লিটলম্যাগ তো অনিশ্চয়তারই খেলা চিরকাল, যার ভবিষ্যত সৃষ্টিকর্তাও জানে না স্বয়ং… … …
একটি প্রতিবাদি কণ্ঠস্বর ও একটি সত্যিকার পরিচিতি খুঁজে পাবার জন্য উপনিবেশের মানুষগুলোকে নিজেদের অতীত পুনরুদ্ধার করতে হবে।
Frantz Fanon, The Wretched of the Earth, Penguin, 1961.
স্বভাবত মানুষ রাজনৈতিক জীব; রাষ্ট্রবিহিন রাজ্য আদতেই সম্ভব কি-না,
অস্তিত্বনির্ভর প্যারালাল মানুষের পক্ষে একক সারভাইভ কতটুকু যৌক্তিক প্রশ্নগুলি জরুরি নানা কারণেই। দেশজ-আঞ্চলিক-বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে বিষয়গুলো ফিরে আসে বার বার। ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যানুসন্ধান, অতীত ও অতীতানুগত্য বর্তমান তথা ভবিষ্যৎ প্রেরণা-জাগরণ-বিনির্মাণে সক্রিয় অনুঘটক। আধুনিক বিশ্ব আরো ভালভাবে বললে আধুনিক কর্পোরেট পুঁজিবাদি বিশ্বের শৃঙ্খলায়িত মানুষের মুক্তিকাক্সক্ষা-মুক্তিস্বপ্ন দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অগণন পুঞ্জিভূত দুঃস্বপ্ন নিগড়ে। আর্য-অনার্য ভেদরেখা ঘুচে যায়নি, আশরাফ-আতরাফ প্রতাপ প্রবল, শ্রেণি-সংগ্রাম শ্রেণি-লড়াই যেমন তেমনি পুঁজির বহুজাতিক আগ্রাসন, উত্তর-ঔপনিবেশিককালেও বর্তমান, ঔপনিবেশিকতার মায়া অথবা মোহ আজো সমানমাত্রায় ক্রিয়াশিল। রাষ্ট্রের সীমানা রেখা মুছে দিয়ে একবিশ্ব গড়ার ঘোষণা তথা ভূবনগ্রামের (বিশ্বায়ন) ইচ্ছা অযৌক্তিক-প্রলাপ বলেই প্রতিয়মান। আশ্চর্য! একবিংশ শতকেও প্রথমবিশ্ব, দ্বিতীয়বিশ্ব, তৃতীয়বিশ্ব শব্দবন্ধ বুকে শেল হানে, পীড়া দেয়। মানবসভ্যতাকে আধুনিক প্রযুক্তির যে বিস্ময়কর অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট, মানুষের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ফলাবার আকাক্সক্ষা শুধু ভ্রান্ত পলিটিক্যাল অর্থনীতি উপজাত নয়, এই আকাক্সক্ষা এক ধরনের বিশ্ববিক্ষাজাত ফল। অন্তর্জাল, উন্মুক্ত আকাশসংস্কৃতি, ভোগ মানুষকে গিনিপিগে পরিণত করছে অথবা কৌশলে করানো হচ্ছে, ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ম্যালা ধরনের উপকরণ। আস্তপৃথিবীর খোঁয়াড়ে সেঁধিয়ে মানুষ মৈথুনকামসুখ অনুভব করছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সা¤প্রতিক আবিষ্কারগুলোকে সুপরিকল্পিত ও সুচারুভাবে ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবিশ্ব পরিব্যাপ্ত যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে বিশাল জনসংখ্যার মেরুদণ্ডহীন মানসিকতা ও চাহিদাসম্পন্ন এক জনগোষ্ঠি, একক বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে সচেতনভাবেই। মানবচৈতন্যের এই হোমোজিনোইজেসেন প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোতে নতুন সমাজ মনস্তাত্তি¡ক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, তাতে জাতিগত-কৌমগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স¤প্রদায়ের অভিজ্ঞানকে আক্রমণ করা হচ্ছে, যাতে করে ক্ষুদ্র-প্রান্তিয়-নিম্নবর্গের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। প্রত্যক্ষ উপনিবেশ হয়ত এখন নেই কিন্তু মননে-অর্থনীতিতে পরোক্ষ উপনিবেশি-আগ্রাসন সাম্রাজ্যবাদি-থাবার বিস্তার রয়ে গেছে সমান তালেই।
আর্য-অনার্যের দ্ব›দ্ব-সংঘাতে আর্যদের বড় করে দেখাবার বাতিক তাড়া করে ফেরে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিভেদরেখায় ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাচ্যকে হেয় করে দেখাবার প্রবণতা বর্তমান। আমরা সচেতনভাবেই ভুলে আছি যে, পাক-ভারত অথবা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা নিজেকে পাশ্চাত্য মানুষের কাউন্টার প্লেয়ার কিংবা প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবেনি কখনোই, আর এভাবে ভাবার কারণও নেই। প্রাচ্য ধমণিতে যেদিন থেকে পাশ্চাত্য হাওয়া সঞ্চারিত হতে শুরু করে সেদিন থেকেই অনেক কিছুর মতো এই দিকটিও পরিবর্তিত হল। মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ইউরোপিয়ই আসতেন এ্যরিস্টটল পড়তে। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মতো প্রথম প্রজন্মের অনেক ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিরাও মনে করতেন, ভারতবর্ষ থেকে তাদের শেখার আছে অনেক কিছু। উপনিবেশ বিস্তারের প্রথমপর্বে ‘ব্যান্ডিট-কিং’রা উপনিবেশগুলোকে বল-প্রয়োগমূলক পদ্ধতির সাহায্যে দখলে নিয়েছিল। সরাসরি তারা মানুষ হত্যা করত, অঙ্গচ্ছেদ ও সম্পদ লুঠ করত। দ্বিতীয় পর্বে উপনিবেশিক-চৈতন্যের বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিশ্রমি, দায়বদ্ধ, মধ্যবিত্ত মিশনারিদের ভূমিকা ছিল প্রধান। দ্বিতীয়পর্বে সাম্রাজ্যবাদিরা শরীরের সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যের যোগে সমাজকাঠামোর অন্তর্লীন স্তর থেকে এমন কিছু শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিল, পরিণতিতে সংস্কৃতির প্রাথমিক চরিত্রকেও স্থায়িভাবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয় তারা; যার রেশ আমাদের টানতে হচ্ছে এখনো। ঔপনিবেশিক মানুষের মননকাঠামোয় বদ্ধমূল ধারণা সঞ্চার করতে সক্ষম হয় যে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদিদের দরকার। আর একথা তো সত্যিই বাষ্পিয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার, যন্ত্রসভ্যতার অভাবনিয় উন্নতি সাম্রাজ্য
বিস্তারকে দ্রুত করেছে।
রাষ্ট্রের ধারণাও আমাদের নয়, আদতেই ভারতবর্ষে আজকের আধুনিক অর্থে যাকে রাষ্ট্র বলা হয় তার কোনোটাই ছিল না। আর্য জনজাতিরা অনার্যদের সঙ্গে এবং নিজেদের মধ্যে বিস্তর যুদ্ধবিগ্রহ করলেও বিস্তৃত কোনো সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেনি তারা। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দিতে ভারতবর্ষের অনেকটা অংশ জুড়ে ষোলটি মহাজনপদ গড়ে উঠে। এদের নাম অঙ্গ, মগধ, কাশি, কোশল, বজ্জি, মল, চেদি, বৎস, কুরু, পঞ্চাল, মৎস্য, সুরসেন, অশ্মাক, অবন্তি, গন্ধার এবং কম্বোজ। ক্রমে এদের মধ্যে মগধ প্রধান হয়ে যায়। মৌর্য সম্রাটদের যুগে এই উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল সর্বপ্রথম একটি রাজশক্তির প্রাধান্য স্বীকার করে। কিন্তু এই প্রাধান্যের অনেকটাই ছিল বাস্তব শাসনের দ্বারা অসমর্থিত এবং এই ঢিলেঢালা সাম্রাজ্য টিকে ছিল খুবই অল্পকাল।
ইংরেজ-পূর্ব ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামই ছিল সমাজ ও আর্থিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামগুলো ছিল দ্বীপসদৃশ এবং সারা ভারত ছিল বিশাল এক দ্বীপপুঞ্জ। অন্ন-বস্ত্র জীবনের যাবতিয় আয়োজনের দিক থেকে গ্রামবহির্ভূত কোনো কিছুর প্রতি তাদের নির্ভরশিলতা ছিল না। যৌথ প্রচেষ্টায় সে প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল তারা। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদিদের আগমনে শাসনে-ত্রাসনে দিনে দিনে সে নির্ভরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর দুই শতাব্দির ইংরেজ রাজত্বের পর ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভিত্তি পরিবর্তিত হয় আমূল।
ভারতে বরাবর স্বত্বত্যাগেই আনন্দ; তাই দেখা গেছে রামায়ণ-মহাভারত ব্যক্তি নামে প্রচারিত হলেও অনেকেই এখানে অংশগ্রহণ করেছেন, করতে পেরেছেন। একাধিক ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ একক ব্যক্তি নামেই প্রচারিত হতে পেরেছে। পাশ্চাত্যের মতো প্রাচ্যেও স্বত্ব ধারণার সৃষ্টি হল। গ্রাম্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতা ধ্বংস করে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ আধখেচড়া নতুন অনুগত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করা হল। সচেতন রাজনীতিকিকরণের ফলে বিশ্বায়ন হাতিয়ার ব্যবহারে গ্রামের একেবারে প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিকও ভোগবাদি কর্পোরেট সংস্কৃতির আওতায় এসে গেল।
বিশ্বায়ন, মনোলোভা বিজ্ঞাপন-প্রতারণা, মিডিয়াসন্ত্রাস, জোরালো প্রচারের ফলে বিশ্বব্রান্ড-মাহাত্ম্য আকৃষ্ট করছে আমাদের, আকৃষ্ট হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। অর্থবান লোকেরাতো বটেই, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের লোকেরাও এর শিকার হচ্ছে। কোকাকোলা, পেপসি, ভিডিও মিউজিক সিস্টেম, জুতা, টি-শার্ট, জিনস, ফাস্টফুড, মোবাইল কালচার গড়ে তোলা হয়েছে। বহু দ্রব্যের অবাধ ব্যবহারে ক্রমেই পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কৃষি-উপকরণে ক্ষতিকর কীট-পোকামাকড় মারার নামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিষ। এখন ঈশ্বর এক নন, বহু বহু। এইসব বহু ঈশ্বরের কেরামতিতে জীবন জেরবার হবার যোগাড়। তো এতসব অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার, নিজেদের জানান দেয়া সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্লেষণ তাই জরুরি হয়ে পড়ে; জরুরি হয়ে পড়ে ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যানুসন্ধান।
চারবাক এমন এক সময় বের হচ্ছে যখন দেশে গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বারবার বলবার চেষ্টা করেছি আমরা তৃতীয় কোনো শক্তি নয়, নেই অন্য কোনো সহজ বিকল্প, একমাত্র নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হওয়া উচিত। ক্রসফায়ারের নামে বিনাবিচারে মৃত্যুর উৎসব মেনে নেয়া যায় না, অবিলম্বে এই আত্মবিধ্বংসি ক্রিয়াকলাপ বন্ধে গণতান্ত্রিক সরকার পদক্ষেপ নেবে এই আমাদের প্রত্যাশা। তেল-গ্যাস-বন্দর-কয়লা-ট্রানজিট নিয়ে জাতি সুচিন্তিত পদক্ষেপ আশা করে। বৈষম্যমূলক কোনো চুক্তি করা যাবে না এবং অতীতের বৈষম্যমূলক সকল চুক্তি বাতিল করতে হবে।