ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র একটি ডায়ালগ ছিল এরকম, ‘এখানে জলের বড় কষ্ট’। কথাটা সেঁটে আছে এখনো মনে। প্রকৃতির অপার রহস্য বাংলাদেশে জল নামক বস্তুটা এতো বিস্তর যে এখানকার মানুষ কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি একদিন এই আপাত সহজলভ্য বস্তুটা পয়সা দিয়ে কিনতে হবে। বহুজাতিক মাজেজায় প্রত্যন্ত গ্রামেও বোতল শোভা পায় এখন, মহার্ঘ্য জল মানুষ পয়সা দিয়ে কিনে খায়। কবিবন্ধুর খাতায় একবার একটি লেখা দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। লেখাটি ছিল-ধান-নদি-খাল এই তিনে বরিশাল। বরিশালের অবস্থা এরকম আছে কি না জানা নেই। তবে ক’দিন আগে রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহি যাবার সৌভাগ্য হয়েছে; শুনেছি মৃত পুনর্ভবা, আত্রাই, তিস্তার ক্রন্দন ধ্বনি।-মানুষের লোভ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবার দুর্দান্ত চলচ্চিত্র, হাজারো বিষণœ মুখ বালুকাবেলায় আটকে আছে। আবার সেই সুদূর প্রাচিনকাল থেকেই এখানকার মানুষের আদর্শিক জগতেও জলের গুরুত্ব অপরিসিম। গঙ্গাতো মা হিসেবেই পূজিতা। পাপমোচনে জলের শুদ্ধকারি ভূমিকা এখনো প্রশ্নাতীত। এর পেছনে হয়তো গ্রাম-বাংলার লোকায়ত জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডলটি অনেকাংশে দায়ি। গ্রিকচিন্তার সাথে যার সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র মানুষের জীবন ছিলো একান্তই সমাজকেন্দ্রিক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়; মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব কর্ম-কীর্তি আবর্তিত হতো সমাজকে ঘিরে। এই ভূ-খণ্ডে জল জনজীবনে নিয়মিত প্রভাবিত করেছে, কিন্তু জলকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো চেষ্টাই লক্ষিত হয়নি কোনোকালে। নদির নিয়মিত ধ্বংসলিলা মানুষকে প্রকৃতির শক্তির কাছে মাথা নত করতেই শিখিয়েছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি নদির মধ্যে ৫৪টি নদি ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। ৫৪টি নদির প্রায় প্রত্যেকটি নদির উপর ভারত কোনো-না-কোনো বাঁধ, ব্যারেজ বা ড্যাম নির্মাণ করেছে অথবা করতে শুরু করেছে। এই পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপৎজনক দিক হলো আন্তঃনদি সংযোগ প্রকল্প। বিশ্ব ইতিহাসে নদির গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে জলের ব্যবহারের উদ্যোগ এই প্রথম। ভারত তার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সারাদেশের নদ-নদির উপর বাঁধ নির্মাণ করছে, আর এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে পছন্দের এলাকা আদিবাসি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল। একাত্তরের আগে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যেসব বিরোধ ছিলো তার অন্যতম একটি ফারাক্কা ব্যারাজও। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ‘দি ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি ১৯৬০’ এর মাধ্যমে ভারত পাকিস্তান একমত হলেও ফারাক্কা ইস্যুটি অমিমাংসিতই থেকে যায়। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১দিন সময়কালের জন্য যে প্রকল্প চালু হয়েছিল পরবর্তিকালে তা আর বন্ধ করা যায়নি। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সম্পাদিত সকল চুক্তির মধ্যে ১৯৭৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিটিতেই শুধুমাত্র গ্যারান্টি ক্লজ এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে তৃতীয় পক্ষের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ ছিলো।
দক্ষিণ এশিয়ায় জলের প্রধান উৎস ০৩টি।
১. হিমালয় ও তদসন্নিহিত এলাকা থেকে বয়ে আসা নদির জল, বরফগলা জল।
২. বৃষ্টিপাতের জল।
৩. ভূ-গর্ভস্থ জল।
বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়াকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। এখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাত ১১৬৪ মিলিমিটার। তবে বর্তমানে এখানে জলের দু®প্রাপ্যতা ঘটছে দ্রুতলয়ে।
বাংলাদেশ তার জলপ্রবাহের জন্য চিন-ভারতের উপর নির্ভরশিল। তবে আশংকার কথা হচ্ছে, কৃষি-শিল্প ইত্যাদিকে ঘিরে চিন-ভারতের জলের ক্ষুধা ক্রমেই বাড়ছে। ভারতে ১৯৫০ সালে জনপ্রতি জলের প্রাপ্যতা ছিলো ৫ হাজার কিউবিক মিটার। ২০০৫ সালে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ কিউবিক মিটারে। ২০২৫ সাল নাগাদ এটা এক হাজার কিউবিক মিটারের নিচে নেমে আসবে তা ধারণা করা যায়। আবার ভারতের নদি প্রবাহের প্রধান তিনটি ধারা সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এর দু’টির সাথেই বাংলাদেশ জড়িয়ে আছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদি রয়েছে। বাংলাদেশের জল প্রাপ্যতার ৮৫ শতাংশই নির্ভর করে এই গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে। ভারতে বিশ্ব জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগের বাস হলেও বিশ্ব জলসম্পদে তার নিস্যা ২৫ ভাগের এক ভাগ। আর ক্রমেই এ ব্যবধান বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশের সাথেই নয় ভারতের পাকিস্তান ও নেপালের সাথেও জলসিমা রয়েছে। আর সেখানে জল জন্ম দিচ্ছে ক্ষোভ যা দির্ঘমেয়াদে বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। অনুরূপভাবে পাকিস্তানের সাথে রয়েছে আফগানিস্তানের বিরোধ। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সম্মিলিত অববাহিকায় বাংলাদেশ সিমান্তে রয়েছে ৭ ভাগ অঞ্চল, নেপালে ৯ ভাগ, চিনে ২০ ভাগ এবং ভারতে ৫৮ ভাগ। স্বাভাবিক কারণেই এই নদিগুলোর অববাহিকায় জল প্রত্যাহার বা নিয়ন্ত্রণে উক্ত সকল অংশিদারদের মতামত ও সম্পৃক্ততা জরুরি, যা ভারত বা চিন কেউই মানছে না। অবশ্য ভারত যখন চিনের সাথে এ বিষয়ক কথা বলে তখন তারা এটাকে ক‚টনৈতিক টেবিলে রাইট বেইজড এপ্রোচ নিতে চেষ্টা করে, চিনের কাছে হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য চায়। কিন্তু একই নদিতে বাংলাদেশের সাথে সে বিষয়গুলো বেমালুম ভুলে যায়।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি ৬ জনের ১ জন নিরাপদ পানিয় জলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রতি ৮ সেকেন্ডে জলবাহিত রোগে মারা যায় একজন করে শিশু। প্রতি বছর ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয় ২২ লক্ষ মানুষের, যার ভেতর ১৮ লক্ষই শিশু। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, সার, কিটনাশক, আর্সেনিক দূষণ, বাঁধ প্রকল্পের জলাবদ্ধতার ফলে লবণাক্ততা, বাঁধের ফলে নদির মৃত্যু সারা পৃথিবীর সামান্য সুপেয় জলকে আরও বেশি দু®প্রাপ্য, দূষিত, অপেয় করে ফেলছে। পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ জল হলেও মাত্র ২.৫ ভাগ সুপেয়। তার আবার ০.৩ ভাগ মাটির উপরে, সহজলভ্য হিসেবে আছে বাকি ৩০.৮ ভাগ মাটির নিচে এবং ৬৮.৯ ভাগ জমাট বেঁধে আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। যেটুকু সুপেয় জল পাওয়া যায় তাও মানুষের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট হিসেবেই বিবেচিত হতো এর জন্য মানুষকে তেমন কোনো মূল্য দিতে হতো না। কয়েকটি কারণে জল মহার্ঘ্য বস্তু হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে যে কৃষির সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে তাতে জলের প্রয়োজনিয়তা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। এই প্রয়োজনে যেসব বাঁধ দেয়া হয়েছে তার ফলে বহু নদ-নদি, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক জলাধার শুকিয়ে গেছে। কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা না করে তাকে জলাশয়ে ফেলা এবং জমিতে ব্যবহৃত সার-কিটনাশক জলকে ক্রমবর্ধমান হারে দূষিত করে ফেলছে। ভূ-গর্ভস্থ জলের অধিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারের ফলে ভূ-গর্ভস্থ জলের দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি ও দূষণ ঘটছে। জীবন ও প্রকৃতির প্রয়োজন আমলে না নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত উপায়ে নগরায়ণ, উন্নাসিক ভোগবাদি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সর্বশেষ জলবাণিজ্য, সেচ যন্ত্রপাতির ব্যবসা, বাঁধ নির্মাণের জন্য বৈদেশিক ঋণবাণিজ্য এসবের মিলিত প্রয়াসে জলবাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠছে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায়। রাসায়নিক ও কিটনাশক মিশ্রিত গার্হস্থ্য ময়লা, শিল্পবর্জ্য জলকে কলুষিত করছে। খোদ ভারতেই ৫০ কোটি মানুষ ময়লা আবর্জনা ফেলছে নদিতে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার লোকসংখ্যা প্রায় ১৭০ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ এ অঞ্চলে লোকসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২৩০ কোটিতে। বিশ্বে জনপ্রতি গড়ে জলসম্পদ আছে ৬ হাজার ২৩৬ কিউবিক মিটার। এখানকার প্রধান সমস্যা জলনির্ভর কৃষিব্যবস্থা। এখানে ব্যবহৃত জলের ৯১ ভাগ ভোক্তা কৃষিখাত। ফলে বিষয়টি সরাসরি খাদ্যনিরাপত্তার সাথেও জড়িত।
এশিয়া, আফ্রিকায় জলের যে ব্যবহার হয় তার একটা বড় অংশ উন্নত বিশ্বের ভোগে লাগে। আফ্রিকার কৃষকরা যে সবজি ফলায় তা শোভা পায় ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় সুপার মলে। কেনিয়ার স্ট্রবেরি, শিম আর গোলাপ ফলাতে যে জল লাগে তার জোগান দিতে গিয়ে সেখানকার খাল বিল শুকিয়ে গেছে। মিশরে সবজি রপ্তানি বাঁধাগ্রস্ত করে এমন কোনো বিক্ষোভের উপর সামরিক
হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছে সরকার। আর এই সবজি উৎপাদন পুরোটাই জলনির্ভর। ভারতের উত্তর প্রদেশে কোকাকোলা কোম্পানি প্রতিদিন ২০০ কিউসেক পানি উত্তোলন করছে আর সেখানকার নারিদের গৃহস্থালি কাজের জন্য পানি আনতে হাঁটতে হচ্ছে ১৭ কিলোমিটার। পুরো এলাকায় দেখা দিয়েছে খরা। এই খরা এখন সারা বিশ্বেরই সমস্যা। দিনে দিনে বেশি বেশি করে মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে আর জলের অধিকার চলে যাচ্ছে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের বাইরে। ভিভেন্দির অঙ্গ সংস্থা ইউএস ফিল্টার এর মাইক স্টার্ক বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের প্রতিদিন জল দরকার এবং কোম্পানিগুলোর জন্য এটা লাভজনক বিনিয়োগের শক্তিশালি ক্ষেত্র।’ তাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদির জল নিয়ে তুরস্কের সাথে ইরাক ও সিরিয়ার ঝগড়া তাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জর্ডান নদির ৮০ ভাগ জল ইসরায়েল আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাতে বঞ্চিত হচ্ছে জর্ডান, লেবানন, প্যালেস্টাইন। বাংলাদেশের জল আটকে রাখছে ভারত। চিন, ভারত-বাংলাদেশের জল কেড়ে নিচ্ছে বাঁধ দিয়ে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের জল নিয়ে নতুন করে শুরু হচ্ছে যড়যন্ত্র; পরিকল্পনা হচ্ছে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবার। এক দেশের জল অন্য দেশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে দির্ঘ পাইপ লাইন।
২০০০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে বৃহৎ বাঁধের সংখ্যা ছিলো ৪০,০০০। বাঁধগুলোর ৯০ ভাগেরও বেশি ’৫০ সালের পর নির্মিত। এসময় থেকেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে ব্যয়বহুল জল অবকাঠামো নির্মাণ আরম্ভ হয়। সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবেই বিশ্বব্যাপি জল ও ভূমির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং উন্নত কৃষি উপকরণ ব্যবহারের ডাক দেয়া হয়। ফাও এর উচ্চ ফলনশিল (উফশি বা এইচওয়াইভি) বিজ ব্যবহার সম্পর্কিত কর্মসূচি, ইউনেস্কোর খাবার জল সম্পর্কিত কর্মসূচি প্রভৃতির মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ঋণ, অনুদান, প্রচারণা প্রভৃতির মাধ্যমে এ নীতি বাস্তবায়নের সহযোগি ভূমিকা পালন করেছে। বিংশ শতকের শুরুতে শুধু কৃষি বাবদ প্রত্যাহৃত জলের পরিমাণ ছিল ৫১৩ ঘন কিলোমিটার, ’৫০ সালে ছিল ১১২৪ ঘন কি.মি., ’৯৫ সালে এসে এটা দাঁড়ায় ২৫০০ ঘন কিলোমিটারে। কিটনাশক ও সার প্রয়োগও এই সময়ে একই রকম উচ্চ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জল ব্যবস্থাপনা সাম্রাজ্যবাদি নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতায় অনুন্নত বিশ্বের পুরোটা জুড়েই অব্যাহত থেকেছে স্থানিয় বিশেষজ্ঞদের বাঁধা, বিপর্যয়ের হুঁশিয়ারি ও সুপারিশ উপেক্ষা কিংবা ধামাচাপা দিয়ে। জলের ঘাটতি নতুন শতাব্দিতে এমন লোভনিয় পণ্যে পরিণত করেছে যে শুধু অবকাঠামো বাবদ বর্তমানে নিয়োজিত বেসরকারি বিনিয়োগ ১৬-২০ বিলিয়ন ডলার। সামনের বছরগুলোতে ১২৫ বিলিয়ন ডলার হারে যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানিয় বিনিয়োগও প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। শিল্পখাতে জল প্রত্যাহার ৭৫০ ঘন কি.মি. থেকে ৯৫০ ঘন কি.মি.।
জনপ্রতি বিশুদ্ধ জল প্রাপ্যতায় বর্তমানে সবচেয়ে সংকটাপন্ন দেশগুলো-কুয়েত, গাজা ভূখণ্ড, আরব আমিরাত, বাহারাইন, কাতার, মালদ্বীপ, লিবিয়া, সৌদি আরব, মাল্টা, সিঙ্গাপুর। জল বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালি অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড ও আলাস্কা। এরপরের পানি সমৃদ্ধ দশটি অঞ্চল-ফরাসি গিনি, আইসল্যান্ড, গায়েনা, সুরিনাম, কঙ্গো, পাপুয়া নিউগিনি, গ্যাবন, সলেমান দ্বীপপুঞ্জ, কানাডা, নিউজিল্যান্ড। আশংকা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে ৪৮টি দেশে ২০ কোটি মানুষ জলের অভাবে কঠিন জীবনের সম্মুখিন হবে। বর্তমানে নদি-হ্রদ ও জলাশয়ে প্রতিদিন ২০ লক্ষ টন বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এক লিটার দূষিত পানি আট লিটার পর্যন্ত বিশুদ্ধ জলকে দূষিত করে ফেলতে সক্ষম। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ি বর্তমানে বিশ্বব্যাপি বারো হাজার কে.এম৩ পরিমাণ দূষিত জল রয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহৎ দশটি নদিতে বর্তমানে যে পরিমাণ জল জমা আছে তারচেয়ে বেশি। এই হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ নষ্ট জলের পরিমাণ হবে আঠারো হাজার কে.এম৩। ইউরোপে মোট ৫৫টি নদির মাত্র ৫টি নদির জল যথাযথভাবে বিশুদ্ধ এবং এশিয়া নগরির পাশ দিয়ে বহমান সকল নদির জলই দূষিত। বিশ্বে ২২৭টি বড় নদির প্রায় ১৩৭টিতে বাঁধ নির্মাণ ও খাল কাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। ১১৬টি নগরে সমিক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, আফ্রিকা অঞ্চলে ১৮ শতাংশ গৃহ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এশিয়াতে এটি ৪০ শতাংশ।
বিগত শতাব্দির প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক জলআইনে ‘সার্বভৌমত্ব’-র তত্ত¡ কার্যকরি ছিলো আর সেটিকে পুঁজি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও মেক্সিকোকে জলঅধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিলো দির্ঘদিন। ১৯৭০ সালের হেলসিংকি রুলের সিমাবদ্ধতা চিিহ্নত করে জাতিসংঘ ইণ্টারন্যাশনাল ল কমিশনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৯৭ সালে প্রস্তাবটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহিত হয়। বাংলাদেশের মানুষের জলের লড়াই তার স্বাধিনতা রক্ষার স্বার্থেই জরুরি। জলকে বাজারের অন্য দশটি সাধারণ পণ্যের মতো বিবেচনা করার সুযোগ নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য কম হওয়ার প্রধান রাজনৈতিক কারণ হলো দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাসের দুর্বলতা। জলের মতো জরুরি প্রসঙ্গেও যার ছাপ পড়ছে। আবার কোনো কোনো দেশের জলকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদি মানসিকতাও এর জন্য দায়ি। এই শতকে জল নিয়ে বিবদমান দেশসমূহের মধ্যে যুদ্ধের আশংকাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পাঁচশ সাতাশিটি বিবাদের ক্ষেত্রে মাত্র ২১টি সামরিক সংঘাতের রূপ লাভ করেছিলো। মোট ২৬১টি
আন্তর্জাতিক নদি ১৪৫টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর ১৯টি প্রবাহিত হয়েছে ৫টি দেশের মধ্য দিয়ে। ভারত-বাংলাদেশ-চিন শুধু নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জল সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যথাযথ জলব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। আবার বলিভিয়া থেকে বেচটেল নামক বহুজাতিক জলব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠানের পাততাড়ি গোটাবার কাহিনি এখনো অতীত হয়ে যায়নি।