তিন রাত আমার থাকার কোনো জায়গা ছিলো না!
আমেরিকাতে এসেছি দু’মাস আগেই। অনেক চড়াই উৎরাই এর পর এক দূরসম্পর্কের মামা’র বাসায় থাকার জায়গা পেলাম। ঠিক তার ক’দিন আগেই আমি নিজেই সাহস করে কোর্টে গিয়ে আমার বাটপার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম। তারপরও, সে আমায় একটা বাসায় আটকে রেখেছিলো! একদিন বিকেলের দিকে সুযোগ বুঝে আমি পালিয়ে যাই। কোথায় যাবো তখনও জানি না! শুধু জানি আমাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচতে হবে।
উপরের কথাগুলো লিখে নীল বসে থাকে কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবে-হ্যাঁ, আমি নীল। মা কেনো যে এই রঙের নামে আমার নাম রাখলেন! বাইরে আকাশের শেষ সীমানাতেও নীল-সবুজাভ এক আলো ছড়াচ্ছে। তার কোল ঘেঁষে লালচে একটা রেখা। যেন আকাশের সীমানা ভাগ হচ্ছে! কিছু পরেই হবে ভোর। নীল আবারো লিখতে শুরু করে…
তখন আমার বয়স কুড়ি। সেদিন একটা ব্যাগ কাঁধে কোনোমতে আল্লাহ্’র নাম নিয়ে লুকিয়ে বের হয়ে যাই বাসা থেকে। ব্যাগটা নিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে, একটা বড় বিল্ডিং এর পিছে ময়লা ফেলার বিশাল লোহার বিনের পিছে লুকিয়ে রাখলাম। পকেটে মাত্র এক’শ ডলার। টাকাটা দেশ থেকে আসার সময় বড় চাচা দিয়েছিলেন, যাতে আমার কোনো বিপদে কাজে আসে। পালাবার সময় সাথে করে কোনো গয়নাগাটি কিছুই আমি আনিনি। শুধু আমার স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট, একটা গীতবিতান, দুই তিনটা জামা, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, একটা সোয়েটার, আর আমার নানু আপা’র (নানীকে আমরা নানু আপা ডাকতাম) দেওয়া গায়ে দেওয়ার একটা চাদর।
সেই প্রথম আমি রাস্তার পাশের সরকারি ফোন থেকে মামাকে ফোনে কল করি। মামা ফোন ধরার আগেই লাইন খুঁট করে কেটে যায়। কাঁপা হাতে আমি আবার কয়েন রি-ফিল করি ফোনে। মনে মনে পয়সা খরচের চিন্তা। প্রতিটি পয়সা আমার কাছে অমূল্য লাগছে। যাহোক, ওপাশ থেকে মামা ফোন ধরে সব শুনে জানালেন উনি অফিসে। সন্ধ্যের পর এসে আমাকে নিয়ে যাবেন উনার বাসায়। আমি শীতে কাঁপতে কাঁপতে মামা’র জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ব্রংক্স (নৎড়হী) নিউইয়র্কের খুব ভয়াবহ জায়গা। ক্রাইম রেট খুব বেশি। দিনের বেলাতেও ডাকাতি, মারামারি, ছিনতাই লেগে থাকে।
তখন আমি এতো কিছু বুঝি না। আমার বুক ভরা অনড় বিশ্বাস-‘আমি কিছুতেই ভয় পাবো না’। একা একটা মেয়ে কোনো মতে নিজেকে লুকিয়ে অপেক্ষা করছি মামা’র জন্য। আমার বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে! কিন্তু,আমি এও টের পাচ্ছি যে, আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে। কয়েকজন ড্রাগ এডিক্ট এর মতো দেখতে কৃষ্ণাঙ্গ আমার চারপাশ টহল দিতে লাগলো। আমি খুব সাহস করে কটমট করে উঠে সেই বিল্ডিংটার দিকে হাঁটলে লাগলাম। এমন ভাব করলাম যে, আমি ওখানেই থাকি। দেখলাম তারাও আসছে আমার পিছে পিছে। আমার মুখে চোখে আমি যথাসাধ্য সাহস ধরে রাখলাম। তারা কি ভেবে একসময় আমার পিছু ছেঁড়ে দিলো। দ্রæত দৌড়ে গিয়ে লুকালাম সেই ডাস্টবিনের পেছনে! হঠাৎই টের পেলাম নাকে এসে লাগছে পঁচা-বাসি খাবারের গন্ধ, বাচ্চাদের ডায়াপারের গন্ধ, ইঁদুর মরে পঁচে যাওয়া গন্ধ, আরো কতো যে উৎকট গন্ধ! যা আমি নিজেও জানি না। মনে হচ্ছিলো আমি অনন্তকালের ভেতর বসে আছি! ভাবছি, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা! এইতো মামা চলে আসবেন আর তিন ঘণ্টা পর। আমি ভালো কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম… স্কুলের বন্ধুদের কথা, যারা আমায় ডাকতো পাগলী অথবা হাস্যমুখি। বাবা মায়ের মুখ মনে করলাম। কিন্তু, কোন বিকার হলো না! বরং এক চাপা অভিমানে আমার বুকে তিল তিল করে গড়ে তোলা সাহসের পাহাড়টা গলে গিয়ে একটি নদীর মতো হয়ে যেতে লাগলো। দ্রæত আমি তাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে ভাবতে লাগলাম অন্য কিছু।
ভালো কিছু… যা আমাকে আনন্দ দেয়! খুব সুন্দর কিছু যা মনে করলেই আমার নাকে ভেসে আসে মিষ্টি শিউলির গন্ধ! আরো আরো বেঁচে উঠতে মন চায়! মনে পড়ে গেলো আমাদের রামপুরার বাসার ছাদের কথা। খুব ভোরে মাঝে মাঝে পাটি বিছিয়ে ছাদে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতাম আর পূর্বদিক থেকে পাশের বাসার ছাদ ফুঁড়ে ইয়া বড় একটা কমলা রঙয়ের সূর্য উঠতো! নারকেল গাছের চিকন চিকন পাতারা সেই সূর্যটিকে ফালি ফালি করে কেটে দিতো! যাতে করে, একবারে সূর্য আমাকে অন্ধ না করে দেয়! পাশের ছাদে পায়রার দলও আমার সাথে মুগ্ধ হয়ে সেই স্বর্ণের হারের মতো ঝিকমিকে ভোর দেখতো, আমার সাথে রাগ বিলাবল-এ গলা সাধতো! শিউলি ফুল কুড়াতাম ছাদেই! সাদা সাদা সেই ফুলের গন্ধকে আমি ভাবতাম, এ হয়তো সকালবেলার নিজের কোন ঘ্রাণ! যেমন হয় মায়ের গায়ের ঘ্রাণ, বাবার শার্টে ঘামের ঘ্রাণ, পুরনো অথবা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, কবুতরের পাখার ঘ্রাণ, স্কুলে যেতে যেই মাটির ছোট গলিটা পার হতে হয়… সেই মাটির ঘ্রাণ! কানামাছি খেলতে গিয়ে পেয়ারা গাছকে ভুলে জড়িয়ে ধরলে যেমন ঘ্রাণ পাওয়া যেতো, ঠিক তেমনই মনে হতো ভোরের ঘ্রাণ!
নীল লেখা থামিয়ে আরো একবার বাইরে তাকায়। আকাশ এতো সবুজ হয় কি করে! পান্না গায়ে জড়িয়ে আছে না-কি! এখানে, এই বিদেশ বিভূঁই-এ আগের সেই ভোরের ঘ্রাণ নেই! আহা! সেই ঘ্রাণ! নীল চলে যায় সেই সব ঘ্রাণের কাছে। মৌন পথিকের মতো নিশ্চুপ কিছুক্ষণ। মনের ভেতর ধাক্কা দেয় সেই সব রাত! নীল বিড়বিড় করে… কলম জেগে ওঠে। যেন, নিজের সাথেই নিজের গল্প চলছে-নীল আবার লিখতে শুরু করে-সেই শৈশবের প্রতি রাতে কারেণ্ট চলে গেলে আমাদের ছাদে বসতো সাংস্কৃতিক আড্ডা। আমরা যারা গান জানি তারা গান গাইতাম, যে কবিতা জানে সে আবৃত্তি করতো। হারমোনিয়াম, তবলা ভরা পূর্ণিমারাত! আমি গান গাইতাম। ইন্দ্রপুরীর কোন রমণী বাসর প্রদীপ জ্বালো ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো। আমার মনে প্রশ্ন জাগতো-ইন্দ্রপুরী কি? সেই এক রমণী কেনোই বা বাসর প্রদীপ জ্বালবে? বাসর প্রদীপ… আমি মামাকে এই বিল্ডিং এর ঠিকানা-ই দিয়েছিলাম। উঠে গিয়ে বারবার দেখি মামা আসলো কি-না। আবার ভাবতে শুরু করি বৃষ্টিতে ছাদে, ভাইয়া আর আমি দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, একে অন্যের গায়ে পানি ছিটাচ্ছি…! এই ভাবনার মাঝে, তখনই মামা আমাকে আবিষ্কার করেন ডাস্টবিন এর পিছন থেকে। হতবাক হয়ে আমাকে দেখেন। কিছুই বলতে পারেন না। আমি মামার বাসায় যাই। মামী আমাকে বুকে টেনে নেন। তার ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় মামা মামী বাংলাদেশে যাবেন বেড়াতে। মামা আমাকে তার এক বন্ধুর (জহির মামা) বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন, উনারা ফিরে না আসা পর্যন্ত। আমি সেই বাসায় গিয়ে উঠলাম। উনি মামা’র চাইতে বয়সে কিছু কম। সুন্দরী বউ, এক মেয়ে আর তার এক শ্যালক। উনারা সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ভীষণ ধর্ম ভীরু।
আমাকে দেওয়া হলো ঠিক বাথরুমের সাইজের এক ঘর, মূলত ওটা স্টোর রুম ছিলো। আমি তাতেই আনন্দে উঠে পড়লাম। ফ্লোরিং করি। মামী একটা বালিশ আর ব্র্যাংকেট কিনে দিয়েছিলো, তাই নিয়েই থাকি। এদিকে আমি কাজ খুঁজতে শুরু করেছি পাগলের মতো। মামা দেশে যাওয়ার আগে, আমার হাতে নিউইয়র্ক সিটির বাস আর ট্রেনের ম্যাপ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। আমার পকেটে তখন ৭৫ ডলার। মামা জিজ্ঞেস করলেন আমার হাতে টাকা আছে কি-না। আমি হেসে বললাম-‘হ্যাঁ মামা। আমার কাছে যথেষ্ঠ পরিমান টাকা আছে, আপনি চিন্তা করবেন না।’ মামা চলে গেলেন। আর আমার মামা-মামী’র সাথে এ বাড়ির আন্টিও মেয়ে নিয়ে দেশে গেলেন।
যাওয়ার সময় আন্টি বললেন-তুমি মাঝে মধ্যে একটু রান্না করে দিও তোমার আংকেল’দেরকে। আমি হাসি মুখে বললাম-জ্বি মামী।
সেদিন রাতে, আমি ঘুমাতে গেছি। হঠাৎ রাত তিনটার দিকে আমার দরজায় ধাক্কা টের পেলাম। ভাবলাম হয়তো কোনো বিপদ। দরজা খুলে দেখি আমার মামার বন্ধু, মানে আমার বাড়িওয়ালা জহির আংকেল। আমি জানতে চাইলাম- কি হয়েছে আংকেল? উনি নূরানি হাসি দিয়ে বললেন-তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়লাম। তুমি নামাজ পড়বা না?
আমি একটু লজ্জ্বা পেয়ে গেলাম। বললাম-জ্বি, কাল থেকে পড়বো। আজ আমি আসলে ক্লান্ত হয়ে গেছি আংকেল।
উনি আরো মধুর সুরে বললেন-তাইলে থাক। তুমি যেহেতু ক্লান্ত। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া ওতো বেশি জরুরী না, আমার বিছানায় এসে ঘুমাও। আরাম পাবা। এইখানে মাটিতে শুয়ে আছো। আমার খারাপ লাগছে।
উনার কথা শুনে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো। আমি আবারো স্বভাবমতো মুখে চোখে অসীম সাহস মেখে বললাম-আমি এখানেই শান্তিতে আছি আংকেল। আপনি এখন যান। আপনার আল্লাহ্’র কাছে আমার জন্য দোয়া করবেন যেন উনি আমাকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন।
উনি আমার গলার স্বর বুঝতে পেরে বললেন-বিপদ দেওয়ার মালিক আল্লাহ্। আর রক্ষা করার মালিকও আল্লাহ্। তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ থাকো, এটা ঠিক না। আল্লাহ্ পাক এসব মানা করেছেন। আসো আমার ঘরে এসে শোও। বলেই উনি আমার হাত ধরলেন। এই অত্যন্ত খাঁটি, আল্লাহ্্’র পেয়ারের বান্দা আমাকে বুঝতে পারেন নি। আমি ভালো কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম!
নারকেল পাতায় ফালি ফালি হয়ে যাওয়া সূর্য!! কী অপূর্ব সেই আলো! পাশেই মসজিদে হুজুর কী যে অসাধারণ গলায় ডাকতেন-‘হাইয়া আলাল ফালাহ… হাইয়া আলাল ফালাহ..’ আমি সেই কান্না ভেজা গলার গান শুনে শুনে বড় হয়েছি! সেই হুজুরকে আমি দেখিনি কখনো! মসজিদে যেতাম আমপারা পড়তে, কিন্তু বড় হুজুরকে আমি মনে করতে পারিনা! আমার কাছে বড় হুজুর মানেই সেই মন গলানো আযান!! আমার খুব জানতে ইচ্ছা করতো হুজুর কি প্রতিদিন হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধেন! এতো মধুর কণ্ঠ উনার!
আমার বয়স যখন ১২/১৩ আমাদের বাসায় মা এক হুজুর’কে রাখলেন। হ্যাংলা লম্বা একটা মানুষ, দাঁতগুলো পানের রঙে লাল হয়ে থাকে, থুতনিতে একগোছা দাঁড়ি ছিল। আমাকে আর ভাইয়াকে আরবি শেখাবে। মেধাবী ভাই আগে আগেই কোরান শরীফ ধরে ফেললো। আমি যেহেতু গানের ক্লাস থেকে এসে আরবি পড়তাম, তাই আমি একটু পিছিয়ে গেলাম। ভাইয়া আগে পড়ে, তারপর হুজুর আমাকে নিয়ে বসে। হুজুর আরবি পড়ানোর চাইতে আমার জামার ভেতর হাত দিতেই আনন্দ বোধ করতেন বেশি। একদিন আমি আম্মাকে গিয়ে বলি আমি আর এই হুজুরের কাছে পড়বো না। মা জানতে চান কি ব্যাপার। আমি বলেছিলাম-এর পর যদি উনি আরেকবার আমার বুকে হাত দেয় আমি কাঠের যেই জিনিসটার উপর আমপারা রেখে আরবি শিখি ওটা দিয়ে মেরে উনার হাত ভেঙে দেবো। মা ওইদিনই আমাকে হুজুরের কাছ থেকে নিয়ে আসলেন। আর হুজুরকেও বিদায় দিলেন।
এই আংকেল জানে না আমার জীবনের একটি অপূর্ণ বাসনা উনি পূরণ করতে যাচ্ছেন। হুজুরের হাত ভেঙে দেওয়া হয়নি আমার। উনি আমার হাত ধরে আছেন দরজার ওপাশ থেকে। আমি বললাম-‘আংকেল আপনি আমার হাত ছাড়েন।’ উনি তবুও ছাড়লেন না! আমিও উনার নূরানি চেহারা দেখে তখন ক্লান্ত। উনার হাতটা আমার ঘরের আরেকটু ভেতরে এনে আমি আমার দরজা আটকানোর জন্য একটু জোরে চাপ দিলাম। উনি ইন্নালিল্লাহ! বলে একটু আওয়াজ করলেন। আমি আর কিছুই বলিনি, তবে উনি বলেছিলেন-আল্লাহ্ না-কি এর বিচার করবে।
পরদিন সকালে আমি ঘর থেকে বের হতে পারিনি যতোক্ষণ না উনি অফিসে গেলেন। বাসা খালি হওয়া মাত্রই আমি কোনোমতে হাত মুখ ধুয়ে একটু খেয়েই, ব্যাগ গুছিয়ে আবার বের হয়ে গেলাম। জানি না কোথায় যাবো। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে বসে রইলাম রাত অবধি। রাত দশটার দিকে একটা লোককে দেখলাম। আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। তারপর আমার কাছে এসে তার নাম বললো, সে ইটালিয়ান। আমার কথা শুনে বললো-পেন স্টেশনে (চবহহ ংঃধঃরড়হ রহ গধহযধঃঃধহ) চলে যেতে ট্রেনে করে। সেটা নাকি ‘সেফ’ জায়গা। যদিও সেটাও একটা রেলস্টেশন তবে সেখানে অনেক পুলিশ ঘোরাঘুরি করে, আমি নিরাপদ থাকবো সেখানে। সে আমাকে বলে দিলো কিভাবে যেতে হয়। আরো বলে দিলো একা একা এতো রাতে ট্রেন নিরাপদ না। তাই আমি যেন ড্রাইভারের সাথের বগিতেই উঠি। আমি আবারো বুকে অসীম সাহস নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম।
যেন আরো একটা অনন্তযাত্রা শুরু করলাম! মনে হলো প্রতিটা সেকেÐ ঘণ্টার হিসেবে চলছে! যেন আমি অনেক দূরে যাচ্ছি! আমাদের রামপুরার বাসার ছাদের মতো দূর! কবুতরের পাখায় সূর্যের আলোর মতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে! একটা কিশোরী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দূরত্বের দিকে! আর দূরত্ব তাকিয়ে আছে কিশোরীটির দিকে! চোখে চোখ পড়ছে কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না…!
তিন রাত আমি স্টেশনে ছিলাম। চার দিনের দিন আমি একটা নিউজস্ট্যান্ডে কাজ পেলাম!! ম্যানেজার ম্যাক্সিকান। আমাকে ওইদিনই একটা থাকার জায়গা করে দিলেন! এক সপ্তাহ পর আমি আরো একটা কাজ পেলাম রেস্টুরেন্ট-এ। সকালে খবরের কাগজের দোকানে আর বিকেলে রেস্টুরেন্টে। ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করি।
একটা কমদামী মোবাইল কিনলাম। মামা মামী কিছুদিন পর দেশ থেকে ফিরে আসেন। আমি যাই তাদের সাথে দেখা করতে। মামা বলেন-‘তোমার এক্স হাজবেন্ডতো আমাকে কল করে বলেছে তুমি না-কি তার টাকা পয়সা আর সব গয়নাগাটি নিয়ে এসেছো! সে হুমকি দিয়েছে আমার আর তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবে।’ মামী আমার পাতে মুরগির আরো এক টুকরা মাংস তুলে দেয়। আমি মাংসের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে ভাবি সেই কবুতরগুলোর কথা! কী দারুণ করেই না উড়তো! ভোরে উঠেই গান গাইতো! আর মুগ্ধ হয়ে সোনালি ছাই মাখা আকাশ দেখতো!
মামা আবারো বলেন-জহির (মামার সেই বন্ধু যিনি তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য আমায় ডেকেছিলেন) বললো তুমি নাকি ওর শালার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলা। তোমাকে নাকি ওর শালার ঘরে রাতের বেলা দেখেছে।
আমি মামীকে বলি, মামী আমি মাছ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। আমাকে আরেকটু ডাল দেন।
মামী হালকা হাসেন। বুঝতে পারেন যে, মাছ মাংস খাওয়ার সাধ্য আমার নেই। উনি আমার পাতে ডাল তুলে দিয়ে মামাকে বলেন-এহ, আসুক না মামলা করতে। আমার কাছেও ছবি আছে। (আমাকে মামা যেদিন নিয়ে আসে আমার গালে, গলার নীচে আর হাতের ডানায় খয়েরী নীল রঙয়ের মারের দাগ ছিলো। মামী ছবি তুলে রেখেছিলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সেই সব কাগজও মামী রেখে দিয়েছিলেন) খাওয়া শেষে আমি মামার হাতে আমার জীবনের প্রথম উপার্জন তুলে দিয়ে বলি-মামা, আমাকে আপনি ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছিলেন। সেদিন আমার হাতে টাকা ছিলো না। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি। এই টাকা আপনি রাখেন।
মামা চোখ মুছতে মুছতে বলেন-মারে, এই টাকা আমি নিতে পারবো না। আমার নিজের একটা মেয়ে আছে। তুমি তোমার ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে আমার বাসায় আবার থাকবা। তারপর, টাকা পয়সা কিছু জমলে তুমি না হয় নিজে ভাড়া নিয়ে থাইকো। মামা বুঝতে পারে আমার টাকা পয়সার খুব টানাটানি অবস্থা। মামী সাথে খাওয়া দিয়ে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে।
মামা এবার আমাকে সেই ভাড়া করা ঘিঞ্জি বাসা থেকে নিয়ে আসেন উনার বাসায়। কিছুতেই আমার কথা শুনলেন না। আমি আমার মামাতো বোনের সাথে জড়াজড়ি করে বসার ঘরের সিঙ্গেল খাটে ঘুমাই। দুইটা জব করি। মামী আমার সব টাকা জমিয়ে রাখেন। ব্যাংকে গিয়ে মামা একটা একাউন্ট খুলে দেয়। মামা বলেন-পড়াশোনা করতেই হবে তোমাকে! দুইটা জব না করে ভালো একটা চাকরি খুঁজে বের করতে বলে, যাতে করে আমি পড়াশুনা করতে পারি। রেস্টুরেন্টের বস শুনে বলে-‘তোমার জন্য এর আগেও একজন বলেছিলো। দাঁড়াও কল করে দেখি।’
উনি কল করেন ওপাশ থেকে আমাকে ইণ্টারভিউ দিতে যেতে বলে। আমি সময়মতো চলে যাই সেই একাউন্টেন্ট এর অফিসে। ম্যানহাটনে বিশাল বড় কর্পোরেট বিল্ডিং! আমি লিফটে করে উপরে যাই আর ভাবি, সেই ধূসর ডানার কবুতরগুলোর কথা, শিউলি ফুলগুলোর কথা… সেই অপেক্ষায় থাকা কিশোরীর কথা! অপেক্ষা, চোখ অন্ধ করে দেওয়ার মতো একটা সূর্য উঠবে! একটু একটু করে চারপাশ সোনালি হয়ে উঠবে! আবার সব আলো হয়ে যাবে!
একাউন্টেন্ট সাহেবকে খুব চেনা চেনা লাগে আমার। উনি আমাকে উনার নিজের রুমে নিয়ে চেয়ার টেনে বসতে দেন। আমি বসে ভাবি কোথায় দেখেছি উনাকে? হ্যাঁ মনে পড়ে, আমার রেস্টুরেন্ট এ উনি মাঝে মাঝেই আসেন। অতঃপর উনি আমার কুশল জানতে চান। আমি চোখে মুখে সেই সাহসের রেখা টেনে উনার প্রশ্নের জবাব দিই। উনার নাম দেখে বুঝিনি উনি বাঙালী! সেই নিপাট ভদ্রলোক উঠে গিয়ে উনার অফিস ঘরের দরজা লক করে দিয়ে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসেন। হাত দিয়ে আমার চুল কিছুটা ছুঁয়ে দিয়ে বলেন-তোমাকে নিশ্চয়ই সবাই বলে যে তুমি খুব সুন্দরী? আমার হাত পা অবশ হতে হতে আবার জোর ফিরে পায়… আবার অবশ হয়ে যায়। আমি মনে মনে নিজেকে বলি, কিচ্ছু হবে না… কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না।
উনি এবার এমনভাবে আমার সুন্দর হাসি, দাঁত, বড় বড় চোখ আর ঠোঁটের তিলের বর্ণনা দিতে থাকে যে আমার কান গরম হয়ে যায়। তারপর উনি আরো একটু কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখেন। আমার মনে পড়ে যায় আমার ছোটবেলার সেই হুজুরের কথা, গত মাসের সেই বাড়িওয়ালার কথা।
আমি চুপ করে বসে থাকি। উনি বলেন, তোমার চাকরি হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবি। মামা’কে বলেছিলাম ছয়’টার সময় ইন্টারভিউ। এখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। ঠিক এই সময় ঝকঝকে একটা সূর্য পৃথিবীর অন্য পাশে কোন এক কিশোরীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে সোনালি আভায়। হয়তো সেই কিশোরীর এখন তেমন প্রয়োজন ছিলো না সূর্যের! আচ্ছা, সূর্য কি বোঝে মানুষের চাহিদা? নাকি মানুষকে সে দেখতেই পায় না? নাকি দেখতে পায়! সূর্য হয়তো সেই কিশোরীর দিকে তাকিয়ে ভাবে- এইটুকুন ছোট্ট একটা মেয়ে! তার কাছে হয়তো মেয়েটা একটা ছোট্ট শিউলি ফুলের মতোই! অতি ক্ষুদ্র! সূর্য কতো বিশাল! তার আঁচে কিশোরীটির গাল মুখ লাল হয়ে যেতে থাকে, তবুও সে নিজেকে আড়াল করে না!
একাউন্টেন্ট সাহেব আমাকে বলেন, আগামী দু’দিন আমার অফিস বন্ধ। নিউ জার্সি’তে একটা নতুন বাড়ি কিনেছি। সাগরের হাওয়া আর জলে তুমি পাগল হয়ে যাবে! খুব সুন্দর! সূর্যাস্ত দেখা যায় বারান্দা থেকে…
আমি মনে মনে ভাবি সূর্য দেখা যায়! আমি সূর্যাস্ত দেখিনি আগে কখনোই! সূর্যাস্ত মানেই পড়তে বসতে হবে। খেলা শেষ করে ঘরে ফিরতে হবে। আমি আবারো ঘড়ি দেখি। ঘড়ি আমার খুব প্রিয়। ঘড়ি ছাড়া নিজেকে আমার অসহায় লাগে, বন্ধুহীন মনে হয়। উনি এবার আমাকে জোর করে দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরতে চায়! আমি চিন্তা করে পাই না সূর্যাস্ত কেন আমি আগে কখনোই দেখিনি!
উনার কাছ থেকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বলি, আমি অনেক কিছু দেখেছি জীবনে। আপনি আমায় কিছুই করতে পারবেন না। টের পাই আমার পা কাঁপছে! তারপর বলেছিলাম, ‘আজ যদি আমাকে আপনি কিছু করতে চান। তবে, আপনাকে সব শেষে আমাকে খুন করে ফেলতে হবে। কারণ, আমি যদি আজ এখান থেকে যেভাবে এসেছি সেই অবস্থায় বের না হই, আমি আপনাকে রীতিমতো ধ্বংস করে ফেলবো। জেলে ঢুকিয়ে ছাড়বো। আমি অন্য আর দশটা বাঙালী মেয়ের মতো চুপ করে বসে থাকবো না। এতোদিনের এই রেপুটেশন আমি শেষ করে দিবো। লোকে আমাকে কি বলবে সেই চিন্তা আমি করি না। সুতরাং, আপনি ভালো করে ভেবে দেখেন আমাকে খুন করে আমার লাশ গুম করবেন নাকি নিজের ইজ্জত বাঁচাবেন?
উনি আমার চোখ মুখ দেখেই হয়তো বুঝতে পারেন যে, আমাকে ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি যখন ঐ অফিস থেকে বের হয়ে লিফটে উঠি তখন ভয়ে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছিল! কিসের ভয় তাও আমি জানি না! আমার মনে আছে ওই বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরেছিলাম! মামাতো বোনের পাশে শুয়ে শুয়ে ‘মার্টিন লুথার কিং ডে’ সম্পর্কে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম মার্টিন লুথার কিং কি রোজ সকালে ছাদে উঠে নারকেলের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্য দেখতো! কে বেশি বড় ছিলো! সূর্য! নাকি মার্টিন লুথার নামের কালো মানুষটি! আমি একটা কিছু মেলাতে চেষ্টা করি। ছোটবেলায় জ্যামিতি বইতে আঁকা সেই অদ্ভুত সব আকারগুলোর দিকে। এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে ছুটে যাওয়া!
আমিও ছুটে যাই রোজ! এক কাজ শেষ করে অন্য কাজের জায়গায়। এই রোজের ভেতর আমি আমার সূর্যটার কথা ভাবতাম। একটা কিশোরীর মুগ্ধ হয়ে অপেক্ষার কথা আমার মনে আসতো। এর দেড় বছর পর আমার মামা একদিন লং আইল্যান্ড এ বাড়ি কিনে চলে গেলেন। আমি এক সিলেটি ফ্যামিলির সাথে গিয়ে একরুম ভাড়া নিলাম। সেই বাসার খালার ছেলে রাত বিরাতে আমার দরোজায় টোকা দিতে লাগলো।
আমি বুঝলাম আমাকে আর কারো সাথে থাকা যাবে না। তখন নিজের কাজের জোরে বেশ কিছুটা ভালো জায়গায় উঠে এসেছি। আমি ম্যানেজার হয়ে যাই সেই রেস্টুরেন্ট এর। যেখানে দিন রাত এক করে আমি হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছি। এরই মাঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরুষ আমার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমিও নিজেকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসেছি কোনো না কোনোভাবে। একটা মেয়ে, একা! বিদেশের মাটিতে, বাবা মা নেই, ভাই নেই… শেয়াল শকুন পিছে লেগেই থাকে! কাজ শেষে রাত করে বাসায় ফিরলে পাশের বাড়ির বাঙালীরা আড়চোখে দেখে, নানান কথা বলে। আমি পাত্তা দিই না। আরো একটু টাকা জমিয়ে বাঙালী এড়িয়া থেকে দূরে চলে যাই নিজের এপার্টমেন্ট নিয়ে। আমার মনে পরে যায় তিন রাত চার দিন আমি রেলস্টেশনে ছিলাম! কেউ আমায় জায়গা দেয়নি, খেতে সাধেনি!
প্রচÐ আত্মসম্মান থাকার দরুন আমি কাউকেই আমার এই কষ্টের কথা জানতে দিইনি।
একদিন মামা মামী আসেন আমার নতুন এপার্টমেন্ট-এ। নিজের একটা এপার্টমেন্ট নিয়েছিলাম আড়াই বছর পর। মামা মামী সারাদিন থাকলেন আমার বাসায়। দিন শেষে যখন মামা’কে বিদায় দিচ্ছিলাম। মামা আমার মামাতো বোনটাকে বললেন, ‘মা, তুমি যতো বড় হবা দিনে দিনে, তোমার এই আপুর মতো করে বড় হবা।’
তারপর মামা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘মারে আমার দুঃখ যে তুমি আমার মেয়ে না আর আমার আনন্দ যে তুমি আমাকে সেইদিন ফোন করছিলা। তোমার মামীকেও বলি তোমাকে দেখে শিখতে কি করে বেঁচে থাকতে হয়। আমার খুব আনন্দ লাগে যখন কেউ তোমার প্রশংসা করে। গর্বে আমার বুকটা ফুলে যায়।’
আমি মামাকে বলি, ‘মামা আমি তো আপনার মেয়ে-ই, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে!’
মামা হাসতে থাকে আর বলে, ‘পাগল মেয়ে। তোমাকে নিয়ে আমার কোন ভয় নাই। তুমি একটা ফাইটার! সূর্যের মতো তেজ!’
সূর্য! বাইরে আকাশ লাল হচ্ছে। মামা’র কথা মনে মনে আসে খুব নীল এর। বুকের ভেতর এক ঝাঁক কবুতর উড়ে উড়ে রাগভৈরবী গাইতে থাকে… সাদা সাদা ভাতের মতো শিউলি ফুলগুলো উড়তে থাকে তাদের সাথে। কতো যে রঙ! তারা কিশোরীটিকে ঘুরে ঘুরে দেখে! নারকেল গাছটাও একমনে তাকিয়ে থাকে কিশোরীটির দিকে। মুচকি হাসে! হয়তো নারকেল গাছটা ইচ্ছে করেই সূর্যটাকে ওভাবে কেটে নিয়ে আসতো! একটু একটু তাপ নিয়ে আসতো। একটু একটু করেই সহ্য করা শিখতে হয়। একটু একটু করে তাপ নিতে হয়, দিতেও হয়। কিশোরীটি চেয়ে থাকে সেই তোলপাড় করা অপেক্ষায়! নীল জানে যারা ভোর দেখেনি, ভোরের বুকের ভেতর কান পাতেনি, সকালের সেই মিষ্টি সুবাস বুকে নেয়নি… তারা হয়তো কখনো জানবেও না কতো কতো কিশোরী রোজ ভোরে, ফালি ফালি হয়ে কেটে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে আগুন হয়ে ওঠে! নীল নামের আগুন।…
লেখক তালিকা
জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক
এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →