004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

পেরুভিয়ান সাহিত্যিক সেসার ভাএহো (César Vallejo)

সেসার ভাএহো (César Vallejo) পুরো নাম সেসার আব্রাহাম ভাএহো মেনদোজা (১৮৯২-১৯৩৮) ল্যাটিন আমেরিকান আধুনিক স্পেনিশ সাহিত্যের শক্তিশালি লেখকদের একজন। স্পেনিশ সাহিত্যে আধুনিকতাবাদি আন্দোলন, বিজ্ঞানের জগতে বিবর্তনবাদের উদ্ভব, রাজনৈতিক বিশ্বে সাম্যবাদি সমাজ-প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক লড়াই, স্পেনের জনযুদ্ধসহ নানা ঘটনার জন্ম তাঁর সময়ে। ফলে উনিশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতক শুরুর শৈল্পিক-বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক নানা বাস্তবতার তিনি প্রত্যক্ষদর্শি। ৪৬ বছরের জীবনে তাঁর মাত্র তিনটি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তাঁর কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা মোট দশখানা। তাছাড়া উপন্যাস, গদ্য, নাটক ও চিঠিপত্রের গ্রন্থসহ তাঁর মোট রচনার সংখ্যা বাইশ। সংখ্যার বিবেচনাটা এখানে অবশ্য প্রধান বিবেচ্য নয় কেননা সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যে শিল্পমানের উৎকর্ষে তাঁর রচনা প্রথম সারির। ফ্রান্সের সাহিত্যিক ও সমাজকর্মি থমাস মার্টন তাঁকে দান্তে পরবর্তিকালের শ্রেষ্ঠ বিশ্বসাহিত্যিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। পেরুর রাজনৈতিক দল পি.সি.পি’র প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ও রাজনীতি-দার্শনিক জোসে কার্লোস ম্যারিয়েটগুই তাঁকে সাহিত্যের ‘পরম স্রষ্টা’-এ অভিধা দিয়েছেন। আসলে শিল্প-সাহিত্যে বৌদ্ধিক পরিহাস প্রকাশে নতুনত্ব ও আঙ্গিকের নিরিক্ষাধর্মিতার কারণে বিশ শতকের যে-কোন ভাষা ও সাহিত্যের বড় লেখকদের কাতারে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কবিতার উৎকর্ষ গুণের জন্য প্রেসিডেন্ট গঞ্জালোস তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে পেরুভিয়ান কবিতায় ভাএহো অনন্য। হ্যাঁ, তিনি আমাদের, এবং পাশাপাশি তিনি ছিলেন সাম্যবাদি।’

রাজনৈতিক আনুগত্য অনেক সময় শিল্পে অনুর্বরতা সৃষ্টি করে। কিন্তু এদিক থেকে ভাএহো ছিলেন একেবারেই আলাদা। তিনি জানতেন কীভাবে শিল্প ও জীবনের সামঞ্জস্য তৈরি করতে হয়। শুধু পেরুভিয়ানদের নয় সমগ্র পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক প্রবঞ্চনা, যুদ্ধ ও যন্ত্রণাময় জীবনে তাই তাঁর কণ্ঠস্বর যথেষ্ট পরিমাণে কার্যকরি ভূমিকা নিয়েছিল। শিল্প ও জীবন-বাস্তবতার সমিকরণ করেছিলেন বলেই তিনি পেরুর তথা বিশ্বের সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারখানার কর্মি, ছাত্র-সকলের কাছে প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। জীবনের চরম অপ্রতিরোধ্যতা অর্থাৎ হার না মানা কিংবা অনমনিয়তা এবং ক্ষুধা-কাতরতায়ও এ- শিল্পি ছিলেন অবিচল। তিনি বিদ্রোহ করেছেন মানুষের জন্য, তাদের বেঁচে থাকবার রসদ যোগাড় করবার জন্য। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিকে বরাবরই তিনি এড়িয়ে চলতে পছন্দ করতেন। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে সেসার ভাএহো নিজে যে-ভাবনা ভেবেছেন তা উদ্ধৃত করছি :

‘আমি সেই আধুনিক সাহিত্য রচয়িতার চেয়ে ভালই জানি যিনি চিলেকোঠায় বসে কবিতায় অবিশ্বাস্য মৌলিকত্ব, প্রভুত্বশিল ছন্দ কিংবা বাক্যে ভয়াবহ ফ্যান্টাসির ঝাঁকুনিতে পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করেন।’

ভাএহো জানতেন বুর্জোয়া সরকারি ব্যবস্থার অনুদানে রচনায় এক ধরনের শৈল্পিক পরাজয় ঘটে চলে। এ-অবস্থাকে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করেন। তিনি মনে করেন এমন সাহিত্যিকের লেখনিতে যে-দারুণ সব টেকনিকের আবর্তনে চিত্রকল্প কিংবা উপমার সৃষ্টি হয় সে-সব ঐ শিল্পির পক্ষে চিলেকোঠার নিশ্চিত জীবন-যাপনের আত্মকন্ডুয়ন থেকেই জন্মলাভ করে। ফলে তাদের প্রাণের ভেতরেই থাকে এক ধরনের কৃত্রিমতা। বুর্জোয়া শিল্পির এই কৃত্রিমতা যে-আত্মভজনাবৃত্তি জন্ম দেয় সেখানে রক্তমাংসের চেয়ে কঙ্কালের প্রাধান্যই হয় বেশি। শিল্প ও শিল্পির ব্যর্থতার প্রশ্নে তিনি মানব-দূরবর্তি স্থবিরময় কলাকৌশলের অভিযোগ তোলেন। উল্লি­খিত শ্রেণির লেখকদের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য:

I know more than a modern poet who usually locks himself in his cabinet to produce verses of astounding originality, masterful rhythms, sentences in which fantasy reaches formidable spasms. His life? … From such an existence as I have said, comes a work full of imagination, outpouring techniques, outshining with metaphors and imageries. But that’s all that ever comes out of that sort of existence ( . . . ) The lackey and sensuous fare of the worst courtesan times is preserved in these bourgeois poets who live from a government salary or a pension from their families.

শিল্পিকে পরজীবী বৃত্তির হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য সেসার ভাএহোর কণ্ঠস্বর সবসময়ই ছিল উচ্চকিত। শিল্পের সততা আর রিয়্যালিজমের ক্ষেত্রে তিনি আসলেই ছিলেন আপোষহীন। পুঁজিভিত্তিক সমাজের শিল্প-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক নন্দন প্রক্রিয়ার পার্থক্য চিন্তায় তিনি স্বকিয় ও প্রাতিস্বিক। শিল্প তৈরির ক্ষেত্রে তাকে কখনো র‌্যাডিক্যাল হয়ে উঠতে যায়নি। বাস্তব-অর্থেই জীবনের সমাজতন্ত্র আর শিল্পের সমাজতন্ত্রকে তিনি আলাদা করেন। তবে তাঁর এই আলাদাকরণ আবার জীবনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কযুক্ত। এ-সম্পর্কে তাঁর ভাবনা হচ্ছে একজন মানুষ রক্তে-মাংসে তখনই সমাজতান্ত্রিক যখন তার অন্তর্গত বা বহির্গত যে-কোন কাজে-কর্মে, পাটিগণিতের অঙ্ক-কষা বা প্রকৃতি-দর্শনে এমনকি নারির প্রেমে তথা চিন্তার সর্বক্ষেত্রেই তা যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবেন। অন্যদিকে নিয়ম-মাফিক তিনিই সোশ্যালিস্ট কবিতা লিখতে পারেন। কিন্তু এ-কথা বলেও শিল্পকে তিনি রাজনীতির যন্ত্র করতে চান না কখনো। তবে জীবনে ও শিল্পে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ আদর্শবাদিতার কথা তিনি বলেছেন, যে-আদর্শের তাগিদ চৈতন্য-লালিত শিল্পির অন্তর্দেশ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্থিত হয়। যেমন তিনি বলেন,

‘The socialist poet cannot project his ideas only at the time of writing a poem, but in all his acts, big and small, internal and visible, conscious and subconscious, and even when he sleeps and when he errs or betrays himself.’

ফলে সংগ্রামি শিল্পি-জীবনের সত্য রচনায় প্রত্যক্ষ বক্তব্যধর্মিতায় প্রকাশিত হবে না। আর এর মাধ্যমে গোপনও থাকে না শিল্পির সেই অভিসন্ধি যা তিনি মানুষের জন্য তথা মানবতার জন্য সম্পন্ন করতে চান।

সুররিয়ালিস্ট একটি আবহ সেসার ভাএহোর কবিতার অস্থি জুড়ে অবস্থান করে। ফলে তাঁর কবিতায় একটি কাঠিন্যের আবরণ থাকে। কিন্তু কবিতার অন্তর্কাঠামোর জটিলতার ভেতরেই সন্ধান করতে হয় জীবনের গভীর বাস্তবতাকে। যে-বাস্তবতা শিল্পির সমসাময়িক জীবন, ঘটমান বিদ্রোহ, বিপ্লব, অসহায়ত্ব, সঙ্কটের তিব্রতা দ্বারা নির্ণিত হয়। ‘Le Heraldos Negros’ নামক একটি কবিতায় পাঠককে তিনি কালো মানুষের বেদনা ও মনুষ্যত্বের অবমাননায় সচকিত করেন। গভীর ব্যাপ্তি নিয়ে ইতিহাস ও মিথের পাতা খুলে সভ্যতার ভিন্নপিঠস্থান ল্যাটিন আমেরিকান বাস্তবতার কথা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে সমকালিন বাস্তবতার বৈশ্বিক পাপের প্রতিবেদনও:
কালো দূত
কেন এমন নির্মম আঘাত মানুষে… জানি না!
না-কি এ-বজ্রাঘাত ঈশ্বরের রোষ থেকে নামে
হয়তো এইসব দুর্দশা পূর্বকৃত গাঁথা
আমাদের আত্মার ভেতরে… আমি জানি না!
হিংস্রতার প্রতিকৃতি আর অসুরিক শক্তিতে
অন্ধকার গুহামুখ খুলে… সিমিত সংখ্যক
বর্বর অ্যাটিলাসের দুর্ধর্ষ অশ্বই
মৃত্যুর কালো ছায়া বয়ে নিয়ে আসে।
তারা গভীর পতনে চিহ্নিত করে যিশু কিংবা
প্রেমময় আত্মাকে গন্তব্য যাদের অকাতর হত্যা
রক্তাক্ত আঘাত তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়
জ্বলন্ত চুলি­ যেমন সঙ্কুচিত করে বস্তুকণা।
হায় মানুষ… দুর্ভাগা মানুষ… হায়!
চোখ ঘুরিয়ে যখন সে তাকায়
মৃদু হস্তাঘাত স্পর্শ করে তাদের স্কন্ধ,
উত্তপ্ত হতাশাগ্রস্ত অক্ষি ফিরে চায়,
সজ্ঞা এখন মূল্যহীন সমস্ত প্রাণে যেন
প্রশান্ত দিঘির জলদগম্ভির স্তব্ধতা।
জীবনে আসে এমন নির্মম আঘাত,
সত্যি আমি জানি না!

[সেসার ভাএহো (César Vallejo)-র একটি কবিতা দখব `Le Heraldos Negros’’-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘The Black Messengers’ থেকে কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।]

উপরিউক্ত কবিতাটি ভাএহো’র গুরুত্বপূর্ণ কাব্যসংগ্রহ Los Heraldos Negros-এর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর শৈশবকালিন স্মৃতির অংশও এ-কাব্য। স্পেনিশ আধুনিকতার অন্যতম প্রকাশক এ-কবিতাগুচ্ছ পেরুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রান্তিক ইন্ডিয়ানদের জীবন-ভাষ্যও। ঊনিশ শতকের ফরাসি সিম্বলিস্ট এবং ডেকাডেন্ট আন্দোলনের প্রভাবের ফলে তাঁর রচনার বিষয় ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ধারিত হয়েছে। সেসার ভাএহো’র বেশির ভাগ রচনাতেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য, একাকিত্ব এবং শরিরি কামনার সঙ্গে এক ধরনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার টানাপড়েন লক্ষণিয়। ভাএহো’র Guitar কবিতায় সংগিতের নোটের সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর একাকিত্বের ভয়াবহ এক যন্ত্রণা। কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি আত্ম-বেদনার সিমাহীন এক আর্তিকে তুলে ধরেন :
The pleasure of suffering, of hating, dyes
my throat with plastic venoms,
but the bristle that implants its magic order,
its taurine grandeur, between the first string
and the sixth
and the mendacious eighth, suffers them all

আনন্দ তাঁর কাছে ঘৃণ্য ও যন্ত্রণাময়। নিলকণ্ঠ তিব্র বিষের মত যা গলা বেয়ে নামে তাকেই সংগিতের উদারা, মুদারা কিংবা তারায় অথবা পঞ্চমে চড়িয়ে তিনি বেদনায় অবগাহন করেন। সংগিতের নিয়মে যে-তারটি সুর তোলে কিছুক্ষণ পরেই বোঝা যায় এ-সুর তাঁর একাকি ভার বহনের নয় :
The pleasure of suffering … Who? whom?
who, the molars? whom society,
the carbides of rage in the gums?
How to be
and to be here, without angering one’s neighbor?

এ-ভাবেই যন্ত্রণা আর বেদনার সামাজিকিকরণ করে তিনি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে কবিতার অস্থিকে তার সঙ্গে যুক্ত করেন। ফলে সমাজ ও কালের দুঃসহ ভারের সঙ্গি হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার গ্রন্থিল পেশি। পুঁজিবাদি সমাজ-ব্যবস্থার ক্ষয়ের ভেতর দিয়েই কবিতার সে-দুর্মর বাস্তবতা উঠে আসে। প্রচণ্ড ব্যক্তিগত অনুভূতি সম্পন্ন এমনকি ব্যতিক্রমি প্রকাশভঙ্গিসত্তে¡ও তাঁর কবিতা বৈশ্বিক মানবতাবাদি কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।

পেরুর স্বনামধন্য লেখক ও সমালোচক Professor Miguel Gutierrez Correa ভ্যাহেইয়ো’র জীবন ও কর্ম নিয়ে যে-সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পেরুভিয়ান সংস্কৃতিতে সেসার ভাএহো এবং মেরিয়েটগুই এ-দুজনকে বুর্জোয়া সাহিত্য বিচারের ‘নৈর্ব্যক্তিকতা’ ও ‘পক্ষপাতহীনতা’-এ দুই মিথ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর বলে মনে করেছেন। ১৯২৯ সালে Pablo Abril de Vivero-র কাছে লেখা এক পত্রে ভ্যাহেইয়ো পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থার চূড়ান্ত ধ্বংসের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর স্বিয় জীবনের ধ্বংসের কথাও সেখানে উচ্চারিত হয়েছিল। মার্ক্সবাদকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর এগিয়ে যাওয়াটা তখন ছিল প্রাগ্রসর চিন্তার প্রকাশ। অন্যদিকে আত্মধ্বংসের আকাক্সক্ষা পুরাতন পন্থার সমর্থন করলেও সমকালিন বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা ছিল ভাএহোর বাস্তব-যন্ত্রণারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। Art and Revolution নামক গ্রন্থে শিল্প সম্পর্কে ভাএহোর অভিব্যক্তি- শিল্প হচ্ছে, “a reflection of the economic, social, political, religious, and of all life.’ Professor Miguel Gutierrez Correa-র ভাষায়:

‘In my understanding, two aspects characterize the times Perú is going through now: On one side, there is a general decomposition of the State, manifested in its institutions and in private life, in the social relations, and in family relationships. On the other hand, it applies to the situation of the war in which we are immersed.’

যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এ-বিশ্বকে না বুঝলে তাই সেসার ভাএহো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অন্যদিকে এ-বাস্তবতার ভেতরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা সংগ্রাম আর প্রতিকূলতায় ভরা। বাবা-মা’র এগার সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ভাএহোর জন্ম ১৬ মার্চ ১৮৯২ সালে উত্তর পেরুর সান্টিয়াগো ডি চুকো’তে। এটি পেরুর মূল শহরগুলোর দূরবর্তি তথা একটি বিচ্ছিন্ন শহর। অভাব-অভিযোগপূর্ণ নিম্নবিত্ত একটি পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর পিতামহ ছিলেন স্পেনিশ ক্যাথোলিক পুরোহিত। পারিবারিক অভাব-অভিযোগের সঙ্গে তাই ছিল দুর্ভেদ্য এক ধর্মিয় পরিবেশের বেড়াজাল। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯১০ সালে স্পেনের ট্রাজিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Trujillo) ভর্তি হলেও অর্থাভাবে তাঁর পড়াশুনা বন্ধ হয়। ১৯১৩-তে তিনি পুনরায় ঐ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সর্বগ্রাসি পাঠক। দার্শনিক নির্দিষ্টতাবাদ, মিথলজি এবং বিবর্তনবাদের প্রতি তাঁর ছিল সিমাহীন আগ্রহ। ট্রাজিলোতে পুনঃভর্তি হবার প্রাক্কালে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কঠোর-কঠিন জীবন-সংগ্রাম দ্বারা পূর্ণ। কখনো গৃহশিক্ষকতা আবার কখনো চিনি-উৎপাদন ফার্মের হিসাব শাখায় তিনি কাজ করেন। এই ফার্মে কাজ করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন মানুষের জীবিকা-অর্জনের কণ্টকাকির্ণ এক ভয়াবহ বাস্তব-জগত। এখানেই সামান্য কয়েক সেন্ট পয়সার জন্য ভোর বেলা থেকে রাত্রির অন্ধকার নামা পর্যন্ত সহস্র শ্রমিককে তিনি একটানা কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেছেন। পরবর্তি জীবনে তাঁর লেখায় শ্রম ও শ্রমের মূল্যহীনতার এই সঙ্কটকে রূপায়ণের দায়িত্ব ভার যেন তিনি গ্রহণ করেন। হয়তো মার্ক্সবাদি রাজনীতির প্রতি তাঁর মোহ ও আগ্রহের বিজও লুকোনো ছিল এ-ঘটনায়।

National University of San Marcos থেকে ১৯১৭ সালে ভাএহো স্প্যানিশ সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ট্রাজিলো বাসের দিনগুলোতে এক সর্বনাশা প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়েছিলেন। সেটা ছিল তাঁর জীবনের মস্ত বড় ভুলের একটি। এরপর একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি যোগ দেন। এখানে থাকতেই রাত্রিবেলা তিনি এক বোহেমিয়ান জীবনের সন্ধান পান চায়না টাউনের অপিয়াম ডেন্-এর ক্যাফের আড্ডায়। এ-ক্যাফেতেই সে-সময়ের বিখ্যাত সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ ঘটে তাঁর। পেরুর বামপন্থি নেতা ম্যানুয়েল গঞ্জালেস প্রাডার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে এখানেই। ১৯১৯-এ Los Heraldos Negros প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্য-বোদ্ধা সমাজে সুতিব্র উৎসাহে তিনি গৃহিত হন। এরপর থেকে এই প্রতিভাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক নানা কারণেই অস্থিরতা সেসার ভাএহোর আজীবনের সঙ্গি। এ-দিকে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকাকে বিয়ে করতে অস্বিকৃতি জ্ঞাপন করায় তিনি হলেন চাকরিচ্যুত। ১৯২০ সাল মায়ের মৃত্যুতে সান্টিয়াগো ডি চুকো’তে ফেরৎ আসেন তিনি। নিজ শহর সান্টিয়াগোতেই তাঁর প্রতিবাদি জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হল। একটি জেনারেল স্টোরে অগ্নিকাণ্ড ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সত্যপ্রকাশে দ্বিধাহীন ভাএহোর ওপর নেমে আসে ‘উস্কানিদাতা বুদ্ধিজীবী’র অপবাদ। ঘটনার সঠিক তদন্ত ব্যতিরেকেই ১৫০ দিন কারাবাসের অভিজ্ঞতা ঘটে তাঁর জীবনে। পুলিশে ধৃত হবার পূর্বেই পালিয়ে বেড়াবার দিনগুলোতেই তিনি লেখেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ Trilce. প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। স্প্যানিশ আভাগার্দ সাহিত্যের এক অনন্য শিল্প হিসেবে এর ঔজ্জ্বল্য অম্লান। পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক বিশ্বে ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রথম পরিচয়ও এই Trilce কাব্যগ্রন্থ। আভাগার্দ সাহিত্য আন্দোলনের এক মুখপাত্র হিসেবে এ-কাব্যে ধ্বনিত হল সাহিত্য-জগতের চরম প্রতিক্রিয়াশিল এক ভাষা। তিনি শব্দকে নতুনভাবে যথেচ্ছ রকমের ভাঙচুর করলেন। প্রচলিত বাক্য-বন্ধনির অপসারণে আর স্বয়ংক্রিয় রচনা প্রক্রিয়া তথা কলা-কৌশলে তা হয়ে উঠল পরাবাস্তবধর্মি। ইউরোপিয়ান শিল্পে পরাবাস্তব আন্দোলন সূচিত হবার পূর্বেই তাঁর কাব্যে এ-রিতির সৃষ্টি হল, যা বিশ্বসাহিত্যে এক অভাবিত ও অভিনব ঘটনা। দুর্বোধ্যতা ও কাঠিন্যের এক জন্মদাতা ভাএহোর এ-রচনার সঙ্গে জেমস জয়েসের Finnegans Wake-এরই কেবল তুলনা চলে।

এতদিন লিমাতেই সেসার ভাএহোর শিক্ষকতা জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে চলছিল পেরুর রাজনৈতিক অসষ্ণিুতার মধ্যেও প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ইতিবৃত্ত। কিন্তু পুনরায় কারাবাসের স্বাদ গ্রহণ যাতে না করতে হয় সে-জন্য ১৯২৩ সালে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে বন্ধু জুলিও গ্যালভেজ-এর ডাকে প্যারিসের পথে তাঁকে রওয়ানা হতে হয়। পরিশেষে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার ফল হল চিরতরে লিমা ছেড়ে আসা। প্যারিস নির্বাসনের দিনগুলোতে ভাএহো ও তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুর জীবন হল প্রায় উপবাসের শিকার। ১৯২৫ সালে একটি নবগঠিত প্রেস এজেন্সিতে চাকরি পাবার পূর্ব পর্যন্ত এ-দুরবস্থাতেই তাঁদের দিন কাটছিল। প্রেস এজেন্সির চাকরি তাঁকে কিঞ্চিৎ সচ্ছলতার মুখ দেখাল। এ-সময় স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনার সুযোগও তাঁর ঘটে। বৃত্তি এবং প্রবন্ধ লেখার অর্থ দিয়ে ১৯২৬ সালে হোটেল রিচেলি পর্যন্ত তিনি পৌঁছাতে সমর্থ হলেন। এখানকার শিল্প-বিষয়ক নানা প্রদর্শনি, কনসার্ট ও ক্যাফেতে তিনি অ্যান্টোনি আরতুঁদ, পাবলো পিকাসো এবং জাঁ ককতোদের মতো বিশ্ব-বরেণ্য মানুষের সান্নিধ্য লাভ করলেন। ১৯৩০-এর সময়গুলোতে রচিত তাঁর গভীর অনুভববেদ্য ও কিছুটা সরলিকৃত শিল্পকর্মসমূহ Trilce-এর সঙ্গে এক অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছিল। এর মধ্যেই ১৯২৭ সালে স্বদেশ পেরু থেকে তাঁর কাছে আসে এক দুঃসংবাদ। পুরনো মামলার কারণে আদালত তাঁকে দোষি সাব্যস্ত করে পুনরায় আটকাদেশ জারি করে। কিন্তু লিমাতে ফিরে যাবার নির্দেশ অমান্য করে তিনি প্রেসের চাকরি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। বৃত্তির অর্থসমূহও অগ্রাহ্য করে তিনি নিজেকে আত্মগোপন করেন। এ-সময় তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশই নিম্নগামি হতে থাকে। ১৯২৮ সালে তিনি মার্ক্সবাদি সাহিত্যের পাঠ নিতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সক্রিয়ভাবে কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়ার বাধন তৈরি হয়। ১৯২৯ সালে মাদ্রিদ ছেড়ে তিনি জর্জেট ফিলিপার্টের সঙ্গে প্যারিসবাসি হন। তিনি এ-সময় তিন তিন বার রাশিয়া গমণ করেন এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের হাতে হাত মিলিয়ে পেরুভিয়ান সোস্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। কবিতা ছেড়ে এবার তিনি মার্ক্সিস্ট সাহিত্যতত্তে¡র গ্রন্থ লেখায় হাত দেন। এর মধ্যে ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম নাটক রচনা করেন। তবে প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার রচনা মৃত্যুর পূর্বে অপ্রকাশিতই থাকে।

এরপর ডিসেম্বরের কোন এক দিনে প্যারিসের রেল রোড স্টেশনে পুলিশ ভাএহোকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের মধ্যে ফ্রান্স পরিত্যাগ করতে বলে। তিনি আবার মাদ্রিদে ফিরে এলেন। ১৯৩১ সালে এখানে বসে রচনা করলেন তাঁর একমাত্র উপন্যাস El tungsteno. রাজতন্ত্রের অবসানে গণতন্ত্রের সূচনা হলে তিনি পাকাপাকিভাবে স্পেনিশ কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ-সময় তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত Rusia en ১৯৩১ পত্রিকা জনপ্রিয়তা লাভ করে কিন্তু প্রকাশকের অভাবে তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। জানুয়ারি ১৯৩২-এ তাঁর বন্ধু জর্জেট ফিলিপার্ট পুলিশ কর্তৃক তছনছ করা পুরনো বাসার খোঁজে বের হন। ভাএহো এ-সময় মাদ্রিদে তাঁর পত্রিকা প্রকাশের জন্য মরিয়া হয়ে একটা সংযোগ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ১৯৩৩-এ তিনি প্যারিসে অভিবাসনের অনুমতি পান। তখন তাঁর সম্বল একটি ব্যাগ ও সামান্য কিছু পরিধেয় বস্ত্র যা তিনি মাদ্রিদ থেকে এনেছিলেন। কিন্তু এ-অভিবাসন তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে এ-সময় তাঁর সকল কর্মকাণ্ড হয় স্থবির। ১৯৩৩-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সেসার ভাএহোর জীবন একটি অন্ধকার অধ্যায়। তিনি ও ফিলিপার্ট ১৯৩৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ-সময় তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা আরো শোচনিয় হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৩৬-এ একটি শিক্ষকতার দায়িত্ব পেলে এ-অবস্থাটা কেটে যায়। অন্যদিকে জুলাইতে স্পেনের ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের দিনগুলোতে অবারিতভাবে তাঁর সৃষ্টির অপূর্ব লিলাসমূহ প্রদর্শিত হতে থাকে। Loyalist anti-Fascist নামক গোষ্ঠির সঙ্গে জড়িত হয়ে তিনি ‘পপুলার পয়েট্রি’ লেখা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে চলল যুদ্ধের রিপোর্ট প্রদানের কাজ। আগের চেয়েও আরো বেশি নিবেদিত প্রাণে তিনি কাজের সঙ্গে হলেন একাত্ম। জুলাই ১৯৩৭-এ তিনি পুনরায় স্পেন যাত্রা করলেন। সেটা ছিল সিভিল ওয়্যারের একটা উত্তুঙ্গ সময়। এ-সময় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখকদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি যোগ দেন। দুইশত লেখকের মধ্যে সেসার ভাএহো নির্বাচিত হন পেরুভিয়ান সাহিত্যের একজন সম্মানিত প্রতিনিধি হিসেবে। স্পেন বাসের সময় তিনি স্বচক্ষে অত্যাচার ও যুদ্ধের ফলাফল প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এখানকার বেদনা বুকে নিয়ে তিনি প্যারিসে ফিরে গিয়ে লিখলেন পনেরো-অঙ্কের দৃশ্যপটে বিধৃত ট্রাজেডি La piedra cansada. এ-বছরেরই সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছুদিনের একটানা সাহিত্য সৃষ্টির জোয়ারে তিনি লিখলেন (৫৪ সংখ্যক কবিতা সম্বলিত) ঝবৎসষ্টহ ফব ষধ নধৎনধৎরব-র ৫২টি কবিতা। পনের সংখ্যক কবিতাগুচ্ছের Sermón de la barbarie-ও এই জোয়ারের ফসল।

১৯৩৮-এর প্রথম ভাগ অস্থিরতা আর প্রবঞ্চনায় ভরা। আগের দিনগুলো যেন তাদের ঋণের প্রতিশোধ নিচ্ছিল স্পেনের ওপর। ভ্যাহেইয়ো মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হলেন এবং মার্চ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে উঠলেন না। চিকিৎসার অপূর্ণতা না থাকা সত্তে¡ও তাকে সুস্থ করে তোলা গেল না। একদিকে জীবন প্রদিপের নিভু নিভু অবস্থা অন্যদিকে পৃথিবীময় শুরু হল চরম অস্থিরতা। এপ্রিলের ১৫ তারিখ ফ্যাসিস্ট বাহিনি ভূমধ্যসাগরের তিরে পৌঁছায়, তারা পৃথিবীকে করে দ্বিধাবিভক্ত। প্রবল ইচ্ছাসত্তে¡ও ভাএহোর স্পেন ফেরা হয়নি, তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি স্পেনে যাচ্ছি! আমি স্পেনে যেতে চাই!’ প্যারিস নির্বাসনে ১৫ এপ্রিল ১৯৩৮-এর এক বর্ষণমুখর দিনে (গুড ফ্রাইডেতে) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। উত্তর প্যারিসের মন্ট্রোগের কমিউনিস্ট সেমিট্রিতে ভাএহো শায়িত হলেন। পেরুর বুর্জোয়া সরকার তাঁকে দেশে ফিরতে দেয়নি। এমনকি মৃত ভাএহোর হাড়-ভষ্ম তাঁর প্রিয় স্বদেশে ফিরে আনাতেও ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তিনি পেরুর মানুষের অন্তরাত্মা আর ধমনিতে বেঁচে আছেন; হয়তো থাকবেন চিরকাল। শিল্প ও জীবন নিয়ে তাঁর অখণ্ড সত্যের বার্তা তাই হারিয়ে যাবার নয় কখনো। কারণ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন :

‘আমি ল্যাটিন বন্দুকের গুলির আঘাতে পালক খসে যাওয়া এক বার্তাবাহী কবুতর। অথবা আমি মানবতার পুষ্প যা সুবাস ছড়ায় দিনভর। কিংবা আমি ল্যাজারাসের অমর আলোককণা যে নিরন্তর উড়ে চলেছে আন্দিজ পর্বতমালায়।’

শেয়ার করুন: