‘চারবাক’ ও ‘জনঅধিকার আন্দোলন’-এর যৌথ উদ্যোগে ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১ সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল ছফা স্মরণ-উৎসব। প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত এ উৎসবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল আশাতীত। সাহিত্য বিষয়ক সভা-সমাবেশে দর্শক-শ্রোতার এই উপস্থিতি চিন্তাচর্চার এ খরা মওশুমে সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। আলোচনার সূত্রপাত করেন শফিউদ্দিন সরকার। শুরুতেই তিনি ইট খোলায় অগ্নি প্রজ্বলন করেন। বলেন, ‘আহমদ ছফা বাঙালির প্রতিভাকে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিভা বলেছেন। এবং তিনি আরোও বলেছেন যে, কোন প্রথম শ্রেণির প্রতিভা বাংলাদেশে নাই।’ জনাব সরকারের বক্তব্যে এ ইঙ্গিত পরিষ্কার ছিল তিনি নিজেও ছফার এ উক্তির সাথে একমত এবং কার্ল মার্কস, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বিভিন্ন রচনার উদ্ধৃতি উলেখ করে ছফার এ উক্তির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি আরো যোগ করেন, বাংলাদেশে তিরিশ উত্তর-কবিদের লেখায় জীবন অনুপস্থিত। তিনি ঢাকার নগর-পরিকল্পনার অদূরদর্শিতার ক্ষেত্রেও কবি-সাহিত্যিকদের পরোক্ষভাবে দোষারোপ করেন। কারণ হিসেবে বলেন ৩০ উত্তর কবি-সাহিত্যিকগণ প্রতিবেশ সচেতন ছিলেন না। ছফা বিশ্লেষণে যে মূল্যবান মন্তব্য করেন তা হচ্ছে-ছফা ব্যক্তি মানুষের মন বিশ্লেষণ করতে পারতেন। জনাব সরকারের কাছে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ছফার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি রচনার ইতিহাসটি সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে বর্ণনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ভূমিকায় ছফা গ্রন্থটি রচনার ইতিহাসটি বর্ণনা করেন এভাবে, ‘তখন জিয়াউর রহমানের রাজত্বকাল। অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা। আবুল ফজল সাহেবের সাথে আমার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল এবং তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার গল্প উপন্যাস এবং প্রবন্ধের ওপর তিনি তিনটে প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির পূজারি এবং ঘোষিতভাবে নাস্তিক। যেহেতু ফজল সাহেব নাস্তিকতা প্রচার করতেন, প্রতিক্রিয়াশিল ধর্মান্ধ লোকেরা তাঁকে ভীষণ খারাপ চোখে দেখত এবং প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় তাঁকে গালাগাল করা হত। একদিন সকালবেলা আমি প্রাতঃভ্রমণ করতে সুহরাওয়ার্দি উদ্যানে গিয়েছি। খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম সকালবেলা আবুল ফজল সাহেব মোটা তাজা উঁচা লম্বা ফর্সা মতন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বিপরিত দিক থেকে হেঁটে আসছেন। তাঁর মাথায় একটা গোল টুপি। আবুল ফজল সাহেবের মাথায় টুপি দেখে আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জানালেন, সিরাত মাহফিলে যোগ দেবেন বলে বেরিয়েছেন। আমি আবুল ফজল সাহেবকে টুপি পরে সিরাত মাহফিলে যোগ দিতে যাওয়ার ঘোষণা শুনে মনে মনে একটা চোট পেয়ে গেলাম। এই ঘোষিতভাবে নাস্তিক ভদ্রলোকটি আজকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে না পেতে নিজেকে প্রচণ্ড ধার্মিক বলে পরিচয় দিতে চাইছেন। এরকম কাণ্ড কি করে ঘটে আমাকে ভয়ানক রকম চিন্তিত এবং উতলা করে তোলে। এই যে হঠাৎ পরিচয় পাল্টে ফেলা তার পেছনে আমার মনে হয়েছিল একগুচ্ছ সামাজিক কারণ বর্তমান। আবুল ফজল সাহেব উপলক্ষ মাত্র কারণ নন। বাঙালি মুসলমান সমাজের ভেতরে এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে যেগুলো ব্যক্তিকে কোন বিশ্বাসের বিন্দুতে স্থির থাকতে দেয় না। ডানে কিংবা বাঁয়ে হেলতে বাধ্য করে। মনের এই উত্তেজিত অবস্থাতে আমি এক রাতে একটুও না থেমে বাঙালি মুসলমান রচনাটি লিখে শেষ করি।’
শফিউদ্দিন সরকারের পর ড. ফজলুল আলম তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি জনাব সরকারের উক্তি ছফা ব্যক্তি মানুষের মন বিশ্লেষণ করতেন- প্রসঙ্গ টেনে সমাজ বিশ্লেষণের হেগেলিয় ও মার্কসিয় দর্শনের প্রাঞ্জল বর্ণনা করেন। কিভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি মানুষের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, আবার বিপরিতদিকে ব্যক্তি মানুষকে বিশ্লেষণ করে সমাজের বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যায়, তার সহজবোধ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন, ছফা তাঁর লেখায় কোন উদ্ধৃতি করতেন না। ছফাকে দঅহমৎু ণড়ঁহম গধহ’ হিসেবেও চিহ্নিত করেন তিনি।
ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, শফিউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মঞ্চে অবতীর্ণ হন। বাঙালি দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিভা- শফিউদ্দিন সরকারের উদ্ধৃত ছফার এ মন্তব্যের বিরুদ্ধেও তিনি অবস্থান নেন। গোটা অনুষ্ঠানটিতে ছড়িয়ে পরে টানটান উত্তেজনা। দর্শক-শ্রোতা সকলে নির্বাক। সকলের জিজ্ঞাসা- জনাব হকের তথ্য ও যুক্তি কি পারবে বাঙালি দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিভা নয়-তা প্রমাণ করতে? জনাব হক তাঁর মতে ছিলেন অনড় এবং তিনি তাঁর মতের সপক্ষে একটার পর একটা যুক্ত উপস্থাপন করেন। বাঙালির প্রথম শ্রেণির প্রতিভারা কখনই মূল্যায়িত হয়নি, বরং বরাবরই তৃতীয় শ্রেণির প্রতিভারা প্রথম শ্রেণিতে উঠে এসেছেন। তিনি যৌক্তিক কারণেই বলেন, বাংলাদেশ স্বনির্ভর একটি দেশ এবং কৃষিভিত্তিক এই দেশ কখনই পরনির্ভরশিল ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি আমেরিকা ও বাংলাদেশের মানুষের পার ক্যাপিটা লোন উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন। যেখানে আমেরিকার জনগণের মাথাপিছু পার ক্যাপিটা লোন ৮০,০০০ ডলার, সেখানে এর বিপরিতে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু পার ক্যাপিটা লোন মাত্র ৩০০ ডলার।
জনাব হক ছফা সম্পর্কে বলেন, ছফা গতানুগতিকভাবে কোন কথা বলতেন না। বরং ছফার ছিল নিজস্ব বক্তব্য। প্রসঙ্গক্রমে এসে পরে তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গ। ছফার গ্রন্থ ‘আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ’-এর ভূয়সি প্রশংসা করেন তিনি। দেশের সকল লেখক বুদ্ধিজীবী যখন তসলিমার ‘লজ্জা’ গ্রন্থটি নিয়ে কোনরূপ বাছ-বিচার না করে নির্লজ্জের মত উলম্ফন করছিলেন, তখন ছফা ‘লজ্জা’র বোরকা উন্মুচিত করে তসলিমার দূরভিসন্ধি জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেন। জনাব হক স্মৃতিচারণ করে ছফার প্রতি গভীর মমত্ববোধের সাথে তাঁর একটি ব্যতিক্রমধর্মি পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, দেশের প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী কখনো না কখনো রমনা পার্কে বসতেন বা এখনও বসেন। কিন্তু তাঁদের কেউই আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফার মত দৌর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে রমনাকে মাতিয়ে রাখতে পারেননি। ছফা যেন সক্রেটিসের মত উঁচু আসনে সমাসিন, আর তাঁকে ঘিরে থাকত নানা বয়সের সাহিত্যামোদি ও বুদ্ধিজীবীরা।
রফিক কায়সার তার বক্তব্যে কবি-সাহিত্যিকদের পক্ষাবলম্বন করেন। ঢাকার নগর-পরিকল্পনায় কোন কবি-সাহিত্যিক জড়িত ছিলেন না। জনাব কায়সারের মতে ছফা কোন দর্শনে বিশ্বাসি নন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যেকোন বিষয় বুঝতে চেষ্টা করতেন তিনি। আবার তিনি প্রচলিত অর্থে মার্কসবাদিও ছিলেন না। তবে একসময় আবুল হোসেন সাহেবের সংস্পর্শে এসে মুসলিম দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কায়সারের মতে ছফার মূল্যবান অবদান গ্যোতের ফাউস্ট অনুবাদ।
আহমদ মাযহার তাঁর স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বজায় রেখে আলোচনাকে ভিন্ন দিকে চালিত করার চেষ্টা করেন। ‘জন অধিকার আন্দোলন’ ও ‘চারবাক’ কে ধন্যবাদ জানান তিনি একটি মহৎ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
শোয়াইব জিবরান তার বক্তব্যে ছফার বিভিন্ন দুর্বলতার জায়গাগুলো তুলে ধরেন। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলছি যে, একটা সময় ছিল যখন বিভিন্ন কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে ভার্সিটিতে মাস্টার্স করা যেত। যে সকল ছাত্ররা এরূপ করতেন তাদেরকে কলু বলা হত। মূল প্রবন্ধকার শফিউদ্দিন সরকারের মতে যেখানে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে বিবেচিত, সেখানে জিবরান সে রচনাটিকেই ছফার একটি ভুল ব্যাখ্যা বলে মন্তব্য করলেন। তিনি ছফাকে লিবিয়া ও ইরানের দালাল বলে অভিহিত করলেন। ছফার উপন্যাস ‘গাভী বিত্তান্ত’ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কে ছফার অজ্ঞতা ছিল বলে জানান।
অরূপ রাহী সমাজের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ছফার সংগ্রামি ভূমিকার কিছু চিত্র তুলে ধরেন। ভার্সিটির বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে যখন সরকারের বিরাগভাজন হবার ভয়ে কোন বুদ্ধিজীবীর সমর্থন আদায় করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন আকমল হোসেন, সিরাজুল ইসলাম ও আহমদ ছফা ছাত্রদের এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। জনাব রাহী ছফাকে অপজিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মোহাম্মদ আজম তাঁর স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত প্রাঞ্জল বক্তৃতায় ছফাকে তরুণ প্রজন্মের একজন ক্রেজ হিসেবে মনে করেন। আজম সুস্থির চিত্তে, গোছানো ঢং-এ তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ছফা আলোচনা করতে হলে আমাদের জানতে হবে ছফা আমাদের কি কাজে লাগে? তিনি ছফাকে গতানুগতিক ও চাটুকারি বুদ্ধিবৃত্তির বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামি চেতনা হিসেবে উলেখ করলেন। জিবরান যেভাবে ছফার গ্যোতের ফাউস্ট অনুবাদ ব্যতিত বাকি সব রচনাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি তার যৌক্তিক ও তীব্র প্রতিবাদ জানান।
ড. সেলু বাসিত ছফা আলোচনায় ছফার ‘ওঙ্কার’ রচনাটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং জানান ১৯৪৭ হতে ১৯৭২ পর্যন্ত ছিল ছফা রচনা সমগ্রের মূল চেতনা।
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বেনজিন খান। আবেগাপ্লুত ভঙ্গিতে ও ভাষায় ছফার সংগ্রামি জীবনের নানাদিক উপস্থাপনের চেষ্টা করেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ছফার অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গক্রমে টেনে আনেন তিনি।
ছফা সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনা ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই লেখাটির সাথে যুক্ত করে দিতে চাই। আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়া থানায়, জুন ৩০, ১৯৪৩ এ। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জুলাই ২৮, ২০০১ এ। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি সব মিলিয়ে তিরিশটিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। ছফার বিতর্কিত কিছু লেখার কারণে তাঁর সৃষ্টির বিশাল ভুবন প্রায়শঃই ম্লান হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে তাঁর উপন্যাসসমূহের কথা উলেখ চাই। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে আহমদ ছফার নাম প্রায়শই উহ্য থাকে। ঔপন্যাসিক হিসাবে ছফার তিরিশ বছরের জীবনে ছফাকে কখনই গতানুগতিক রীতিতে নাম ও প্রতিপত্তির পেছনে ছুটতে দেখা যায়নি। একজন সুপরিচিত প্রবন্ধকার, সমালোচক এবং কবি হিসেবে ছফা তাঁর উপন্যাসের পরিকল্পনা ও রচনায় অনেক বেশি যতœবান ছিলেন। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের কাঠামো ও বিষয়, উভয় ক্ষেত্রে তিনি এনেছিলেন নতুন কিছু। চিন্তা ও চরিত্র, কৌশল ও প্রকাশের মধ্যে নতুনত্ব না এনে তিনি কখনোই কোন নতুন উপন্যাস লেখায় হাত দিতেন না। উপন্যাসে ¯্রফে গল্প বলার যে রীতি তা তাঁকে কখনই আকর্ষণ করেনি। সূর্য তুমি সাথি, ওঙ্কার, অলাতচক্র, আলী ক্যানান, মরণ বিলাস, গাভী বিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ-পুরাণ মিলিয়ে ছফার মোট আটটি উপন্যাস।
ছফার স্পষ্টবাদিতা, নিজের মতের উপর অনড় অবস্থান তাঁকে প্রসিদ্ধি এনে দিয়েছিল। তাঁকে কখনই গতানুগতিক পথে সাফল্য অর্জনের জন্য লালায়িত হতে দেখা যায়নি। সামাজিক গতিময়তা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি তিনি দেখতেন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিজ্ঞানের কারণে আহমদ ছফা সম্পূর্ণ এক পৃথক সত্তায় পরিণত হয়েছিলেন। ছফার সহচর সাহিত্যিক ও রাজনীতিক বন্ধুরা যখন সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি অনুযায়ি নানাভাবে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত, তখনও আহমদ ছফা ছিলেন একজন আত্মকেন্দ্রিক দলছুট ভবঘুরে। তাঁর দেশপ্রেম কখনোই সাম্প্রদায়িকতা ও উৎকট স্বাদেশিকতায় পর্যবসিত হয়নি।
আপাত বামপন্থি হলেও ধর্মের উপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ধর্মচর্চা নিয়ে তিনি কখনই মাথা ঘামাতেন না, তবে তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সংশয় পোষণ করার কোন অবকাশ তিনি রাখেননি। জুন ১৩, ১৯৮২ এ তিনি তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন, ‘আলাহর উপর নির্ভরতা বাড়ছে। আমি নিজের ভেতর আলাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করছি। আমার এ উপলব্ধিটাই আমার সম্বল। ধর্মবিশ্বাসের মতই প্রেম, বিয়ে, সংসার নিয়েও এক অদ্ভুত দোটানায় ছিলেন আহমদ ছফা। মার্চ ৫, ১৯৭৩ এ আহমদ ছফা লিখছেন,‘আমি ইচ্ছে করলে হয়ত কাউকে বিয়ে করে ফেলতে পারি। কিন্তু ভয় হয়, বড় ভয় হয়, পাছে এমন মেয়ে মানুষের হাতে পড়ি যে, আমার জীবনটা বিষময় করে তোলে। জমাট প্রেমও জমিয়ে তুলতে পারি। কিন্তু তাতে যে পরিমাণ সূ² শ্রম এবং উদ্যম ব্যয়িত হবে তা করতে আমি সত্যি সত্যি অপারগ। জীবন কয় দিনের? এই যে পৃথিবীতে এতদিন বেঁচে থাকলাম, মানুষের এত স্নেহ, মমতা পেটুকের মত ভোগ করলাম, তার কৃতজ্ঞতাটুকু তো কোন সৃষ্টিকর্মে ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না। আমার জীবন কি অরণ্যরোদনের মত অকাজে ফুরিয়ে যাবে? আমি কি মানুষের খুব কাছাকাছি আসতে পারব না?’ ঠোঁটকাটা ছফার আত্মবিশ্বাস ছিল পাহাড় প্রমাণ। তিনি নিজে যা বুঝতেন তা-ই লিখতেন এবং বলতেন। কোন প্রভুর নির্দেশনায় বা কোনরূপ স্বার্থচিন্তায় কখনোই নিমজ্জিত হননি। জুন ২১, ১৯৮২ এ আহমদ ছফা তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন, ‘আমার মধ্যে একটা চৎড়ঢ়যবঃরপ চৎড়ঢ়বৎঃু আছে। সেটিকেই পরিচর্যা করতে হবে। রাশি রাশি বস্তু ছেঁকে ছেঁনে পরীক্ষা করে দেখা আমার কর্ম নয়। আমি তো অতি অনায়াসেই বস্তুর অন্তর্বর্তী জটসমূহ দেখতে পাই। জন্মান্ধ দৃষ্টিহারা মানুষদের সঙ্গে বচসা করে নিজের উপলব্ধিকে আবিল করতে চাইনে। আমি পৃথিবীকে অতো তোয়াজ করতে পারব না। আমার আকাক্ষা অনুসারে পৃথিবীকে পাল্টাতে হবে।’ বস্তুত এই-ই আহমদ ছফা অথবা তারো চেয়ে বেশি কিছু…। আর এভাবেই শেষ হয় ছফা স্মরণ-উৎসবের।