সাম্রাজ্যবাদ স্বশাসনের ইচ্ছা অথবা কাক্সক্ষা ক্রমশ ফিকে করে দেয়, শক্তি নিঃশেষিত করে তিলে তিলে, আত্মশক্তির প্রতিরোধি মনোভাব লুপ্ত করে দিয়ে মানুষকে করে ফেলে গৃহপালিত অথর্ব, পঙ্গু, স্থবির জড়চিন্তার প্রতিভূ। আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিকসত্তা প্রাধান্য পায় চিন্তায়, প্রচারে, বিবেচনায়। সাংস্কৃতিক-ভাষিক-অঞ্চলভিত্তিক আগ্রাসন আধিপত্যবাদিশক্তির প্রধান হাতিয়ার। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে বেকন ভালভাবেই বুঝেছিলেন জ্ঞানের মাহাত্ম্য। জ্ঞানকেন্দ্রিক আধিপত্য-আগ্রাসন যেকোনো বিবেচনায়ই অধিকতর কার্যকর ফলপ্রসূ। সেই আদিকালে যখন বিশাল নৌবহর নিয়ে বেরিয়ে পড়ত পররাজ্যলোভি সাম্রাজ্যবাদি লুটেরাশক্তি আজকের মতো মসৃণ ছিল না অনেককিছুই। শক্তির প্রদশর্নী লড়াইয়ে আপন বৈভব-অহমিকা পেশিশক্তির দাপট দেখাতে হত, কৌশলে প্রমাণ করতে হত নিজেদের শ্রেষ্ঠয়তা। জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক বিরোধ কি আজকের? বিশ্ববিচিত্রতায় নিজের আধিপত্য-আগ্রাসন টিকিয়ে রাখতে হলে, পদানত করতে হলে অন্যজাতিকে নিজেদের চেয়ে একধাপ উপরে তুলে ধরে প্রমাণ করতে না পারলে চলে? বিচিত্র সভ্যতার লীলাভূমি এশিয়া-আফ্রিকা সাম্রাজ্যবাদি প্রচারণায় অসভ্য বর্বর জাতির তকমা কপালে সেঁটে দিয়ে মননে দুর্বল করে দেবার প্রচেষ্টা চলে তাই। তবে প্রতিরোধ যে হয়নি এমনটি নয়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদি প্রচার-মাহাত্ম্য প্রচার-দর্শনে সুবিধা করতে পারেনি বরাবর। বিচিত্র নামে বিচিত্রভাবে সাম্রাজ্যবাদি শক্তি তৎপর, উন্নয়ন কখনো বিশ্বায়ন তকমা কপালে সেঁটে দিয়ে চলে এর প্রচার।
বিশ্বায়নে উদারিকরণ ও বেসরকারিকরণ শব্দদ্বয় গেঁথে দেয়া হয় শর্ত হিসেবে। যদিও বিশ্ববাণিজ্য এক প্রাচীন প্রথা, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদি উপনিবেশের যুগে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাণিজ্যিক শোষণ। অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাড়াতে দরকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগবস্তুর চাহিদা সৃষ্টি। দরকার মাস মিডিয়ার মনোলোভা বিজ্ঞাপন ক্যারিশমা, জোরাল প্রচার, ফলে সহজেই আকৃষ্ট হয় ভোক্তা। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে মুক্ত-অবারিত-অবাধ আকাশ বন্ধ করবার হাতিয়ার মালমসলা জানা নেই আমাদের। হাজার চ্যানেল হাজারভাবে আকাশে ভাসমান, দৃশ্যমান-সন্তরণরত। একেবারে হেঁসেলে সেঁধিয়েছে। গৃহিনিরা এমনভাবে মজেছেন যে স্বামি-সংসার, সন্তানও গুরুত্বহীন এখন। নির্ভরশিলতা বাড়ছে। হেরে যাচ্ছি অদ্ভুত এই সংস্কৃতির কাছে, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আমাদের আত্মা। বিজ্ঞাপনি চমক, বাণিজ্যের কাছে আমরা অসহায়। পণ্য আমাদের মন, হৃদয়, বেঁচে থাকাকে হরণ করেছে সুকৌশলে। মানুষ পণ্য, নারী পণ্য। পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছি ক্রমশ। ভৌগোলিক সীমানা বাড়ছে। সত্যি বলতে কি সীমানাটাই আর থাকছে না। বিশ্ব-নাগরিক হয়ে ওঠবার সাথে সাথে বাড়ছে বিশ্ব-আপদ। রাষ্ট্র-সরকার থেকেও শক্তিশালি তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ। আইবিএম-মাইক্রোসফট আজকে ঈশ্বরের জায়গায়। স্বীকার করতে বাধা নেই, ইন্টারনেট তথা তথ্য-প্রযুক্তি আয়েশ বাড়ানোর সাথে সাথে যোগাযোগ সহজ সাবলিল করে দিয়ে বন্ধুত্বের সীমানাও বাড়িয়ে দিয়েছে অবিশ্বাস্য রকম। ভোগপণ্যের অবাধ ব্যবহার প্রচার-প্রসারের ফলে মানুষ অবচেতনভাবেই ভোগবাদি চিন্তায় নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। ব্যক্তিক আরাম-রুচি-আয়েসকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ভোগবাদি সংস্কৃতির ক্রমশ বিস্তার ঘটছে তথাকথিত উন্নয়নের নামে। সস্তা আমোদ মোহে নিমজ্জিত হচ্ছি, আর তা করা হচ্ছে সুকৌশলে। ব্যক্তিকে যদি একক সত্তায় রূপান্তরিত করা যায়, বন্দি করে ফেলা যায় স্বেচ্ছা-বলয় কাঠামোর মধ্যে, তবে অনেক কিছুই সহজে সমাধা সম্ভব, তাতে বিপ্লবের সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়।
আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদি সংস্কৃতিতে মানুষ পরিণত হয় গিনিপিগে, করা হয়। চিন্তার জগৎ নামিয়ে আনা হয় শূন্যে, অভ্যস্ত করে ফেলা হয় অন্যের
চিন্তাচেতনাকে নিজের করে ভাবতে। চাপিয়ে দেয়া চিন্তাভার বহন করে চলে মানুষ। আকাশসংস্কৃতির গোলক ধাঁধা, মিডিয়া প্রচারণার কাছে সে হয়ে পড়ে অসহায়, অনেক সময় বুঝতেই পারে না কখন পাল্টে গেছে, বদলে গেছে চিরচেনা অভ্যস্ততায়।
উত্তর-ঔপনিবেশিককালে মানুষকে বদলাবার কায়দাকানুন ভালই রপ্ত করে নিয়েছে বহুজাতিক কর্পোরেট হাউজ, ম্যালাধরনের মালমসলা উপাচার সমাবেশ ঘটাচ্ছে তারা; নিত্যনতুন চমক, বিজ্ঞাপনচিত্রে নধরশরীরি আমেজ এত আকছার। বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেয়া অন্তর্জাল (ইন্টারনেট) জীবন সহজিকরণের সাথে সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক, যোগাযোগব্যবস্থাকে অভাবনিয় মাত্রা দিয়েছে; কম্পিউটারের এক কমান্ডে একক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে আইবিএম-মাইক্রোসফট কোম্পানি।
তেল-গ্যাস চুক্তি: সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশিল সিদ্ধান্ত নিতে হবে
পৃথিবীব্যাপি বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবিস্তারের কাহিনি পুরোনো। কথিত উন্নয়নশিল ও তৃতীয়বিশ্ব বলে চাপিয়ে দেয়া দেশের ওপর নানা উপলক্ষেই সরব তারা, সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে, কখনো উন্নয়নের নামে। এর জন্য রয়েছে নানা ধান্দা, নানা দেনদরবার। এদের প্রচার প্রচারণায় মনে হবে তেল-গ্যাস নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়ে গেছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোই সত্যিকারের ত্রাণকর্তা। আবার, বিনিয়োগের নামে চলে তেলেসমাতি খেইল! সত্য এই, শিল্প-কলকারখানায় বিনিয়োগ হয়নি, বিনিয়োগের নামে ঋণ হয়েছে রাস্তা নির্মাণে, বেহুদা আলাপে পকেট ফাঁকার অপূর্ব কৌশল মোবাইলে কোটি কোটি টাকা লগ্নি হয়েছে, আর হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হচ্ছে বিদেশে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অক্সিডেন্টাল, শেল, কেয়ার্ন, নাইকো, ইউনিকোল নামের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তেল-গ্যাস নিয়ে ছেলে-খেলা করেছে, চুক্তির মারপ্যাঁচে লুটে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলার, লুটপাটের দোসর-সঙ্গি হিসেবে এদেশিয় কিছু দালালও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় তারা।
ছোট্ট একটি উদাহরণ বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। অক্সিডেন্টালের সাথে সরকার চুক্তি করে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি। চুক্তির শর্তে উলেখ ছিল গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে তার ৭৭.৫ শতাংশ বহন করবে বাংলাদেশ এবং বাকি ২২.৫ শতাংশ বহন করবে অক্সিডেন্টাল। প্রথম দু’বছরে সাড়ে সাতশ কিলোমিটার সিসমিক জরিপ, তিনটি কূপ খনন এবং পরবর্তী পর্যায়ের সিসমিক জরিপের জন্য বিডিং-এ অক্সিডেন্টাল ১ কোটি ৮৮ লক্ষ ডলার বাজেট প্রস্তাব করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি আকর্ষণিয় প্রস্তাব। ডলারের তৎকালিন মূল্য অনুযায়ি একশ কোটি টাকারও কম খরচে সাতশ কিলোমিটার সিসমিক জরিপ, ৩টি কূপ খনন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সিসমিক ডাটা সংগ্রহ বাবদ প্রকল্প ব্যয় বিশ্ববাজারের তুলনায় বটেই বাংলাদেশের মতো সস্তা প্রকল্প ব্যয়ের দেশেও অকল্পনিয় প্রস্তাব। বাপেক্সের প্রকল্প-ব্যয় যেখানে উপমহাদেশে সবচেয়ে কম তার পক্ষেও এরকম প্রস্তাব দেয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই বিড মূল্যায়নের সময় মূল্যায়ন কমিটি তৎক্ষণাৎ সেটি গ্রহণ করে। অক্সিডেন্টাল কাজ শুরু করার পরই পেট্রোবাংলা টের পায় আসল ঘটনা। চুক্তিতে বাংলাদেশের ৭৭.৫ শতাংশ ব্যয়বহন করার ধারা সেটিকে বেছে নেয়া হয় লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অক্সিডেন্টাল ৪ বার সংশোধিত বাজেট জমা দেয়। ১ কোটি ৮৮ লক্ষ ডলারের প্রকল্প ব্যয়ের হিসেব থেকে ৪ দফায় লাফিয়ে লাফিয়ে সেটি ৪ কোটি ৯১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলারের অবিশ্বাস্য বিশাল ব্যয়-বাজেটে রূপান্তরিত হয়। অবাক করার বিষয়, এই সংশোধিত ব্যয়-বাজেট অক্সিডেন্টাল পেট্রোবাংলায় জমা দেয় ১টিও কূপ খনন না করে। প্রকল্প শেষে এই বাজেট কোন অংকে পৌঁছেছিল সেটি জানা না গেলেও অনুমান করা যায় অংকটা গৌণ নয়। আবার, জালালাবাদ-১ নং গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভার কাজের জন্য অক্সিডেন্টাল চুক্তি ভঙ্গ করে ত্র“টিপূর্ণ রিগ আমদানি করে। ক্রয়মূল্য দেখানো হয় আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়েও অনেক বেশি। সিলেটের মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায় ব্যাপক গ্যাসসম্পদ বিনষ্ট করার পরপরই অক্সিডেন্টাল সটকে পড়ে। কূপ খনন করুক বা না করুক, অক্সিডেন্টাল গ্যাস লিজ নেয়ার পর পরই ১৯৯৯ সালের দিকে ১২, ১৩, ১৪নং ব্লকের ৪২.৫ শতাংশ অংশিদারিত্ব আর এক মার্কিন কোম্পানি ইউনিকোলের নিকট বিক্রি করে দেয়, অবশ্য কি পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় তার কোনো সংবাদ পরিবেশিত হয়নি, গোপনেই সমাধা হয় সবকিছু। সাম্রাজ্যবাদি-আধিপত্যবাদি শক্তি তথা মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এভাবেই তেল-গ্যাস সম্পদ নিয়ে লুটপাটে মেতেছে, কৌশল ও চুক্তির ফাঁকফোকর গলে নিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি ডলার, পাচার করছে সুকৌশলে অক্ষমতা ও কারিগরি সুবিধার অভাব সামনে এনে। তেল-গ্যাস তথা প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিশ্বব্যাপি সাম্রাজ্যবিস্তার তথা দখল কারো অজানা নয়। আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বারবার প্রমাণিত সত্য এটি। নিকট অতীতে নানা দেশে তেল এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে আমাদের। অতএব অভিজ্ঞতা থেকে সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা তেল-গ্যাসের ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এটিই কাম্য।
সাংপো ও টিপাইমুখ: বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এখনই
বাংলাদেশ-ভারত সীমানার ১০০ কিমি উজানে বরাক ও তুইভাই নদীর সংযোগস্থলের ৫০০ মিটার ভাটিতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারত। ১৬২.৮ মিটার উঁচু ৩৯০ মিটার লম্বা এই বাঁধের পরিকল্পনার সমস্ত কিছু ভারত সরকার সম্পন্ন করেছে অত্যন্ত গোপনিয়ভাবে, বাংলাদেশকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে।
হিমালয় পর্বতের তিব্বতের অংশ কৈলাশ পর্বত হতে উৎপন্ন হয়ে ইয়ারলুং সাংপো নামে জিমা-ইয়াং জং হিমশৈল উত্তর হিমালয় থেকে পূর্ব দিকে প্রায় এক হাজার সাত শ’ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। পরে তা বিশ্বের সর্বোচ্চ নদী নামচা বারওয়া পর্বতের কাছে বাঁকা হয়ে গতি পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে ইয়ারলুং সাংপো গিরিখাত ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করে সিয়াং নামক স্থানে হঠাৎ উচ্চতা কমে যায়। সাংপো পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর নদীখাত। চিন এখানেই বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। এখানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চিনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত। শুধু বাঁধ নির্মাণ নয়, আরও মারাত্মক শংকার কথা, চিন এই নদী খাতে পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পানির গতি পরিবর্তন করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের গোবি মরুভূমি সবুজায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে, যা গোটা এশিয়ার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। সাংপো খাত থেকে প্রবাহিত পানি অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নামক স্থানে হঠাৎ উচ্চতা কমে যাওয়ার পর প্রবাহটি সমভূমিতে প্রবেশ করে। যেখানে এর নাম হয় দিহং। এখান থেকে ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর দিহং ও রুহিত নামে দু’টি প্রধান নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এই সংযোগস্থল থেকেই নদীটি খুব প্রশস্ত। এটি সম্পূর্ণ আসাম রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাঝে-মধ্যে এর প্রশস্ততা ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। ডিব্র“গড় ও ল²িপুরের মাঝামাঝি এসে নদীটি দু’টি চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে একটি উত্তরাঞ্চলের খেরকুটিয়া চ্যানেল নাম ধারণ করে। বাংলাদেশের মোট পানিপ্রবাহের শতকরা ২৩ ভাগ আসে এই ব্রহ্মপুত্র হতে। একইভাবে ভারতে মোট পানিপ্রবাহের শতকরা ৩০ ভাগ আসে এই ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ থেকে। তিব্বতেও একটি বড় জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বাঁধ নির্মাণ করছে বেইজিং। এরই মধ্যে চিন মেকং নদীতে বড় আকারের একটি বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাপি আধিপত্যবাদি রাজনীতিতে পানি-সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাঁধ। ব্রহ্মপুত্র নদে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাংপো ড্যাম নির্মাণ কিংবা ভারতে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে শুরু হবে ভয়াবহ অবস্থা; তৈরি হবে পানির জন্য হাহাকার। পানি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে কথা হাওয়ায় ভাসছে, এবং এশিয়া থেকেই শুরু হওয়ার যে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে আমরা চাই তা মিথ্যা হোক। বড় বাঁধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপি প্রতিবাদ হচ্ছে, বলা হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থেই হয় বড় বড় বাঁধ। বিশ্বের অনেক দেশেই বড় বড় বাঁধ ভেঙে ফেলে প্রকৃতির মুক্ত-প্রবাহকে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে, ঠিক সে সময় চিন ও ভারতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান আমাদের আহত করে। জনমত গঠন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রিয়ভাবে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি উপস্থাপন করে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
লিটলম্যাগ মেলা ও প্রাসঙ্গিক কথা
লিটলম্যাগচর্চা উত্তরোত্তর বাড়ছে, আশার কথা। বাড়ছে উত্তাপ, তত্ত¡ এবং তথ্যের যাচনায়। মত এবং পথের দ্বৈরথ, পক্ষ এবং বিপক্ষ চিন্তার সখ্য যেমন আছে তেমনি আছে বিরোধিতার সুস্পষ্ট বয়ান। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা লিটলম্যাগ আন্দোলনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে এ-নিয়ে দ্বিধাদ্ব›দ্ব কাজ করে সমানে। সা¤প্রতিক পুঁজিবাদি বিশ্বের (আপাত মন্দাকে মাথায় রেখে) অভাবিত সাফল্য, আকাশব্যাপি ইথারে ছড়িয়ে দেয়া অন্তর্জাল (ইন্টারনেট), চ্যানেল, মিডিয়া কর্পোরেট পুঁজি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদি তেল-গ্যাস কোম্পানির আগ্রাসি তৎপরতা ভাবাচ্ছে নানাভাবেই। সোভিয়েত রাশিয়া তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতা বিপ্ল¬বের সম্ভাবনাকে ফিকে করে দিয়েছে। স¤প্রতি শ্রীলংকায় প্রভাকরণের নির্মম মৃত্যু ভাবনাকে নতুন করে উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্রান্ড কালচার পণ্যায়ন দুনিয়ার হাতছানি ভ্রান্তির মোহ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ব্রান্ড নামের তলানিতে শোধিত না করলে আমরা আরাম, শান্তি পাই না মনে। প্রবাদপুরুষ বিপ্ল¬বি চে’ গুয়েভারা ফ্যাশনের মাধ্যমে ফিরে আসেন তারুণ্যের মাঝে, প্রকৃত বিপ্লব থেকে যায় অধরাই, ভবিষ্যতে প্রভাকরণও যদি ফ্যাশন দুনিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব অর্জন করেন, বিস্মিত হব না আমরা। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় একক স্বাতন্ত্র্যের নামে মানুষকে করে ফেলা হচ্ছে শেকড়হীন, চিন্তাশূন্য, অথর্ব। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কিংবা বিপ্লবের সম্ভাবনা যাতে সৃষ্টি না হয় তার জন্য চলছে তোড়জোড়। উদ্দেশ্য একটাই
চিন্তাশূন্য অথর্ব পঙ্গু জাতি সৃষ্টি করা। যারা কথা বলবে, চিন্তা করবে সাম্রাজ্যবাদি প্রভুদের শেখানো বুলিতে। ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে একদিনে নয়, দিনে দিনে। প্রতিদিনের দৈনিক, চ্যানেল থেকে শুরু করে মিডিয়ায় চলছে নানা কায়কারবার। লিটলম্যাগচর্চা বা আন্দোলনকে স্রোতের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাই পাল্টা আন্দোলন বা অভিমুখে দাঁড় করাতে চাই আমরা। মলয়রায় চৌধুরীদের অনুকরণে ‘কণ্ঠস্বর’ বা অন্যরা যে চর্চা করেছেন তাতে ভ্রান্তির পরিমাণ ছিল প্রভূত। আশির দশক কিংবা নব্বই দশকেও লিটলম্যাগ নিয়ে ভ্রান্তি কমেনি এতটুকু। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে যেভাবে যে অর্থে দেখা হয়, বাস্তব এবং সা¤প্রতিক প্রেক্ষাপট বিষয়টিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে পুরোপুরি। আরেকটু পিছিয়ে যদি বুদ্ধদেব বসুর কথা বলি তারাও কি ভ্রান্তির বাইরে ছিলেন? বুদ্ধদেব বসুর প্রতি বড় অভিযোগ হল তিনি একটি ভুল শব্দকে ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। যে-অর্থে লিটলম্যাগ বা ছোট কাগজকে তারা সংজ্ঞায়িত করেছেন তার সাথে একমত নই আমরা; গোড়াতেই গলদ রয়ে গেছে। আদতে লিটলম্যাগ লিটল নয়-চিন্তায়, চর্চায় বা আন্দোলনে। শুধু সাহিত্যের বিস্তৃত বেলাভূমিতে লিটলম্যাগকে রাখতে রাজি নই; চিন্তার ম্যালা ম্যালা জায়গা, যেখানে আধিপত্য-সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসন থাবার বিস্তার ঘটাতে চাইবে সেখানে লিটলম্যাগ গর্জে উঠবে সর্বশক্তি নিয়ে; তেল-গ্যাস নিয়ে যেমন তেমনি জাতিয় যেকোনো ইস্যুতে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যেকোনো জাতির অহংকারের বিষয়, জাতিকে সামনে নিয়ে যাবার জন্য। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের মগজকে এমনভাবে ধোলাই করেছে যে আমরা আমাদের অতীত ইতিহাস বিস্মৃত হতে বসেছি। উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে তাই নতুন চর্চা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়ে। সা¤প্রতিক বিশ্বমন্দা সম্পর্কিত যে আলাপ সেটিকেও অপ্রয়োজনিয় বিষয় বলেই মনে হয়। পুঁজিবাদি বিশ্বের সংকটকে আমাদের সংকট হিসেবে দেখাবার অদ্ভুত প্রয়াস লক্ষ্যণিয়। আরেকটি কথা তিরিশের দশকে পুঁজিবাদি সংকটকে নিয়ে যে সাহিত্য প্রয়াস, যার পুরোটাই ভুল, আমাদের জাতিসত্তার সাথে বেমানান, উত্তরাধিকারসূত্রে আজো বয়ে বেড়াচ্ছি। কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতায় পুঁজিবাদি সভ্যতার সংকট চিহ্নিত, চিত্রিত করা হচ্ছে। নাগরিক মননকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা যা করছি, করার চেষ্টা করছি, তার কোনোটার লক্ষণই আমাদের এখানে এখনো প্রবল হয়ে ওঠেনি। বিপ্লবপরবর্তী পুঁজিবাদি কর্পোরেট বিশ্বের সা¤প্রতিক আগ্রাসনে সত্যিই আতঙ্কিত ভবিষ্যত লিটলম্যাগ আন্দোলন কিভাবে চিহ্নিত হবে, বিষয়টি ভেবে। এই-সব বিষয় ভাবাচ্ছে আমাদের। ধীরে-ধীরে দানা বাঁধছে, শক্তিশালি হচ্ছে চিন্তার
বিস্তৃত প্রান্তর। আর দশটা ভাবনার সাথে কেন আমার ভাবনা মিলে যাবে, অথবা কেন আমি অন্যের মতো নই, স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শনের লড়াই সৃজনমাত্রেরই। এত এত মিডিয়া, এত এত ধাঁধা, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। নতুন নতুন বায়না খেলা, মগজধোলাইয়ের মহোৎসব। ঠাসা বিশ্বায়ন চমক। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় আমরা বদলাই।
সারাদেশে কয়েকটি লিটলম্যাগ মেলার খবর পেয়েছি আমরা। লিটলম্যাগ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে মেলার বিকল্প নেই। তবে প্রকৃত লিটলম্যাগ নিয়ে মেলা হলেই এ-ব্যাপারে সফলতা আসবে।
বর্ষ ৯, সংখ্যা ১৩, ফেব্র“য়ারি ২০১০