004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

প্লেটো’র লেখা থেকে- দর্শন এবং কাব্যের বিরোধ

আমি বললাম: গ্লকন, তুমি নিশ্চয়ই জান আমাদের আদর্শ রাষ্ট্রের উত্তম গুণের মধ্যে যাকে আমি সর্বোত্তম বলে গণ্য করি, সে হচ্ছে তার কাব্যের নীতি।
কিন্তু কেন সক্রেটিস?
কারণ, আমাদের রাষ্ট্রের বিধান এখানে সুস্পষ্ট। সকল নাটকিয় সৃষ্টিকে আমাদের রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আত্মার বিভিন্ন ভাগকে আমরা চি‎িহ্নত করেছি। এবার আমরা পূর্বের চেয়েও স্পষ্টরূপে এই বিধানের উপযোগিতাটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, সক্রেটিস।
তোমাকে একান্তে একটি কথা বলছি। তুমি বিষাদাত্মক এবং অন্য প্রকৃতির নাট্যকারদের কথাটি বোলো না। আসলে আমরা যদি শ্রোতাদের মনে এই নাট্যকারদের সৃষ্টির যথার্থ প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি তৈরি না করি তাহলে এদের সৃষ্টি শ্রোতাদের মনকে নিশ্চিতই বিভ্রান্ত করবে।
কিন্তু তুমি সঠিকভাবে কি বলতে চাচ্ছ?
অবশ্য তোমাকে আমার আর একটি কথা বলতে হয়। কিন্তু আমার শৈশবকাল হতে হোমারের প্রতি যে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা আমি পোষণ করে এসেছি তাতে কথাটি প্রকাশ করতে আমি দ্বিধাবোধ করছি। কারণ, আমার মতে সকল বিষাদাত্মক কবির গুরু হচ্ছেন হোমার। তিনি হচ্ছেন অপর সকলের শিক্ষাদাতা পথপ্রদর্শক। কিন্তু সত্যের চেয়ে কি ব্যক্তি বড়? সত্যের চেয়ে ব্যক্তিকে আমরা অধিক সম্মান দেখাতে পারিনে। কাজেই তোমার কাছে কথাটি আমার বলতেই হবে।
কথাটি তুমি বলো, সক্রেটিস।
বেশ, তাহলে তুমি শ্রবণ করো। না, বরঞ্চ তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
জিজ্ঞেস করতে শুরু করো।
আচ্ছা গ্লকন, প্রতিসৃষ্টির কোনো সংজ্ঞা দিতে পার? আমি নিজে জানিনে প্রতিসৃষ্টি যথার্থই কি।
তুমি না-জানলে আমারও জানার আশা কম।
না, যথার্থই আমি জানিনে। বস্তুত, নিকটদৃষ্টি অনেক সময়ে দূরদৃষ্টির চেয়ে তিক্ষè হয়। ঠিক নয় কি?
গ্লকন বললেন: তা হয় বইকি। কিন্তু তুমি উপস্থিত থাকতে আমার কিছু বলা সঙ্গত নয়। সক্রেটিস, তোমার নিজের দৃষ্টির উপরই তোমার নির্ভর করতে হবে।
তাহলে, এসো আমরা শুরু করি। কিন্তু অন্য বিষয়ে যেখান থেকে আমরা সর্বদা শুরু করি এ বিষয়েও কি আমরা সেখান থেকে শুরু করবো? তুমি তো জান, আমরা সর্বদা একটি সত্যকে ধরে নিয়েছি যে, প্রত্যেক প্রকার বস্তুর পেছনে তার অনুরূপ একটি মূল সত্তার অস্তিত্ব আছে। এই বস্তুর যা নাম সেই একই নামে আমরা সত্তাকেও অভিহিত করি। ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, একথা আমি জানি।
বেশ, একটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। যেমন শয্যা এবং টেবিল; জগতে বিশেষ শয্যা এবং বিশেষ টেবিলের সংখ্যা অনেক আছে।
তা আছে।
কিন্তু এদের মূল সত্তা দুটি। একটি হচ্ছে ‘শয্যা’, অপরটি হচ্ছে ‘টেবিল’।
হ্যাঁ, একথা ঠিক।
তাছাড়া একথাও আমরা সাধারণত বলি যে, কোনো সূত্রধর অর্থাৎ এই সকল গৃহসামগ্রির যে তৈরিকারক, তৈরির ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি থাকে, যে দ্রব্যটি সে তৈরি করবে তার মূল সত্তার দিকে। সকল দ্রব্যের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কারণ, কোনো দ্রব্যের মূল সত্তাকে কেউ তৈরি করতে পারে না। তুমি কি বল? কেউ কি তা পারে?
না, তা পারে না।
বেশ ধরো, এমন একজন মানুষ আছে, সে সকলরকম কারিগরের তৈরি দ্রব্যই তৈরি করতে পারে। একে তুমি কি বলবে?
তাকে আমরা বিস্ময়কররূপে দক্ষ লোক বলব।
বেশ, এবার একটু থামো। তোমার জন্য অধিকতর বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। কারণ, যে কারিগরের কথা বললাম, তার দক্ষতা কেবল কৃত্রিম দ্রব্যসামগ্রি সৃষ্টিতেই সিমাবদ্ধ নয়। সে উদ্ভিদজগতের সকল উদ্ভিদ, পশু এবং নিজেকেও যে সৃষ্টি করতে পারে তাই নয়, অধিকন্তু এই পৃথিবী, আকাশ, দেবতাকুল, ঊর্ধ্ব এবং অধঃলোকের বস্তুপুঞ্জ-সব সৃষ্টিরই সে কারিগর।
এ দক্ষতা অবশ্যই বিস্ময়ের বিস্ময়।
আমি জানি তুমি আমায় বিশ্বাস করছ না গ্লকন। কিন্তু তুমি বলো, তুমি কি সত্যই বিশ্বাস কর না, এরূপ শিল্পি একজন থাকতে পারে? এবং সে উলে­খিতভাবে কিংবা অন্যভাবে এই সবকিছুর সৃষ্টি করতে সক্ষম? এক অর্থে কিন্তু তুমি নিজেও এই সবকিছুকে সৃষ্টি করতে পারো।
কি অর্থে?
খুব যে কঠিন, এমন নয়। বস্তুত বিভিন্ন উপায়ে দ্রুতই করা যায়। এবং দ্রুততম উপায়টি হচ্ছে একটি আরশি নিয়ে তোমার চারদিকে একবার ঘুরিয়ে আনা। মুহূর্তমধ্যে তুমি দেখতে পাবে সূর্য, তারকারাজি, পৃথিবী, তোমার নিজেকে, সকল পশু, উদ্ভিদাদি-এবং আর যা কিছুর আমরা উলে­খ করেছি তার সবকিছু তুমি সৃষ্টি করে ফেলেছ।
হ্যাঁ, তা আমি পারব বটে। কিন্তু সেগুলো তো প্রতিচ্ছবি মাত্র। সেগুলো তো যথার্থ বস্তু নয়। আমি বললাম: খুবই ঠিক কথা। তুমি ধরেছ ঠিকই। আমি বলব, একজন চিত্রশিল্পি ঠিক এই ধরনেরই একজন কারিগর। তুমি কি একথা স্বিকার কর?
হ্যাঁ, আমি একথা স্বিকার করি।
তোমার আপত্তি হবে, শিল্পি যে বস্তু তৈরি করবে তা সত্যকার বস্তু নয়। তবু একটা অর্থে শিল্পি একটি শয্যা অবশ্যই তৈরি করে। ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, সে তৈরি করে-কিন্তু তার সে শয্যা তো যথার্থ শয্যার একটি দৃশ্য বা প্রকাশমাত্র।
হ্যাঁ, কিন্তু সূত্রধর সম্পর্কেও কি তুমি বলনি যে সূত্রধর যা তৈরি করে তা শয্যার মূল সত্তা নয়, তার অন্তরসত্তা নয়, একটি বিশেষ শয্যাকেই সে তৈরি করে?
হ্যাঁ, একথা আমি বলেছিলাম।
তাহলে যা সে তৈরি করে তা মূল সত্তা নয়। সে সৃষ্টি করে এমন কিছু, মূল সত্তার সঙ্গে যার সাদৃশ্য আছে। কাজেই কেউ যদি বলে, সূত্রধর কিংবা অপর কোনো কারিগর যা তৈরি করে তা হচ্ছে মূল সত্তা বা চরম সত্তা, তাহলে সে নিশ্চয়ই সত্য কথা বলবে না। তুমি কি বল?
যে আমাদের যুক্তির সঙ্গে পরিচিত সে নিশ্চয়ই এরূপ কথা বলতে পারবে না।
কাজেই সূত্রধরের শয্যার মূল সত্তার যদি কিছু ঘাটতি পড়ে, তাতে আমাদের বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
তাহলে এই দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে আমরা কি এবার প্রতিসৃষ্টির সংজ্ঞাদানের চেষ্টা করব?
হ্যাঁ, এবার তুমি সংজ্ঞাটি দাও।
আমরা দেখেছি, শয্যা তিন প্রকারের হতে পারে। প্রথম হচ্ছে মূল শয্যা। এ হচ্ছে সকল শয্যার মূল সত্তা। একে কেউ যদি তৈরি করে থাকে সে একমাত্র বিধাতা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সূত্রধরের তৈরি শয্যা। এবং তৃতীয়টি হচ্ছে চিত্রশিল্পির ‘শয্যা’।
হ্যাঁ, একথা ঠিক।
তাহলে আমরা বলতে পারি একই শয্যার পেছনে তিনজন স্রষ্টা রয়েছে: সূত্রধর, বিধাতা এবং শিল্পি।
হ্যাঁ, তা-ই তো রয়েছে দেখছি।
এর মধ্যে বিধাতা শয্যার কেবল মূল সত্তা তৈরি করে দিয়েছেন। এর কারণ হয়তো এই যে, তিনি শয্যার এই সত্যটিই তৈরি করতে চেয়েছেন কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য তিনি শয্যার অপর কোনো সত্তা তৈরির সময় পাননি। মোট কথা বিধাতা শয্যার একটি সত্তাই তৈরি করেছেন, এর একাধিক রূপ তিনি তৈরি করতে পারেননি।
কিন্তু কেন তিনি পারলেন না?
কারণ, তিনি যদি দুটি সত্তাও তৈরি করতেন, তাহলেও সে দুটির মধ্যে চারিত্রিক মিল থাকতো এবং এই দুটি সদৃশ সত্তাই মূল হিসেবে পরিগণিত হতো।
হ্যাঁ, একথা সত্য।
আমার মনে হয় বিধাতা এ কথাটি জানতেন। এবং তিনি সূত্রধরের ন্যায় একটি বিশেষ শয্যা তৈরি না করে সত্যকার মূল শয্যা তৈরি করতে চেয়েছিলেন বলেই তাকে তিনি দ্বিতীয় কোনো মূল শয্যার সদৃশ না করে একটিমাত্র অনন্য মূল শয্যা তৈরি করেছেন।
তাই হবে, সক্রেটিস।
তাহলে আমরা কি তাকে বস্তুর সত্তার স্রষ্টা কিংবা অনুরূপ অপর কোনো নামে অভিহিত করতে পারিনে?
আমরা সঙ্গতভাবেই তাঁকে এই বলে অভিহিত করতে পারি। কারণ তাঁর সকল সৃষ্টিই হচ্ছে সকল মূল সত্তার সৃষ্টি।
বেশ। তাহলে সূত্রধরের বিষয়ে আমরা কি বলবো? সূত্রধরও তো শয্যা তৈরি করে?
হ্যাঁ, সে-ও শয্যা তৈরি করে।
এবং শিল্পি সম্পর্কে আমরা কি বলবো? সে-ও কি শয্যা তৈরি করে?
না, সে তৈরি করে না।
তাহলে সে কি করে?
আমরা বলতে পারি অপর দুজন যে শয্যা তৈরি করে শিল্পি তাকে প্রকাশ করে।
উত্তম কথা। তাহলে শিল্পির প্রকাশ, সত্য থেকে তিন প্রস্থ তফাতে অবস্থিত?
হ্যাঁ, তিন প্রস্থ তফাতে তার অবস্থান।
তাহলে বিষাদাত্মক কবি, যার কৌশল হচ্ছে সত্যের প্রতিসৃষ্টি রচনা করা, তার অবস্থানও সত্য থেকে তিন প্রস্থ দূরত্বে। অপর সকল শিল্পি সম্পর্কেও একথা সত্য। ঠিক নয় কি?
তাই তো মনে হচ্ছে, সক্রেটিস।
তাহলে প্রতিসৃষ্টি সম্পর্কে আমরা একমত। কিন্তু গ্লকন তুমি বলো, শিল্পি কোন্ সৃষ্টিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে? সে কি বস্তুর মূল সত্তাকে প্রকাশ করে কিংবা কারিগর যা সৃষ্টি করে তারই প্রতিরূপ সে তৈরি করে?
কারিগর যা তৈরি করে তারই প্রতিরূপ সে সৃষ্টি করে।
কিন্তু শিল্পি কারিগরের সৃষ্টি যেমন আছে তেমন তৈরি করে কিংবা সে সৃষ্টির বহিঃরূপটিকে প্রকাশ করে? এ পার্থক্যটি স্থির করা আমাদের এখনও বাকি রয়েছে।
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছিনে, সক্রেটিস।
আমি বলতে চাচ্ছি: তুমি যদি একটি শয্যা কিংবা অপর কোনো বস্তুকে তার পার্শ্বদেশ, প্রান্তদেশ কিংবা কোনো কৌণিক অবস্থান থেকে দেখ তাতে কি শয্যাটির চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটবে? না, বিভিন্ন অবস্থান থেকে বস্তুটি কেবল বিভিন্ন রূপে দৃষ্ট হবে?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, সক্রেটিস। একই শয্যা কিন্তু সে বিভিন্ন রূপে দৃষ্ট হবে।
তাহলে শিল্পির সম্পর্কে কি বলবে? শিল্পি কি শয্যাটি কিংবা অপর কোনো বস্তু যেমন আছে তেমন তাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে? না, এ সকল বস্তু যেমন দৃষ্ট হয় তেমন তাকে সে প্রকাশ করে? না যেমন সে দেখায় তেমন তাকে প্রকাশ করে?
বস্তুটি যেমন দেখায়, তেমন প্রকাশ করে।
তাহলে শিল্পির প্রকাশ সত্য থেকে বহুদূরে অবস্থিত। এবং শিল্পি যে যেকোনো বস্তুরই প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে, তার কারণ তার দৃষ্টি বস্তুর বাহ্যরূপকে ভেদ করে কখনো তার অন্তঃসত্তায় পৌঁছে না। যেমন ধরো, একজন শিল্পি, একজন পাদুকা প্রস্তুতকারক, একজন সূত্রধর কিংবা অপর যেকোনো কারিগরেরই প্রতিকৃতি এদের শিল্পনৈপুণ্যের কোনো জ্ঞান ব্যতিরেকেই অঙ্কন করতে পারে। কিন্তু তবু এই চিত্রশিল্পি যদি দক্ষ হয় তাহলে কিছুটা দূরত্ব থেকে শিশুদের নিকট কিংবা সকল মানুষের কাছে তার অঙ্কিত প্রতিকৃতি যথার্থ সূত্রধর বলেই বোধ হবে। ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, প্রতিকৃতিটি যথার্থ সূত্রধর বলে বোধ হতে পারে।
তাহলে এরূপ ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হওয়া সঙ্গত। তাই, যদি কেউ আমাদের বলে যে, সর্বক্ষেত্রে নিপুণ কারিগরের সে সাক্ষাৎ পেয়েছে, সকল জ্ঞানির চেয়েই এর জ্ঞান অধিক, তাহলে আমরা তাকে বলব মূর্খের মতো আচরণ করা তার পক্ষে সঙ্গত নয়। হাতুড়ের হাতে প্রতারিত হওয়া তার উচিত নয়। হাতুড়ে তার কাছে সর্বজ্ঞ বলে বোধ হচ্ছে, কারণ সে নিজে জ্ঞান এবং অজ্ঞতা এবং প্রতিরূপের মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবনে অক্ষম।
খুবই যথার্থ।
এবার তাহলে আমাদের বিষাদাত্মক কবি এবং তাদের গুরু হোমারের দাবি পরিক্ষা করে দেখা আবশ্যক। তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়, তাঁরা নাকি সকল নৈপুণ্যে দক্ষ। তাঁরা ধর্ম এবং নীতির ক্ষেত্রেও সর্বজ্ঞ। কারণ কবিদের সমর্থকরা বলেন, একজন উৎকৃষ্ট কবিকে কোনো বিষয়ে উত্তম রচনার জন্য তাকে সে বিষয়ের সবকিছুই জানতে হয়। যাঁরা এই কবিদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, যাঁরা এঁদের রচনা পাঠ করেছেন আমরা তাঁদের জিগ্যেস করব তাঁরা কি একটি বিষয় লক্ষ্য করেননি যে, কবিদের এই সৃষ্টি সত্য থেকে তিন প্রস্থ দূরে অবস্থিত: এরা সত্যের ছায়ামাত্র, সত্য নয় এবং এ কারণে সত্যের জ্ঞান ব্যতিত এদের সৃষ্টি করা কবিদের পক্ষে সহজ হয়েছে? অথবা আমরা বলব যে, তাদের কথাই সত্য এবং জনসাধারণ যেমন তাদের উত্তম কথক মনে করে তেমনি উত্তম কবিগণ তাদের রচনার বিষয় সম্পর্কে যথার্থই জ্ঞানি?
সক্রেটিস, বিষয়টি আমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।
আচ্ছা বেশ, ধরো কেউ কোনো সৃষ্টির মূল এবং তার প্রতিরূপ-উভয়কে জানে। তাহলেও কি সে প্রতিরূপ সৃষ্টিতেই নিজেকে নিয়োজিত করবে এবং জীবনের চরম লক্ষ্যে পরিণত করবে?
না, আমি তা মনে করিনে।
ঠিক, তা সে অবশ্যই করবে না। যে বস্তুর প্রতিরূপ সে সৃষ্টি করছে, তাকে যদি সে যথার্থই জানে তাহলে মূল বস্তুর প্রতিই সে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, তার প্রতিরূপের উপর নয়। তার উত্তম রচনার প্রশংসার স্মৃতির বদলে সে কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়ারই অধিক কামনা করবে। অপরের বৃহৎ কর্মের প্রশংসায় কাব্যকলা রচনার পরিবর্তে নিজেই সে বৃহৎ কর্মের নায়ক হওয়ার কামনা করবে।
গ্লকন বললেন, হ্যাঁ, একথা ঠিক। অপরের প্রশংসায় রচিত কাব্যের চেয়ে নিজের কর্মের প্রশংসা এবং পুরস্কার-উভয়ই অধিক হবে।
তাহলে আমরা এরূপ আশা করবো না যে, হোমার কিংবা অপর কোনো কবি আমাদের নিকট নিরাময়বিদ্যা কিংবা অপর কোনো দক্ষতার ব্যাখ্যা পেশ করবেন। যেমন ধরো, কবিদের কেউ যদি যথার্থই চিকিৎসাবিদ বলে নিজেকে দাবি করেন এবং যদি তিনি চিকিৎসকের আলাপের কেবল অনুকারি না-হন তাহলে চিকিৎসাবিদ এসক্যুলাপিয়াসের ন্যায় কোনো প্রাচিন কিংবা আধুনিক কবি চিকিৎসায় পারদর্শি হয়েছেন কিংবা তাঁর কোনো কবি চিকিৎসা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁর নাম তাঁকে বলতে হবে-এমন দাবি নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আমরা করবো না। কিন্তু হোমার যখন রণনীতি, রাষ্ট্রিয় শাসন এবং শিক্ষার ন্যায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন তখন তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করার আমাদের অবশ্যই অধিকার আছে। আমরা বলবো: ‘কবিবর হোমার, আমরা যদি আমাদের সংজ্ঞায় ভ্রান্ত হয়ে থাকি এবং আপনি যদি সত্য থেকে তিন প্রস্থ দূর থেকে সত্যের ছায়া সৃষ্টি করে না-থাকেন, যদি আপনি মানুষের উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে সত্যের এক প্রস্থ নিকটবর্তি হয়ে থাকেন এবং আপনি যদি যথার্থই বলতে পারেন কোন আচরণ ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রকে উত্তম বা অধম করে, তাহলে আপনি দয়া করে বলুন লাইকারগাস যেমন স্পার্টার কিংবা অপরে যেমন অন্যত্র রাষ্ট্রিয় সংবিধানের সংস্কার কম কিংবা অধিক পরিমাণে সাধন করেছেন, তেমনি আপনি কোন রাষ্ট্রের সংবিধানের সংস্কার সাধন করেছেন। কোন নগরির বিধানাবলি আপনার জ্ঞানের নিকট ঋণি? ইতালি এবং সিসিলি তাদের সংবিধানের জন্য চারোন্দাজের নিকট ঋণি, আমরা ঋণি সালোনের নিকট। আপনি বলুন কোন রাষ্ট্রের মানুষ অনুরূপভাবে আপনার নিকট ঋণি?
গ্লকন বললেন: সক্রেটিস, আমার তো মনে হয় না, হোমারের যে সর্বাধিক অনুরক্ত সে-ও তাঁর জন্য এমন কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে।
বেশ। কিন্তু হোমারের কালের এমন কোনো যুদ্ধের কথা কি আমরা জানি যে যুদ্ধের সাফল্য তাঁর অধিনায়কত্বে কিংবা তাঁর উপদেশে অর্জিত হয়েছে?
না, তা আমরা জানিনে।
তাহলে মাইলেটাসের থেলিস কিংবা সিদের আনাকারসিসের ন্যায় কোনো বাস্তব কৌশলকে কি তিনি আবিষ্কার করেছেন? এরূপ বাস্তব কোনো দক্ষতা কি তাঁর ছিল?
না, এরূপ কোনো দক্ষতাও হোমার প্রদর্শন করেননি।
বেশ, তিনি যদি জনসেবামূলক কিছু না-ও করে থাকেন, তবু নিজের শিক্ষাকেন্দ্র কি তিনি স্থাপিত করেছিলেন, এমন শিক্ষালয় যেখানে তাঁর জীবনকালে সাগ্রহি শিক্ষার্থিগণ তাঁর উপদেশ শ্রবণের জন্য সমাগত হত এবং তিনি তাঁর উত্তরপুরুষদের জন্য একটা বিশিষ্ট হোমারিয় জীবনপদ্ধতি দান করে গেছেন? পাইথাগোরাসের খ্যাতিতো এ কারণেই। তাঁর অনুসারিগণ আজও পাইথাগোরিয় জীবনধারার কথা বলেন এবং এই জীবনধারা তাঁদের অপর সকল থেকে বিশিষ্ট বলে চি‎ি‎হ্নত করে।
না সক্রেটিস, হোমার সম্পর্কে আমরা এরূপ কোনো খ্যাতির কথা শুনিনে। বস্তুত হোমার সম্পর্কে প্রচলিত সব কাহিনি যদি সত্য হয় তাহলে তাঁর সুহৃদ ক্রিওফাইলাস অধম শিক্ষার একটি অধমতম দৃষ্টান্ত। কারণ হোমার যখন জীবিত ছিলেন তখন তাঁর সুহৃদ তাঁর প্রতি অতি সামান্য সম্মানই প্রদর্শন করেছেন।
গ্লকনের কথায় আমি বললাম: হ্যাঁ, এরূপ কাহিনিই প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু গ্লকন, হোমারের যদি যথার্থই মানুষকে শিক্ষার উপকারে উপকৃত করার ন্যায় জ্ঞান থাকত, কোনো বস্তুর অলিক প্রতিরূপ তৈরি করার ক্ষমতা ব্যতিত তাঁর যদি সত্যিকার জ্ঞান থাকত, তাহলে তাঁর কি বহুসংখ্যক অনুসারি এবং অনুরাগি না থেকে পারতো? আবডেরার প্রোগাগোরাস এবং সিওস-এর প্রডিকাস এবং তাঁদের অনুরূপ বহু শিক্ষক তাঁদের সমকালিনদের বুঝিয়েছেন যে, তাঁদের অধিনে শিক্ষা গ্রহণ না করে তাদের পক্ষে ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রিয় কোনো দায়িত্ব পালনই সম্ভব হবে না। এবং এঁদের অনুসারিগণ এই শিক্ষকদের জ্ঞানের দক্ষতার প্রশংসায় এরূপ উচ্ছ¡সিত হত যে, তারা তাদের শিক্ষকদের নিজেদের স্কন্ধে তুলে সম্মান জানাতেও দ্বিধা করতো না। হোমার এবং হিসিয়ডের যদি যথার্থই মানুষকে উত্তম করার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তাঁদের সমকালিন লোক কি তাদের চারণকবি হিসেবে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দিতো? তারা কি সকলে খাঁটি স্বর্ণের ন্যায় তাঁদের দেহে সংলগ্ন হয়ে গৃহের মধ্যে অবস্থানে তাঁদের সম্মত করতে সচেষ্ট হতো না? তথাপি তাঁরা যদি গৃহে অবস্থান না-করতেন, তাহলে অনুরাগিগণ কি তাদের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য তাঁদের অনুগমন করে, তাঁরা যেখানে যেতেন সেখানেই যেতো না?
সক্রেটিস, তোমার একথা যথার্থ বলেই আমার মনে হয়।
তাহলে আমাদের এ কথাই মনে করতে হয় যে, হোমার থেকে শুরু করে কবিকুলের কারোরই সত্যের যথার্থ কোনো জ্ঞান নেই। যে বিষয়ে তারা আলোচনা করে তার অগভীর প্রতিরূপই মাত্র তারা সৃষ্টি করতে সক্ষম। মানুষের কিসে মঙ্গল সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। যেমন আমরা খানিক পূর্বেই উলে­খ করেছি, অঙ্কনশিল্পি পাদুকা প্রস্তুতকারক বলে যা মনে হয় তার চিত্রই সে অঙ্কন করে। অথচ সে কিংবা তার চিত্রের দর্শকবৃন্দ কেউই পাদুকা প্রস্তুতের বিষয়ে কোনো জ্ঞান রাখে না। তারা বস্তুর বর্ণ এবং আকার দ্বারাই তাকে বিচার করে।
এ কথা সত্য।
অনুরূপভাবেই একজন কবি শব্দের মাধ্যমে যেকোনো কারিগরের একটি চিত্র তৈরি করতে পারে। অথচ সে তার ছবি তৈরি করা ব্যতিত তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু তার শব্দের মাত্রা এবং ছন্দ এবং তার সংগিত মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। সাধারণ মানুষ যারা নিজেরা কবির মতোই অজ্ঞ, যারা কেবল শব্দের ভিত্তিতেই কোনো বিষয়কে বিচার করে তারা মনে করবে, এ কবির পাদুকা প্রস্তুতকারক কিংবা যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা ইত্যাকার সব বিষয় সম্পর্কেই গুরুতর বক্তব্য একটা কিছু রয়েছে। এরূপ প্রবল হচ্ছে কাব্যের স্বভাবগত জাদুর ক্ষমতা। কবির এই বক্তব্যকে তুমি তার কাব্যিক বর্ণলেপ থেকে মুক্ত করে ফ্যালো, সাধারণ গদ্যে তাকে পরিণত করো, তাহলেই তুমি দেখবে সে বক্তব্য কত মূল্যহীন।
হ্যাঁ, এটি আমি লক্ষ করেছি। তখন এরূপই হয়।
এ হচ্ছে সেই মূর্খের মতো যার যথার্থ কোনো সৌন্দর্য নেই; যৌবনের ফুটন্ত কুসুমই যার সৌন্দর্যের একমাত্র নির্ভর।
হ্যাঁ, এ কথাও সত্য।
আর একটি বিষয় লক্ষ্য করো। যে শিল্পি কোনো বস্তুর প্রতিরূপ তৈরি করে সে বস্তুর সত্তাকে জানে না, তার প্রকাশকেই মাত্র জানে। আমরা এই কথাটি বলেছিলাম, ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, আমরা এ কথা বলেছি।
কিন্তু তার মারফত আমরা অর্ধপথই অগ্রসর হতে পারি, অধিক নয়।
বেশ, তাহলে আরও অগ্রসর হও।
শিল্পি অশ্বের লাগাম এবং বল্গার ছবিও তৈরি করতে পারে?
হ্যাঁ, তা পারে।
কিন্তু আসলে এ বস্তুগুলো তৈরি করে কর্মকার এবং অশ্বের সাজ প্রস্তুতকারক। ঠিক নয় কি?
ঠিক কথা।
কিন্তু শিল্পি কি জানে বল্গা এবং লাগাম কিরূপ হওয়া আবশ্যক? বস্তুত কর্মকার কিংবা প্রস্তুতকারকও এ বিষয়টি জানে না। বল্গা এবং লাগাম কিরূপ হওয়া আবশ্যক, সে কথা জানে কেবলমাত্র অশ্বচালক, যে এদের ব্যবহারের জ্ঞান রাখে। তুমি কি বলো?
অবশ্যই। অশ্বচালকই মাত্র জানে।
একথা কি সব সময়ের জন্য সত্য নয়। যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রেই তিনটি প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব রয়েছে; তার ব্যবহার, তার সৃষ্টি এবং তার প্রতিসৃষ্টি।
ঠিক কথা।
এবং কোনো হাতিয়ার কিংবা কোনো প্রাণি বা কোনো কার্য-তার গুণ, সৌন্দর্য এবং উপযোগিতা কি তাকে মানুষ কিংবা প্রকৃতি যে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে তার ভিত্তিতেই বিচার করা হয় না?
হ্যাঁ, তাই করা হয়।
তাহলে এ থেকে বোঝা যায় যে, বস্তুর ব্যবহারকারিকে বস্তুটিকে জানতে হবে; তার প্রস্তুতকারিকে সে বলে দেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বস্তুটি তার উপযোগিতার পরিচয় কতখানি দিতে সক্ষম হয়েছে। যেমন ধরো, বাঁশি যে বাজায়, সে বাঁশি যে বানায় তাকে বলে দেয়, তার বানানো বাঁশিটি কেমন করে বেজেছে। এবং তার কি ধরনের বাঁশি আবশ্যক সে কথাও বাঁশি-প্রস্তুতকারককে সে বলে দেবে।
হ্যাঁ, তাই তাকে বলতে হবে।
তাহলে বস্তুর ব্যবহারকারিই বস্তুর জ্ঞান রাখে। বস্তুর যে তৈরিকারক তাকে ব্যবহারকারির নির্দেশ গ্রহণ করতে হয়। তার জ্ঞানের উপর তাকে নির্ভর করতে হয়। ব্যবহারকারির মাধ্যমেই মাত্র প্রস্তুতকারক বস্তু সম্পর্কে, তার গুণ এবং দোষ সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
এ কথা সত্য।
তাহলে শিল্পি এবং তার সৃষ্ট প্রতিরূপ সম্পর্কে আমরা কি বলবো? যে বস্তুর সে ছবি অঙ্কন করে, তার যথার্থতা কিংবা অযথার্থতা সম্পর্কে তার কি প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা আছে? অথবা এমন কি আমরা বলতে পারি যে, যারা জানে তার কি অঙ্কন করা উচিত তাদের নির্দেশের উপর নির্ভরজনিত সঠিক ধারণা অন্তত তার রয়েছে?
না, এর কোনোটিই শিল্পির নেই।
তাহলে, শিল্পি যে বস্তুর ছবি আঁকে তা ‘উত্তমতা’ কিংবা ‘অধমতা’ সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান কিংবা ধারণা থাকে না।
না, তার এরূপ জ্ঞান কিংবা ধারণা থাকে না।
ঠিক শিল্পির মতো, কবিও তার কাব্যের বিষয় সম্পর্কে সমভাবেই অজ্ঞ?
হ্যাঁ, সে সম্পূর্ণরূপেই অজ্ঞ।
তথাপি, যে বিষয়ে সে কাব্য রচনা করছে সে সম্পর্কে তার অজ্ঞতা সত্তে¡ও সে কাব্যসৃষ্টি করতে থাকবে। এবং অজ্ঞ জনতার যাতে মনস্তুষ্টি ঘটে তারই প্রতিরূপ সে সৃষ্টি করে চলবে।
এছাড়া সে আর কি করতে পারে?
তাহলে আমরা বেশ পরিমাণেই একমত যে, শিল্পি তার সৃষ্টির বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা সে সম্পর্কে তার জ্ঞান অতি নগণ্য এবং তার এরূপ শিল্পের যথার্থ কোনো মূল্য নেই। একথা শুধু শিল্পির ক্ষেত্রে নয়, বিষাদাত্মক কবি, মহাকাব্য বা নাট্যকাব্য: কাব্যের সকল ক্ষেত্রেই একথা সত্য?
হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, সক্রেটিস।
একটা বিষয়ে আবার একটু স্মরণ করা আবশ্যক, গ্লকন। আমরা বলেছি প্রতিরূপের এই সৃষ্টি সত্য থেকে তিন প্রস্থ দূরত্বে অবস্থিত। ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, আমরা একথা বলেছি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের কোন অংশকে এই প্রতিরূপ প্রভাবান্বিত করে?
সক্রেটিস, মানুষের অংশ বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ?
বলছি। তুমি তো জান, কোনো বস্তুর দৃশ্য, আকার তোমার চোখ থেকে তার দূরত্বের উপর নির্ভরশিল।
হ্যাঁ, একথা ঠিক।
তেমনি একটি কাঠি যদি তুমি পানিতে নিমজ্জিত করো, তাহলে সেটি তোমার চোখে বাঁকা ঠেকবে। এবং তুমি যখন তাকে পানির বাইরে নিয়ে আস তখন সেটি সোজা বোধ হয়। আবার আবরণের ব্যতিক্রমে একই তল তোমার চোখে অবতল কিংবা উত্তল বোধ হতে পারে। এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের আত্মার বিভ্রান্তি। আমাদের এই স্বাভাবিক দুর্বলতার উপরই দৃশ্যশিল্পি, জাদুকর এবং তাদের অনুরূপ লোকেরা নির্ভর করে এবং তাদের কৌশল দ্বারা আমাদের বিভ্রান্ত করে।
একথা যথার্থ।
পরিমাপ, হিসাব এবং ওজনের উপায় মানুষ আবিষ্কার করেছে এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির জন্য, এই নিশ্চয়তার জন্য যে, কোনো কিছুর বাহ্য আকার, কিংবা পরিমাণ দ্বারা যেন আমরা পরিচালিত না-হই, যেন আমরা নির্ভর করতে পারি সংখ্যা, পরিমাপ এবং ওজনের সঠিক হিসাবের ওপর। এবং আমরা জানি এরূপ সঠিক হিসাবের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আত্মার বুদ্ধি এবং যুক্তির।
হ্যাঁ, একথা ঠিক।
অথচ দ্যাখো, বারংবার হিসাবের ভিত্তিতে যুক্তি যদি আমাদের বলে যে, একটা বিশেষ বস্তু অপর একটা বিশেষ বস্তু থেকে বৃহত্তর কিংবা ক্ষুদ্রতর কিংবা পরস্পর সমান, তবু তাদের বাহ্যদৃশ্য এ সিদ্ধান্তের বিরোধি বলে বোধ হতে পারে।
হ্যাঁ, এরূপ হতে পারে।
কিন্তু আমরা বলেছি যে আমাদের একই অংশ একই বস্তু সম্পর্কে একই সময়ে পরস্পরবিরোধি ধারণা পোষণ করতে পারে না?
হ্যাঁ, একথা আমরা বলেছি এবং একথা যথার্থ।
তাহলে আত্মার যে অংশ যুক্তির হিসাবকে অস্বিকার করছে, সেই একই অংশ যুক্তির হিসাবকে স্বিকার করতে পারে না?
না, তা পারে না।
কিন্তু আত্মার যে অংশ অঙ্কের পরিমাপ এবং হিসাবের উপর নির্ভর করে সে অংশই উত্তম এবং যে হিসাবকে অস্বিকার করে সে অংশ অধম?
অবশ্যই।
গ্লকন, আমি যখন বলেছিলাম, চিত্রশিল্পি কিংবা অপর শিল্পিদের সৃষ্টির অবস্থান সত্য থেকে বহু দূরে এবং এ সৃষ্টির আবেদন আমাদের সত্তার এমন উপাদানের নিকট যে যুক্তি থেকে ভ্রষ্ট এবং আমাদের সত্তার সঙ্গে যার যোগটি অসুস্থ-তখন এই সিদ্ধান্তের কথাই আমি ভাবছিলাম।
হ্যাঁ, আমাদের সত্তার সঙ্গে তার যোগটি সম্পূর্ণ অসুস্থ।
তাহলে আমরা বলতে পারি, প্রতিরূপ শিল্প হচ্ছে এমন একটি অধম চরিত্র যে আর একটি অধম চরিত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি অধম সন্তানের জন্ম দিয়েছে।
আমারও তা-ই বোধ হয়।
এবং একথা কি কেবল দৃশ্যশিল্পের ক্ষেত্রেই সত্য? একথা কি যে শিল্পের লক্ষ্য আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়-অর্থাৎ কাব্য তার ক্ষেত্রেও সত্য নয়?
হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় কাব্যের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
কিন্তু চিত্রশিল্প থেকে সম্ভাব্যতাকে গ্রহণ করে তার ওপর নির্ভর করা আমাদের উচিত হবে না। আমাদের দেখতে হবে আমাদের আত্মার কোন অংশের উপর নাট্যকারের আবেদন সর্বাধিক এবং তার প্রভাব আত্মার জন্য মঙ্গলকর কিংবা অমঙ্গলকর?
হ্যাঁ, আমাদের সেটি দেখা আবশ্যক।
তাহলে গ্লকন, এসো বিষয়টিকে আমরা এভাবে প্রকাশ করি: নাটক মানুষের ইচ্ছুক কিংবা অনিচ্ছুক, কর্মরত জীবনকে রূপায়িত করে। সেই কর্মে মানুষ যেরূপ মনে করে সেরূপ উত্তম কিংবা অধম বলে নিজেকে প্রকাশ করে এবং সে তার আনন্দ বা দুঃখকে ভোগ করে। কথাটি কি ঠিক বলা হলো?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, সক্রেটিস।
কিন্তু যে ব্যক্তিসত্তার মধ্যে অভিজ্ঞতার এত বৈচিত্র্য সে সত্তাকে কি আমরা সংঘাতহীন বলে গণ্য করতে পারি? আমরা দেখেছি, দৃশ্যজগতে পরস্পর বিরোধিতার উদ্ভব ঘটতে পারে। তাহলে কর্মের ক্ষেত্রেও অনুরূপ দ্ব›দ্ব এবং বিরোধিতার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? বস্তুত, প্রশ্নটি জিজ্ঞাসার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, আমরা একথা স্বিকার করেছি যে, আত্মার মধ্যে এরূপ দ্ব›েদ্বর অবকাশ আছে এবং একই সময়ে আত্মার মধ্যে দশ সহস্র পরস্পর-বিরোধি উপাদানের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
হ্যাঁ, আমরা সঠিকভাবেই একথা বলেছিলাম।
হ্যাঁ, আমরা ঠিকই বলেছিলাম। কিন্তু একটি বিষয়ের তখন উলে­খ করা হয়নি। সেটি এবার উলে­খ করা আবশ্যক।
সেটি কি?
আমরা কি একথা বলিনি যে, একজন উত্তম মানুষ যখন তার পুত্রসন্তান কিংবা অপর কোনো প্রিয়জনকে হারায়, তখন সে অপর সকলের চেয়ে অধিক অবিচলভাবে তার এই দুর্ভাগ্যকে বহন করতে সক্ষম?
হ্যাঁ, একথা আমরা বলেছিলাম।
কিন্তু এবার বিবেচনা করে বলো: তার কারণ কি? একি এই কারণে যে, সে কোনো দুঃখ বোধ করে না? তা যদি অসম্ভব হয়, তাহলে কারণ কি এই যে, সে তার দুঃখকে সহনিয় করে তোলে?
দ্বিতীয় কারণই সত্যের নিকটতর বলে বোধ হয়।
তাহলে বলো, শোকাচ্ছন্ন অবস্থায় তাকে অপর সকলে যখন দেখবে তখন কি সে তার শোকের প্রকাশকে অধিকতরভাবে বাধাদানের চেষ্টা করবে, কিংবা সে যখন একাকি থাকবে তখন নিজের শোককে অধিকতরভাবে প্রতিরোধ করবে?
সকলের মধ্যেই তার প্রতিরোধ ইচ্ছা অধিকতর হবে।
অর্থাৎ অপরের সম্মুখে যে আচরণে সে লজ্জিত হত, একাকি সে আচরণে বা সে বাক্য উচ্চারণে তার দ্বিধা হবে না?
হ্যাঁ, একথা সত্য।
কারণ দুঃখবোধ তাকে শোকের দিকে নিয়ে গেলেও তার নীতি এবং যুক্তি তার চরিত্রের নিকট সংযম দাবি করবে।
যথার্থ।
তাহলে একই সময়ে পরস্পরবিরোধি ইচ্ছার অস্তিত্বের অর্থ তার চরিত্রে দুটি ভিন্ন প্রকৃতির উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে।
অবশ্যই।
এ দুটি উপাদানের একটি হচ্ছে আইনের অনুগত এবং আচরণের সঙ্গত নীতিকে স্বিকারে আগ্রহি। এই উপাদান বলে-শোকে এবং দুর্ভাগ্যকে যতদূর সম্ভব আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে এবং তিক্ততা ব্যতিরেকে বহন করা উচিত। কারণ এ দুর্ভাগ্য ছদ্মআবরণে আমাদের জন্য আশির্বাদ স্বরূপও হতে পারে। তাছাড়া, ধৈর্যহীনতা আমাদের কোনো মঙ্গল সাধন করে না এবং মানুষের জীবনে মহামূল্যবান বলেও কিছু নেই এবং শোকাচ্ছন্নতা, যে সাহায্য আমাদের প্রয়োজন, সে সাহায্য লাভকেও অসম্ভব করে তোলে।
কি সাহায্য আমাদের প্রয়োজন?
আমাদের বুদ্ধি বা যুক্তির সাহায্য। যে বুদ্ধি দ্বারা আমরা ঘটনাকে বিচার করি এবং অনিবার্যতার মধ্যেও যে উদ্যোগ নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব, সেই উদ্যোগ গ্রহণে আমরা অক্ষম হয়ে পড়ি। অথচ, শিশুদের ন্যায়, যে আঘাত আমরা পেয়েছি তাকে চেপে ধরে ক্রন্দন করে সময়ক্ষেপণ করা আমাদের উচিত নয়। আঘাতকে নিরাময় করে শোককে দূর করা এবং যথাশিঘ্র ভ্রান্তি সংশোধনের শিক্ষায় আত্মাকে শিক্ষিত করে তোলা আমাদের কর্তব্য।
হ্যাঁ, দুর্ভাগ্যের ক্ষেত্রে এরূপ আচরণই আমাদের পক্ষে সঙ্গত আচরণ। এবং আমাদের সত্তার যে উত্তম অংশ সে এরূপ আচরণেই আগ্রহি?
অবশ্যই।
কিন্তু আমাদের সত্তার অপর যে অংশ আমাদের কোনো দুর্ভাগ্যকে বিস্মৃত হয় না এবং তা নিয়ে বিলাপেরও তার বিরাম নেই, তাকে আমরা অযৌক্তিক, অলস এবং কাপুরুষ বলে অভিহিত করতে পারি?
হ্যাঁ, তাকে আমরা এরূপই অভিহিত করব।
এবং আমাদের আত্মার এই অবাধ্য উপাদানই নাটকিয় প্রতিসৃষ্টির কাঁচামালের যোগান দেয়। কিন্তু যে কারোর পক্ষে আমাদের আত্মার যৌক্তিক এবং অবিচল প্রশান্ত অংশকে প্রতিসৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। কিন্তু কেউ যদি এভাবে প্রকাশ করে তবুও তাকে অনুধাবন করা, বিশেষ করে রঙ্গালয়ের সেই বিচিত্র দর্শকদের পক্ষে অনুধাবন করা বিশেষভাবে কঠিন। কারণ আত্মার এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
খুবই সত্য কথা।
নাট্যকাব্যের স্রষ্টা অর্থাৎ নাটকিয় কবি তাই স্বাভাবিকভাবে আত্মার এই উপাদানের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না। তার কৌশল দ্বারা আত্মার এই অংশকে সন্তুষ্ট করারও সে প্রয়াস পাবে না। কারণ, এমন প্রয়াস তার জন্য কোনো জনপ্রিয়তা বহন করে আনবে না। কাজেই সে তার নাটকের বিষয়কে অšে¦ষণ করবে আত্মার অস্থির এবং আঘাতপ্রবণ অংশের মধ্যে।
এ কথা স্পষ্ট।
তাহলে কবিকে আমরা সঙ্গতভাবেই চিত্রশিল্পির পার্শ্বেই স্থাপন করতে পারি। কবিও চিত্রশিল্পির সদৃশ। কারণ, তার সৃষ্টিরও সত্য মূল্য নগণ্য। তার আবেদনও আমাদের আত্মার অধম অংশেরই নিকট। এবং এ কারণে আমাদের সুশাসিত রাষ্ট্রে কবির প্রবেশ নিষিদ্ধ করলে আমরা সঠিক কাজই করব। কারণ, যুক্তির বিনিময়ে কবি আমাদের আত্মার অধম উপাদানগুলোকে উত্তেজিত করে তোলে। এগুলোকে সে উৎসাহিত এবং শক্তিশালি করে তোলে। আত্মার অধম অংশকে প্রবল করার অর্থ, রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং পরিচালনার ভার নিকৃষ্টতম চরিত্রের হাতে তুলে দেওয়া এবং রাষ্ট্রের উত্তম চরিত্রের ধ্বংস সাধন করা। নাট্যকাব্যের কবিও অযৌক্তিক অংশকে উৎসাহিত করে ব্যক্তির চরিত্রে অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি করে। কারণ, আত্মার অযৌক্তিক অংশ আকারের পার্থক্য অনুধাবনে অক্ষম। ক্ষুদ্র এবং বৃহতের পার্থক্য স্থির করতে সে বিভ্রান্ত হয়। কবি আত্মার এই অযৌক্তিক অংশকে উৎসাহিত করে এবং সত্য থেকে বহু দূরে অবস্থিত এর প্রতিরূপের সৃষ্টি করে।
আমি এক্ষেত্রে তোমার সঙ্গে একমত, সক্রেটিস।
কিন্তু কাব্যের বিরুদ্ধে এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ আছে। খুব উত্তম যে চরিত্র, তাকে কলুষিত করতেও এ কৌশলের ক্ষমতা মারাত্মক। এই মারাত্মক প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে খুব কম চরিত্রই।
এরূপ হলে, এর ক্ষমতা মারাত্মকই বটে।
তাই আমরা যখন হোমার কিংবা অপর কোনো বিষাদাত্মক কবির কাব্যে দেখি, কবি কোনো মহৎ নায়কের দুঃখকে বর্ণনা করতে যেয়ে সেই চরিত্রের মুখে শোকের বিলাপধ্বনি দুঃখের সকল ব্যঞ্জনা সহকারে স্থাপন করছেন, তখন তাঁর সে দক্ষ কৌশলে আমাদের মধ্যে যারা মহৎ তারা পর্যন্ত বিমোহিত হয়ে আবেগের বন্যায় ভেসে যাই। এবং আমাদের ওপর কবির এরূপ প্রভাবের দক্ষতায় কবির প্রশংসায় আমরা উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠি।
হ্যাঁ, এ আমাদের পরিচিত অভিজ্ঞতা।
অথচ আমাদের ব্যক্তিগত শোকে আমরা বিপরিত আচরণ করি। শোককে নিরবে বহন করার ক্ষমতায় আমরা গর্ব বোধ করি এবং নাট্যমঞ্চে যে আচরণকে আমরা প্রশংসা করেছি, ব্যক্তিগত জীবনে সেরূপ আচরণকে আমরা স্ত্রিজনোচিত বলে আখ্যায়িত করি।
হ্যাঁ, একথা সত্য।
তাহলে, যার সদৃশ হতে আমি নিজে লজ্জা বোধ করি, মঞ্চে তার আচরণকে প্রশংসা করা কি আমার পক্ষে সঙ্গত? এরূপ আচরণে ঘৃণার বদলে আনন্দ এবং বিমুগ্ধতা বোধ করা কি অযৌক্তিক নয়?
হ্যাঁ, এরূপ মনোভাব নিতান্তই অযৌক্তিক।
বিশেষ করে বিষয়টিকে যদি আমরা এভাবে দেখি।
কিভাবে?
যেমন ধরো, তুমি যদি মনে কর ব্যক্তিগত জীবনে শোকের যে প্রকাশ আমরা দমন করি, কবি মঞ্চে তাকে রূপায়িত করে আমাদের অশ্র“পাত এবং শোক প্রকাশের স্বভাবগত প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্ত করছে। কারণ, আমাদের চরিত্রের যেটি উত্তম অংশ সে অংশ নৈতিক এবং যৌক্তিক শিক্ষার অভাবে মঞ্চে রূপায়িত শোকের দৃশ্যে তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণকে এই অজুহাতে শিথিল করে দেয় যে, আমরা অপরের শোকের দৃশ্য দেখছি, নিজে শোকাহত হচ্ছিনে এবং এর শোকের প্রকাশটির মধ্যে যদিও আতিশয্য রয়েছে তবু তার প্রশংসায় কোনো ক্ষতি নেই। তাছাড়া শোক দেখে আমাদের চরিত্রের এই অংশ একটা আনন্দও বোধ করে। এ আনন্দকে সে লাভজনক বলে গণ্য করে এবং এর বিনিময়ে কবির সমগ্র সৃষ্টিটিকে নাকচ করে দিতে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কারণ, এ সত্য খুব কম লোকই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, অপরের প্রতি আমাদের মনোভাব আমাদের নিজেদেরও অনিবার্যরূপে প্রভাবিত করে। এবং অপরের শোকের প্রকাশে আবেগে আপ্লুত হলে আমাদের নিজেদের শোকের আবেগকে দমন করাও আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।
একথা খুবই যথার্থ।
হাস্যধ্বনির ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। কারণ, যে পরিহাস প্রকাশে তুমি নিজে লজ্জা বোধ কর, অপরের ক্ষেত্রে মঞ্চে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে সেই পরিহাসের স্থূলতাকে ঘৃণা না করে তাতে আনন্দবোধ করার প্রভাব তোমার চরিত্রের ক্ষেত্রে একই। কারণ, তোমার যে পরিহাস-প্রবৃত্তি নিজে নির্বোধ বলে প্রতিপন্ন হওয়ার আশংকায় দমিত ছিল, সেই পরিহাস-প্রবৃত্তিকে তুমি বল্গাহীন করে দিচ্ছ। ফলে মঞ্চের কুরুচি অচেতনভাবে তোমার মধ্যে সংক্রমিত হয়ে তোমাকে হাস্যাস্পদ জীবে পর্যবসিত করে দেবে।
হ্যাঁ, এ আশংকা অমূলক নয়।
কাব্য যখন দেহের লালসায় এবং ক্রোধের আবেগে এবং আমাদের কর্মের সঙ্গে জড়িত সুখ এবং দুঃখের কামনা ও বোধে পূর্ণ থাকে তখন আমাদের চরিত্রের উপর কাব্যের প্রভাবও একই। এই সকল প্রবৃত্তিকে যখন অভুক্ত রাখা আবশ্যক, তখন কাব্য এগুলোকে উৎসাহিত করে তোলে এবং যখন আমাদের মঙ্গল এবং সুখের স্বার্থে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক, তখন এই প্রবৃত্তিই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
হ্যাঁ, তোমার একথা অস্বিকার করার উপায় নেই।
তাহলে গ্লকন, তুমি যদি এমন লোকের সাক্ষাৎ পাও যারা গ্রিসের শিক্ষাদাতা হিসেবে হোমারের প্রশংসা করে এবং বলে যে, আমাদের রাষ্ট্রিয় এবং শিক্ষার বিষয়ে হোমারকে আমাদের অধ্যয়ন করা আবশ্যক এবং তাঁর নির্দেশের ভিত্তিতে আমাদের জীবনকে গঠিত করা উচিত, তাহলে তাদের সিমাবদ্ধ জ্ঞানের মধ্যে তুমি তাদের সৎ মানুষ বলে বিবেচনা করতে পার এবং তাদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে বলতে পার, হোমার কবিদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বিষাদাত্মক নাট্যকারের পথিকৃৎ। কিন্তু এ বিষয়েও তোমার খেয়াল রাখা আবশ্যক যে, রাষ্ট্রে যদি তুমি কোনো কাব্যকলাকে অনুমোদিত কর, তবে তা অবশ্যই দেবতা এবং উত্তম মানুষের প্রশংসায় রচিত স্তোত্র ব্যতিত অপর কিছু হতে পারবে না। কারণ, একবার যদি তুমি এই সিমানাকে অতিক্রম কর এবং সুমিষ্ট গীতিকবিতা বা মহাকাব্যকে অর্গলমুক্ত করে দাও তাহলে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত নীতি এবং বিধানের বদলে আনন্দ এবং বেদনাই তোমার আত্মার শাসক হয়ে দাঁড়াবে।
তুমি যথার্থ বলেছ, সক্রেটিস।
তাই আমাদের রাষ্ট্র থেকে কাব্যকে নির্বাসিত করার অভিযোগের যদি জবাব দিতে হয় তাহলে আমরা বলবো: এ নির্বাসনের দাবি যুক্তির দাবি। কিন্তু যদি বলা হয় যে, কাব্য বাদে আমরা অচেতন এবং বর্বরে পরিণত হয়ে যাব, তবে আমাদের জবাব হবে: দর্শনের সঙ্গে কাব্যের বিরোধ একটি পুরাতন বিরোধ। এই প্রাচিন বিরোধের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ‘জন্তুটি প্রভুর দিকে মুখব্যাদান করল’ ‘শূন্যমস্তিষ্ক নির্বোধের মধ্যে সে সম্মানের পাত্র’ অথবা ‘বুদ্ধিতে অতিশয় স্ফিত মস্তিষ্কওয়ালাদের দল’ এবং ‘বুদ্ধিতে ভারি বটে কিন্তু সম্পদে সর্বহারা ভিক্ষুক’ ইত্যাকার উক্তি আমাদের অপরিচিত নয়। কিন্তু তবু কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে, একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে তৃপ্তির জন্য রচিত নাটক এবং কবিতা মঙ্গলকর, তাহলে আমরা আনন্দের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রে তাদের সংবর্ধনা জানাব। কারণ এদের প্রতি মানুষের আকর্ষণকে আমরা ভালোভাবেই জানি। কিন্তু তাই বলে যাকে আমরা সত্য বলে জানি তাকে কোনো কারণে পরিত্যাগ করা আমাদের চরিত্রের সততার সাক্ষ্য বহন করবে না। আমি জানি, গ্লকন, তোমার মধ্যেও কাব্যের আকর্ষণ, বিশেষ করে হোমারের কাব্যের আকর্ষণ কম নয়। ঠিক নয় কি?
তুমি ঠিকই বলেছ, কাব্যের প্রতি আমার মধ্যেও আকর্ষণ রয়ে গেছে।
তাহলে সঙ্গতভাবে আমরা বলতে পারি, কাব্য যদি গীতিকাব্য কিংবা ভিন্নতর ছন্দের যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় তবে তার প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দানেও আমাদের আপত্তি হবে না।
হ্যাঁ, একথা ঠিক।
কাব্যের পক্ষে কৌসুলি নিয়োগের যদি আবশ্যক হয় তাহলে আমরা এমন কাউকে নিযুক্ত করবো, যে নিজে কবি নয় কিন্তু কাব্যকে যে ভালোবাসে। কাব্যের পক্ষে সে গদ্যে যুক্তি প্রদর্শন করবে এবং তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কাব্যদেবি কেবল আমাদের মধ্যে উপভোগের প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে না, সে মানুষের জীবন এবং রাষ্ট্রের জন্য স্থায়ি মঙ্গলও বহন করে নিয়ে আসে। এমন যুক্তিকে আমরা স্বাগত জানাবো। কারণ, কাব্য যদি আমাদের আনন্দ এবং উপকার-উভয়েরই উৎস হয় তাহলে তার কাছ থেকে আমাদের লাভ ব্যতিত লোকসানের কোনো আশংকা থাকবে না।
হ্যাঁ, তেমন হলে কাব্য থেকে আমরা অবশ্যই লাভবান হবো।
কিন্তু কৌসুলি যদি তার দাবিকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রেমিক যেমন যতোই কষ্ট হোক-না কেন তার অপদার্থ প্রেমাস্পদ বা প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে, তেমনি আমরাও প্রেমিককে অনুসরণ করে কাব্যকে পরিত্যাগ করবো। যেভাবে আমরা বর্ধিত হয়েছি তাতে কাব্যকে ভালোবাসতে আমরা বাধ্য। এবং কাব্য যদি আমাদের মঙ্গলের উৎস বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে আমরা যথার্থই আনন্দিত হবো। কিন্তু এই চরিত্রের প্রমাণ যদি আমরা না-পাই, তাহলে সাধারণ মানুষের উপর তার যে দুরারোধ্য প্রভাব, তার মোহে আমরাও যেন আবদ্ধ না-হই-তার জন্য মন্ত্রপাঠের ন্যায় এই যুক্তিকে কাব্যের প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজেদের কাছেই আমরা আবৃত্তি করতে থাকবো। আমাদের মূল কথাটি হবে: এরূপ কাব্যের কোনো যাথার্থ্য কিংবা সত্যমূল্য নেই। অপর মানুষকেও আমরা তাদের চরিত্রের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে সতর্ক করে দেবো এবং তাদের বলবো তারা যেন কাব্য সম্পর্কে আমাদের এই নীতিকেই গ্রহণ করে।
আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, সক্রেটিস।

 

অনুবাদ: সরদার ফজলুল করিম
শেয়ার করুন: