মহামতি সক্রেটিসের গুণমুগ্ধ শিষ্য প্লেটো (প্লেটো খ্রি.পূ. ৪২৭-৩৪৭) শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন জ্ঞান-সত্য-সুন্দর-কল্যাণের এক মহামান্বিত মানবজীবনের। মানবশিশু রাষ্ট্রের সম্পদ। শিশুকে জন্ম দেয়া যেমন মাতা-পিতার প্রাকৃতিক দায়িত্ব, তেমনি তাকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের বিশেষ কর্তব্য বলে মনে করেন আমাদের প্লেটো। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রকে বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে প্লেটোর দর্শনচিন্তার উত্থান ও এর বিকাশকে। প্লেটো তাঁর নৈতিকতা ও রাষ্ট্রবিষয়ক সকল চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন মূলত সক্রেটিসের দ¦ারা প্রভাবিত হয়ে। সক্রেটিসকে তিনি যে কতখানি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং গুরুভক্তি করতেন তা প্লেটোর এ উক্তি থেকেই বোঝা যায়: ‘স্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে আমি বর্বর না হয়ে সুসভ্য গ্রিক জাতির একজন হয়ে জন্মেছি, ক্রিতদাস না হয়ে স্বাধিন হয়েছি, মহিলা না হয়ে পুরুষ হয়ে জন্মেছি, এবং বিশেষ করে আমি সক্রেটিসের যুগে জন্মাতে পেরেছি।’ বস্তুত, প্লেটোদর্শনে সক্রেটিসের প্রভাব এত স্পষ্ট যে, মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কাছে সক্রেটিস যে দর্শন প্রচার করেছেন, প্লেটো তারই দিয়েছেন এক লিখিত সংবদ্ধ তাত্তি¡ক রূপ। প্লেটোর দার্শনিক মত প্রকাশের বাহন ছিল সংলাপ। তিনি যে প্রাঞ্জল ও প্রসাদগুণযুক্ত ভাষায় দার্শনিক আলোচনা করেছেন, দর্শনের ইতিহাসে তার নজির বিরল। অবশ্য তার রচনা শৈলির দিক দিয়ে চমৎকার হলেও কোথাও কোথাও প্লেটোর ভাষা দুর্বোধ্য। এর কারণ, একই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দর্শন ও কাব্য, বিজ্ঞান ও কলার সংমিশ্রণের চেষ্টা করেছেন। এ সত্তে¡ও তাঁর সাহিত্য-সংলাপগুলো আজও বিশ্বের সাহিত্যভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্লেটোর দার্শনিক অবদানের স্বিকৃতি প্রসঙ্গে এমারসন যথার্থই বলেন: ‘প্লেটো মানেই দর্শন, আর দর্শন মানেই প্লেটো।’
প্লেটো তাঁর একাডেমিতে যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন সেগুলোর কোনো প্রামাণিক রেকর্ড আজ আর নেই। তবে তার রচিত বহু গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে। এসব গ্রন্থ সংলাপের আকারে লেখা, এবং এগুলো প্লেটের ডায়ালগ (dialouge) নামে পরিচিত। ‘ডায়ালগ’ কথার অর্থ সংলাপ বা কথোপকথন। বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে কিছু বিষয় নিয়ে সংলাপ আকারে আলোচনা প্লেটোর গ্রন্থাবলিতে ব্যক্ত হয়েছে। প্লেটোর সংলাপগুলোর কেন্দ্রিয় চরিত্র সক্রেটিস; এবং সক্রেটিসের মুখ দিয়েই প্লেটো তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। প্লেটোর নামে মোট ছত্রিশটি গ্রন্থ প্রচলিত আছে। তবে এসব গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি গ্রন্থের মৌলিকত্ব নিয়ে পণ্ডিতেরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে ‘পারমেনাইডিস’, ‘সোফিস্ট’, ‘ক্রেটাইলাস’ এবং ‘ফিলেবুস’ উল্লেখযোগ্য। প্লেটোর সংলাপগুলো বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি নানা সময়ে বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবেে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: এপোলজি (Apology), ক্রিটো (Crito), ইউথিফ্রন (Euthyphron), ল্যাচেস (Laches), আইয়ন (Ion), প্রোটাগোরাস (Protagoras), চারমাইডিস (Charmides), লাইসিস (Lysis), রিপাবলিক (Republic), জর্জিয়াস (Gorgias), মেনো (Meno), ইউথিডেমাস (Euthydemus), ক্র্যাটিলাস (Cratylus), সিম্পোজিয়াম (Symposium), ফিডো (Phaedo), ফ্রিডাস (Phaedrus), থিয়্যাটিটাস (Theaetetus), পারমেনাইডিস (Parmenides), সোফিস্ট (Sophist), ফাইলিবাস (Philebus), টাইমিয়ুস (Timaeus), লজ (Laws)। এর মধ্যে রিপাবলিক (Republic) ও লজ (Laws) এ দু’টি বইয়ে তিনি একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার পদ্ধতি ও বিধি-বিধান কেমন হবে সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। সর্বোপরি তিনি মনে করেন তার প্রস্তাবিত আদর্শ রাষ্ট্রের নকশার প্রয়োগ হলে একটি রাষ্ট্রে সত্য-ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। দেশের যুবসমাজের ভেতর থেকে নৈতিক অবক্ষয় হ্রাস পাবে। দেশ আরো বেশি উৎপাদনমুখি হয়ে উঠবে। তবে তার প্রস্তাবিত পদ্ধতিসমূহ খুব বেশিদিন ধোপে টেকেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ছিল স্ববিরোধি ও সাংঘর্ষিক। যার ফলে তিনি রিপাবলিক-এর পরে উক্ত বইয়ে উলেখিত বিধানের সংস্করণ ও সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন লজ (Laws) বইটি প্রকাশের মাধ্যমে। আমরা পর্যায়ক্রমে প্লেটোর দর্শনে রাষ্ট্রচিন্তার উত্থান ও গণতন্ত্রবিদ্বেষি মনোভাব, তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাপদ্ধতি, আদর্শ রাষ্ট্রে কমিউনিজম-এর প্রবর্তন, আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রের সাথে আদর্শ রাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক বিষয়সমূহ ও আদর্শ রাষ্ট্রের পতন, পুঁজিবাদের গণতন্ত্র নামক ভেলকিবাজির প্রয়োগ আলোচনা করবো।
প্লেটোর দর্শনে রাষ্ট্রচিন্তার উত্থান ও গণতন্ত্রবিরোধি মনোভাব: প্লেটোর জন্মলগ্নে তাঁর মাতৃভূমি এথেন্স ছিল এক জাতিয় সংকটের সম্মুখিন। প্রতিবেশি রাষ্ট্র স্পার্টার সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর এথেন্স যখন সম্পূর্ণরূপে পরাভূত, তখন প্লেটোর বয়স মাত্র তেইশ বছর। মাতৃভূমির এ শোচনিয় পরাজয়ে প্লেটো বিচলিত ও ব্যথিত বোধ করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এথেন্সের পরাজয়ের মূলকারণ তথাকথিত গণতন্ত্র। তাই তিনি ভাবলেন: এই গণতান্ত্রিক সরকারের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন সু-সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায় কি করে? প্লেটোর গুরু সক্রেটিসের মতবাদ মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। তাই সে গুরুর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই বলেছিলেন-‘গণতন্ত্র হচ্ছে মুর্খের চর্চা, এখানে মত এবং মাথার (সংখ্যার) বিবেচনা করা হয়, জ্ঞান-বুদ্ধি, ন্যায়-কল্যাণের বিবেচনা করা হয় না।’
শিঘ্রই দেখা গেল প্লেটোরই চাচা ক্রিটিয়াসের নেতৃত্বে বিশ নেতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হলো এক নতুন সরকার। দুঃখের বিষয় এ নতুন সরকারের শাসনও দেশের সামগ্রিক কল্যাণের অনুকূল হলো না। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গণবিরোধি কার্যকলাপ ছাড়াও এ উচ্ছৃঙ্খল সরকার প্লেটোর গুরু সক্রেটিসকে বিভিন্নভাবে অপমানিত করে। যাই হোক, অচিরেই এ সরকারের পতন ঘটলো। প্রাচিন গণতন্ত্রের হলো পুনরুত্থান। বলাবাহুল্য, এ নতুন গণতান্ত্রিক সরকারও এমনসব অবাঞ্ছিত কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়লো, যার ফলে শুরু হলো দেশের সামগ্রিক অবস্থার অবনতি। বিশেষ করে এ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার সক্রেটিসের উদারনৈতিক দার্শনিক শিক্ষা সমর্থন করতে না পেরে নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে ব্যবস্থা করে তাঁর প্রাণদণ্ডের। পরম শ্রদ্ধেয় গুরুর এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুতে মর্মাহত হলেন প্লেটো। গণতন্ত্রের প্রতি আদর্শ সরকারের যার পরিচালনার ভার ন্যস্ত থাকবে কতিপয় উত্তম ও বিজ্ঞ ব্যক্তির ওপর। তাই তাঁর পরবর্তি চেষ্টা হলো এমন এক পদ্ধতির আবিষ্কার যার সাহায্যে উত্তম ও বিজ্ঞ প্রশাসকদের মনোনায়ন সম্ভব।
এদিকে সক্রেটিসের মৃত্যুর পর ক্ষমতাসিন গণতান্ত্রিক নেতারা সক্রেটিসের সমর্থকদের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। প্লেটোর শুভাকাক্সিক্ষরা এথেন্সকে তাঁর জন্য নিরাপদ না ভেবে তাঁকে অবিলম্বে এথেন্স ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। প্লেটো প্রতিবেশি রাষ্ট্র মেগারাতে চলে যান। তারপর তিনি দীর্ঘ বারো বছর দেশের বাইরে অবস্থান করেন এবং প্রবাসজীবনে তিনি মিসর, ইটালি, সিসিলি প্রভৃতি দেশ সফর করেন। দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশ সফরের পর বিপুল অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের অধিকারি হয়ে চলিশ বছর বয়সে প্লেটো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রথমেই তিনি একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরবর্তিকালে এই শিক্ষাপিঠই প্লেটোর একাডেমি নামে পরিচিতি পায়। আজকাল আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বুঝি, প্লেটোর একাডেমি ছিল অনেকটা তাই। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জ্ঞান ও সত্যের অনুশিলন এবং সর্বোপরি দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রিয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার জন্য নাগরিকদের শিক্ষাদানই ছিল এই একাডেমির মূল কাজ। অল্পদিনের মধ্যেই একাডেমির নাম-যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষার্থি তাতে ভর্তি হতে থাকে।
প্লেটো তাঁর গ্রন্থাবলিতে দর্শনের জয়গান করেন তাতে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষ করে তাঁর অমর গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এ তিনি দার্শনিক শাসিত এক আদর্শ রাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা করেন, তা বিভিন্ন মহলে বিপুল প্রেরণা ও উদ্দিপনা সৃষ্টি করে। কথিত আছে যে, সিরাকুসের রাজা ডায়োনিসাসের মৃত্যুর পর তাঁর তরুণ পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করেই ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্লেটোকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানান। অনিচ্ছা সত্তে¡ও প্লেটো এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ছ’বছর পর একই কারণে তিনি আবার আমন্ত্রিত হন। কিন্তু আবার তিনি বিফল হয়ে এথেন্সে ফিরে আসেন। এথেন্সে ফিরে এসে তিনি তাঁর একাডেমিতে পুনরায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং দার্শনিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্লেটো দর্শনকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।
দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর প্রতিবেশি স্পার্টার হাতে এথেন্স যখন পরাস্ত হয়, তখন প্লেটোর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। মাতৃভূমির এই শোচনিয় পরাজয় প্লেটোর কোমল মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তাই যুগিয়েছে তাঁর সামাজিক ও নৈতিক দর্শনের মূল প্রেরণা, নির্ধারিত করেছে সেই দর্শনের রূপরেখা। প্লেটো প্রথমেই হাত দিলেন তদানিন্তন সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যালোচনা ও সমিক্ষার কাজ। তিনি অচিরেই বুঝতে পারলেন যে, নৈতিক জ্ঞানের অভাবই এথেনিয়দের দুঃখ-দুর্দশা ও অধঃপতনের মূল কারণ। তাদের এ দুঃখ-দুর্দশা লাঘব এবং একটি সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে প্রথমেই তিনি প্রয়োজন বোধ করলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার যার মূল লক্ষ্য হবে দেশের মানুষকে সুবিচার ও ন্যায়পরতার ধারণার সাথে পরিচিত করে তোলা। তবে তিনি এ-ও উপলব্ধি করলেন যে, সাধারণ অর্থে জাস্টিস বা ন্যায়পরতা কথাটিকে যদিও সহজ বলে মনে হয়, এর স্বরূপ ও তাৎপর্য উপলব্ধি এবং ব্যবহারিক জীবনে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ মোটেও সহজ নয়। তাই ন্যায়পরতার বিমূর্ত ধারণাকে কি করে মূর্ত ও স্পষ্ট করে তোলা যায় এবং কি করেই-বা একে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, তা-ই হয়ে দাঁড়ালো প্লেটোর সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শনের প্রধান আলোচ্য।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা: মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনবোধ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে যে সমাজ গড়ে ওঠে এর আদিম রূপ ও ক্রমবিবর্তনের বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের অভিভাবক, সৈনিক ও কারিগর-এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেন এবং তাদের শ্রেণিগত কার্যক্রম নির্দিষ্ট করে দেন। নিজ নিজ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হবে নাগরিকদের কর্তব্য। কারিগর ও সৈনিক শ্রেণির কাজ হবে যথাক্রমে খাদ্য উৎপাদন ও দেশরক্ষা। রাজনৈতিক দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে একমাত্র অভিভাবক বা শাসকশ্রেণির ওপর। অভিভাবকদের সংখ্যা থাকবে সৈনিক ও শ্রমিকদের সংখ্যার তুলনায় কম। রাষ্ট্রিয় কর্তৃপক্ষ প্রথমেই যোগ্যতার ভিত্তিতে অভিভাবকদের মনোনিত করবেন। এরপর তা বংশানুক্রমিকভাবে চলবে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে মাঝে মধ্যে নাগরিকদের শ্রেণি পরিবর্তন করা হবে। এ নীতি অনুসারে শ্রমিকশ্রেণির মেধাবি শিশুকে অভিভাবক-শ্রেণির, আর অভিভাবক-শ্রেণির অনুপযুক্ত শিশুকে শ্রমিকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
জন্ম থেকে শুরু করে সারাজীবন মানুষ বোধ করে নানারকম অভাব। কিন্তু কোনো মানুষের একলার পক্ষে তার সব অভাব মেটানো সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ গ্রহণ করে নেয় নিজ কর্মপন্থা। এ চিরন্তন সামাজিক নীতির দিকে লক্ষ্য রেখেই প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের শ্রেণিবিভাগ করলেন এবং তাদের শ্রেণিগত কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিলেন। তবে এ শ্রমবিভাগের অর্থ এ নয় যে তারা পারস্পরিক কলহ-কোন্দলে লিপ্ত হয়ে সামাজিক ঐক্য ও শান্তি ব্যহত করবে। প্লেটো তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন: নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতে হবে আদর্শ রাষ্ট্রের তিন শ্রেণির নাগরিকদের। একের কাজ অন্যকেউ হস্তক্ষেপ না করে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বলিষ্ঠ সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলাই হবে তাদের লক্ষ্য। প্লেটোর মতে তিন শ্রেণির নাগরিকদের একতা ও সমঝোতার মধ্যেই নিহিত রাষ্ট্রের ন্যায়পরতা।
রাষ্ট্র বলতে ব্যক্তিমানুষের সমষ্টিকেই বোঝায়। তার ধ্যান-ধারণা, আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটে। রাষ্ট্রে যেমন রয়েছে দার্শনিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক, এ তিনটি দিক, মানবাত্মারও রয়েছে বুদ্ধিজাত (rational), বির্যজাত (spirited) ও কামনাজাত (appetitive), এ তিনটি দিক। রাষ্ট্রিয় ন্যায়পরতা যেমন রাষ্ট্রের তিন শ্রেণির নাগরিকদের সহযোগিতা ও সমঝোতার উপর প্রতিষ্ঠিত, ব্যক্তিগত ন্যায়পরতাও নিহিত মানবাত্মার তিন অংশের সমঝোতার মধ্যে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাপদ্ধতি: নির্ভেজাল দর্শনানুরাগ ও রাষ্ট্রিয় কল্যাণ কামনা, এ দুই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে অভিভাবকদের। আর এ লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবেই প্লেটো প্রণয়ন করলেন কতকগুলো শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও জৈবিক পরিকল্পনা। প্রথমেই তিনি ব্যাখ্যা করেন আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাপদ্ধতির স্বরূপ। আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষার স্তর থাকবে দুটো-প্রাথমিক ও উচ্চতর। ভূমিষ্ঠ হওয়ার থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত নাগরিকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। তবে উচ্চশিক্ষার ব্যাপ্তি থাকবে সিমিত। বেশ কিছু পরিক্ষা-নিরিক্ষার পর যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি উপযুক্ত বিবেচিত হবেন কেবল তারাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নানা পরিক্ষায় যারা উত্তির্ণ হবেন তাদের ওপরই ন্যস্ত থাকবে দেশের শাসনভার।
প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়বস্তু হবে সংগিত ও ব্যায়াম। দুটিকেই প্লেটো ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আজকাল সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি, সংগিত কথাটিকে প্লেটো অনেকটা সে অর্থেই ব্যবহার করেছেন। ব্যায়াম কথাটিকেও তিনি মাংসপেশির নিছক সঞ্চালনের সঙ্কুচিত অর্থে ব্যবহার না করে করেছেন ক্রিড়ানুষ্ঠান (athletics)-এর অর্থে।
নাগরিকদের মধ্যে গাম্ভির্য, শালিনতা ও সৎসাহসের প্রেরণা সৃষ্টি করাই হবে শিক্ষাদর্শনের মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনে প্রসূতি থেকে শুরু করে সব শিক্ষক-শিক্ষিকার রয়েছে এক গুরুদায়িত্ব। তাই শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে তাদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সাহিত্য ও সংগিতের ক্ষেত্রে আরোপ করা হবে কঠোর বাধানিষেধ। শিশুদের শুধু এমন গল্প ও সংগিত শিক্ষা দেয়া হবে যা তাদের মনে সৎসাহস ও সংযম সৃষ্টি করবে। কালেভদ্রে যদিও-বা আদর্শ রাষ্ট্রে নাটক মঞ্চস্থ করা হবে তাতে থাকবে শুধু সদ্বংশজাত ও নিষ্কলঙ্কচরিত্র পুরুষ অভিনেতা। মহিলা ও ভিলেনদের অনুকরণের ফলে দর্শকদের নৈতিক চরিত্র কলুষিত হতে পারে। সুতরাং আদর্শ রাষ্ট্রে যেসব নাটক মঞ্চস্থ করা হবে সেগুলোতে মহিলা ও ভিলেনদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
জেনোফ্যানিসের ন্যায় প্লেটো কবিদের নিন্দা করেন। বস্তুত, তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোনো স্থান নেই। হোমার ও হেসিয়েড সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা ছিল বিরূপ। কেননা তাঁরা উভয়েই তাঁদের রচনায় দেবতাদের অনৈতিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত বলে দেখিয়েছেন এবং দেবতারা ভাবাবেগ দ্বারা চালিত বলে তারা প্রচার করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা দেবতাদের উচ্চ মর্যাদার কথা উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষের পক্ষে অনুকরণিয় কোনো ভালো গুণ দেবতাদের আছে একথাও অস্বীকার করেছেন। হোমার এ-ও দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, পৃথিবীতে দুষ্টু লোকেরা সুখি এবং পুণ্যবানেরা অসুখি জীবন যাপন করে থাকে। এসব কাহিনি কোনোমতেই শিশুদের শোনানো চলবে না। প্লেটোর দৃষ্টিতে এ ধরনের মন্তব্য দেবতাদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মানের পরিচায়ক এবং নিতান্তই অবাঞ্ছিত। তাঁর মতে, ঈশ্বরকে কল্যাণ ও অকল্যাণ এ দুয়েরই স্রষ্টা না বলে দেখাতে হবে শুধু কল্যাণের স্রষ্টা বলে। আদর্শ রাষ্ট্রের ছাত্রদের এ শিক্ষা দিতে হবে যে পুণ্যবানেরা পুরস্কৃত ও পাপিরা তিরস্কৃত হবে।
ব্যায়াম তথা শরীরচর্চার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বাধানিষেধ আরোপ করা হবে। পানাহারের ব্যাপারে নাগরিকদের খুবই সংযমি হতে হবে। তাদের খাবারের তালিকা থাকবে অত্যন্ত সিমিত। মাছমাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, তবে রোস্ট ব্যতিত অন্য সবরকম আমিসের ব্যঞ্জন নিষিদ্ধ। প্লেটোর বিশ্বাস, এ সংযমি নিয়ম অনুশিলনের ফলে আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকেরা সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অভিভাবকদের অবশ্যই প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ হতে হবে। আর এজন্য রাষ্ট্রে প্রণয়ন করতে হবে এমন এক ব্যবস্থা যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য নির্বাচিত নাগরিকদের একইসঙ্গে উপযুক্ত শাসক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যারা ভবিষ্যতের শাসক নির্বাচিত হবেন তারা শুধু সংগিত ও ব্যায়াম শিখবেন না, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানও শিক্ষা লাভ করবেন। শুধু শুদ্ধ গণনার জন্য নয়, বুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যেও তারা গণিত শিখবেন। শাসক হিসেবে মনোনিত ব্যক্তিকে ত্রিশ বছর বয়সে দার্শনিক শিক্ষার জন্য নিযুক্ত হতে হবে। পাঁচ বছর তিনি এ শিক্ষা লাভ করবেন। তারপর তাঁকে সামরিক কিংবা অন্য কোনো সরকারি বিভাগে পনেরা বছর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এ সময় তিনি জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করবেন এবং কোনো প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হওয়ার মতো দৃঢ়তা অর্জন করবেন। এভাবে তিনি পৌঁছাবেন পঞ্চাশ বছর বয়সে এবং ভূষিত হবেন উচ্চতম দার্শনিক প্রজ্ঞায়। প্লেটোর মতে, এহেন প্রাজ্ঞ দার্শনিক দ্বারা রাষ্ট্রের যে প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আদর্শ রাষ্ট্রে কমিউনিজমের প্রবর্তন: একটি আদর্শ অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে প্রবর্তন করলেন কমিউনিজম। কমিউনিজমের প্রথম প্রকাশ ঘটবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি এবং রাষ্ট্রিয় তত্ত¡াবধানে সমষ্টিগত জীবন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। এরপর তা বিকাশ লাভ করবে জীবন ও স্ত্রিপুত্র বর্জনের মাধ্যমে। সমষ্টিগত জীবনে সহঅবস্থানকালে নারি-পুরুষের সম্পর্ক থাকবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তবে এ সম্পর্ক যেন কোনো অবৈধ রূপ না নিতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা থাকবে আইনানুগ বিয়েশাদির। রাষ্ট্রিয় কর্তৃপক্ষ আয়োজিত বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠানে লটারি দ্বারা বর ও কনেদের যথাক্রমে তাদের পাত্র ও পাত্রি নির্বাচিত করার অনুমতি দেয়া হবে। আর এ নিয়মেই অনুষ্ঠিত হবে তাদের মিলন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। ফলে মা-বাবা তাদের সন্তানদের চিনতে পারবে না। বিশেষ শিশুপালন কেন্দ্রে রাষ্ট্রিয় তত্ত¦াবধানে তাদের প্রতিপালন করা হবে। রাষ্ট্র পঙ্গু ও ব্যাধিগ্রস্ত শিশুদের কোনো যত্ন নেবে না, বরং তাদের এমন অজ্ঞাত জায়গায় সরিয়ে নেয়া হবে যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকবে না।
আজন্ম জনক-জননির দর্শন ও পরিচয়বঞ্চিত শিশুদের পক্ষে তাদের নিজ নিজ মা-বাবাকে চেনা সম্ভব নয়। তাই তাদের প্রতি প্লেটোর নির্দেশ, বয়সে বড় পুরুষ ও মহিলাদের তারা যথাক্রমে বাবা ও মা বলে সম্বোধন করবে। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলারাও অনুরূপভাবে সব ছেলেমেয়েকে তাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে বলে বিবেচনা করবেন। শুধু তা-ই নয়, সমবয়সি পুরুষ ও মহিলাদের যথাক্রমে ভাই ও বোন বলে সম্বোধন করবে। হাস্যকর মনে হলেও প্লেটো আশা করেন যে, এ নিয়ম অনুশিলনের ফলে আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোর উপর আলোকপাতের পর তাতে নারিদের স্থান কি হবে, এ প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। আর প্লেটোও একথা ভুলে যাননি। তিনি বলেন, দৈহিক দিক দিয়ে পুরুষ ও নারিদের মধ্যে পার্থক্য আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাপারে কিংবা অধিকার ও দায়িত্বের সাথে এ পার্থক্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নাগরিক হিসেবে পুরুষ ও নারিদের দায়িত্ব সমান। কাজেই পুরুষের বেলায় যে শিক্ষা প্রযোজ্য নারির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। প্লেটো তাই বলেন: ‘যে শিক্ষার কল্যাণে একজন পুরুষ যথার্থ অভিভাবক হতে পারেন, ঠিক একই শিক্ষার ফলে একজন মহিলাও উত্তম অভিভাবক হতে পারবেন।’ এককথায় রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের ব্যাপারে প্লেটো নারি ও পুরুষের সমতার সুপারিশ করেন এবং উপযুক্ততা অনুসারে পুরুষের ন্যায় নারিদেরও দেশের যেকোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করার কথা বলেন।
আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে আকর্ষণিয়। তিনি তাঁর দর্শনচিন্তায় এরকম এক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশা করতেই পারেন। কল্পনার রঙিন তুলির আঁচড়ে তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে আকর্ষণিয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ কাল্পনিক রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন কি সম্ভব? আর তাই যদি না হলো, তা হলে রাষ্ট্র প্রণয়নের সার্থকতা কোথায়? উত্তরে প্লেটো বলেন: আদর্শ রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ন্যায়পরতা আবিষ্কার। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়িত না হলেও আদর্শের প্রতিক হিসেবে এর মূল্য অপরিমেয়। নিষ্কলুষ আদর্শ রাষ্ট্রের অনুকরণ করে পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কগণ তাঁদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের দোষত্র“টি সংশোধন করার সুযোগ পাবেন। এভাবে অনুকরণ করতে গিয়ে সত্যিকারের রাষ্ট্রগুলো যদি আদর্শ রাষ্ট্রের পর্যায়ে না-ও পৌঁছাতে পারে, অন্তত তার কাছাকাছি যেতে পারবে। বাস্তব রাষ্ট্রের শুভ প্রেরণার উৎস হিসেবে আদর্শ রাষ্ট্রের বিশেষ সার্থকতা এখানেই।
তবে আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন যে সম্পূর্ণ অসম্ভব, একথা প্লেটো মনে করেন না। বরং বিশেষ একটি শর্তপূরণ সাপেক্ষে এর বাস্তবায়ন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। শর্তটি হলো: দার্শনিকেরা আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক হবেন। কথাটিকে হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। তবে, ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের ছয় ও সাত সংখ্যক পুস্তকে প্লেটো দার্শনিকদের স্বভাব-চরিত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা থেকে এর মর্ম অনুধাবন করা যায়। সাধারণত দার্শনিক বলতে বাস্তবজ্ঞানহীন কল্পনাবিলাসি এক শ্রেণির অদ্ভুত লোককে বোঝায়। তাদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করলে দেশের দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য যে বেড়েই চলবে তাতে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। কিন্তু ‘দার্শনিক’ কথাটিকে প্লেটো এ স্থ’ূল অর্থে ব্যবহার করেননি। তাঁর মতে, দার্শনিক হলেন তিনি যিনি কেতাবি মতবাদের সিমা অতিক্রম করে বাস্তব জীবনের সাথে স্থাপন করবেন নিবিড় যোগসূত্র, যাঁর প্রচেষ্টা হবে চিন্তা ও কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন। যথার্থ দার্শনিকের লক্ষ্য হবে চলমান অভিজ্ঞতার জগতের ঊর্ধ্বে যে নিশ্চল নির্বিকার চিরন্তন সত্তা রয়েছে তার সুনির্মল জ্ঞান। সত্যের প্রতি তাঁর থাকবে যতটুকু আকর্ষণ, মিথ্যার প্রতি থাকবে ততটুকু অবজ্ঞা। দৈহিক ভোগবিলাসের প্রতি থাকবে তার বিতৃষ্ণা, আর আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির প্রতি তার থাকবে সবিশেষ লক্ষ্য। তিনি হবেন পরম সাহসি। মিথ্যার আবরণ থেকে সত্যকে মুক্ত করার সংগ্রামে তিনি করবেন যেকোনো ত্যাগ স্বীকার। এসব অমূল্য চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন দার্শনিকদের উপর দেশের শাসনভার অর্পিত হলেই দেশের ব্যাপক স্থায়ি কল্যাণ সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, জনগণের মনে ন্যায়পরতার প্রেরণা জাগবে এবং পরিণামে মানুষ সুখশান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
গণতন্ত্রের সাথে আদর্শ রাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক বিষয়সমূহ ও আদর্শ রাষ্ট্রের পতন : ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো দেখিয়েছেন যে, সহজেই আদর্শ রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ধরতে পারে। ভাঙ্গনের প্রথম পর্যায়কে তিনি বলেছেন টিমোক্রেসি (timocracy)। প্রজ্ঞা ও সুবিচারের মনোবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সরকার যখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখনই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণ নয়, ক্ষমতাই এ সরকারের লক্ষ্য। সুতরাং যে একতা ও শৃঙ্খলার ওপর আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত তা এখানে অনুপস্থিত। আদর্শ রাষ্ট্রের পতনের দ্বিতীয় ধাপ ধনিকতন্ত্র (oligarchy)। এখানে অর্থ সংগ্রহ সরকারের অভিষ্ট লক্ষ্য। অর্থলোলুপ শাসকদের অধিনে যখন একটি দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব হয় তখনই ধনি ও দরিদ্র, এ দুই শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। তবে যারা প্রভূত অর্থের অধিকারি, তারাই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালি হয়ে ওঠে। তৃতীয় প্রকারের সরকারকে বলা হয় গণতন্ত্র (democracy), যা ধণিকদের চেয়ে নিকৃষ্টতর। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রে পূর্ণ অরাজকতা সৃষ্টি হয়। শাসকদের আইন-শৃঙ্খলার প্রতি ভ্র“ক্ষেপ না করার ফলে সর্বত্র দেখা যায় ব্যক্তিবাদের (individualism) প্রভাব। এখানে প্লেটো এথেনিয় গণতন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করেন, কেননা তাঁর মতে এ গণতন্ত্রই ছিল এথেন্সের সর্বনাশের মূল কারণ। চতুর্থ পর্যায়ের সরকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট। একে বলা হয় স্বৈরতন্ত্র tyranny)। এখানকার শাসক ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারি মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। স্বৈরতন্ত্রে কি করে যুদ্ধের উদ্ভব হয়, প্রাজ্ঞ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে কতিপয় অবিবেচক ব্যক্তি কি করে সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, প্লেটো এখানে ব্যাখ্যা করেন। স্বৈরাচারি ব্যক্তি পশুবৎ। সুতরাং তার অভিলাষ কোনোদিনই পূরণ হয় না। মানুষের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং স্বৈরাচারী শাসিত রাষ্ট্র সর্বাধিক নিকৃষ্ট।
পরবর্তিকালে প্লেটো ক্রমশই রক্ষণশিল-ভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। সিরাকুসের ব্যর্থতার ফলে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁর দার্শনিক রাজার পরিকল্পনা নিতান্তই অবাস্তব। ফলে এ পরিকল্পনা পরিহার করে তিনি আইনের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনায় মনোনিবেশ করেন। ‘স্টেটস্ম্যান’ গ্রন্থে তিনি কল্পলোকের ভাববাদ পরিহার করেন এবং আইনের প্রতি সরকারের আনুগত্যের ভিত্তিতে রাজতন্ত্র (monarchy), অভিজাততন্ত্র (aristocracy) এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্র (constitutional democracy)-এ তিনভাগে সরকারকে বিভক্ত করেন। এ তিন প্রকারের সরকারের মধ্যে তিনি গণতন্ত্রকে নিকৃষ্টতম এবং রাজতন্ত্রকে সর্বোত্তম সরকার বলে ঘোষণা করেন। আবার স্বৈরতন্ত্র (tyranny), ধনিকতন্ত্র (oligarchy) এবং বিশৃঙ্খল গণতন্ত্র (lawless democracy) এ তিন শ্রেণির সরকারের কথাও তিনি বলেন। এ প্রকল্পে তিনি বিশৃঙ্খল গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম এবং স্বৈরতন্ত্র নিকৃষ্টতম সরকার। প্লেটোর মতে, বিশৃঙ্খল গণতন্ত্রে স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম নিপিড়ন সংঘটিত হয়। স্বৈরচারি শাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করে যথেচ্ছাভাবে। এ গ্রন্থে প্লেটো সরকার পরিচালনার কলাকৌশলের উপর জোর দেন। তাঁর মতে, সরকার পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন জনসাধারণের পক্ষে অসম্ভব। এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। অজ্ঞ রাজনীতিকদের কাছে দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারাদি ছেড়ে দেয়ার প্রথাকে তিনি বিদ্রুপ করেন। ‘লজ’ গ্রন্থে প্লেটো রাজনীতিবিষয়ক আলোচনায় প্লেটো প্রতিক্রিয়াশিল মনেবৃত্তির পরিচয় দেন। তিনি এখানে ঈশ্বরতান্ত্রিক সরকারের সমর্থন করেন। রাষ্ট্রের শাসকদের ধর্ম সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে। তাঁদের অনপেক্ষ নৈতিক নিয়ম গ্রহণ এবং আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতে হবে। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁদের বিশেষজ্ঞ হতে হবে। এর ফলে তাঁরা জগতের স্থায়ি নিয়মাবলির সাথে পরিচিত হতে পারবেন। ঈশ্বরই হবেন এ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান। ঈশ্বর তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশ শাসন করবেন। যারা এ সরকারের বিরোধিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্লেটোর মতে, এথেন্সের দুর্দশার কারণ সে দেশের নৈতিক অবক্ষয়।
পুঁজিবাদের গণতন্ত্র নামক ভেলকিবাজের প্রয়োগ: বুর্জোয়াদের প্রতি বোদল্যার যথার্থই বলেছেন-‘সংখ্যায় আর বুদ্ধিতে তোমরাই বড়; তাই তোমারই ক্ষমতা; আর ক্ষমতাই ন্যায়। তোমাদের কেউ কেউ ‘শিক্ষিত’; অন্যরা ‘বিত্তবান’। ‘শিক্ষিত’রা যেদিন বিত্তবান আর ‘বিত্তবান’রা ‘শিক্ষিত’ হবে, নতুন গৌরবময় এক দিন শুরু হবে সেদিন। তখন তোমাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ হবে; আর কেউই এর বিরোধিতা করবে না। সেরকম একটা সময়ের আগ পর্যন্ত চূড়ান্ত-অবিরত-স্বস্তির সমন্বয় আমাদের। বিষয়টা এই যে, ‘বিত্তবান’রা ‘শিক্ষিত’ হতে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে; কেননা জ্ঞান হলো উপভোগেরই এক ভঙ্গি যা মালিকানার চেয়ে কম নয়। নগরের নিয়ন্ত্রণ তোমাদের এবং এটাই হওয়ার কথা, কেননা ক্ষমতা তোমাদেরই। কিন্তু সুন্দরকে অনুভব করার ক্ষমতা অবশ্যই থাকা উচিত তোমাদের; কেননা তোমাদের কারোরই অধিকার নেই ক্ষমতাকে ছেড়ে থাকার। একইভাবে তোমাদের কারোরই ক্ষমতা নেই কবিতাকে ছেঁড়ে থাকার। খাবার ছাড়া তুমি তিনদিন বেঁচে থাকতে পার; কবিতা ছাড়া কখনোই নয়। আর তোমাদের মধ্যে যারা উল্টোটা ভাবো তারা ভুল, তারা নিজেদের জানো না।’
কিন্তু প্লেটো স্বপ্ন দেখছেন কবি ও কবিতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একটি নৈতিক অথচ উৎপাদনশিল রাষ্ট্রব্যবস্থার; কখনও কখনও তা মানবতা-বিবর্জিত; যা পরস্পরবিরোধি। প্লেটো তার প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে সংগিত ও ব্যায়ামের বিষয়টি রেখেছেন। অথচ যারা সংগিত রচনা করবেন সেইসব কবি ও গিতিকবিকে রেখেছেন দূরে। তাঁর মতে কবিরা ঈশ্বরের নীতি-বিবর্জিত বিষয়টিকে তুলে ধরে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছেন। কিন্তু সব কবিই কি ঈশ্বর নিয়ে ভাবেন, মাথা ঘামান? কবির কবিতা কখনো হয়ে ওঠে সংগিত, কখনো-বা জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে তার মা-বাবার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। তুলে দেয়া হবে জাতিয় মা-বাবার কাছে। অর্থাৎ সরকার সন্তান লালন-পালন করার জন্য আদর্শ ও নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে সন্তানের ভার তুলে দেবেন। অভিভাবক-শ্রেণিই আবার শাসন করবে দেশের শ্রমিক ও সৈনিক-শ্রেণিকে। অভিভাবক-শ্রেণির অনুপযুক্ত শিশুই লাগাম ধরবে শ্রমিক বা সৈনিক- শ্রেণির। কে কোন শ্রেণিতে কাজ করবে তা নির্ভর করবে অভিভাবক-শ্রেণির ওপর। অভিভাবকরা যাকে চাইবেন তাদের শাসকগোষ্ঠিতে অন্তর্ভুক্ত করবেন আবার যাকে চাইবেন শ্রেণি পরিবর্তন করাবেন। এ ব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য দেখা দেবে প্রকটরূপে। এক শ্রেণি জমির লাঙ্গল টানবে অন্য শ্রেণি অভিভাবকত্ব করবে। এ বিষয়টি অনেকেই মেনে নেবে না। যার ফলে তাদের দমন করতে শাসককে অবশ্যই স্বৈরতান্ত্রিক হতে হবে। এ ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে কতটুকু নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক গড়ে উঠত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। চার্চভিত্তিক শিক্ষা সংগঠন বা আমাদের মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা সংগঠনও প্রায় প্লেটোর প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের মতোই। এখান থেকে কতজন আদর্শ নাগরিক বেরিয়ে এসেছে তা বলা মুশকিল। তবে তিনি শাসক কে হবেন এ বিষয়ে সুপরামর্শই দিয়েছেন। দেশের শাসনভার বুঝিয়ে দেয়া হবে সেইসব ব্যক্তিকে যারা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত নানা পরিক্ষায় উত্তির্ণ হবেন।
আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে হলে সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জাতিয় মা-বাবার হাতে তুলে দেয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু? প্রতিটা পরিবারের ভেতর নৈতিকতার বিজ বপন করলেই জাতিয়ভাবে একটি রাষ্ট্র আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। প্লেটো একদিক দিয়ে একটি কথা ভালো বলেছেন-তিনি পুরুষের পাশাপাশি নারি-শিক্ষার প্রতিও জোর দিয়েছেন। যা আধুনিক সমাজব্যবস্থার অগ্রগতিতে এক বিস্ময়কর টনিক হিসেবে কাজ করছে। আবার এক জায়গায় প্লেটো বলেছেন প্রতিবন্ধি কিংবা কর্মক্ষম সন্তানকে এমন জায়গায় সরিয়ে দেয়া হবে, যেখান থেকে তারা যেন আর ফিরে আসতে না পারে। দেশের ও পরিবারের বোঝাকে তারা যেন ভারি করে তুলতে না-পারে। বিষয়টি কতটুকু মানবিক ও নৈতিক তা প্রশ্নাতিত। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কতটুকু অধার্মিক হওয়া যায়; নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কতটুকু অনৈতিক হওয়া যায় প্লেটোর শুধুমাত্র এই বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়। মানবশিশু কার? রাষ্ট্রের না ঈশ্বরের। যে সে বিকলাঙ্গ হলে অনুৎপাদনশিল হলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে অন্যদের চেয়ে দূরে। এত দূরে যে সে যেন আর ফিরে আসতে না পারে। বিষয়টি মর্মান্তিক ও হাস্যকরও বটে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের পতন ঘটেছিল। প্লেটো দার্শনিক মানুষ তাই তিনি স্বপ্ন দেখতেই পারেন। এ স্বপ্ন দেখাটা তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু কল্পনা ও বাস্তব সবসময় বিপরিত। কল্পনার রাষ্ট্র অনেক সুন্দর ও সুখময় হয়। বাস্তবিকতার রাষ্ট্র পরিপূর্ণ থাকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নিষ্ঠুরতায়। যুগে যুগে পুঁজিবাদের স্রষ্টা শাসকগোষ্ঠিরা বিশ্বকে শাসন করেছেন কখনো সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা গণতন্ত্রনামক ভেলকিবাজির মুখোশ পড়ে। তন্ত্র কিংবা মন্ত্রাচ্ছন্ন নাগরিকেরা কেবল হা-হুতাশই করেছেন। কিন্তু তারা জানেন না তারা কত বড় কাজ করেছেন। বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন তারাই তাদের অজান্তে নিরবে। তাই অতি নিষ্ঠুর হলেও বোদল্যারের সেই কথাটি বলে ইতি টানব-‘সংখ্যায় আর বুদ্ধিতে তোমরাই বড়; তাই তোমারই ক্ষমতা; আর ক্ষমতাই ন্যায়।’