004746
Total Users : 4746
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

বাঁধবাণিজ্য: মুনাফা আধিপত্যের গ্রাসে মানুষ-প্রকৃতি

জওহরলাল নেহেরু একসময় বলেছিলেন, ‘বড় বাঁধগুলো আধুনিক ভারতের মন্দির’। শুধু নেহেরু নন একসময় সারা দুনিয়ার শাসকরাই বাঁধের প্রশস্তি গাঁথা গেয়েছেন। বাঁধকে বিবেচনা করা হয়েছে ‘উন্নয়নের’ নিদর্শন হিসেবে। বাঁধ নির্মাণকে পুঁজির স্থবিরতার সংকট দূর করতে লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়েছে। কৃষির একমুখিকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণে উচ্চ ফলনশিল হাইব্রিড ফসলের চাষ চালু হলে সেচের প্রয়োজন বেড়েছে বহুগুণ। সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সেচকাজে ব্যবহৃত বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। দুনিয়ায় বাঁধ নির্মাণ ব্যবসা বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দাঁড়িয়েছে। বাঁধ নির্মাণ কোম্পানি, আমলা, রাজনীতিকদের একটা চক্র গড়ে উঠেছে। বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে সবসময় হাজির থেকেছে বিশ্বব্যাংক। যদিও কখনো সখনো তাদের ভূমিকার অদল বদলও ঘটে। ব্যাংক থেকে কেউ গিয়ে বনে যায় প্রকল্প পরামর্শক আবার পরামর্শক হয়ে যায় ব্যাংকার। বাঁধ কোম্পানির মাইনে পাওয়া চাকুরে হয়ে যায় স্বাধিন পরামর্শক।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মাধ্যমে নদিগুলোর স্বাভাবিক নাব্যতা ও প্রাণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্লাবনভূমি হিসেবে গড়ে ওঠা বাংলাদেশে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, কমেছে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ। শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়াই নয় সারাবিশ্বেই বাঁধ বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করেছে। সে কারণে উন্নত বিশ্বে এখন বড় বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। অনিবার্য কারণে এই বিপর্যয় রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে। বড় বাঁধের বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতাকে অরুন্ধতী রায় সংক্ষেপে তুলে ধরেন এভাবে-‘বড় বাঁধের শুরু হর্ষধ্বনিতে আর শেষটা কান্নায়। একসময় ধর্ম, জাতিগোষ্ঠি, মতাদর্শ নির্বিশেষে সবাই প্রবল উচ্ছ¡াসে বড় বড় বাঁধকে স্বাগত জানিয়েছে। বাঁধকে নিয়ে কাব্যও করা হয়েছে। এখন আর হয় না। এখন বড় বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। যদিও উন্নত বিশ্বে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো উপকার যা করে তার চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি। বড় বাঁধ সেকেলে। অগ্রহণযোগ্য। অগণতান্ত্রিক। সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার, কে কি পাবে, কতটুকু ফলাবে তা ঠিক করে দেবার হাতিয়ার। কৃষকের জ্ঞান তার কাছ থেকে কেড়ে নেবার নিশ্চিত পদ্ধতি। গরিবের পানি, সেচ আর জমি বড়লোকের হাতে উপহার দেবার উদ্ধত পথ। এগুলোর জলাধার মানুষকে করে গৃহহীন, নিঃস্ব। প্রতিবেশগত বিবেচনায় চরম দুর্দশা সৃষ্টিকারি। এগুলো মাটিকে বানায় আবর্জনা। বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খরা আর রোগের বিস্তার এগুলোর পরিণতি। বড় বাঁধের ভূমিকম্প প্রবণতা বৃদ্ধিরও যথেষ্ট প্রমাণ আছে।’

পৃথিবীব্যাপি বড় বাঁধের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে এসব বাঁধের বেশিরভাগ অর্থায়নকারি বিশ্বব্যাংক এডিবি নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম (ডঈউ) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। ডঈউ-এর ভাষ্য অনুযায়িই বড় বাঁধ প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে-
– বন ও বন্যপ্রাণি ধ্বংস, উজানে প্রাণি প্রজাতির লোপ, উজান সংলগ্ন এলাকায় জলাধারের প্লাবনজনিত কারণে ক্ষয়।
– উজান ও ভাটিতে জলজ প্রাণবৈচিত্র্য বিশেষত মাছের ধ্বংস এবং ভাটিতে পলিবিধৌত অঞ্চল, জলাভূমি, নালা, মোহনা ও নিকটস্থ সামুদ্রিক প্রতিবেশের ধ্বংস।
– পানির মান, প্রাকৃতিক বন্যা, জৈব বৈচিত্র্যের উপর দির্ঘস্থায়ি কুপ্রভাব, বিশেষত যখন একই নদির ওপর একাধিক বাঁধ দেয়া হয়।

জীবন-যাপনের উপর বাঁধ কি প্রভাব ফেলেছে তা তুলে ধরা হয়েছে-
– বাঁধের ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
– বাঁধের ভাটিতে বসবাসকারি কোটি কোটি মানুষ বিশেষত প্লাবনভূমির স্বাভাবিক কৃষিকর্ম ও মাছ ধরা যাদের জীবিকা তারা তাদের জীবিকা হারায় এবং তাদের সম্পদের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশিলতা ঝুঁকির মুখে পড়ে।
– বাস্তুচ্যুত বহুসংখ্যক মানুষকে হিসেবেই ধরা হয়নি। ফলে তারা কোনো ক্ষতিপূরণও পায়নি।
– যারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণও অপ্রতুল। অনেকেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য বিবেচিত হননি।
– ’৯০ দশক পর্যন্ত বাঁধের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ভাটি অঞ্চলে প্রতিবেশ ও মানুষের জীবনে কি সমস্যা সৃষ্টি হবে তা বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনার সময় ধরা হয়নি।

নদি-প্রাণ-প্রকৃতির ওপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব
বাঁধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ, পানি সরিয়ে নেওয়া বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, আবার এদের মিশ্রণ। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ যে ধরনের প্রভাব বিস্তার করে তার একটা চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো-
১. বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রথম প্রভাব হলো নদির উদ্ভিদ ও প্রাণি যেভাবে নদির স্বাভাবিক জীবন-চক্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকে তার ধ্বংস। অনেক জলজ প্রাণিরই প্রজননকাল বার্ষিক প্লাবণকালের সাথে মিলে যায়। বন্যা পানিকে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় সে কারণে ঝোপঝাড়, গাছপালার আশ্রয়ে অনেক প্রাণি ডিম পাড়তে পারে যা তাদের শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা করে। উদ্ভিদের জীবনচক্রের সাথেও একইভাবে যুক্ত বছরব্যাপি নদির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ, বন্যা ইত্যাদি। ফলে এর যে কোন ব্যত্যয় এলাকার উদ্ভিদ প্রজাতিরও স্থায়ি পরিবর্তন বা বিলুপ্তি ঘটায়। আবার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটা সার্বক্ষণিক পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হয় বলে সেখানে শুকনো মৌসুমেও প্রচুর পানি বাঁধে ধরে রাখতে হয়। বর্ষাকালে অধিক বৃষ্টিপাত হলে অতি আবশ্যিকভাবেই ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি তাকে ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে ভাটি অঞ্চলে দেখা দেয় অকাল বন্যা।

২. জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের জন্য পানি পলিমুক্ত করতে হয় ফলে নদি পলির জন্য হাহাকার করে একদিকে, অন্যদিকে বাঁধের পেছনে জমা হয় প্রচুর পলি। বাঁধের ভাটিতে স্বচ্ছ, টলটলে, ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পানি প্রাণহীন। যেন একটা জীবন্ত নদির বদলে বয়ে চলেছে প্রাণহীন, মৃত জলরাশি। পলির অভাবে উর্বরতা হারায় মাটি, পাখি ও মাছের বাসের অনুপযোগি হয়ে পড়ে নদি। এই জলরাশির গতিও হয় ধির। ফলে অন্যান্য প্রবাহের সাথে যখন তা মেশে তখন তাও শ্লথ হয়। এই মিলিত স্রোতধারার গতির পরিবর্তন ঘটে মিলিত স্রোতে বাঁধ প্রভাবিত নদির স্রোতের অনুপাতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে। কিন্তু গতির একমাত্রা হ্রাসেও যেহেতু তার ১৬ গুণ বেশি পলি পড়ে কাজেই এই মিলিত স্রোতধারায় অধিক পলি পড়ে নদির তলদেশ উঁচু হওয়া এবং অধিক বন্যা এর আরেক পরিণতি।

৩. বাঁধ শুধু পলিকেই নয় লতাপাতা, শাখা, পুরোগাছ, মৃত জীবদেহসহ নানা জৈব পদার্থকেও আটকায়। এগুলো জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির খাদ্য জোগায়। দেয় লুকানোর জায়গা। জৈববস্তুর অনুপস্থিতিতে শৈবাল ও অনুজীবের পুষ্টির উৎস নষ্ট হয়। নদির উজানে এগুলো বেশি পরিমাণে পাওয়া গেলেও ভাটিতে তা একেবারেই মেলে না। আবার উজানে অধিক পুষ্টির যোগানের কারণে অনুজীব ও অন্যান্য প্রাণের অধিক উপস্থিতি দেখা দেয়। তাদের আবার বেশি খাদ্য দরকার হয়। রেচন প্রক্রিয়ায় তারা বেশি অংশগ্রহণ করে। ফলে পানিতে দেখা দেয় অক্সিজেন স্বল্পতা। এই পানিই আবার বাঁধে তোলা হয়, ছাড়া হয় ভাটিতে। ফলে ভাটির প্রতিবেশ হয় বিপন্ন।

৪. পানির তাপমাত্রা মাথাব্যথার আরেকটা কারণ। সাধারণভাবে নদিতে একই ধরনের তাপমাত্রা বজায় থাকে, অন্যদিকে বাঁধের জলাধার হয় স্তরায়িত। এই জলাধারের উপরের স্তরের পানির তাপমাত্রা থাকে বেশি এবং নিচে অনেক কম। সাধারণভাবে পানি নিচের স্তর থেকেই ছাড়া হয় বলে নদির পানি হয় শিতলতর। এই তাপমাত্রায় অনভ্যস্ত প্রাণি বা উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এমনকি ঘটতে পারে তাদের বিলুপ্তি।

৫. বাঁধের কারণে মাছের উজান-ভাটিতে চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হয়। অনেক মাছই আছে যারা জীবনচক্রের কোনো এক পর্যায়ে থাকে উজানে, আরেকবার ভাটিতে, কখনো মোহনায়। যার সাথে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন যুক্ত। মাছের স্বাভাবিক এই গতিতে বাধা পাওয়া মানে তার জীবনচক্রেরই বাধাগ্রস্ত হওয়া। অনেকসময় বাঁধে মাছ যাতায়াতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। সেক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয় যখন মাছ অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে তখন। নিচে পড়ার কারণেই মাছ মারা যায় না, মারা যায় হঠাৎ পতনের পর বাঁধের নিচের দিকটাতে নাইট্রোজের উচ্চমাত্রার কারণে। এই নিচের পানিই আবার ছাড়া হয় নদির ভাটিতে ফলে প্রভাব পড়ে সেখানেও। আরও একটা ব্যাপার হলো অনেক মাছ, ‘মাছ উত্তোলক’ বিশেষ ব্যবস্থায় আদৌ উঠতে পারে না। ফলে তারা দ্রুত শিকার হয় অথবা জীবনচক্র শেষ করতে না পেরে মারা যায়।

৬. সাধারণভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে দিনের বেলায় যখন বিদ্যুতের চাহিদা ও দাম বেশি থাকে তখন বেশি পানি ব্যবহার করা হয় এবং রাতের বেলা তা দিনে ব্যবহারের জন্য ধরে রাখা হয়। এর ফলে একদিকে যেমন তা হঠাৎ প্লাবনের সৃষ্টি করে মাটির ক্ষয় ঘটায়, তেমনি তার পলি, প্রাণ ধ্বংস হয়।

 

টিপাইমুখের ক্ষতিকর প্রভাব
প্রথমত. জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে পানি প্রবাহ কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। জলবিদ্যুৎ বাঁধের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহের গতি বহুগুণ কমে যাবে। গতি কমার ফল হবে ধান চাষের মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া। কেননা গতি কমার কারণে পানি আসতে দেরি হবে। এছাড়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে পানিতে দ্রবিভূত নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যাবে, পানির তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাবে। ফলে মাছসহ জলজ প্রাণের জন্য ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে এবং হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র্য। এই হ্রাসপ্রাপ্ত গতির পানি মেঘনা নদিতে পড়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদি ত্রয়ির গতি হ্রাস করবে। ফলে নদির তলদেশে পলি পড়ে তা উঁচু হবে।

দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ‘ফুলেরতাল ব্যারেজ’। ভারতিয় পত্র-পত্রিকায় পরবর্তিকালে সেচসহ অন্যান্য সুবিধাদি পাওয়া যাবে বলে উলে­খ করা হয়েছে। ভারতিয় পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও টিপাইমুখ বাঁধের পরবর্তিকালে কাছার সমভূমি অঞ্চলের সেচ প্রকল্প চালুর ‘আশাবাদ’ প্রকাশ করেছে। আবার তারা ব্রহ্মপুত্র নদি যেখানে ভারতে প্রবেশ করেছে সেখানে বিভিন্ন নদিতে বাঁধ দিয়ে ৬৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মেগা পরিকল্পনা নিয়েছে। সেক্ষেত্রে ফুলেরতাল ব্যারেজ না করলে মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ভারতিয় শাসকদের উন্মাদ হওয়ার কি কারণ রয়েছে? টিপাইমুখ ড্যামের সাথে যদি ফুলেরতাল ব্যারেজ যুক্ত হয় তবে শুকনো মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারা নদির গতিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। এই সুরমা-কুশিয়ারা যেহেতু মেঘনায় এসে পড়েছে, কাজেই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদি মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও গতিশিল মিঠা পানির অববাহিকার দেশ বাংলাদেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। কারণ এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা স্রোতধারার ১৫% পানি আসে মেঘনা দিয়ে।

তৃতীয়ত, টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতাল ব্যারেজের মিলিত প্রভাবে এলাকার কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা এই অঞ্চলের কৃষির পুরোটাই পানি নির্ভর এবং তা গড়ে উঠেছে হাওড় অঞ্চলের স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে। এমনকি ফুলেরতাল ব্যারেজ যদি নাও হয় সেক্ষেত্রেও এ অঞ্চলের কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা সেক্ষেত্রে যে পানি আসবে তা হবে প্রাণহীন, পলি বয়ে নিয়ে আসার অনুপযুক্ত। ফলে পাললিক ভূমির যে স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পাবে এবং ধানের জীবনচক্রের যে সময় পানিহীনতাই জরুরি সে সময়েও পানি থাকবে।

চতুর্থত, বৃষ্টিপাতের ৬০-৭০ ভাগ এখানে হয় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। আবার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাধারণভাবে মে-জুনের ভেতরে পূর্ণ পানি ধারণ ক্ষমতা বজায় রাখতে হয় বছর জুড়ে একে কার্যক্ষম রাখতে। বরাক ও এর শাখানদিগুলো সাধারণত বছরের অন্যান্য সময় শান্ত থাকলেও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময় অশান্ত, স্রোতস্বি হয়ে ওঠে। ভূ-প্রকৃতিগত কারণেই বাংলাদেশের সিলেট ও পার্শ্ববর্তি মণিপুর অঞ্চলে বর্ষাকালব্যাপি অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হয়। ফলে এই সময় বাঁধের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে বাঁধের ভাটিতে মনিপুরে এবং বাংলাদেশে অকাল বন্যা দেখা দেবে। আর এভাবে পানি ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তি রাষ্ট্রে বন্যা ঘটাবার নজির যে ভারতের রয়েছে তা এমনকি তাদের সংস্থা সায়েন্স এণ্ড এনভায়রনমেন্ট, ইন্ডিয়াও স্বিকার করে।

পঞ্চমত, টিপাইমুখ বাঁধের ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে মাটির লবণাক্ততা বাড়বে। এছাড়া নদির পানির গতিপ্রবাহ হ্রাস পেলে তার বিরূপ প্রভাবে উপকূল অঞ্চলব্যাপি লবণাক্ততার সৃষ্টি করবে। কেননা জলাবদ্ধ অবস্থায় মাটিস্থ বায়ুর অক্সিজেন হ্রাস পেলে কিংবা অধিক শুকনো অবস্থা সৃষ্টি হলে উভয় ক্ষেত্রেই লবণাক্ততার বৃদ্ধি ঘটে। কারণ নদি যখন সমুদ্রে মিলিত হয় তখন মিঠা পানির স্রোত লোনা পানিকে ঠেলে তার স্থলভাগে প্রবেশকে বাধা দেয়। এক্ষেত্রে মিঠা পানির স্রোতের দুর্বল হওয়া মানে লোনা পানির স্থলভাগে ঢুকে পড়া এবং মাটির লবণাক্ত হয়ে পড়া। ফলে বাংলাদেশের একটি বিরাট অঞ্চল কৃষির অনুপযোগি হয়ে পড়বে।

ষষ্ঠত, যেখানে এই বাঁধ করা হচ্ছে সেটি বিশ্বের ৬টি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি; ফলে এর সংলগ্ন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বাঁধের কারণে ভূমিকম্প প্রবণতা বেড়ে যাবে।

সপ্তমত, ইন্সটিটিউট অভ ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) নামে একটি স্বাধিন গবেষণা সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, টিপাইমুখ পুরোপুরি ক্রিয়াশিল হলে সুরমা কুশিয়ারা নদির প্রবাহ বর্ষাকালে ১০ থেকে ২৩ ভাগ কমে যাবে। কমবে পানির গড় উচ্চতা। এতে সিলেটের ২৬ ভাগ, মৌলভিবাজারের ১১ ভাগ বর্ষাকালে প্লাবন বঞ্চিত হবে। সুরমা-কুশিয়ারা জিবন্ত প্লাবন সৃষ্টিকারি নদির বদলে হয়ে যাবে একটি নির্জিব জলাধার। কুশিয়ারা-বরদল হাওড় শুকিয়ে যাবে। কাউয়ার দিঘি হাওড়ের ২৬ ভাগ শুকিয়ে যাবে। এর প্রভাব সিলেট-মৌলভিবাজারের অন্যান্য হাওড়ের ওপরেও পড়বে।

 

আন্তর্জাতিক নদিসংক্রান্ত বিধিমালা
আন্তর্জাতিক নদির পানি বণ্টন নিয়ে দ্ব›দ্ব-বিরোধের ইতিহাস পুরোনো। সেই প্রাচিন মিশরিয় ফারাওদের আমল থেকেই পানি নিয়ে বিরোধ চলে আসলেও জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের পর নিঃসন্দেহে এই বিরোধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই বিরোধ মিমাংসার জন্য জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক নদি সংক্রান্ত কিছু বিধিমালা প্রস্তাব করা হয়। এই বিধিমালার লক্ষ্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুপ্রতিবেশিসুলভ সম্পর্ক, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জলাধারের সর্বোচ্চ ও টেকসই ব্যবহার। এই লক্ষ্যে তা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেবে-
– ভৌগোলিক, জলবায়ুগত, প্রতিবেশগত বিষয়াবলি
– পানিবিদ্যাগত বিষয়াবলি
– আর্থ-সামাজিক প্রয়োজন
– প্রত্যেকটি দেশের নির্ভরশিল জনগোষ্ঠির আয়তন
– অন্যান্য জলাধারের উপর প্রভাব
– বিদ্যমান বিকল্পগুলোর আনুপাতিক মূল্য
– বিদ্যমান ও সম্ভাব্য ব্যবহার
– সুরক্ষা ও সঞ্চয়

এক্ষেত্রে যেসব সমাধানসূত্র প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো-
– রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সাথে আলোচনা, সমঝোতার প্রক্রিয়ার ভেতরে যাবে। সময়মতো তথ্য জানাবে, পরিবেশগত প্রভাব সংক্রান্ত বিষয়াবলি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করবে, এবং সকল রাষ্ট্রের অধিকার ও বৈরি স্বার্থের বিষয়ে আলোচনা, সমঝোতা করবে। এক্ষেত্রে বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের ভেতরে যৌথ সংস্থা গঠন করতে পারে।
– যখন ভাটি এলাকায় অবস্থিত উজানের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পানি ব্যবহারে বৈষম্যের অভিযোগ করবে তখন তার ন্যায্য বিবেচনা করতে হবে।
– প্রত্যেক নদিকে তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবাহমানতা অনুসারে চলতে দিতে হবে। নদির পানিকে এমনভাবে সরিয়ে নেয়া যাবে না, বা তার প্রবাহের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে এমন বাড়ানো বা কমানো যাবে না যাতে অন্য এক বা একাধিক রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
– প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই তার উপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদিকে এমনভাবে ব্যবহারের অধিকার আছে যাতে তা অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করে।
– অন্য রাষ্ট্রে প্রবাহের পরিমাণ কমে, পানির গুণগত মানের পরিবর্তন ঘটে, প্রবাহের সময়ের হেরফের ঘটে অথবা এগুলোর মিলিত প্রভাব দেখা দেয় এরকম কোনকিছু কোনো রাষ্ট্রেরই করার অধিকার নেই।
– প্রত্যেক ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট বাস্তবতা অনুযায়ি যৌক্তিক ও সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
– যৌথ নদি আছে এমন যেকোনো দেশ কোনো তথ্য জানতে চাইলে অপর রাষ্ট্র দ্রুততার সাথে তা জানাবে। যদি তা দ্রুত হাতের নাগালে না থাকে তবে তা সংগ্রহের খরচ তথ্যগ্রহিতা রাষ্ট্র দেবে।

 

পানিবিরোধ বা জলযুদ্ধ
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি ৬জনের ১জন নিরাপদ পানিয় জলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রতি ৮ সেকেন্ডে পানিবাহিত রোগে মারা যায় একজন করে শিশু। প্রতি বছর ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয় ২২ লক্ষ মানুষের, যার ভেতর ১৮ লক্ষই শিশু। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, সার, কিটনাশক, আর্সেনিক দূষণ, বাঁধ প্রকল্পের জলাবদ্ধতার ফলে লবণাক্ততা, বাঁধের ফলে নদির মৃত্যু সারা পৃথিবীর সামান্য সুপেয় পানিকে আরও বেশি দু®প্রাপ্য, দূষিত, অপেয় করে ফেলছে। পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ জল হলেও মাত্র ২.৫ ভাগ সুপেয়। তার আবার ০.৩ ভাগ মাটির উপরে, সহজলভ্য হিসাবে আছে বাকি ৩০.৮ ভাগ মাটির নিচে এবং ৬৮.৯ ভাগ জমাট বেঁধে আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। যেটুকু সুপেয় পানি পাওয়া যায় তাও মানুষের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট হিসেবেই বিবেচিত হতো এর জন্য মানুষকে তেমন কোনো মূল্য দিতে হতো না। এ্যাডম স্মিথ একবার আফসোস করে বলেছিলেন, ‘যে পানি আমাদের এতো কাজে লাগে তা এতো সস্তা আর যে হিরা তেমন কোনো কাজেই লাগে না, তা এতো দামি। কি অদ্ভুত!’ পণ্যের মূল্য তার প্রাচুর্য, তাতে সংরক্ষিত শ্রমের মাধ্যমেই ঠিক হয়। যে জিনিস অল্প শ্রমে প্রচুর মেলে তা যত প্রয়োজনিয়ই হোক তার দাম সস্তা। পানির ব্যাপারটাও তাই ছিল। কয়েকটি কারণে পানি এরকম মহার্ঘ্য দ্রব্য হয়ে উঠেছে। প্রথমত, সবুজ বিপ্লবে যে ধরনের কৃষির সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে তাতে পানির প্রয়োজনিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পানি শাসনের জন্য যেসব বাঁধ দেয়া হয়েছে তার ফলে বহু নদি, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক জলাধার শুকিয়ে গেছে। তৃতীয়ত, কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা না করে তাকে জলাশয়ে ফেলা এবং জমিতে ব্যবহৃত সার-কিটনাশক পানিকে ক্রমবর্ধমান হারে দূষিত করে ফেলছে। চতুর্থত, ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি ও দূষণ। পঞ্চমত, জীবন ও প্রকৃতির প্রয়োজন আমলে না নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত উপায়ে নগরায়ণ, উন্নাসিক ভোগবাদি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সর্বশেষ পানি বাণিজ্য-বোতলজাত পানি, কোমল পানি, সেচ যন্ত্রপাতির ব্যবসা, বাঁধ নির্মাণের জন্য বৈদেশিক ঋণ বাণিজ্য। এসবের মিলিত ফলে আজ পানি ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায়।

ভিভেন্দির অঙ্গ সংস্থা ইউএস ফিল্টার এর মাইক স্টার্কের অকপট স্বিকারোক্তি ‘প্রতিটি মানুষের প্রতিদিন পানি দরকার এবং কোম্পানিগুলোর জন্য এটা লাভজনক বিনিয়োগের শক্তিশালি ক্ষেত্র।’ ১৯৯১ সালে বহুজাতিক সংস্থাগুলো বিশ্বের ৫ কোটি ১০ লাখ লোকের পানি সরবরাহ করত, ২০০৪ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৪৬ কোটি এবং অনুমান করা হয় ২০১৫ সাল নাগাদ তা হবে ১১৬ কোটির মতো। তাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদির পানি নিয়ে তুরস্কের সাথে ইরাক ও সিরিয়ার ঝগড়া প্রতিদিনই বাড়ছে। জর্ডান নদির ৮০ ভাগ পানি ইসরায়েল আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে যাতে বঞ্চিত হচ্ছে জর্ডান, লেবানন, প্যালেস্টাইন। বাংলাদেশের পানি আটকে রাখছে ভারত। চিন, ভারত-বাংলাদেশের পানি কেড়ে নিচ্ছে বাঁধ দিয়ে। এভাবে দুনিয়াব্যাপিই পানি নিয়ে নানা ধরনের দ্ব›দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান। আর পানি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার ভেতরেও রয়েছে নানা ধরনের বৈষম্য।
এশিয়া, আফ্রিকার পানির যে ব্যবহার হয় তারও একটা বড় অংশ উন্নত বিশ্বের ভোগে লাগে। আফ্রিকার কৃষকরা যে সবজি ফলায় তা চলে যায় ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় সুপার মলে। এশিয়ার চিত্রটাও একই রকম। কেনিয়ার স্ট্রবেরি, শিম আর গোলাপ ফলাতে যে পানি লাগে তার যোগান দিতে গিয়ে সেখানকার খাল বিল শুকিয়ে গেছে। মিশরে সবজি রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো বিক্ষোভের উপর সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছে সরকার। আর এই সবজি উৎপাদন পুরোটাই পানি নির্ভর। ৫০ গ্রাম সালাদের জন্য লাগে ৫০ লিটার পানি, আর ব্রিটেনের শপিংমলে টমেটো, শসা আর লেটুস দিয়ে তৈরি একটি প্যাকেটের জন্য লাগে ৩০০ লিটার পানি।

ভারতের উত্তর প্রদেশে কোকাকোলা কোম্পানি প্রতিদিন ২০০ কিউসেক পানি উত্তোলন করছে আর সেখানকার নারিদের গৃহস্থালি কাজের জন্য পানি আনতে হাঁটতে হচ্ছে ১৭ কিলোমিটার। পুরো এলাকায়ই দেখা দিয়েছে খরা। এই খরা এখন সারা বিশ্বেরই সমস্যা। দিনে দিনে পানি বেশি বেশি করে মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে আর পানির অধিকার চলে যাচ্ছে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের বাইরে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের পানি নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা হচ্ছে এগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবার। এক দেশের পানি অন্য দেশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে দির্ঘ পাইপ লাইন। বাংলাদেশে ভূ-উপরিভাগের পানিও এভাবে পাইপ লাইন দিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ডেকে আনা হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। বিশ্বব্যাংক পানির ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবার শর্তে ঋণ দিচ্ছে গরিব দেশগুলোকে। এই শর্তে ঋণ নিয়ে ঘানাসহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ কারবালার রূপ ধারণ করছে। বাংলাদেশেও চলছে এই অবস্থা। নিরাপদ পানির শ্লোগান দিয়ে মানুষকে পানি কিনে খেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

 

ফারাক্কা থেকে টিপাইমুখ
নদি নিয়ে ভারতের আগ্রাসি পরিকল্পনা নতুন কিংবা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস করে, ভাটি অঞ্চলের প্রয়োজন উপেক্ষা করে নদি শাসনের ইতিহাস ভারতের অনেক পুরনো। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে তাৎক্ষণিক প্রভাবে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে-
১. পানির অভাবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস, ২. জলজ প্রাণের হ্রাস প্রাপ্তি, ৩. শুকনো মৌসুমে নদি পথে যোগাযোগে সমস্যা, ৪. লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন, পানিয় জল ও শিল্পোৎপাদনে বিরূপ প্রভাব। তাছাড়া যেসব দির্ঘমেয়াদি ক্ষতি দেখা যাচ্ছে ও ভবিষ্যতে দেখা দেবে সেগুলো হল-(ক) এক চতুর্থাংশ উর্বর জমির পানির অভাবে অনুর্বর পতিত জমিতে পরিণত হওয়া, (খ) মৎস্য, ফসল, নদি পথের চলাচল ও শিল্পোৎপাদন মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি, (গ) গঙ্গার প্রাকৃতিক প্রবাহের পরিবর্তনের কারণে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘন ঘন বন্যা। (ঘ) ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের পদ্মা নদির একটি বিরাট অংশের শুকিয়ে যাওয়া, যার প্রভাব অন্যান্য শাখা নদির উপরও পড়ছে। এককালের প্রমত্তা পদ্মার বহুস্থানে এখন বর্ষাকালেও হেঁটে পার হওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর আমলে যৌথ নদি কমিশন গঠনের সময় ঠিক হয়েছিল বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু ভারত কখনোই এই শর্ত পূরণ করেনি। ১৯৭৬ সালে ভারতের এই ধোঁকাবাজি জাতিসংঘে তুলে বাংলাদেশ ন্যায্য বিচার চায় এবং জাতিসংঘ উভয় দেশকে এ বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক সমাধানে পৌছুতে তাগিদ দেয়। ’৭৭ সালে শুকনো মৌসুমে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং বেশ কয়েকবারের স্বল্পমেয়াদে বর্ধিতকরণের পর তা ’৮৯ সালে শেষ হয়। এরপর দির্ঘসময় ধরে বাংলাদেশ ১০-১২ হাজার কিউসেক, এমনকি শুকনো মৌসুমে ৯০০০ কিউসেকের চেয়েও কম পানি পেয়ে এসেছে। অবশেষে ৯৬-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্য শুকনো মৌসুমে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি নিশ্চিত করতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপরও চুক্তি অনুযায়ি পানি পাওয়া যায়নি। তিস্তা ব্যারেজে যেখানে সাধারণভাবে ১০ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা, চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৯ সালে সেখানে ছিল এক হাজার ৩৩ কিউসেক, ২০০০ সালে যৌথ নদি কমিশনের বৈঠকের পর তা বেড়ে চার হাজার পাঁচশ ৩০ কিউসেক দাঁড়ায়। ২০০১ সালে আবার কমে দাঁড়ায় এক হাজার চারশ ছয় কিউসেক। ২০০২-এর জানুয়ারিতে এক হাজার কিউসেক, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে এগার শ কিউসেক, ২০০৭-এর জানুয়ারিতে পাঁচশ ২৫ কিউসেক এবং ২০০৮-এর জানুয়ারিতে পনের শ কিউসেক। এভাবে ভারত দিনের পর দিন সমস্ত চুক্তি লঙ্ঘন করে আসছে এবং বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে আসছে ন্যায্য পাওনা থেকে।

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পায়নি পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারও। ভারতের অভ্যন্তরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির বিপুল অংশ নানান ধরনের বাঁধ নির্মাণের ফলে উচ্ছেদ হয়েছে। নদি শাসন করে, কৃত্রিমভাবে নদির গতিপথ পরিবর্তন করে আন্তঃনদি সংযোগের মহাপরিকল্পনাও নিয়েছে ভারত। এগুলো সবই পানি নিয়ে সামনের দিনে দুনিয়াব্যাপি সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ধের অংশ। এবং ভারত এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদি ব্যবস্থার আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্যই। মার্কিন নেতৃত্বাধিন সাম্রাজ্যবাদি বিশ্বব্যবস্থার উপকেন্দ্র হিসেবে ভারত-মার্কিন সংযুক্তি এখন অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় শক্তিশালি। এই উপকেন্দ্রের চারপাশের সমস্ত দেশই তাদের কাছে নিজেদের অর্থনীতির পশ্চাদভূমি অর্থাৎ তাদের বিচারে বাজার ও কাঁচামালের যোগানদাতা এবং সম্পদ লুণ্ঠনের ক্ষেত্র। এই দেশগুলোর স্বাধিনতা, সার্বভৌমত্ব, জীবন, প্রকৃতি, সম্পদ সবই কেন্দ্র-উপকেন্দ্রের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে নিয়োজিত।

বাঁধ নির্মাণ শুধু বাঁধেরই নির্মাণ নয় একই সাথে মতাদর্শেরও নির্মাণ। যে মতাদর্শ উন্নয়নের। নয়া-উদারতাবাদি নগদ লাভের হিসাব নিকাশের। যেখানে লাভ-ক্ষতির বিবেচনাটা নিখাদ অর্থের মাপকাঠিতে হয়। মানুষের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি যেখানে তুচ্ছ। যে উন্নয়নে কিছু মানুষের জন্য বলি দেওয়া হয় বিশাল জনগোষ্ঠি। বড় বড় বাঁধ দিয়ে নদিকে মেরে ফেলার, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এখনই, কেননা এর সাথে অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। আন্তর্জাতিক ও দেশিয় প্রতিরোধ-প্রতিবাদ এবং জনমত গঠনই পারে টিপাইমুখ বাঁধ তথা পরিকল্পিত সকল বড় বাঁধের বিরুদ্ধে সফল বিরোধিতা, সে লক্ষ্যেই আগামির সকল আন্দোলন হওয়া উচিত।

তথ্যগুলো ‘প্রতিবেশ আন্দোলন’ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত পুস্তিকা থেকে নেয়া হয়েছে
শেয়ার করুন: