004745
Total Users : 4745
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

দিলওয়ারের শব্দরূপে চেতনা-কাঠামো

দিলওয়ারের কাব্যকুশলতা বা ক্রাফটের বিষয় নিয়ে অনেকেই তাঁর কাব্যশিল্পের সংগঠন সম্পর্কে আলোকপাত করেন তীর্যক দৃষ্টিতে-তা দিলওয়ার কেন আত্মম্ভরি বিদ্যাদিগগজ সমালোচকরা নজরুল-সুকান্ত-সুভাষ সম্পর্কেও এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন এবং এখন সুযোগ পেলে নন্দনতত্তে¡র সাংগঠনিক প্রায়োগিতকার আরোপে গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়ে দিয়ে কাব্যভাষার ব্যাকরণ নির্ধারণ করেন। বস্তুত আধুনিক ব্যাকরণের নিয়ম হলো সৃষ্টিশিলতা,
রূপান্তরমূলকতা এবং উদঘাটন প্রয়াস, সৃষ্টিপ্রবাহ থেকে উপাত্তের আহরণ এবং সে-উপাত্তই শৃংখলা ও সংগঠন নির্ণয়ের ভিত্তি। এ ধারণা থেকে বলা যায়, দিলওয়ারের কাব্য বিবেচনায় সম্পূর্ণতই তার কাব্যকুশলতাকে বিবর্জিতভাবে শুধুমাত্র ভাবচেতনাকে নিয়েই এ যাবৎ আলোচনা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী দিলওয়ারকে তাঁর মানসপুত্র বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনি বলেছেন ‘কবিতার কাব্যগুণ না থাকলে কেবল বয়সের তারুণ্য’ দিয়ে কবিতা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে না; দিলওয়ার তা পেরেছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবী দিলওয়ারের কবিতাকে ভারতবিখ্যাত করেছেন।
কাব্যকুশলতা কাব্য-ভাষার সঞ্চারণশিলতার উপর অনেকাংশে নির্ভরশিল, কাব্যের গঠনকাঠামো, এর ভাষাবোধ এবং ভাষার সংসাধন তথা সৌষম্য যোগ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যাকরণ যেমন ভাষার উপর আরোপিত সত্য নয়-তেমনি কবি-কুশলতার ব্যাপারটিও আরোপিতভাবে বিবেচিত হলে যথার্থ কাব্য মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। স্টাইলিস্টিক দৃষ্টিতে ব্যক্তিমানুষের ভাব ও ভাষা যেমন স্বিয় প্রকাশের একক সত্য তেমনি প্রকাশিত ভাষা ও অলঙ্কারের নির্দিষ্ট যোগ্যতা সে সত্যের অনুরূপ, স্বতন্ত্র মর্যাদায় বিবেচিত হওয়াই যথার্থ উপলব্ধি।
মানুষের হর্ষ-বিষাদ-যন্ত্রণা-ক্লেদাক্ততা বস্তু-উপলব্ধিতে সুব্যক্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে বলেই দিলওয়ার আমাদের অন্তরস্পন্দনে সঞ্চারিত করেন তাঁর কাব্য- ভাষার সংবেদনশিল সৃষ্টিশিল প্রণোদনা। এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর কাব্যকুশলতার সৌষম্য সৃষ্টি হয়েছে শব্দ এবং শব্দার্ন্তগত অর্থব্যাপ্তিতে।
দিলওয়ারের কাব্যের আরেকটি অন্যতম প্রধান দিক হলো তাঁর মিথিক্যাল পরিচর্যা। শুধু ‘মিথ’ নয়, পুরাণের ব্যবহারের মাধ্যমে ‘অর্থান্তরন্যাস’ নির্দেশনা নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মিথ এবং পুরাণ-এর প্রথাগত সামঞ্জস্যে যে ভ্রান্তি তা অপনোদন করা আবশ্যক।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষে’ পুরাণের যে পরিচয় আছে তার সাথে প্রকারান্তরে মিথের সাদৃশ্য রয়েছে; কিন্তু মিথের চরিত্র-লক্ষণ এ থেকে ভিন্ন। ‘পুরাণ’ শব্দটির মধ্যে ইতিহাস-চেতনাটি অন্বিত এবং অনুস্যুত এবং ‘মিথ’ বলতে প্রাক-ইতিহাস যুগের চিত্র বিদিত। প্রয়োগ ও ব্যবহারগত কারণে পুরাণের মধ্যে ইতিহাস ও মিথের যুগপৎ উপস্থিতি অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে,-এ প্রসঙ্গে ‘বায়ুপুরাণে’ বলা হয়েছে-
ইতিহাস পুরণাভ্যং বেদং সমুপবৃংহষ্যে।
বিভেত্যল্প শ্র“তাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি।

অর্থাৎ “ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা দেবজ্ঞান উপচিত করিয়া লইতে হয়। অন্যথা আমাকে এই ব্যক্তি প্রহার করিবে” এই মনে করিয়া অল্পজ্ঞান ব্যক্তির নিকট হইতে শ্র“তি ভীত হইয়া থাকেন।
ইতিহাস-আশ্রিত পুরাণের চারিত্র্য লক্ষণের যথার্থতা পুরাণকার-এর পঞ্চ লক্ষণ থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে, সেখানে বলা হয়েছে :
সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরানি চ।
বংশ্যানুরচিতং চেতি পুরাণং পঞ্চলফণম।

সর্গ অর্থাৎ সৃষ্টি, প্রতিসর্গ অর্থাৎ প্রতিসৃষ্টি বা প্রলয় মন্বন্তর। বংশ এবং রাজ বংশানুচরিতের এ পঞ্চম ভাগ পুরাণের শ্রুতিফল।
Encyclopaedia of Religion and Ethics গ্রন্থে F. F. Pargiter বলেছেন : … “of the five subjects propel to Puranas the first three concern early religion and mythology and the other two deal with traditional history.” তাই ‘ইতি হ আস পুরাণ’ এই রকমই ছিল সেকালের কথা। “এই বাক্যটি পরে দাঁড়াইল একটি মাত্র পদে ‘ইতিহাস ও পুরাণ’ পদটিকে সমাহার দ্ব›দ্ব সমাস মনে করিয়া ভাঙ্গিয়া দুইটি শব্দ পাওয়া গেল ‘ইতিহাস ও পুরাণ’। সুকুমার সেনের এ কথাটি পুরাণের ইতিহাসাশ্রিত চেতনাটির সাথে মিথের দূরান্বয় সৃষ্টি করে এবং তা আরো পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায় ‘পুরাণ প্রবেশ’ গ্রন্থের লেখক গিরীন্দ্র শেখর বসুর কথা থেকে। তিনি স্পষ্টই বলেছেন : “পুরাণার্থ বিচক্ষণ ব্যক্তির কাছে পুরাণ প্রকৃত হিস্টরি এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য পুরাবৃত্ত বলিয়াই বিবেচিত হইবে। … পুরাণে উলি­খিত আছে, চাক্ষুষ মন্বন্তর শেষ হইলে ভীষণ জলপ্লাবনের কথা বহুদেশের কিংবদন্তীতে প্রচলিত আছে। পুরাকালে কবে লোকক্ষয়কর ভূমিকম্প হইয়াছিল পুরাণে তাহাও লিখিত আছে।”
তাই, ‘মিথে’র মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক কালের শ্রুত আখ্যায়িকা কিংবা কল্প ধারণাকেই আমরা এ পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত করতে চাই এবং বলতে চাই পুরাণ মিথকে স্বীকরণ করে বাস্তবতার বহমানতাকে কিংবা কথিত, স্থিত ধারণা কিংবা বাস্তবতার শ্র“ত-কল্পকে নিয়ে ব্যাপক ক্যানভাসে প্রতিকল্প কিংবা সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে।
দিলওয়ার আদিমপুরাণ কথা কিংবা মিথকে তাঁর কাব্য-প্রকরণে ব্যবহার করে মানবিক ঐতিহ্যের শক্তিমত্তাকে প্রবহমান বাস্তবতার স্বরূপ নির্ণয়ে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আধুনিক অর্থের ইতিহাসকে বিগত ঐতিহাসিক এবং কল্প ঐতিহ্যের সমন্বিত ভাবকল্পনায় পুরাণের চিত্রকল্পে জীবনঅন্বেষার রূপকে জীবনময় করে তুলেছেন।
সংস্কৃত কাব্যলোকের ভাষ্যে ‘সুকবির বাণী ও ক্রিয়ার বিভ্রম চিরকালের’-বলেই বর্ণিত, সে-অর্থে কবিতার অব্যাহত ধারায় দিলওয়ার চিরকালের চিরন্তনতাকে মানবিকতায় পুরাণ এবং মিথের বাগর্থিক বিন্যাসে-অনুভবে-ধ্বনি ও বাক্যতরঙ্গে দিলওয়ার প্রতিকায়িত করেছেন তাঁর কাব্য কৌশলে।
অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ যথার্থই বলেছেন : “দিলওয়ারের কাব্যে সচেতন ও সার্থকতায়-মিথের-ব্যবহার আমাকে বিমুগ্ধ করেছে। সমগ্র বিশ্বের মিথকে তিনি দু-হাতে গ্রহণ করেছেন তবে সেমিটিক মিথই বেশি। দিলওয়ারের কাব্যে মিথ এসেছে পুরনো খোলস ত্যাগ করে আধুনিকতার উত্তাপে। তিনি মহাকাব্য লিখেন নি বা মহাকাব্যের কবিও তিনি নন। কিন্তু তাঁর হাতে মিথ মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও বিস্তারে শিল্পরূপ পেয়েছে। ইতিহাস আর মিথের কি অপূর্ব শিল্পরূপ ‘ফেডিপাইডিসের প্রতি’ কবিতায়। সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস ও পুরাণকাহিনি এবং লোকজ ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে পরিচয় থাকলে তবেই তা সম্ভব। শুধু পরিচয় নয় দিলওয়ার এসবকে আত্মস্থ ও আত্মিকরণ করেছেন। শুধু কাব্যে নয় প্রবন্ধেও দিলওয়ারের এ ব্যাপ্তি ও বিস্তার। আমি তাঁর ‘কেন বাংলাদেশ’ প্রবন্ধটি পড়ার জন্য অনুরোধ করবো। দিলওয়ারের মিথ প্রসঙ্গে এ কথা বলা যায় যে, দিলওয়ার মিথের অধিন নন। মিথই দিলওয়ারের অধিন। তাই ইডিপাস, স্পার্টাকাস থেটিস, প্রমিথিউস ও ফেডিপাইডিসকে আমাদের কাছে অতীব পরিচিত-আমরা যেনো আগে থেকেই তাদের চিনি। রবীন্দ্রসাহিত্যের অফুরন্ত ঐশ্বর্য লোকজ ঐতিহ্য। আর নজরুল-পুরাণ, কোরান ও লোকজ ঐতিহ্যই তাঁর সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। চারণকবি মুকুন্দ দাস ও রমেশ শীল যদিও আমাদের লোকজ ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন কিন্তু সেখানে শিল্পসৌকর্য নেই, তা এসেছে অতীব স্থূলভাবে। আর দিলওয়ার টি. এস. এলিয়টের মতোই পুরনোকে নতুনের অভিধায় ব্যঞ্জিত করেছেন। ফররুখ আহমদে ঐতিহ্য এসেছে খণ্ডিতভাবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পরে একমাত্র দিলওয়ার ছাড়া পুরাণ, কোরান ও লোকজ ঐতিহ্য তথা বিশ্বের মিথকে এমনিভাবে আর কেউ শিল্পরূপ দিয়েছেন কি না সন্দেহ আছে।” (দ্রষ্টব্য: দিলওয়ার : কবি ও কবিমানস, দিলওয়ার, কবি দিলওয়ার কল্যাণ পরিষদ, লন্ডন শাখা কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন, ১৯৮৭ পৃ. ২৬-২৭।)

অধ্যাপক যতীন সরকার স্পন্দপূর্ণ গদ্যে, পুরাণের নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত প্রয়োগে, শব্দের প্রতিকায়িত ব্যবহারে দিলওয়ারের অবলম্বিত বিষয়বস্তু যে ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ শিল্পসম্মত রচনা তা কাব্য-বিনির্মাণ এবং আঙ্গিক-আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। (দ্রষ্টব্য: দিলওয়ারের কবিতার বিষয়বস্তু-যতীন সরকার, একজন কবি: দিলওয়ার, ঢাকা ১৯৮১, পৃ. ২৮-৪৬),

দিলওয়ার, ‘মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত অনুসারী’ এ-কথা ঠিক কিন্তু ‘উদ্ভিন্ন উল­াস’-এ যে ক’টি কবিতা গদ্যছন্দে গ্রথিত সেগুলোর সাফল্য উপেক্ষার নয়। অক্ষরবৃত্ত প্রয়োগে তাঁর নিরুৎসাহ অনেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন, এ প্রসঙ্গে যতীন সরকার বলেন-যদি তাঁর “নিরুৎসাহই থাকতো তবেতো মানুষের কঠিন বন্ধন কে কিছুতেই অঙ্গীকার করে নিতে পারতেন না”। সমাজান্তর্গত দ্বানিদ্বক প্রক্রিয়ার আত্মস্থতায় জাতিক-
আন্তর্জাতিক স্থাবর জঙ্গমে সমকাল হয়ে উঠে প্রচ্ছদপট:
জঠরে জটিলাবর্তে, ওরে অন্ধ উপমহাদেশ
তুই যেন বরপুত্র মরণ জননীর পিঙ্গলার,
খণ্ডিত ধর্মের শরে দুর্গন্ধের নারক্য উদগার
অলৌকিক মূর্খতার অপূর্ব বিচিত্র সমাবেশ

এ-প্রসঙ্গে সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং ধর্মিয় সা¤প্রদায়িকতায় সমগ্র উপমহাদেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করে দিলওয়ার ধর্মের মুখোমুখি হন সমাজ- বিনির্মাণের সাম্যবাদি মেরুকরণের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করে; এক্ষেত্রে তাকে যারা একদেশদর্শিভাবে বিবেচনা করার অপপ্রয়াস করে-তাদেরকে নজরুলের ধর্মিয় সহমত-সংহতি চেতনাধারার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। রবীন্দ্রনাথও উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের সমাজে ধর্ম প্রবল,-ভারতবর্ষে কিংবা বাংলার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তিনিও সমাজ-সমন্বিতির ভিত্তিতে মানবধর্মের কথা নিয়ে সমাজকাঠামোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে দিলওয়ার সামাজিক জাগরণের প্রত্যয়বোধকে সচকিত করার লক্ষ্যেই ধর্মবোধ জনিত এবং ধর্মজ Mythecal approach রূপে তাঁর মনস্বি মনিষায় প্রতিফলিত ও প্রতিকায়িত হয়েছে। বাংলা কবিতার ধারায় দিলওয়ার-ই একমাত্র বলা যায় যিনি ভারতিয়, গ্রিক এবং সেমেটিক মিথ একসাথে সফলতার সাথে ব্যবহার করে বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা আর দূরগামি জীবনস্পন্দনকে সচকিত করেছেন।

বহির্জগতের অচরিতার্থতা থেকে প্রেরণা-উৎস জাত মিথ-পুরাণ নৃ-ঐতিহ্য ব্যবহার পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের কাব্য বিবেচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন : ‘কবির প্রকৃতি সিদ্ধ অন্তর্জগতে জাগ্রত চিত্রকল্প মূলত সজীব, প্রাণবান যা বস্তুপ্রচ্ছদ উন্মোচন করে আমাদের পৌঁছে দেয়, টোনাবেগ, তত্ত¡াবেগ বা হৃদয়াবেগের পরমার্থে অথবা আমাদের সঞ্চালিত করে সভ্যতার প্রাত-কালিন স্মৃতিগর্ভে। কিংবা কখনো কবি আমাদের প্রসারিত করেন লক্ষ-কোটি স্মৃতি অনুষঙ্গবিন্দু-চঞ্চল কোনো এক প্রত্নপ্রতিমায় (Archetype)’। দিলওয়ারের প্রত্ন-ঐতিহ্য আর মিথিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি সন্দর্শনে সৈয়দ আকরম হোসেনের এ বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
দিলওয়ারের কাব্যবিবেচনায় বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানি ও সাহিত্য-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুন বলেন: “কবি দিলওয়ারের পড়াশোনার পরিধি ব্যাপক। তিনি একজন আধুনিক সমাজসচেতন মানুষ। তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং কমিটমেন্ট তাঁর বিশিষ্টতা দান করেছে। কবিতার গঠনশৈলীতে তাঁর ব্যতিক্রমী সচেতনতা প্রশংসাযোগ্য। আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারে তিনি স্বচ্ছন্দ। তিন পার্বিক মাত্রাবৃত্ত ও চার মাত্রার মাত্রাবৃত্তের ব্যবহার তাঁর ছন্দে এনেছে বৈচিত্র্য। তাঁর অশিথিল শব্দচয়ন স্মরণ করিয়ে দেয় সুধীনোত্তর পরিশ্রমকে।”
ভারতের প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার শচীন ভৌমিক দিলওয়ারের কাব্যের ছন্দ ও জগৎ সম্পর্কে বলেন: “মুক্তকণ্ঠে বলবো দিলওয়ার শক্তিশালী কবি। তাঁর মনের জগতে কাব্য সুষমামণ্ডিত এক কাজলকালো দীঘি। যার জলে ভাবনার আকাশের সব খণ্ড মেঘরাই ছায়া ফেলে ছন্দের গতিময়তায় ভাবের মধ্যে গ্রামসংগীতের করুণ মধুর রেশ যেন ঝিরঝিম করছে, যেন শীতের সূর্য পাতার মেঘের রৌদ্রটাকে ঝেড়ে শুধু ভালোবাসার গুমটটাকে মেলে দিয়েছে কোনো শিশিরপ্রান্তর নয় কি? কবি অবাক করেন শুধু শিশুসরল হেসেই, আবার যখন গভীর কথা বলেন, বলেন জীবনের পরম দর্শন, তখন তাঁর প্রশ্নের রূপ শিশুর মতোন নগ্ন সুন্দর-
তাকে আমি শুধালাম ডেকে :
তুমি জানো প্রিয়তমা
কোথা থেকে আসে অন্ধকার?
বললো না মুখে সে কিছুই
শুধুমাত্র অংগুলি সংকেতে
নিশ্চিন্তে দেখিয়ে দিলো
পশ্চাতের আমার ছায়াকে।

ঐকতান প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে গিয়ে পরিশেষে শচীন ভৌমিক বলেছিলেন-“মুগ্ধ হয়ে গেলাম কবির দাবীর কণ্ঠ শুনে। দিলওয়ার সম্পর্কে আমি আশাবাদী”। পরবর্তি কালে একই গ্রন্থ প্রসঙ্গে অধ্যাপক কবির চৌধুরী বলেন, ঐকতানে দিলওয়ারের সমাজ সচেতনতা, বিশ্বের বঞ্চিত দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ও বলিষ্ট আশাবাদ মূর্ত হয়ে উঠেছে, কিন্তু এই গ্রন্থে এমন একাধিক কবিতা আছে যার মূল উপজীব্য প্রকৃতির স্নিগ্ধ সৌন্দর্য এবং রমণীয় প্রেম ও কীনব্রীজে সূর্যোদয়, ‘রাত্রি যখন’, ‘অপূর্ব সেই’, ‘এমনের মিউজিয়ামে’ প্রভৃতি কবিতার প্রতি তাকালেই তাই বোঝা যায়। তবে এ ধরনের কোনো কোনো কবিতাতেও কবি ‘দার্শনিক’ প্রায় ‘সাম্যবাদী’, মাত্রিকতা এনেছেন, যেখানে প্রকৃতি বা প্রেমের কবিতা নিভৃত ব্যক্তিবাদকে অতিক্রম করে সমষ্টির চিন্তায় স¤প্রসারিত হয়েছে।
“দিলওয়ারের কবিতায় প্রত্ন-প্রতিমায় এবং শব্দ-চেতনায়ও তিনি আমাদের জীবনসত্তাকে জাগিয়ে দেন। চেতনামুখর করে তুলে প্রগতির দুয়ার খুলে দেন: অনির্বাণ; পূর্বাশা, সূর্যপ্রেম, সংগ্রাম, রক্তদন্তী, অরুণিমা তরুণ, অরুণ, রক্তের রাগে ধারালো বর্শা, সূর্যরশ্মি সূর্যশিশু প্রভৃতি শব্দগুলো” প্রতীকী প্রয়োগে সার্থক এবং সৌন্দর্যজিজ্ঞাসায় সফল বলে মনে করেন অধ্যাপক ডক্টর সফিউদ্দিন আহমদ।
সূর্য এবং রক্ত যেমন জীবনের-প্রাণের-বিপ্লবের-বাঁচার প্রতিক, বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্য দর্শন’ শীর্ষক অলংকার গ্রন্থে বলা হয়েছে-
শব্দার্থয়ো বন্থিরা যে ধর্মাঃ শোভাতিশায়িতা।
রসাদীনুকুর্বন্থোহলংকারাস্থেহঙ্গাদাদিবৎ।

শব্দ ও অর্থের যে অস্থির ধর্ম কাব্যের শোভা বৃদ্ধি করে ও সাহিত্যিক রসের পরিপোষক হয় তাদের নাম অলংকার। অলংকার কাব্যের অস্থায়ি ধর্ম। কাব্যে অলংকার থাকলে কাব্যের সৌন্দর্যবৃদ্ধি হবে। না থাকলে কাব্যগুণের স্থায়িত্বের হানি ঘটে না।
দিলওয়ারের কাব্য-প্রেরণার উৎস নৈসর্গ এবং জীবন। প্রকৃতির সর্বকালিন রূপ ঐশ্বর্য,-তাই প্রকৃতিপ্রদত্ত শব্দরূপের অন্তরঙ্গ ভাষ্যকার তিনি। প্রেম এবং নারি, দেশ এবং সমাজের দায়বদ্ধতার প্রণোদনায় তিনি উদ্বেলিত ও প্রত্যয়দিপ্ত। বুদ্ধদেব বসুর ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ নাগরিক উপলব্ধির কাব্যপ্রয়াস। যতীন সরকার বলেন, ‘দিলওয়ারের দ্রৌপদী ভাবনা তাঁর সকল পূর্বসূরিদের থেকে স্বতন্ত্র।’ দিলওয়ার লিখেন-

তোমাকেও প্রতীক রূপে আমার ভীষণ ভালো লাগে
আদিম সাম্যের যেনো তুমি এক ধারালো মূর্চ্ছনা
……………………………………..
পঞ্চ পাণ্ডবেরা যেন জনপদে গণ পঞ্চায়েৎ
তুমি তার মধ্যমণি সাম্যবাদী মানব সমাজে,
তোমাতে লক্ষিত শস্যের অনন্ত লাল শাড়ী
যৌবনে বহন করো উর্বশীর সোনালী সংকেত,
সুরের তরঙ্গ হও জনতার সেতারে এস্রাজ
মহাকাল শরণার্থী তোমাতে বাঁধবে তার বাড়ী।

কিংবা দিলওয়ার যখন বলেন :

দেবী নয় বুকে চাই সমুদ্রের মানবী থেটিস
এইতো কাক্সিক্ষত নারী রক্তে যার গণ দম্ভ হয়ে
দুর্বার ঘোষিত হয় বীরোত্তম পুত্রের সম্মান :
জনতার কালান্তরে, হেলেন বিজয়ী একিলিস।

তখন প্রকৃতির অপরাজেয় শাসনে লিঙ্গনিরপেক্ষ মানবতার গণচেতনা প্রাণবান হয়ে উঠে সংগ্রামি মানুষের শক্তিবোধে। সিমাবদ্ধ এ-নিবন্ধে বিস্তৃতভাবে দিলওয়ারের কাব্যশিল্পের শব্দরূপ আলোচনা সম্ভব নয়-এ-আলোকপাত মাত্র। পরিশেষে উদ্ধৃত করছি এ প্রসঙ্গে নূরুউল করিম খসরু-এর মন্তব্য-“কবি দিলওয়ারের মূল্যায়ন… তাঁর কবিতার ভাষা, বিষয়, সামাজিক বাস্তবতা, নিসর্গ ও রোমান্টিসিজম, স্বর, মাত্রা, প্রতীক ব্যবহার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, পর্যবেক্ষণ, আঙ্গিক-উপস্থাপনা, বাক-রীতি, উচ্চারিত ধ্বনি, শব্দচয়ন ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র আলোচনার দাবীদার”। (দ্রষ্টব্য : একজন কবি দিলওয়ার, ১৯৮১, পৃ-৬৭-৬৮)।

দিলওয়ারের কবিতায় ছন্দ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি শব্দালংকার, অর্থালংকার ও অনুপ্রাস-দ্যোতনা সৃষ্টি করে বাচ্যাতিরিক্ত ভাবোদ্দিপনার ব্যঞ্জনা এবং স্বাতন্ত্র্য স্বাক্ষর রেখেছে। যেমন-দিলওয়ার শেখ মুজিবের স্তাবক না হয়েও ‘তুমুল ক্ষমতার জলভ্রমি কোলাহলে’-মাছরাঙা অনুরাগে ঝাঁপ না দিয়েও, তার মধ্যে মমতার স্বাক্ষর’ রেখে বলে উঠেন-
তোমার সমস্ত ত্র“টি যেখানে আমার উদ্দীপনা
পরিণামে সেইখানে নির্লজ্জ জারজ স্তাবকতা
তোমাকে বানিয়ে দিল ধু ধু মাঠ শোকের ত্রিশূল
নিজ গৃহ জতুগৃহ প্রবল বিশ্বাস ছিন্নমূল
বহুমুখী মধ্যবিত্ত, ক্ষুধিতা নদীর প্রমত্ততা,
পলিকে ছাড়িয়ে গিয়ে কর্দমাক্ত করে শস্য কণা।

‘স্বনিষ্ঠ সনেটে’র এই ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ কবিতা শুধু নয় স্বভাব-প্রকৃতি অন্যান্য কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলোতেও উপমানের উলে­খযোগ্য দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। এ কবিতারই পূর্ণাঙ্গ এক মহাকাব্যিক ‘বঙ্গবন্ধু, আমি তোমার পেশাদার মিত্র নই’ (২০১০) শীর্ষক কাব্যপুস্তকে আফিম ধর্মের ব্যবসা আর ঐশি বিবর্তন, নৃ-তাত্তি¡ক মহাশক্তিকে ধারণ করে উর্বরতার দর্শনে মানবতার ধর্মে ‘অমিত্র ঈশ্বর চিন্তা চিরতরে ভাগো’, বলে প্রস্থান কালে ’চিরশ্রেয় সম্পদ প্রাকৃতিক মানবতাবোধ’-শস্য-স্বপ্নে আলিঙ্গন করে গণ-বৈপ্লবিক চেতনার বাংলাদেশকে।
‘ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা’
কিংবা, ‘অরণ্যে পথের মতো আশ্বাসের আলো হয়ে ঝরে’
আপ্লুত করে: ‘বিপ্লবের রক্ত অশ্ব ডেকে গেছে বহুবার
বাঁধন ছিড়ে
সর্বহারা মানুষের ভীড়ে’
কারণ; ‘ক্ষুধার পোষাকে ফুল: রক্তিম আনন্দে অত্যাচারী’!
অথবা; ‘রক্তের অকাল শোক: মনিষাকে সানন্দে পরাবো’।

বার্ণিক রায় তাঁর ‘চিত্রকলা, চিত্রকম্প ও চিত্রকল্প কবিতা: চিত্রিত ছায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন-কবিরা ভাষার সাহায্যে যে কবিতা তৈরি করেন, তা মিথ ছাড়া কিছু নয়, ঘটনা কিভাবে স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে যায়, এ-মিথের সঙ্গে ইমেজের সাদৃশ্য রয়েছে। যা এজরা পাউন্ডের ইন্দ্রিয়-নির্দেশনা থেকে চিত্রকল্প পরিচর্যা ও মাত্রা বহু বঙ্কিম ধারণা অর্জন করতে প্রণোদনা সৃষ্টি করে,-দিলওয়ারের কাব্যপর্ব কবির অন্তরজগতের জাগ্রতাবস্থা তাই চিত্রময় শব্দরূপের মধ্যদিয়ে আমাদের প্রাণিত করে।
এ-পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে Fertility myth সমাজবাস্তবতার আলোকে গুরুত্ববহ, যেখানে Collective Unconscious কিংবা যূথ প্রকাশ করে, দিলওয়ারের কাব্যভাষা বিকাশে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
Northop Frye-Anatomy of Criticism থেকে যদি উপলব্ধি করি তাহলে দেখবো মিথ allegory হিসেবেও ভূমিকা রেখে ‘And as realism is an art of implicit similer myth is an art of implicit metaphorical identity-‘ দিলওয়ারের কাব্যকুশলতার সার্থকতা এখানেই।

Edmund wilson-Gi ‘Symbolism’ †_‡K ejv hvq : poet has his unique personality, each of his moments has its special tone, its special combination of elements, and it is the poets task to find, to invent the special language which will alone be capable of expressing his personality and feelings. Such a language must make use of symbols; what is so special, so fleeating and so vague cannot be conveyed by direct statement or description, but only by a succession of worlds, of images, which will serve to suggest it to the reader.

“উত্তর-ঔপনিবেশিক কিংবা উত্তর-আধুনিক ব্যবচ্ছেদ থেকে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চালিত হচ্ছে প্রত্নরূপে পুননির্মাণ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, পাশ্চাত্য মনন দখলদারিত্ব-মুক্ত ভাবনায় যেমন পুননির্মাণ তথা deconstruction, বি-ঔপনিবেশিকরণ এবং ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এক ভাষাগত সমতা বিনির্মাণ করে, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, আরবদেশসমূহ প্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যের ভিত্তিমূলে যে-সত্যটি প্রতিভাত তা-হলো Resistance, চিনুয়া আচিবির লোককথাভিত্তিক Thing fall Apart (লন্ডন, ১৯৫৮)-এ ভাষিক চিন্তন-শৈলি অভিব্যক্ত এ-প্রসঙ্গে তা স্মরণ করা যেতে পারে। Resistance Literature অর্থাৎ প্রতিরোধ সাহিত্যচর্চা বিষয়টি নন্দনতত্তে¡র বিকল্প সৌন্দর্য ভাবনা থেকে উত্থিত। ফিলিস্তিনের সাহিত্য আলোচনায় বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচনা-তত্ত¡বিৎ গাসান কানাপানি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ‘মুকাওয়ামা’ দ্বারা Resistance Literature ধারণাটি প্রথম ব্যক্ত করেন। মৌলিক প্রতিরোধ-চর্চা সাহিত্য চর্চা ইতিবাচক এক সাহিত্য মূল্যায়ন ধারা বিকাশে বক্ষ্যমাণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত বিষয় থেকে দিলওয়ারের কাব্য-ভাষা এই ঐতিহ্য ধারণ করে বলে বিশ্বাস।”
পরিশেষে এ কথা বলতেই হয়. মতাদর্শ আর রাষ্ট্রনীতি উপেক্ষা করে সাহিত্য-ভাষা বিনির্মাণ হলো বস্তু-আর্থহীন শব্দ-বিন্যাস মাত্র, মনন-সৌকর্য আর তত্ত¡বেগচালিত আদর্শ-সন্ধিৎসু কাব্য-ভূগোলের পূর্ণায়তন আলোকরশ্মির প্রকাশ সেখানে দুর্লভ-সত্তা সন্ধিৎসা, আত্মানুসন্ধান আর বিশ্বকে অবলোকনের আকুলতা দিলওয়ারের শিল্প-মিমাংসার উৎস, তাই কাব্য-ভাষার-মননাবেগ আর হৃদয়াবেগ তত্ত্বাবেগ প্রত্ন-প্রতিমায় জারিত।

লেনিন বলেছিলেন : ‘প্রকৃত সাহিত্য, সাহিত্যিক কর্মিকে অবশ্যই হতে হবে একক বিশাল সোস্যাল-ডেমোক্রেটিক যন্ত্রের দাঁত ও স্কু, যা হবে সমাজ-প্রগতি এবং গণ-আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য যুক্ত মননে ও কর্মে, জিজ্ঞাসা ও বিকাশে’। দিলওয়ারের কাব্যভাষা এ দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনালোক থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিকশিত তাঁর ভাবনা জীবন-জিজ্ঞাসা ও বস্তু-জিজ্ঞাসায় জাগ্রত, সচকিত করে আমাদের চেতনাকে।

শেয়ার করুন: