004743
Total Users : 4743
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

দক্ষিণ এশিয়ায়‘এথনো পলিটিক্স’-এর সংকট : শ্রী লংকার অভিজ্ঞতা

“(স্বাধীনতার মুহূর্তটিতে) অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে চমকে দেয়ার মতো কোন পরিবর্তন দেখা যায় নি। জনগণের কোন অংশে কোন উদ্বেগ, আতংক, সংঘাত ছিল না। সরকারের কোন সংস্থায় তাৎক্ষণিক উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তনও ঘটে নি। অর্থনীতিতেও প্রতিকূল কিছু ঘটে নি। উপনিবেশিক ব্রিটিশরা কয়েক দশক ধরে, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে সাজিয়েছে সেভাবেই থেকে গিয়েছিল সব। যথারীতি ইংরেজিই থেকে গিয়েছিল দাপ্তরিক যোগাযোগ মাধ্যম। বহুদিন পর ইংরেজ হিসেবে এখানে এসেও- পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যায় না, এমন কিছুই পাই নি…।”

 

এক.

উপরের এই উদ্বৃতিটি হলো ‘স্বাধীনতা’ উত্তর শ্রী লঙ্কার প্রথম ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার ওল্টার হ্যাংকিনসন (Sir Walter Hankinson) এর। শ্রী লঙ্কা স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। দেশটির স্বাধীনতার এক বছর পর তিনি কি দেখছেন তারই চুম্বক চিত্র পাওয়া যায় এই উদ্বৃত্তিতে এবং এ থেকে এও বোঝা সম্ভব স্বাধীনতা আদৌ দেশটিতে কোন রূপান্তরধর্মী পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম ছিল না। আর ‘রূপান্তর’-এর পরিবর্তে ‘ধারাবাহিকতা’র এই বৈশিষ্ট্য শ্রী লঙ্কা ধরে রেখেছিল মূলত তার সাংবিধানিক ‘ঐতিহ্য’-এর জোরে এবং উপনিবেশকালে তৈরি হওয়া ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত প্রভাবশালী একটি শ্রেণীর বদৌলতে।
ওল্টার হ্যাংকিনসন যখন শ্রী লঙ্কা নিয়ে এটা লিখছিলেন- তখন কমবেশি একই অবস্থা চলছিল উপনিবেশ-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানেও। তবে বর্তমান লেখায় শ্রী লঙ্কাকে ধরেই দক্ষিণ এশিয়ায় উপনিবেশ-উত্তর ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর জাতিগত টানাপোড়েনের সংকটটি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বোঝা-পড়ার অংশ হিসেবে মূল গবেষণা র সময় শ্রী লঙ্কায় নতুন করে আবার সংবিধান রচনার উদ্যোগ চলছিল। মূলত জাতিগত সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে সংবিধান তৈরির এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ সফল হলে সেটা হবে শ্রী লঙ্কার চতুর্থ সংবিধান। এর আগে স্বাধীনতারকালে (১৯৪৮), ১৯৭২ সালে এবং ১৯৭৮ সালে দেশটিতে তিন দফা সংবিধান তৈরি হয়। উপরন্তু সর্বশেষ এবং এখনো চলমান ১৯৭৮-এর সংবিধানটিতে ১৯ দফা সংশোধনীও আনা হয়।
শ্রী লঙ্কার জাতিগত গৃহযুদ্ধের এক বড় কারণ তার সংবিধান। আবার এই সংঘাত নিরসনের বহু সাংবিধানিক উদ্যোগও নেয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু এসব উদ্যোগ ও অনুশীলন দেশটিকে কোন আলোর সন্ধান দিতে পারে নি এবং পারবে বলেও কেউ আশা করছে না। বস্তুত এই সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সংবিধানের রাজনৈতিক দার্শনিক ভিত্তিও- যে ভিত্তি আবার ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিরই দিয়ে যাওয়া।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা স্থানীয়দের জন্য ‘সিলন’ নামের একটি ভ‚খন্ড রেখে যাওয়ার সময় তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় অতিক্রম করে ‘সিলনিজ’ হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জটুকুও রেখে যায়। কিন্তু সিলনিজ বা শ্রী লঙ্কান হওয়ার সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রমের চেষ্টা আজও দেশটিতে অধরাই হয়ে আছে। আর এই ব্যর্থতটার বড় উৎস রয়েছে দেশটির সাংবিধানিক অনুশীলনে। এ পর্যায়ে তার উপর কিছু আলোকপাত করা জরুরি। জাতি-রাষ্ট্রের সফলতা বা ব্যর্থতার আলোচনায় সাংবিধানিক অনুশীলনের পর্যালোচনা এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এইরূপ রাষ্ট্রে সংবিধানই শাসকদের শাসনের বৈধতা দেয়; রাষ্ট্রের অন্যান্য ধরনগুলোতে (যেমন, personal rule, theocracy, city state, oligarchy, military state, tribal state কিংবা empire)-এর শাসন পদ্ধতিতে যা অত জরুরিভাবে উপস্থিত ছিল না।
ইতিমধ্যে পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতার পূর্বে শ্রী লঙ্কা সর্বাত্মক অর্থেই বৃটিশ সিদ্ধান্তে এবং নামেমাত্র স্থানীয় প্রতিনিধিসভার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। অধীনস্থ থাকার ক্ষেত্রে শ্রী লঙ্কার বাধ্যবাধকতার অসামান্য নজিরের জন্য কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক রাজনৈতিক সাহিত্যে দেশটিকে বলা হতো ‘মডেল কলোনি’। একই সময় ভারত, বর্মা ইত্যাদি দেশও ব্রিটিশ কলোনি ছিল। তবে ভারত বা বর্মার মতো রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে নয় বরং বিস্ফোরণ, আগুন, রক্ত আর অশ্রু ছাড়াই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শ্রী লঙ্কার ব্রিটিশ শাসন মুক্তির চেষ্টা চলছিল। এক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আদলে শ্রী লঙ্কাতেও ‘সিলন ন্যাশনাল কংগ্রেস’ গঠিত হলেও (১৯১৯) প্রথমোক্তরা যেখানে মূলত ‘স্বরাজ’-এর জন্য লড়ছিল- শেষোক্তরা চাইছিল ব্রিটিশ অধীনেই ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান স্বায়ত্তশাসন।
শ্রী লঙ্কায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নরকে ‘পরামর্শ’ দেয়ার জন্য ১৮৩৩-এ যে আইনসভা গঠিত হয় এবং তাতে ১৯১১ সাল নাগাদ যিনি প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই স্যার পন্নামবলাম রামনাথ ছিলেন দেশটিতে ‘সিলন ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা পন্নামবলাম অরুনাচলম-এর ভাই। সম্পর্কেরই এই দিকগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে এই জন্য যে, স্বাধীনতার সময়ের শ্রী লঙ্কার প্রভাবশালী রাজনীতি ছিল ‘সংবিধানপন্থী’ ও ‘ধারাবাহিকতা’পন্থী। আর তাদের হাত ধরে রক্তপাতহীন ‘নিয়মতান্ত্রিক’ পথে ব্রিটিশশক্তি ফেরত যাওয়ার মুহূর্তে হবু স্বাধীন দেশটির সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কে সুপারিশ উত্থাপনের জন্য যে কাঠামো গড়ে তোলে সেটা ছিল ‘সউলবারি কমিশন’।
সউলবারি কমিশনের আগের সাংবিধানিক উদ্যোগ ছিল ‘ডনুগমোর কমিশন’ (Donoughmore Commission). যার সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত শ্রী লঙ্কায় ব্রিটিশ শাসন চলছিল। এই কমিশন দেশের নির্বাহি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু কমিটি তৈরি করে দেয়। যার প্রধানকে বলা হতো মন্ত্রী। এরূপ মন্ত্রীদের একটি বোর্ড ছিল- যার প্রধান ছিলেন শ্রী লঙ্কার প্রাচীন রাজনৈতিক দল ‘সিলন ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর ডি এস সেনানায়েক। স্থানীয়দের এইরূপ বোর্ড একই সঙ্গে স্বাধীনতা প্রত্যাশী হলেও ব্রিটিশদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক অভিলাষের সঙ্গে সমন্বয় করেই সেই প্রত্যাশা পথ খুঁজছিল। আলোচ্য ধাঁচের ‘স্বাধীনতা’ প্রত্যাশী এইরূপ স্থানীয় এলিটদের বিশেষ পছন্দ ছিল ব্রিটিশদের। এই স্থানীয়দের ‘চাপ’ তথা gentlemanly pressure -এ অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের জন্য দেশটিতে আসে লর্ড সউলবারি (Lord Soulbury)-এর নেতৃত্বাধীন কমিশন।
ইতিহাসের এই সময়টির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যায়। এসময়ই বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে আবির্ভাব ঘটছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। আর পুঁজিতন্ত্রের কর্তৃত্ব যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এবং ব্রিটিশদের তা মেনে নিতে হচ্ছে। ঠিক এই সময়টিতেই ১৯৪৫-এর সেপ্টেম্বরে লর্ড সউলবারির নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ পূর্বোক্ত ডনুগমোর কমিশনের সুপারিশের স্থলাভিষিক্ত হয় শ্রী লঙ্কায়। নতুন কমিশন তখনকার স্থানীয় এলিটদের মুখ্য মুখপাত্র সেনানায়েক-এর ভাবাদার্শিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত পূর্ববর্তী একটি সাংবিধানিক খসড়াকেই শ্রী লঙ্কার জন্য ভবিষ্যত সাংবিধানিক সুপারিশ হিসেবে তুলে ধরে। ১৯৪৪ সালে ঐ খসড়াটি তৈরি করেন সেনানায়েকের উপদেষ্টা ব্রিটিশ আইনজীবী আইভরী জেনিংস (Ivory Jennings). ব্রিটিশ সরকারকর্তৃক জেনিংস ১৯৪২ সালে শ্রী লঙ্কায় এসেছিলেন কলম্বোতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি সাংবিধানিক আইনে বিশেষ দক্ষ ছিলেন এবং সেনানায়েক এক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপরই নির্ভর করেছিলেন। সেনানায়েক ও জেনিংসের প্রণীত সংবিধানই সউলবারি কমিশন শ্রী লঙ্কার হাতে তুলে দিয়ে যায় ‘স্বাধীনতা’র উষালগ্নে। আর একে রাজনৈতিক পরিসরে এগিয়ে নিতে সেনানায়েক ‘সিলন ন্যাশনাল কংগ্রেস’ থেকে বের হয়ে গড়ে তোলেন নতুন রাজনৈতিক দল‘ন্যাশনাল পার্টি’।
কোন ধরনের ‘সাংবিধানিক সভা’ ছাড়াই সউলবারি কমিশন ভবিষ্যতের শ্রী লঙ্কার জন্য- (যা ‘স্বাধীন’ হয়েও প্রজাতন্ত্র হবে না- বরং ব্রিটিশ ডমিনিয়ন হয়ে থাকবে এবং ব্রিটিশ রাজাকেই নিজের শাসক ভাববে কিছু সীমিত স্বাধীনতাসহ!!) দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার সুপারিশ করে- যেখানে নির্বাহি ক্ষমতা থাকবে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে- তবে তারা গভর্নরের অধীনস্থ হবেন এবং দেশটির প্রতিরক্ষা ও বিদেশ নীতিও গভর্নরের এখতিয়ারেই থাকবে! শ্রী লঙ্কায় এইরূপ মডেল কার্যকর থাকে ‘স্বাধীনতা’র পরও ২৫ বছর!
রাজনৈতিক দর্শনগতভাবে সউলবারি কমিশন ‘দেশ’টিকে ব্যক্তির সমষ্টি হিসেবে দেখার সুপারিশ করেছিল; নৃতাত্ত্বিক সমীকরণে নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র দ্বীপটির ইতিহাস, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যায় তারা। পরিবর্তে ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় ইউরোপীয় চিন্তার আদলে কিছু কাঠামোগত সুপারিশ করে। উপরোক্ত সুপারিশের ওপর দাঁড়িয়ে প্রয়োজন ছিল শ্রী লঙ্কাজুড়ে একটি সর্বাত্মক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী (Political Community) গড়ে তোলা। কারণ যেকোন রাষ্ট্রই কেবল একখন্ড ‘ভূখন্ড’ (Territory) নয়- বরং রাষ্ট্র হলো কোন বিশেষ ভূখন্ডে আবদ্ধ একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী (A Territorial Political Community)। যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সুরক্ষার ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে বিকশিত হবে এবং যার একটা নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয় থাকবে। এইরূপ সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয়ের উপর দাঁড়িয়েই কেবল একটি বিশেষ ভ‚খন্ডের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং সেই ‘স্থিতিশীলতা’ ঐ রাষ্ট্রের আর্থিক-বাণিজ্যিক-প্রযুক্তিগত বিকাশ নিশ্চিত করে। সউলবারি কমিশন শ্রী লঙ্কায় ফেডারেল ব্যবস্থারও বিপক্ষে মত দেয়। অর্থাৎ এই কমিশন রাজনৈতিক দর্শন আকারে মূলত তৎকালীন ইউরোপের ‘আধুনিকতা’, ‘যুক্তিবাদ’ ও ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর ধারণাটিই মডেল আকারে শ্রী লঙ্কায় রেখে যায়।
কিন্তু স্বাধীনতার পরপর দ্রুতলয়ে ‘সিংহলা মহাসভা’ বা ‘তামিল কংগ্রেস’ বা মুসলমান সম্প্রদায়ের পৃথক পৃথক নৃগোষ্ঠীভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সউলবারিকমিশনের নির্দেশনা অপর্যাপ্ত ছিল এবং তার আলোকে তখনকার শাসক শ্রেণী দেশটিতে state crafting করতে পারে নি বা করতে চায়ও নি। ফলে স্বাধীনতার উষালগ্নেই দেখা যায়- দেশটিতে ক্ষুদ্র কিছু কমিউনিস্ট সংগঠন ব্যতীত আন্ত-সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব সম্পন্ন বড় কোন রাজনৈতিক দল থাকছে না।
যে সমাজে অনেক ধরনের নৃগোষ্ঠীর বাস সেখানে রাজনৈতিকগুলো পৃথক পৃথক নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়ে পড়া জাতি-রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার জন্য একটি নেতিবাচক শর্ত তৈরি করে। কারণ এইরূপ রাষ্ট্রগঠনের জন্য একক ভাষা, ঐতিহাসিক একক স্মৃতিসত্তার উত্তরাধিকার, সংস্কৃতি ও সামাজিক সংগঠনের একক উত্তরাধিকার, শাসন সংস্কৃতির একক উত্তরাধিকার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় শর্ত। শ্রী লঙ্কায় এগুলো কোনটাই ছিল না। যেমনটি ছিল না ভারতে, পাকিস্তানে ও বর্মায়ও। অথচ এগুলোকে ‘জাতি-রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ দিয়ে যায় উপনিবেশিক প্রভুরা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বাধীনতার পরপরই এসব দেশগুলোতে দরকার ছিল এমন এক সংবিধান যা বিবিধ সকল জনগোষ্ঠীর কথা শুনবে এবং তাদের সকলের স্বার্থ নিশ্চিত করে নতুন এক রাষ্ট্র গড়ে তুলবে। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে উল্টোটি ঘটেছে- বিভিন্ন নৃগোষ্ঠেীর মাঝে প্রতিনিয়ত আস্থাহীনতা ও বিশ্বাসহীনতা বেড়েছে। শাসক এলিটরা পরিস্থিতিকে ‘মুষ্টিমেয়’-এর শাসনে পরিণত করেছে। অন্তত শ্রী লঙ্কার অভিজ্ঞতায় আমরা পরিপূর্ণভাবে তাই দেখবো।
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দুটি সরকারে দেশটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জাতিসত্তা তামিলরা শরিক ছিল কিংবা প্রথম দিকের অনন্ত দুটি সংসদে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ‘মালয়’ বা ‘বার্গার’ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীরও প্রতিনিধি ছিল- কিন্তু কালক্রমে সংসদে যেমন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিঃশেষ হয়ে গেছে,তেমনি সরকারও পুরোদস্তুর প্রধান জনগোষ্ঠীর এলিট কয়েকটি পরিবারের সরকার হয়ে গেছে।
সউলবারি কমিশনের সময় থেকে তামিলরা পার্লামেন্টে সিংহলি বনাম অন্যান্য জাতিসত্তার মাঝে ‘৫০:৫০’ ক্ষমতার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। এসময় তারা ‘এক ব্যক্তি-এক ভোট’ ধারণাও প্রত্যাখ্যান করে এবং দ্রুতই তারা আরও চূড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হয়ে পৃথক হোমল্যান্ডের দাবি নিয়ে আসে। তামিলদের এই অবস্থান ছিল ইউরোপের তখনকার উদারনৈতিক রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে- যদিও তার স্থানীয় বাস্তবতা ছিল। অর্থাৎ এখানে আমরা দেখবো দক্ষিণ এশিয়ায় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ইউরোপিয় মূল্যবোধ কোনই সুফল দেয়নি।
‘৫০:৫০’ প্রস্তাবের উপস্থাপক, তামিল তাত্তি¡ক পন্নামবলাম তাঁর উপরোক্ত প্রস্তব সম্পর্কে ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, যেকোন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিই নীতিনির্ধারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে সেটা অস্বাভাবিক নয়- কিন্তু ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হওয়া উচিত আপেক্ষিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা- চ‚ড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়। কারণ শ্রী লঙ্কার মতো দেশে সিংহলিরা যদি চ‚ড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপভোগ করতে থাকে- তাহলে সংখ্যালঘুদের সামান্য প্রতিনিধিত্ব কোনই অর্থবহন করবে না। এক্ষেত্রে পন্নামবলাম ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা উপমহাদেশের বাস্তবতায় অন্ধভাবে অনুসরণের বিরুদ্ধে ছিলেন।
সিংহলি জনগোষ্ঠীর এলিটরা তামিলদের ক্রম-বিচ্ছিন্নতাবোধের উক্তরূপ অবস্থানের প্রতিউত্তর দেয় দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে সিংহলাকে একক আসনে বসিয়ে (Official Language Act No. 33 of 1956) এবং প্লানটেশন খাতে কর্মরত ভারতীয় তামিলদের নাগরিকত্বে নিয়ন্ত্রণমূলক শর্তাদি আরোপ করে। এসব প্রস্তাব ও প্রশাসনিক নীতি-কৌশলের বাস্তব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে সেটা বর্তমান লেখক তার গবেষণায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তামিলদের মাঝে বিচ্ছিন্নতাবোধ যত বেড়েছে দেশটিতে নিরাপত্তাহীনতা তত বেড়েছে। শেষে, ২০০৯ পর্যন্ত দেশটিতে ২৬ বছরব্যাপী যুদ্ধ হয়েছে।
এরই মাঝে উপরোক্ত জাতিগত টানাপোড়েন সামাল দিতেই ‘স্বাধীন’ শ্রী লঙ্কায় নতুন একটি সংবিধানের বাস্তবতা দানা বেঁধে ওঠে ১৯৫০-এর পর থেকে। তার পরিণতি ছিল, ১৯৭২ সালের সংবিধান- যা কার্যকর ছিল মাত্র ছয় বছর। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে বিশেষভাবে জাতিগত ঘৃণা ও ১৯৫৮-এর কয়েক দফা দাঙ্গা এবং ১৯৭০-এ বামপন্থীদের সমর্থনে শ্রীমা বন্দরনায়েকের (বন্দরনায়েকের স্ত্রী) নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টির নির্বাচনী বিজয়। এই বিজয়ের মধ্যদিয়ে গঠিত পার্লামেন্টকে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী শ্রীমা সাংবিধানিক সভায় পরিণত করে ফেলেন। এই সংবিধানের প্রধান দিক ছিল, এটা ব্রিটিশদের হাত থেকে শ্রী লঙ্কাকে পুরোপুরি মুক্তি দেয়। নামের পরিবর্তন ঘটায় এবং পার্লামেন্টকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে। কিন্তু এই সংবিধানও জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুদের state crafting-এ জায়গা করে দিতে ব্যর্থ হয়। এসময় তামিল দলগুলো নতুন সংবিধানে দেশটিকে বহু নৃগোষ্ঠীর দেশ (multi-ethnic country) হিসেবে ফেডারেল ব্যবস্থার দাবি তুললেও তা অগ্রাহ্য হয়। এসময় শ্রীমা বন্দরনায়েক সরকারের রাজনৈতিক সহযোগী মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও পার্লামেন্টে তামিলদের দাবি সমর্থন করে নি। তামিলদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল- এই সংবিধানে যদিও সকলের ধর্মীয় চিন্তা ও আচরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়- কিন্তু বৌদ্ধধর্মকে দেশটির ‘the foremost place’-এ স্থাপন করা হয়। একইভাবে ভাষাপ্রশ্নে বলা হয়- ‘সকল রাষ্ট্রীয় দলিল সিংহলা ভাষায় প্রণীত হবে- তবে তার একটি তামিল অনুবাদও থাকবে।’ এছাড়াও এই সংবিধানে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে অনেক আপাত সুন্দর বাক্য থাকলেও তা আদালতকর্তৃক বলবৎযোগ্য করা হয় নি এবং প্রত্যেকটি অধিকারকে পুরানো ঔপনিবেশিক আইনগত কাঠামোর কর্তৃত্বাধীন করে রাখা হয়েছিল। যা ছিল একই সময়ে রচিত বাংলাদেশ সংবিধানের অভিজ্ঞতার মতোই। যেমন বিস্তর নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার দিয়ে শ্রী লঙ্কার ৭২-এর সংবিধানের ১৮(২) ধারায় বলা হয়:
এই অধ্যায়ে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তার অনুশীলন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এরূপ আইনগত শর্তসমূহকে বিবেচনায় নিতে হবে যে, যাতে তা জাতীয় ঐক্য, নিরাপত্তা ও সংহতির বিনষ্ট না করে। জাতীয় অর্থনীতি, জনগণের নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা অথবা নৈতিকতার সুরক্ষা বা সংবিধানের ১৬ নং অধ্যায়ে অন্য কারো অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় যে পরিবেশ থাকা দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে তার সুরক্ষার স্বার্থে সংবিধানপ্রদত্ত ১৮(২) অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার প্রয়োগ অবশ্যই শর্তাধীন হবে।

রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিরংকুশ করতে যেয়ে ১৯৭২-এর সংবিধানে প্রেসিডেন্টও এককভাবে প্রধানমন্ত্রীকর্তৃক মনোনীত করা হয়। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট পদে সরাসরি বা পরোক্ষ নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে রাজনৈতিক পরিসরে সিংহলিদের কর্তৃত্ব একচেটিয়া হয়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর মতোই প্রেসিডেন্টও যে সিংহলি হবেন- সেটা নিশ্চিত হয়। উপরোক্ত বাস্তবতায় তামিলদের ফেডারেল পার্টি সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াই বয়কট করে।
এভাবে বস্তুত ১৯৭২ সালেও শ্রী লঙ্কা ‘জাতি-রাষ্ট্র’ হিসেবে বিকশিত হওয়ার আরেকটি সুযোগ হারায়। ১৯৭২-এর পরের পরিস্থিতির বিকাশ ঘটে আরও রূঢ় আকারে। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে ন্যাশনাল পার্টি ১৬৮ আসনের মধ্যে ১৪০ আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে এবং পরের বছরই প্রথমে সংবিধান সংশোধন করে দেশের নির্বাহী ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে প্রেসিডেন্টের হাতে অর্পণ করে এবং ১৯৭৮ থেকে জয়বর্ধনে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। পরে সংবিধানে আরও সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন একটি সংবিধানই প্রস্তাব করা হয় ও গৃহীত হয়। এই সংবিধানে দেশের শাসন ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে অধিকতর কেন্দ্রিভূত হয়ে পড়লেও এতে দেশটিতে সংখ্যালঘুদের জন্য সুখকর কিছু বিষয় ছিল। জয়বর্ধনের ন্যাশনাল পার্টি সংবিধানে প্লানটেশন সেক্টরের ভারতীয় তামিলদের ভোটের অধিকার প্রদান (অনুচ্ছেদ ২৬) ও তামিল ভাষাকে সিংহলার মতোই দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেয় (অনুচ্ছেদ ১৯)। এই সংবিধান ভোটের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনে। পুরানো First-past-the-post পদ্ধতি পাল্টে ভোটের অনুপাতে আসন বন্টনের নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়। নতুন সংবিধানের উপরোক্ত সংস্কারগুলো শ্রী লঙ্কার জন্য ছিল গভীরভাবে ইতিবাচক। বিশেষত ভাষা প্রশ্নে ও ‘ভারতীয় তামিল’দের রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে এই সংবিধান যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে তামিল তরুণরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল।
এ ছাড়া এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়মনীতি নিয়ে তামিল তরুণদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ দানা বাঁধে- যা এমনকি, সাংবিধানিক ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকেও আড়াল করে ফেলে। জয়বর্ধনের এসময়কার আরেকটি সিদ্ধান্ত নতুন করে তামিল প্রধান নর্দান প্রভিন্সকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি নর্দান প্রভিন্সে জাফনাকেন্দ্রিক উদীয়মান তামিল সশস্ত্রতা মোকাবেলায় তার নিকটাত্মীয় ব্রিগেডিয়ার তিসা ওয়ারাতুঙ্গাকে সেখানে পাঠান (জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯) এবং তার হাতকে শক্তিশালী করতে যেয়ে ‘প্রিভেনশন অব টেরোরিজম এক্ট (১৯৭৯’ নামে দানবীয় এক আইন করেন। প্রদেশটিতে এসময় তামিল তরুণরা ব্যাংক ডাকাতি করছিল একের পর এক এবং চোরাগোপ্তা হামলায় পুলিশ সদস্যরাও নিহত হচ্ছিলো একের পর এক। স্থানীয় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। আর এভাবেই প্রথম শ্রী লঙ্কার আর্মি তামিল তরুণদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে উল্টো ফল দেয়। জাতিগত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক সমাধান চিন্তা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে এবং তা থেকে আর পিছিয়ে আসা যায় নি।
তামিলদের মাঝে এসময় পৃথক ‘হোমল্যান্ডে’র (তামিল ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ইলম’) দাবি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এবং তামিল তরুণদের সঙ্গে তামিল নাড়– ও ভারতীয় কেন্দ্রিয় শাসক-এলিটদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া অনেকদূর এগিয়ে যায়। জয়বর্ধনের অর্থনৈতিক নীতি ও বৈশ্বিক নীতিও তাকে ভারতীয়দের কাছে অগ্রহণীয় করে ফেলছিল। কারণ জয়বর্ধনে ছিলেন বাজার অর্থনীতির সমর্থক ও পশ্চিমমুখী। আর ভারত এসময় ছিল মস্কোঘেঁষা এবং এক ধরনের মিশ্র ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিরীক্ষক।
ইতিহাসের এই সময় (১৯৭৮ পরবর্তী) শ্রী লঙ্কায় নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা এবং তামিলদের অপর দাবি- অঞ্চলগত স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় দেশটি পূর্বের তুলনায় অধিকতর এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ে- যা ছিল জাতিগত সংখ্যালঘুদের আকাঙ্খার বিপরীত ও স্পষ্টত পশ্চাৎধাবন। ঠিক এইসময় আমরা দেখবো, তামিলরা পৃথক রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে তাদের রাজনেতিক জোট টিইউএলএফ (তামির ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট) গঠন করে ফেলেছে, টিইউএলএফ নেতা অমির্থালিঙ্গম নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হয়েও তরুণদের কাছে টানতে যেয়ে এমন সব দাবিকে জনপ্রিয় করে তোলেন যা শেষবিচারে তামিল পরিসরে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির যবনিকাপাত ঘটায় এবং সেটার বলি হন তিনি নিজেও।

দুই.
বর্তমানে (২০১৭) গৃহযুদ্ধ শেষে শ্রী লঙ্কা আবারও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মতো নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগের মুখে। এই পরিস্থিতিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, শ্রী লঙ্কা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতেই অবস্থান করছে। অন্যান্য সদ্যস্বাধীন দেশের তুলনায় তার পার্থক্য কেবল এটুকুই যে, তার রয়েছে ভুল-ভ্রান্তি-রক্তক্ষয়ের বিপুল অভিজ্ঞতা। এইরূপ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে দেশটি বর্তমানে আবার কীরূপ সাংবিধানিক অনুশীলনে লিপ্ত তার আরেকদফা আলোচনা আমরা দেখবো এই লেখার শেষাংশে।
কিন্তু এক্ষেত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বহুজাতিক ‘জাতি-রাষ্ট্র’গুলোর সকল ‘মডেল’-এ সংখ্যালঘুদের সন্তুষ্ট করতে পারা দুরূহই থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক (centralized unitarism) বহুজাতিক শ্রী লঙ্কা, আধা-ফেডারেলধর্মী (quasi-federalism) বহুজাতিক ভারত কিংবা নির্বাহী ক্ষমতায় প্রকৃতই ফেডারেলধর্মী (confederal devolutionism) বহুজাতিক কানাডাকে যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখি তাহলে এই উপলব্ধিই হয় যে, সংখ্যালঘুদের সার্বভৌমত্ববাদী রাজনৈতিক সমাবেশীকরণ থেকে নিবৃত করা সহজ নয়।
আবার এও ঐতিহাসিক এক রূঢ় নিয়তি যে, এইরূপ যেকোন মডেল থেকেই ভীতশ্রদ্ধ হয়ে যখন কোন জাতিসত্তা নতুন ‘রাষ্ট্র’-এর জন্ম দিচ্ছে তখন তা পুনরায় একটি এককেন্দ্রিক সমাজই গঠন করছে বা করতে চাইছে। এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে দেখতে পারি। বাংলাদেশের বাঙ্গালিরা পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে শোষণের যেসব অভিযোগ উত্থাপন করে ১৯৭১-এর জন্ম দিয়েছেÑ সেই একই অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে করছে এখন দেশটির বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী। এইরূপ অভিজ্ঞতার আলোকেই শ্রী লঙ্কার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জয়দেব ইয়াংগুদা বলেছেন :

it is a political irony that ethnic nationalists, who claim discrimination under larger multi-ethnic states, are generally driven towards establishing highly centralized, and where possible anti-democratic, states of single ethnic communities.

এখানে একটি বিষয় বলা দরকার যে, শ্রী লঙ্কার মতোই দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংকটের মূলে ইতিহাসের এক বড় ভ‚মিকা রয়েছে। যেমন, শ্রী লঙ্কায় তামিল ও সিংহলি- উভয় সম্প্রদায় তাদের বাছাই করা কিছু ‘ঐতিহাসিক উৎস’কে ব্যবহার করে নিজ নিজ এমন ‘পরিচয়’ নির্মাণ করেছে- যা প্রতিনিয়ত তাদের বিবাদবাদী জাতীয়তাবাদী মনস্তত্ত¡কে ‘বৈধতা’ দিয়ে চলেছে। তাদের জাতিগত ‘পরিচয়’ দাঁড়িয়ে আছে যে ঐতিহাসিক স্মৃতিকথার উপর- তা প্রতিনিয়ত উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে চলেছে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ, বেদনা ও গর্ব। এই ভাবাবেগ, পরাজয় ও গর্ব জাতিগত ‘অপর’-এর সঙ্গে সমন্বয়ের পরিবর্তে- তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও তার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের কথাই বলে এবং বিজয় ও পুনঃবিজয়ের তাগিদ দেয়।
বস্তুত এটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে এথনো-পলিটিকস্-এরই সমস্যা। এই এথনো-পলিটিকস্-এ প্রধান এক ভ‚মিকা পালন করছে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্ব-বাছাইকৃত ‘ইতিহাস’ । এরূপ ইতিহাস আবার ‘মন্ত্র’-এর মতো। দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেক জাতির ইতিহাস তাই ‘আলাদা’ ‘আলাদা’ এবং তারা পরস্পর নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর কথা বলে, কেবল নিজেদের ইতিহাসকেই ‘সত্য’ বিবেচনা করে এবং পরস্পরের প্রতি নীরব বৈরিতা ও ঐতিহাসিক হিংসাও লালন করে। এইরূপ ‘ঐতিহাসিক’ উপলব্ধি সর্বশেষ যে কথা সামনে নিয়ে আসে তা হলো, সংখ্যালঘু ‘অপর’-এর ওপর সংখ্যাগুরুর (প্রয়োজনীয়) চূড়ান্ত বিজয়-এর মধ্যদিয়েই রাষ্ট্র-এর স্থিতিশীলতা (stability) নিশ্চিত হতে পারে।
শ্রী লঙ্কার ক্ষেত্রে এইরূপ ‘ইতিহাস চেতনা’র একটি বড় (এবং বিপজ্জনক) নজির তার পতাকা নির্মাণের সংস্কৃতিতে দেখতে পাই আমরা। শ্রী লঙ্কা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যেকেউ জানেন, দেশটিতে জনসাধরণের কাছে প্রিয় প্রাণী হলো হাতি। একে সেখানে পবিত্রও গণ্য করা হয়। মন্দিরে মন্দিরে সেখানে হাতি পোষা হয়। এমনকি পারিবারিক পরিসরে হাতি শাবক থাকা সেখানে এলিটদের কাছে মর্যাদার প্রতীকও বটে। কিন্তু এইরূপ একটি দেশের জাতিয় পতাকায় যে প্রাণীটির ছবি রয়েছে তাহলো সিংহ। ১৯৫০-এ তৈরি ‘স্বাধীন’ শ্রী লঙ্কার পতাকায় সিংহ তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রী লঙ্কার জাতীয় পতাকার এই সিংহ-এর ধারণা তারা নিয়েছে খ্রিস্টপূর্ব সময়ের পূর্বপুরুষ ‘বিজয়’-এর মিথ থেকে। বলা হয়, বিজয় যখন (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৪৮৬ সালে) শ্রী লঙ্কায় বসতি স্থাপনের জন্য পদার্পণ করেছিলেন তখন তাঁর হাতে সিংহ প্রতীক সম্বলিত পতাকা ছিল।
আবার, সিংহলি এই প্রতীকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এলটিটিই ‘তামিল ইলম্’-এর যে পতাকা তৈরি করেছে সেখানে এক গুচ্ছ বুলেটের মাঝে স্থাপিত হয়েছে একটি ঝাঁপ দিতে উদ্ধ্যত বাঘের ছবি। কৌতুককর বিষয় হলো শ্রী লঙ্কায় বাঘ বা সিংহ কোনটাই নেই। সিংহলি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে এলটিটিইও তার পতাকার বাঘ প্রতীক (তামিল ভাষায় যাকে বলা হয় পুলি কোডি; বাংলায় বাঘ পতাকা) নিয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় চোলা রাজাদের সংস্কৃতি থেকে। যে চোলা রাজারা একদা শ্রী লঙ্কার সিংহলী এলাকায়ও রাজত্ব করেছে।
এইরূপ ‘ইতিহাস’-এর প্রভাব রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চিন্তায় পর্যন্ত কীভাবে পড়ে তার কিছু নজির উল্লেখ করা যায় শ্রী লঙ্কার সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ থেকে। দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে সুদক্ষ রেজিমেন্টগুলোর নাম রাখা হয়েছে প্রাচীন যুদ্ধ ইতিহাসের সিংহলি রাজাদের নামে (যেমন, গামুনু রেজিমেন্ট, গাজাবা রেজিমেন্ট, বিজয়বাহু রেজিমেন্ট ইত্যাদি)। যেসব রাজারা মুখ্যত লোকপ্রিয় মূলত দক্ষিণ ভারতীয় তামিলভাষীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যে রাজারা যুদ্ধ করেছিলেন উত্তরের তামিল রাজাদের বিপক্ষে। শ্রী লঙ্কার সবচেয়ে শক্তিশালী নৌ যুদ্ধজাহাজের একটির নাম হলো পরাক্রম (রাজা পরাক্রমবাহুর নামে)।
বলাবাহুল্য, এইরূপ ইতিহাস চর্চার আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো স্বনির্মিত ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র ধারণা। শ্রী লঙ্কায় যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা সংখ্যালঘু তামিলদের ‘হুমকি’ এবং ‘আগ্রাসী’ জ্ঞান করছে এবং তাদের ‘ভীতি’ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তামিলদের ওপর সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে জরুরি মনে করে তেমনি আমরা দেখবো ভারতেও সংখ্যাগুরুদের রাজনৈতিক দর্শন ‘হিন্দুত্বভা’ সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ’ সাব্যস্ত করে তাকে ‘হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এইরূপ কল্পিত ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র ধারণা, ক্রমাগত ছাপাখানাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ (Print Capitalism)-এর বিকাশের মধ্যদিয়েই পরিগঠিত করছে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের সম্মিলিত ‘জাতিয় চেতনা’ বা ‘জাতিয়তা’র ধারণা। এবং এই ধারণাকে কাজে লাগানো হচ্ছে নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ‘পুনর্জাগরণ’ ও কথিত ‘স্থিতিশীল’ রাষ্ট্র নির্মাণে। আবার তৃতীয় পক্ষ এরূপ ‘হুমকি’ ও ‘ভীতি’র মনস্তত্তে¡ ইন্ধন যুগিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে সবসময়ই শ্রী লঙ্কার কেন্দ্রিয় সরকারকে তামিল ভাষা ও তামিল সংস্কৃতিকে সিংহলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমানাধিকারের জন্য চাপ দিয়ে গেলেও তাদের দেশে হিন্দির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় তামিল, কানাড়া ও তেলেগু ভাষা ও সংস্কৃতির তীব্র বিরোধিতার কথা সেখানে ধামাচাপা দেয়া হয়। ‘হিন্দি ও হিন্দুত্বভা’ ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদকে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করছে। তামিল নাড়–র রাজনীতি তথা দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের মৌলিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে উত্তর ভারতীয় হিন্দি ভাষা ও তার সংস্কৃতিকে বিরোধিতা করতে যেয়ে। তবে শ্রী লঙ্কায় সিংহলিদের বিপরীতে তামিলদের সংগ্রামে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় অবস্থান শর্তহীনভাবে তামিলদের পক্ষে।
বস্তুত এইরূপ সংকট ধামাচাপা দিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ ‘জাতি-রাষ্ট্র’ গঠনের চেষ্টা করেছে এবং করছে। কিন্তু বিবাদমান জাতিসত্তাগুলো যতক্ষণ ‘ঐতিহাসিক স্মৃতিকথা’র শক্তির উপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে একক পলিটিক্যাল কমিউনিটি আকারে নিজেদের পুনর্গঠন না করছে ততদিন এথনো-পলিটিকস-এর চলতি সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রায় অসম্ভব। এটা তাই কেবল পশ্চিমা ‘আধুনিকতা’র আলোকে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমেই ফয়সালাযোগ্য বিষয় নয়। যদিও পশ্চিমের ঐ ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা’ই উপরে আলোচিত ‘ইতিহাস’রূপী ‘মন্ত্র’-এর শক্তিশালী সামাজিক ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশীয়ার রাষ্ট্রকাঠামোতে বহু জাতিসত্তার সমন্বয়ে সেক্যুলার ‘জাতি-রাষ্ট্র’ নির্মাণের চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে।

(সংক্ষেপিত)

সরলরেখা থেকে

শেয়ার করুন: