005294
Total Users : 5294
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

গান্ধী বিষয়ক স্বপ্ন জটিলতা

একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর রাতের বিধ্বস্ত স্বপ্নের কথা ভাববার চেষ্টা করে জিহাদুল ইসলাম। কিছুতেই পুরো স্বপ্নটা মনে করতে পারে না। ফলে তার সারাদিন অস্বস্তি হয় এবং কোনো কাজ করতে পারে না।
জিহাদুল ইসলাম অবশ্য তেমন কোনো কাজ করে না। সারাদিন বসে থাকে এবং ভাবে। কী ভাবে তা কেউ জানতে পারে না কারণ সে কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলে না। এবং বললেও তার কথা কেউ বুঝতে পারে না। সন্ধ্যার পর হাজী চিনু মিয়া রোডের মাথায় ছয় তলা বাড়ির চিলেকোঠা থেকে নেমে হেঁটে রিং রোডে উঠে চা খায়। তারপর মনসুরাবাদে ঘুরে ঘুরে দুটো বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে হাজী চিনু মিয়া রোডের মায়ের দোয়া হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিঃশব্দে চিলেকোঠায় ঢুকে পড়ে। তার ঘুমোবার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে প্রায়ই তার ঘরে বাতি জ্বলতে দেখা যায়।
রাতের স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে জিহাদুল ইসলাম আনমনা হয়ে যায় এবং তার
নাস্তার কথা মনে থাকে না। রাতে ফিরবার সময় নিয়ে আসা পাউরুটি আর কলা তার দিকে ম্রিয়মাণ চেয়ে থাকে। স্বপ্নটি আদ্যোপান্ত মনে করা দরকার। না হলে তার স্বস্তি হবে না। কারণ স্বপ্নটি সাধারণ কোনো স্বপ্ন নয়। বহু দিন ধরে এরকম একটি অথবা এর বিপরীত কোনো ন্বপ্ন সে দেখে আসার চেষ্টা করছিল। অথবা এরকম হতে পারে সে কোনো স্বপ্ন দেখতে চায়নি। স্বপ্ন কিংবা বাস্তবতায় কোনো অব্যক্ত কথা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কথাগুলো সে বলে ফেলতে চায় কিন্তু পারে না কারণ যাকে সে কথাগুলো শুনাতে চায় তার কাছে যাবার সাধ্য তার নেই। এরকম না বলতে পারা কথার সংখ্যা প্রচুর হবার কারণে প্রায়শই তার ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলতে দেখা যায়।

২.
দেয়ালে হেলান দিয়ে ডান পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে জিহাদুল ইসলাম। বাম পায়ের তুলনায় অস্বাভাবিক রকমের ক্ষীণকায় পা নিয়ে সে কতকাল চলছে তা সে মনে করতে পারে না। দাদীর কাছে শুনেছিল ছোটোবেলায় কী এক অসুখে তার ডান পা শুকিয়ে যায়। তার পিতা কি তার পা বাঁচানো চেষ্টা করেছিল? বেঁচে থাকলে কথাটি তাকে শুধোনো যেত। প্রশ্ন করা শিখতে পারার আগে মা-বাবা দুইজন কী কারণে এক মাসের ব্যবধানে মরে গিয়েছিল তাও জানে না জিহাদুল ইসলাম। মরে গিয়েছিল নাকি মেরে ফেলা হয়েছিল? জিহাদুল ইসলাম প্রায়ই পিতার রক্তমাখা দেহ দেখে। রক্তাক্ত মুখ নিয়ে পিতা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলতে চায়। বলতে পারে না। অথবা জিহাদুল ইসলাম পিতার কথা বুঝতে পারে না। হয়ত বুঝতে পারে কিন্তু তার কিছু করার থাকে না বলে চুপ করে শুনে যায়। তাদের হয়ত মরে যাবার দরকার ছিল অথবা বেঁচে থাকবার আর কোনো আনন্দ তাদের অবশিষ্ট ছিল না। অথবা অন্য কোনো কারণ যা তার দাদীও জানত না।
তবু সেদিন বিকালে লাঠি ভর দিয়ে মিছিলে যায় জিহাদুল ইসলাম। শ্লোগানে মুখরিত রাজপথে লাঠি ভর দিয়ে এক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আকাশে তুলে দেয়। কিন্তু দুই দিন আগে দেখা স্বপ্নের কথা ভুলতে পারে না সে। মিছিল তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় বটে, অন্যদিনের মতো সে মিছিলে মনোযোগ দিতে পারে না।
জিহাদুল ইসলামকে চিলেকোঠার দরজায় আনমনা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লায়লা জানতে চেয়েছিল, ‘কী হইছে আপনার? আনমনা লাগে?’
‘কিছু না।’
‘কিছু একটা তো হইছে। আমারে কওয়া যায় না?’
‘তোমাকে বললে কী হবে?’
‘বলে দেখেন। লাভ হইতেও তো পারে।’
লাভ হবার কোনা সম্ভাবনা না থাকলেও জিহাদুল ইসলাম কয়েক দিন আগে দেখা মনে করতে না পারা স্বপ্নের কথা লায়লাকে বলে। লায়লা খুব অবাক হয়।
‘আপনের একটা পাও থাইকাও নাই। অহন দেহি মাতাও নাই।’
জিহাদুল ইসলাম জানত লায়লা নামের মাথামোটা মেয়েটা মেজাজ খারাপ করা একটা কথা বলে চলে যাবে। আবার তার মন খারাপ হবে এবং ঘুমোনোর আগ পর্যন্ত তার মন খারাপ করা অবস্থার অবসান হবে না।
মুক্তাঙ্গনে এসে মিছিল শেষ হলে মাইকে অবিরত ঘোষণা করা হতে থাকে: ‘সংগ্রামী বন্ধুগণ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের যে নীলনকশা তৈরি করেছে, বিশ্বের আপামর কৃষক, শ্রমিক এবং মেহনতি জনতা তা বাস্তবায়ন করতে দেবে না। আমরা আজকের এই সমাবেশ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে চাই…’। এর পরের কথাগুলো জিহাদুল ইসলামের কানে প্রবেশ করে না। সে আনমনা হতে হতে কখন যে মুক্তাঙ্গন ছেড়ে চলে আসে নিজেও বুঝতে পারে না। ফুটপাতে কোথাও ইটের সঙ্গে লাঠির ঠোকা লাগলে তার সম্বিৎ ফিরে আসে এবং সে বুঝতে পারে জীবনে এর আগে কোনো স্বপ্ন নিয়ে এতটা ভাবেনি সে। নিজের ভিতর গুটিয়ে থাকা এবং কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাবা তার স্বভাবগত। তবে এইরকমভাবে কখনো সে স্বপ্ন নিয়ে ভাবেনি কারণ স্বপ্ন বিষয়টিকে সে অন্যভাবে জানে। স্বপ্ন-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধান সে ফ্রয়েডের কাছে পেয়ে যায়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড পড়ার আগে স্বপ্ন নিয়ে এরকমভাবে ভাবতে ভাবতে কাবু হয়ে যেত জিহাদুল ইসলাম। কিন্তু সে তো বহু দিন হলো।
রমনায় তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যার পর এখানে এলে জিহাদুল ইসলাম শীত বোধ করে। তার বেশ ক্লান্তিও লাগে। এই ক্লান্তি হয়ত সে দেখেছিল সলিমুল ইসলামের মুখে। সলিমুল ইসলাম তার পিতা। অথবা সে কথনো কিছ্ইু দেখেনি। পিতা কিংবা মায়ের মুখ তার দেখা হয়নি। সে কি দেখতে চেয়েছিল কোনো মুখ? আজ আর কিছু মনে করতে পারে না জিহাদুল ইসলাম। মনে করতে চাইলে তার ভিতরটা কেবল গুলিয়ে ওঠে। রক্তভেজা শরীর সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভ­াদিমির ইলিচ লেনিনের মতো করে দাড়ি রেখেছিল সলিমুল ইসলাম। জেলা সদরের এক কোনায় পড়ে থাকা অন্ধকার এক মুদির দোকানদারের কাছে লেনিন কী করে পৌঁছালেন এখনো তার জবাব খুঁজে পায় না জিহাদুল ইসলাম। নিতান্ত পাড়াগাঁয়ে একদা এক কমরেড এলেন শহর থেকে। বাবার সঙ্গে কয়েক দিন কাটালেন। তারপর চলে গেলেন। এর পর থেকে সলিমুল ইসলাম চায়ের দোকানে আলোচনায় বসতে শুরু করল এবং আড্ডায় এমন কিছু কথা বলা শুরু করল যা নিয়ে বাজারে, মাঠে-ময়দানে এবং মসজিদে আলোচনা হতে লাগল। মসজিদের ইমাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সলিমুল ইসলামের বাড়িতে এসে হাজির হলো। জিহাদুল ইসলামের মা তাদের টুল পেতে বসতে দিল। ইমাম সাহেব কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি বললেন, ‘শোনো মা, তোমার জামাইরে বোঝাও। তার মাথা খারাপ হইয়া গেছে। উল্টাপাল্টা কথা বলতাছে। তারে দীনের পথে নিয়া আসার দায়িত্ব তোমার। পোলা বড় হইতাছে। তার উপরে যেন এইসবের কোনো আছর না লাগে।’
‘আমি বোঝাব।’
‘আমি খুব অবাক হইছি মা। মুসলমানের পোলা হইয়া তুই কেমনে কস কোনো ধর্মে অর্থনৈতিক সুবিচার নাই। অন্য ধর্মে নাই এইডা হাজারবার সত্যি। ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামে সুবিচার নাই! নাউজুবিল­াহ!’
জিহাদুল ইসলামের মা মাথা নীচু করে তাদের কথা শুনে গেল। চেয়ারম্যান বয়স্ক মানুষ। মেয়ের বয়েসি সব মেয়েকে তিনি মা বলেন। এলাকার লোকজন ত্রিশ বছর এই লোকটাকেই চেয়ারম্যান বানায়। তিনি ইমামের কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘আমি একলা তারে কেমনে সামলামু কও তো, মা। এলাকার মানুষ খেপলে আমি তারে কেমনে বাঁচামু? তুমি তারে সামলাও, মা।’
মা বাবাকে বুঝাতে পারেনি। চেয়ারম্যান কিংবা ইমাম তারাও পারেনি। বোঝাতে না পারা অথবা বুঝতে না পারার ফল এই হলো যে শত শত মানুষের বিক্ষুব্ধ হাত সলিমুল ইসলামের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিল। মরবার আগে কী কথা বলেছিল সলিমুল ইসলাম? ‘মানুষের মুক্তির জন্য এই দেশে বিপ্লব আসবে।’ এই একটি বাক্য রক্তাক্ত মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। জগতের অনেক বিষয়ে তখনো জিহাদুল ইসলামের জ্ঞান না জন্মালেও সে এই কথাটি বুঝতে পেরেছিল যে তার পিতা আর বাঁচবে না এবং ‘বিপ্লব’ নামের কোনো বস্তু তিনি কায়মনে কামনা করেছিলেন যা এই মানুষগুলো চায়নি। সুতরাং তাকে মরে যেতে হবে।
জিহাদুল ইসলাম ক্লান্তবোধ করে। সোহরাওয়ার্দির ভিতর এক সময় চমৎকার হাঁটবার জায়গা ছিল। দিনে কিংবা রাতে মানুষ বসে জিরিয়ে নিতে পারত। জাহিদুল ইসলাম কোথাও বসে জিরিয়ে নিতে চাইছিল। শীত প্রায় চলে এসেছে। অগ্রহায়ণ বিদায় নেওয়ার আগে পৃথিবীটাকে এমন ঠাণ্ডা কেন করে দিয়ে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। সিমেন্টের ভাঙ্গা বেঞ্চে বসে নিজের জীবনের পিছনের দিকে আবার ফিরে তাকাবার চেষ্টা করে জাহিদুল ইসলাম। তখন পিছন থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে, ‘যাইবেন নাকি?’ জিহাদুল ইসলামের যাবার প্রয়োজন বোধ হয় না। মানুষের এই জীবনের পশ্চাতের বহু হাহাকার আর বেদনার কথা তার জানা আছে বলে এই নারীর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না সে। তখন তার পিতার রক্তমাখা কণ্ঠের কথা মনে পড়ে: মানুষের মুক্তির জন্য এই দেশে বিপ্লব আসবে।
প্রবল নিঃসঙ্গতা এবং ক্লান্তি নিয়ে জিহাদুল ইসলাম যখন তার চিলেকোঠায় ফিরে আসে তখন পাশের মসজিদে ফজরের আজান শুরু হয়।
৩.
ঠিক সাত দিনের মাথায় ঐ স্বপ্নটি আবার দেখে জিহাদুল ইসলাম।
মহাত্মা গান্ধী তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
গান্ধীজির সামনে বসা জিহাদুল ইসলাম।
‘আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন; কেন জানতে পারি?’
‘তোমার মধ্যে অনেক হতাশা। হতাশাগ্রস্ত মানুষ জীবনে উন্নতি করতে পারে না।’
‘উন্নতি বলতে আপনি যা বোঝেন আমি তা বুঝি না। আমি আপনার মতো করে ভাবি না।’
‘এটাই তো স্বাভাবিক। থাক এসব কথা। যে জন্য তোমাকে ডাকা। তুমি আমাকে খুব অপছন্দ কর। কেন জানতে পারি?’
‘এক কথায় তার জবাব দেওয়া যাবে না। আপনার প্রতি আমার অনেক ক্ষোভ আছে। আমি তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। ডেকে ভালোই করেছেন।’
‘তোমার ক্ষোভের কথাটা বলে ফেল। হালকা লাগবে।’
জিহাদুল ইসলাম কিছু সময় নেয়। সে গুছিয়ে কথাগুলো বলতে চায়। বহুদিন চেপে রাখা কথা আজ প্রকাশ করার সুযোগ এসেছে। সুযোগটি সে নষ্ট করবে না।
‘তুমি সময় নষ্ট করছ। একটু পর আমাকে একটা সভায় যেতে হবে।’
জিহাদুল ইসলাম ইতস্তত করে।
‘আপনি এ অঞ্চলের মানুষের অনেক ক্ষতি করেছেন।’
‘কীভাবে?’
‘প্রথমত, ভারত উপমহাদেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সব ধরনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছেন। বুর্জোয়া পুঁজিপতি আর স্বার্থপর এলিটদের হাতে রাজনীতি তুলে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বাংলার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আপনার জন্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে।’
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে জিহাদুল ইসলামের। দরজা খুলে দেখে বাড়ির মালিক মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। জিহাদুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে, চাচা?’
‘তুমি আজই আমার বাড়ি ছেড়ে দেবে।’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘সব কথা তোমাকে বলতে পারব না। তাছাড়া আমার বাড়ি যে-কোনো সময় ভাড়াটেকে ছেড়ে দিতে বলার অধিকার আমার আছে।’

৪.
পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে জিহাদুল ইসলাম লেনিনের মতো দাড়িওয়ালা পিতার মুখ দেখতে পায়। পিতার মুখ থেকে, সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। টুপটুপ করে লাল রক্ত জিহাদুল ইসলামের শরীরে এসে পড়ে। সে মনে করতে চায় বাড়িওয়ালা কেন তাকে হঠাৎ বাড়ি থেকে বের করে দিল। কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। তবে সন্ধ্যায় চিলেকোঠা থেকে নামবার সময় বাড়ির সামনে কিছু পুলিশের আনাগোনা দেখেছিল।
মাথার কাছে আবার নারীকণ্ঠ শুনতে পায় জিহাদুল ইসলাম: ‘কিছুই বদলায় না। কেবল দিনে দিনে আমাদের দল ভারি হয়।’

শেয়ার করুন: