বিপ্রতীপ চিন্তার ১০ বছর
‘শুধুমাত্র শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা করি না আমরা। মাদকযুক্ত সুকুমার শিল্পচর্চা ঘৃণা করি।’ প্রকৃত লক্ষ্যাভিসারি জনমুক্তির কাছাকাছি শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য-দায় আছে কি-না, অনুক্ত-অব্যক্ত ভাবনা ডালপালা পত্রপলবে বিভ্রান্ত করছে; উত্তর মিলেছে কখনো, প্রায়শই মেলেনি। অভ্যস্ত যাপন, চারপাশের জীবনজট ভাবনাকে বিষিয়ে দেয়, মানুষের মানবিক দৈন্য পরাস্ত-আহত করে, নিত্যকার প্রয়োজন খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, জীবনরক্ষাকারি ঔষধ, নিরাপত্তা কোনটা আগে-শিল্পসংস্কৃতিচর্চার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? ১০ বছরের ‘চারবাক’ আরো ভালভাবে বললে ১২ বছর (শুক্কুরবারের আড্ডা ও চারবাক) প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে এসেছে মালার মতো, উত্তর খুঁজেছি নিজেদের মধ্যে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নন্দনভাবনার সাথে প্রাত্যহিকতা জীবনের ক্লেদ, দ্বেষ, জিঘিষা, বিভ্রম, আনন্দ, বেদনা, আভ্যন্তরিণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বৈশ্বিকভাবনা, আন্দোলন রক্তপাত রক্তক্ষরণ মিলিয়ে দিতে চেয়েছি, চেয়েছি একাকার হতে। ব্যক্তি আমি’র দৈন্য ঘুচিয়ে উত্তর-উপনিবেশিক মনন পুনঃআবিষ্কারে ব্রতি হয়েছিলাম আমরা।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লি¬উটিওর মতো সাম্রাজ্যবাদি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভু হয়ে বসেছে, ঋণের বোঝা বাড়ছে তো বাড়ছেই। বিশ্বায়ন গোলোকায়নের ধাঁধায় নিঃস্ব মধ্যবিত্ত। প্রকৃতি, প্রকৃতির সবুজ, বীজ, গাছ-গাছড়া পেটেন্ট রসায়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে অবাধ অবারিত মুক্ত প্রকৃতির মালিক বনে যাচ্ছে রাতারাতি চিহ্নিত বহুজাতিক কোম্পানি। চিরচেনা সবুজ, প্রকৃতি, লালিত স্বপ্ন ফিরিয়ে আনতে হয়ত একদিন ধর্না দিতে হবে এইসব লুটেরাদের কাছে। শত বছরের ঐতিহ্য কৃষি ধ্বংস করা হচ্ছে জিন প্রযুক্তির দোহাইয়ে। উন্নত চাষ, অধিক ফলনের লোভে হারিয়ে যাচ্ছে বিশাল বীজভাণ্ডার। কৃষি, গাছগাছড়া, প্রাণ ও প্রাণিকুল, নারীর জরায়ু, ডিম, পুরুষের বীর্য মুনাফা কামানোর হাতিয়ার। পুঁজি ক্রমশ চেপে বসছে, বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের উপর; স্বপ্ন উসকে দিয়ে আকাক্সক্ষা ও চাহিদা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অস্পষ্ট, ধ্র“ব, আপোসকামি সত্তা অজান্তেই তৈরি হচ্ছে। বহুজাতিক পণ্যায়ন, আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদের নীল-থাবায় সবকিছু এলোমেলো, অসংলগ্ন, আত্মবিনাশক। জীবনযাপনের নিয়ন্ত্রক শক্তি বাড়ছে, অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা মানুষ বিভ্রান্ত, বাস্তুচ্যুত, চিন্তাশূন্য, অথর্ব, জড়। হয়ে পড়ছে কর্পোরেট নিয়মের অধিন। পুঁজির অসম বিকাশ, কর্পোরেট সময়ের নীল থাবায় দাঁড়িয়ে চিহ্নায়ন সম্ভব নয় আসল লড়াই কোথায়, কার বিরুদ্ধে। সস্তা আজগুবি কেচ্ছাকাহিনিসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র-পুঁথি-বইয়ের মাধ্যমে যা করা গেছে, বাঁধ দিতে পারিনি আমরা তাতেও। আধুনিকতার নামে, মিডিয়া ভেল্কিবাজির তোপে-প্রভাবে, প্রতিদিনের মস্তিষ্ক ধোলাই কর্পোরেট পুঁজিবাদিপ্রকল্প শৃঙ্খলে শৃঙ্খলায়িত মানুষের মুক্তিকাক্সক্ষা-মুক্তিস্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। শ্রেণি-সংগ্রাম শ্রেণি-লড়াই যেমন তেমনি পুঁজির অসম বহুজাতিক আগ্রাসন, উত্তর-উপনিবেশিককালেও বর্তমান, উপনিবেশিকতার মায়া অথবা মোহ আজো সমানমাত্রায় ক্রিয়াশিল। আবার, প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট, মানুষের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ফলাবার আকাক্সক্ষা আসলে শুধু ভ্রান্ত-পলিটিক্যাল অর্থনীতি উপজাত নয়।
অন্তর্জাল, উন্মুক্ত আকাশসংস্কৃতি, ভোগ মানুষকে গিনিপিগে পরিণত করছে অথবা কৌশলে করানো হচ্ছে, ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নানা উপকরণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সা¤প্রতিক আবিষ্কারগুলোকে সুপরিকল্পিত ও সুচারুভাবে ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবিশ্ব পরিব্যাপ্ত যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে তাতে বিশাল জনসংখ্যার মেরুদণ্ডহীন মানসিকতা ও চাহিদাসম্পন্ন এক জনগোষ্ঠি, একক বাজার তৈরি করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। মিডিয়ার আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদি তৎপরতা, ফাস্ট ফুড-এফএম রেডিও-ফেসবুক সংস্কৃতির এই দশকে চিন্তাও ঢেলে সাজাতে হচ্ছে। জরুরি হয়ে পড়েছে পক্ষ প্রতিপক্ষ নির্ধারণ, শত্র“ মিত্র চিহ্নিতকরণ।
‘চারবাক’ গোষ্ঠির কাগজ। নাহিদ আহসান, মজিব মহমমদ, আরণ্যক টিটো, রিসি দলাই কাগজের নিউক্লিয়াস। যাদের লেখা ছাপা হয়েছে (ছাপার বাইরে যারা রয়েছেন তাদের সংখ্যাও কম নয়), শুভানুধ্যায়ি আমরা সবাইকে ‘চারবাকগোষ্ঠি’রই মনে করি। ১০ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায় ‘চারবাক’-এ থাকেননি কেউ কেউ মতাদর্শ অথবা অন্য কারণে যাদের অনেকের লেখাই প্রথম ‘চারবাক’-এ ছাপা হয়েছে, যাদের প্রতিষ্ঠাকালিন দায় ‘চারবাক’ সানন্দে গ্রহণ করেছে, তাদের যাত্রাপত্র দীর্ঘ হোক এই কামনা বরাবর।
‘চারবাক’ ১৩ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংখ্যা থেকে লেখা বাছাই সহজ ছিল না মোটেও। স্মৃতিকাতরতা, পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, স্পর্ধা বিষয়গুলো কাজ করছিল। তারপরেও সক্ষম হয়েছি ‘নির্বাচিত চারবাক-১’-এর লেখকসূচি তৈরি করতে। ক্রোড়পত্র এবং বিশেষ সংখ্যার বিষয় এ সংকলন গ্রন্থে স্থান পায়নি। বিশেষ সংখ্যা ‘বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা, বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধিজীবীর দায়’ ইতোমধ্যেই ঢাকা থেকে ‘বুদ্ধিজীবীর দায়ভার’ নামে প্রকাশিত হয়েছে, বাকি বিষয়গুলো নিয়েও পর্যায়ক্রমে গ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছে রয়েছে আমাদের। ‘নির্বাচিত চারবাক-১’ ভবিষ্যতের ‘চারবাক’ গবেষক, সংকলক, সম্পাদক, পাঠকদের জন্য তোলা রইল এই ভরসায়-আমি এর লেখক-বিষয় নির্বাচনে কতটা ব্যর্থ হয়েছি তা যাতে তারা নির্ধারণ করতে পারেন। সংকলনে প্রতিনিধিত্বশিল সব লেখাই রয়েছে, কোনো লেখা ইচ্ছাকৃত বাদ দেয়া হয়নি। যেসব লেখা স্থান পেল না ভাবার কারণ নেই লেখনি রসায়নের কমতি অথবা লেখক-লেখা মানের খামতির জন্য সেসব লেখা বাদ পড়ল, পৃষ্ঠাস্বল্পতা এবং গ্রন্থের কলেবর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির আশংকা থেকেই কিছু লেখা বাদ দিতে হল।
‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’-র সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত আলি ‘চারবাক’ প্রকাশের শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করে আসছেন, আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। ‘সুচারু ডেস্কটপ পাবলিশিং’ প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যায় সহায়তা করে কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে। ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র নানা ঝামেলাপূর্ণ অনুষ্ঠানের দায় কাঁধে দিয়ে আমরা নির্ভার থাকি ‘সুস্বাদু’র কল্যাণে, নানা অত্যাচারও তারা সহ্য করেন সহাস্যে, তাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।
গ্রন্থ সম্পাদনা বিষয়ে অকুণ্ঠ সহায়তা, পরামর্শ নিয়েছি ‘চারবাক’-এর লেখক, বুদ্ধিজীবী ড. সেলু বাসিত, বইয়ের জগৎ সম্পাদক, লেখক, গবেষক আহমাদ মাযহার এবং কথাসাহিত্যিক শহিদুল আলমের কাছ থেকে। বানান সমন্বয় করেছেন লেখক ও বানানবিশেষজ্ঞ ফরীদুল আলম। ‘চারবাকগোষ্ঠি’র বন্ধুদের সহায়তা ছাড়া এই কঠিন কাজ কিছুতেই সম্পাদন হতে পারত না। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
রিসি দলাই
সম্পাদক
চারবাক
১৩৫/২ আহম্মদবাগ
ঢাকা-১০০০