-লেখক: শামসুদ্দোহা শোয়েব, এম এম আলী, আলতাফ পারভেজ
উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধিনতা সংগ্রাম দমন এবং ভারতের চিনবিরোধি রণসজ্জা থেকে ট্রানজিটকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনও অবকাশ নেই। ট্রানজিট আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছে শিতল যুদ্ধকালিন জার্মানির কথা। সেই সময়ে ন্যাটো বা ওয়ারশ’র ছোড়া পরমাণু বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম বিস্ফোরণ ভূমি হতো জার্মানি। পাকিস্তান একটি ভাড়া খাটা রাষ্ট্রে পরিণত হতে গিয়ে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে আছে।
ট্রানজিট নয়, করিডোর
প্রথমত যে কথাটি বলতে হয় তাহলো ভারত যে ট্রানজিট চাইছে সেটি আসলে ট্রানজিট নয়, বরং করিডোর। এবং ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই করিডোর, তথা নৌকরিডোর সুবিধাভোগ করে আসছে। এর সঙ্গে স¤প্রতি যুক্ত হয়েছে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক করিডোর। বর্তমান সরকার ভারতকে এখন সরাসরি সেই সুযোগ দিয়েছে। চট্টগ্রাম এবং মংলাকেও করিডোর সুবিধার আওতায় আনার তোড়জোর চলছে। তাছাড়া ভারতকে করিডোর দিতে গিয়ে বর্তমান সরকার ভারতের কাছ থেকেই একশ কোটি ডলার ধার নিয়েছে উচ্চ সুদে এবং ভারতকেই রাস্তা করে দিতে। এরচেয়ে বড় গৌরিসেন আর কে হতে পারে? ওয়াল স্ট্রিট-সহ সারা দুনিয়ার তারুণ্য যখন পুঁজিবাদি ঋণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তখন আমাদের গৌরিসেন ঋণ করছেন বিদেশের স্বার্থে।
নেহেরু ও প্রত্যাখ্যাত করিডোর
কিন্তু এ ঘটনাকে আমরা ট্রানজিট না বলে করিডোর বলছি কেন? এর জবাব হলো, ভারত বাংলাদেশের সড়ক-নৌ বা রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় কোনও দেশে যেতে চাইছে না, বরং তার নিজের দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সহজ যোগাযোগ চাইছে। কোনও দেশকে প্রতিবেশি কোনও দেশের সেই সুযোগ দেয়াকে বলে করিডোর। যতটুকু ইতিহাস, উপমহাদেশে করিডোর শব্দটি প্রথম আলোচিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঠিক অব্যবহিত আগে। প্রেক্ষাপটটি এরকম যে, মুসলিমলিগ নেতা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন কংগ্রেস যদি কেবিনেট মিশন প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে তিনিও তাতে সম্মতি দেবেন। কিন্তু প্রথমে রাজি হয়েও কংগ্রেস পরে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার লন্ডনে ভারতবর্ষের স্বাধিনতার ঘোষণা দেয় এবং এটা নির্ধারিত হয়ে যায় যে, ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রিটিশ ঘোষণার পর জিন্নাহ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সঙ্গে পূর্ব অংশের সংযোগ রক্ষার স্বার্থে করিডোর সুবিধার দাবি জানান। কিন্তু ভারতের ‘সার্বভৌমত্বে’র দোহাই দিয়ে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধিন কংগ্রেস সেই দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু এখন সেই ভারত বাংলাদেশের কাছে করিডোর চাইছে ট্রানজিটের নাম করে। এবং তারও ওপর ব্যাপার যে, দেশটি একদম নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশের কাছে করিডোর চাইছে না। প্রকৃতপক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দিলিকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে। বস্তুত পাকিস্তানকে করিডোর না দেয়া হলেও ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্তকরণের পর শিলিগুড়ি করিডোর সৃষ্টি করা হয়েছিল দিলিকেন্দ্রিক ভারতকে উত্তরপূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। কারণ তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের মতো আজকের বাংলাদেশের অস্তিত্বও উত্তরপূর্ব ভারত ও মূল ভারতের মধ্যে ছিল ‘একধরনের ভৌগলিক বাধা’। কিন্তু শিলিগুড়িকে দিয়ে সেই ‘বাধা’র নিষ্পত্তি ১৯৪৭ সালে সম্পন্ন হলেও ভারত এখন সমগ্র বাংলাদেশকেই করিডোর বানাতে চাইছে। সাধারণ তথ্যমতে, বাংলাদেশকে করিডোর বানালে উত্তরপূর্ব ভারতের সঙ্গে দিলিকেন্দ্রিক ভারতের দূরত্ব তিন থেকে চারগুণ, বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি কমে আসবে। যেমন বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা-আগরতলার দূরত্ব দাঁড়ায় তিনশ কিলোমিটার। কিন্তু ভারতের আসাম হয়ে কলকাতা থেকে আগরতলায় যেতে পাড়ি দিতে হয় ১৫০০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব কমে গেলে ভারতিয় পণ্যমূল্য উত্তরপূর্ব অঞ্চলে সস্তায় বিক্রি করা যাবে। দৃশ্যত দিলি এ যুক্তিতেই বাংলাদেশের কাছে করিডোর চায়।
করিডোর ও যুদ্ধ
বলতে হয় যে, করিডোরের সঙ্গে মূলত যুদ্ধের সম্পর্ক। নবগঠিত পোল্যান্ডকে বাল্টিক সমুদ্র পথ দিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তি পোলিশ করিডোর সৃষ্টি করা হয়েছিল ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে। এই করিডোর পশ্চিম দিক থেকে জার্মান রাইখকে পূর্ব প্র“শিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। যদিও ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব প্র“শিয়া ছিল পোল্যান্ডেরই অংশ এবং বাল্টিক সাগরে পৌঁছতে এই করিডোর ছিল পোল্যান্ডের একমাত্র অবলম্বন। তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এটিকে ‘সমুদ্রে পৌঁছানোর একটি মুক্ত ও নিরাপদ সুবিধা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে জার্মানরা এটিকে কোনও ধরনের মাশুল ব্যতিরেকেই ব্যবহার করতে পারত। পরে এই করিডোরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠে। মার্চ, ১৯৩৯-হিটলার, তার নিজের ভাষায়, এই জায়গা তথা করিডোর জার্মানিকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। তাছাড়া পূর্ব প্র“শিয়াকে জার্মানির সঙ্গে যুক্ত করতে এটির ওপর দিয়ে একটি হাইওয়ে নির্মাণ করেন। কিন্তু পোলান্ড হিটলারের হস্তান্তরের আহŸান প্রত্যাখ্যান করে এবং জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফরাসি ও ব্রিটিশ সুরক্ষা চায়। সেপ্টেম্বরে জার্মানি পোলান্ড আক্রমণ করে এবং এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে।
আঞ্চলিক নয়, উপ-আঞ্চলিক
এক. সরকার এবং করিডোর-সমর্থক (যদিও তারা করিডোর না বলে ট্রানজিটই বলছে) থিংক ট্যাংকদের পক্ষ থেকে এই বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে, ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। এ কারণে ভারত নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এখানেও শুভংকরের ফাঁকি কাজ করছে। প্রথমত, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বলতে কোনও সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, নেপাল-ভুটানকে ট্রানজিট দিতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে করিডোর সুবিধা আদায় করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নেপাল-ভুটানকে ভারত ট্রানজিট সুবিধা দিলে বাংলাদেশকে ভারতের করিডোর হতে হবে সেই বাধ্যবাধকতা কে তৈরি করলো?
দুই. করিডোরকে গ্রহণিয় করতে গিয়ে ক্ষমতাসিনদের কেউ কেউ এখন ট্রানজিটকে ‘চিন পর্যন্ত বিস্তৃতির কথা’ বলছেন। প্রধানমন্ত্রির পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর ভাষায়, ‘বড় বিষয় হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চিন পর্যন্ত ট্রানজিটের বিস্তৃতির ফলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে (সূত্র: আমাদের সময়/ট্রানজিটে ভারতের সাশ্রয়ি অর্থে ভাগ চাওয়া ঠিক হবে না: গওহর, ১৩ই সেপ্টেম্বর)।’ প্রথমত, এখানেও সেই একই ব্যাপার, তথা ভারতকে করিডোর দিতে গিয়ে ট্রানজিটের আশ্রয় গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, এভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনও আঞ্চলিক কাঠামোর জন্ম দিলেও এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হলো যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে? (এদিকে নেপালের সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রি বাবুরাম ভট্টরাই বলছেন, ‘প্রথাগত বাফার রাষ্ট্রের বদলে নেপাল দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল এবং চিনের মধ্যে জোরদার সেতুবন্ধন (ারনৎধহঃ নৎরফমব) হতে চায় (সূত্র: কধঃযসধহফঁ চড়ংঃ, ঝবঢ়ঃবসনবৎ ১৪, ২০১১/দঘবঢ়ধষ ধিহঃং ঃড় নৎরফমব ঝঅংরধ-ঈযরহধ মধঢ়: চগ’).
এরপরও কথা থেকে যায়, এখন চিন পর্যন্ত বিস্তৃতির কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভারতকে করিডোর দেয়ার আগে নেপাল, ভুটান, চিন, পাকিস্তানকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আঞ্চলিক ট্রানজিট কাঠামো দাঁড় করানোর কোনও উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছিল? ভারত কি রাজি যে, উত্তরপূর্ব অঞ্চলের করিডোর পেলে ভারত নিজের ওপর দিয়ে চিন পাকিস্তানকে বাংলাদেশে আসার ট্রানজিট দেবে? সেই বিষয়টি ফয়সালা করেই কি করিডোর দেয়া হয়েছে? কিংবা চিনকে ভারতের ওপর দিয়ে ট্রানজিট পেতে বাংলাদেশকে করিডোর দিতে হবে কেন?
করিডোর ও ভারতের বিশ্বশক্তি হওয়ার মহড়া
বাংলাদেশকে করিডোর বানানো আসলে ভারতের বিশ্বশক্তি হওয়ার মহড়া-এরকমই একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ভাষ্যকার এন. চন্দ্রমোহন। মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর পরই চন্দ্রমোহন লিখেন: ‘সিংয়ের সফর দু’প্রতিবেশি এবং ভিন্ন ধারণার মধ্যে সম্পর্ক পাল্টে দেয়ার কথা ছিল: বৃহত্তর বঙ্গপোসাগর জোট এবং দক্ষিণ এশিয় প্রতিবেশিদের সঙ্গে সংহতি গড়ে তোলা যা ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হওয়ার বড় ধরনের সুযোগ করে দিত।… তিস্তা নিয়ে এ ধরনের অবস্থান গ্রহণকে ধন্যবাদ। বঙ্গপোসাগর জোট গঠন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ভারত উত্তরপূর্ব অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আর বেহতর সুযোগ পাচ্ছে না।… বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে যদি ট্রানজিটের অনুমতি মিলতো তাহলে ৩৮.৯ টন পণ্য চলাচলের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন টন সেই পথ দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া যেত। এই জোট গঠন বাস্তবে রূপ নেবে না, যদি না বাংলাদেশ ভারত এবং উত্তরপূর্ব, মায়ানমার এবং বঙ্গপোসাগরের আশপাশ অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের অবাধ সুযোগ না দেয়। সূত্র: Hindustan Times/A river called Teesta N. Chandra Mohan, September 08, 2011 [Gb. P›`ª‡gvn‡bi G m¤úwK©Z Av‡iKwU fv‡l¨i Rb¨ †`Lyb From Bangladesh to Bimstec: Closer India-Bangladesh ties will help in the creation of a Bay of Bengal community/September 06, 2011
তাই এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, ভারত যদি চিনকে প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে তার পূর্বমুখি অভিযানে মায়ানমার থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত কোনও বৃহৎ বঙ্গপোসাগরিয় জোট (বে অব বেঙ্গল গ্র“প) গড়ে তুলতে চায় সেইক্ষেত্রে তার কৌশলগত ভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহৃত হওয়ার দায় কে চাপালো?
আসলে ট্রানজিট-করিডোর সম্পর্কিত পুরো বিষয়টিই অস্বচ্ছ এবং দিলিকেন্দ্রিক। ভারতকে করিডোর দিতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে অপ্রাসঙ্গিক ও নানামুখি কথাবার্তা বলা হচ্ছে।
করিডোর এবং চিনের প্রতিক্রিয়া
গত ৬ই সেপ্টেম্বর ভারতিয় প্রধানমন্ত্রি যখন ঢাকায় পদার্পণ করেন গণপ্রজাতন্ত্রি চিনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস ‘চায়না’স পিসফুল ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এই শ্বেতপত্রে বলা হয়: ‘আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমন্বয়ে উৎসাহিত করবে, চলমান আঞ্চলিক এবং উপআঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামোর উন্নয়ন ঘটাবে, আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে অন্যের প্রস্তাবকে খোলামনে নেবে, এবং অঞ্চলের বাইরের দেশগুলোকে আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে স্বাগত জানাবে। চিন আঞ্চলিক আধিপত্য বা প্রভাব খাটাতে চায় না, না চায় কোনও দেশকে আঞ্চলিক সহযোগিতায় অংশগ্রহণ থেকে বাইরে রাখতে।’ এরপর বাংলাদেশে নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চিন অবশ্যই আঞ্চলিক কানেকটিভিটিকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তা যেন হয় ‘শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে’। আমরা বলতে চাই যে, চিনের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উপায়ে এটি স্পষ্টতই একটি হুমকি। চিন নিজেও এ কথাটিই বলতে চাইছে যে, কথিত ট্রানজিট তার বিরুদ্ধেই ‘অশান্তি’র কাজে ব্যবহৃত হবে।
পানির বদলে ট্রানজিট?
একটি বিপৎজনক ব্যাপার হলো, তিস্তার পানি প্রাপ্তির সঙ্গে এখন করিডোরকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন ভারতিয় প্রধানমন্ত্রি মনমোহন সিংয়ের গত সেপ্টেম্বরের সফরকালে প্রকাশ্য ট্রানজিট চুক্তি সম্পাদন না হওয়ার কারণস্বরূপ দেখানো হয়েছে তিস্তা চুক্তি না হওয়াকে। কিন্তু ভারত সিমান্তে ভাটির দেশ হিসেবে পানিপ্রাপ্তি বাংলাদেশের অধিকার এবং এই অধিকারের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সনদেই সুরক্ষিত। এখন ‘পানির বদলে ট্রানজিট’ নামের দরকষাকষিতে গিয়ে বাংলাদেশ তার সেই অধিকারকে নিজেই জলাঞ্জলি দিচ্ছে। বলাবাহুল্য, ট্রানজিট বাধ্যবাধকতা ভোগ করতে পারে একমাত্র ল্যান্ডলকড কান্ট্রি। যেমন নেপাল ট্রানজিট সুবিধা দাবি করতে পারবে ভারতের কাছে। (কিন্তু দিলির নিয়ন্ত্রণাধিন উত্তরপূর্ব ভারত ল্যান্ডলকড নয়; কারণ এই অঞ্চল কলকাতা বন্দরের সুবিধা রয়েছে)।
ভারতের সা¤প্রতিক বড় অর্জন এবং বিএনপি
স¤প্রতি এ ধরনের ব্যাপার ঘটেছে যে, এক. বাংলাদেশ সরকার আসামের স্বাধিনতাকামি সংগঠন উলফার কয়েকজন প্রধান সারির নেতাকে দিলি সরকারের হাতে গোপনে তুলে দিয়েছে। দুই. আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরোধি হলেও বাংলাদেশের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করার জন্য বর্তমান সরকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়াও চলছে। তিন. প্রধান বিরোধি দল বিএনপির অবস্থানও ‘মাশুল’ নিয়ে করিডোরের পক্ষে। তবে মনমোহন সিংয়ের সফরের পর থেকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ‘করিডোর’ বা ‘আগ্রাসন’ (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সূত্র: আমার দেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১; প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর, ২০১১) শব্দটি প্রয়োগ করলেও দলটির পক্ষ থেকে এরকম কোনও ঘোষণা দেয়া হয়নি যে, তারা ক্ষমতায় এলে এই ‘করিডোর’ চুক্তি/সমঝোতা বাতিল করবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স¤প্রতি রোড মার্চ করছেন, করিডোর শব্দটি তার মুখ থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। ২৭ অক্টোবর ময়মনসিংয়ের রোডমার্চ জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়া হয়েছে। এতদিন শুনেছি, করিডোর দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে সিকিম। ট্রানজিট দেয়ায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কত টাকা পেয়েছে?’ কিন্তু তারপরও দলটির পক্ষ থেকে ট্রানজিট/করিডোরবিরোধি কোনও কর্মসূচি দেয়া হয়নি। আখাউড়া-আশুগঞ্জের কোথাও প্রতিরোধের ডাক তুলছে না বিএনপি। বলাবাহুল্য, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত নৌ-করিডোর চুক্তি/ সমঝোতার নবায়ন তারাই ঘটিয়েছে। [একজন ঊর্ধ্বতন বিএনপি নেতার এ বক্তব্য অবশ্যই দৃষ্টিগ্রাহ্য: ‘ভারতের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা মনে করি তা হচ্ছে, ভারত এখন এটা বুঝতে পারছে যে বাংলাদেশে দুটি বড় রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। আর এই দুটি রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেই দেশটির যোগাযোগ রাখা উচিত। তাদের এই মনোভাব পরিবর্তনকে আমি ইতিবাচক বলে মনে করি। ভারতের দিক থেকে এটা একটি পরিপক্ক অবস্থান।’-শমসের মবিন চৌধুরী (বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক/ প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাতকার/ ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১)
আসল উদ্দেশ্য সামরিক
এক.
আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, করিডোর বা ট্রানজিট কোনও অর্থনৈতিক বিষয় নয়। ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর চাইছে মূলত সামরিক কৌশলগত কারণে এবং আপত্তি ঠিক এখানেই। আন্তর্জাতিক সাময়িকি ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের মানুষের এই উদ্বেগ উপস্থাপিত করেছে এই বলে যে, ‘নতুন ট্রানজিট প্রকল্প শুধুমাত্র উন্নয়নের বেশিকিছু হতে পারে। সমর কর্মকর্তা-সহ ঢাকার অনেকেরই সন্দেহ যে, ভারত এর মাধ্যমে তার নিরাপত্তা করিডোর সৃষ্টি করতে চাইছে। এই করিডোর দিয়ে সে তার উত্তরপূর্ব অঞ্চলের বিপদসংকুল এবং গেরিলা অধ্যুষিত পাহাড়ি পথের বদলে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ওপর দিয়ে সামরিক রসদ সরবরাহের পথ উন্মুক্ত করতে চায়। এরফলে ভারত খুব সহজেই নাগাল্যান্ড এবং মণিপুরের বিদ্রোহ দমন করতে পারবে। সামরিক কর্মকর্তাদের ভয় এটি বিদ্রোহি দলকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে প্ররোচিত করবে। তাছাড়া এই পথ দিয়ে ভারতিয় বাহিনি তাদের চিন সিমান্তের অরুণাচল প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত অতিরিক্ত ডিভিশনগুলোর কাছেও সরবরাহ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করবে। চিন অরুণাচলের ওপর ভারতিয় দাবিকে স্বীকার করে না, বরং চিন অরুণাচল অঞ্চলকে তার দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করে। অনেক বাংলাদেশি উদ্বিগ্ন যে, ভারত যদি বাংলাদেশকে তার বিশাল সেনাবাহিনি পরিচালনার ক্ষেত্ররূপে ব্যবহার করে নিজস্ব লজিস্টিক সমস্যার সমাধান করতে চায়, তার বিপরিতে বাংলাদেশের ওপর চিনের প্রতিশোধ গ্রহণ অবধারিত হয়ে উঠবে (সূত্র: ঊপড়হড়সরংঃ/দওহফরধ ধহফ ইধহমষধফবংয: ঊসনৎধপবধনষব ুড়ঁ/এৎড়রিহম মবড়ঢ়ড়ষরঃরপধষ রহঃবৎবংঃং ঢ়ঁংয ওহফরধ ঃড় ংববশ নবঃঃবৎ ৎবষধঃরড়হং হবধৎবৎ যড়সব’/ঔঁষ ৩০ঃয ২০১১). এ কথাটি এভাবেও বলা যায়, ১৯৬২ সালে যুদ্ধে পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ভারত এখন শিলিগুড়ি করিডোরের বদলে পুরো বাংলাদেশকেই তার করিডোর বানাতে চাইছে। এভাবে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের পাশাপাশি ট্রানজিট-করিডোরের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ভূমির ওপর কার্যত তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। ভারত-চিন সিমান্ত নিয়ে ভারতিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত সা¤প্রতিক তথ্য এরকম যে, চিনা সেনাবাহিনি গত তিনমাসে কম করে হলেও ৫০ বার সিমান্ত অতিক্রম করে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। এরমধ্যে হিমাচল সিমান্তে কয়েকটি পুরানো ভারতিয় ব্যাংকারও তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
দুই.
ভারত যে চিনবিরোধি রণসজ্জার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশকে করিডোরে রূপান্তরিত করেছে সেটিকে অন্যভাবেও বিশ্লেষিত করা যায়। তবে সেই বর্ণনার আগে আমাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালিন একটি ঘটনার কথা মনে রাখতে হবে। ফ্রান্স সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণ মোকাবিলায় তার জার্মান-ফ্রান্স সিমান্তকে দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরে দেখা গেল যে, ফ্রান্সের এই প্রতিরক্ষা কোনও কাজেই লাগছে না। কারণ এডলফ হিটলার বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্সের দখল নেন।
এই সূত্রে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে যে, ভারত তার চিন সিমান্তকে ফরাসি সিমান্তের মতো দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুললেও ভারতের জন্য অরক্ষিত থেকে যাবে তার নেপাল সিমান্ত। চিন নেপাল হয়ে সোজা শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দিলিকেন্দ্রিক ভারত থেকে উত্তরপূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। সেই লক্ষেই হোক বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে চিন এরইমধ্যে নেপাল সরকারের কাছ থেকে নেপালের তরাই অঞ্চলে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সুবিধা করে নিয়েছে। সম্ভাব্য যুদ্ধে ভারত নেপাল-শিলিগুড়ি সিমান্তে চিনকে প্রতিরোধ করতে গেলে তার জন্য প্রয়োজন পড়বে বাংলাদেশকে। তথা গোটা বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে সে তার স্ট্র্যাটেজিক ভূমিরূপে ব্যবহার করতে চাইবে। এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশকে ভারতের করিডোর বানিয়ে সেই বৈধতা দিয়ে রেখেছে। ফলে আরেকটি চিন-ভারত যুদ্ধে বাংলাদেশ হয়ে যাবে শিতল যুদ্ধকালিন জার্মানির মতো একটি দেশ। তখন বাংলাদেশের ওপর চিনের প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ হয়ে পড়বে, যে বৈধতা বেলজিয়াম আক্রমণে হিটলারের ছিল না।
অর্থনীতির লাভের খাতা?
এক.
অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলি, একমাত্র হাওয়াই হিসাব ছাড়া এমন কোনও নিরেট তথ্য-উপাত্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না যে, কথিত ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ লাভবান হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) গত ক’বছর ধরে টোটাল ট্রানজিটের কথা বলছে এবং ট্রানজিট থিংক ট্যাংক হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ট্রানজিট দিলে আমরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজার হারাবো কি? ট্রানজিট ব্যয় ও প্রাপ্তি বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে? বর্তমান ‘চিকেন নেক’ (শিলিগুড়ি করিডোর) দিয়ে যে পরিমাণ ট্রাক পণ্য পরিবহন করে, তার অর্ধেকও যদি বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে ট্রানজিট নেয়, তাহলে বছরে ২০ মিলিয়ন টন আসা-যাওয়া করবে, সেগুলোতে জ্বালানি তেল কিভাবে সরবরাহ করা হবে?’ এ ধরনের প্রশ্নে সিপিডির জবাব এই হয় যে, ‘ট্রানজিট প্রদানকারি ও ব্যবহারকারি উভয় পক্ষকেই লাভবান হতে হবে। আর ব্যয় কিভাবে ব্যবহারকারি দেশগুলোর সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায় সেই কৌশল ঠিক করতে হবে [সূত্র: প্রথম আলো, ২৯শে জুলাই, ২০১১/‘আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে সেমিনার: নিরাপত্তার জুজু দেখিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকা যায় না (ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও সিপিডির নির্বাহি পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের মধ্যকার প্রশ্ন ও উত্তর)]।’ তার মানে কোনও কৌশল ঠিক না করেই ওকালতি চলছে? বলা হচ্ছে, ‘ট্রানজিট-সুযোগ যেন নষ্ট না হয়’ (সূত্র: প্রথম আলো ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১১/ সিপিডির অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য)।
দুই.
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) থেকে রেল ট্রানজিটের পক্ষে অনুকূল মতামত দেয়া হয়েছে। বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক কেএএস মুরশিদের মতে, ‘ট্রানজিট দিয়ে কোটি কোটি ডলার পাওয়ার যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। বরং এসব লাভের অংকের ফানুস ওড়ালে জনমনে বিভ্রান্তি বাড়বে। ট্রানজিট সুবিধা থেকে কিছুটা লাভ পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে তা যদি রেলপথে সম্পন্ন করা হয়, তাহলেই। কেননা রেলপথ নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও ব্যয়সাশ্রয়ি। এতে দেশের রেল অবকাঠামোও শক্তিশালি করা যাবে। এজন্য অবশ্য বিনিয়োগ ও কিছুটা সময় লাগবে। অন্যদিকে সড়কপথে এখন ট্রানজিট দেয়ার মতো অবস্থায় বাংলাদেশ নেই। সড়ক অবকাঠামোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাই আপাতত সড়কপথে ট্রানজিট বাস্তবায়নযোগ্য হবে না। ট্রানজিটের লাভালাভের ক্ষেত্রে এর বাজারের দিকটিও বোঝা দরকার। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর পণ্য বহন মূলত রেলপথনির্ভর ও আসামকেন্দ্রিক। রেলপথে বছরে এই রাজ্যগুলোতে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে যে পরিমাণ পণ্য আসা-যাওয়া করে, এর সিংহভাগই সম্পন্ন হয় আসামের সঙ্গে। আর তাই আসামকেন্দ্রিক পণ্য বাণিজ্যের কতটা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সম্পন্ন হতে পারে, এর ওপর ট্রানজিটের লাভ বহুলাংশে নির্ভর করছে। বর্তমানে ত্রিপুরা ছাড়া অন্য কোনও রাজ্য, বিশেষত আসাম বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহি নয়। আর রাজনৈতিক কারণেও আসামকেন্দ্রিক বাণিজ্য ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের বড় ধরনের ভর্তুকি পেয়ে থাকে। সুতরাং, আসাম থেকে বর্তমান বাণিজ্যের উলেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশে ধাবিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ট্রানজিট থেকে বড় অংকের লাভ তুলতে হলে দীর্ঘ সময় লাগবে। কাজেই তড়িঘড়ি না করে সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ জুন, ২০১১/ তেমন আর্থিক লাভ হবে না: মুরশিদ-ট্রানজিট থেকে বড় ধরনের উচ্চাশা সরকারের’)।
তবে নিজ ব্যবসা স্বার্থ সংরক্ষণের সপক্ষের ব্যবসায়ি অংশটি ‘ভারতকে বাংলাদেশ কি ট্রানজিট দিতে পারে না’-এরকম প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ‘হ্যাঁ এবং না। প্রথমত, ভারতের যাওয়ার জন্য বা পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দায়বদ্ধ নয়। এমনকি স¤প্রতি স্বাক্ষরিত হাসিনা-মনমোহন সিং চুক্তিতে এ ধরনের পণ্য পরিবহনের কথা উলেখ নেই। শুধু আগরতলার পাওয়ার হাউসের যন্ত্রপাতি পরিবহনের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছিল। কানেকটিভিটি-সংক্রান্ত অন্য সিদ্ধান্তসমূহ কেবল দ্বিপক্ষিয় বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু ভারতের এক অংশের পণ্য অন্য অংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন করতে দিলে অথবা মায়ানমারে ভারতিয় পণ্য প্রেরণ করা হলে ট্রানজিট বিবেচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকে। কেননা, ভারত ভূআবদ্ধ দেশ নয়। তার নিজস্ব সমুদ্রবন্দর আছে, আছে বিস্তৃত উপকূল।… ট্রান্সশিপমেন্ট বাংলাদেশের জন্য কিছুটা লাভজনক হত। কেননা, ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশি যানবাহন ব্যবহার করে ট্রানজিট করা হলে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন মাশুল-সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সেবা বাবদ বাণিজ্যিকভাবে মাশুল আদায়যোগ্য হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখত।… তাছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা আমাদের প্রকৃতিপ্রদত্ত সুবিধা। এই সুবিধাকে হাতছাড়া করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ভারতিয় পণ্য শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক’ দিয়ে ঘুরে এক হাজার ৪০০ বা এক হাজার ৬০০ কিলেমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শিলচর বা আখাউড়া গেলেও এই পণ্য পরিবহনে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হয়। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেলে দূরত্ব কমে ৪০০ কিলোমিটারে নেমে আসবে। এতে কিন্তু উত্তরপূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে, বাজার হাতছাড়া হতেও পারে (সূত্র: প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১/ ট্রান্সশিপমেন্ট বাংলাদেশের জন্য কিছুটা লাভজনক হত-এফবিসিসিআই উপদেষ্টা মনজুর আহমেদের সাক্ষাতকার)।’
তিন.
ভারতিয় পণ্য পরিবহন থেকে বাংলাদেশের আয়-রোজগার কত হতে পারে তা নিয়ে ট্রানজিটপন্থি নানা মুনির নানা মত। তাদের হিসাবে এই আয়ের পরিমাণ হবে টাকা ৭০ বিলিয়ন থেকে ৮ বিলিয়ন পর্যন্ত। টাকা ৭০ বিলিয়নের (ডলারের সঙ্গে বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ি) আয়ের হিসাব দিয়েছে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত থিংক ট্যাংক আরআইএস (জবংবধৎপয ধহফ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঝুংঃবস-জওঝ) এবং টাকা আট বিলিয়নের হিসাব কষেছে বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি পরিচালিত প্রধান থিংক ট্যাংক সেণ্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
আরইএস ফেলো ড. প্রবীর দে’র মতে, উত্তরপূর্ব ভারত দুটি করিডোরের মাধ্যমে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে ট্রানজিট পেলে বাংলাদেশ সেই গাড়ি চলাচল থেকে বছরে রোজগার করতে পারবে এক বিলিয়ন ডলার। তবে এই পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে যদি ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার অন্য করিডোরগুলো ব্যবহার করা হয়। ড. দে এই পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেছেন তার দঋধপরষরঃধঃরহম ঝড়ঁঃয অংরধ’ং ঞৎধফব: ঊসবৎমরহম রংংঁবং ধহফ ওহফরধ’ং জড়ষব রহ ২০১০’ শির্ষক একটি সমিক্ষাপত্রে।
২০০৪ সালে ঝঁন-ৎবমরড়হধষ জবষধঃরড়হং রহ ঃযব ঊধংঃবৎহ ঝড়ঁঃয অংরধ নামে অন্য একটি সমিক্ষায় বাংলাদেশ এবং ভুটানের ওপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়। এটি পরিচালনা করেছে ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ উবাবষড়ঢ়রহম ঊপড়হড়সরপং এবং ঔধঢ়ধহ ঊীঃবৎহধষ ঞৎধফব ঙৎমধহরংধঃরড়হ (ওউঊ-ঔবঃৎড়)। আইডিই-জেটরো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি ট্রানজিট সুবিধা দেয় তাহলে পণ্য পরিবহন ও অন্যান্য ভাড়া বাবদ ভারতিয় মালামাল থেকে বর্তমান হারে আট বিলিয়ন টাকা আয় করতে পারবে। তাছাড়া ‘বাংলাদেশের অবকাঠামোর উন্নয়নে যে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে সেই অর্থ ‘চিকেন নেকে’র (শিলিগুড়ি করিডোর) ওপর দিয়ে যাওয়ার সড়ক মেরামত তহবিল থেকে সরিয়ে এনে পণ্য পরিবহনের এই সম্ভাবনাপূর্ণ রাস্তায় ব্যবহার করা যেতে পারে।’ বস্তুত আইডিই-জেটরো প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সেণ্টার ফর পলিসি ডায়লগ এবং ভুটানের সেন্টার ফর ভুটান স্টাডিজ পরিচালিত সমিক্ষাগুলোকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে।
উলেখ্য যে, প্রথমত, এডিবির (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) অবস্থান ট্রানজিট তথা করিডোরের পক্ষে। দ্বিতীয়ত, জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোও ট্রানজিটের পক্ষাবলম্বন করছে। এ প্রেক্ষাপটে এ কথাটি উলেখ করা অসমিচিন হবে না যে, প্রথমত, এডিবি উত্তরপূর্ব ভারতে বিনিয়োগে ভারত সরকারের অংশিদার (এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অরুণাচল প্রদেশ, কারণ চিনা আপত্তির কারণে এডিবি অরুণাচলে বিনিয়োগ করা থেকে পিছিয়ে এসেছে)। দ্বিতীয়ত, ভারতপ্রশ্নে জাপান এবং আমেরিকার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। আমেরিকা এশিয়ায় চিনকে মোকাবিলার কাজটি এখন ভারতকে দিয়েই করতে চাইছে। টোকিও-জাপান এক্ষেত্রে মিত্র।
চার.
ট্রানজিট-করিডোর নিয়ে স¤প্রতি বক্তব্য রেখেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশ (আইসিসিবি)। ‘ট্রানজিট নয়, ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার পক্ষে আইসিসিবি’ শিরোনামযুক্ত সংবাদটি এরকম: প্রতিবেশি ভারতকে ট্রানজিট নয়, বরং ট্রান্সশিপমেন্ট-সুবিধা দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশ (আইসিসিবি)। আইসিসিবি’র মতে, ট্রানজিটের পরিবর্তে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তিতে যাওয়া একান্ত বাঞ্চনিয়। এতে বাংলাদেশি পরিবহনের মাধ্যমে কম সময়ে কম খরচে ভারত তার উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পাঠাতে পারবে এবং উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।… আইসিসিবি’র মতে, আপাতদৃষ্টিতে ট্রানজিট-সুবিধা ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, ভারতের পশ্চিমাংশ থেকে মালামাল পরিবহনের দূরত্ব ও সময় প্রায় তিনভাগের একভাগ নেমে আসবে এবং পরিবহনের খরচও প্রচুর সাশ্রয় হবে। এরকম ব্যবস্থায় ভারতের উৎপাদনকারিরা তাদের পণ্য ওই রাজ্যগুলোয় কম মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন, কিন্তু বাংলাদেশি ব্যবসায়িরা উত্তরপূর্ব ভারতে তাদের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ হারাবেন বলে আশংকা করছে আইসিসিবি।… আইসিসিবি মনে করে, ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি-সহ বিভিন্ন মাত্রার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে, ব্যবসায়ের সুযোগ বাড়বে ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যাবে। অন্যদিকে ট্রানজিটের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রাপ্তি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। প্রস্তাবিত ট্রানজিট পরিকল্পনায় ভারতের ট্রাকগুলো বাংলাদেশের মধ্যদিয়েই ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাতায়াত করতে পারবে, অথচ অন্যদিকে বাংলাদেশি পণ্যবাহি ট্রাকগুলো শুধু ভারতের সিমানা পর্যন্ত যেতে পারবে, এ তথ্য উলেখ করে আইসিসিবি এটিকে একটি বৈষম্যমূলক সংযোগ পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছে। আবার বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ভারতিয় পণ্য নিয়ে ভারতিয় যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তথা অবকাঠামোকে এর উপযোগি করার নিমিত্তে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে তা কোথা থেকে আসবে, সেটিও স্পষ্ট নয়। বিদেশি ঋণ অথবা আভ্যন্তরিণ সম্পদ-কোনও উৎস থেকে এই বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করে না আইসিসিবি।
আইসিসিবির প্রকাশনায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌবন্দরের মাধ্যমে ভারত তার উত্তরপূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য ট্রানজিট-সুবিধা চেয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সংযোগ স্থাপনের জন্য ভারত রেল ও সড়ক যোগাযোগে সম্মত হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে, নেপাল ও ভুটান থেকে ট্রানজিট মাশুল হিসেবে বাংলাদেশ ভাল রাজস্ব আদায় করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মনে করে আইসিসিবি। সংগঠনটি এর কারণ হিসেবে বলেছে, ভুটানের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০০ কোটি ডলারের কম এবং নেপালের অর্থনীতিও খুব বড় নয়। আবার এ দুটি দেশের অর্থনীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে একিভূত হয়ে আছে। এ দুটি দেশ খুব বেশি রপ্তানিমুখি পণ্যও উৎপাদন করে না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে আশানুরূপ পণ্যসামগ্রি ট্রানজিট পরিবাহিত হবে না বলে অনুমান করা যায়। সূত্র: প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর, ২০১১
প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের মিডিয়া
এক.
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যেকোনও ইস্যুতে বাংলাদেশের মিডিয়ার শক্তিশালি অংশটি ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয় (অনুরূপভাবে আমেরিকার)। এবং বাংলাদেশ-ভারত ইস্যুতেও তার একই ভূমিকা। সা¤প্রতিক বছরগুলোতেও বাংলাদেশের মিডিয়া বাংলাদেশে ভারতিয় ইস্যুগুলোকেই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। যেমন, প্রথমত, বাংলাদেশের সরকারি তরফ থেকে উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধিনতাকামিদের ‘সন্ত্রাসবাদি’রূপে আখ্যায়িত করার আগে বাংলাদেশের মিডিয়ার এই অংশটি বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল তাদেরকে সন্ত্রাসবাদি বলে চিহ্নিত করার জন্য। বিগত বিএনপি সরকারই উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধিনতাকামিদের ‘সন্ত্রাসবাদি’ হিসেবে প্রথম অভিহিত করে। এরপর এই শ্রেণির মিডিয়া ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিতে প্রচারণা শুরু করে এবং তাতেও সফলতা পায়। তাছাড়া ‘পানির বদলে ট্রানজিট’ নীতির প্রচারণা বাংলাদেশের মিডিয়াই চালাচ্ছে। কিন্তু অভিন্ন নদিগুলোর ওপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, ফারাক্কা চুক্তির বাস্তবায়ন, সিমান্ত গণহত্যা বন্ধ, সমগ্র স্থল সিমান্ত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগার বানানো ইত্যাদির মতো বাংলাদেশের ইস্যুগুলো তারা আমলেই নিচ্ছে না। সিলেট সিমান্তে বাংলাদেশের ভূমি যখন ভারতের হাতে তুলে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংঘটিত হয় বা দিনাজপুর সিমান্তে বাংলাদেশি যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলে বিএসএফ তার লাশ নদিতে ভাসিয়ে দেয় মিডিয়া তখন সেই নিউজগুলোও গায়েব (কিল) করে ফেলে।
মনমোহন সফরে সিমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি বাংলাদেশের মিডিয়ায় একদম আসেইনি। ট্রানজিট নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিস্তা নিয়ে একটি শব্দও মিলে না। তারও ওপর ‘তিস্তায় ডোবেনি সৌহার্দ্য’ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। ভারত টিপাইমুখে বাঁধ দিলেও এ শ্রেণির মিডিয়ার কিছু যায় আসে না।
দুই.
মনমোহন সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ওপর দোষ চাপাচ্ছে যে, তার কারণেই চুক্তি হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য ঢাকার মিডিয়া মমতাকে দোষি বানাতে যাচ্ছে কেন? তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা দুই দেশের প্রধানমন্ত্রি তথা শেখ হাসিনা ও মনমোহনের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার নয়। মমতা সম্মতি দেননি-এটা ভারতের রাজ্য-কেন্দ্রবিরোধ, তথা কেন্দ্রের ব্যর্থতা। (কিংবা টাইমস অব ইন্ডিয়ার ভাষায়: ‘গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে ভারত পড়ে যায়, কারণ কোনও বড় কিছু পাওয়ার লক্ষে সে তার আঞ্চলিক রাজনীতিকে জাগাতে পারেনি।… তিস্তা চুক্তি নিয়ে মোটমাট ২০ মাস ধরে কাজ এগোনোর পর বাংলাদেশ দেখতে পায় মমতাকে গেলা খুব কঠিন। কারণ তার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি।’ সূত্র: ঞরসবং ড়ভ ওহফরধ/গধহসড়যধহ’ং উযধশধ ঃৎরঢ়: ঘড় ‘ঢ়ধৎধফরমস ংযরভঃ’ রহ ওহফরধ-ইধহমষধফবংয ঃরবং/০৮ ঝবঢ়ঃবসনবৎ, ২০১১)
কিন্তু আমাদের মিডিয়ার কাছে মমতা দোষি কেন? তার জবাব এই যে, মনমোহনকে দোষ দিতে গেলে সেটি কার্যত কংগ্রেস সরকার তথা দিলি শাসনকারি গান্ধি পরিবারকে আঘাত করে। ভারতিয় এস্টাবলিশমেন্ট যেভাবে গান্ধি পরিবারকে ‘অস্পর্শ’ রাখতে চায় ভারতিয় ইউনিয়ন কাঠামোকে অক্ষত রাখার স্বার্থে, আমাদের একশ্রেণির মিডিয়ারও একই নীতি। এমনকি এরা ক্ষেত্রবিশেষে ভারতিয় মিডিয়ার চেয়েও বেশি সংবেদনশিল। গান্ধি পরিবারের ইমেজ বৃদ্ধির কোনও একটি নিউজও তারা বাদ দেয় না, কিন্তু গান্ধি পরিবারবিরোধি নিউজ পারতপক্ষে চেপে রাখে। এর একটি সা¤প্রতিক প্রমাণ মার্কিন কংগ্রেশনাল রিসার্চ রিপোর্ট (সিআরএস)। ভারতিয় পত্রিকাগুলো এই নিউজকে জনসমক্ষে নিয়ে এলেও বাংলাদেশের মিডিয়ায় সেই খবর দেখা যায়নি-‘এই সম্ভাব্য উত্তরাধিকারের (রাহুল গান্ধি) দল পরিচালনার সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচন কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রেও তিনি অবিমিশ্রভাবে সফল নন। তাছাড়া জনসমাবেশগুলোতে আড়ষ্ঠ হয়ে থাকেন এবং অনেক সময়ই ভুলভাল মন্তব্য করেন (সূত্র: ঞরসবং ড়ভ ওহফরধ, ঝবঢ় ১৫, ২০১১/টঝ ঈড়হমৎবংং ৎবংবধৎপয ৎবঢ়ড়ৎঃ ঢ়ৎড়লবপঃং ৎবংঁৎমবহপব ড়ভ ইঔচ).
‘সাতবোন’ ও করিডোর
এক.
উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সাতবোন’ নামে পরিচিত সাতরাজ্য হচ্ছে, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মিজোরাম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ড। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ভারত রাষ্ট্র হচ্ছে একটি দখলদার শক্তি এবং সাত রাজ্যবাসি নিজ ভূমিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে জীবনযাপন করছে বলেই মনে করে। এই মনোভাব থাকায় দিলিকে ওই অঞ্চল মূলত তার সামরিক বাহিনি মোতায়েন করে শাসন করতে হচ্ছে। অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগই নৃতাত্তি¡ক এবং ভাষাগত দিক দিয়ে মূল ভারত থেকে ভিন্ন। বর্তমানে অধিকতর বিদ্রোহি অঞ্চল হলো আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা।
বিগত শতাব্দির ষাটের দশকে এই অঞ্চলে স্বাধিনতার দাবি প্রথম তুলেছিল নাগা জনগোষ্ঠি এবং সেই লক্ষে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট নাগা নেতা এ. জেড ফিজোকে লেখা একটি চিঠিতে এ কথাটি লিখেন যে, ‘নাগাল্যান্ডকে আমরা ভারতের সেইরূপ অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করি যেভাবে আমেরিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ইলিনয় বা পেনসিলভানিয়া (সূত্র: ঝঁনরৎ ইযধঁসরশ/ দওহংঁৎমবহঃ ঈৎড়ংংভরৎব’/ খধহপবৎ চঁনষরংযবৎং, ঢ় ৪৫)’ বলে দেয়ার পরও নাগা বিদ্রোহে উদ্দিপ্ত হয় সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারত। বস্তুত, ফিজো ১৯৪৭ সালে স্বাধিনতা চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৫৬ সাল থেকেই সশস্ত্র গোপন তৎপরতা শুরু করেন।
দুই.
একইভাবে স্বাধিনতা চেয়েছিল দার্জিলিং। বলা হয়, ঊনিশ শতাব্দিতে চা-শিল্পের প্রসারের পর নেপালি-গোর্খারা এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র লেপচা-লিম্বুদের চেয়ে সংখ্যা ও শক্তিতে এগিয়ে যায়। তারপর ১৯৪৭ সালে সংবিধান পরিষদে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও জি এল সুব্বা স্বাধিন গোর্খাস্তান গঠনের জন্য একটি স্মারকলিপি জমা দেন। এদিকে উলফা বিগত আশির দশকে আসামে ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন থেকে সৃষ্ট হলেও এখন পরেশ বড়–য়ার নেতৃত্বে সার্বভৌম আসাম প্রতিষ্ঠার লক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে পিছপা হয়নি।
ইতিহাসের নিরিখে সাতবোন বা উত্তরপূর্ব ভারত কখনও দিলিকেন্দ্রিক ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেনি। তাই দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধি ভারতিয় জাতিয় আন্দোলনে উত্তরপূর্ব অঞ্চল নেই। দিলিও তাদেরকে শাসন করা ব্যতিত সঙ্গে নেয়ার কোনও তাগিদ দেখায়নি। এই অ-সম্পৃক্তিকরণের জন্য ভারতিয় এস্টাবলিশমেন্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে দায়ি করতে চাইলেও বাস্তবতা বলে দেয় যে, তার কারণ ভারতিয় রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ বিপত্তি বেঁধেছে একটি উপমহাদেশকে (বা মুঘল-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামো) একটি একক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে গিয়ে। সাম্রাজ্য এবং রাষ্ট্র যে ভিন্ন ভারতিয় এস্টাবলিশমেন্ট তা মেনে নিতে চাইছে না।
তিন.
উত্তরপূর্ব ভারত যে দিলিকেন্দ্রিক ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন তার অতিসা¤প্রতিক উদাহরণ ইরম শর্মিলা চানু। ২০০০ সালের নভেম্বরের গোড়ায় মণিপুরের মালোম গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে জঙ্গি সন্দেহে ১০ গ্রামবাসিকে হত্যা করে ভারতিয় নিরাপত্তাবাহিনি। তার পরদিন থেকে অনশনে বসেন চানু যে আইন ব্যবহার করে উত্তরপূর্ব অঞ্চলে এ ধরনের সন্ত্রাস চালায় ভারতিয় সেনাবাহিনি, সেই আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে। অনশন শুরু করার দু’দিন পরেই তার বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যা চেষ্টা’র অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। চানু দিলি গিয়ে যন্তরমন্তরের সামনে প্রতিবাদ জানালে চিকিৎসার নামে জওহরলাল নেহেরু হাসপাতালে তাকে একরকম বন্দি করে রাখা হয়। মাঝখানে ২০০৭ সালে একবার ফিরেছিলেন ইম্ফলে। চানুর ভাই ইরম সিংহজিৎ বলছেন, ‘দিদি মূল ভূখণ্ডের নেত্রি হলে এতদিনে ‘আফস্পা’ উঠে যেত (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘শর্মিলার অনশনে দেশ নিরব কেন, প্রশ্ন’, ২৩ আগস্ট ২০১১)।’ আর চানুর যখন এই অবস্থা তখন আন্না হাজারের অনশন নিয়ে দিলিকেন্দ্রিক রাজনীতি, সরকার ও সিভিল সোসাইটি এবং মিডিয়া ও কর্পোরেট এমনকি বলিউডও ত্রস্ত-ব্যস্ত। জনলোকপাল দাবি মেনে নিয়ে মুখে মধু দিয়ে আর শরবত খাইয়ে তার অনশন ভাঙানো হচ্ছে। কিন্তু চানুর খবর কেউ রাখছে না। উত্তরপূর্ব ভারতে সেনা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মূল ভূখণ্ডে এক অরুন্ধতি রায় ছাড়া আর কোনও প্রতিবাদি নেই।।
এ বিষয়গুলো আমরা এখানে টেনে আনছি এ কারণে যে, এই উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধিনতা সংগ্রামকে দমন করতেই ভারত বাংলাদেশকে করিডোর বানাতে চাইছে। তাছাড়া নেপালি জাতিয়তাবাদি এবং মাওবাদিরা যে মহানেপাল আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন, যে আন্দোলন নেপাল সিমান্তকে বাংলাদেশের রাজশাহি সিমান্ত পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসতে চাইছে সেই আন্দোলনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশে পাওয়া করিডোর সুবিধাকে কাজে লাগাতে চাইবে।
জাতিরাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ট্রানজিটের আত্মঘাত
এখানে দুটি বিষয়ের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। একটি হলো, পাকিস্তানি কাঠামো ভেঙে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসা এবং অপরটি তার বাঙালি জাতিসত্তার বিনির্মাণ। এদিক থেকে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে দুটি ফ্রন্টে-একদিকে পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ, অপরদিকে দিলির আধিপত্যবাদ তথা সর্বভারতিয় জাতিয়তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ উপমহাদেশে প্রথম জাতিরাষ্ট্র।
কিন্তু ট্রানজিট/করিডোর প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়টি কেন উত্থাপন করছি? তার জবাব হলো, ট্রানজিট হলো বাংলাদেশকে ভারতিয় উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল দু’টি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত, পাকিস্তানের পশ্চিম শাখা থেকে তার পূর্ব শাখাকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানকে একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। ব্যাপকভিত্তিক ট্রানজিট-করিডোর প্রদান ভারতকে সেই সুযোগই করে দিয়েছে। এরপর আসবে বিনিয়োগ। ব্রিটিশ ভারতে যেভাবে ব্রিটিশ পুঁজি এসেছিল সেইভাবে টাটা-মিত্তাল-গোয়েঙ্কারা আসবে বাংলাদেশে। এয়ারটেল-সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরইমাঝে এসেছে।
এতে কী ঘটবে? এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ যখন একটি ভারত-নির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হবে তখন দিলি তার উত্তরপূর্ব অঞ্চলকে এই বলে শাসাতে থাকবে যে, দেখো, একটি স্বাধিন জাতিরাষ্ট্র হওয়ার পর বাংলাদেশ নিজ স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে পারেনি। তাই তোমাদের স্বাধিনতা দিলেও একই পরিণতি দাঁড়াবে। এ কারণে ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো।
কথাটি সোজা ভাষায় বললে দাঁড়ায়-স্বাধিন বাংলাদেশ উপমহাদেশে যে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শক হয়েছিল ট্রানজিট-ঔপনিবেশিকতা তার অপমৃত্যু ঘটাবে। উত্তরপূর্ব ভারতের নেতৃত্বপদে বাংলাদেশের যে আসন বাংলাদেশ নিজেই তা খুইয়ে বসবে। এদিকে যে অর্থনীতির লাভের কথা বলা হচ্ছে তাও থাকবে শূন্য। আমাদের মনে আছে, বিগত আওয়ামিলিগ সরকার যখন ট্রানজিটের উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশের জাতিসত্তার কণ্ঠস্বর আহমদ ছফা এই ট্রানজিট আত্মঘাতের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জানিয়ে আরেকটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন যে, ‘বাংলাদেশ উত্তরপূর্ব ভারতের নেতা’।
এখানে এই কথাটি কোনও ভাবাবেগ ছাড়াই বলে রাখা যায়, উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধিনতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন। ভারতে বিদ্রোহ দমনে করিডোর দিয়ে বাংলাদেশ নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। তাছাড়া আরেকটি কথাও বলতে হয়, ভারত তথা উপমহাদেশের স্থিতিশিলতা, সংহতি ও সমৃদ্ধি দিলির আধিপত্যবাদের ওপর নির্ভর করছে না, বরং দিলিকেন্দ্রিক আধিপত্যের শৃংখল ছিন্ন করে উপমহাদেশিয় জাতিসত্তাগুলো জাতিরাষ্ট্র গঠনের দিকে গেলেই তা সম্ভব। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে সেই কাজটি করে রেখেছে। এখন প্রয়োজন কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা এবং আসাম-মেঘালয় থেকে মিজোরাম পর্যন্ত ভূখণ্ডে জাতিরাষ্ট্রের উদ্বোধন। এটি হবে বাংলাদেশের রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামেরই পূর্ণতা।
কিন্তু ট্রানজিট নামের করিডোর তার গলা টিপে ধরতে চাইছে।
লেখকবৃন্দ: ট্রানজিট স্টাডিগ্র“প গবেষক
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের ২০ বছর পূর্তি উৎসবে পঠিত