষয়ের বই প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশক তা প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন, যা ক’বছর আগেও সম্ভব ছিল না। বিপ্রতীপ প্রকাশনাগুলোর কারণেই সম্ভব হচ্ছে। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লিখতে যেমন লেখক আগ্রহী হচ্ছেন তেমনি পাঠকও বেড়েছে এসব বইয়ের না হলে প্রকাশনাগুলো হচ্ছে কি করে? আকাঙ্ক্ষা এবং প্রাপ্তিযোগ এভাবেই মেলানোর চেষ্টা আমার, রাজনৈতিক এবং আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে।
‘লিটল ম্যাগাজিন’ চাপিয়ে দেয়া একটি শব্দ, বুদ্ধদেব বসু এই শব্দটি চাপিয়ে দিয়েছেন; অবশ্য স্বজ্ঞানে তিনি এই কুকর্মটি করেছেন কি-না আমার জানা নেই। ছোট কাগজ কিংবা লিটলম্যাগাজিন বলে কিছু নেই, এভাবে ভাবতে পছন্দও করি না। পূর্বসুরিদের অনিচ্ছাকৃত ভুল মাধ্যমটিকে জটিল করে ফেলেছে, বিপর্যস্তও খানিকটা। কথা ও কাজ এবং যাপিত জীবন ও মুভমেন্টে বিস্তর ফারাক ক্ষতির কারণ হয়ে গেছে। অসংলগ্নতাও খানিকটা দায়ী। অবশ্য দীর্ঘদিনের প্রচার প্রচারণায় শব্দটি যদিও বেশ জনপ্রিয়, ফ্যাসানের অংশও বটে এখন। থিয়েটার করা যেমন অনেক নাটককর্মীর হবি, লিটলম্যাগও অনেকটা তাই। সম্ভবত লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে যত বিতর্ক-উত্তাপ-বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে অন্য কোন মাধ্যমে হয়নি। ভুলভাল ব্যাখ্যা, যাপনীয় জীবনের সমস্যা মাধ্যমটিকে আক্রান্ত ও জটিল করে গুলিয়ে ফেলায় এই দৈব উৎপাত। ফ্যাশন তাড়নায় উদ্দীপ্ত কতিপয় উর্বর-মস্তিষ্ক তরুণের উদ্ভ্রান্ততাও দায়ী কমবেশি। আদর্শ ও দর্শনগত দিক মুখ্য না হয়ে প্রধান হয়েছে কতিপয় ব্যক্তিখেয়াল, নিজস্ব উদ্ভাবিত কিছু সস্তা অস্ত্র। ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পক্ষ-প্রতিপক্ষের নির্ণায়ক সূত্র হারিয়ে প্রধান হয়েছে কিছু দুর্বৃত্তশক্তি। প্রতিপক্ষ কে চিহ্নিত করা যায়নি। আবার ছদ্মবেশি লিটলম্যাগওয়ালাদের সংখ্যাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। কোনটি লিটলম্যাগ, কোনটি নয় এমন বিতর্ক যদিও উত্থাপিত হয় হামেশাই। কল্পিত লিটলম্যাগের ছাপানো তালিকাও অহেতুক বিভ্রান্তি উসকে দেয়। পুঁজির অসম বিকাশ দৈত্যায়নের যুগে, আগ্রাসন-সাম্রাজ্যবাদ কর্পোরেট সময়ের নীল থাবার নিচে দাঁড়িয়ে চিহ্নায়ন সম্ভব হয় না এখনো লড়াই আসলে কোন জায়গায়, কার বিরুদ্ধে। সেই একই কথা একই বুলি আওড়ে চলেছি তোতাপাখি লক্ষ-উদ্দেশ্যহীন। অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে অজান্তেই প্রতিপক্ষের হাতে। তরুণমননে সস্তা আজগুবি কেচ্ছাকাহিনীসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র-পুঁথি-বইয়ের মাধ্যমে যা করা গেছে, বাঁধ দিতে পারিনি আমরা তাতেও। প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নিয়ে ভাবনা দীর্ঘদিনের। কাকে প্রতিষ্ঠান বলব, কাকে বলব না তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিরোধিতার সূত্রমুখটি। পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান-ধর্ম, বিবাহ, বিদ্যালয়, মোটাদাগে রাষ্ট্রও। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে আমরা এগুলোকে বোঝাই না। এ প্রসঙ্গে আমি বহুবার বলেছি। পরিষ্কার করেছি আমার অবস্থান। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলে আসলে কিছু নেই, বৃহত্তর অর্থে ধরলে, হয়ও না। প্রচলিত ছকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে যা বোঝায় তার পক্ষে আমি নই। ব্যক্তিও কখনো কখনো প্রতিষ্ঠান হয়ে যেতে পারেন-রবীন্দ্রনাথ। মানুষের ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা ধ্যান ধারণা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জ্ঞান আসলে প্রাতিষ্ঠানিকই বলা চলে খানিকটা। নিশ্চয়তার ধারণার সাথে যার সাদৃশ্য কল্পনা করা যায়। অনিশ্চিত কিছু মানুষ সইতে পারে না। মানুষের গতিমুখ সরল অথবা জটিল যাই হোক প্রতিষ্ঠানমুখীই। তাহলে বিরোধিতা করছি কার, নিজেরই? নিজের অস্তিত্বের বিরোধিতা করা যায় কি? প্রচল সময়ে দাঁড়িয়ে অসংলগ্ন আত্মবিনাশক কর্মকান্ডের বিরোধিতা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় খ্যাতি পেয়ে গেছে। যা কিছু সভ্যতার গতিমুখের বিপরীত তার বিরোধিতাই আমাদের কাম্য। আরেকটি কথা, বুদ্ধবাবুর সময়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তরুণদের আত্মপ্রকাশের পথে। তাঁকে কিছুতেই অতিক্রম করা যাচ্ছিল না। তাই তরুণদের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দরকার ছিল এমন শব্দের যাতে করে আলাদাভাবে মঞ্চে জায়গা করে নেয়া যায়, রবীন্দ্রবিরোধিতার মূল সুরটি খানিকটা একারণেও। বর্তমান সময়ে তরুণদের সামনে এমন কোনো বাঁধা নেই যাকে অতিক্রম করতে হবে। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বা আদর্শও নেই। মঞ্চ প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। যেখান থেকে শুরু করবেন সেটাই প্রথম কাজ হবে। দৃষ্টতাপূর্ণ শোনালেও এটিই সত্য।
অনেক সময় মনে হয়েছে এবার থামার পালা। নিজেদের মধ্যে চিন্তাগত পার্থক্য, দ্বিধা, কখনো সখনো তিক্ততা যে কাজ করেনি তা বলবো না। প্রতিবারই কেউ না কেউ নতুনভাবে হাল ধরেছেন ‘চারবাক’ এর। খুব বড় না হলেও যে কয়জন শুভাকাক্ষী রয়েছেন তাদের অব্যাহত তাগাদা, অনুপ্রেরণা সংখ্যা প্রকাশে বাধ্য করেছে। স্মৃতি হাতরে যখন দেখি এই আড্ডা থেকে অনেকেই তার জীবনের রসদ পেয়েছেন, স্বাতন্ত্র্যের জায়গাটুকু চিহ্নিত করতে পেরেছেন নিছক বন্ধুত্বের স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থকে ত্যাগ করছেন তখন মনে হয় ‘চারবাক’ সঠিক পথেই তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। অনেক অনেক স্বপ্ন ‘চারবাক’ নিয়ে প্রতিদিন রচিত হচ্ছে সেটাই বা কম কিসে? সম্প্রতি চারবাক তার অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করেছে। জয়তু ‘চারবাক’ জয়তু স্বপ্ন। স্বপ্ন দীর্ঘজীবী হউক।