একুশ শতকের দুই বাঙালির আলাপসালাপ
ধরেন যে, দুর্বায় চিত হইয়া শুইয়া আমি যখন দেখি নীল আসমান
আপনি কইলেন ‘দিকদিগন্তে শুভ্রনীলাকাশ’।
এই কথায় আমার আসমানে কালিঝুলি, রৈদ মনমরা
আর আপনে বিদ্যুতের খুঁটিত শুভ্রনীলাকাশ লটকায়া
ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ . . . কুড়ির শতক পার হয়্যা যান আজব বাজারের পথে
জঙলি ফুলের বাঁসে মাতাল বাংলা কথাডা কিন্তু আমার শুরুই হইল না।
আমার পায়ের নিচে মাটির উম, কার্তিকের বাঁস,
আপনি কইলেন ‘পদতলে মৃত্তিকর ওম্, শস্যের ঘ্রাণ’
যেই কথা আমার না, যেই কথায় বাঁস মায়া কিচ্ছু নাই
সেইসব কিতাবী কথা আমি শুনি আপনার জবানে।
শুনতে শুনতে আমি বিলপাড়, কাইমের রঙিন পাঁখ হারায়া ফেলি
ধানক্ষেত জঙলিফুল, রাখ্খোয়ালের আনমনা বিচ্ছেদী গান-
আহা এই বাংলাদেশ-আমি বেবাকই হারাই।
আর আপনি কিতাবে সওয়ার পার হয়্যা যান
এই বাংলাদেশের খাল-বিল-গাঙ, কচুয়া জমিন
আর কিতাবের দূর দেশে একখান ‘বাঙালি’ চোতা লটকায়া
‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো…’
অথচ আষাইঢ়্যা চান রাইতের নিশা কিবা
বাঁসমতি ধানের কথাডা আমার কওয়াই হইল না।
দুই কিসিমের দৃশ্যের মধ্যে
তোমারে দেখি না যেন, দেখতাছি ব্যক্তিগত দৃশ্যগুলি তোমার
কিছু কিছু মিলতাছে আগাম স্কেচের সাথে।
যেইখানে বেমিল লেখা হইতেছে কিছু মাঘের বাতাস
আমি তারে একদিকে রাখি, ঘুরপথে যাই;
শূন্যবোর্ডে প্রথমে একটা মুখ আঁকি মনে মনে
দুইপাশে মাপমত ছড়ায়া দেয়া কালা চুলগুলি
কেন উইড়া দূরে দূরে চইলা যায়;
তাহাদের মাতাল গন্ধ পইড়া থাকতেছে হাতের তালুতে।
দেখি দূরে ওইসব চুলদের মুখ কাল্পনিক দূরে
বানানো পরিদের মত উড়তেছে কি না!
আর তার চোখে গোপন নিরাকে পুনর্জন্মা লইতেছে
আরো আরো অন্তর্গত ক্ষতের ঘটনা;
আমি তাতে ঢুইকা পড়ি, তাদের বেদনার রং হাতে মাখি,
মনের পাখিদের পাখনায় লাগাই এই দুঃখু;
ভাবি, হায় কেন বুঝলাম এই ব্যক্তিগত রোদনের ভাষা!
তে কারণে এই জন্মে আমার আর তোমার সুন্দর মুখ দেখা হইল না।
উপনিবেশের দাগ
সে থাকে আমার সাথেই
আমার বুঝা বা না বুঝার আড়ালে,
আমার জানার মধ্যে সে এক রঙচোরা
ঘুরেঘারে, খায়দায়, গোজামিলে ইতিহাস নাটক বানায়।
নাকি আমিই সে? নাইলে কেন তার কথা কানে তুলি!
এক টাই খুইলা ফালায়া কেন আবার রঙ মিলায়া বান্ধি
হাসাহাসি করি নিজে নিজে–যেন গলার চাইরদিকে
একখান রশিই প্যাঁচায়া নিজেরে জাহির করি–
আয়নায় দেখি নিজেরে নিজেই,
তাহারেও দেখি,
ভাবি প্রত্যেক সকালে কার আদত কি কারণে মাইরা দিয়া
এই আচানক পিরান পরতাছি?
আমি আমারে লেখি
নিজের ছাপচিন্ রাখি সামাজিক বয়ানে,
মাঝে মাঝে চমকে দেখি আনমনে তাহারেও লেইখ্যা ফেলি
শেষে মুছি–যেন জোর করে নিজেরেই মুছতেছি।
আমি হাঁটি, পিছে পিছে পায়ের আওয়াজ পাই,
জানি সে হাঁটে একই সাথে
আর আমার বেবুঝের কালে দোটানায় ফেলাইতে চায় এই আমারেই
সে টানে পশ্চিমে
আমি বোধের পসারে ইঞ্চি ইঞ্চি পুবেই আগাইতেছি,
সে আমার হাতের তালুতে নাকি বোধজুড়ে
বহুজনমের দাগ– প্রতিদিন তিলতিল মুছতেছি।
ঢুপি দেখার জন্য
একবার একটা ঢুপি দেখার জন্য
ভরদুপুরে জংলা ভাইঙ্গা কই যেন যাইতেই ছিলাম।
তার গায়ে আমাদের ছেঁউড়া দুপুরগুলা না,
যেন আঁকা হইতেছে তাদের ছায়াছবি ।
যেই ঢুপিগুলারে কাইল বিকালে শিকারীরা ধইরা নিয়া গেছে
তারা আইজ আমাদের এতিম বাসনার মাঝে ডাকতেছে
ঘু-উ-উ-উ, ঘু-উ-উ-উ।
আমরা আওয়াজের দিকে ঝাঁপ দিয়া ভাসি,
একটা ঝোপের ঘরে বই কিছুক্ষণ।
পাকনা গাবের গন্ধে গাব গাছ বিছরায়্যা
এই গাব সুরাইয়ার গালের মত লাগে বলে
আমরা শেষে কামড় দেই না,
যদি দাগ পড়ে!
গাবের রঙে গাল ঘঁষতে ঘঁষতেও আমি ঢুপির কথা ভুলি না।
দেখি বিধান এখনো কেন পশ্চিমেই যাইতেছে
আমি কই, ও বিধান, ওইদিকে পাকা রাস্তা, যাইস না,
গেলে এ জন্মে তর আর ঢুপি দেখা হইব না।
আমার একলা আমি আমার মইধ্যে ঘুরি-
জংলার পেটে নিরাবেলি ঠান্ডার শান্তির আদলে
নিজের না-কওয়া কথা কিছু আইজ কই নিজে নিজে!
ছাগলবুড়ির গাছেরে নাড়াই, একটা বনজামের ডালে গলা রাখি, বলি-
আগের জন্মে তুমি আমার মা হইয়া থাকতেও পার;
মউতে মাটিতে বুঝি জন্ম নিছ গাছের বাসনা!
জুড়ানো চোখের ভিতরে আরো কতক দুপুর,
তার ঢুপিগুলি আইসা বয়, ডাকে ঘু-উ-উ-উ!
যেন আমি এক ঢুপির জংলা,
জংলার মইধ্যেই বাড়তাছি মনে মনে।
আমারেই বলি, ও বিধান, তুই কেন পশ্চিমে চইলা গেলি!
আমরা দুইজনে মিলে এইসব ঢুপিদের আইজ দেখতেই পারতাম!
ঢুপি শিকারীরা তারারে পিঞ্জরায় ভইরা ফালানোর আগে।
ঢুপি বিষয়ে আরো কয়েকটা কথা
অনেক দুপুর আর তাহাদের আনাগোণা ঢুপিগুলা
ঢুপির জংলায় উইরা আসে, বয়, ডাকে, উইড়া যায়।
আমি ঝোপের ভিতরে বইয়া দেখি একটাই ঢুপি উড়ে
একটাই ঘু-উ-উ-উ, ঘু-উ-উ-উ ডাকে।
একটাই ঢুপিরে মনের মতন আমি চিনে রাখি।
ঢুপি শিকারের কোন কল না, তাই
এ জন্মে আমার আর ঢুপি শিকার করা হইল না ।
সব ঢুপি পিঞ্জরায় ভইরা শিকারীরা চলে গেছে,
মইর্যা পরে গজাইতেছে আমাদের মায়ের তরফের
জারুল বনজাম গাছগুলি।
এইমত মউত ও জন্মের কিনারে
একটা ঢুপি আইজও উইড়া আসে, নিরাকার ডালে বয়,
একটা ঢুপি আইজও ডাকে ঢুপির জংলায়-
মনে মনে।
দিনলিপি
আঙ্গুলের ভাঁজে সমুদ্রযাত্রার গল্প নিয়া আমি
সব গোছায়া আনার কথা ভাবি:
যেমন ব্যাংক হিসাব থাইকা আলাদা করে
একপাশে রাখতে পারি নিরাকার পক্ষীগুলি,
পেছনে দূরের না-গাওয়া গান আর
তাহাদের মরা আসমানগুলি লটকে দেয়া যায় জানালায়।
জন্মের তিরাসের কাছে থাকেত পারে পানির কলস ও গেলাস
যার থাইক্যা হয়তো কোনদিন পানি খাওয়া হইব না।
ঘরজুড়ে আর আর পাওয়াগুলি থাকতেই পারে গোছগোছ করা-
খাট পালঙ্কে আমার সব বকেয়া ঘুমগুলাও;
এইভাবে নিজেরে গুছায়া আনতে পারি দস্তুরমত।
অথচ কাইল বিয়ানে পিছে আগোছাল ঘর রাইখা
দরজা খুলেই বাইর হয়্যা পড়বো
ছড়ায়া ছিটায়া যাব দূরদূরান্তে।
ঘুমের জন্য রোদন
নিজেরে শোয়াত রাইখা আমি উইঠা পড়ি
ঘুমের আকালের জঙলা ঘাসে
না ঘুমায়া তাকায়া থাকি কিছু ঘুমের দিকেই
যদি সে ধরা দেয় শেষ রাইতের দূরান্তের উঁশ!
উঁশের সওয়ারেরা দূর দিয়া ঘোরে ফিরে,
যেন বা বাঁশতলার জোনাকি
কতকটা জাহির হইয়া বাতিনে গড়ায়
হয়তো থাকতেছে কোনো কুয়াশায় ধানের হাওড়ের নিয়ড়ে।
এই দেখে আমি তো ভাবতেছি পাখি হইলে উইড়া গিয়া
উঁশের ভিতরে ডুবতে পারতাম
কাতর অঘুমা চোখ নিয়া কিছুকাল থাকতাম অফুরন্ত ঘুমের অতলে।
পাখি না হইয়া কেন হইছি আমি পাখির পালক!
মাতৃপাখি যারে ছাইড়া যায় আনমনে নাডানাল ক্ষেতে
ঘুম তারে দেখে দূর হতে,
যেন ভাবে, ত্যাজের বেদনা নিয়া থাকুক সে কিছুকাল একা একা
পৃথিবীর আরো সব অ-ঘুমা মানুষের অবিরাম জাগ্নার ভিতরে।
রাইতের আগে
সন্ধ্যার তারাদের নিচে একটা গান বান্ধনের আগে ভাবি
দূরের তারার আভাস এইখানে থাকতে পারে
গতহওয়া রৈদের টকটকা রঙের মধ্যে
যাওয়া আসা করুক আগামী কাইল ও
তাহার পরের আরো যত দিন
হাতের কাছে জঙলার ঘাসফুল, কয়গোছা উজাউড়ির মৌজ
কিছুটা লাগলে ভালো
তোমার জানালায় আমরার না-ফোটা জোছনা
কতক উঠতেই পারে এইখানে রক্তিপুন্যির চানে
তাতে মোটামুটি একটা গড়পড়তা জীবন আঁকা যায়।
শেষে দেখি লেখছি নিজেরই কিছু ছায়া
তাতে আসরের ওয়াক্তের বিলাপই মূল রঙ
যেন লেখা হইছি আমি একটা দু:খের গান
সন্ধ্যার নিরাবেলি মনে!
ঘর
তুমি যেন একটা ঘর
অবেলায় শুন্যে বানতাছি
যোহর বেলার গান এই খানে কিছুটা বিদেশী
আর না গাই সেইসব গান, বরং দুনিয়ার মায়াবী বুনিত
না-ফোটা বাসনাগুলি রাইখা বলি
তোমরা জন্মাইও কতক সবুজ ঘাস
অন্য কোন সময়ের উরে।
আমি তো বাওরা ঘরামি আইজ
ঘর ভাইবা এক মনে তোমারেই বান্ধি
তলে তলে কার কোন তিরাসের টানে
এইখানে যেইসব দৃশ্যের ছুরা জন্মাইতেছে
বিকালের দেওলিয়া রৈদে তুমি তার ঝড়
আমি হৈলদা পাতা হয়া ঝরি!
সিনেমা দেখার আগে
সিনেমা দেখার আগে আমরা স্ক্রিপ্ট দেখি
পথে শাহবাগের মোড়ে একটু বসি চায়ের দোকানে
উঠতি বয়সের ছেলে ও মেয়েরা কে কারে চোখ মারতেছে
আমরা মজা পাই
মৌসুমের আগেই আমরার ছেলেমেয়েরা সাবালক হইতেছে!
চাঅলারে কই ‘মামা’ তাতে কিছুটা সাম্যবাদ হইল
পায়ে পড়ে না তার মাথার ঘাম
শার্ট ভিজতেছে বলে ভাবা যায়
আহা এই শট কি দারুণ–
যত দূর যাইতে পারি মধ্যবিত্তের শিল্প কলা
ততদূর দাড়ায়া কই, ঠিক পথের প্যাঁচালের মত, দারুন দারুন!
নিদারুণ হইলো না কি!
রিক্সাঅলারে জিগান যাইতে পারে নিদারুণ তার জীবন
প্যাডেলের পাশ দিয়া অতঅত দামি গাড়ি
আসমান ছোঁয়া বিল্ডিংগুলার নিচ দিয়া
স্ক্রিপ্ট দেখা চলতেছে
মধুবালা নার্গিস সাবানের বাঁসে আমরা শেষে
উত্তেজিতই হয়া পড়তাছি মনে হয়
কাজেই এই সময় গুলির শব্দ মোড়ে মোড়ে,
বেশ যায়, যাইতেই পারে
সিনেমার শেষের দিকে কিছু কিছু মারামারি
কিছু গলাবাজি
যদিও এইখানে স্ক্রিপ্টের ভিতর কেমন সুনসান বোবা মানুষেরা।
আমরা সিনেমা দেখতেছি কিছু লাশ পড়তাছে
তাতে তলে পড়তেছে সাবানের বাঁস
সহবাসের বদলে হাতমারা শেষ।
কাইল সকালে অফিসের কামের ফাঁকে এইখানে
মধ্যবিত্তের একটা বিপ্লবই হইয়া যাবে হয়তো।
ক্লাইভের চেয়ারের নিচের আন্ধাইর
ক্লাইভের চেয়ারের নিচে জমছিলো যেই রাত
দ্ইু শত চৌষট্টি বছর আগে
তার কতক আন্ধাইর আইজো আমাদের একাডেমিক চেয়ারের পাছায়
কলাভবনের খাঁজে ঝুল খায়
লাইব্রেরীর সেলফে সে এক দেশি বিলাইর কালা মুখ
নিরাকার ইঁদুর বিলাই খেলে যে চতুর
আমাদের উঠতি কাঁঠাল আম জামের চারাগুলার সাথে
সোনারইদে ঝলঝলা ফিরিঙ্গি শিকলের দাগ হাতে পায়ে
মহামাতা ভিক্টোরিয়ার করপোরেট সিল ভাবে
কয়জন আবাল অধ্যাপক দেলের ভিতর
তারা পার হইতে চাইতেছে বুক পকেটের তাড়াহুড়াগুলি
আর বহুজাতিক সকালের মোড়
বোধের ভিতর খেলে ‘বিশ্বায়ন’ হরফের মালা
সে কি আর জানে ফিরিঙ্গির সাজানোর গুনে হরফও খেলতে জানে
তিন শ বছরের পুরানা খেইল
বিশ্ববাজারের মোকামের পায়ের তলা পার হইয়া
যেখানে পৌঁছবে এই আবালের দল
তারা তো জানে না সেইখানে হরফেরা লেইখা রাখছে
‘দাসের বাজার’।