বাঙালির আড্ডা নিয়ে লিখতে বসে যেসব বিষয় মনের আকাশে ভিড় জমাচ্ছে সেগুলো হলো তার চমৎকার আড্ডাবিষয়ক উত্তরাধিকার। আড্ডার সাথে জড়িয়ে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, অর্থনীতি। ‘কফি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই…’ মান্না দে’র অসাধারণ গায়কিতে নিজেদের হারানো আড্ডাটা যেন চোখের সামনে সেলুলয়েড হয়ে ধরা দেয়। আহ্, সেই দুর্বিনিত সময়ে যদি আবার ফেরা হতো!
আড্ডা কী শুধু নিছক আড্ডা। সমাজ-সভ্যতা রাজনীতি সাহিত্যের অনেক বড় বড় বিষয়গুলোর সমাধান বেরিয়ে এসেছে এই মামুলি আড্ডা থেকেই। ঢাকা অথবা কলকাতার সাহিত্যিকদের সেই বিখ্যাত আড্ডাগুলো এখনো জীবন্ত। পত্রিকাকেন্দ্রিক আড্ডাগুলো মরে গেছে, কর্পোরেট ঝাকানাকা মুক্ত পুঁজির বাজার অর্থনীতি বাঙালির অনেকদিনের ঐতিহ্য আড্ডাকেও শেষ চিতায় আরোহন করিয়ে দিয়েছে। উদার মুক্ত প্রকৃতি যেমন নেই তেমনি নেই মুক্ত প্রাণের প্রবাহ সেই আড্ডাগুলোও। দেয়াল-পাথরের ঢাকা শহর বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচর্চায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, অবরুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে চেতনার সবগুলো দরোজা। ঢাকায় সাহিত্যিকদের বিখ্যাত আড্ডা ‘বিউটি বোর্ডিং’-এর কথাই ধরা যাক, এখানে একসময় আড্ডা জমিয়ে তুলেছিলেন অনেকেই। স্মৃতিচারণেও লিখেছেন কেউ কেউ। তারুণ্য আর রাজনীতির জমাট আড্ডা সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মধুর কেন্টিন’ এখনো তার আভিজাত্য ধরে রেখেছে। বইবাজার হিসেবে পরিচিত ‘আজিজ সুপার মার্কেট’-এ সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, নাট্যকারদের জমাট আড্ডা। স¤প্রতি বইয়ের মার্কেট ‘কনকর্ড এম্পোরিয়াম’-এ কিছু কিছু আড্ডা হচ্ছে। একসময়ের নিউ মার্কেটের আড্ডা এখন সুখস্মৃতি। আমাদের ধারণার বাইরে অনেক জায়গায় নিশ্চয়ই আড্ডা হয়, এখনো হচ্ছে।
তবে সৃষ্টিশিল আড্ডা কমে যাচ্ছে। তারপরও যেকটি এখনো টিকে আছে এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে আলাপে আলোচনায় ব্যতিব্যস্ত আছে-টিএসসিকেন্দ্রিক কিছু সংগঠনের আড্ডা, কবিতাকর্মিদের পরিচালিত আড্ডা, চারবাক পরিচালিত ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে শিল্প-সাহিত্য রাজনীতির আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আড্ডা’, আহমদ শরীফের বাসভবনে অনুষ্ঠিত আড্ডা, রাজনীতির পাঠ নিয়ে আড্ডা ‘গণ-সংস্কৃতি কেন্দ্র’, এশিয় শিল্প-সংস্কৃতি সভা ‘কাক’-এর আড্ডার কথা মনে পড়ছে।
ইট-পাথরের দেয়ালের ভারে ক্রমশ যখন ন্যূব্জ হয়ে পড়ছি আমরা, একচিলতে আকাশ দেখবার বাসনায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে যখন একাকি, ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, চটকদার পণ্যপুঁজির সীমাহীন লোভ আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তখন একটু আলো একটু উন্মুক্ত জায়গার দরকার হয়, যেখানে পা রাখা যায়, নিজেদের কথা নিজেকে শোনানো যায়। সত্য এটাই তেমন জায়গা ঢাকা শহরে ক্রমেই কমছে, কমে যাচ্ছে আমাদের ব্যপ্তি, আকাক্সক্ষা, অবলোকনের সীমানাও।
বিশ বছরের বেশি সময় ধরে ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ বাঙালির আড্ডা জিইয়ে রেখেছে। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের আড্ডা কি নিছক আড্ডাই? এখানে কারা আসেন? আড্ডার ধরনইবা কি?
কবি অঞ্জনা সাহার ভাষায়, ‘এখানে যে নবিনরা নিয়মিত আসেন, সব দেখে শুনে মনে হয়েছে, তারা একদিন কুঁড়ি থেকে বিকশিত গোলাপ হয়ে নিশ্চিতভাবে সৌরভ ছড়াবেন। এই কাজে ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ যে নিভৃত বিপ্লব দান করে চলেছে, তার সঙ্গে কণামাত্র যুক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।’ নবিনরা আসেন একথা সত্যি, আসেন বিভিন্ন পাঠচক্রের সাথে জড়িত শিক্ষার্থিরা জ্ঞানের অšে¦ষণে। গড় আড্ডা এদের দ্বারাই সংগঠিত হয় প্রতিদিন। তার বাইরে আছে বিভিন্ন পেশার মানুষের আড্ডা-রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মি, পরিবেশবাদি, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, কবি, থিয়েটারকর্মি, সংগিতশিল্পিদের আড্ডা।
ফলে আড্ডার বিষয় পলবিত হয় বিভিন্ন খাতে। সা¤প্রতিক রাজনীতির বিষয় যেমন রেখাপাত করে মুক্ত আলোচনায় তেমনি প্রাধান্য পায় বর্তমান সময়ে রচিত সাহিত্য, সংগিত, কবির কবিতা, শেয়ারবাজার, কাঁচাবাজার বিষয়ক ঘটনাবলিও। প্রাসঙ্গিক কারণেই হয়তো বিষয় হিসেবে চলে আসেন খালেদ চৌধুরি (প্রভু), তারেক মাসুদের দুর্ঘটনা অথবা ওস্তাদ আজিজুল ইসলামের বাঁশি। বাদ থাকে না কার নতুন বই বের হলো, কে ভাল লিখছেন। বিশ্বসাহিত্য ও আমাদের অবস্থান নিয়েও তর্ক-বিতর্কে আসর মশহুর হয়। কোন বইটি পড়া যায়, পড়া দরকার এমনতরো হাজারো বিষয়। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের আড্ডা-এত দীর্ঘসময়ব্যাপি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে মুক্তমনা মানুষের আড্ডা বাংলাদেশে আর কয়টা আছে?