মূল: লোরি জনস্টন
ভাষান্তর: রাকি ইউসুফ
বৃটিশতত্ত্ব-পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং, বেঁচেছিলেন যখন, নিজে পুরোপুরি প্রকাশ্য নাস্তিক হয়েও পোপদের সাথে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা করেছেন। সুবিখ্যাত বিজ্ঞানী তিনি, প্রায়ই তাকে ধর্মবিশ্বাস আর ঈশ্বর বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বলেছেন, তার বিশ্বাসএমন যে, এ জগতের সৃষ্টিকর্তা থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই।
২০১৪ সনে এলমুন্দো পত্রিকার এক সাক্ষাতকারেবললেন, “বিজ্ঞান জানবার আগে এমন মনে করা খুব স্বাভাবিক ছিলো যে, ঈশ্বর এই জগত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞান এখন এর আরো যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারছে। ‘ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবো’ কথাটা ব’লে আমি এমনটাই বুঝিয়েছিলাম যে, ঈশ্বরের পক্ষে যা জানা সম্ভব তার সবই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব, যদি বা ঈশ্বর ব’লে কেউ থাকে, যা আসলে নেই-ই। আমি একেবারেই অস্তিবাদী নই।”
১৯৬৩ থেকে অ্যামিও ট্রোফিক লেটারাল স্ক্লেরোসিস (এএলএস, লূগেহ্রিগ্জ্ ডিজিজ-ও বলাহয়) নামের অসুস্থতায় ভুগতে থাকা হকিং এর আগে ২০০৭ সনে রয়টারের কাছে নিজেকে “স্বাভাবিক অর্থে ধার্মিকনই” বর্ণনা করে বলেছিলেন –
“আমার বিশ্বাস জগত নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের নিয়মে। সে নিয়ম হয়তো ঈশ্বর সৃষ্টি করে থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি কখনো সে নিয়ম ভাঙতেও আসেন না।”
পণ্টিফিক্যাল অ্যাকাডেমি অভসায়েন্সেস-এর সাথে সম্পর্ক ছিলো তার। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো ‘ধর্মবিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া এবং বিজ্ঞানের সাথে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ও ধার্মিক মূল্যবোধের সংলাপ উৎসাহিত করা’। সে সম্পর্কের কারণেই একাধিকবার ভ্যাটিকানেও গিয়েছেন তিনি। ২০১৬ তে ভ্যাটিকানে অনুষ্ঠিত এই গোষ্ঠির সম্মেলনে হকিং ‘জগতের উৎস’ বিষয়ে বক্তব্যও রেখেছিলেন।
ওই সব সফরে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার সাথে মিলিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস আর পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট। সে অ্যাকাডেমির উদ্দেশে ২০১০ সনে দেয়া বক্তব্যে পোপ বেনেডিক্ট হয়তো হকিংকে ইইংগিত ক’রে বলেছিলেন, “বিজ্ঞানীরা জগত সৃষ্টি করেন না, তারা এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, আর তাকে অনুকরণের চেষ্টা করেন।”
২০১০-এ প্রকাশ করা ‘দ্য গ্র্যাণ্ডডিজাইন’ বইতে স্টিফেন হকিং আর তার সহ-লেখক লিওনার্দম্লদিনো ব’ ল রেখেছেন যে, বিগ ব্যাং ছিলো অনিবার্য।
সে বইতে বলা হয়েছিলো, “যেহেতু মহাকর্ষ বলের মতো একটা নিয়মের অস্তিত্বআছে, তাই জগতের পক্ষে সম্ভব শূন্য থেকে সৃষ্টি লাভ করা, আর হয়েছেও তাই। স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির কারণেই শূন্যতার বদলেএখন কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে, জগতটা আছে, আমরা আছি। বারুদের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দেবার মতো ক’রে মহাবিশ্বকে চালু ক’রে দিতে ঈশ্বরকে টেনে আনবার দরকার নেই।”
সে বইটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এবিসি নিউজকে তিনি বলেছিলেন, “প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, ঈশ্বর নেই। কিন্তু বিজ্ঞান তাকে অপ্রয়োজনীয় ক’রে ফেলেছে।… পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়েই মহাজগতকে ব্যাখ্যা করা যায়, সেখানে ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় না।”
এর আগে প্রকাশ করা মহাকাশ তত্ত্ব সম্পর্কিত বেস্টসেলার বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ টাইম’-এ হকিং ব্ল্যাকহোল আর বিগব্যাং নিয়েও আলোচনা করেছেন। ১৯৮৮তে প্রকাশ করা এই বইতে তিনি তার ‘থিওরি অভ এভরিথিং’ উপস্থাপন করেছেন, যাতে ‘ঈশ্বরের মন’ সম্পর্কেআভাস দেয়া হয়েছিলো।
সারা জীবন ধ’রে সম্ভাব্য পরকাল সম্পর্কেও নিজের মতামত ব্যাখ্যা ক’রে গেছেন। বলেছেন, “আমার বিশ্বাসে সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হলো, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। এ জগত কেউ সৃষ্টি করেনি, আর আমাদের নিয়তিও কারো হাতে নয়। এ থেকে আমি এই উপলব্ধিও পাই যে, হয়তো স্বর্গ বা পরকাল ব’লেও কিছু নেই। এই একটা জীবনই আমাদের আছে যা নিয়ে আমরা মহাবিশ্বের এই বিশাল নকশাকে অনুভব করতে পারি, আর সে কারণে আমি পরম কৃতজ্ঞও বোধ করি।”
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২০১১ সনে করা মন্তব্যে তার এই অবস্থান আরো স্পষ্ট হয় – “ভাঙা কম্পিউটারের জন্য কোনো স্বর্গ বা পরকাল নেই; ওসব হলো অন্ধকারে ভয় পাওয়া মানুষের বানানো কল্প কাহিনী।”
১৯৪২-এর ৮ জানুয়ারিতে জন্ম নিয়ে এক সময়ে প্রবল অসুস্থতা নিয়েও অনেক সময় ধ’রে বেঁচে থাকা হকিং ওই সাক্ষাতকারে আরো বলেছিলেন, “মৃত্যুকে ভয় পাই না, কিন্তুমরার জন্য কোনো তাড়াও নেই। তার আগে অনেক কিছুই ক’রে যাবার আছে আমার।”
অনুবাদসূত্র: ‘I’m not afraid’: What Stephen Hawking said about God, his atheism and his own death
By Lori Johnston, March 14, 2018