কৃষ্ণ বললেন, ধিক ধিক! অর্জুন, আমি বুঝেছি তুমি বৃদ্ধের নিকট উপদেশ লাভ করনি, তাই অকালে ক্রুদ্ধ হয়েছ। তুমি ধর্মভীরু কিন্তু অপণ্ডিত; যাঁরা ধর্মের সকল বিভাগ জানেন তাঁরা এমন করেন না। যে লোক অকর্তব্য কর্মে প্রবৃত্ত হয় এবং কর্তব্য কর্মে বিরত থাকে সে পুরুষাধম। আমার মতে প্রাণিবধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বরং অসত্য বলবে কিন্তু প্রাণিহিংসা করবে না। যিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা, ধর্মজ্ঞ ও রাজা, নিচ লোকের ন্যায় তুমি তাঁকে কি করে হত্যা করতে পার? তুমি বালকের ন্যায় প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এখন মূঢ়তার বশে অধর্ম কার্যে উদ্যত হয়েছ। ধর্মের সূ² ও দুরূহ তত্ত¡ না জেনেই তুমি গুরুহত্যা করতে যাচ্ছ। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, বিদুর বা যশস্বিনি কুন্তি যে ধর্মতত্ত¡ বলতে পারেন, আমি তাই বলছি শোন।-সত্য বলাই ধর্মসংগত, সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছু নেই; কিন্তু জানবে যে সত্যানুসারে কর্মের অনুষ্ঠান উচিত কি-না তা স্থির অতি দুরূহ। যেখানে মিথ্যাই সত্যতুল্য হিতকর এবং সত্য মিথ্যাতুল্য অহিতকর হয়, সেখানে সত্য বলা অনুচিত, মিথ্যাই বলা উচিত।-বিবাহকালে, রতিসম্বন্ধে, প্রাণসংশয়ে, সর্বস্বনাশের সম্ভাবনায়, এবং ব্রাহ্মণের উপকারার্থে মিথ্যা বলা যেতে পারে; এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।
মহাভারত, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, সারানুবাদ- রাজশেখর বসু, পৃ. ৪৯৩, কলকাতা
যার সাধারণ জ্ঞান আছে, সে-ই বুঝতে পারবে চোখের বিভ্রম দুরকমের। দুটি কারণে এই উদ্ভব। একটি কারণ হচ্ছে, অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসা। অপরটি আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়া। দেহের চোখের ক্ষেত্রে এ কথা যেরূপ সত্য, মনের চোখের ক্ষেত্রেও এ কথা তেমনই সত্য। এই সত্য যার জানা আছে সে যখন কারুর দৃষ্টিভ্রম দেখে, তখন তার হাসির কোনো কারণ থাকে না। তার প্রশ্ন হবে, যে বিভ্রান্ত সে কি উজ্জ্বল আলো থেকে অন্ধকারে এসেছে এবং তার চোখ এখনও অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়নি? কিংবা অন্ধকার থেকে সে দিনের আলোতে বেরিয়ে এসেছে এবং আলোর আধিক্যে তার চোখ ধাধিয়ে গেছে? কেউ যদি তার মতো সত্যের সন্ধান লাভ করে থাকে তাকে সে নিজের মতোই সুখি বলে বিবেচনা করবে। কিন্তু যে আলো থেকে অন্ধকারে গেছে তার জন্য অবশ্যই তার সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু সে যদি অন্ধকার থেকে আলোতে অতিক্রান্ত আত্মাকে পরিহাস করতে চায়, তা হলে যে ঊর্ধ্বদেশ থেকে গুহার অন্ধকারে প্রত্যাবর্তন করেছে তার প্রতি তার পরিহাসের চেয়ে তাকে অধিক হেতুময় হতে হবে।
প্লেটোর রিপাবলিক, অনু- সরদার ফজলুল করিম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃ. ৩৩৮
বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচর্চার সূচনা ঠিক কবে হয়েছিল সন তারিখ গণনা করে বলা না গেলেও একথা জোর দিয়েই বলা চলে, তার চিন্তাচর্চার ইতিহাস একেবারে আটপৌঢ়ে নয়। হৃদ্য মননচর্চায় সে পিছিয়ে একথাও বলা যাবে না। সমৃদ্ধ চিন্তাচর্চার ইতিহাস যেমন তার সযতœঅর্জিত তেমনি জ্ঞান বিতরণেও সে কখনো পরাক্সমুখ হয়নি। যদিও অনেকে বলবার চেষ্টা করেন বাঙালির কোনো দর্শন নেই, অতএব তার চিন্তাও নেই। কথাটা সত্যি নয় একেবারেই সা¤প্রতিক বিভিন্ন তথ্যনথি উদ্ঘাটনে টের পাওয়া যায়। আমাদের বলবার কথা স্পষ্ট, বাঙালি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারি, জাতিসত্তা নিয়ে গৌরব করবার যথেষ্ট মূলধন তার আছে। বহিশত্র“র আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে যদিও বারবার, তেমনি ঠকে ঠকে বিভিন্ন জাতি-উজাতি-বিজাতির সংস্পর্শে আসার দরুণ মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে তার চিন্তাকে সাজাতে সক্ষম হয়েছে সে।
ভাবমার্গের সুস্পষ্টতা বাংলা তথা বাঙালির আপন অধিকার। আলস্য আর কর্মনিস্পৃহতা তার পুরুষ-পৌরুষক্রমে বংশপরম্পরার স্মারক। জাতিগত প্রাপ্য অর্জনকে সে যেমন চেনে না, তেমনি অনুসন্ধান করে না তার শ্রেষ্ঠত্বকে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নিচুতাকেও আপন ঔদার্য্যে শ্রেষ্ঠ ভাবে সে। আর্যরা এদেশিয় অনার্যদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যেমন করতে পেরেছে সহজে, তেমনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তাদের কর্তৃত্ব। উপনিবেশের মোহনমায়ায় এদেশের আদি অনার্যরা (আর্যরা তাদের আদর করে দাস আখ্যা দিয়েছিল) এমনতরভাবে মজেছে যে আজো তার ছোয়াচ টের পাওয়া যায়। তার পরের ইতিহাসতো উপনিবেশেরই। বিদেশিরা এসেছে, বিস্তার করেছে তাদের সাম্রাজ্যের ডালপালা।
বাঙালির চিন্তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হয় বৈকি, তার চিত্তবৃত্তির ক্ষরণ, ঔদার্য্য, মেজাজ, প্রকৃতি, কর্মনিস্পৃহতা, ভাবালুতা, আরাধনা, যোগ, শাক্তসাধনা বিষয়গুলোকে বাদ দেয়া চলে না। পূজাঅর্চনার সাথে সে যেমন তার সংস্কৃতির ল²িকে একাসনে স্থান দেয় তেমনি প্রকৃতির খেয়াল মুগ্ধতা তার উপর অলৌকিক বিভা ছড়িয়ে দেয়। নাস্তিক্যবাদি বুদ্ধদর্শন, নানক, কবির, বাউল, একতারার সঙ্গত এখানে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারেনি সাধারণ জনমানসে। যাগযজ্ঞ, ব্রাক্ষণদের প্রতাপ যত বেড়েছে ক্ষয়িষ্ণু থেকে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে চিন্তার মানসকাঠামো। নালন্দা-তক্ষশিলার মতো পাঠঅধ্যয়ন এখানে গড়ে উঠতে পেরেছিল। কর্মমুখি দর্শন বেদ প্রাধান্য পেয়েছে। গলদটা শুরু হয়েছে আরো পরে ধীরে ধীরে। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জায়গায় জাতপাত সমাজসংস্কৃতি অসাম্য যত প্রবল হয়েছে শ্রেণিবিভাজন তত বড় হয়ে গেছে। কর্মমুখি বেদের জায়গায় সহজেই ঊপনিষদ জায়গা করে নিয়েছে। বিরুদ্ধ মতকে বলপ্রয়োগে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পেরেছে এখানে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ অনেককেই আকৃষ্ট করেছিল। ফলে নিরন্তন বাইরে থেকে লোভি দস্যুর দল হানা দিয়েছে। আরব, পর্তুগিজ, ইংরেজ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে বহুসংস্কৃতি, বহুধর্ম, বহুমত। কার উপর কে যে প্রভাব ফেলেছে বলা মুশকিল, মোদ্দাকথা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জগতটা আসল আদি ঐতিহ্যে থাকেনি, বিলিন হয়ে গেছে বহুসংস্কৃতির উঞ্ছবৃত্তে। আবার, বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি সভ্যতার গতিমুখ, গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞাননির্ভর হয়েছি বটে, নিজের নির্ভরতা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি, কিন্তু আচার-আচরণ-ধ্যান চিন্তায় স্থবির-পঙ্গু-জড় চিন্তার ভার বইছি মননে। বিজ্ঞানের বাহ্যিক খোলস স্কন্ধে চাপালেও আন্তর-সম্পর্ক বিজ্ঞানবিমুখই রয়ে গেছে আগাগোড়া।
পলাশির পর ইংরেজরা এদেশের বিস্তর ধনসম্পদ লুঠ করে স্বদেশে নিয়ে যায়, তাদের নানামুখি নীতি ও আইনকানুন এবং শিল্পবিপ্লবের চাপে নানা পরিবর্তন আসে চেতনায়। ঔপনিবেশিক-ব্যবস্থায় এদেশি বণিক ব্যবসায়িদের স্বাধিন উদ্যোগ ও স¤প্রসারণের সুযোগসুবিধা দ্রুত কমে যায়। গোড়ায় এদেশি দোভাষি, দালাল, পাইকার, মহাজনেরা কোম্পানির সেবা করে এবং অল্প কিছু বণিক ব্যবসায়ি ইংরেজদের সহযোগিতা করে দ্রুত ফুলে ফেঁপে ওঠে, কিন্তু তাদের টাকা মুখ্যত নিযুক্ত হয় জমি কেনায় এবং ব্যয়িত হয় বেহিসেবি ব্যসনে-উৎসবে, আচার-অনুষ্ঠানে। স্বাধিন ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ কম এবং তাতে বিস্তর ঝুঁকি-ঝামেলা দেখে তাদের সন্তানেরা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষিতরা সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে আগ্রহি হয়ে ওঠে, যা থেকে আজও আমরা বেরুতে পারিনি। আর্য থেকে মোগল-আফগান-আরব মুসলমান হয়ে ইংরেজ পর্যন্ত যে বিশাল ভাগ্যান্বেষি অথবা সাম্রাজ্যবাদি-ঔপনিবেশিক শক্তি এদেশের বিপুল-বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে নিছক ক্ষুন্নিনিবৃত্তির জন্যে এসেছিল তারাই একদিন ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে। অবশ্য আর্য কিংবা মোগল-আফগানদের কেউ কেউ এদেশের সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। বৃহত্তর অর্থে জাতি কিংবা রাষ্ট্রনৈতিক রাজনীতির সাথে ভারতবর্ষের পরিচয় আরেকটু পরের ঘটনা। এখানে জাতি-রাষ্ট্র-সাম্রাজ্য সম্পর্কিত ধারণার যেমন অভাব ছিল, তেমনি রাষ্ট্র-পরিচালনায় এদেশিয়রা বরাবরই অনিহ এমন ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আধ্যাত্মিক-মরমিয়া কিংবা মুনি-ঋষিদের তপোবন প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া যায়নি। বেদ বা কর্মকাণ্ডে যৌক্তিক কারণে এরা পিছিয়ে পড়ে অথবা আগ্রহের অভাবে বেশি দূর এগোয়নি, পক্ষান্তরে উপনিষদ বা জ্ঞানকাণ্ডে এদের প্রবল উৎসাহ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত উপনিষদ দ্বারা প্রবলভাবে নিমজ্জমান, গানে কবিতায় উপনিষদকে আঁকড়ে ছিলেন। বৃহৎ সাম্রাজ্যবিস্তার কিংবা কিছুটা সাফল্য মনে হয় সম্রাট অশোকের সময়ে সম্ভব হয়েছিল। আর উদার ভারতিয়রাতো বরাবরই আর্যদের যেমন আলাদা একটা জাত হিসেবে মেনে নিয়েছে, তেমনি গ্রহণ করেছে আরব-আফগান মুসলমানদেরও। ইংরেজদেরও ভেবেছিল বহুজাতিরই একটি, না হয় আর একটা জাত বাড়ল, এমন ভাবনাও এদেশিয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অসংগত নয়। বিজাতিয় বহিরাগত প্রতিটি শক্তি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে বড় করে দেখেছে, এদেশিয়দের হীন করার চেষ্টায় মেতেছে। মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ যখন অহিংসার বাণি প্রচার করেন, নিম্নবর্গিয় মানুষ দলে দলে বুদ্ধের বাণির শিতল ছায়ায় এলো, বহু জাত-পাতে বিভক্ত ভারতিয় সমাজে বিষয়টি বেশ তাৎপর্যের। উচ্চবর্গিয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শক্তি সহজে মেনে নিতে পারল না, যতদিন রাজশক্তির ছায়ায় বুদ্ধধর্ম ততদিন বড় ধরনের কোন সংঘাত মোকাবেলা করতে হয়নি তাদের, কিন্তু যখন ব্রাহ্মণ্যবাদি উচ্চবর্গিয়দের প্রভাব-প্রতাপ বাড়ল, তখন নির্মমভাবে বুদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের হত্যা করা হল, অত্যাচার করা হল অকথ্যভাবে। ইসলাম আগমনে অত্যাচারিত নিম্নবর্গের মানুষ এবং বুদ্ধরা দলে দলে সে ধর্ম গ্রহণ করল নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে। বুদ্ধের সময় থেকে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের বিলোপকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণদের ঘাত-প্রতিঘাতের বিস্তর সাক্ষ্য বিদ্যমান। হিন্দুদের উপর বৌদ্ধদের প্রভাব অথবা বৌদ্ধদের উপরে হিন্দুদের প্রভাব যতখানিই পড়ে থাক না কেন, দুঃখবাদ, সংসারবিমুখতা এবং সন্ন্যাসি অথবা ভিক্ষুর আদর্শের জন্য কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে ঋণি ছিলেন একথা ধোপে টেকে না। এই ধারাটি ভারতবর্ষে সম্ভবত ইতিহাসের সূচনা থেকেই ছিল, কখনো বেশি কখনো কম প্রাধান্য পেয়েছে। ঐতিহাসিকের মতে জৈনদের আদি তীর্থঙ্কর ঋষভ ছিলেন নবম খৃষ্টপূর্ব শতকের মানুষ। তবে সংঘ জাতিয় সংগঠনের পরিকল্পনা সম্ভবত বুদ্ধ থেকেই শুরু হয়। সিন্ধু সভ্যতার ভিতরে থেকে কোনো বিবর্তনমুখি শক্তি ঐ সভ্যতাকে কোনো উন্নততর স্তরে নিয়ে যায় নি। আর্যগোষ্ঠিরা বহিরাগত, তাঁরা জোরজবরদস্তি করে নতুন নতুন অঞ্চল দখল করেছিল। তবে এদেশে আর্য নামে খ্যাত গোষ্ঠিদের প্রবেশের আগেই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান-ব্রিটিশ আমলেও এখানে নগর গড়ে উঠেছে। ইংরেজরা নিজেদের শাসন শোষণ নিরবচ্ছিন্ন করতে অনেক কৌশল জন্ম দিয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পাতল রেল-লাইন, ডাক-ব্যবস্থার প্রবর্তন করল, আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোর সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় তখনই, অস্বীকার করা যাবে না। প্রবল জাত্যাভিমানে ইংরেজদের সাথে সাথে ইংরেজ হয়ে উঠবার কসরত দেখায় কেউ কেউ। তবে প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। উনিশ শতকের বাঙালির সাধনার বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল জাতি-বৈষম্য। ব্রিটিশরা চেয়েছিল এমনভাবে শিক্ষিত করতে যাতে করে আমরা তাদের অধিনস্থ হয়ে থাকি চিরকাল। বিদ্যাবুদ্ধি ও পদমর্যাদায় বাঙালি তখন ইউরোপিয় সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল কিন্তু সমমর্যাদার স্বীকৃতি পায়নি তারা। শুধু সমমর্যাদা নয়, ইউরোপিয় ও ভারতিয়দের মধ্যে বেতন বৈষম্য ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের কালেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনেই এই শ্রেণির বিকাশে সহায়তা দিয়েছিল। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বিভিন্ন ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। আবার রেনেসাঁস থেকেই ইউরোপিয় মানস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এদেশে। আঠার শতকের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে এটি সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করে। যন্ত্র-প্রচার-মারণাস্ত্রের সাহায্যে সারাবিশ্বকে নিজস্ব প্রভাববলয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় তারা। লজ্জার কথা, রেনেসাঁসের মানুষই সাম্রাজ্যবাদি ও বিকৃত চেহারায় পরিণত হয়। বুর্জোয়াতন্ত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সহায়তায় পৃথিবীর ক্ষুদ্র-প্রান্তিয় দুর্বল জাতিগোষ্ঠির উপর আর্থিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখে। সর্বগ্রাসি পণ্য ও বাজার দখলের স্বার্থে গড়ে তুলে বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার।
২.
বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রাজা রামমোহন রায়ের অবদানের কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, সম্ভবত বুদ্ধিবৃত্তিকদৈন্য গোচাতেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। এক্ষেত্রে হিন্দু কলেজের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। হিন্দু কলেজের প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ডিরোজিও ও ইয়ংবেঙ্গলদের কথা। প্রথাভাঙার দুঃসাহস, পরিবার সমাজ ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে, প্রচল ধারার বাইরে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় নিজেকে মেলে ধরবার সেইতো প্রথম প্রচেষ্টা। তবে বাঙালি মুসলমানদের এই আলোকায়নে একটু দীর্ঘসূত্রিতাই লক্ষিত হয়, নিকষ আঁধার ভাঙতে তাদের বেশ সময় লেগে যায়। এ অঞ্চলে প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সূচনা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, না আরো পরের ঘটনা খতিয়ে দেখার দরকার আছে। মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় বাঙালি মুসলমানদের অনিহা অনাগ্রহ, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি বিরাগ পিছিয়ে দিয়েছে সন্দেহ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে জগন্নাথ কলেজকেন্দ্রিক একটা ক্ষীণস্রোত ছিল। বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রথম সাংগঠনিক প্রয়াস সম্ভবত শিখাপত্রিকাগোষ্ঠি কেন্দ্রিক। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে একঝাঁক নবিন একত্রিত হয়েছিলো সাম্যসন্ধানে, কুসংস্কার দূর করে আলোকের মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখতে। কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আবুল হুসেন একত্রিত হয়েছিলেন মুসলমান সমাজের দৈন্যদশার উত্তরণে। কাজী নজরুলের মতো প্রতিভাকে উপেক্ষা করা যাবে না এই মুক্তির মিছিল থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বাঙালির মুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চায় এক ব্যতিক্রমি ব্যক্তিত্ব। পাশ্চাত্য রেনেসাঁস বা আলোকায়ন যাকে বলা হয় প্রকৃত অর্থে এতদঞ্চলে সেরূপ কিছু ঘটেনি তা জোর দিয়েই বলা চলে। সাম্য মৈত্রি মুক্তির যে বাণি প্রচারিত হয়েছে তার যথার্থ প্রতিফলন কতটুকু সম্ভব হয়েছিল তা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ।
৩.
সর্দারশাসিত ও মসজিদের শহর ঢাকা জ্ঞানের চর্চায় পিছিয়ে ছিল নানা কারণেই, প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক আলোকায়ন তথা পাশ্চাত্যশিক্ষার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছিল ধর্মিয় অন্ধত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রথম সুযোগ ঘটলো জগতজীবনকে নতুন করে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের, মুক্তচিন্তার চর্চাও গতি পেল। কলকাতাকেন্দ্রিক যে নবজাগরণের ঢেউ তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বুদ্ধিবৃত্তিকচিন্তায় নতুন অধ্যায় রচিত হয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটি বড় ধাক্কা। ষাটের দশক প্রস্তুতির, সত্তরের দশক লড়াই সংগ্রাম যুদ্ধ উন্মাদনার, আশিতে মনন স্থিতু হয়, এবং প্রকৃত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় সে মনোনিবেশ করতে শেখে। অবশ্য দীর্ঘকালিন সামরিক শাসন আমাদের নানাক্ষেত্রেই পিছিয়ে দিয়েছে, তার জের টানতে হচ্ছে এখনো। আশির পর এবং নব্বইয়ের শুরুতে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। তেমনই একটি সংগঠন ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’। শুরু হয়েছিল ‘চিন্তার ইতিহাস’ পাঠ অধ্যয়ন চক্র দিয়ে, পরিচালনা করছেন অধ্যাপক লিয়াকত আলি বাইশ বছরের অধিক সময় ধরে। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকাখ্যাত মীজানুর রহমানের ভাষায়, ‘সমাজের কিছু ক্ষণজন্মার দেখা যাঁদের নিজেদের যত না ভাবনা পরের তরে তার চেয়ে বেশি। এঁরা মননে আঢ্য. আলাপে শিরিন জবান এবং এঁদের দর্শনমাত্রেই হর্ষোদয় হয়। এমনই এক চারুব্রতি লিয়াকত আলি। তাঁর চিত্তবৃত্তির স্ফ‚র্তি ঘটে যে প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে তার নাম ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’। কোনো শ্বেতকাক নয়-এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রয়েছে প্রকৃত মানুষ গড়ার নানা আয়োজন। এই আয়োজনে রয়েছে পঞ্চবন্ধনমুক্তি ও হৃদয়শুদ্ধির মন্ত্র।’
৪.
প্রচলিত অর্থে দর্শনের আলোচনা বলতে যা বোঝায় ‘চিন্তার ইতিহাস’ মোটেও তা নয়, ‘চিন্তার ইতিহাস’ বিজ্ঞানেরও ইতিহাস পাঠচক্র বটে। দর্শন অধ্যয়নের নামে আমাদের একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে ধর্মিয় ইতিহাস, অধিবিদ্যার চর্চায় রত সেখানে অধ্যাপক আলি পরিচালিত ‘চিন্তার ইতিহাস’ পাঠচক্র বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানমুখি সমাজ সংগঠন গড়ার দিকেই মনোযোগি। আধুনিক বিজ্ঞানের সা¤প্রতিক গবেষণা এবং তার দর্শন নিয়েও অবলিলায় আলোচনা চলে এখানে। অধ্যাপক আলির ভাষায়, ‘জ্ঞানই শক্তি’-ফ্রান্সিস বেকনের এই উক্তিটি বোধ করি মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে অপব্যবহৃত একটি উদ্ধৃতি। বিশেষত সমাজে এ কথা আরও সত্য। ইউরোপিয় রেনেসাঁর একটি সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক বিশ্ববিক্ষার অন্যতম প্রধান পুরোহিত বেকন একটি বিশেষ পদ্ধতির দ্বারা আহরিত উপাত্তভিত্তিক চিন্তার ফসলকেই কেবল ‘জ্ঞান’ বলেছিলেন। বেকনের আগে ও পরে বহু মানুষের শ্রম ও সাধনার দ্বারা জ্ঞানের এ পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে যাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘বিজ্ঞান’। আজ বিংশ শতকের শেষে, সূ² বিষয়ে অনেক পার্থক্য থাকাসত্তে¡ও, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌল পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ঐক্যমতের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ, মজার ব্যাপার, এসব পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরিত মেরুতে বসেও এক শ্রেণির মানুষ নির্বিচারে বেকনদের উদ্ধৃত করে নিজেদের চিন্তাচেতনাকে জ্ঞান বলে দাবি করছেন।’
৫.
অধ্যাপক আলি তাঁর মত কারো উপর চাপিয়ে দেন না, যদিও তাঁর নিজস্ব মত আছে। স্বাধিন চিন্তা উসকে দিয়ে শিক্ষার্থির জ্ঞানতৃষ্ণা জাগ্রত বা জানার উপায় চিিহ্নত করেন মাত্র। ‘চিন্তার ইতিহাস’ প্রকৃত অর্থেই আনন্দময় এক ভ্রমণ, যে ভ্রমণ শেষ করে দুই বছর পর একজন শিক্ষার্থি তার নিজস্ব পথ চিনে নিতে পারে। বাস্তব প্রায়োগিক জীবনের একটি প্রাথমিক খসড়া শিক্ষার্থি এখান থেকেই পেয়ে যান, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় হিসেবে পথ চলতে সহায়তা করে। অধ্যাপক আলির সচেতন লক্ষ সত্যিকার বিজ্ঞানমনষ্ক একজন আধুনিক মানুষ, পণ্ডিত বা দার্শনিক তৈরি করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই, যদিও লেখক-বুদ্ধিজীবী বা পণ্ডিত কেউ হতেই পারে। অধিকাংশ মানুষই জ্ঞানের সঙ্গে অজ্ঞান ও কুজ্ঞান-এর তফাৎগুলো খুব সতর্কভাবে দেখে না, ফলে মানসিক বয়ঃসন্ধির বিবিধ পর্যায়ে আটকে থাকে। এমনকি কেউ কেউ চিরকাল শিশুই থেকে যায়। অবশ্য মহাবিশ্বকে চিরশিশুর বিস্মিত ও সরল চোখ দিয়ে দেখতে পারার মাহাত্ম্যকে তিনি স্বীকার করেন। আবার এ বলেও সতর্ক করেন, এর সিমা সম্পর্কে সচেতন না থাকলে জগৎ ও মানবসমাজ নিয়ে খুব শিগগিরই ‘ছেলেমি’ শুরু হয়ে যাবে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ সত্য অনুধাবন করে মানুষ তার চিন্তার ফসলকে দুটি পরস্পরসম্পর্কিত কিন্তু সুষ্পষ্টভাবে পৃথক ধারায় প্রবাহিত করে। রবীন্দ্রনাথ যার নাম দেন ‘ভাবের কথা’ আর ‘জ্ঞানের কথা’। এর প্রথমটি প্রধানত ব্যক্তি মানুষের আবেগ অনুভূতির ফসল যেখানে সমগ্র বিশ্বসংসার প্রকৃতপক্ষে তার মনের রঙে রাঙানো। দ্বিতীয়টি প্রধানত সামষ্টিক মানুষের নৈর্ব্যক্তিক চর্চার ফসল যা এ বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনের দ্বারা প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ এবং সে সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। প্রশ্ন অধ্যাপক আলি কোনটিকে প্রধান হিসেবে দেখতে চান। এখানেই চিন্তার পদ্ধতির প্রসঙ্গটি এসে যায়। প্রাত্যহিক জীবনেও প্রতিটি মানুষের জানা দরকার কাদের কথাকে তিনি কতটুকু গুরুত্ব দেবেন ও কোন কোন বিষয়কে তিনি ‘জ্ঞান’ মনে করবেন। আমাদের সমাজে এই বিষয়টি অত্যন্ত ধোঁয়াটে থাকায় এখানে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অপজ্ঞান নির্বিঘেœ তাদের রাজত্ব চালিয়ে যায়।
৬.
মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান মনিষিদের প্রত্যেকেই প্রথমে স্থির করতে চেষ্টা করেছেন যে কোন পদ্ধতির চিন্তাকে তিনি জ্ঞান মনে করেন আর কোনগুলোকে করেন না। পদ্ধতিগত এই ভিত্তির ওপরেই গড়ে উঠে তাদের চিন্তার সৌধ। যারা নিজেরা জ্ঞানের ভিত্তি নিয়ে মৌলিক চর্চা করেননি তারা অন্য কারো মডেল অনুসরণে নিজেদের চিন্তা বিকশিত করেছেন। জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলে জগতে বড় কিছু সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব। অধ্যাপক আলির মতে, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই আমাদের সমাজে যাঁরা জ্ঞানের বিকাশে অগ্রসর হন, দুর্ভাগ্যবশত, তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত। সুপরিকল্পিতভাবে জ্ঞানের পদ্ধতিগত সচেতনতার ভিত্তি তৈরি না করে ঢালাও পাঠাভ্যাস সৃষ্টির ফলে তরুণ ও নিষ্ঠাবান জ্ঞানার্থিকে তাঁরা কিছুদিনের মধ্যে পরিণত করছেন আপাত উজ্জ্বল ও ধারালো এক ধরনের উদ্ধৃতিজীবীতে। এসকল তার্কিক জ্ঞানার্থি প্রয়োজনে বিপরিত মেরুর দুই মনিষির চিন্তাকেও নিজের স্বপক্ষে উদ্ধৃত করেন আর ‘প্রচুর পাঠ’-এর চোখ ধাঁধানো বিকিরণ দিয়ে খ্যাতি এবং সাফল্যও লাভ করেন। একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব যে এ ধরনের অন্ধ পাঠ ও লাইব্রেরি আন্দোলন সমাজ ও দেশের উন্নয়নে কোন সুদূরপ্রসারি ভূমিকা রাখতে পারবে না। ‘অজস্র পাঠ নয় নির্দিষ্ট লক্ষে সুনির্বাচিত অধ্যয়ন’-এ সত্য অনুধাবন না করলে আমরা কেবল অজস্র সম্পদ ও মেধার অপচয়ই ঘটিয়ে যাব।’ তাহলে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে, অধ্যাপক আলি কি অজস্র পাঠের বিরোধি? অন্যভাবে যদি বলি একজন জ্ঞানার্থি তার পাঠকে কিভাবে অজস্র পাঠ থেকে বেছে নেবেন? তিনি কিভাবে বুঝবেন কোনটি জ্ঞান আর কোনটি জ্ঞান নয়? দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়, অধ্যাপক আলি পাঠের বিরোধি নন, তিনি চান একজন জ্ঞানার্থি সুচিন্তিতভাবে তার পাঠবস্তুকে বেছে নিক। সেক্ষেত্রে নতুন শিক্ষার্থির পাঠকে সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন এবং জ্ঞান আকাক্সক্ষাকে বাড়িয়ে দিতেই আলির যত প্রয়াস। চিন্তার ইতিহাস পাঠচক্রে তিনি ঠিক সেই কাজটিই করে থাকেন তার সুদীর্ঘ অধ্যয়ন, বৌদ্ধিক বিবেচনাশক্তির প্রয়োগে। কবি আলতাফ হোসেন লিখেন, ‘… অজস্র পাঠ নয়, নির্দিষ্ট লক্ষে সুনির্বাচিত অধ্যয়ন-এ সত্য অনুধাবন না করলে কেবল সম্পদ ও মেধার অপচয়ই ঘটিয়ে যাবো।-তাই কি? প্রথমত নির্দিষ্ট লক্ষে সুনির্বাচিত অধ্যয়ন যদি সম্ভবও হয়, তা কি দিতে পারে সর্বদেশদর্শি জ্ঞান? আর ‘সত্য’ মানে কী? দর্শনের যদি ছাত্র আমরা তাহলে এত সহজে এসব কথা কি বলতে পারি? সত্য জানার আকাক্সক্ষা কি নয় এমন একটি ক্ষুধামাত্র যা কেবলই কুরে কুরে খায়, ধ্বংস করে চলে?’
৭.
অধ্যাপক আলি মনে করেন, মানুষের জ্ঞানচর্চার প্রয়াসের সঙ্গে তার খাদ্যাভ্যাস সৃষ্টির একটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে। শিশু অবস্থায় সে প্রথম প্রথম হাতের কাছে যা পায় তাই খেয়ে ফেলতে চায়, এমন কি তার প্রিয় খেলনাটি পর্যন্ত। ক্রমশ বেড়ে ওঠার সঙ্গে মানুষ বুঝতে পারে যে চারপাশের সবই খাদ্য নয়। আরও বড় হলে সে জানতে পারে যে খাদ্যেরও পুষ্টিভেদ রয়েছে এবং কিছু কিছু খাদ্য সুস্বাদু হলেও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও মানুষ প্রথমে মনে করে ছাপার অক্ষরে পড়া কিংবা পিতা-মাতা-গুরুজন আর নামি দামি ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া সব কিছুই বুঝি মূল্যবান জ্ঞান। ক্রমশ সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সে জানতে পারে যে সব শিক্ষাই সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কিছু কিছু পড়া ও জানার বিষয় রীতিমত জ্ঞানের শত্র“। এ-প্রসঙ্গে প্লেটোর রিপাবলিকের আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়। প্লেটোও শিক্ষাকে সার্বজনিন বিষয় ভাবেন নি। তিনি শিক্ষার নানা শ্রেণিবিন্যাস করে কে কোন বিষয়ের যোগ্য সে সেই বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করবে এমনটিই মত প্রকাশ করেন। এতে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেমন শৃঙ্খলা বজায় থাকে তেমনি রাষ্ট্রের কার্যাবলিও সুচারুভাবে সম্পন্ন হয় এমনটিই তার ধারণা। আবার একজন মানুষের স্বল্পায়ু জীবনে সে যদি বাছাই করে নিতে না পারে তার শিক্ষার বিষয় কোনটি তাহলে সে অথই সমুদ্রে ঘোরপাক খেতে থাকবে। অজস্র পাঠের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাবে। আর এখনতো নানা বিষয়ের নানা ফেকাল্টি। কে কোন বিষয়ে সত্যিকার আগ্রহ লালন করে সে বিষয়ের দিকেই পদ্ধতিগতভাবে ধাবিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। অধ্যাপক আলির অজস্র পাঠ নয়, সুনির্বাচিত পাঠ বিবেচনা সমালোচনা সত্তে¡ও এই যুক্তিতে উৎরে যায়। তবে খণ্ডিত পাঠের কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে সেটিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না, আর এই বিষয়টি থেকে যাতে পাঠার্থিরা বিভ্রান্ত বা বিচ্যুত না হন সে চেষ্টাই সম্ভবত করা হয় ‘চিন্তার ইতিহাস’ অধ্যয়ন চক্রে।
৮.
প্লেটো একাডেমির প্রবেশ পথে শিক্ষার্থিদের জন্য লিখে রেখেছিলেন, গণিত যে না জানে তার এই একাডেমিতে প্রবেশ করার দরকার নেই। গণিতের মোহময় জাদুকরি ক্ষমতা সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা ছিল বিস্ময়কর। পূর্বেই বলা হয়েছে অধ্যাপক আলির চিন্তার ইতিহাস পাঠ অধ্যয়নচক্র তথাকথিত একাডেমিক ছাচে শুধুমাত্র দর্শন অধ্যয়ন সভা নয় মোটেও। বিজ্ঞানের সা¤প্রতিক বিতর্কগুলো যেমন উসকে দেয়া হয় এখানে, তেমনি তর্ক-বিতর্ক বিশ্লেষণ খণ্ডন পাল্টা খণ্ডন চলে আগ্রহিদের মধ্যে। আচার্য লিয়াকত আলিও তার ছাত্রদের সাথে সে বিতর্কে সহাস্যেই অংশগ্রহণ করে থাকেন। ভারতের ইতিহাস, রামায়ণ, মহাভারত, মুসলিম দার্শনিকদের দর্শন যেমন গুরুত্ব পায় এখানে তেমনি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হন পাশ্চাত্য দার্শনিকগণও। গ্রিসের আয়োনিয় চিন্তা থেকে শুরু করে প্রাক-সক্রেটিক যুগ ও সক্রেটিক যুগ, প্রাচিন ভারত ও চিন, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ ও আধুনিক কালের প্রধান প্রধান চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে অধ্যয়ন সভায়।
৯.
অধ্যাপক আলি’র শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। চিন্তার ইতিহাস পাঠচক্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মৌলিক চিন্তাবিদদের বইয়ের সঙ্গে সরাসরি পরিচয়। মৌলিক বইগুলো থেকে নির্বাচিত অংশ পঠনের সাথে সাথে অধ্যাপক আলি ভারি ভারি বিষয়কেও অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থির উপযোগি করে পরিবেশন করেন। উপরি পাওনা তাঁর টিকাটিপ্পনি, এবং সবশেষে শিক্ষার্থিদের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে পাঠের সংক্ষিপ্তসার। সংশ্লিষ্ট দার্শনিকের বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি নিরপেক্ষ অবস্থা অবলম্বন করেন, ধারণা জন্মায় সেই দার্শনিকের মতের পক্ষেই যেন তাঁর অবস্থান; ভুল ভাঙতে দেরি হয় না যখন দেখা যায় বিপরিত ঘরাণার দার্শনিকও সমান গুরুত্ব পায় পরবর্তি পাঠ অধ্যয়নচক্রে। ড. আলি পাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটান অবলিলাক্রমে।
১০.
প্লেটো তাঁর রিপাবলিকে আদর্শ রাষ্ট্রের ছক আঁকতে যেয়ে গুহারূপকের একটি চমৎকার উদাহরণ দেন। গুহায় বন্দি একদল লোক হাত-পা বাঁধা পেছন ফিরে শুধুমাত্র দেয়ালগাত্রই দেখতে পায়। পেছনে একটি আলোর উৎস থেকে আলো এসে উপরে যাতায়াতকারিদের ছায়াচিত্র সেই দেয়ালে প্রতিফলিত হয়। বন্দিরা সেই ছায়াকেই আসল সত্য বলে জানে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবশত কেউ পালিয়ে কখনো আলোর প্রকৃত উৎসের খবর পেয়ে যায় এবং সে যদি আবার সেই বন্দিশালায় ফিরে আসে তখন অন্যরা কি তাকে বিভ্রান্তকারি হিসেবে চিিহ্নত করবে না? তারা বলবে চক্ষু নিয়ে সে উপরে উঠেছিল এবং দৃষ্টিহীন হয়ে সে ফিরে এসেছে। আল গাযালি তাঁর তাহফাতুল ফালাসিফা গ্রন্থে জ্ঞান সম্পর্কে একটি চমৎকার উপমা দেন। একটি ক‚প যার চারদিকে অসংখ্য নল রয়েছে, তা দিয়ে বিশুদ্ধ এবং ময়লা পানি ভেতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু যদি কেউ বিশুদ্ধ পানি পেতে চায় তাহলে তাকে সেই ময়লা আসার রাস্তাগুলো আগে বন্ধ করতে হবে, তারপর ভেতরের সব ময়লা পরিষ্কার করে বিশুদ্ধ পানি আসার দ্বারগুলো খোলে দিতে হবে। সম্ভবত জ্ঞানতাত্তি¡ক আলোচনায় এই দুটো রূপক তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক আলি চিন্তার ইতিহাস পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থিদের বোধ ও বোধিতে এই সত্যই প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হলে মুক্ত জানালা দিয়ে অবারিত আলো-হাওয়া নয় বিশুদ্ধ স্বাস্থ্যপ্রদ আলো-হাওয়াই আসতে দিতে হবে। তাঁর ছাত্র আশরাফ আহমেদ-এর কথা দিয়েই শেষ করি, ‘এরিস্টটলকে তার এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিলেন, দর্শন পড়ে কি লাভ? এরিস্টটল তার অন্য এক ছাত্রকে বলেছিলেন, এ ছাত্রটিকে একটি টাকা দিয়ে একাডেমি থেকে বের করে দিতে। আমি মনে করি গল্পটি এরিস্টটলের আদর্শবাদি জ্ঞানতত্তে¡র ভ্রান্তির বড় একটা উদাহরণ। জ্ঞানতত্ত¡ হয়ে উঠতে পারে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কঠিন এক অস্ত্র, এই শিক্ষাই আমাদের ফিলোসফি ক্লাবের বড় এক প্রাপ্তি।’ কঠিন সময়ে দিনযাপনে বিভ্রান্ত আমরা উন্মুক্ত আলো-হাওয়া পাবার জন্য লালায়িত থাকি। স্বাস্থ্যপ্রদ তর্ক-বিতর্ক, বিরুদ্ধ মতকে সহ্য করার শক্তিও যে একটা বড় অর্জন সেটাই সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের দীর্ঘ বিশ বছরের সাধনা। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা যেখানে শূন্যের কোঠায় সেখানে আপাত লাভালাভের কথা বিবেচনা না করে অধ্যাপক আলি শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে বাইশ বছরের বেশি সময় ধরে একক চেষ্টায় ‘চিন্তার ইতিহাস’ পাঠচক্র ও ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ পরিচালনা করছেন সেটাই বা কম কি?