004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

জলমগ্ন যন্ত্রণার শিলান্যাস

শ্যামল ভট্টাচার্যের ‘লোদ্রভার কাছাকাছি’ উপন্যাসটি পাঠক প্রিয়তায় সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসের কাটতির তালিকায় সম্মানজনক আসন লাভ করেছে এর বর্ণনাভঙ্গি এবং বহুধাবিভক্ত ভারতবর্ষের সমাজ-রাজনীতি স¤প্রদায়লগ্নবোধ ব্যক্তিচেতনার ব্যষ্টিকআবহ আর ঘরে ফেরার অর্থাৎ স্বিয় অস্তিত্বের কাছে আত্ম-সন্দর্শনের কারণে। বরাক উপত্যকার ভূ-প্রকৃতি অনন্ত সৌন্দর্য্য-লিপ্সাকে উপন্যাসের নায়ক পরিতোষের উপলব্ধিতে জাগ্রত করে তুলে, আমরা সচকিত হয়ে উঠি টিপাইমুখের অনাগত প্লাবণভূমি-প্রবর্ধনায়; বর্তমান ভূ-সৌন্দর্য্য আমাদের জিজ্ঞাসাকে প্রলম্বিত করে।

শ্যামলের বর্ণনা
‘দিনে সাদামাটা অনেককিছু রাতের অন্ধকার ও আলোছায়ায় রহস্যঘন। সেই রহস্যের গা ছুঁয়ে আসা বাতাসে মনে হতো দূরবর্তি পাহাড়শ্রেণি যেন পাথরকঠিন আরাবলি­ নয়, মামাবাড়ির দিগন্তরেখায় মাইলং ডিশা; যে পাহাড় চলমান, যে পাহাড় গতিশিল।

ভোরের দিকে মনে হতো মাইলং ডিশা ও ঘন বনানি সবকিছুই কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে। পার্শ্ববর্তি কেন্দ্রিয় মরু অনুসন্ধানশালার ফলবাগান ছুঁয়ে আসা কিন্নুর সুবাস বরাক, জিরি, ঘাঘরা, চিরি কিংবা মধুরা নদির দুপাশের পাহাড় লাল করা কমলার ফলনের কথা মনে করিয়ে দিত। শিলচর শহরে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা অনেক কটা ট্রাকের কাছে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে কমলা পড়ে থাকতে দেখেছে পরিতোষ। বড়মামা তখন দশটাকায় একশোটা কমলার ঝুড়ি কিনে আনত। ঐ সময় সমস্ত বরাক উপত্যকা কমলার গন্ধে ম ম করতো ত্রিপুরার জম্পুই পাহাড়। শেষ রাতের অন্ধকারে মনে হতো মাইলং ডিশা ও ঘন বনানি, টিপাইমুখের সঙ্গম কিংবা ফুলেরতলের টিলাজমিতে বিশালাকায় আনারসের সাম্রাজ্য সব কিছুই আছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে, ঠিক যেন কৈশোরের দিনগুলির মতন। পরিতোষের অনুভবে কৈশোরই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এমনি এমনি হলে সে আর শুতে যেত না। মনে মনে কৈশোরকেই যেন টেনে টেনে স¤প্রসারিত করতো। চোখ বুঁজে উপলব্ধি করতো ভোরের অনাঘ্রাত রেশ, নাগাঝংকার বিশাল কালোদিঘির পাশে বেড়ে ওঠা গাছেদের ঘন সবুজ।’

সৌন্দর্য্য বিস্তৃত এই প্রাকৃতিক আবহে টিপাইমুখের সম্ভাব্য প্রকল্প প্রস্তাবনা শস্য স্বপ্নের সোনালি-সবুজের বাস্তবতায় জল-স্তম্ভে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আর মৎস্য-কল্পে বাস্তুকরের প্রান্তর-উদ্ভাস, কর্পোরেট বিশ্বমাত্রার সমাজ-ভূ-পরিবেশ দলিত আর্থ-ভাবনার এক উন্নয়নচিন্তার বিস্তৃতি।

দুই
ফ্রন্টপেইজ (ভলিউম-৫, নং-৫৬৯/জানুয়ারি-১ ২০০৬ সাল) পত্রিকায় পরিবেশবিদ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘If Tipaimukh Dam is built, the Surma and Kushiara (in Bangladesh) will be choked in a year,’
তিনি আরও বলেছেন,

‘Indian Government is not considering Preserving human livelihoods and ecology, it is considering the dam issue in the line of cement-mafia, iron-mafia and turbine manufacturers.’

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরী ‘বরাক বাঁধ বিতর্কে অন্য একটি দৃষ্টিকোণ’ দৈনিক যুগশঙ্ঘ, ১৭ জুন ২০০৯) শির্ষক আলোচনায় উলে­খ করেছেন:

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গাটুকু জীববৈচিত্র্যে ভরপুর-তাই এটি, ‘জেনেটিক হটস্পট’ এর অন্তর্গত। বলাবাহুল্য, গোটা পৃথিবীতে প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রাচুর্যে যে সমস্ত এলাকা রয়েছে, তাদেরকে ‘হটস্পট’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সারা বিশ্বে এমন পয়ত্রিশ খানা ‘হটস্পট’ রয়েছে।

বরাক ড্যাম এ প্রস্তাবিত নির্মাণস্থল জেলিয়াংগ্রাং (Zeliangrong) এবং মার (Hmar) উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। কোন জায়গায় বৃহৎ কোন শিল্প বা নদি বাঁধ নির্মাণের জন্য ঐ স্থানের ‘পরিবেশের প্রভাবজনিত মূল্যায়ন’ করে নেওয়াটা একান্ত বাধ্যতামূলক। এটা একটা দির্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, যার অবলোকন, পর্যবেক্ষণ, পরিবর্ধন ইত্যাদি ধাপে ধাপে করে এরপর সিদ্ধান্তে উপনিত হতে হয়। স্থানিয় বাসিন্দাদের মতামতকে এক্ষেত্রে যুক্তিসহকারে বিবেচনা করার সংগত কারণ রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাঁধের নির্মাণস্থল বরাক (স্থানিয় ভাষায় তুইলুযাং) এবং তুইভাই নদির সংযোগস্থলের ৫০০ মিটার নিচে। বাঁধের উচ্চতা ধরা হয়েছে ১৬২.৮০ মিটার। এত উঁচু বাঁধের উপর আবার অনবরত জমা জলের চাপ থাকবে। আবার অন্যদিকে এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ, যেহেতু ‘টাইথু’ নামক ‘সিসমিক বেল্ট’ এর ভেতর রয়েছে।

এই বাঁধ নির্মাণের ফলে মণিপুরের ২৭৫.৫০ বর্গকিলোমিটার জেলিয়াংগং এবং মার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা চলে যাবে জলের নিচে। আরও আশঙ্কা করা হচ্ছে এর ফলে মণিপুর ও মিজোরাম সিমান্তের নব্বইটি গ্রামের ১৪০০ পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং ৩১১ বর্গকিলোমিটার এলাকা স্থায়িভাবে নিমজ্জিত করবে। যার মধ্যে আটাশ হাজার হেক্টর বন এবং চাষাবাদ উপযোগি স্থান রয়েছে।

ভারত পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার কৃষি-সুপেয় পানি-বিদ্যুৎ-মৎস্য চাহিদা এমনকি পর্যটন শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর হাইড্রোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করেছে যা তার উন্নয়ন ভাবনার অংশ। ভারতের প্রধান প্রধান নদি যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গাদারি নর্মদা, কাবেরি, মহানন্দা, ব্রাহ্মণি এবং হিমালয়ের গঙ্গোত্রি হিমবাহ উৎপন্ন স্রোতধারা-নদি প্রবাহ দক্ষিণের পানি প্রবাহ দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে River Linking project (RLP) একটি উলে­খযোগ্য প্রকল্প। ভারতের হিমালয়-উৎস নদিপথের ৪,৫০০ কি.মি প্রবাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ঘাটতি পানি নিরসন সম্ভব হবে ১,৩৫,০০০ বর্গমাইল জমিতে সেচ, ৩৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে Indian national water development কর্তৃপক্ষ মনে করে। সেজন্যে ১৭৩ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রায় ৪০% শতাংশ প্রকল্পমুক্ত জল প্রবাহ থেকে অপসারণ করে শতাধিক পানি সংরক্ষাণাগার এবং ৬০০ মাইল খাল খনন সম্পন্ন করতে হবে। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এ প্রকল্প সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমাপ্ত করার জন্য বলা হয়েছে যদিও প্রকল্প প্রস্তাবনায় ১৪ বৎসর অর্থাৎ ২০০২-২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা বাস্তবায়নের কথা।

এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০-২০০ বিলিয়ন ডলার, ভারতিয় বংশোদ্ভুত মার্কিন প্রকৌশলি স্যাম কান্নাম্পান-এর পরিকল্পনা অনুযায়ি বিশ্বব্যাংক এ-প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যেমন আমাদের এই বাংলাদেশে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এবং অ-বিশেষজ্ঞরা যতো বেশি সোচ্চার ভারতে কিন্তু সেরকম নয়। তবে পরিবেশবাদিরা সামগ্রিকভাবে ভারতের এইসব প্রকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে কৌশলগত বিতর্ক উপস্থাপন করেন।

ভারত ছাড়া চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পানি পরিকল্পনা ও সংস্কার কর্মসূচি এক অব্যাহত প্রক্রিয়ারূপে বিবেচনা করে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গ্যাস ও ব্যারেজ ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের উন্নয়ন প্রকল্পের অংশরূপে অধ্যয়ন প্রয়োগ ভাবনায় কার্যকর করতে আগ্রহি। সময়ে সময়ে এগুলোর সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস করা হয়ে থাকে-যেমন তরল পানি প্রবাহ বর্তমানে বন্ধ্যাস্বরূপ হওয়াতে ব্যারেজ পরিকল্পনার অংশরূপে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৯-২০০২ খ্রিস্টাব্দর মধ্যে নদি প্রবাহ পুনসংস্কার ও পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক বাঁধ পুনঃবিন্যাস ও অপসারণ করেছে।

বিভিন্নসূত্রে জানা যায় ইতোমধ্যেই চিন সরকার ৪০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। এ জন্য ইয়ার সুং সাংপো নদির ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখে শুরু হয়েছে এ বাঁধ নির্মাণের কাজ। এই বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে এই নদির সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন নদির ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার জলধারা স্থবির হবে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদি শ্লথ হয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে নদি অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য।

এখানে উলে­খ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের লক্ষ্যে চিনের যে নদিতে বাঁধ দেয়া হচ্ছে সেটি হিমালয় পর্বতের তিব্বতের অংশ কৈলাসটিলা থেকে উৎপন্ন হয়ে ইয়ার সুং সাংপো নামে জিমা ইয়াং জং হিমশৈল উত্তর হিমালয় থেকে পূর্ব দিকে প্রায় এক হাজার সাতশো কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে তা নামচা বারওয়া পর্বতের কাছে গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে ইয়ার সুং সাংপো গিরিখাত দিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করে। এরপর ভারতের ডিব্র“গড় ও ল²িপুরের মাঝামাঝি এসে নদিটি দুটি চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে একটি উত্তরাঞ্চলের খেরকুটিয়া চ্যানেলে এবং অপরটি দক্ষিণাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারণ করেছে। ভারতের ধুবরি নামক স্থানের উপর দিয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

প্রায় ২০০ বছর আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদি দুভাগে বিভক্ত হয়ে একটি যমুনা নাম ধারণ করে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদির সঙ্গে মিলিত হয়।

অপর শাখাটি বাহাদুরাবাদের উজানে হরিণধরা নামক স্থানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে বর্তমানে জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজার নামক স্থানে মেঘনা নদির সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তিব্র প্রবাহ সংকটের কারণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অস্তিত্বও এখন বিপন্ন।

ভারত, চিন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক-ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করে নিজস্ব স্বার্থ ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন অধ্যয়ন চেতনাকে সামনে রেখে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইতিহাসের এক উলে­খযোগ্য বিষয় হল গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ-১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে কোয়েটা প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয় এবং এতে সকলে সম্মত হয় ২০০৮-১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ ৫ শতাংশ কমানো হবে। কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা থেকে সরে দাঁড়াল। ২০০৭-এ আইপিসিসির চতুর্থ রিপোর্টে দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ৯০ শতাংশেরও বেশি মানবসদৃশ গ্রিন হাউস গ্যাস দায়ি। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে বিশেষজ্ঞ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চিন বিশ্বের সবচে বেশি গ্যাস নির্গমন শুরু করে।

বস্তুতঃ জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের রক্ষণশিল ধারণাকে এক্ষেত্রে পোষণ করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি-পানির স্বল্পতা, পানির অত্যধিক চাপ, ফসলের কম ফলন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, হিমালয়ের পর্বত উৎস থেকে উৎপন্ন নদির উপর ১৩০ কোটি মানুষের নির্ভরশিলতা আর বরফগলার ভিত্তিতে অধ্যয়নশিল হওয়া উচিত।

তিন
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের সিংহভাগই বর্তমানে ঘনিভূূত হয়েছে এবং মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত কারণে তা দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছে। আধুনিক গবেষণার ফলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জীব পরিবেশিক সংবেদনশিলতা এত প্রগাঢ় যে শুধু অবক্ষয়ের রাশ টেনে ধরলেই জীব বিলুপ্তি কিংবা পরিবেশ বিনষ্টের গতিরোধ করা যাবে না, সে জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কৌশলগত প্রায়োগিক উদ্যোগ প্রয়োজন, প্রয়োজন জৈব নিরাপত্তা বিষয়ক নীতিমালার ভিত্তিতে অগ্রসর কৌশলগত জীব-পরিবেশিক ব্যবস্থাপনা। অথচ টিপাইমুখ কিংবা চিনের উদ্যোগ গ্রহণের পর এতদবিষয়ে আমাদের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন কৌশল পরিবেশ কিংবা হাইড্রো চেতনা সিমাবদ্ধ তো বটেই রাজনৈতিক ধারণাও যথা বিস্তৃত কিংবা বাস্তবানুগ নয় বলেই ভারত কিংবা চিন এর দুর্বলতা ব্যবহার করে অগ্রসরমান।

আসলে পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমরা অগ্রসর হই তাহলে দেখা যায়-
বাস্তবতা, প্রকৃতি বিনাশি উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফল জন-সমাজ-ভূ কাঠামোর পরিবর্তন ও প্রভাব:
বৃটিশ-ভারত রাষ্ট্রশক্তির পরিকল্পনায় উনিশ শতকের শুরুতে (১৯০৬-১৯০৭) কর্ণফুলি নদিতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই হলেও প্রায় পনের বছর পর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় নদিতে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালান প্রকৌশলি গ্রিভস। তারও প্রায় আঠারো বছর পর ১৯৪৭ এ সে-সময়ের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলি ই এ মূর কর্ণফুলি প্রকল্পের বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করে। এখানে উলে­খ্য যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একই সময়ে বরাক উপত্যকায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় বলে জানা যায়।

Bangladesh district gazetteer Chittagong hill treacts-১৯৭৫ সূত্রে জানা যায় কাপ্তাই বাঁধে ৫৪ হাজার একর জমি ডুবে গিয়ে জলাধারের সর্বোচ্চ উচ্চতার বিপরিতে ২১,৫২২ একর ভূমি পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৪০ বর্গমাইল এলাকা আবাদ করে ১০,০০০ একর জমি মাত্র ৩,৭৩৪টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পুনর্বাসনের জন্য আবাদ করা ছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৩০ বর্গমাইল এলাকা কাপ্তাই হ্রদে নিমজ্জিত হয়, নিমজ্জিত অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ২৩৪ বর্গমাইল। মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ভূ-পরিবর্তনের কারণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সৃষ্টি হল পরিবেশ উদ্বাস্তু।

ভারতের অরুণাচল রাজ্যে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে বিতর্ক।

১৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রস্তাবিত লোয়ার দিমৌ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প লোহিত নদির উপরে তৈরি হচ্ছে। বাঁধের আনুমানিক দৈর্ঘ্য হবে ৮০০ মিটার। প্রকল্পের পাওয়ার হাউসটি হিন্দু তির্থক্ষেত্র পরশুরাম কুণ্ডের দেড়শ’ থেকে দু’শো মিটার উপরে স্থাপন করা হবে। জানা গেছে, নদির ডান দিক দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি হওয়ার কথা যা দিয়ে পরশুরামকুণ্ডের নিচের জলধারায় পানি পড়বে। প্রকল্প কর্মকর্তারা নদির বা দিকেও একটি সুড়ঙ্গ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন যাতে কুণ্ডে পানি ছেড়েও পানির স্তরে সামঞ্জস্য রাখা যায়। সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ৯০০ মিটার, পরিধি ৬ মিটার।

প্রায় একই কায়দায় তৈরি লোয়ার সুবনসিরির ক্ষেত্রে সমস্যা দাঁড়িয়েছে বর্ষাকালে তলায় পলি আর পাথর জমে যায়। কাদাসহ সরাসরি নিচে আছড়ে পড়ে। পরিবেশবাদি সংগঠনগুলোর একই আশঙ্কা দিমৌতে। এক্ষেত্রে উপরের পাথর, বালিসহ পাহাড়ের ধসবাহি পানি নিচে পবিত্র কুণ্ডে আছড়ে পড়বে। সংগঠনগুলোর আরও দাবি, কুণ্ডের কাছে এত বড় বাঁধ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে যে পরিমাণ জনসমাগম হবে ও পাহাড়ে যতো বিস্ফোরণ ঘটানো হবে তাতে পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বিঘিœত হবে। এথিনা দিমৌ পাওয়ার প্রাইভেট লিমিটেড, পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড ও ইনফাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোগে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।

নিমকি ও তাইলুং এলাকার উপরে আঘাত আসায় স্থানিয় মিসমি জনগোষ্ঠিও ক্ষিপ্ত। পরিবেশবাদিদের বক্তব্য, লোহিত নদি ও উপনদির উপর ১১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো অববাহিকায় এর কি প্রভাব পড়বে বা পড়ছে তার বিশদ Impact assessment study ছাড়া এসব বাঁধের গ্রিন সিগন্যাল দেয়া উচিত নয়। এছাড়া ত্রিপুরার গোমতি নদিতে ডম্বুর বাঁধ সৃষ্টি করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলনের-যা আমাদের কাপ্তাই বাঁধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দিলি­ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক এম ফিল অভিসন্দর্ভ থেকে জানা যায়-মণিপুরের ‘লোকটাক প্রকল্প’ বা ইথাই বাঁধ একটা স্থবির আর্থ-সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রকল্পটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত জানুয়ারি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রাকেশ মেহেতার Climate change agenda for Dilhi ২০০৯-২০১২ সুপেয় পানির আর পানি-ব্যবস্থাপনার এক উজ্জ্বল নিদর্শন, ভারত তার অভ্যন্তরিণ জলব্যবস্থাপনার জনসম্পৃক্ত উন্নয়ন-অংশের যেমন রূপান্তর করতে চায় বৃহত্তর প্রকল্প গ্রহণে তেমনি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ও জনগণের অংশিদারিত্বনির্ভর জলব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎব্যবস্থাপনা এ অঞ্চলের সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে তুলবে নিঃসন্দেহে।

ভারত সম্পর্কে আমরা যত সোচ্চার, আলোচনা বিশ্লেষণে ইতিবাচক, প্রগলভে-প্রতিরোধে আবেগপ্রবণ চিনের ব্যাপারে তেমন নই; অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তর পরবর্তি রাজনৈতিক মেরুকরণ, ভূ-আর্থ রাজনৈতিক প্রবাহে সাংপো নদির জলাধার পরিকল্পনার মতোই চিনের প্রভাব কূটনৈতিক বাস্তবতায় দৃশ্যমান।

১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম রবীন্দ্র জন্মদিবসে চিনের পিপলস ডেইলিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল-তিনি সেখানে শ্রমরত চিনা অধ্যবসায়কে রবীন্দ্রচেতনায় সৃষ্ট ভবিষ্যৎ চিনের কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে ধর্মতন্ত্রি সমাজের শ্রমের বন্ধন-মুক্তির আনন্দ হিসেবে দেখেছেন, দেখেছেন সাংস্কৃতিক-সাহিত্য-কলাও রসোপলব্ধির এক নতুন মাত্রা-তা ছিল ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চিন যাত্রার উপলব্ধি। পরবর্তিকালে কলকাতায় সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৪ এ যখন তিনি দ্বিতীয়বার চিন গেলেন-তাঁর অভিজ্ঞতা তিনি ব্যক্ত করেন-‘লড়াইটা সুগন্ধ ফুল বনাম বিষাক্ত আগাছার’ শির্ষক এক প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি ১৯৭৯-এ চিন গণপ্রজাতন্ত্রের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকি উপলক্ষে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘পূর্বা’-তে মুদ্রিত হয়। সেখানে দেখা গেল ১৯৭৪ এ চিনে গিয়ে দেখলেন আগে যা কিছু দেখেছিলেন তা সব বদলে গেছে-বাতিল হয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উত্তাল তরঙ্গ আঘাতে যেমন ভেসে গেছে কিছু আগাছা-সে সাথে ভেসে গেছে বহু সুগন্ধি ফুলের গন্ধ। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে যখন চিনের ৬০ বছর পূর্তি উৎসব হল তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস বেঁচে থাকলে দেখতেন শক্তিমত্তার প্রদর্শনি, উচ্চ-প্রযুক্তি সামরিক অর্থনীতির সাম্রাজ্যবিস্তার কল্প-সজ্জা. প্রকৃতি বিনাশি বিদ্যুৎ-তরঙ্গ মালার জলোউন্মাদনা।

২০০৯ খ্রিস্টাব্দের সিন হুয়ার ( ১২/৯/২০০৯) এক তথ্যে জানা যায়:
চিনে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বৃহৎ বাঁধ নির্মাণের জন্য এ বৎসরের জুন পর্যন্ত ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। চিনের কর্মকর্তারা এর আগে জানিয়েছিলেন, চিনের মধ্যাঞ্চলে বর্তমানে নিমজ্জিত বা পরে নিমজ্জিত হবে এমন স্থান থেকে ১৪ লাখ লোককে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এলাকার অবশিষ্ট বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য কোন সময়সিমা ঘোষণা করা হয়নি। বাঁধের ব্যাপারে সমালোচনাকারিরা পুনর্বাসন কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। বাড়িঘর থেকে সরে যেতে বাধ্য করা গ্রামবাসিরা অভিযোগ করেছে তাদের যথাযথ চাকরি প্রশিক্ষণ এবং পুনর্বাসন তহবিল দেয়া হয়নি। ২০২০ সালের মধ্যে এলাকা থেকে আরো ৪০ লাখ লোককে সরে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সরকার অবশ্য বলেছে যে এদের স্থানান্তর করার সঙ্গে বাঁধের কোন সম্পর্ক নেই। হুবেই প্রদেশে অবস্থিত এ বাঁধটি বিশ্বের বৃহত্তম অবকাঠামো। এ বছরেই বাঁধটি থেকে পূর্ণ সামর্থ অনুযায়ি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জর্জিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জোলজি ও ই পি ওগম এর Fundamental of Ecology গ্রন্থে আফ্রিকার হাম্বারি নদির বাঁধ প্রসঙ্গে উলে­খ করা হয়েছে । সে বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ‘Producing hyde-clectri power’, সাথে সাথে মৎস্য ও কৃষি বান্দা উন্নয়ন ভাবনা কিন্তু দেখা গেল:

Displacement of people and cultures has created soil erosion and serious social upheaval as people were move to sweet able lands or to cities that were not prepared for them. The “regulated flow” downstream from the dam turned out to be more damaging than normal flooding which formerly enriched bottomlands each year free of charge. As a fertility of these lands declines, expensive fertilizers which the people cannot now afford, have to be imported. It will be many years before the full impact will be known.

এটা সব বাঁধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যা ‘ইকোলজিক্যাল ব্যাকলাস’ রূপে গণ্য হয়ে আসছে। আমরা যদি A poldervar chemistry of earths rest zoological society of America special paper 62(1955) পর্যবেক্ষণ করি তাহলে লক্ষ্য করা যায় বারিমণ্ডলের পানির পরিমাণ ও বণ্টন নিম্নরূপ:

পানির পরিমাণ ১০১৫টন আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা শতকরা হার
সমুদ্রের পানি ১৪১০ ৮৬.৫
হ্রদ পানি ০.৫ ০.০৩
মহাদেশিয় বরফ ২২ ১.৩
বায়ুমন্ডলের জলিয়বাষ্প ০.০১৩ ০.০০১
পাললিক শিলা ও পললে অবস্থিত পানি ২০০ ১২.২
মোট ১৬৩২ ১০০(প্রায়)

চার
আমাদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে টিপাইমুখ কিংবা ফুলেরতলা ব্যারেজ নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া নির্দিষ্ট গবেষণা কিংবা সমিক্ষা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ‘এসেসমেন্ট স্টাডি’ ছাড়া প্রকল্প সম্পর্কে অনুমাননির্ভর বক্তব্য বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি করবে। বাস্তবত নির্দিষ্ট কূটনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন হবে তেমনি যেমন-দিলি­ দুরস্ত।

টিপাইমুখ বাঁধের প্রকল্প পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে যৌথ নদি বৈঠকে বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে World Bank এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রণিত ঋঅচ-১ তৎকালিন মন্ত্রিপরিষদের ৭ম বৈঠকে অনুমোদন লাভ করে। অনুরূপভাবে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঋঅচ-৬ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সমর্থনে তৎকালিন সরকার ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। যে কারণে বর্তমানে এর বিরোধিতা যারা করছেন তা স্ববিরোধিতা ও দ্বিচারিতা নয় কি?

নেপাল, চিন, ভারত, বাংলাদেশ সমন্বয়ে পানি ব্যবস্থাপনার এক সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা আজ অনির্ণেয়। অথচ সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের ভৌগোলিক, পানিতাত্ত্বিক (Hydrological), জলবায়ুতাত্ত্বিক (Climatological), ভূ-তাত্ত্বিক (Geological), ভূ-কাঠামো বা ভূ-গঠনিক (Tectonical Foults) বিবেচনা করে আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা যদি সাম্যতা ও জৈবিক বাস্তবতায় সম্ভাব্য ব্যবস্থা প্রকল্পে গুরুত্ব দিলে নিঃসন্দেহে গণ ও পরিবেশবান্ধব এক চিন্তা প্রবাহের সূচনা ঘটবে। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন বিশেষত ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-চিন সমন্বয়ে এক যৌথ ভাবনা, যৌথ সমিক্ষা, যৌথ প্রায়োগিক কৌশল। এছাড়া বাংলাদেশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র ব্যারেজ নির্মাণ পরিকল্পনার আশু বাস্তবায়ন আমাদের প্রয়োজন, প্রয়োজন বঙ্গোপসাগরে ‘বে-ক্রস ড্যাম’ নির্মাণ-তাহলেই পানি ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

পাঁচ
পানি সম্পদের লাগামহীন ব্যবহার বন্ধ করতে আঞ্চলিক জাতিয় এবং স্থানিয় পর্যায়ে এমন পানি ব্যবস্থাপনা কৌশল গড়ে তুলতে হবে যাতে সকলের সমান ও যথেষ্ট পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। জাতিসংঘ সমিতির এক দলিল থেকে জানা যায়-
পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চল ও ভূখণ্ড তিব্র পানি সংকটের মধ্যে আছে। জনপ্রতি বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতায় বর্তমানে সবচে সংকটাপন্ন দেশগুলো হচ্ছে-কুয়েত, গাজা ভূখণ্ড, আরব আমিরাত, বাহারাইন, কাতার, মালদ্বীপ, লিবিয়া, সৌদি আরব, মাল্টা, সিঙ্গাপুর।

পানির বিবেচনায় পৃথিবীর সবচে সম্পদশালি অঞ্চল হচ্ছে গ্রিনল্যান্ড ও আলস্কা এলাকা। এরপরের পানি সমৃদ্ধ দশটি অঞ্চল হচ্ছে-ফরাসি গিনি, আইসল্যান্ড, গায়েনা, সুরিনাম, কঙ্গো, পাপুয়া নিউগিনি, গ্যাবন, সলেমান দ্বীপপুঞ্জ, কানাডা, নিউজিল্যান্ড। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পৃথিবীর এক বিপুল জনসংখ্যা গভীর পানি সংকটের মধ্যে পতিত হবে। ৪৮টি দেশে ২০ কোটি মানুষ অন্তত পানির অভাবে কঠিন জীবনের সম্মুখিন হবে। বর্তমানে নদি-হ্রদ ও জলাশয়ে প্রতিদিন ২০ লক্ষ টন বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এক লিটার দূষিত পানি আট লিটার পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানিকে দূষিত করে ফেলতে সক্ষম। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ি বর্তমানে বিশ্বব্যাপি বারো হাজার কে.এম৩ পরিমাণ দূষিত পানি রয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহৎ দশটি নদিতে বর্তমানে যে পরিমাণ পানি জমা থাকে তারচে বেশি সুতরাং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল রেখে যদি পানি দূষণ চলতে থাকে তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ নষ্ট পানির পরিমাণ হবে আঠারো হাজার কে.এম৩। এটি বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত সেচকার্যে মোট পানির পরিমাণের চেয়ে নয় গুণ বেশি। বলা দরকার বর্তমানে সারা পৃথিবীতে পানি সম্পদের যে ব্যবহার তার সত্তর শতাংশ ব্যবহৃত হয় সেচ কাজে। দুই হাজার পঁচিশ সাল নাগাদ উন্নয়নশিল দেশসমূহে পঞ্চাশ শতাংশ এবং শিল্পোন্নত দেশসমূহে আঠারোশ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি হ্রাস পাবে এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ এর যে ক্ষতি হবে তাতে একটি ভয়ংকর দুষ্ট চক্রের উদ্ভব ঘটবে। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে এক সমিক্ষায় দেখা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট পানির ৪০ শতাংশ মানসম্মত নয়। ইউরোপে মোট ৫৫টি নদির মাত্র ৫টি নদির পানি যথাযথভাবে বিশুদ্ধ এবং এশিয়া নগরির পাশ দিয়ে বহমান সকল নদির পানিই দূষিত। বিশ্বে ২২৭টি বড় নদির প্রায় ১৩৭টিতে বাঁধ নির্মাণ ও খাল কাটার কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছে। ১১৬টি নগরে সমিক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, আফ্রিকা অঞ্চলে ১৮ শতাংশ গৃহ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এশিয়াতে এটি ৪০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পানি-সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে গ্রিন-হাউস গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করার কথাও উলে­খ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই হ্রাসের পরিমান ১৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে যাতে জীব-বৈচিত্র্য শূন্য করা না হয় সেই বিষয়েও জাতিসংঘ প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

এই শতকে পানি নিয়ে বিবদমান দেশসমূহের মধ্যে যুদ্ধের আশংকাকে গুরুত্ব দেয়া না হলেও পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে এ ধরনের পাঁচশ সাতাশিটি বিবাদের ক্ষেত্রে মাত্র ২১টি সামরিক সংঘাতের রূপ নিয়েছিল। মোট ২৬১টি আন্তর্জাতিক নদি ১৪৫টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর ১৯টি প্রবাহিত হয়েছে ৫টি দেশের মধ্য দিয়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত-বাংলাদেশ-চিন শুধু নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পানি সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজন পানিব্যবস্থা পরিকল্পনা। নিঃসন্দেহে তাতে আঞ্চলিক-ভৌগোলিক ও জৈবজীবন ব্যবস্থাপনা স্ব-স্ব রাষ্ট্রিয় জাতিয় আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্তি¡ক পরিবেশ হয়ে উঠবে জনবান্ধব। মানুষের আনন্দময় এবং সমৃদ্ধ জীবনের অনুকূল।

 

চারবাক, বর্ষ ৯, সংখ্যা ১৩, ফেব্রুয়ারি ২০১০
শেয়ার করুন: