অবিভক্ত বাংলা, বাঙাল, বাঙালি আত্মার আত্মিয়, সাংস্কৃতিক ঐক্য-এমন আবেগের আতিশয্য আমাদের অনেকের মাঝেই আছে। আবেগ-সর্বস্ব অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই যুক্তি, ইতিহাস, অর্থনৈতিক বিশ্লে¬ষণের অভাব থাকে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই এড়িয়ে যাওয়া বা অভাবের জন্যে অনেক সময়ই কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বাঙালির ঐকতান বিষয়ে এমনি কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন মঈন চৌধুরী ‘ভাষা, মনস্তত্ত্ব ও বাঙালি/বঙ্গাল সংস্কৃতি’ রচনায়।
তিনি প্রথমেই ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কৃষ্টি (উৎপত্তিগত অর্থ কর্ষণ, হালচালনা) শব্দটির বদলে সংস্কৃতি শব্দটি ব্যবহারের পেছনে একটি রাজনীতি বা শ্রেণি বৈষম্য দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেই প্রসঙ্গ লেখক তুলেছেন। তিনি বলেছেন, “ … ‘কৃষ্টি’ শব্দটি দিয়ে একটি জাতি কিংবা সমাজের মূল্যবোধ, ভাষা, সাহিত্য, আচার, আচরণ, রীতি-নীতি, উৎসব-পার্বণ ইত্যাদিকে যেভাবে বোঝানো যায়, সংস্কৃতি শব্দটি দিয়ে ঠিক একই মাত্রার দ্যোতনা আনা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষপাতিত্ব থাকায় ইংরেজি Culture শব্দটির বিপরিতে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি বাংলা ভাষাতে মোটামুটিভাবে স্থান করে নিয়েছে। তবে এ কথাও সত্য, এখনো আমরা অনেকেই ‘সংস্কৃতি বোঝাতে ‘কৃষ্টি’ শব্দটিও ব্যবহার করি।
কোলকাতা ও শান্তিনিকেতন-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি-চর্চা একসময় ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির মর্মার্থ নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলে, সংস্কৃতির বিকাশ বা চর্চার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যায় ‘সাংস্কৃতিক’ অনুষ্ঠানসমূহের আনুষ্ঠানিকতা। এখনো আমাদের সমাজের অনেক শিক্ষিত লোকই ‘সংস্কৃতি-চর্চা’ বলতে গান-বাজনার আসরকেই বোঝাতে চান। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি যে তাদের জীবন ও চরিত্রের উপাদান হয়ে তাদের মাঝেই অবস্থান করছে, তা উপলব্ধি করাও তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষায় ‘সংস্কৃতি’ এবং ‘কৃষ্টি’ নামক দুটি শব্দ আছে, কিন্তু দ্যোতক হিসেবে শব্দ দুটির সঠিক দ্যোতিত রূপ আমাদের চেতনসত্তায় কেন পৌঁছাচ্ছে না, তা বিচার-বিশ্লে¬ষণ করা অবশ্যই প্রয়োজন। আমাদের জ্ঞানি-গুণিজন বাঙালি বা বঙ্গাল সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করেছেন প্রচুর; বিভিন্ন সত্য, অর্ধসত্য এবং মিথ্যা অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্তও তারা উপস্থিত করেছেন, যৌক্তিকভাবেই, কিন্তু সংস্কৃতি বা কৃষ্টির আসল দ্যোতিত অর্থকে বাঙালি/বঙ্গাল চেতনা-চৈতন্যে উপস্থিত করতে পারেনি কখনোই। আমরা ঈঁষঃঁৎবফ/ঁহপঁষঃঁৎবফ যুগ্ম-বৈপরিত্যকে যে মাত্রায় বিচার-বিশ্লে¬ষণ করি, ঠিক একই মাত্রায় সংস্কৃতি/অপসংস্কৃতি যুগ্ম-বৈপরিত্যকে বিচার-বিশ্লে¬ষণে আনি না। কেন আনি না, এই প্রশ্নের উত্তর যথাযথ যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে আমাদের জ্ঞানি-গুণিজন সবসময় ধর্ম, সামাজিক বিভেদ, জাতপাতকেন্দ্রিক বিভাজন ইত্যাদিকে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু সংস্কৃতির উৎসমূলে অবস্থানরত মনস্তত্ত্বকে বিশ্লেষণে আনেননি।” (পৃ. ৩)
এই আলোচনাটি কিছু চিন্তার খোরাক দেয়। দ্বন্দ্ব ও বিরোধ প্রশ্নে আমাদের এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, এবং এ প্রশ্নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চলককে (ফ্যাক্টরকে) বিবেচনায় না এনে আমাদেরকে অনেকক্ষেত্রেই একটি ভ্রান্তিতে রাখে যার প্রতিফলন জনমানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ও চিন্তা-ধারণায় পড়ে। এই কারণেই শহুরে, নগর এবং আভিজাত্যের সংস্কৃতি নামে একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং প্রচার পায়, যা ধীরে-ধীরে জাতিয় সংস্কৃতির মর্যাদা আদায় করে বা দখল করে। খেটে খাওয়া, কৃষক-মজুরের সংস্কৃতিও ফিউশনের মাধ্যমে একটি পণ্যে পরিণত হয় এবং সেই সংস্কৃতিকে ‘মাটির গন্ধ মেশা’ জাতিয় উপাধি দিয়ে যেন করুণা করা হচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সংকটই অতি প্রবল। পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দ প্রকাশনা’ গোষ্ঠির বিকৃত করে বাংলাদেশের লেখকের নাম উপস্থাপন করা হয়তো এই সংকটের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ।
পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভৌগলিক ভাগ নয়, ‘অন্তরের ভাগ’ও-একথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। ভাষা এক হওয়ার পরও পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের মাঝে একটি ‘মনস্তাত্তি¡ক দ্ব›দ্ব’ আছে, যার দার্শনিক স্বরূপ লেখক ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে বিভিন্ন বাংলা বচনের মাঝে দেখানো হয়েছে কি করে প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনে জাত-পাতের ছায়া, হীনম্মন্যতা, ধনি বা ক্ষমতাধরের প্রশংসা, ধর্মের নামে সামাজিক শোষণ ইত্যাদি নেতিবাচক উপদানগুলোকে সনাক্ত করে তিনি আমাদের ‘যৌথ অচেতন’ অবস্থাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। বাঙালির আজকের মনোজগতের উপনিবেশ ব্যাখ্যা করার জন্যে এই মনস্তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
মাছে-ভাতে বাঙালির মাহাত্ম্য কীর্তন প্রশ্নে লেখক কতগুলো জরুরি ভাবনার অবতারণা করেছেন। উর্বর মাটি, কৃষি উপযোগি জলবায়ু, মাছের প্রাচুর্যের জন্যে নদী-খাল-বিল থাকলেও এর পাশাপাশি ছিল বন্যা, খরা, মশা-মাছি, সাপ, বাঘ ইত্যাদি। তাই এই জনপদের প্রাচিন বাসিন্দাদের কষ্ট করেই জীবনধারণ করতে হত। দুর্যোগের কারণে প্রবল সমস্যাও ঘটত, তৈরি হত অস্তিত্ব সংকট। এই অস্তিত্বসংকটকে কেন্দ্র তরে মনস্তাত্তি¡ক স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতার প্রকাশ ঘটে লেখক এমন ব্যাখ্যা করেছেন। সেই জন্যেই হয়ত বাঙালির মাঝে পরচর্চা, পরনিন্দার চর্চা আজও এত ব্যাপক। সেই সাথে নিকট ভবিষ্যতে কোনো সুদিন, সাফল্যের সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ার কারণে ‘গোলা-ভরা ধান’, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি এ জাতিয় বুলি আউরিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার প্রবণতা দেখা যায়, যাকে লেখক বলেছেন, “অবদমিত জনগোষ্ঠির মনস্তাত্তি¡ক আনন্দ ও বিরহের প্রকাশ হয়েছে লোকসঙ্গীতে, যাত্রায়, উৎসবে ও পার্বণে।” (পৃ.১৫)
শাসক-শোষিতের সম্পর্ক, উচ্চ-নিচ শ্রেণি, নানা তরিকা (চিশতিয়া, নকশাবন্দি ইত্যাদি) এমন নানা কারণ বঙ্গাল বা বাঙালি সমাজের মনস্তাত্তি¡ক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বিভাজনকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব আমরা আমাদের সমাজজীবনে আজও দেখতে পাই। সাম্প্রদায়িকতার নানা প্রকাশ প্রচলিত বিভিন্ন ‘যুগ্ম-বৈপরিত্য’ শব্দের মাঝে প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, “হিন্দু-মুসলমান যুগ্ম-বৈপরিত্য ও বিনির্মিত (deconstruction) হয়ে যায় ‘মুচলমান-বাঙালি’, ‘হিন্দু-যবন’, ‘মুসলমান-মালাউন’ কিংবা ‘মুসলমান-কাফের’। সমাজের এই ভাঙনের মুখে মনস্তাত্তি¡ক কারণেই কোনো একক সংস্কৃতির সুষ্ঠু বিকাশ বঙাল বা বাঙালি সমাজে হয়নি, বরং এই মনস্তাত্তি¡ক ভাঙনকে কেন্দ্র করে সমাজের মানুষ হয়ে ওঠে গোষ্ঠিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পরশ্রীকাতর। ইংরেজ শাসন Divide and Rule নীতি প্রয়োগ করার ফলে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত আরও বেড়ে যায় এবং ইংরেজদের রাজনীতি বাংলাদেশে সৃষ্টি করে ‘জমিদার-প্রজা’, ‘আড়তদার-কৃষক’, ‘বাবু-রায়ত’, ইত্যাদির মতো যুগ্ম-বৈপরিত্য।” (পৃ. ১৬)
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ধারা ধরে বাঙালির বর্তমান মানস রাজনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আবহকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই বইতে। সংকট ও দুর্গতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে তিনি বাঙালির যৌথ মনস্তত্ত্বে একটি Social Psychotherapy-র কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে বর্তমান আলোচনা শেষ করছি, “যে কোনো জাতির সঠিক আত্ম-পরিচয়, নৃ-তাত্তি¡ক উৎসমূল এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিচার-বিশ্লে¬ষণ করতে হলে আবশ্যিকভাবে শিকড়-সন্ধানি হতে হয়। আমরা যদি জাতি হিসেবে আমাদের উৎস বা মূল বিচারে আনি, তবে ১৯৭৫ সালের সা¤প্রদায়িক চিন্তার ফসল ‘বাংলাদেশি জাতি’র অন্তর্ভুক্ত আমরা নই, কিংবা অষ্টাদশ শতকের সা¤প্রদায়িক বিভাজনের ‘বাঙালি জাতিয়তাবাদ’ আমাদের সঠিক আত্ম-পরিচয়ের সন্ধান দেয় না। বাংলাদেশ বা বঙ্গদেশের হাজার বছরের ইতিহাস বিবেচনায় আনলে আমরা দেখতে পাব যে প্রাচিন বঙ্গদেশের সমতট, বঙ্গ, উপবঙ্গ, প্রবঙ্গ, হরিকেল, গঙ্গারিডি, তাম্রলিপ্তি, সূক্ষ্মম রাঢ়, গৌড়, বরেন্দ্র ও পুণ্ড্র নামের আদিম জনপদ সমন্বয়ে সংগঠিত বৃহৎ-বঙ্গের বঙ্গাল স¤প্রদায় বা জাতিই ছিল আমাদের পূর্ব-পুরুষ এবং এ সত্যকে মেনে নিয়ে এবং নৃ-তাত্ত্বিক ও জেনেটিক বিশ্লেষণের যৌক্তিক উপাদানসমূহ গ্রাহ্য করে, বঙ্গাল জাতির উত্তরসূরি হিসেবে আমরা নিজেদেরকে ‘বঙ্গাল জাতি’ হিসেবেই বিবেচনা করব। কোনো জাতির ইতিহাস তিরিশ, পঁয়ত্রিশ কিংবা দুইশত বছরের পুরোনো হয় না, একটি জাতির সঠিক উৎসমূলের ইতিহাস হয় হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশে। আমরা যদি বঙ্গাল জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসি হই, তবে আমাদের চিন্তা-চেতনাও হবে অসাম্প্রদায়িক আর আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে নিয়ে যেতে পারব হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসে।” (পৃ. ২৩)