004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং মধ্যবিত্ত

বার্লিনের এক ব্যাংকারে আধপোড়া একটি মৃতদেহ হয়ে পরে রইলেন অ্যাডলফ হিটলার, তারিখ ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৫। তার আগে পার্টিজানরা মিলানের রাস্তায় চিনতে পেরে যায় ছদ্মবেশে থাকা বেনিতো মুসোলিনিকে; আর তারপর তাকে তার উত্থানভ‚মি মিলানের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেয়। এতোটাই ঘৃণা মৃতদেহটা নামাতেও আসেনি ইতালির কোনো মানুষ। মৃত্যুর তারিখ ২৮ এপ্রিল।
মাঝখানে সাতটা দশক। চাইলে ভুলে যেতেই পারতো পৃথিবী। কিন্তু পৃথিবী ভোলেনি, ভুলতে পারেনি। এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের নাম ফ্যাসিবাদ।
বেনিতো মুসোলিনির ইতালি (১৯২২-১৯৪৫) আর অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি (১৯৩৪-১৯৪৫)-দুটিই প্রধান স্থায়ী ফ্যাসিবাদী জামানা। কিন্তু সমসাময়িক ইউরোপে অনুরূপ মতাদর্শে পরিচালিত অস্থায়ী সরকার আরো কয়েকটি ছিলো এবং দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপের প্রায় সব ক’টি দেশেই ফ্যাসিবাদী পার্টি গড়ে ওঠে। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এবং ইতালির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের ফ্যাসিবাদী জামানার অবসান ঘটে এবং অন্য দেশগুলো থেকেও ফ্যাসিবাদী পার্টিগুলো বিলীন হয়। কিন্তু যে বীভৎসতা এবং মৃত্যুলীলা ফ্যাসিবাদ পৃথিবীর বুকে রেখে যায়, তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী। প্রায় ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়, এর মধ্যে ৪ কোটি মানুষই যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন অসামরিক মানুষ। যারা মারা যায় তার প্রায় অর্ধেকই সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি চার জন নাগরিকের মধ্যে একজন হয় নিহত অথবা আহত হন। ইহুদীদের দৈহিকভাবে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টা হয়। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো দেখার আগে সভ্যতার জানা ছিলো না একদল মানুষ আর একদল মানুষের প্রতি এতোটা অমানবিক, হিংস্র হতে পারে। এ যেন এক গণ-মানসিক বিকৃতি, যার উৎস এক বিকৃত রাজনীতি। ফ্যাসিবাদ এমন এক রাজনীতি, এমন এক মতাদর্শ, এমন এক বিশ্বাস যা মানুষকে হিংস্র অমানুষে পরিণত করে। ফ্যাসিবাদ সভ্যতার দুঃস্বপ্ন। কাজেই গত সময়টা ধরে এই প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে-ফ্যাসিবাদ কি আবার ফিরে আসতে পারে?
ফ্যাসিবাদের পুনঃআবির্ভাবের সম্ভাবনা বারবারই পৃথিবীর সামনে এসে হাজির হয়েছে। ইউরোপের রাস্তা আবার দেখেছে নয়া নাজিদের পদচারণা। ফ্যাসিস্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরম দক্ষিণপন্থী সরকার ইউরোপ দেখেছে। এবং নির্দিষ্টভাবে ফ্যাসিস্ত গুণাবলীসম্পন্ন সরকার এশিয়া-লাতিন আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অস্ট্রিয়ার জর্জ হাইডার, ফ্রান্সের লে পেন বা গ্রীসের ডিক্টেটার পাপাদোপৌলাস এ প্রসঙ্গে কতগুলো প্রাসঙ্গিক নাম। খোদ জার্মানি বা বিশেষ করে ইতালির চরম দক্ষিপন্থীরা প্রকাশ্যেই ফ্যাসিবাদের প্রতি সহানুভ‚তিসম্পন্ন। নিঃসন্দেহে এরা কেউই হিটলার বা মুসোলিনি নন। তবে দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী সকলকেই ফ্যাসিবাদী বলে দেওয়াটার একটা রাজনৈতিক চলও তৈরি হয়েছে, যা আবার সঠিক নয়। প্রতিপক্ষকে ফ্যাসিবাদী বলে গাল দেওয়াটা একটা পরিচিত রাজনৈতিক কৌশলও বটে।
তবে এই সব কিছুকে অতিক্রম করে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়-ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে পারে কি-না? এবং বিগত সাত দশকের ইতিহাস বলছে-সম্ভব এবং তা ভীষণভাবেই সম্ভব। একদল ইতিহাসবিদ এবং বিশ্লেষক ফ্যাসিবাদকে একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন গোটা বিষয়টিকে মুসোলিনি এবং হিটলারকেন্দ্রীক করে দেখাতে। কিন্তু ইতিহাসে ব্যক্তির প্রভাব অস্বীকার না করেও বলা যায়-এই বিশ্লেষণ ভ্রান্ত। কোনো রাজনৈতিক ঘটনারই ইতিহাস এবং শ্রেণি নিরপেক্ষ বিচার হয় না। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকেই এক কথায় দুর্ঘটনা বলে দেওয়া যায় না। প্রতিটি ঘটনার পেছনেই কতগুলো ঐতিহাসিক কার্যকারণ থাকে। আর সমাজে ক্রিয়াশীল শ্রেণিগুলোর সংঘাত এবং অবস্থানের প্রতিফলন ঘটে যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে; ফ্যাসিবাদও এই প্রশ্নে ব্যতিক্রম না। ইতিহাসের কার্যকারণ এবং শ্রেণিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক যা ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিলো-সেই পারস্পরিক সম্পর্কের পুনরাবৃত্তি যেহেতু সম্ভব, সেহেতু ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সতর্কতা প্রয়োজন।
তৃতীয় আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছিলো এই বলে-‘ফ্যাসিবাদ হলো ফিন্যান্স পুঁজির সব চাইতে প্রতিক্রিয়াশীল, সব চাইতে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অংশের সর্বাধিক প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।’
ফ্যাসিবাদের এটিই সংক্ষিপ্ততম এবং সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যায় ফ্যাসিবাদের দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে-এক, সে ফিন্যান্স পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী, দুই, কিন্তু সে ‘সব চাইতে প্রতিক্রিয়াশীল, সব চাইতে উগ্র জাতীয়তাবাদী… সর্বাধিক প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।’
অনেকেই সংজ্ঞার এই দুটি অংশের মধ্যেকার গতিশীল সম্পর্কটিকে বিবেচনায় না রেখে অতিসরলীকৃত কতগুলো ধারণায় পৌঁছান। শ্রেণিভিত্তিটি বাদ দিয়ে কেবল ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে সিদ্ধান্ত করতে গেলে, যেকোনো সহিংস দক্ষিণপন্থাকেই ফ্যাসিবাদ বলে ভ্রম হবে। আন্তর্জাতিক মৌলবাদকে ‘ফ্যাসিস্ত’ আখ্যা দিয়ে এই ভুলটি করছেন অনেক পশ্চিমী পÐিত। আর এক অংশ যান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিয়ে কেবল শ্রেণিভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদ এবং ফিন্যান্স পুঁজির মধ্যে একটি সরল সম্পর্ক স্থাপন করে ফ্যাসিবাদের বিশেষ কুৎসিত রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয়। এরকম একটি ‘যান্ত্রিক মার্কসবাদী’ ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে ঐতিহাসিক এরিক হবসবম সঠিকভাবে প্রশ্ন করেছেন- ‘হিটলার ফিন্যান্স পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করে, রুজভেল্ট বা চার্চিল করে না?’
ফ্যাসিস্তরা কোনো বিপ্লব করেননি, ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদকেই রক্ষা করেছে, তাকে প্রসারিত করেছে। শ্রেণি শাসনের চরিত্রকে অক্ষুণœ রেখেই ফ্যাসিবাদ সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য।
ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ কিভাবে ঘটে তার একটি বাস্তবধর্মী বিবরণ দিয়েছেন, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ইয়ান কারশ, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কারশর এই বর্ণনা অধিকাংশ বামপন্থী বিশ্লেষকই গ্রহণ করেন। কারশর তালিকাটি এরকম-
ক্স তীব্র সংকীর্ণ (ঈযধাঁরহরংঃরপ) জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, যা প্রকাশ্যেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের (বীঢ়ধহংরড়হরংঃ) পক্ষে ওকালতি করে।
ক্স সমাজতন্ত্র-বিরোধী, মার্কসবাদরিরোধী-অন্যতম প্রধান লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণির সংগঠন এবং তাদের মার্কসবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
ক্স একটি গণ-পার্টি তৈরি করে সমাজের সব অংশের সমর্থন নিয়ে। কিন্তু এদের প্রধান সমর্থন আসে মধ্যবিত্তদের দিক থেকে। কৃষকদের একটা অংশকেই আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এছাড়া সমাজের নানা মূল্যহীন, অস্থায়ী, অনিশ্চিত চরিত্রের মানুষজনকে সংগঠিত করতে পারে।
ক্স একজন নেতাকে মহত্ব দিয়ে, প্রচার দিয়ে, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
ক্স কোনো বিরোধী বা সম্ভাব্য বিরোধীদের অস্তিত্বটুকুও সহ্য করতে তীব্র অনীহা। এবং এই অনীহার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তীব্র সন্ত্রাস, প্রকাশ্য হিংসা এবং নির্দয় নিষ্পেষণের মাধ্যমে।
ক্স যুদ্ধ এবং সমস্ত সামরিক বিষয়কে মহত্ব দেবার চেষ্টা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী তীব্র সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের একমাত্র পথ হিসাবে যুদ্ধের পক্ষে ওকালতি করে।
ক্স সমাজের অভিজাত, শিল্প ও কৃষি মালিক, সামরিক এবং আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বের সাথে জোট তৈরি করে ক্ষমতায় আসে।
ক্স এবং শুরুতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী জনপ্রিয় বিপ্লবী বক্তৃতা দিলেও ক্ষমতায় এসে পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের একনিষ্ঠ সেবক হিসাবেই কাজ করে। মূল শ্রেণি লক্ষ্য অভিন্ন হলেও এই বৈশিষ্ট্যগুলোও আর পাঁচটা বুর্জোয়া শাসনের থেকে ফ্যাসিবাদীদের আলাদা করে দেয়।
ফ্যাসিস্তরা একটি গণ-পার্টি তৈরি করে। যার হাতিয়ার হিংস্র গণ-জমায়েত। অবলীলাক্রমে এবং হাসিমুখে কোটি মানুষ খুন করতে যে গণ-মানসিক বিকৃতি লাগে সেটি তৈরি করতে পারাটাই ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
এই কাজটি করতে গেলে হাতে গোনা কয়েকজন ফিন্যান্স পুঁজির অনুগত ব্যক্তি হলে হয় না। একটা বড় সংখ্যক অন্য মানুষও লাগে। কোরশ নির্দিষ্ট ভাবে (এবং ডান বাম সব বিশেষজ্ঞই) বলেছেন ফ্যাসিবাদের প্রধান সমর্থনের ভিত্তিটি আসে মধ্যবিত্তদের থেকে। ফ্যাসিবাদের বিকাশের প্রশ্নে এই মধ্যবিত্ত বা নির্দিষ্ট আরো শ্রেণি সংজ্ঞার পেটি বুর্জোয়াদের ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। (যদিও পেটি বুর্জোয়া মানেই মধ্যবিত্ত না, কিন্তু এই আলোচনার প্রয়োজনে এক অর্থে দুটিকে ব্যবহার করা যায়।)
কি ইতালি, কি জার্মানি ফ্যাসিস্তদের প্রথম লক্ষ্য অবশ্যই ছিলো শ্রমিকদের তাদের পক্ষে নিয়ে আসা, কারণ যারা জাতীয় ‘সমাজতন্ত্র’-র জন্য লড়ছে, তাদের শ্রমিকশ্রেণিকে সঙ্গে প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তারা খুব একটা সফল হয়নি। যে রকম ইতালির শিল্পশহর জেনেয়ায় শুরুতে ফ্যাসিস্তরা বেশকিছু শ্রমিককে সংগঠিত করে। কিন্তু ১৯২০ সালে ধর্মঘটের বিরোধিতা করে এরা শ্রমিকদের থেকে চ‚ড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। ১৯২০-২১ সালে ফ্যাসিস্ত পার্টি (পিএনএফ)-এর মোট সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশকে দেখানো হয় শ্রমিক এবং কৃষক, কিন্তু আসল হিসেবে এটা ১৫-২০% এর মতো ছিলো। মিলানের মতো সর্ববৃহৎ শ্রমিক অঞ্চলে ফ্যাসিস্তদের মোট সদস্যর মাত্র ১০-১২% ছিলো শ্রমিক।
১৯৩৩ সালে জার্মানির মোট জনসংখ্যার ৪৬.৩% ছিলো শ্রমিক, কিন্তু নাজিদের মোট সদস্যদের মধ্যে মাত্র ২৯.৭% তাদের নাম লিখিয়েছিলো শ্রমিক হিসেবে। আসল শ্রমিক এর থেকেও কম ছিলো। আর ১৯৩১ সালে দেখা যাচ্ছে নাজিদের সদস্যদের মাত্র ৫% তাদের শ্রমিক সংগঠন এনএসবিও’র (ঘধঃরড়হধষ ঝড়পরধষরংঃ ঋধপঃড়ৎু ঙৎমধহরংধঃরড়হ) সদস্য। জার্মানির জনসংখ্যার ২০.৭% ছিলো কৃষক, কিন্তু নাজি সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৯% ছিলো কৃষক। নাজিদের নেতা, কেবল হিটলার না, বোরম্যান, ফেডের, ফ্রিক, হিমলার, রোহম, রোজেনবার্গরাও এসেছিলো মধ্যবিত্তদের থেকে, গোয়েরিং-এর মতো শিল্পপতি খুব কমই ছিলো।
যে কোনো দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী পার্টি থেকে ফ্যাসিবাদের বাইরের চেহারার অন্যতম প্রধান পার্থক্য তার গণ-জমায়েতের ক্ষমতা এবং তার হিংসার সংগঠনে। এই গণ-জমায়েত করার বড় ক্ষমতাই দেয় ফ্যাসিবাদ অনুগত পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি। ফ্যাসিবাদ ফিন্যান্স পুঁজির স্বার্থই রক্ষা করে, মধ্যবিত্তের করে না, কিন্তু তাকে ফ্যাসিবাদের চেহারা দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা নেয় মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া এই অংশ।
কিন্তু কেনো পেটি বুর্জোয়া এই কাজ করে এই আলোচনার ঢোকার আগে বিংশ শতাব্দীতে পেটি বুর্জোয়া আসলে কারা এ বিষয়টিতে দৃষ্টিপাত করা উচিত। এক্ষেত্রে আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক এবং সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য গ্রামীণ পেটি বুর্জোয়াদের এই মুহ‚র্তে আমরা বিবেচনায় রাখছি না। মার্কস, এঙ্গেলস এমনকি লেনিনও পেটি বুর্জোয়া বলতে প্রধানত বলেছেন ছোটো উৎপাদনকারী এবং ছোটো ব্যবসায়ীদের। এই ছোটো উৎপাদনকারীদের বড় একটা অংশ নিজে উৎপাদন উপকরণের মালিক হলেও নিজের এবং নিজের পরিবারের শ্রমে উৎপাদন করে। কখনও কখনও শ্রমিক নিয়োগ করলেও এদের আয়ের প্রধান অংশ অন্যকে শোষণ করে আসে না। ছোটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও প্রধানত ক্রয় ও বিক্রয়ের দামের ফারাক থেকে আয় করে-উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করার সুযোগ সে পায় না। এই পেটি বুর্জোয়ার অস্তিত্ব অনেকটাই নির্ভর করে বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপস্থিতির ওপর। পুঁজিবাদের বিকাশ যতো হতে থাকে সমাজে এই অংশ ততো ক্ষীণ ও দুর্বল হতে থাকে। লেনিন এই অংশকে এর জন্য বলেছেন ‘অতিক্রান্তিকালীন শ্রেণি’ (ঃৎধহংরঃরড়হধষ পষধংং)।
কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ আর একটি নতুন অংশের সৃষ্টি ও বিস্তার ঘটায়-তাদেরও পেটি বুর্জোয়া বলা হয়। এরা হলো প্রধানত উৎপাদনের সাথে সরাসরি যুক্ত নয় এরকম মাইনে করা কর্মচারী (হড়হ-ঢ়ৎড়ফঁপঃরাব ংধষধৎরবফ বসঢ়ষড়ুবৎং)। এরা অন্য বিচারে আসলে উৎপাদনের সাথে সরাসরি সম্পর্কহীন শ্রমিক কি-না এই বিতর্কটি আমার এখানে পরিহার করছি। এই অংশটি আরো সমৃদ্ধ হয়-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা অন্য অনুরূপ সংগঠনের কর্মচারী এবং সরকারী কর্মচারীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যার দ্বারা। এই সরকারী কর্মচারীরা যেহেতু সরকারের হয়ে কাজ করে তাই কোনো উৎপাদন বা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিতে এরা কোনোভাবেই যুক্ত থাকে না। একটি উৎপাদন কাঠামোতে সম্পূর্ণ পৃথক ভ‚মিকা পালন করে নির্দিষ্ট দুটি আলাদা অংশকে ‘পেটি বুর্জোয়া’ বলে অভিহিত করা হয় কেনো? কারণ অর্থনৈতিক ভ‚মিকা আলাদা হলেও এই দুই অংশ রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত প্রশ্নে একই ভ‚মিকা নেয় সচরাচর।
আর এটাও বলা বাহুল্য, পুঁজিবাদী কাঠামোতে বুর্জোয়া এবং সর্বহারা প্রধান বিবদমান দুটি শ্রেণির মতাদর্শ থাকে অনেক সংঘবদ্ধ এবং নির্দিষ্ট যে সংঘবদ্ধতা কখনও পেটি বুর্জোয়া মতাদর্শের থাকে না। ফলত পৃথিবীর কোনো দেশেই গোটা পেটি বুর্জোয়ার প্রতিনিধিত্ব কোনো একটি পার্টি করে না; পেটি বুর্জোয়া বিভক্ত হয় অনেকগুলো পার্টির মধ্যে।
পেটি বুর্জোয়ার সবসময়ই আকাক্সক্ষা থাকে বুর্জোয়া হবার-ফলত তার স্বাভাবিক মতাদর্শ কিছুটা বুর্জোয়া মতাদর্শগামী, আবার অন্যদিক থেকে সে প্রতিনিয়ত এই বুর্জোয়াদের দ্বারা শোষিত হয়, কাজেই শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন তীব্র হলে সে সেই আন্দোলনের পক্ষে ঝুঁকে পরে। কিন্তু সে নিজেও সর্বহারায় রূপান্তরিত হতে পারে এই বাস্তব আশংকার সামনে দাঁড়িয়ে যথাসাধ্য শ্রমিকশ্রেণির থেকে দূরে থাকতে চায়। ফলত অদ্ভুত রাজনৈতিক চরিত্র পেটি বুর্জোয়ার মধ্যে দেখা যায়।
১. ‘পুঁজিবাদ-বিরোধী স্থিতাবস্থার‘ পক্ষে ছোটো উৎপাদনকারী, সে বড় পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সে সর্বহারার পর্যায়ে নামতে চায় না, সে এর জন্য ‘সংবিধান’ বর্ণিত ‘সমান অধিকার’, ‘সমান সুযোগের’ পক্ষে। কর্মচারীদের অংশটিও প্রতিনিয়ত চায় তার সাথে বড় মালিকের ফারাক যেনো না বাড়ে। সে মালিকদের উপর বাড়তি করের পক্ষে। যাতে সেই করের টাকা তার সামগ্রিক ‘উন্নয়নে কাজে লাগে। সে আয়ের সমতা চায়। কিন্তু সমাজ বিপ্লবের মতো একটা ওলোট পালোট সে চায় না; তার ভয় এতে তার নিরাপদ মায়না এবং সমাজে নিরাপদ অবস্থান বিঘিœত হবে।
২. পেটি বুর্জোয়া বিপ্লব চায় না, সে চায় ধাপে ধাপে অর্থনীতিতে উপরে উঠতে। তার কাছে সমাজের অগ্রগতির পথটি সিঁড়ির মতো। সে ধাপে ধাপে বুর্জোয়া হতে চায়। এবং এই অগ্রগতিটি একক, তথাকথিত ব্যক্তিগত ‘যোগ্যতা’র ভিত্তিতে। এর জন্য সে সমাজে অভিজাত (ঊষরঃব)দের টিকে থাকা চায়, চায় পুরানো এলিটদের জায়গা ভবিষ্যতে সে নিজে নেবে।
৩. উপরে বুর্জোয়া এবং নিচে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে পেটি বুর্জোয়া সবসময় আশংকায় থাকে। সে সবসময় প্রত্যাশা করে রাষ্ট্র তাকে রক্ষা করবে। এরজন্য তারা শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে। পেটি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সাথে নিজেকে অংগীভ‚ত করতে চায়। আর সরকারী বা অনুরূপ সংস্থায় কর্মচারীদের বড় অংশই রাষ্ট্রের নিজস্ব মতাদর্শের অংশীদার থাকে, লেনিন এককথায় পেটি বুর্জোয়া এই রাষ্ট্রমুখীনতাকে বলেছেন চড়বিৎ ভবঃরংযরংস।
পেটি বুর্জোয়ার এই প্রতিটি রাজনৈতিক প্রবণতাকে পুষ্ঠ করে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদের উত্থান পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মৌখিক যুদ্ধ ঘোষণা করেই, যদিও শেষ বিচারে সে এই পুঁজিবাদকেই শক্তিশালী করেছিলো।
ফ্যাসিবাদ কোথাও বিপ্লব করে ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু পুরানো এলিটদের ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন একদল এলিট অংশ সৃষ্টি তারা করেছিলো। (একথা বিশেষভাবে জার্মানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।) যারা আসলে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র দৈনন্দিন পরিচালনা করতো, এদের একটা বড় অংশ এসেছিলো উচ্চাকাক্সক্ষী মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে মধ্যবিত্তকে আকৃষ্ট করেছিলো শক্তিশালী নেতা, শক্তিশালী জাতি, শক্তিশালী রাষ্ট্রের শ্লোগান দিয়ে। ফ্যাসিবাদ সে প্রশ্নে মধ্যবিত্তের চড়বিৎ ভবঃরংযরংস উগ্রতম রূপ।
তবে এক্ষেত্রেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। যে কোনো পুঁজিবাদী দেশেই পেটি বুর্জোয়ার চরিত্র অল্পবিস্তর ফারাকসহ অভিন্ন। ইউরোপের প্রতিটি দেশেই ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ফ্যাসিবাদ সফল হয়েছিলো কেবল দুটি দেশে। ইতালি এবং জার্মানিতেই পেটি বুর্জোয়ার উল্লেখযোগ্য সমর্থন ফ্যাসিস্তরা অর্জন করতে পেরেছিলো। কাজেই সেই দেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঘটনাগুলোও এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দেশ ও কালের বৈশিষ্ট্যগুলোর অনুধাবন পেটি বুর্জোয়ার চিরায়ত চরিত্রের বিশ্লেষণের থেকেও এক্ষেত্রে জরুরী।
যে দুটি দেশে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় এসেছিলো-ইতালি এবং জার্মানি, দুটি দেশেই পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের অন্য দেশগুলোর থেকে অনেক পরে। জার্মানিতে পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক শক্তিতে বিপুল শক্তি অর্জন করলেও সংকটের সামনে পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামো ধরে রাখতে বার বার সে ব্যর্থ হচ্ছিলো। আর ইতালিতে প্রায় আধা পুঁজিবাদ আধা সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা বিরাজ করছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের সংকটের সামনে তাদের উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পরেছিলো।
ইতালি এবং জার্মানি দুটি দেশেই ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমতায় আসার পটভ‚মিকা হিসাবে কাজ করেছে দুটি ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকট। এবং পরিস্থিতির বিস্ময়জনক মিল হলো-দুটি দেশেই সংকট এরকম পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো যে সমাজবিপ্লব আসন্ন। এবং দুটি দেশেই আলাদা আলাদা কারণে শ্রমিকশ্রেণি এবং তাদের পার্টি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি। এর পরে প্রতিবিপ্লবের পালা, পুঁজিপতিদের প্রত্যাঘাত, দুটি দেশে ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখল।
ইউরোপ জুড়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নেমে আসে ভয়ংকর আর্থিক সংকট। ইতালির বুকে সেই সংকটও বাড়তি তীব্রতা নিয়ে হাজির হয়েছিলো। যুদ্ধের সময় বিপুল সরকারী খরচ শিল্পকে চাঙ্গা রেখেছিলো, বাড়িয়েছিলো কর্মসংস্থান। যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র এই গোলাপী চিত্র মুখ থুবড়ে পড়লো। ফল কর্মহীনতা, এর সাথে সৈনীবাহিনী থেকে কাজ হারালো কয়েক লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে যুদ্ধের এক বছরের মধ্যে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ২০ লক্ষ। রপ্তানি কমলো অনেকটা, কিন্তু আমদানি কমলো না। লিরার দাম কমলো অকল্পনীয় গতিতে। মুদ্রাস্ফীতি চার গুণ।
এই আর্থিক বিপর্যয়ে ফল হলো ‘বিন্নিও রোসসো’ (ইরবহহরড় জড়ংংড়), বাংলায় যার অর্থ ‘দুটি লাল বছর’। ১৮৯৮-১৯২০। তুরিনে সশস্ত্র শ্রমিকরা কারখানা দখল করে নেয় সোভিয়েতের অনুকরণে। কারখানাভিত্তিক শ্রমিক কাউন্সিল গঠন করে কারখানা চালাতে শুরু করে। ১৯২০-র সেপ্টেম্বরে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে মালিকদের লক-আউট ঘোষণার প্রতিবাদে ৫ লক্ষ শ্রমিক তাদের কারখানাগুলো দখল করে নেয়। সব মিলিয়ে ইতালি জুড়ে প্রতিবাদী মানুষের আন্দোলনের এক বিস্ফোরণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার নেতৃত্বে ইতালির সমাজতান্ত্রিক পার্টি (পিএসআই) সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি তো ছিলোই-সমাজের অন্য অংশের মধ্যে দ্রæততার সাথে ছড়ালো সমাজতান্ত্রিক পার্টি। বিশেষত শহুরে পেটি বুর্জোয়ার একটি অংশ এবং গ্রামীণ ক্ষেতমজুরদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক পার্টির বিস্তার ঘটলো। ফলত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নির্বাচনে শিল্পশহর এবং উত্তর ও মধ্য ইতালির গ্রামীণ জেলাগুলোতেও জয়ী হয় পিএসআই। ক্ষেতমজুরদের বিপুল সংগঠন ইতালির গ্রামাঞ্চলে শ্রেণি ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। শহর এবং গ্রামে ক্ষমতাশীল অংশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামসির ভাষায় ইতালি আর একটি বলশেভিক বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
ক্ষমতা দখল করার চ‚ড়ান্ত পরিকল্পনা এবং আহŸান জানাতে ব্যর্থ হয় সমাজতান্ত্রিক পার্টি। কুখ্যাত হয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক পার্টির মুখপত্র ‘অবন্তি’র একটি শিরোনাম-‘আমরা এখন কেবল অপেক্ষা করতে পারি।’
আসলে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের ইউরোপ আলোড়িত হয়েছে তিনটি ঘটনা নিয়ে-এক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ; দুই, রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব; তিন, ১৯২৯-৩২’এর ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকট। এই তিনটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণিগুলোর অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। এই তিনটি ঘটনার প্রভাবে তিন ধরনের রাজনৈতিক প্রবণতা এবং সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়-এক, মার্কসবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র, দুই, সোস্যাল ডেমোক্রাটে এবং পুঁজিবাদের জোটের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র, তিন, ফ্যাসিবাদ। মধ্যবিত্ত প্রতিক্রিয়ায় উত্থানের সময় অন্তত এই দুটি দেশে তৃতীয়টিকেই বেছে নিয়েছিলো।
জার্মানিতে পরপর আসে সমাজবিপ্লবের সম্ভাবনা এবং প্রতিক্রিয়ার পাল্টা অভিযান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত, বিধ্বস্ত, যুদ্ধের বিপুল ক্ষতিপূরণের ঝোয়ায় প্রায় মৃত জার্মানিকে স্বাগত জানিয়েছিলো একের পর এক সৈনিক বিদ্রোহ। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিয়েলের নৌবিদ্রোহ। যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে অন্য সেনাবাহিনী এবং শ্রমিকদের মধ্যে। উত্তর সাগরের সবকটি বন্দর হয়ে বিদ্রোহ প্রসারিত হয় বার্লিন পর্যন্ত, শেষমেশ কাইজার নিজে পালান বার্লিন ছেড়ে। ১৯১৯’এর বিখ্যাত ব্যাভেরিয়া গঠন। আবার, ১৯২৩ এ মার্ক এর দাম পড়ে গেলে দেশজোড়া রাজনৈতিক ধর্মঘটে অচল হয় গোটা জার্মানি, সশস্ত্র শ্রমিকদের হাতে চলে যায় জার্মানির শিল্পাঞ্চলগুলো। জার্মানিতে কমিউনিস্ট বিপ্লব আসন্ন, এটাই ছিলো পরিস্থিতি।
কিন্তু সম্ভাবনা মতো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় না জার্মানিতে এবং মাথা চাড়া দেয় প্রতিবিপ্লবী অভিযান। এ রকমই এক প্রতিবিপ্লবী অভিযানে খুন হন জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতৃত্ব-রোসা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিবনেখ্্ট, এবং ঐ বছরেই হিটলারের প্রথম ক্ষমতা দখলের অভিযান। কিন্তু ১৯২৯-৩২’র অর্থনৈতিক সংকটই নাজিদের সামনে সুযোগ করে দেয় ক্ষমতা দখলের মতো শক্তিতে পরিণত হতে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ এর মধ্যে জার্মানিতে শিল্প উৎপাদন কমে ৪২%। আর বেকারের সংখ্যা ১৩ লক্ষ থেকে বেড়ে হয় ৫৬ লক্ষ। আর ১৯২৮-এ নির্বাচনে নাজি পার্টি পায় মোট ভোটের ২.৬%, কিন্তু দু’বছর পর ১৯৩০‘র তাদের ভোট বেড়ে হয় ১৮.৩% আর জুলাই ১৯৩২-এ তারা পায় ৩৭.৩% ভোট। তবে এটি চিত্রের একটি দিক-একইভাবে না হলেও এই নির্বাচনগুলোতে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিরও ভোট বাড়ে। যদি মধ্যবিত্ত ভোটের ঢল নামে ফ্যাসিস্তদের দিকে, শ্রমিকদের ভোটের একটা বড় অংশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে যায়। শেষ পর্যন্তও কমিউনিস্ট এবং সোস্যাল ডেমোক্রোটদের ভোট যোগ করলে ফ্যাসিস্তদের থেকে তা অনেক বেশি ছিলো।
কেনো মধ্যবিত্তরা ফ্যাসিস্তদের সমর্থন করেছিলো সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এরিক হবসবমের ঐতিহাসিক মন্তব্য মধ্যবিত্ত তার ভয়ের উপর ভিত্তি করে তার রাজনীতি ঠিক করে। অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্তকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্ধিহান করে তুলেছিলো। পুঁজিপতিরা ক্ষমতাবান, আর শ্রমিকরা সংগঠিত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করবে-মধ্যবিত্ত কোথায় যাবে?
পুরোনো লিবারেল রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের রক্ষা করবে, কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকদের জন্য লড়বে। একমাত্র ফ্যাসিস্তরাই তার স্বার্থ রক্ষা করবে। ফ্যাসিস্তরা মধ্যবিত্তের অসহায়তার কথা জানতো এবং সাধ্যমত তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। ‘মেইন ক্যাম্প’-এ খোদ হিটলার বলছেন-‘শ্রমিক অবস্থা থেকে উঠে আসা মানুষটি এক মুহ‚র্তের জন্য পুরোনো অবস্থায় ফিরে যেতে চায় না।’ এই ভয়কেই ফ্যাসিস্তরা ব্যবহার করেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে একটি সমালোচনা কমিউনিস্ট পার্টিদেরও প্রাপ্য। ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখলের পরবর্তী সময়ে জর্জি ডিমিট্রভের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নতুন গুরুত্ব দেবার আগে কমিউনিস্ট পার্টি দু’টিই মধ্যবিত্ত সম্পর্কে উদাসীন থেকেছে। ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা অ্যামাডিও বোর্ডিকা তাত্তি¡কভাবেই মনে করতেন, শ্রমিক ছাড়া কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে পারে না। ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির ৯৮% ছিলো ব্যবহারিক জীবনে শ্রমিক।
ইউরোপের মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের একটা আবেদন ছিলো। ভার্সাই চুক্তির অন্যায়, জাতীয় সম্মান পুনরুদ্ধার-সেøাগানগুলো এই অংশকে আকৃষ্ট করছিলো। ১৯২১ সালে মুসোলিনির ‘রোম অভিযান’-এর আগে ফ্যাসিস্ত পার্টির ১৩% ছিলো ছাত্র। ১৯৩০ সালে জার্মানির ছাত্রদের ৫ থেকে ১০% ছিলো নাজি পার্টির সদস্য। আর একটি অংশ বিপুলভাবে ফ্যাসিস্তদের সমর্থন করেছিলো, যাদেরও একটা বড় অংশের উৎস পেটি বুর্জোয়া শ্রেণিতে-এরা হলো প্রাক্তন সেনা অফিসার। ইতালির ফ্যাসিস্ত পার্টির শুরুর দিকে মোট সদস্যদের ৫৭% ছিলো প্রাক্তন সৈনিক।
আরোও বিস্তারিতভাবে যেটা বলা যায় নাজি পার্টির মোট সদস্যদের মধ্যে ১৯৩০-৩৪ সালের মধ্যে ২০.৬ থেকে ২৫.৬% ছিলো সরকারী কর্মচারী। যদিও এরা মোট জনসংখ্যার মোট ১২% ছিলো। সরকারী কর্মচারী এবং শিক্ষক ১৯৩০ সালের ছিলো নাজি পার্টির মোট সদস্যের ৮.৩% আর ১৯৩৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯% যদিও মোট জনসংখ্যার এরা ছিলো মাত্র ৫%। স্বাধীন হস্তশিল্পী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এরা ছিলো মোট সদস্যদের ২০% যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ছিলো মাত্র ৯%। পার্টি হিসেবে নাজি পার্টির অভ্যন্তরীণ গঠনের দিক থেকে ছিলো পেটি বুর্জোয়া পার্টি।
যে প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল সেøাগান নিয়ে ফ্যাসিস্তরা মাথা তুলেছিলো-সে কথাগুলো ইতালি বা জার্মানিতে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতায় আসার আগেই ছিলো-যাকে ধারণ করতো দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলো। সাংগঠনিকভাবে যারা ছিলো নিষ্ক্রিয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল সেøাগানের পালে ঝোড়ো হাওয়া লাগালো ফ্যাসিস্তরা তাদের গণ সমর্থনের জোর নিয়ে। নিঃসন্দেহে অক্টোবর বিপ্লব এবং সে সূত্রে শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশে ভয় পেয়েছিলো সমাজ ‘স্থিতাবস্থা’র পক্ষের শক্তি, যারা আবার বুঝেছিলো পুরোনো ব্যবস্থা বিপ্লব ঠেকাতে পারবে না। এই স্থিতাবস্থার পক্ষের পরিবর্তনকামী শক্তিদেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে ফ্যাসিস্তরা। ফ্যাসিস্তরা হলো প্রতিবিপ্লবের প্রশ্নে বিপ্লবী। ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে এটা একটি আবশ্যিক শর্ত-পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজবিপ্লবকে আর ঠেকাতে পারছে না। ঠিক এই কারণেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। কিন্তু ফ্যাসিস্তদের এই ক্ষমতা দখলে সহায়তা করে পুরোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি। দু’টি দেশেই ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতায় এসেছে পুরোনো ক্ষমতাসীনদের সাথে চক্রান্ত করে, কোনো বিপ্লব করে নয়। ফলত, ক্ষমতা দখল করার পুরোনো বিপ্লবী সেøাগান ভুলতে সময় নেয় না ফ্যাসিস্তরা। হিটলার এবং মুসোলিনি দু’জনেই তাদের নিজের পার্টির ভেতরে যারা পুরোনো সেøাগানের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো প্রথম তাদেরই কণ্ঠরোধ করেছিলো।
গণতন্ত্রের পথ ধরে জনগণের একটা অংশের সমর্থন নিয়েই ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু তাদের প্রথম কাজ হয় এই গণতন্ত্রকে নিকেশ করে চ‚ড়ান্ত স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ইতালিতে এ কাজ করতে একটু বেশি সময় লেগেছিলো ১৯২২ থেকে ১৯২৮, কিন্তু জার্মানিতে গণতন্ত্র নিধনের কাজটি হয় অসম্ভব দ্রæততায় ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৪। এই গণতন্ত্র নিধনের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদবিরোধী অবস্থান পরিত্যাগটিও হয় বিনা বাধায়।
শুদ্ধ আর্য নির্মল গ্রামীণ জীবনে ফিরে যাওয়ার যে স্বপ্ন ক্ষমতায় আসার আগে ফ্যাসিস্তরা দেখিয়েছিলো তার পুনোরুল্লেখও তারা আর করেনি। কিন্তু তা সত্তে¡ও দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিস্তরা তাদের পক্ষে একটা সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। এটা সেই মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া অংশের সমর্থন নিয়ে। কিন্তু এটাই হলো মজার বিষয় একটা প্রাথমিক পর্যায়ের পর ফ্যাসিস্তরা মধ্যবিত্তদের স্বার্থ রক্ষারও চেষ্টা করেনি। আসলে দীর্ঘমেয়াদীভাবে একচেটিয়া পুঁজিপতি এবং মধ্যবিত্তের স্বার্থ এক সাথে রক্ষা করা যায় না। শুরুতে কিছু চমক ছিলো, যেমন-‘মুসোলিনির আমলে ট্রেন ঠিক সময়ে চলতো’। ‘নাজিরা জার্মান অর্থনীতিকে সংকটের বাইরে নিয়ে এসেছিলো’, ‘হিটলার বেকারি দূর করেছিলো’, নিঃসন্দেহে হিটলার কিছু অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোর উন্নয়ন করেছিলো কিন্তু তা সে করেছিলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের লক্ষ্যে। মুসোলিনির ক্ষেত্রে সে সাফল্য ছিঁটেফোটা।
এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য অন্তত ১৯৩০ সাল পর্যন্ত জার্মানির বড় পুঁজিবাদীরা অনেকেই হিটলারকে চায়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিটলারের শাসনেই তাদের পক্ষে সবচেয়ে লাভজনক এই বোধ হবার পর থেকেই তারা হিটলারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলো। কয়েকটি বাড়তি উপাদান ফ্যাসিস্ত শাসন এনে দিয়েছিলো যা পুঁজিপতিদের কাছে ছিলো অকল্পনীয়।
এক. বামপন্থী সামাজিক বিপ্লবের ভয় আর নেই।
দুই. শ্রমিক ইউনিয়নের অবলুপ্তি।
তিন. ফ্যাসিস্তদের ‘নেতৃত্বের নীতি’র প্রয়োগ শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হচ্ছিলো, ফলত কারখানার কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বিনা বাক্যে পালন করতে হচ্ছিলো।
চার. ফ্যাসিস্তরা কোনো দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে না।
পাঁচ. ইহুদী প্রতিদ্ব›দ্বীদের নির্মমভাবে সরিয়ে দিয়েছে ফ্যাসিস্তরা। ফলত ব্যবসার প্রসার ঘটেছে জার্মান পুঁজিপতিদের।
ছয়. কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে পাওয়া সস্তা শ্রমিক লাভের পরিমান বাড়িয়েছিলো।
কিন্তু মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে এরকম নির্দিষ্ট কারণ খুব বেশি ছিলো না। কিছুটা ইহুদী বিরোধিতা চিরকালই লালিত হয়েছে ইউরোপীয় মধ্যবিত্তের মনে। বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর্সের মালিক ইহুদীরা তাদের শত্রæ। ছোটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ছোটো শিল্পের মালিকরা খুশি হয়েছিলো তাদের বড় প্রতিদ্ব›দ্বীকে ফ্যাসিস্তরা সরিয়ে দিয়েছে বলে। এমনকি ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতায় আসলে জার্মানি থেকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স ব্যাপারটা তুলে দেওয়া হবে। যথারীতি বাস্তবে তা হয়নি, জার্মানি মালিকানার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স-এর সাথে ছোটো ব্যবসায়ীদের অসম প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কাঁচামাল না পেয়ে ছোটো উৎপাদনকারীদের একটা বড় অংশই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৩১ সালে যেখানে ৪০০০ থেকে ১ লক্ষ মার্ক এর মধ্যে পুঁজি এরকম কোম্পানির সংখ্যা ছিলো ৭৫১২, ১৯৩৭ এ তা কমে দাঁড়ায় ৩৮৫০ এ। বড় সংস্থা এবং সরকারী সংস্থার কর্মচারীরা উপকৃত হয়েছিলো। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৮ এর মধ্যে জার্মানি শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরী কমেছিলো প্রায় ৩%। কিন্তু সেই একই সময় ঐ ধরনের কর্মচারীদের আয় বেড়েছিলো গড়ে প্রায় ১৪৮%। কিন্তু বড় সংস্থাগুলোর লাভের পরিমানের তুলনায় এগুলো কোনো বিষয় না। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ এর মধ্যে কোম্পানিগুলোর লাভ বেড়েছিলো ৪৩৩%। আই জি কারবেনের মতো বৃহৎ একচেটিয়া সংস্থার লাভ ১৯৩৩ এ ছিলো ৭.৪ কোটি মার্ক, ১৯৩৯ এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ কোটি মার্ক। আর এই একই সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে নাজি পার্টিকে দেওয়া চাঁদার পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ লক্ষ মার্ক থেকে ৭৫ লক্ষ মার্ক। সরকার থেকে খুচরো দামের নিয়ন্ত্রণ করায় সবচেয়ে সমস্যায় পরে ছোটো ব্যবসায়ীরা। ১৯৩৬ সালে ৭৫% খাদ্যদ্রব্যের ছোটো ব্যবসায়ীর মাসিক আয় দাস শ্রমিকের মজুরির থেকেও কমে যায়।
১৯৩৯ সালে এই অংশের কফিনে শেষ পেরেক পুঁততে দু’টি ডিক্রি জারি করা হয়। এক হস্তশিল্পী যারা ‘অপ্রয়োজনীয়’ পণ্যের উৎপাদনে নিযুক্ত তাদের অন্য পেশায় যেতে বলা হয়। এসবের আগেই ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ এর মধ্যে ১০৪০০০ স্বাধীন হস্তশিল্পী মজুরি শ্রমিকের পেশায় যেতে বাধ্য হয়। আর দ্বিতীয় ডিক্রিটি আরো ভয়ংকর, যেসব কোম্পানির মোট বিক্রি একটি নির্দিষ্ট পরিমানের কম তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। অবশ্য সংস্থার কর্মচারীর সংখ্যা এই সময় যথেষ্ট বেড়েছিলো। ১৯৩৩ এ কর্মচারীরা ছিলো জনসংখ্যার ১১.৮%, ১৯৩৯ এ তা বেড়ে হয় ১৩.৩%। অনুরূপ সময়ে সরকারী কর্মচারীদের ৬.৬% থেকে বেড়ে ৭.১% হয়।
ফ্যাসিবাদকে তার শক্তি জুগিয়েছিলো যে পেটি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত অংশ ফ্যাসিবাদ তাদের রাষ্ট্র তাদের কথা বিবেচনায় রেখে পরিচালনা করেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতটাই হয়েছে। যে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়ে ফ্যাসিস্তরা লোক জড়ো করেছিলো,-সেই একচেটিয়া ফিন্যান্স পুঁজিকেই অকল্পনীয় লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলো। ফ্যাসিস্তদের আগের ইতালির উদারনৈতিক সরকার, বা জার্মানি বুর্জোয়া-সোস্যাল ডেমোক্রাটরা ফিন্যান্স পুঁজিরই স্বার্থরক্ষা করতো। কিন্তু উদ্যত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ‘ভয়ংকর’ সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী, হিংস্র ফ্যাসিস্তদেরই ফিন্যান্স পুঁজি বেছে নিয়েছিলো। এটাই ফ্যাসিবাদের মূল শ্রেণি পরিচয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ হতো না যদি পেটি বুর্জোয়ার সমর্থন তারা আদায় করতে না পারতো। আর পেটি বুর্জোয়া? ভুল মিত্র বেছে প্রতারিত হওয়া তাদের গোটা ইতিহাস জুড়েই। শুধু এই ভুলের জন্য পৃথিবীতে ৬ কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে-এটাই এই ভুলের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই ভুলের পুনরাবৃত্তি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় হয়েছে। সচেতন থাকা প্রয়োজন। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধিই মধ্যবিত্তকে টেনে আনতে পারে ভুলের আবর্তের বাইরে-এটাও ইতিহাসেরই শিক্ষা।

শেয়ার করুন: