‘না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মতো গতর; এমনতর অকর্মণ্য যে পুরোহিতশ্রেণি, তাদেরই একটা হিলে হিসেবে রচিত হয়েছে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কথা, তিন তিনটে বেদ, এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। আসলে স্বর্গ, অপবর্গ বা পারলৌকিক আত্মা বলে সত্যি কিছু নেই।’
ভাবতে অবাক লাগে: অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের দেশে এই রকম সাংঘাতিক কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে আক্রোশটা স্পষ্ট। তবু শুধু আক্রোশ নয়, সহজ বুদ্ধির নির্মল খণ্ডন-পদ্ধতিও। চার্বাকপন্থি যেমন বলেন। কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে শাসকশ্রেণির দাবিগুলোকে ঘষে দেখো, দেখবে কি অসম্ভব রকমের মেকি।
জ্যোতিষ্টম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সোজা স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের বাপকে হাঁড়িকাঠে ফেলে না? শ্রাদ্ধপিণ্ড যদি পরলোকগত মানুষের পেট ভরাতে পারে, তাহলে কেউ বিদেশ যাবার সময় তার সঙ্গে চিঁড়েমুড়ি বেঁধে দেবার আর দরকার কি? (ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ডি দিলেই তো চলা উচিত; হাজার হোক পরলোকের চেয়ে ইহলোকেরই দেশান্তর অনেক কাছে-পিঠের ব্যাপার)। কিংবা, স্বর্গে বসে পৃথিবীতে দেওয়া পিণ্ডে যদি কারুর সাধ মেটে, তাহলে ছাদে বসে মাটিতে দেওয়া পিণ্ডে তার পেট ভরে না কেন?
এই যেন চার্বাকপন্থির খাঁটি দার্শনিক পদ্ধতি। কূটতর্কের দিকে ঝোঁক কম, মৌলিক চার্বাকবাদে একান্তই তা ছিল কি-না ভেবে দেখবার কথা। কাজের ক্ষেত্রে, আটপৌরে দৈনন্দিত জীবনে যাচিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কোন দর্শনের কতখানি দৌড়। অবশ্য এমন খোলাখুলি এই পদ্ধতির কথা তাঁরা বলতেন কি না জানা নেই; খুব সম্ভব বলতেন না,-দর্শনের পদ্ধতি নিয়ে তখনকার দিনে আজকালকার মতো এত তর্কাতর্কি নিশ্চয়ই ছিল না। তা ছাড়া চার্বাক-দর্শনের কোনো সম্পূর্ণ পুঁথি আমাদের কাছ পর্যন্ত তো এসে পৌঁছয়নি, যদিও যে সব খণ্ড বিক্ষিপ্ত শ্লোক আজো টিকে রয়েছে তার থেকে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, কোনো-না-কোনো সময়ে এ দর্শনের উপর সম্পূর্ণ গ্রন্থ নিশ্চয়ই রচিত হয়েছিল। সে পুঁথি বিলুপ্ত হয়েছে। এ ঘটনাকে শুধুই শতাব্দির শোভাযাত্রার ফল বলে বর্ণনা করা চলবে না, কেননা শতাব্দির শোভাযাত্রা সত্তে¡ও তো প্রাচিনতর অন্যান্য গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়নি। বরং অনুমান করা স্বাভাবিক যে, বিজয়ি ব্রাহ্মণ্যশ্রেণি দেশের বুক থেকে এই সাংঘাতিক নাস্তিক্যবাদের সমস্ত কীর্তিকলাপ ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। এই প্রচেষ্টার বহুমুখি স্বাক্ষর আছে। তবু এই দর্শনের যে সমস্ত টুকরো বিক্ষিপ্ত চিহ্ন আজও বর্তমান, তা থেকে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, চার্বাকদের ব্রাহ্মণ্যবিদ্বেষ নিছক বিদ্বেষ ছিল না, রীতিমত দার্শনিক ভিত্তির উপর তার প্রতিষ্ঠা ছিল এবং বিপক্ষের বহুমুখি প্রচেষ্টা সত্তে¡ও এ মতবাদকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়া কোনোদিন সম্ভব হয়নি। এ কথার সপক্ষে বহু প্রমাণের মধ্যে একটি উলেখযোগ্য প্রমাণ হলো মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। প্রায় ছশো বছর আগে লেখা এই পুঁথি, দেশের দার্শনিক আলোচনার আসর তখনো রীতিমতো সরগরম। সংস্কৃতে লেখা ভারতিয় দর্শনের ইতিহাসের মধ্যে এ গ্রন্থ অন্যতম। তাই একে প্রামাণিক বলে না মেনে উপায় নেই। অন্যান্য আস্তিক লেখকদের মতো মাধবাচার্য ঈশ্বর-বন্দনা করে গ্রন্থ শুরু করতে চেয়েছেন। কিন্তু এভাবে শুরু করতে গিয়েই তাঁর হুঁশ হয়েছে চার্বাকদের কথা: তারা ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক সবই উড়িয়ে দিতে চায়। তাই, চার্বাকবাদ খণ্ডন করে না নিলে ঈশ্বরস্তুতির ভিত মজবুত হয় না। এই সূত্রে মাধবাচার্য একটি পরিপূর্ণ দার্শনিক মতবাদের বর্ণনা করেছেন, এমনকি কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যা নাকি খোদ চার্বাকপন্থিদের রচনা বলেই সাধারণত স্বিকৃত। সাধারণত এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকুকেই চার্বাক দর্শনের প্রধান সম্বল বলা হয়। এ ছাড়া অবশ্যই চার্বাক-দর্শনের খুচরো কথাবার্তা বিভিন্ন দার্শনিকদের গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্তটাই পূর্বপক্ষ হিসেবে। এসব থেকে অন্তত একথা নিশ্চয়ই প্রমাণ হয় যে, এ দর্শন সম্বন্ধে কোনো কালে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ লেখা হোক আর না-ই হোক এবং সে-সব পুঁথি দেশের বুক থেকে বিলুপ্ত করবার জন্যে বিপক্ষ দলের চেষ্টা থাকুক আর না-ই থাকুক,-মতবাদটা দেশের দার্শনিক সমাজে এককালে রীতিমত শোরগোল সৃষ্টি করেছিল। নইলে একে খণ্ডন করবার জন্যে সমস্ত দার্শনিক দিকপালের এত মাথাব্যথাই-বা হবে কেন? মাধবাচার্য তো সোজাসুজি মেনে নিয়েছেন: দুরুচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টিতম্, চার্বাক মত উচ্ছেদ করা নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়।
তবু এ মত উচ্ছেদ করবার জন্যে চেষ্টার ত্র“টি ছিল না। তাই এই দর্শনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান প্রচারক, তাঁর নামটুকু পর্যন্ত ইতিহাস থেকে বেমালুম মুছে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো আধুনিক পণ্ডিত অবশ্য সোজাসুজি মনে করেন যে, চার্বাক বলেই এক ব্যক্তি এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তাঁর নাম অনুসারেই দর্শনটার নামকরণ। কিন্তু দেশের প্রবাদ ও ঐতিহ্যে এ মতের কোনো সমর্থন নেই। বরং প্রবাদ আছে যে, দেবতাদের গুরুদেব বৃহস্পতি এককালে কোনো এক কূট অভিপ্রায় চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যে এই মতবাদের প্রবর্তন ও প্রচার করেছিলেন। মাধবাচার্যও চার্বাকদের সোজাসুজি ‘বৃহস্পতি-মতানুসারি’ বলেই বর্ণনা করেন। এই প্রবাদ, এবং এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃত তথ্য আছে, তার আলোচনা পরে করব। আপাতত প্রশ্ন উঠবে: যদি তাই হয়, তাহলে ‘চার্বাক’ নাম এল কোথা থেকে? আধুনিক পণ্ডিতেরা শব্দার্থের বিচারে এ প্রশ্নের জবাব খোঁজেন। হতে পারে, সাধারণ লোকের মন ভোলানো কথা বলত বলে-চারু+বাক্-এদের নাম চার্বাক। হতে পারে চর্ব শব্দ থেকে এ নামের উৎপত্তি, অর্থাৎ চার্বাক হলো সেই দার্শনিকের নাম, খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে যে খুঁজত পরম পুরুষার্থ।
চার্বাকপন্থি যে সাধারণ মানুষের মনে ধরবার মতো কথা বলতেন, এ বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা জনগণের সহজ কর্মবোধের কাছে এই লোকায়ত জগৎই একমাত্র সত্য। কৃষক জানে, তার পায়ের তলায় মাটি আর মাথার উপরে মেঘ-পৃথিবীর সমস্ত দার্শনিক তত্তে¡র চেয়ে ঢের বেশি সত্য। এই মাটিতে লাঙল দিয়ে সে যে সোনার ফসল ফলায়, তা মায়া নয়, মনের খেয়ালি ধারণা নয়, আর এই সোনার ফসলের প্রায় সবটুকু যখন ওঠে জোতদারের গোলায়, তখন কৃষকের পেটে যে বাস্তব জ্বালা ধরে তার উপর অনেক রকম আধ্যাত্মিক প্রলেপ মাখিয়ে তবে ঠাণ্ডা রাখতে হয়। পেটটা হলো মনের ধারণা, আর খালি পেটের যন্ত্রণাটা দীর্ঘ স্বপ্নের মতো প্রাতিভাসিক-এমনতর কথা শুধু তারই স্বার্থে রঞ্জিত, যে নিজে চাল উৎপাদন করতে নারাজ অথচ নৈবেদ্যর চাল দিয়ে সংসার চালাতে নিপুণ। ধুলোমাটির গ্লানিমুক্ত এক চিন্ময় জগতের কথা জনগণের দর্শন হতে পারে না, জনগণের মনে ধরবার মতো কথাই চার্বাক দর্শনের কথা। আর জনগণের দর্শন বলেই খিদে পেলে পেট ভরে খাবার কথা বলতে এ দর্শনের চক্ষুলজ্জা নেই। চর্বণ ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের কাছে অগৌরবের কিছু নয়,-আভিজাতিক সমাজের ক্ষিণাঙ্গির, কাছে চর্বণ জিনিসটা যত হীন আর নিচ পশুবৃত্তির পরিচয়ই হোক-না কেন। তাই, একথা যদি প্রমাণও হয় যে, চর্ব শব্দ থেকে তাদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে, তাহলেও জনগণের পক্ষে কান লাল করবার কোনো কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই।
শ্রেণি-সংগ্রামের আলোচনায় এসে পড়তে হয়। একদিকে জনগণ আর তাদের লোকায়ত দর্শন, অপরদিকে পুরোহিত শ্রেণি, যাগযজ্ঞ। আর পারলৌকিক আত্মার কথা। একদিকে নিদেন পেট ভরে খাবার কথা, (যদিও ধার করে ঘি খাওয়ার উৎসাহটা নিশ্চয়ই অপপ্রচারের দরুন) অপর দিকে ইহজীবনে উপবাসি থেকে পুরোহিত-ভোজন করিয়ে পরলোকে পরমান্ন পাবার স্বচ্ছ যুক্তি। প্রাচিন ভারতিয় দর্শনেও শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। একে অত্যাধুনিক ছাত্রের উদ্ধত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাধবাচার্যের বইতে খোদ চার্বাকপন্থির যে শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে, তার মধ্যেও শ্রেণি-সংগ্রামের ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট:
‘মৃতের উদ্দেশে প্রেতকার্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের জীবনোপায় ছাড়া আর কিছু নয়। যারা তিন তিনটে বেদ রচনা করেছে তারা বেবাক ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরের দল।’
‘ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ’: শুনতে যে রুচিতে বাধে, মনে হয় কাঁচা খিস্তি। দর্শনের ‘নৈর্ব্যক্তিক’ আলোচনায় এ রকম শালিনতার অভাব কেন? কিন্তু মুশকিল এই যে, ‘ছোটলোকের’ দল শাসকের বিরুদ্ধে যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন তাদের কাছে সুরুচি, শালিনতা প্রভৃতি তথাকথিত ‘মনুষ্যধর্ম’গুলো লোকঠকানো সাধুবাক্যেরই অঙ্গবিশেষ মনে হতে পারে বই কি! বিপক্ষের সাধুপুরুষমাত্রই জানেন যে, বিপ্লবের সময় রক্তাক্ত বিভৎসতা করতে পর্যন্ত ‘ছোটলোক’দের রুচিতে বাধে না, খিস্তি-খেউড় তো নেহাত ছোট ব্যাপার। তবু সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম এক জিনিস-এবং দার্শনিক দ্ব›দ্ব তার প্রতিবিম্ব হলেও হাজার হোক স্বতন্ত্র স্তরের ব্যাপার। বাষ্পজল ছাড়া কিছুই নয়, তবু শুধু জলও নয়-শুধু জলে এঞ্জিন চলে না, বাষ্পে চলে; তাই বাষ্পের আইনকানুনও আলাদা। মানুষের দার্শনিক চেতনা জিনিসটিরও সেই অবস্থা। বাস্তব সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতেই তার জন্ম, তবু নিছক এই ঘাত-প্রতিঘাত দিয়ে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না। তার আইনকানুন আলাদা। তাই কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু শ্রেণিস্বার্থের উলেখ করলেই চলবে না। মাটির পৃথিবীতে মজবুত খুঁটি ছিল বলেই আমাদের দেশের চার্বাকপন্থিরাও সুস্থ জড়বাদের এই প্রাথমিক সত্যকে যেন অস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। বিপক্ষদলের শ্রেণিস্বার্থের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই চলবে না। কেননা, বিপক্ষের হাতে আছে দার্শনিক পদ্ধতির এক অপূর্ব সুদর্শনচক্র, সে অস্ত্র দিয়ে সমস্ত জড়বাদ তারা অবলিলায় খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে পারে। এ অস্ত্র হলো বিশুদ্ধ বিচার-বুদ্ধি, অভ্রান্ত তর্কপদ্ধতি। পরমসত্তা বিশুদ্ধ তর্কপ্রণালির দাবি মানতে বাধ্য, বিপক্ষের কাছে এ কথা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ এবং বুদ্ধির দাবি জড়বাদ কোনোমতেই মেটাতে পারে না। কিন্তু জড়বাদের প্রথম কথা হলো: বাস্তবজগৎ বুদ্ধির দাবি মানতে বাধ্য নয়, বরং বুদ্ধিই বাস্তব জগতের দাবি মানতে বাধ্য।
চার্বাকপন্থিও বিপক্ষের শ্রেণিস্বার্থটুকু প্রকাশ করে দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বিপক্ষকে নিরস্ত্র করতে কোমর বেঁধে লেগেছেন। বিশুদ্ধ তর্কপদ্ধতি বলে ব্যাপারটার গোড়াতেই গলদ, তর্কের কোনো দার্শনিক প্রতিষ্ঠা নেই। চার্বাকপন্থি বলেন, তর্ক-পদ্ধতির সবচেয়ে মামুলি উদাহরণটা নিলেই একথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে। পর্বতঃ বহ্নিমান ধূমাৎ। ধূম দেখে পর্বতে বহ্নি অনুমান করা সম্ভব। তার কারণ আমাদের স্থির বিশ্বাস-যত্র যত্র ধূমঃ তত্র তত্র বহ্নি, যেখানে যেখানে ধুঁয়ো সেখানে সেখানেই আগুন। কিন্তু কথা হলো, এ রকম বিশ্বাস পোষণ করবার অধিকার কোথা থেকে পাওয়া সম্ভব? নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো অজুহাত থাকতেই পারে না, অথচ নিছক অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে ‘সমস্ত’ ধূম সম্বন্ধে কথা বলা নিশ্চয়ই দুঃসাহস। আমাদের অভিজ্ঞতা অতি স্বল্প-ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের সমস্ত ধূম এ অভিজ্ঞতার আওতায় আসতে পারেই না। চার্বাকদের কথাটা আমাদের দেশের দার্শনিক পরিভাষায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে: অনুমান নির্ভর করে ব্যাপ্তির উপর, ব্যাপ্তি হলে হেতু বা লিঙ্গ (middle term: আলোচ্য উদাহরণে ধূম) এবং পক্ষ (major term: আলোচ্য উদাহরণে ‘বহ্নি’), এদের মধ্যে সামান্য সম্বন্ধ (universal relation: আলোচ্য উদাহরণে ‘যত্র যত্র ধূমঃ তত্র তত্র বহ্নি’)। চার্বাকপন্থি বলেন, এই ব্যাপ্তি জিনিসটে কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মানুষ বড়জোর বলতে পারে-যে-যে জায়গায় আমি ধুঁয়ো দেখেছি সেই সেই জায়গাতেই দেখেছি আগুন। কিন্তু আমি আপনি ক-জায়গায় ধুঁয়োই-বা দেখেছি? অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সমস্ত ধুঁয়ো কেউ কখনো দেখেনি, দেখতে পারে না। কারুর পক্ষে তাই জোর গলায় বলবার অধিকার নেই: সমস্ত ধুঁয়োর সঙ্গে আগুনের যোগাযোগ থাকতে বাধ্য।
দৈনিক জীবনে সবচেয়ে সরল অনুমানের বেলাতেই যদি দেখি তর্কপদ্ধতির গোড়ায় গলদ রয়েছে, তাহলে দার্শনিকদের কূটতর্ককে সত্য অন্বেষণের অভ্রান্ত উপায় বলে মানবার কোনো মানেই হয় না। এবং অনুমানই যদি অচল বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ ছাড়া জ্ঞানের অন্যান্য তথাকথিত উৎসগুলোর উপর নির্ভর করতে যাওয়া নেহাতই মূঢ়তা, কেননা এগুলো সবই অনুমাননির্ভর অর্থাৎ উপমান, আপ্তবাক্য প্রভৃতি জ্ঞানের তথাকথিত উৎসগুলো শেষ পর্যন্ত দেউলে, কেননা এদের আসল সম্পত্তি বলতে অনুমান এবং অনুমান নেহাতই অচল। তাই চার্বাকপন্থি বলেন, নিছক প্রত্যক্ষ দিয়ে যতটুকু জানা যায় ততটুকুকে সত্যি বলে মানব। অবশ্য একথা ঠিক, চার্বাকদের এই অনুমান-খণ্ডন বিচার-সহও নয়, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষে অনিবার্যও নয়। বরং এর থেকে চরম ভাববাদ এবং সন্দেহবাদ এসে পড়াই স্বাভাবিক-যেমন এসেছিল ইংরেজ দার্শনিক হিউমের বেলায়। তবে এখানে একটা প্রশ্ন তোলা যায়: যদিও মাধবাচার্য চার্বাকদের এই ব্যাপ্তি-খণ্ডন পদ্ধতির নিখুঁত বর্ণনা করেছেন, তবুও চার্বাকদর্শনে এমন খুঁটিয়ে অনুমান-পদ্ধতিকে খণ্ডন করবার চেষ্টা সত্যি কি ছিল? আমার বিশ্বাস তা ছিল না, থাকার কথা নয়। কেননা, মৌলিক চার্বাকদর্শনের প্রচলন ও প্রভাব হয় অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে। সে যুগ জ্ঞানের উৎস নিয়ে দেশে এমন কূটতর্কের রেওয়াজই থাকা সম্ভব নয়। তাই সে যুগে এমন খুঁটিয়ে ব্যাপ্তি জিনিসটে কেউ যে খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন, তা নেহাতই অসম্ভব বলে মনে হয়। তাহলে মাধবাচার্য ব্যাপ্তি-খণ্ডনের এই নিখুঁত বর্ণনা দিতে গেলেন কেন? তার কারণ হয়তো মৌলিক চার্বাকদর্শনে যদিও সমস্ত অনুমানকেই উড়িয়ে দেবার উৎসাহ ছিল না, তবুও নিশ্চয়ই সুস্থ বস্তুবাদির বিশুদ্ধ-বুদ্ধি-বিদ্বেষটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ মৌলিক চার্বাকবাদ নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছিল যে, বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে দর্শন গড়া চলবে না, পরমসত্তা বুদ্ধির মুখাপেক্ষি নয়, শুদ্ধ-বুদ্ধির দাবি মানতে বাধ্য নয়। আগেই বলেছি, প্রেতকার্যের অন্তঃসারশূন্যতা দেখাতে গিয়ে চার্বাকপন্থি সূ² দার্শনিক যুক্তির অবতারণা করতে চাননি; বরং দৈনন্দিন কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে ঘষে দেখাতে চেয়েছেন, এসব ব্যাপার স্রেফ লোকঠকানো ধাপ্পাবাজি। মৌলিক চার্বাকদর্শনের এই শুদ্ধবুদ্ধিবিদ্বেষ হয়তো কালক্রমে, ফলাও হয়ে, ব্যাপ্তিখণ্ডনে-অনুমানমাত্রকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টায়-পরিণত হয়েছিল। মাধবাচার্যের গ্রন্থে হয়তো তারই বর্ণনা। তাহলে মানতেই হবে, ভারতবর্ষে বস্তুবাদ এমন পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিল যে পথে এগুলে বস্তুবাদের ঠিক বিপরিতে, অর্থাৎ চরম ভাববাদে গিয়ে পড়বার সম্ভাবনা। বস্তুত, কডওয়েল দেখিয়েছেন, শ্রেণিসমাজের দর্শনের পক্ষে এই মারাত্মক সম্ভাবনা থেকে যায়; অধ্যাত্মবাদ শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে যান্ত্রিক বস্তুবাদে, বস্তুবাদ ভাববাদে। কড্ওয়েল এই কথার উদাহরণ দেখিয়েছেন সা¤প্রতিক ইউরোপিয় দার্শনিক পরিস্থিতি থেকে; একদিকে হেগেলেও অধ্যাত্মবাদ পরিণত হতে চেয়েছে যান্ত্রিক বস্তুবাদে এবং অপরদিকে বৈজ্ঞানিকদের যান্ত্রিক বস্তুবাদ পরিণত হতে চেয়েছে চরম অধ্যাত্মবাদে। এই বিপরিত-পরিণতির আসল কারণ, কড্ওয়েল দেখিয়েছেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অন্তর্নিহিত দ্ব›দ্ব। প্রাচিন ভারতের শ্রেণিবিভক্ত সমাজেও যে এই ঘটনার পুনরুক্তি থাকবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এবং ঘটেছিলও তাই। একদিকে চার্বাকদের বস্তুবাদ এমন পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিল যে পথের চরম পরিণতি ভাববাদ ও সন্দেহবাদ-এ। অপরপক্ষে, ভারতিয় অধ্যাত্মবাদ যে যুগে যুগে কেমনভাবে চরম ভোগবাদ ও জড়বাদে পরিণত হয়েছে, তার বহুল দৃষ্টান্ত দেশের ইতিহাসে। এখানে দুটি দৃষ্টান্তের উলেখ করা যায়। প্রাচিনকালে বৈদিক অধ্যাত্মবাদের অপর পিঠে ছিল ক্রিয়াকাণ্ডের চরম পার্থিবতা, মধ্যযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদ তন্ত্র, সহজিয়া প্রভৃতি চূড়ান্ত পার্থিবতায় পর্যবসিত হয়েছে।
চার্বাকদের কথায় ফেরা যাক। বিশুদ্ধ তর্ক অপ্রতিষ্ঠ। অতএব, এই জড়জগতের দুর্নিবার যাথার্থ্যকে তর্কবলে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপরপক্ষে, স্বর্গ, নরক বা পারলৌকিক আত্মার কথা হাজার তর্কবলেও প্রমাণ করা অসম্ভব। মানতে হবে এই পৃথিবীই একমাত্র সত্য, মাটি-জল-আগুন-বাতাস দিয়ে তৈরি এই পৃথিবী। চার্বাকপন্থি পঞ্চভূতের পঞ্চম ভূতকে-আকাশ বা ব্যোমকে-সত্য বলে মানেন না, কেননা আকাশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এবং ইন্দ্রিয়বেদনা বা অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এই পৃথিবীর চরম সুখই আসল স্বর্গসুখ, এই পৃথিবীর চরম যন্ত্রণাই আসল নরকযন্ত্রণা। মোক্ষ জিনিসটা দেহচ্ছেদেরই নামান্তর। বলাই বাহুল্য, চার্বাকপন্থি দেহের অতীত আত্মা বলে কোনো জিনিস মানেন না। ওরফে তাঁদের নাম তাই দেহাত্মবাদি। তাঁরা বলেন, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রতি পদেই দেহাত্মবাদে স্বতঃপ্রবৃত্ত আস্থা দেখিয়ে থাকে। মানুষ বলে: ‘আমি স্থূল’, ‘আমি কৃশ’, ‘আমি কৃষ্ণ’। অর্থাৎ, ‘আমি’ জিনিসটা স্থূল, কৃশ, কৃষ্ণ প্রভৃতি দৈহিক লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘আমার দেহ’ এ শুধু কথার কথা, যেন ‘দেহ’ আর ‘আমি’ দুটো আলাদা জিনিস। এরকম কথার কথা তো আমরা কতই বলে থাকি; যেমন ধরুন-‘রাহুর মাথা’। আসলে মাথাই তো রাহুর সর্বস্ব-মাথা বাদ দিলে রাহু বলে আর কি বাকি থাকবে? ঠিক সেই রকমই: ‘আমার দেহ’। দেহই আমি এবং আমিই দেহ।
প্রশ্ন ওঠে: তাহলে চেতনা বলে জিনিসটা আসলে কি? চার্বাকপন্থি বলেন, চেতনা জিনিসটা কোনোরকম পারলৌকিক আত্মার বিকাশ মোটেই নয়। তাই বলে চেতনা জিনিসটাকে উড়িয়ে দেবার দরকারও নেই; জড়ের উপর আবির্ভাব, জড়ের দরুন তার আবির্ভাব, তবু আবির্ভাব হিসেবে অপূর্ব। তাই তার মধ্যে নতুন গুণের লক্ষণ, সে গুণ জড়মাত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশ্চর্য সরল উদাহরণ দিয়ে তাঁরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে চান: কিণ্বাদিভ্যঃ সমেতেভ্যো দ্রব্যেভ্যো মদশ্চক্তিবৎ! কিণ্ব (সুরাবিজ) ইত্যাদি কয়েকটি দ্রব্য একত্র মেশানোর ফলে যেরকম মদশক্তির আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই রকমই। কিংবা, আর একটি এইরকম সরল উদাহরণ চার্বাকপন্থিদের নামে প্রচলিত আছে: পান, চুন, খয়ের, সুপুরি-এগুলোর কোনোটার মধ্যেই টুকটুকে লাল রঙ নেই, অথচ এগুলো দিয়ে পান সেজে মুখে দিলে পর ঠোঁটদুটি লাল হয়ে যায়। লাল রঙ এল কোথা থেকে? এ রঙ পান-চুন-খয়ের-সুপুরি ছাড়া কিছুই নয়, অথচ পান-চুন-খয়ের-সুপুরির উপর এক অপূর্ব আবির্ভাব বই কি। ঠিক তেমনি, ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুত ছাড়া মানুষ আর কিছুই নয়, তবু এই চতুর্ভূতের এক বিশেষ সমাবেশের ফলেই মানুষের মধ্যে চেতনা-বলে ওই অপূর্ব গুণের আবির্ভাব।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদি অবশ্য আলোচনা এখানেই শেষ করবেন না। তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, যদিও জড় থেকেই চেতনার উৎপত্তি, জড়ের উপরই তার স্থিতি এবং শেষ পর্যন্ত জড়ের মধ্যেই তা বিলিন হয়ে যায়, তবুও জড়ের উপর তার যে প্রভাব, সে প্রভাবকেও অগ্রাহ্য করবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে সত্তার দিক থেকে চেতনার বা চিন্তার দাবিই চরম দাবি নয়: বস্তুসত্তা ন্যায়শাস্ত্রের মুখাপেক্ষি নয়, বরং ন্যায়শাস্ত্রই বস্তুসত্তার মুখাপেক্ষি। কিন্তু আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ চার্বাকপন্থিদের মধ্যে আশা করা মূঢ়তার পরিচয় হবে, তাঁরা যে সমাজের দার্শনিক সেই সমাজের প্রতিচ্ছবিই তাঁদের দর্শন।
এই কথা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার চার্বাকপন্থিদের সুখসর্বস্ব নীতিবাদ সম্বন্ধেও। চার্বাকপন্থি বলেন, জড়জগৎই যেহেতু একমাত্র সত্য সেইহেতু ইহজগতের ভোগসুখই মানুষের একমাত্র পুরুষার্থ। দেহ একবার ভস্মিভূত হলে পুনরাগমনের আর সম্ভাবনাই নেই, অতএব যতদিন বাঁচা যায়, সুখে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। সুনীতি সম্বন্ধে এই সুখসর্বস্ব মতবাদ কিন্তু বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত নয়। বস্তুত, আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এমনতর কথা মোটেই বলে না। তবু চার্বাকপন্থির সমসাময়িক সমাজের ছবি মনে রাখলে এই সুখবাদের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, এ মতবাদের প্রচলন হলো বৈদিক যুগের ঠিক পরেই, পুরোহিত শ্রেণি তখন অনেকাংশে দেশের শাসক স¤প্রদায়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই চার্বাকবাদের মূল প্রেরণা। ফলে, পুরোহিত যদি বলেন: ধার করে হোক আর যেমন করেই হোক, পিতৃশ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত-ভোজন করাতে ভুললে চলবে না, তার উত্তরে চার্বাকের পক্ষে বলে বসাই স্বাভাবিক: ধার করেই হোক আর যেমন করেই হোক, নিজের পেটটা আগে ঠাণ্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ! বিপক্ষদল তর্ক করতে পারেন: এ পৃথিবী শুধু দুঃখময়, তাই এখানে ভোগান্বেষণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত দুঃখের জালেই জড়িয়ে পড়তে হবে। চার্বাকপন্থি তার উত্তরে বলেন: মাছ খেতে গেলে গলায় কাঁটা বেঁধবার ভয় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে কি মাছ খাবার চেষ্টাই করবে না?
এ কথা ঠিক যে, শুধু এইটুকু বললেই চার্বাকদের সুখসর্বস্ব নীতিবাদের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মতে সুখসর্বস্ব নীতিবাদ শুধু সেই শ্রেণিরই মুখপাত্র হতে পারে, যে শ্রেণিসমাজে সুখের অধিকার পেয়েছে। মার্কস এর পত্রগুচ্ছ দ্রষ্টব্য। যদি তাই হয়, তাহলে চার্বাক দর্শনের পেছনে সুখসম্ভোগের অধিকারি কোন শ্রেণিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? চার্বাক দর্শনকে জনগণের দর্শন বলেছি। তাহলে এই নীতিবাদ এলো কোথা থেকে? এই নীতিবাদ বস্তুবাদ মাত্রেরই অনুসিদ্ধান্ত তো নয়।
বস্তুত, শ্রেণিসংগ্রামের দিক থেকে চার্বাক দর্শনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া দুঃসাহসের কথা। তার কারণ এ নয় যে, চার্বাকদর্শনে শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অস্পষ্ট। তার আসল কারণ এই যে, প্রাচিন ভারতিয় সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসটুকু অত্যন্ত অস্পষ্ট, কেননা আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা করেননি। তাই দর্শনের ছাত্রকে এগুতে হয় উলটো দিক থেকে: সামাজিক ইতিহাসের পাশাপাশি দর্শনের ইতিহাসকে বুঝবার মতো মালমশলা নেই বলে দর্শনের ইতিহাসে শ্রেণিসংগ্রামের যে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাকেই প্রধান সূত্র বলে মেনে নিয়ে সমাজের বিস্মৃত ইতিহাস থেকে শ্রেণিসংগ্রামের কথা খুঁড়ে বের করবার আশায়। নইলে যে দর্শনের ইতিহাস খামখেয়ালের দুর্বোধ্য পরম্পরা হয়েই থেকে যায়।
দর্শন জিনিসটে ব্যক্তিগত দার্শনিকদের খেয়ালি চিন্তা নয়, নৈর্ব্যক্তিক সত্যান্বেষণও নয়। সংস্কৃতির অন্যান্য অঙ্গের মতো দর্শনের ইতিহাসেও সামাজিক ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি, এবং সমাজের ইতিহাস যেহেতু শ্রেণিসংগ্রামেরই ইতিহাস-সেই হেতু দার্শনিক মতবাদমাত্রই শ্রেণিস্বার্থের রঙে রঞ্জিত। প্রত্যেক সমাজেরই একদিকে শোষক-শাসক শ্রেণি এবং অপরদিকে শোষিত শ্রেণি। শোষকশ্রেণি সংখ্যায় স্বল্প বলেই শাসিতশ্রেণিকে মোটামুটি জনগণ বলে উলেখ করা যায়। লোকোত্তর দর্শন শাসক শ্রেণির দর্শন, কেননা লোকোত্তরে শাসিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে লোকায়তের হাজার গ্লানি তুচ্ছ ও নশ্বর বলে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, জনগণকে নিরাপদ, নিরুপদ্রব করে রাখা যায়। লোকায়তিক দর্শন জনগণের দর্শন, কারণ জনগণকে খেতে হয় গতর খাটিয়ে-পরান্নে ভূরিভোজন তাদের কপালে নেই-এবং গতর খাটিয়ে খেতে হলে বাস্তব পৃথিবীর দুর্নিবার যাথার্থ্য নিয়ে তর্ক করবার উপায়ও থাকে না, মেজাজও না। লোকায়তিক দর্শন জনগণের স্বার্থে উদ্দিপ্ত, শাসকশ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হলে মানতেই হয় শোষণের গ্লানিতে ভরা এই মাটির পৃথিবী স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মানসিক ধারণামাত্রও নয়। অবশ্য জনগণ আর তাদের দাবি কোনো বিশেষ সমাজের একচেটিয়া লক্ষণ নয়, তবুও লোকায়তিক দর্শন প্রত্যেক যুগে প্রসার লাভ করতে পারেনি। কারণ একটি বিশেষ যুগের দর্শনে শুধু সেই শ্রেণির কথাই প্রতিফলিত হয় যে শ্রেণি সমাজব্যবস্থার মধ্যেও অগ্রণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় জনগণ এগিয়ে এসেছিল উদিয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির পাশাপাশি, সে যুগের ফরাসি দর্শনে তাই বস্তুবাদের অমন প্রতিপত্তি। আজকের পৃথিবীর এক বিরাট দেশে জনগণ নতুন পৃথিবী গড়বার পণ করেছে, তাদের কাছে তাই বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদই একমাত্র দর্শন।
ইউরোপিয় সভ্যতার আলোচনায় ওই তথ্য শুধু অভ্রান্ত নয়, দর্শনের ইতিহাসকে বোঝাবার একমাত্র উপায়। কেননা অন্য যে কোনোভাবেই চেষ্টা করা যাক না কেন, দর্শনের ইতিহাস শেষ পর্যন্ত হয় ব্যক্তিগত মানুষের খেয়ালি চিন্তার অর্থহীন পরম্পরা, আর না হয় হেগেলিয় ব্রহ্মের দুর্বোধ্যতম লিলাখেলার কাল্পনিক উপাখ্যান হয়ে থাকে। এই অভিজ্ঞতার আলোয় দেশের দর্শনকে বুঝতে পারার আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়। কারণ এ দেশ আমার দেশ হলেও এমন কিছু সৃষ্টি ছাড়া আজব দেশ নয়। অথচ সুধিসমাজে ভারতিয় দর্শনের যে আলোচনা আজও প্রচলিত, তা নেহাতই ভাবালুতার ভারে ভারাক্রান্ত, ভ্রান্ত স্বাদেশিকতার বিড়ম্বনার বিকৃত। কিন্তু বিপদ এই যে, ঐতিহাসিক তথ্যের সম্বল অতি স্বল্প, এবং সেইটুকুর উপর নির্ভর করে শ্রেণি-সংগ্রামের দিক থেকে ভারতিয় দর্শনের ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া দুঃসাহস। ভরসার কথা শুধু এইটুকুই যে, এ-আলোচনার ভুলভ্রান্তি যোগ্যতর ব্যক্তিকে যোগ্যতম আলোচনায় উদ্দিপ্ত করতে পারে এবং তিনি ভারতিয় দর্শন নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনার পথ খুলে দিতে পারেন।
প্রথম কথা হলো চার্বাক দর্শনের কাল নির্ণয়। এ দর্শনের উপর কোনো যুগে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ রচিত হোক আর না-ই হোক, বিশেষ কোনো ব্যক্তি এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান প্রচারক হোন বা না-হোন, এ কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই দর্শন এককালে আমাদের দেশে রীতিমত শোরগোল শুরু করেছিল এবং কালক্রমে এ দর্শনকে দেশের বুক থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলবার চেষ্টাও নিশ্চয়ই হয়েছিল। কোন যুগে প্রচারিত হয়েছিল এই দর্শন? নানান প্রাচিন গ্রন্থে লোকায়তিক দর্শনের উলেখ পাওয়া যায়। প্রাচিনতম বৌদ্ধ গ্রন্থে, এমনকি মহাভারতে ও উত্তর উপনিষদে, এ মতবাদের কথা আছে। এই সাক্ষ্যগুলোর উপর নির্ভর করে আধুনিক পণ্ডিতেরা (রাধাকৃষ্ণন, গার্বে প্রমুখ) প্রমাণ করেন যে, বৈদিক যুগের ঠিক পরে-আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে-দেশে এই দর্শনের প্রচলন হয়েছিল। ভারতিয় সভ্যতার এই সময়টা ছিল যুগসন্ধির যুগ! রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোড়নের যেন শেষ নেই-সেই আলোড়নের ঢেউ যে দর্শনের মতো তথাকথিত নৈর্ব্যক্তিক রাজত্বেও এসে লাগবে, তাতে বিস্ময়ের অবকাশ নেই। এমনকি শ্রিযুক্ত রাধাকৃষ্ণনের মতো ভারতিয় দর্শনের আধ্যাত্মিক ঐতিহাসিক এ কথা অস্বীকার করতে চান না। কিন্তু যে করে হোক একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তিনি দেবেনই। ফলে সমস্ত ব্যাপারটাই অর্থহীনতায় অদ্ভুত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘লোকাচার আর তন্ত্রমূলক পুরনো ধর্মবিশ্বাসকে খণ্ডন করবার ব্যাপারে এই বস্তুবাদের অবদান অনেকখানিই ছিল। চার্বাকমতের মতো বিস্ফোরক শক্তির সাহায্যে বহু শতাব্দির অন্ধবিশ্বাসকে যদি ঝাঁকুনি দেওয়া না হতো, তাহলে দীর্ঘ যুগের সমর্থন-লব্ধ তখনকার আচার-বিচারকে উদারপন্থা অনুসারে সংস্কার করবার চেষ্টা বিফল হতে বাধ্য। বস্তুবাদ ঘোষণা করে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মুক্তি, উচ্ছেদ করে আপ্তবাক্যমূলক ব্যবস্থার: বুদ্ধির দাবির কাছে যার সাক্ষি টেকে না, ব্যক্তি তাকে স্বীকার করবে না। বস্তুবাদ হলো মানবাত্মার পক্ষে নিজেকে ফিরে পাওয়া, যা-কিছু বাইরের জিনিস আর বিদেশি তাকেই পরিত্যাগ করা। অতীতের বোঝা এই যুগের শ্বাসরোধ করেছিল। চার্বাক দর্শন তার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য পাগলের মতো চেষ্টা। বিশুদ্ধ চিন্তার গঠনমূলক চেষ্টাকে ঠাঁই করে দেবার জন্যে দরকার ছিল গোঁড়ামি দূর করা, এই দর্শন তা করতে সক্ষম হয়েছিল।’
সোজাসুজি বলা যায় এগুলো নেহাতই স্থূল অসত্য, কেননা চার্বাকবাদ আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ, এর প্রধান উৎসাহ নিছক বুদ্ধির দাবিকে অস্বীকার করবার, এ মতবাদ আত্মার কোনো অস্তিত্বই মানে না। তাই আধ্যাত্মিক আত্মোপলব্ধির কোনোরকম পথ প্রদর্শন করায় চার্বাকপন্থির মধ্যে আগ্রহ-কল্পনা নেহাতই বাড়াবাড়ি, এবং বুদ্ধির কাল্পনিক পটকাবাজির জন্যে চার্বাকদের মাথাব্যথার কথাটুকু প্রায় হাস্যকর। আশা করি, শ্রিযুক্ত রাধাকৃষ্ণনের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিত এই স্থূল অসত্যগুলোকে নেহাত অলংকারের খাতিরেই উলেখ করেছেন। কিন্তু তবুও, অলংকারের খাতিরে এসব কথা মেনে নিলেও, তাঁর প্রধান বক্তব্যটুকু সহজবুদ্ধির কাছে অর্থহীনতায় দুর্বোধ্যই থেকে যায়। আসল কথা হলো: বৈদিক যুগের ক্রিয়াকাণ্ড থেকে মানুষের মনকে সরিয়ে নেবার জন্যে এত মাথাব্যথা ঠিক কার? কার মাথাব্যথা উন্মুক্ত বুদ্ধির নির্মল দর্শনের জন্যে পথ পরিষ্কার করে দেবার? ইতিহাসের? নবযুগের? না, ইতিহাসের ক্রমবিকাশের মধ্যে দিয়ে লিলাখেলায় প্রমত্ত কোনো হেগেলিয় পরব্রহ্মের? ভাষার ঝঙ্কার দিয়ে, অলংকারের চোখ-ধাঁধানো কারিগরি করে এই মূল প্রশ্নকে ঢেকে রাখা যেতে পারে, কিন্তু এর কোনো মিমাংসা দেওয়া যায় না। বস্তুত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ছাড়া যুগে যুগে সভ্যতার পরিবর্তনগুলো নেহাতই হেঁয়ালি হয়ে থাকে! হাজার রকম আধ্যাত্মিক গোঁজামিল দিয়েও এগুলোর ব্যাখ্যা হয় না।
অথচ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের অর্থ প্রাঞ্জল। সমাজের কাঠামো নির্ভর করে ধন উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যবস্থার উপর। ফলে, এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন এলে সমাজের চেহারাও বদলে যায়: পুরনো শাসকশ্রেণির পরিবর্তে দেখা দেয় নতুন শাসকশ্রেণি। এবং সংস্কৃতি জিনিসটি যেহেতু শাসকশ্রেণিরই মুখপত্র, সেই হেতুই নতুন সমাজে সংস্কৃতির রূপান্তর চোখে পড়ে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে চার্বাক-দর্শনকে বোঝবার মতো খণ্ড ও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মালমশলা জোগাড় করা যাক। তবু সেটুকুর সাহায্যে প্রাচিন ভারতে এই দর্শনের আবির্ভাবের উপর যেটুকু আলোকপাত করা যায়, তার মূল্যও সামান্য নয়।
শ্রিযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় দেখাতে চাইছেন, প্রাচিন বৈদিক যুগে ভারতিয় সমাজে শ্রেণিবিভাগ দেখা দিয়েছিল, তবু শ্রেণিসংগ্রাম প্রকট হয়ে পড়েনি। তার কারণ প্রাচিন বৈদিক সমাজের অর্থনীতিতে আদিম সাম্যতন্ত্র ছেড়ে আদিম সামন্ত প্রথার দিকে অগ্রসর হবার লক্ষণ। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষিসভ্যতার দিকে যত অগ্রসর হয়েছে, শ্রেণিসংগ্রামও ততই স্পষ্ট ও ব্যক্ত হয়ে পড়েছে। তাই পদানত জনগণ বা শূদ্র সম্বন্ধে ঋগ্বেদে উলেখ শুধু এক জায়গায়। পুরুষসূক্তে, এবং এই পুরুষসূক্ত অনেক পণ্ডিতের মতেই আসলে উত্তর কালে রচিত হয়েছে এবং ঋগ্বেদের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। পুরুষসূক্তে শ্রেণিবিভাগের প্রথম প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বৈদিক ঋষি বলেছেন: ‘সেই বিরাট পুরুষের মুখ থেকে জন্ম হয়েছে ব্রাহ্মণের, তাঁর হাত থেকে রাজন্যের, তাঁর ঊরু থেকে জন্মেছে বৈশ্য এবং তাঁর পা থেকে জন্মেছে শূদ্র।’ আবার, ‘ইন্দ্র আর অগ্নি জন্মেছে তাঁর মুখ থেকে… তাঁর পা থেকে পৃথিবী বা মৃত্তিকা।’ অর্থাৎ, জনগণ বা শূদ্রের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক যেন নাড়ির সম্পর্ক। এই বর্ণনার মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। আদিম সাম্যাবস্থায় সমস্ত মানুষেরই সামাজিক অবস্থা সমজাতিক ও সদৃশ ছিল, যেন এক অভিন্ন বিরাট পুরুষ। কালক্রমে ভারতিয় সমাজ চারটি বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমত, যুদ্ধের দায়িত্ব ও কৃষি উৎপাদনের দায়িত্ব পৃথক হয়ে যায়, উৎপাদনের দিক থেকে উন্নত সমাজের রক্ষাকার্যের জন্যে এ বিভাগ প্রয়োজন ছিল। যোদ্ধার দল নিশ্চয়ই বাহুবলে নিজেদের শাসকশ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছিল। কিন্তু বাহুবলে প্রতিষ্ঠাকে আরও মজবুত করবার জন্যে প্রয়োজন হয় ধর্মবল ও যুক্তিবলের প্রতিষ্ঠা। তাই, ক্রমশ এই রাজন্য শ্রেণির মধ্যে থেকে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণির উদয় হলো-বিশ্বামিত্র প্রভৃতির উপাখ্যানে এই ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিচ্ছবি। অবশ্যই, শাসক স¤প্রদায় হিসেবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে একতা থাকলেও, স্বার্থ বিভাগের দিক থেকে দুই শ্রেণির মধ্যে দ্ব›দ্ব নিশ্চয়ই ছিল-পরশুরাম ও কার্তবির্যার্জুন প্রভৃতির উপাখ্যানে তার প্রতিচ্ছবি। এই সমস্ত দিক থেকে প্রাচিন ভারতে শ্রেণিসংগ্রামের ছবি অত্যন্ত জটিল, সন্দেহ নেই। তবু পুরুষসূক্তে এই যে বহিঃরেখা পাওয়া যায়, তার তাৎপর্য স্পষ্ট। একদিকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের শাসকশ্রেণি, ব্রহ্মতেজ ও ইন্দ্রবিক্রমে তারা শাসনকাজ চালাত; পরের উৎপাদনে চলত তাদের সংসার, তাই মাটির সঙ্গে সম্পর্ক বড় একটা ছিল না। অপরদিকে, শূদ্র বা জনগণ; উৎপাদনের সমস্ত দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে, তাই মাটির সঙ্গে তাদের যেন নাড়ির যোগ। সেই বিরাট পুরুষের-সেই আদিম সমজাতিক মনুষ্য সমাজের-পায়ের থেকে জন্মেছে শূদ্র, আর জন্মেছে মাটি,-শূদ্রের অন্তরঙ্গ আত্মিয়। একথা ঠিক যে, শ্রেণিসংগ্রামের এই রূপ ভারতিয় সমাজে হঠাৎ একদিন ফুটে ওঠেনি এবং সে রূপ এত সরলও নয়। তবু এ কথাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বৈদিক যুগের শেষের দিক থেকে ভারতিয় সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম প্রকট থেকে প্রকটতর হতে শুরু করেছে, কেননা এই সময়টায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, ভারতবর্ষে ‘এশিয়াটিক সামন্তসমাজে’র ভিত পাকাপাকিভাবে গড়ে উঠেছিল। যুগসন্ধির এই সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সংগ্রাম কঠোর ও তিক্ষè হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব সংগ্রামের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের শাসক-ভাগ্য ভাগাভাগি করা নিয়ে যে মারামারি, তারই ঐতিহাসিক প্রতিচ্ছবি সবচেয়ে বেশি করে পাওয়া যায়। রামায়ণে এই সংগ্রামের ব্রাহ্মণ-সংস্করণ, বৌদ্ধ ও জৈন পুঁথিতে তার ক্ষত্রিয়-সংস্করণ। এই দুটি সংস্করণই যে ভালোভাবে টিকে গিয়েছে, তার কারণ শাসক শ্রেণির মধ্যে শেষ পর্যন্ত স্বার্থের যেন খানিকটা ভাগাভাগি হয়ে গেল।
কিন্তু এই শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে শূদ্রদল বা জনগণ বিপক্ষের জয় বা নিজেদের পরাজয় যে নেহাত অসহায়ভাবে মেনে নিয়েছিল, এমন কথা মনে করবার কোনো কারণ নেই। বস্তুত এই সংগ্রামের কোনো স্পষ্ট শূদ্র-সংস্করণ ইতিহাসে টিকে না থাকলেও খণ্ডবিক্ষিপ্ত কয়েকটি তথ্য থেকে এটুকু স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শূদ্র শ্রেণিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবার চেষ্টা মাঝে মাঝে করেছিল, করেছিল বিপ্লব ঘোষণা। এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা ছাড়াও শাসকশ্রেণি এ বিপ্লবের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। তবু প্রাচিন ইতিহাসে এ বিপ্লবের অস্পষ্ট স্বাক্ষর: ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে জনশ্র“তি নামে শূদ্র রাজার বিবরণ, শতপথ ব্রাহ্মণে শূদ্র মন্ত্রিদের কথা, মৈত্রেয়ানি সংহিতায় শূদ্র ধনি ব্যক্তির উলেখ। গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রকাররা যে শূদ্র সম্বন্ধে কিছুদিনের মধ্যে কঠোরতম বিধিনিষেধের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই শূদ্রকে নিশ্চয়ই আদর আপ্যায়িত করে রাজা-উজির বানানো হয়নি। তারা যদি রাজা-উজির হয়ে থাকে, তাহলে তা নিছক নিজেদের জোরেই হতে পেরেছিল। তাই এগুলোকে শূদ্রবিপ্লবের খণ্ড বিক্ষিপ্ত স্বাক্ষর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। সংস্কৃতির স্তরে এই বিপ্লবের প্রতিচ্ছবিই চার্বাক দর্শনে। এবং চার্বাক দর্শন তাই প্রাচিন ভারতিয় শ্রেণিসংগ্রামের একমাত্র শূদ্র-সংস্করণ। আরও একটা কথা এই সূত্রে বুঝতে পারা সম্ভব। আগেই বলেছি, সুখসর্বস্ব নীতিবাদ বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত হতে বাধ্য নয়; মার্কস-মতে এ নীতিবাদ শুধু তারই মনের কথা হতে পারে, সমাজে যে সুখসম্ভোগের অধিকার পেয়েছে। তাই যেসব শূদ্র রাজা বা শূদ্র ধনি ব্যক্তির উলেখ ইতিহাসে পাওয়া যায়, তাদের মুখে সুখসর্বস্ব নীতিবাদ কল্পনা করা অসঙ্গত নয়, সমাজে সুখের অধিকারি তারা নিশ্চয়ই হয়েছিল, এবং যেহেতু মূলত তারা শূদ্রই, সেই হেতু শূদ্র-শ্রেণির সাধারণ দর্শনের সঙ্গে তাদের ভোগবিলাসি নীতিবাদ মিশে যাবার প্রচুর সম্ভাবনা।
অবশ্যই একদিক থেকে এ সমস্ত কথাই নিছক অনুমান মাত্র, কেননা নিশ্চিত ও পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য আপাতত যেটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব, তা দিয়ে প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বৈদিক যুগের পরে ব্রাহ্মণরা যে একের পর এক ধর্মশাস্ত্র রচনা করে শূদ্রদের নির্মমভাবে দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল, সে কথাটুকু নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক সত্য। গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু থেকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই প্রচেষ্টার ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও দীর্ঘ। আপাতত তার উলেখ না করলেও চলবে। কেবল এই কঠোর থেকে কঠোরতর বিধানপরম্পরা সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন না তুললেই নয়; শূদ্রবিপ্লবের পুনরুক্তি সম্বন্ধে ভয় না থাকলে শাসকশ্রেণি এমন বিচলিত মনোবৃত্তির পরিচয় দেবে কেন? চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেশে যে প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে, তার মধ্যেও এই বিচলিত মনোভাবেরই পরিচয়। শূদ্রদের সমাজে দমন করেও, শূদ্রদর্শনের পুঁথি নিশ্চিহ্ন করেও পুরোহিত শ্রেণির মনে শান্তি ছিল না। কেননা, জনগণ যেন মরেও মরতে চায় না, তাদের লোকায়তিক দর্শন বারবার খণ্ডন করা হলেও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া কঠিন। দুরুচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টিতম। এই দর্শনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করবার আশাতে পুরোহিতশ্রেণি তাই রটিয়ে দিল-সত্যি বলতে কি, ওই ভ্রান্ত দর্শন এককালে আমরাই রচনা করেছিলুম। আসলে দেবতাদের সঙ্গে তখন অসুরদের জোর লড়াই চলেছিল, অসুরেরা এমন লড়াই লড়ছিল যে দেবতাদের অবস্থা প্রায় টলোমলো। তখন দেবতাদের গুরুদেব বৃহস্পতি এক ফন্দি আঁটলেন। এক ভ্রান্ত ও হেয় দর্শন রচনা করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে সেই দর্শন প্রচার করে দিলেন-এই ভ্রান্ত দর্শনের মোহে পড়ে তারা ভোগবিলাসি হয়ে পড়ল, তারা চরিত্র হারাল এবং শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো।
খোদ দেবতাদের গুরুদেবের ফন্দিফিকির নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা সামান্য মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই শোভা পায় না। পুরোহিতশ্রেণি হয়তো তাই নিশ্চিত ছিল, এ প্রশ্ন কোনোদিন উঠবে না। তা ছাড়া, লোকায়তে বিশ্বাস করলে লড়াইতে হার মানবার ভয় যে কেন, সে যুক্তিও সহজবুদ্ধির কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু আসল কথা হলো, এই প্রবাদটির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেণির একটি আদর্শ পদ্ধতির পুনরুলেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃতির স্তরে ব্রাহ্মণ শ্রেণি বিপক্ষকে শুধু খণ্ডন করেই ক্ষান্ত হয় না, কোনোমতে নিজের শ্রেণির মধ্যে বিপক্ষকে শুষে নেবার চেষ্টা করে। তাই ভগবান বুদ্ধ দশ অবতারের এক অবতার হয়ে গেলেন। শুধু দর্শনের বেলাতে নয়, ব্রতের বেলাতেও একই পদ্ধতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন, কেমনভাবে দেশের ঘোষিত প্রচলিত বা মেয়েলি ব্রতগুলোকে শাস্ত্রিয় ব্রতের মধ্যে শুষে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই রকম অজস্র উদাহরণ সাহিত্যে-শিল্পে দেবদেবির কল্পনায়-সংস্কৃতির প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই। অতুলচন্দ্র গুপ্ত’র সেই ছোট্ট প্রবন্ধটির কথা মনে পড়ল: ‘গণেশ’। ‘সর্ববিঘœহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা বলে যে দেবতাটি হিন্দুর পূজা-পার্বণে সর্বাগ্রে পূজা পান, তাঁর ‘গণেশ’ নামেই পরিচয় যে তিনি ‘গণ’ অর্থাৎ জনসংঘের দেবতা। এ থেকে যেন কেউ অনুমান না করেন যে, প্রাচিন হিন্দুসমাজের যাঁরা মাথা, তাঁরা জনসংঘের উপর অশেষ ভক্তি ও প্রিতিমান ছিলেন। যেমন আর সব সমাজের মাথা, তেমনি তাঁরাও সংঘবদ্ধ জনশক্তিকে ভক্তি করতেন না, ভয় করতেন! …আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘেœর দেবতা। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতির মতে এঁর দৃষ্টি পড়লে রাজার ছেলে রাজ্য পায় না, কুমারির বিয়ে হয় না… বণিক ব্যবসায়ে লাভ করতে পারে না…। এই জন্যেই গণেশের অনেক প্রাচিন পাথরের মূর্তিতে দেখা যায় যে শিল্পি তাঁকে অতি ভয়ানক চেহারা দিয়ে গড়েছে; গণশক্তির উপর প্রাচিন হিন্দু সভ্যতার কর্তাদের মনোভাব কি ছিল, তা গণেশের নর-শরীরের উপর জানোয়ারের মাথার কল্পনাতেই প্রকাশ।’ কিংবা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে রকম দেখাবার চেষ্টা করেছেন, আদিদেব মহাদেবের কল্পনাটা ব্রাহ্মণদের পক্ষে আদিবুদ্ধ’র কথা আত্মসাৎ করবার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়: ‘খ্রিস্টান পাদ্রিরা যেমন দিক্ষিত ব্যক্তির মাথায় জল ছিটাইয়া দিয়া দলে টানিয়া লন সেইরূপ ব্রাহ্মণেরা আদিবুদ্ধ’র গলায় যজ্ঞোপবিতের ফাঁস নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে আপনাদের দলে টানিয়া লইলেন।’ তাই চতুর্মুখ ব্রহ্মার চারমুখ ভরা বেদ থাকলেও গলায় পৈতে নেই; কিন্তু গাঁজাখোর শিব ভূতপ্রেতের দলে নাচলেও তার গলায় পৈতে! হিন্দুসভ্যতার ইতিহাসে এমনতর দৃষ্টান্তর অভাব একটুও নেই।