কথা হচ্ছিল সাতপাড় নিয়ে। কথক আমাদের সরকারি নজরুল কলেজের সহকারি অধ্যাপক রবীনবাবু মানে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস। ম্যানেজমেন্টের প্রভাষক জিয়ার রুমে আমরা তিনজন শরীর ছড়িয়ে বসেছিলাম। মূল কলেজ ভবনের গা ঘেঁষে বহিরাগত শিক্ষকদের এই মেস। লম্বাকৃতি মেসের আড়াআড়ি টিনের বেড়া দিয়ে ছোট ছোট রুম বানিয়ে নিয়েছে শিক্ষকরা।
ছেলেমেয়েদের কথাবার্তার শব্দ ফিকে হয়ে এসেছিল অনেক আগেই— কলেজের শেষ ঘণ্টা পড়তেই আমরা আরেকটু বে-আব্রু হয়ে যাই। ভ্যাপসা গরম, সেই সঙ্গে টিনের উষ্ণ আঁচ। জিয়ার ফ্যানটা নষ্ট, কয়েল পুড়ে গেছে, অগত্যা হাতে হাতে কাগজের টুকরো, শার্টের বোতাম খোলা আমাদের। রবীনবাবু কপালে ভাঁজ ফেলে, স্মৃতিকাতর চোখে জিয়ার দিকে ফিরে বললেন,
‘তয় সেই পাথারের আভাষডাই আপনারে দেহাতি পারব এ্যাহন, অথৈ বলতি যা বুঝায়… বিলে-আকাশে একাকার, আদিগন্ত গ্রাস করা জলের সেই উল্লাস আর নাই। পথ বলতি পারেন, আবার বাঁধও বলতি পারেন—সাঁকোর নাহান বিলের ভিতর ছড়ায়্যা গিয়া এক গাঁওয়ের সঙ্গে আরেক গাঁওয়ের সংযোগ হইছে।
সাতপাড়ের প্রকৃতিতে জলের আলাদা একটা রূপ আছে; সেই রূপের সঙ্গে যুক্ত আকাশের রকমারি খেয়ালিপনা। প্রথমবার এসেছিলাম ভরা-বর্ষা মৌসুমে, পুকুর খাল বিল হাওড় বৃষ্টির পানিতেই তখন একাকার। সেই সঙ্গে ছিল বড় বড় নালা খাল নদীর শাখা-প্রশাখা দিয়ে ধেয়ে আসা বানের জল।
‘যে জলের কোনো কিনার ছিল না— এসব বাঁধের গতরে হামলায় পড়্যা, বলতি পারেন, সেই জল তার দিগন্ত খুঁজ্যা পাইছে। ভুল কলাম নাকি জিয়া সাব?
রবীনবাবু চেইন স্মোকার। জিয়াকে একটু আনমনা মনে হয়। সে সিগারেটের প্যাকেটটা রবীনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সোমেন নামে আমার এক ছাত্র আছে— ছেলেটা মেধাবি। কলেজ থেকে ফিরে বিকেলের দিকে প্রায়ই সে আমার কাছে আসে। যাই হোক, বহুবার এড়িয়ে অগত্যা একদিন তার বাড়ি গেলাম বেড়াতে। শহিদ ভাই ভাবেন একবার, এই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আমরা দু’জন প্রায় দেড় মাইল হাঁটলাম। তারপর সে নৌকায় উঠাল, মিনিট পনের নৌকায় চলার একপর্যায়ে পচা কচুরি-কাদার মণ্ডে আটকে গেল আমাদের নৌকা। হাঁটুর ওপর প্যান্ট ফোল্ড করে সেই মণ্ড মাড়িয়ে কিছুদূর চলার পর উঠলাম কাঁচা কচুরিপানার ধাপের ওপর। শরীরের টাল সামলে সেই ধাপের ওপর দিয়ে হেঁটে কিছুক্ষণ পর আবার একটা কঞ্চির মতো সরু উঁচু মাটির রাস্তা পাওয়া গেল। সেখানেও মিনিট বিশেক চলার পর ওদের বাড়ি…
করোগেটের টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে রবীনবাবু জিয়ার চৌকিতে বসেছিলেন। এবার শরীরটাকে সোজা করে কিছুটা উত্তেজিতভাবেই বললেন।
‘আরে মেয়া, আপনি তো তবু হাঁট্যা, নায়ে চড়্যা, ক্যাদাজল ঘাট্যা এক দ্যাড় ঘণ্টায় ওগে বাড়ি যাতি পারছেন। আপনি কি জিগাইছিলেন এক পুরুষ আগে ওগে বাড়ির মানুষ আমাগে সাতপাড়ে ক্যাম্বায় আইছে? তহন বিল বলতি নরম প্যাঁকের ওপর জল, আরালি-নল-নটা-কলমির জলজ জঙ্গল আর মানুষ সমান দেশাল কচুরির ঝাড়। টানলি সরে না, সরলিও তহনি অন্য কচুরির ঝাঁক আস্যা ভর্যা ফেলায়— এটটার লগে আরেটটা শিয়ড়ে বান্ধা। অন্য পাড়ায় যাতি গেলি ভোর বেলায় উঠ্যা সারাদিনের খাবার আর মাটির কলসিতি জল নিয়া নায়ে উঠতি হ’তো। নায়ে কম কর্যা দু’জন জোয়ান পুরুষ লাগত— একজন লগি দিয়া কচুরি সরাব— অন্যজনে লগি দিয়া নাও ঠ্যেলব। আর জল? জলের কথা কি কব মেয়া, জলজ জঙ্গলের পাঁচন মিশানো থিকথিকা কালা জল। শরীলে লাগলি শরীল চুলকোয়, ঘা-পাচড়া জাঁক্যা ধরে। আমাগে এ অঞ্চল নিয়া একখান প্রবাদ আছে— শোনছেন না-কি জিয়া সাব?
‘সাতপাড়ে আমিও নতুন রবীনদা। না বললে জানব কি করে!
রবীনবাবু জিয়ার ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলতে থাকেন— ‘জল মাটির এই স্বভাবের কারণে মানুষ একসময় এ অঞ্চলে আসতি ভয় পাতো। বিল অঞ্চলের গাঁও তো! বাপ-ঠাকুরদারা কতো, ‘সিংগা সাতপাড় বয়রাবাড়ি/ কেউ যায় না কেরুর বাড়ি।’ বুঝতি পারলেন? হেঁয়ালি করে তাকালেন আমার দিকে।
যতদূর শুনেছি রবীনবাবু এখানে বসত গড়েছেন বছর তিরিশেক হবে। তার আগে ছিলেন নিজামকান্দি— বাবার ভিটেয়। সে আরো ভেতরে। রবীনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা আদিম উৎসের গন্ধ টের পাই। মনে হয় লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন এই গ্রহে এখনো এমন বহু অঞ্চল রয়েছে যার আস্বাদ পেতে এই শতাব্দি পর্যন্ত মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই রকম এক উদগ্রিবতা নিয়ে আমি রবীনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘জলের পোকা দ্যাখছেন— আমাগে বিল অঞ্চলের মাইনষিরা এক সময় চার হাত-পায় জল-ক্যাদার সঙ্গি লড়াই কত্তি কত্তি শক্ত মাটির উপর খাড়া হতি শেখছে। এই সাতপাড়ের মাটি জাগছে কয়দিন? যে জাগায় বস্যা আমরা গল্প করতিছি— এহেনে মাটি খুড়লি বিশ হাত নিচে দ্যাখবেন কয়লার নাহান কালা ভুষা মাটি। রোদি শুকনির পর আগুনি ধরেন— মাটি দাউ দাউ করি জ্বলি ওঠবে।
‘তো যাই হোক কতিছিলাম এই মাটির গল্প। বান তো আর প্রতি বছর হয় না, বর্ষারও কাল-অকাল আছে। খরা যে আসে না এমন না। তহন এই বিল বাওড়ের চেহারাখান দাঁড়ায় অন্য রওম। বিলজোড়া সেই বিশাল কচুরিপানার স্তুপ নিচের ক্যাদার সঙ্গি মিশ্যা গিয়া পচে। শুধু কচুিরপানার কথাই বা বলি কেন— জলাভূমির শ্যাওলা, শাপলা মালঞ্চ ঝামটি জলদুর্বা, কলমিলতা নল খাগড়ার বিশাল একখান পচন উৎসব শুরু হয় যেন। রোদে শুকায়ে ভুষার নাহান দেখতি হয়। কিন্তু কত আর শুকোবে, আপনি গিয়া দাঁড়ান— কোমর অবধি দেবে যাবেনে। পরের বছর নালা খাল বায়্যা নদীর পলি আস্যা একটা স্তর পড়ে। এই কত্তি কত্তি দীর্ঘ সময় ধর্যা আমার বাপ-দাদাগে চোহের সামনেই ভূমিগুলা জাগে ওঠে। মানুষের আবাস এখানে খুব বেশি দিনের নয়। তো প্রবাদটার মানে কিছুটা আঁচ করতি পারছেন নিশ্চই?
রবীনবাবুর বর্ণনায় সাতপাড়ের আঞ্চলিক টান সাবলিলভাবে প্রকাশ পায়। শাসন করেন না, প্রয়োজনও বোধ করেন না। আমরা এক উৎসমুখে প্রবেশ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘ভূমির লোভে কিংবা জীবনের টানে যাই কন, নতুন জাগ্যা ওঠা এই দুর্গম অঞ্চলে কেউ বাসের জন্যি কেউবা চাষের জন্যি আসা-যাওয়া শুরু করে। কিন্তু এ মাটি বড় শত্তুর মাটি। কালা কুচকুচ্যা তার রঙ। হাঁটলি পা কালা হয়্যা যায়। আর ক্যাদা, য্যান গুড়া কয়লার গাদ, হাত-পায় লাগলি চুলকয়। চুলকতি চুলকতি ঘা পাঁচড়া। জলের সেই কামড়ের সঙ্গি আছে বুনো মশার উপদ্রপ। বোঝতি পারলেন, সেই শুরুতি এই সাতপাড় সিংগায় যারা ভিটা গড়তি আরম্ভ করছিল, দুঃসাহসি সেইসব মাইনষেরও সময় লাগছিল এই বিরান বিপদজনক জলমাটির সঙ্গে নিজেগে খাপ খাওয়াই নিতি। বহুকাল পর্যন্ত এসব পরিবারের লোকরা নিজেগে বাসযোগ্য ভিটাটুক ছাড়্যা ভিন গাঁয়ে আÍিয় স্বজনের বাড়ি যাত না, কেউ তাগের কাছে আসতিও সাহস পাতো না। সেরেফ রোগ-বালাইর ভয়ে। সেই ভয়ের গহন থেক্যাই তৈরি হইছেল অন্তমিলের এ বচনটি।
রবীনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বেলা নামতে শুরু করেছে। কলেজ ক্যাম্পাসের সমস্ত আলোড়ন এখন নৈঃশব্দে লীন। আজ বৃহস্পতিবার। সামনে পর পর দু’দিন ছুটি। পাশের রুমের শিক্ষকরা ক্লাস সেরে সরাসরি বাড়ি চলে গেছে। জিয়ারও ঢাকা চলে যাওয়ার কথা-জরুরি কি কাজে আটকে গেছে ও।
কলেজের পেছনে একটা পুকুর, পুকুরের ওপারে রবীনবাবুর বাড়ি, গাছপালার ঝোপের ফাঁক দিয়ে কিঞ্চিৎ দেখা যায় মাত্র। সামনের দু’দিন ওই বাড়ির দু’এক টুকরো গার্হস্থ্যশব্দ ছাড়া আমরা মোটামুটি একটা স্তব্ধ জগতে পতিত হব। রবীনবাবু বাড়ি ফেরার জন্য হাত বাড়ালে আমি বললাম-তাহলে আমাদের জল দর্শনের ব্যাপারটা…
সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, চান কর্যা একটু ফ্রেশ হয়্যা আসি। ঘামে একেবারে নাইয়া গেছি। আপনারাও তৈরি হয়্যা নেন।
রবীনবাবু চলে যেতেই পেছনের পুকুর পাড় থেকে একটা মেয়ে এসে সরাসরি জিয়ার সামনে দাঁড়ায়। কুমড়োলতার মতো লকলক করে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে, দেখলেই বোঝা যায় চোখেমুখে একশ’ ভাগ ছেলেমানুষি ভাবখানা, শুধু প্রকৃতিগতভাবেই শরীরটা বর্ষার দিঘির মতো উপচে উঠেছে। সদ্য ফোটা একটা শাপলা যেন, ঢেউয়ে মৃদু কাঁপছে।
কিছু বুঝতে না পেরে আমি চুপচাপ বসে থাকি। জিয়া অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু বলেওনি।
দেখলাম, জিয়া অনুত্তেজিত স্বরে ওকে বলল, তৈরি থেক-আজ রাতেই…
কণ্ঠের দৃঢ়তা খেয়াল করার মতো। মেয়েটি আর অপেক্ষা না করে চলে গেল।
মাথা ঝাড়া দিয়ে জিয়া স্বাভাবিক হতে চাইলেও ওর চেহারায় কঠিন সংকল্পের আভাস স্পষ্ট।
তোয়ালে লুংগি সাবান বের করে জিয়া আমার সামনে দাঁড়ায়।
— মিতুল! রবীনবাবুর ছোট মেয়ে। ওকে নিয়ে আজ রাতেই সাতপাড় ছেড়ে চলে যাব। এক মাসের ছুটি ম্যানেজ করেছি কিন্তু সাতপাড়ে আমি আর ফিরব না। অন্যখানে বদলির একটা ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছি…
— ভাল, আগে বলবে না! প্রেমে পড়ে মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া এ আর এমন কি। তাছাড়া তুমি চাকরি করছ, সক্ষম পুরুষ।
— রবীনবাবু তার স্ত্রী-কন্যাকে খুবই ভালবাসেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে তিনি একজন নিষ্ফলা পুরুষ। কিছুটা অক্ষমও। মিতুল ওর মেয়ে নয়। মিতুল যার মেয়ে তার সঙ্গে মিতুলের মায়ের সম্পর্ক এখনো অটুট। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটার কোনোটাই রবীনবাবুর পক্ষে সহজভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
— তাহলে?
— জানি না।
— তোমাদের ব্যাপারে রবীনবাবু স্ত্রীর মতামত কি? তার সায় আছে?
— আমি মিতুলকে সুখি করতে চাই।
— রবীন বাবুর কি হবে?
— জানি না।
অনেকক্ষণ পর জিয়া আবার বলে ওঠে।
— বর্ষায় চাঁদনি রাতে তিনি প্রায়ই বিলে নৌকা নিয়ে চলে যান, একা একা চাঁদ দেখেন। চাঁদ দেখতে দেখতে হয়ত… জীবন য্যামন, জানি না… চলেন…
কলেজের বিশাল পুকুরে আমরা অনেকক্ষণ গোসল করলাম। সাঁতার কাটলাম। আমাদের সাঁতার মানে জলের তোলপাড়, জিয়া কিংবা আমি কেউই ভাল সাঁতার পারি না। পুকুরের ঠাণ্ডা টলমল জলের নিরবচ্ছিন্ন ঢেউ ঘাটের পাশে কলমিলতা জলদুর্বার ঝাড়ে গিয়ে মৃদু দোলা দিচ্ছিল। কলমিলতার ফুল থেকে পাতায় উড়ে গিয়ে বসছিল বাহারি রংয়ের প্রজাপতি জলফড়িং।
জিয়ার রুমে ফিরে আমরাও দ্রুত তৈরি হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেলি। পুঁটি মাছের ঝোল আর সবজি। হাঁস-মুরগি ছাড়া এখানে মাংস পাওয়া যায় না। পাশের গ্রামের দশ-বার বছরের একটি ছেলে হাসানই সবকিছু করে। সামনের দু’দিন আমরা কোথায় কোথায় যাব, কার সঙ্গে দেখা করব— দু’জনে তার একটা ছক তৈরি করে ফেলি। জিয়া তার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা একান্তই গোপন রাখতে চাইলেও রবীনবাবুর অসহায়ত্ব আমাকে পীড়া দিচ্ছে। হাসান আমাদের জন্য ফ্লাস্ক ভরে চা বানিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে রবীনবাবু গুন গুন করতে করতে ভেতরে এসে ঢোকেন— কই আপনারা প্রস্তুত? হাসানের হাতে এঁটো প্লেট দেখে যেন তিনি স্বস্তি পেলেন।
‘খাওয়া দাওয়ার পর্ব তাহলি শেষ। চলেন, রওনা দেই?
সাতপাড় কলেজ চত্বর পেছনে ফেলে নিচু ধানি জমির আলপথে আমরা তিনজন এগিয়ে যাই। সত্যি বলতে কি, জলাভূমি আর বিল-বাওড়ের আকর্ষণেই বারবার সাতপাড়ে আসা। গতবারের বর্ষায় দেখেছি চান্দার বিল। আজ আমরা চলেছি চান্দার বিলের উল্টোদিকে।
ধানি জমির আলপথ থেকে ঢাল বেয়ে সামান্য উঁচু মেঠো পথে উঠতেই দৃশ্য পালটে গেল। মনে হল এই উঁচু পথ, এটা বাঁধও বটে (রবীনবাবুর ভাষ্য অনুযায়ি), নইলে এতক্ষণ যে পথ বেয়ে হেঁটে এলাম সেখানে কোমর জল থাকার কথা। বাঁধের ওপাশে খৈ খেজুর ঢোলকলমি আশশ্যাওড়ার ঝোপ জল পর্যন্ত নেমে গেছে। আর জলের ওপর অনেকদূর পর্যন্ত কচুিরপানা বাঁধকে বেড় দিয়ে আছে যেন। তারপর জল-চতুর্দিকে দু’তিন মাইল তার বিস্তার হবে। জলের মধ্যে দু’একটা হিজল গাছ গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক মাঝখানটায় মাটির ঢিবির ওপর একটা বিশালাকৃতির অশ্বত্থ গাছ চারদিকে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যেন সমস্ত বিলটাকে শাসন করছে। জিয়া তার গাম্ভির্য কাটিয়ে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘শহিদ ভাই— ওটা হচ্ছে আমাদের আর্কেডিয়া, সাতপাড়ের ইহ জ্বালা জুড়াবার নিরাপদ স্বর্গ।
জিজ্ঞেস করলাম, কেমন?
‘যেমন ধরেন সাতপাড়ের এক যুবক তার প্রেমিকাকে হৃদয় নিবেদন করবে, কোথায়— ঐ অশ্বত্থতলে। প্রেমিকা কিছুতেই প্রেমিকের কাছে ধরা দিচ্ছে না, তাকে গলা টিপে শেষ করতে হবে, কোথায়? ঐ অশ্বত্থতলে। জীবনের সর্ব বিষয়ে পরাস্ত পুরুষ গলায় দড়ি দেবে, কোথায়? ঐ অশ্বত্থের ডালে। শরীরের আগুন নেভানোর জন্য ফেলনা শেকড়-বাকড়হীন একটা মেয়ে ফুসলানো গেছে, তাকে তছনছ করতে হবে, কোথায়? না, ঐ…
রবীনদা আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘ওহনে একখান আখড়া আছে— রাধাকৃষ্ণের। যতই পানি থাক না ক্যান, আখড়া ডুব্যা না যাওয়া পর্যন্ত সন্ধ্যার পরপরই ঢোলের বাড়ি পড়বে। শুকনর সময় বৌ-ঝিরাও গান শুনতি যায়। তখন আখড়াটা দারুন জম্যা ওঠে।
এটাও তো বিল, না-কি?-আমি জিজ্ঞেস করি।
‘তা, বলতি পারেন। বিলের একখান কংকাল বটে। আমাগে উঠানের পর কি-না, তাই আর বিল বল্যা মনে হয় না।
হাসতে থাকেন রবীনবাবু।
‘তয় আমরা এহান থেক্যাই নৌকায় উঠতি পারি। ওই পুবি তাকান, ওহনে খাল পার হয়্যা আমরা বড় বিলি উঠতি পারবানে। কি কন জিয়া সাব?
— আমাকে আর জিজ্ঞেস করা কেন, নৌকা নিয়ে নেন যদি ভাল হয়’।
‘কিন্তু পথ তো অনেক জিয়া সাব। সেই পুঁইশুর, পিঠাবাড়ি ফেলায়া বিলবাজনিয়া। আমরা বিলবাজনিয়া ছাড়ায়্যা আরো ভিতরে ঢুক্যা পড়ব। একটা ভটভটি নৌকা পালি ভাল হত। সময় নিয়া ভাবা লাগত না। জানেন তো আজ চাঁদনি আছে!
রবীনবাবুর কথা শেষ করার আগেই একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে তাকে নমস্কার করল—
‘মাস্টার মশাই, বাবা আপনাগে এট্টু দাঁড়াতি কইছে। খাতি বইছে কি-না, এহনি আস্যা পড়বেনে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা দাঁড়াই। তুই গিয়া ক, তাড়াতাড়ি যাতি কইছে।
ছেলেটা আবার দৌড়ে চলে গেল।
‘নিধু মাঝির ছেলে। জানেন তো জিয়া সাব নিধুর একখান ভটভটি নৌকা আছে। সকালবেলা আমি তারে কৈয়া রাখছেলাম কিনা। যাক, যাত্রাটা শুভ হল মনে হয়।
জিয়া অবয়বে কিঞ্চিৎ পরিহাস তুলে বলল, ‘দ্যাখেন শহিদ ভাই, মানুষের আবেগ কত বেপরোয়া। এই বয়সেও রবীনদার মন চাঁদের ডাক শুনতে পায়।
‘দূর মিয়া— রবীনদা লাজুক স্বরে বলেন, ‘রাত যত গভীর হব, বিশাল বিলের চ্যাতানো বুকির উপর জোছনার ঢল নামবে। নৌকায় শুয়্যা শুয়্যা দু’চোখ ভর্যা চারদিক দ্যাখবেন— এরম পাইছেন কহনো। আপনাগে ঢাকার মতো না-কি, একটুকরা ফ্যাকাশে চাঁদ আস্যা কেবলই জানলার গ্রিলে আটকায় যায়! এই বাংলাদেশে বিল বাওড়ের মতো বিশাল আকাশ আপনি আর কোনো জাগায় পাবেন না।
— তা ঠিক, একটু খোঁচা দিলাম। মাঝে মধ্যে আপনাকে খোঁচা দিতে ভালই লাগে রবীনদা, কিন্তু কাজ তো হয় না। এই জলাভূমির পাঁচালি আপনার কতদিনের দেখা জানা— ডায়রিতে শুধু নোট করেই গেলেন। আর এখন একটা প্রমোশন পেয়ে আরো গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। অথচ লেখা শুরু করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন আমাকে।
‘জিয়া সাব বুড়ো বয়সে আর ক্যান ধাক্কা দ্যান কন তো ? ঝাঁপাই পড়লি পড়তি পারি কিন্তু ডাঙায় ওঠার শক্তি পাবনানে। আমার আবেগ বড় জান্তব। অনেক কষ্টে থিতায় রাখছি। সংসারের ফটোকপিটা কোনোরকমে আগলায় রাখছি, একটু টোকা লাগলিই খান খান হয়্যা যাবো।
আশ্চর্য! নিধুমাঝির ভটভটি নৌকাটা না এসে পড়লে অবস্থা সামাল দেয়াই কঠিন হয়ে পড়ত। রবীনবাবুর মাঝবয়সি ভারি শরীরটা কেমন টলমল করে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে তিনি ডাক দিলেন— আসেন শহিদ ভাই, উঠ্যা পড়েন। বেশ দূরির পথ কি-না, কই জিয়া সাব।
এরপর কয়েকটি মুহূর্ত আমাদের নিঃশব্দে কাটল। স্রেফ ইঞ্জিনের শব্দের মধ্যে আমরা তিনজন গুছিয়ে নিয়ে নৌকায় পরস্পর মুখোমুখি বসলাম।
শেষ আশ্বিনের পড়ন্ত বেলা। রোদের ঝাঁঝ শরীরে এসে বিঁধছে। মাথার ওপর স্বচ্ছ-নীল বিস্তীর্ণ আকাশ। জল-ছোঁয়া ভেজা বাতাসে সোঁদা গন্ধ, ভেজা গন্ধ। পচা পানা, পচা শ্যাওলা, জাল থেকে পড়ে যাওয়া দু’একটা মাছের মৃদু আঁশটে মৃতগন্ধ আমাদের নাক মুখ শরীর ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে।
দূরে সেই অশ্বত্থ গাছের ডাল থেকে দুটো চিল নেমে এসে বিলের বুকে বৃত্তাকারে ওড়ে— এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তের উচ্চতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। ইঞ্জিনের ধাতব শব্দে আমরা তাদের ছায়া চুর্ণ করে এগিয়ে যাই।
নৌকা বাওয়া গতরের কাজ। নিধু মাঝির সে ভয় নেই এখন। নৌকার পেছনে আয়েশ করে বসে এক হাতে কোনো রকমে হালটা সামলে অন্য হাত হুঁকো ধরে গড় গড় তুলে চলেছে।
আমাদের যাত্রায় যান্ত্রিক শব্দটা অতিরিক্ত এক অনুষঙ্গ হয়ে উঠলেও কিছুক্ষণ পরই লক্ষ করলাম বিলের খোলা হাওয়ার মধ্যে তীব্রতা অনেক কমে গেছে । শুধু দূরে, বেশ দূরে ভটভট শব্দের একটা ক্ষীণ প্রতিশব্দ তৈরি হয়ে কানে এসে বাজছে।
রবীনবাবু আর আমি একসঙ্গে সিগারেট ধরালাম । উনি বললেন, ‘বিলক্ষণ ভাল সময় আয়েছেন আপনি। একটানা সাতদিন আমরা রোদের চেহারা দেহি নাই। গতকাল বিকালে আকাশটা খানিক ফস্যা হইছিল মাত্র। আজ এ্যকেবারে ফকফকা। কিন্তু জলের চেহারা দ্যাখছেন— কেমন ঘোলা ।
ক্রমান্বয়ে আমরা কাটা খালের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দু’পাশে ঘর-গেরস্তালির হালকা আভাস চোখে পড়ে। ধোঁয়া আর মিষ্টি গন্ধে আমাদের দম আটকে আসে, গাঁয়ের কেউ আখের রস জ্বাল দিচ্ছে। অল্পক্ষণ পরই আমরা আরেকটি বিলে গিয়ে পড়ি— আয়তন অনেকটা ফেলে আসা বিলের মতোই তবে গভীরতা বেশি। এখানে আর জলের ঘোলাটে ভাবটা নেই।
জিয়া ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললে রবীনবাবু বললেন, ‘চা খাবেন, আপনার বৌদি পিঠা দেছেলো, পূজা-পার্বনের মাস কি-না। আপনাগে তো সেই সময় পাওয়া যায় না-শুরু করবেন না-কি?
— একটু পরে রবীনবাবু। বৌদি ভালই করেছেন। আমরাও তো বিস্কুট চানাচুর, সব মিলিয়ে বেশ ভালই আয়োজন— কি বলেন শহিদ ভাই?
বাতাসের আর্দ্রতা চশমার কাঁচে পাতলা শরের মতো পড়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে পড়েছিল। আমি মুছতে মুছতে বললাম, রবীনবাবু চলেছেন আমাদের মনের খোরাক জোগাতে আর বৌদি দিয়েছেন পেটেরটা। দু’জনকে যখন পেয়েছি আমাদের আর ভাবনা কি?
দূরের গ্রামগুলো এক অলিক ধোঁয়ার মধ্যে ডুবে আছে যেন। পশ্চিমের দিগন্ত রেখায় সূর্য ধীরে-ধীরে ঢলে পড়ছে।
ইঞ্জিনের শব্দ সয়ে আসায় এখন নৈঃশব্দের আমেজটা ক্রমান্বয়ে ধরা দিচ্ছে। আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণা বরাবর দেখা যাচ্ছে রবীনবাবুর সেই কাঙ্খিত চাঁদ। এখনো রঙ ধরেনি— সাদা, ঠাণ্ডা আর ম্লান তার মুখ। পেছনের গ্রাম, রবীনবাবু বলেছিলেন বিলবাজনিয়া, বেশ পেছনে ফেলে এলেও তার সান্ধ্য-পূজার উলুধ্বনি, কঁসর আর ঢোলের মিলিত আওয়াজ মুক্ত বিলের বাতাস কানে বয়ে আনে।
রবীনবাবু আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘গোটা পঞ্চাশ বছর আগে এইসব অঞ্চল বড় দুর্গম ছেল। মানুষ আসতি পাত্তো না। বাংলাদেশের ম্যাপ খুল্যা দ্যাখবেন সামনে পেছনে ডানে বায়ের এই গোটা অঞ্চলটাই জলাভূমি হিসাবে আঁকা রয়েছে। জল ফুঁড়ে মাটির ঢিপির মতো যে দু’একখান গ্রাম দেখতি পাতিছেন এগুলর নিয়তিও জলের সঙ্গে বাঁন্ধা। বেশিরভাগ অঞ্চলই জলের তলায় থায়ে বছরের নয় মাস । আবাদ নাই, ফসল নাই, মাছ ধর্যা আর ক’পয়সা— চাল কিনতিই ফুরায় যায়। কচু-ঘেঁচু লতা-পাতা সিদ্ধ খাইয়াই জীবনধারণ-কতি পারেন। এইটা বাংলাদেশের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলারও এ্যাকটা।
জিয়ার চোখ বিলের জলে আটকে গেছে যেন। দু’একটা দলছুট পানা, খড়কুটা, ঢোলকলমির ভাঙা ডাল জলের ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছে। স্বচ্ছ কাল জলের নিচে কাঁটা শ্যাওলার ঝাড়, নল, শাপলা, আরালির সবুজ পাতা স্পষ্ট দেখা য়ায়। জলের বুকে ছায়া দেখেই সম্ভবত জিয়া ওপরে তাকিয়েছিল-আমাকে ইশারা করলে দেখলাম ত্রিভুজের একটি কোণ তৈরি করে শতখানেক পাখি উড়ে যাচ্ছে, দূর ছায়া-অন্ধকারে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা তাকিয়ে রইলাম। অন্ধকার গাঢ় না হওয়া অবধি পাখির ঝাঁক বেশ কয়েকবার এল— দু’একটা ঝাঁক একেবার আমাদের মাথার ওপর দিয়ে বিচিত্র শব্দ তুলে চলে গেল।
দূরে বিলের বুকে ছোট একটা মাটির ঢিপির মতো চোখে পড়ল, ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা অন্ধকারের একটি পিন্ডের মতো লাগছিল, কেবল দু’একটি ক্ষুদ্র আলোর রেখা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর থেকে উঁকি মেরে জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ করছিল— ওটাই বিলবাজনিয়া।
কিঞ্চিৎ আহার সেরে চা পান করতে করতে ছোট গ্রামটির পাশ কাটিয়ে ছুটে চলল আমাদের নৌকা ।
রবীনবাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। অনেকক্ষণ তিনি নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলেন। সিগারেট ধরিয়ে বললেন,
‘দ্যাহেন এবার, দিগন্ত চারদিকে কিভাবে ছড়ায়ে গেছে! আকাশটা পরিষ্কার, ধীরে-ধীরে চান্দের রঙটা আরো গাঢ় হলি দ্যাখবেন বিলের আন্ধারের সঙ্গে স্বর্ণের রেণুর মতো আলোর কণা মিশ্যা ক্যামন বিভ্রম সৃষ্টি করবে—কৃষ্ণ-নিলাভ সেই রঙ কেমন নেশা ধরায় দেয়। ঠিক স্বপ্নে ওই রঙ দেহা যায়…
আমি রবীনবাবুর ছড়ানো দিগন্তের দিকে ফিরি। শরীরটা সত্যিই শির শির করে ওঠে। বিশাল এ জলাভূমির প্রকৃতির মধ্যে কেমন একটা গম্ভির আদিম স্তব্ধতার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। এখানে আকাশের বিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জলও যেন ছুটে গেছে তাকে ছুঁয়ে দেবার আশায় আর আমরা ক’জন বিমূঢ়ের মতো এসবের মধ্যখানে চলে এসেছি…
রবীনবাবু নিধুমাঝিকে ডেকে বললেন, ‘নিধু এবার তোমার ভটভটিরে জির্যান দাও। আমরা একটু জুড়োয় বসি।
হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ থেমে গেলে নৈঃশব্দ আমাদের গ্রাস করে— চরাচর যেন পলকেই থমকে গিয়ে তার বিশালাকৃতির শরীরী ভার আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়। আতংকিত বিস্ময়ে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করি।
‘শহিদ ভাই কি ভয় পাতিছেন?— রবীনবাবুর আকস্মিক কণ্ঠস্বর যেন সত্যি সত্যি আমাকে ঐ গুমোট ভাবনা থেকে সরিয়ে আনে।
রবীনবাবু বলতে থাকেন, ‘আমি যহন প্রথম আইছেলাম এহেনে, আমারও শরীর কাঁটা দিয়া উঠছেল। তাড়াতাড়ি নাও বাইয়া পাশের গ্রামে উঠ্যা হাঁটা পথে বাড়ি ফিরছেলাম। কিন্তু কয়দিন পর দেহি এই পাথারের ছবিই বারবার মনে উঁকি মারে— এমন জোছনা তো কোথাও দেহি নাই! এতো বড় আকাশ তো কোথাও দেহি নাই। এমন গভীর কালা জলের আকাশ-ছোঁয়া বিস্তার, জলের এমন গন্ধ, এমন গম্ভির হেঁয়ালি চরাচর ! আর এর বুকে চান্দের আলো য্যান শরীল ছাড়্যা দিয়া নেত্য করতিছে— আমার যৌবনের স্বপ্নগুলো এহেনে আসলি কেমন দোলা দিয়্যা ওঠে। আমার ভেতর থেক্যা কে যেন বার হয়্যা চারদিক মাতম কত্তি থায়ে… জিয়া সাব কথা কন না আপনারে আজ ক্যামন অন্যমনস্ক লাগতিছে…
জিয়ার চোখে স্বপ্নতাড়িতের ঘোর। বলল, ‘সত্যি রবীনবাবু, অদ্ভুত! আপনাকে ছাড়া এসব ভাবাই যায় না’।
‘আরে মিয়া— আপনারে বিনয় দেহাতি কইছি না-কি? কইছি কেমন দেখতিছেন— সেই কথা। তয় এহেনে আসলি একটা গল্প মনে পড়্যা যায় বোঝছেন— মানষির একখান হু হু স্বর শুনতি পাই, মানুষটা য্যান জলের উপর দাপাইয়া বেড়াতিছে। গগন ফাটাইয়া চিৎকার করতিছে জল জল কয়্যা! মনডা ভার হয়্যা ওঠে। মানষে এডারে কয় ‘ভাতার মারা পাথার’— আপনাগে সেই গল্পটা কতি কতি বাড়ি ফেরবানে।
ঠিক তখনি ‘ঝপাৎ’ করে জলে একটা শব্দ ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত নৌকাটা দুলে উঠলে আমি আর জিয়া না বুঝেই নৌকাটা আঁকড়ে ধরি দুহাতে! শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখি নিধুমাঝি কোঁচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোঁচের মাথায় ছটফট করছে মাঝারি মাপের একটা মাছ!
‘কিরে, দেহি— শোল না নিধু, তয় মনে ধরল নারে। মাপ মতো যদি একখান কোপাতি পাত্তি তো টাটকা বিলের মাছের স্বাদ দিতি পারতাম মেহমানগে— কি কস নিধু?
‘দেহি মাস্টার মশাই। পালি অয়।
নিধু এবার কেরোসিনের কুপি ধরিয়ে নৌকায় মাথায় বাঁধে, তারপর কোঁচ নিয়ে আলোর নিচে চোখ রেখে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। কোমরে নিধুর মালকোচা বাঁধা। খালি গা, পেটানো কাল শরীরটা জোছনার আবছা অন্ধকারে মনে হয় আদিম শিকারি।
রাত বাড়তে থাকে। ততক্ষণে চাঁদ যেন সুডৌল যৌবন ফিরে পেয়েছে। তার উদোম বুক থেকে উদ্দাম আলোর ফোয়ারা আমাদের ঘিরে লুটোপুটি খেলছে, আমরা এখন সেই বন্য স্পর্শের শিকার।
রবীনবাবু এক সময় আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়িমুখো হওয়া যায়— না-কি?
যে সময় নিয়ে আমরা এখানে এসেছি তাতে ফিরতে ঘণ্টা আড়াই লেগে যাওয়ার কথা। এই জনহীন গহন জলাভূমির মধ্যে সে অনেক রাত। আমরা সায় দিয়ে রবীনবাবুকে তার গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেই।
রবীনবাবু নিধুমাঝিকে সংকেত দিয়ে শুরু করেন,-‘এই সুনসান প্রান্তরের যতটুক আমরা দেখতি পাতিছি, জলাভূমিটা আসলে তার চাতি অনেক বড়। উত্তরে আমাগে সাতপাড়, দক্ষিণি সাদুল্লাপুর, পুবে রাধাগঞ্জ, আর পশ্চিম দিকি কাজলিয়া-— মানা ধরলি এরম একখান অনুমান খাড়া করা যায়। কিন্তু, আসলে পুবে এই জলাঞ্চল মাদারিপুরির বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুক্যা গেছে। এর মধ্যি এ্যহনো কোনো ভিটাবাড়ি গড়্যা উঠে নাই। দ্যাখছেন না, আসার পথে সেই ছোট্ট মাটির একখানা টিপির নাহান— আমাগে দিক থেক্যা সেডাই শ্যাষ চিহ্ন— নাম হলো গিয়া বিল বাজনিয়া। তো আজ থেক্যা ধরেন ষাট/সত্তর বছর আগে, নালা খাল দিয়া পলি আসতি আসতি আর নল নটা আরালি কচুরি শ্যাওলা পইচ্যা জমতি জমতি এক সময় বিলের বুক জাগ্যা ওঠে। ফাল্গুন-চোত্তিরের দিক খানিক শুকয়, খানিক বুক সমান ক্যাদায় প্যাঁচ প্যাঁচ করতি থাকে। সেই রকম এক সময় বিল বাজনিয়ায় দু’একখান পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই কর্যা নেয়। সহায় সম্বলহীন গতরখাটা মানুষ, চাষ করতি জানে। তো, বিল হলি কি হবে, তারও একখান মহাজন আছে— তিনি জমিদার মানুষ, চোহে দেহা যায় না। নায়েব মশাই তার হয়ে দেহাশোনা করে।
‘তো সেই গতরখাটা জোন চাষি যেভাবেই হোক চাষের জন্যি বিলের কিছু জমি পত্তন নিতি পারছিল হয়ত। বিল বাজনিয়া থেক্যা তার সেই চাষের জমি তিন চার মাইল ভিতরে, বিরান পাথারের মধ্যি। রোদ মাথায় ওহেনে যাতি নাগলি, বলতি পারেন, বুক শুকায়্যা যায়। চোত্তির মাসের রোদ, খোলা আকাশের নিচে একখান বড় গাছপালাও নাই, দু’তিন মাইল ব্যাড়ের মধ্যি খাওয়ার একফোটা জল নাই— বুঝতি পারতিছেন নিশ্চই। অবশ্য জলের ওপর ভটিভটি নৌকায় বস্যা এই বিশাল অঞ্চলের শুষ্কতার কথা ভাবনায় আনা বেশ কঠিনই বটে !
‘তো একদিন ভোররাতে ঘুম থেক্যা উঠ্যা আমাগে চাষি গেছে চাষ করতি। সাথে দুড্যা বলদ আর কান্ধে লাঙ্গল। তামাটে দশাশই শরীল, মাজায় লুঙ্গি বান্দা, তার উপরে একখান গামছা গিঁট দিয়া নেছে। আর বলদ দুড্যারে ঠিক রাহার জন্যি ডান হাতে নেছে একখান পাঁচন। খাবার সময় নাই! বেলা বাড়ে যাবে। ঠিকঠাক পৌঁছতে পারলি ভোরে ভোরেই কাজ শুরু করা যাবে— এই আর কি!
‘ওদিকি আমাগে চাষি-বউ, তারও চিত্যায় শুয়্যা থায়ার একটু উপায় নাই। চাষা গেছে পাথারে চাষ করতি। তার জল-খাবার সময় মতো নিতি না পারলি উপায় আছে! কয়লা দিয়া দাঁত মাজতি মাজতি মাইল খানিক দূরির বিল-পুকুরি মুখ ধুতি হবে। জল নিতি হবে কলসি ভর্যা। মাটির চুলোয় ভাত চড়ায়্যা ঘর উঠোন ঝাড় দিতি হবে। হাঁস মুরগি ছাড়্যা তাদের খাবার দিতি হবে। চাষির বউ— তার কাজের শ্যাষ নাই। বাচ্চা কাঁন্দিয়া উঠলি মাই দিয়্যা তার সারা রাতির হাগামোতার কাপড় বিলির ডোবায় ধুতি হবে। আলু কলা যাই হোক একখান ভত্তা না হলি চাষি খাবে কি দিয়্যা! চাষি বউর অনেক ঝামেলা। সবকিছু ঠিকঠাক গোছায়্যা, চাষার জল-খাবার একখান ধামায় সাজায়্যা, দশ বছোর বয়সের বড় মাইয়াডার কাছে বাচ্চা আর সংসারের খুটিনাটি বুঝায়্যা তারপর চাষি বউ যাত্রা করবে। পৌঁছুতি পৌঁছুতি দশটা, সাড়ে দশটা। পথ তো আর পথ না, ভুসা-মাটির আলপথ— চলতি চলতি বারবার পাও ডাব্যা যায়, খরো রোদি শরীল পোড়ে— চোখ জ্বালা করে চাষি বউর। বুকির মধ্যি তহন কাঁন্দা উথলায়্যা ওঠে, কিন্তু বিরান পাথারে তার সেই কাঁন্দা শোনার মানুষ কো। মাঝে মদ্যে দু’একটা শালিকের ঝাঁক ঘুঘুর ঝাঁক পোকামাকড়ের লোভে ফর ফরাইয়া উড়্যা যায়। দু’একখান ভয়ানক সাপখোপ যে চোহে পড়ে না— এমন না! তয় সাপখোপের কথা মনে আসলি চাষি বউর বুকটা হিম হয়্যা আসে।
‘একবার আলপথ দিয়া যাতি যাতি দ্যাহে কি একখান সাপ আলপথের ডানপাশের শুকনো ধাপের উপর দিয়া আসতিছে, শুকনো কচুরি পাতার মধ্যিরত্যা শরীলডা যেন তার ঝিলিক দিচ্ছে। হঠাৎ সাপটা হাত দশেক দূরি দাঁড়ায়্যা পড়ল। বাও পাশের খানিকটা জায়গা তহনো পুরো শুকোয় নাই, গলা উঁচু সবুজ পানাগুলো তহনও খাড়ায় আছে। ওই কচুরি ঝোপের সামনে মনে হল কি একখান সরু কালচে ডাল মাটিতে পোতা। চাষি বউর মনে হল লাঠিটা হাতে নেয়া দরকার। কাঁধেরত্যা জলখাবারের গামলাটা আলপথে রাখ্যা চাষি বউ লাঠিটা ধর্যা দিছে টান। লাঠিটা উঠ্যা আস্যা চাষি বউর শরীলের উপর হামলায় পড়তি না পড়তি চাষি বউ বেদম চিৎকার দিয়্যা পিছনে দৌড় দ্যায়— সাপের কথা তহন তার মনে নাই। অনেকক্ষণ চোখ বুঁজ্যা থাক্যা আতংকের ভাব খানিক কুমলি তাকায় দ্যাহে আস্ত একখান মানষির কঙ্কাল শুয়্যা আছে— ওইডারে সে টান দিয়া মাটিরত্যা তোলছিল! চাষি বউর ম্যালা রাতির ঘুম কাড়্যা নেছেল ঐ কঙ্কালডা। এতো কিছুর পরও আমাগে চাষি বউর মনে সুখ— পত্তনের জমিটুক ঠিকমত ধান দিলি বছরের বেশির ভাগই দুই বেলা খাবার জোটে, গতরের শরম হায়াও নিশ্চিন্তি ঢায়া যায়।
‘স্বামিটাও তার জুটছে— সবই ঠাকুরির ইচ্ছা। লোহার নাহান শক্ত শরীল, সারাদিন গতর খাটাইয়া ফেরনের পরও তার ক্লান্তি নাই। একটু ফুরসুত পাইলি বাচ্চাগো নিয়া রস করে। এইসব দেখতি দেখতি চাষি বউয়ের চোখ জলে ভর্যা যায়। দু’একদিন মেজাজ মরজি খারাপ থাকলি শুধু চিৎকার জোড়ে, চোখ দুইটা জবাকুসুমের লাহান লাল হয়্যা যায়। খুব বেশি মেজাজ চড়লি ঘরের খুঁটিতি কপাল ঠোকে, কপাল ঠুইক্ক্যা রক্ত বাইর কইরা ফেলায়। কিন্তু চাষি বউয়ের গায়ে একদিনও হাত তোলে নাই। মায়্যাটার বয়স হইছে দশ বছর—আজ পর্যন্ত মায়্যা কইতে পারব না বাবায় আমারে মারছে।
‘তো এই সুখি চাষি বউর দিনের শুরুতিই আজ একটু ভুল হয়্যা গেল!
‘চাষি যাবার সময় বউরি জাগায় দিয়া গিছিল ‘উঠ, দেরি করিস না, আমি চলি গেলাম।’ —চাষি বউর আলসেমিতে পাইছিল। চাষির ডাকে একটু উইঠ্যা আলগা দরজার ফাঁক দিয়া তাকাইয়া আবার শুইয়া পড়ছিল। ঘুম যখন ভাঙ্গে চারপাশে রোদি
তহন চিকচিক করতিছে। মায়্যাটার ঘুম ভাঙ্গে নাই, বাচ্চাটাও দুধের জন্যি কান্দে ওঠে নাই আজ।
‘লাফ দিয়া উইঠ্যা চাষি বউ মেয়েটারেও ঠেলা দিয়া উঠায়। ঝড়ের মতো একটার পর একটা কাজে হাত দিয়া সারতি চায়, বারবার ভুল হইয়া যায়। বাচ্চাটা কান্দি ওঠে। চুলোর আগুন জ্বালাতি জ্বালাতি বাচ্চাকে মাই দেয়। কলসিতে খাওনের জল নাই। মেয়েটারে জল আনতি পাঠায়। নিজের খাওন, দাঁত মাজা, মুখ ধোওনের কথা তার মনে আসে না। সবকিছু সারতি তার নাভিঃশ্বাস উইঠ্যা যায়। বাচ্চারে মাইয়াটার হাতে রাইখ্যা চাষির জলখাবার কোনো রকমে গুছাইয়া চাষি বউ দোড় দেয় পাথারের পানে। অনেকদিনির চেনা তার এই পথ। থপ থপিয়ে বড় বড় পা ফেলি চলতি গিয়া এক সময় তার বুক শুকাইয়া ওঠে। ভয়ে রক্ত চলকায় ওঠে শরীলের মধ্যি। হাঁটতি হাঁটতি বড় বড় চোখ তোলে সে সামনের দিকে তাকায়— যেন সে এখনই সুদূর প্রান্তরের মাঝখানে স্বামির নড়াচড়ার ছায়াবিন্দুটি দেখতি পাবে।
‘কিন্তু দেখতি চাইলিই কি দ্যাহন যায়। দু’আড়াই ঘণ্টার পথ। কতক্ষণ হইল সে পথে নামছে? সূর্যটা যেন মাথার উপরি এহনি খাড়া হয়্যা উঠতি চায়। ঝাঁঝাল রোদি সারা শরীলডা য্যান ঘামে নায়ি উঠিছে। পায়ের নিচে পায়ের শব্দ দ্রুত অয়। নাহ্, সে ভয় পাইছে? নিজেরে আর সামলায়্যা রাখতি না পাইরা চাষি বউ ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকি দৌড়াতি শুরু করে।
‘এদিকি আমাদের ভালমানুষ চাষিটার অবস্থা সত্যি নিদারুণ। ভোরবেলা দুইখান বলদ আর ঘাড়ে একখান লাঙ্গলের ভার নিয়া সে তিন চার মাইল পথ হাঁটি আইছে। তারপর জমিতে একটানা লাঙ্গল— চোত মাসের রোদ না য্যান বাতাসে আগুনির আঁচ!
‘যদিও বিলের মাটি ভূষা মাটি, বলদ ঠিকমত চললি লাঙ্গল শুধু ধরি থাকলিই চলে, মাটি আলগা হয়্যা যায়। কিন্তু পাথারের রোইদ— সে খুব সহজ জিনিস না। পাথারে রোদি শুধু শরীল তাতায় না, রস নিংড়ায়্যা বাইর করে। শরীল শুকায়্যা যায়, জলের জন্যি শরীল চিৎকার পাড়ে। বউ আসলি তার ভাড়ের জলে সে আগে শরীল জুড়ায়। তারপর লাঙ্গল দেয়া জমির দিকি আঙ্গুল নাড়ায়্যা সে বউরি বোঝায়, দু’একখান ভবিষ্যতের কথা কতি কতি সে বউর ভাত বাড়া দ্যাখে। চাষির তর সয় না। হাভাতের মতো বউ যা আনি দেয় গোগ্রাসে গিলা ফেলায়। বউ চলি গেলি আস্তে আস্তে আবার লাঙ্গলে গিয়া হাত রাহে চাষি। সূর্য যহন পশ্চিম-পাশে অনেকটা হেইলা পড়ে, তহন যে কাজ গুটায়। লাঙ্গলটা কান্ধে ফেলায়্যা, নিঃশব্দ প্রাণি দুইটা সামনে নিয়া সকালের আসা পথে বাড়ি ফেরে।
‘কিন্তু চাষি বউর আজ কি হ’ল— সে বুঝতি পারে না। অনেকক্ষণ হইল তার গলা শুকাইছে, চোখমুখ কেমন টান টান লাগতিছে। নাড়িতেও মনে হয় টান পড়িছে— ক্ষিদেয় ঝিম ঝিম করতিছে মাথা। তৃষ্ণায় ছাতিটা বোধ হয় এবার ফাটি যাবে। আশপাশে এক ফোঁটা জল নাই। চাষি গামছাটা কোমর থেইক্যা খুইল্যা মাথায় রাখে। জমির এক ধারে আলের উপর সে এতক্ষণ বস্যা ছিল। অহন তার বসি থাকতিও কষ্ট হতিছে। কিছুক্ষণ পরপরই সে ছটফট করতি করতি আলের উপর খাড়া হইয়া চাষি বউর আসার পথে তাকাইতে থাকে— যদি তার ছায়াটা দেহা যায়! আবার বইসা পড়ে। জিব দিয়া ঠোঁট ভিজাইতে চায় কিন্তু জিবেও জল আসে না। চারপাশ তাকায়্যা দেখতি গিয়্যা তার ভয় ভয় করে— ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যি শূন্য পাথারটা যেন দুলি উঠতিছে। চোখ বুঁইজা সে বস্যা পড়ে। কান্না পায়। প্যাটের ক্ষিদে সওন যায় কিন্তু তৃষ্ণা? শরীল কাঁটা দিয়্যা ওঠে। আর তো থাহন যায় না!
‘চাষি ভয় পায়। ভয় বড় কঠিন অসুখ! মাথার মধ্যি কি য্যান গমগম কইরা ওঠে। শরীল খাড়াইতে চায় না, জোর কর্যা দাঁড়ায়্যা আবার চাষি বউর পথের নিশানে তাহায়। হ্যাঁ! খা খা রোদের মইদ্যে একখান ছায়া বিন্দু যেন নড়তিছে!! মাথাটা শক্ত কইরা ধইরা সে আরো শংকিত প্রাণির মতো কিছুক্ষণ তাকায়্যা থাকে। বউ তার দৌড় দিয়া আইতিছে মনে অয়। একটা মুহূর্তও অপেক্ষা করা তার জন্যি এখন অসম্ভব। তৃষ্ণাকাতর চাষি একফোটা জলের জন্যি দিশাহারা হয়্যা গরু তাড়ানো পাঁচনটা তুল্যা পাগলের মতো আকাশে নাড়াতি থাহে—য্যান কইবার চায় জলদি কর্যা আয় বউ আর পারতিছি না! এক সময় সে পাঁচনটা হাতে নিয়া বউর আসা পথের দিকি প্রাণপণে দৌড় শুরু করে।
‘ওদিকি চাষি বউর তখন হুঁশজ্ঞান নাই। দৌড়তি দৌড়তি সে একসময় চাষিরে দেখতি পায়— খাড়ায়্যা খাড়ায়্যা মাথার উপরে কি য্যান নাড়তিছে। আরো সামনে আইস্যা চাষি বউ হঠাৎ সম্বিত ফির্যা পায়, দাঁড়ায়্যা পড়ে। তার এত দিনের চিনা মানুষটা কেমুন জানোয়ারের মত দাপাতি দাপাতি দৌড়াই আসতিছে। আজ বুঝি তার রেহাই নাই। মেজাজ গরম হলি যে নিজির মাথা ফাটায়্যা ফালায় আজ এত বড় পাপের জন্যি নিশ্চই আমারে মারি ফ্যালাবে। স্বামি আমার ক্ষেপি গেছে— ওই তো, মানুষডার ভঙ্গিখান দেহো— চোখ দু’টা য্যান কোটর থেইক্যা বেরয় আসবেনে। হাতে পাঁচন নিয়্যা ঠোঁট মুখ ফুলায়্যা আমারে গিলতি আসতিছে। ঠিক একখান হায়নার মতন। মাঠে একটা জন-মনিষ্যি নাই যে আমারে ঠেহাবে! উরে বাপরে…
‘বেহুঁশ চাষি বউ এবার কাঁধ থেইক্যা জলখাবারের ধামাটা ফেলায়্যা পিছনে দৌড় দেয়। তার সে দৌড়ের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকার প্রাণপণ ইচ্ছা ছাড়া আর কিছু বোঝা যায় না। কয়বার যে হোঁচট খায়্যা সে মাটিতে পড়ছে, কয়বার যে পায়ে আটকায়্যা শাড়ি ছিঁড়ছে, শাড়িতে যে তার কতটুকু শরীল ঢাক্যা আছে— সেদিকি তার কোনো হুঁশ নাই।
এক সময় সে শুধু টের পায় দু’হাতে বাচ্চা দু’টারে বুকের সঙ্গে আঁকড়ায়্যা উঠোনির উপরে বস্যা আছে— আর আশপাশের জনাকয়েক বৌ-ঝির কৌতূহলি চোখ, তাদের ফিসফিস…
‘আর চাষির কথা কি কব— গুলি খাওয়া বিলেন পাখি য্যান মাটিত পড়্যা ছটফট করতিছে। শরীলের শ্যাষ শক্তি দিয়া সে শুধু চাষি বউর কাছে যাতি চাইছিল। তার দিকে তাকায়্যা কতি চাইছিল বউ, তুই আরেকটু জলদি আয়। মুহে আমার একফোটা জল দে। কিন্তু কি অইল চাষি কিছু বুঝতি পারল না। বউটা তার জল-খাবার ফেলায়্যা দিয়া পালায় গেল। এই বিরান পাথারের বুক ফাটায়্যা তার চিৎকার কত্তি ইচ্ছা হ’ল— ভসভস শব্দ ছাড়া কিছু বাইর হল না তার মুখ দিয়া…
‘সে কি আর মানুষ আছে তহন! চার হাত-পায়ে মাটি আঁকড়ায়্যা, শরীলডারে হিঁচড়ায় হিঁচড়ায় সে জল-খাবারের ধামার কাছে আনল। ভাঙ্গা কলসির খাওনের জল পাথারের শুকনা মাটি কখন শুষা নিছে! কলসির টুকরাগুলান কুড়ায়্যা চাষি জিব দিয়্যা চোষে! জলে ভিজা পাথারের কালা কাদার মদ্যি মুখ ঢুকায়্যা দেয়, নিস্তেজ অসাড় মানুষটা দু’হাতে কাদা চিবুতি থাকে। ওকে তহন বড়সড় একখান মৃতপ্রায় মাটির পোকার মতো লাগে…
‘পাথারের ধুধু শূন্যতায় কাদা-ধুলা-ভাত-তরকারির মদ্যে মুখ থুবড়ানো সেই চাষি কখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল সে নিজেও ট্যার পালো না। আরো কিছুক্ষণ পর চাষির নিথর শরীলে পিঁপড়া, পোকা, পাথারের কিট-পতঙ্গ নির্ভয়ে চলাফেরা করতি লাগল।
নৌকার ইঞ্জিন অকস্মাৎ থেমে গেল। নৌকা থেকে নেমে আমরা নিঃশব্দে রবীনবাবুকে অনুসরণ করি।
রবীনবাবু তখনো থামেননি—
‘তাই বলতিছিলাম— এই পাথারে আসলি মনডা ভারি হয়্যা যায়। মনে হয়, এই বুঝি বিলের বিশাল বুক ফুঁড়্যা দানবের মত কেউ একজন উঠি আসব, গগন ফাটায়্যা চিৎকার কর্যা উঠব— জল দাও… জল…
জিয়া আমার কানের কাছে মুখ এনে খুব আস্তে আস্তে বলে
— আর কিছুক্ষণ পরেই সাতপাড়ের শান্ত আবহাওয়ায় আমি একটা ঢিল ছুঁড়ব.. ঢেউ কতদূর গড়াবে জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, রবীনদাও একদিন জলের জন্য চিৎকার করে উঠবে। সে গল্পটা কেমন হবে কে জানে…
বর্ষ ১, সংখ্যা ২, আগস্ট ২০০২