‘জ্ঞানের উত্তরোত্তর বিশেষায়নের সঙ্গে মানবিক চর্চার সমন্বিত রূপটির ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটছে। সভ্যতার এ পর্যায়ে এসে প্রায়োগিক কারণেই জ্ঞানের বিষয়ভিত্তিক ক্রমবিভাজন অপরিহার্য, কিন্তু মনন ও সৃষ্টিশিলতার সামগ্রিক রূপটিকে যদি তা পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে তাহলে আমরা মানবসত্তার খণ্ডিত রূপকেই কেবল দেখব এবং তা এক অনতিক্রম্য বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্টি করবে। এ বদ্ধ অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজন একটু খোলা মাঠ-যেখানে বিবিধ মত ও পথের মানুষের নির্ভার পদচারণা এবং সম্মিলন ও প্রীতিময় মতবিরোধ সম্ভব হবে। দুর্ভাগ্যবশত কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানই কখনো সম্পূর্ণ খোলা মাঠ হতে পারে না তবু সৎভাবে যদ্দুর সম্ভব চেষ্টা করে যায় কেউ কেউ। সে পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ যার উদ্দেশ্য মানবিক সকল চর্চার উজ্জ্বলতম মুহূর্ত ও নিদর্শনের সম্মিলন।’ সম্ভবত উপরের কথা কটি থেকে সংগঠক অধ্যাপক লিয়াকত আলি’র সংগঠনচিন্তার স্ফুর্তির খানিকটা মেলে। জ্ঞানের চর্চা ও প্রসারে সংগঠন যে একটি অপরিহার্য শর্ত তার খানিকটা আভাসও পাওয়া যায়। মুসলমান বাঙালির প্রথম সংগঠন ‘শিখা’ যাদের শ্লোগান-‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। জ্ঞানের উত্তরসাধক অধ্যাপক লিয়াকত আলি মনেপ্রাণে তা ধারণ করেন, ধারণ নয় তা ছড়িয়ে দিতে সংগঠনও গড়ে তুলেন।
বাঙালির যে অপবাদ খানিকটা নিরবে হজম করতে হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো সে সংগঠন গড়তে জানে না, কোনোক্রমে যদি গড়ে তাকে রক্ষা করতে পারে না। আবার চালু সংগঠনেও যদি তাকে বসিয়ে দেয়া হয় তাহলে তাকেও সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। এমন অভিযোগ যে বাঙালির বিরুদ্ধে সেখানে বাঙালির সংগঠনচিন্তা নিয়ে কথা বলতে যাওয়া একটু ঝক্কিঝামেলার, কখনো কখনো বিব্রতকরও। দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম যে বাঙালির সত্যিকার ব্যর্থতার জায়গা কোনটি, বারবার ব্যর্থ হয় কেন সে। আবার অভিযোগের যে পাহাড় আসল সত্যি কি তাই? এটি বিরুদ্ধবাদিদের অপপ্রচার নয়তো?
দীর্ঘকালিন উপনিবেশিক শাসন শোষণের ফলে মানুষের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়, তার ছাপ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজো। আবার উপনিবেশিক শাসকশ্রেণি তাদের শোষণ-শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য এমন সব অপপ্রচার চালায় যাতে করে শাসিতশ্রেণির মধ্যে এই বোধ সঞ্চারিত হয় তারা শাসিত হবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে। ফলে দীর্ঘ অবদমন তার উপর গভীর ছাপ ফেলেছে, এবং সে বয়ে বেড়াচ্ছে একধরনের সংকীর্ণতা। স্বশাসন কিংবা উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হবার অভিজ্ঞতা তার বেশি দিনের নয়। নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপনের চেষ্টাও সেদিনের ঘটনা। সংগঠন জাতিয় বিষয় ভারতিয় ধারণায় খুব বেশি দিনের নয়। ধর্মিয় সংঘ বা মঠের ধারণা আমাদের ছিল, সেটা যে বৃহত্তর পরিসরে বৃহত্তর জনমানস সম্পৃক্ত ছিল তা বলা যাবে না। ধর্মের বাইরে তার আসবার সুযোগ ছিল কম। জনমানসও তার বাইরে সংঘকে বিবেচনায় আনতে চাইত না।
বৃহত্তর ধর্মিয় সংগঠন সম্ভবত বুদ্ধের সময় থেকে সক্রিয় কাজ করেছিল এখানে, এবং সেখানে অনেকটা বৈজ্ঞানিক পন্থার সংশ্লেষ ঘটেছিল।
বাঙালির সক্রিয় সংগঠন গড়বার প্রবণতা বা সুযোগ আসলে স্বাধিনতার পরের। যদিও আমরা গৌরবের ৪০বছর উদ্যাপন করছি কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। সামরিক ও স্বৈরশাসন পিছিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। রক্তক্ষয়ি যুদ্ধউন্মাদনাও বাঙালিকে আত্মসচেতন করতে ভূমিকা রাখে। হাঁটিহাঁটি পা পা সে সংগঠন এবং সাংগঠনিক বিষয়াবলি বুঝতে শেখে, কিছু কিছু গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা পায়। যার অনেকগুলোই আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। ভাংচুরের ভেতর কিছু কিছু প্রতিষ্ঠিত সংগঠনকে যদিও আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছি, একে আমি একক ব্যর্থতা না বলে সামষ্টিক ব্যর্থতাই বলবো।
‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ এমন এক সংগঠন, যা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় জাতিগঠনে নিজেদের শ্রম, মেধা, আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সংগঠনের পেছনে যে মানুষটির নিরলস সাধনা তিনি হলেন অধ্যাপক লিয়াকত আলি। ১৯৯১ সালে চিন্তার ইতিহাস ভিত্তিক একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে গড়ে উঠে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্কৃতিকর্মি, সমাজসেবি ও জ্ঞানপিপাসুদের প্রধান মিলনস্থলে এরই মধ্যে পরিণত হতে পেরেছে এটি। অধ্যাপক আলি ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’কে আনন্দময় চর্চায় সম্পন্ন মানুষ গড়ার একটি ‘ইনকিউবেটর’ মনে করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানি হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক আলি’র সংগঠনচিন্তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’-এর মাধ্যমে। ব্যাপকভাবে জ্ঞানপিপাসু মানুষের একত্রিত হওয়ার স্থান বাংলাদেশে নেই বললেই চলে, মুক্তবুদ্ধি মুক্তচর্চার ক্ষেত্রে এই দৈন্যদশা আরো প্রকট। আবার সুনির্দিষ্ট মত ও পথের বাইরে এসে সংগঠনচিন্তা এদেশে বিরল। দলিয় লেজুরবৃত্তি অথবা কোনো লক্ষ ও আদর্শকে কেন্দ্র করেই এখানে সংগঠনগুলো আবর্তিত। প্রকৃত উদার ও বিস্তৃত আকাশ নেই বললে চলে, অধ্যাপক আলি কোনো লিখিত ম্যানুফেস্টো’র বাইরে এসে বৃহত্তর মত ও পথের নানা পেশার মানুষকে একত্রিত করে যে সংগঠনচিন্তা করেছেন এবং বাস্তবে তার রূপায়ণ সম্ভব হয়েছে সেটা আনন্দের বিষয়। ম্যানুফেস্টো না থাকলেও অধ্যাপক আলি লক্ষ ও উদ্দেশ্যবিহিন আবর্তিত হচ্ছেন এমন বলা যাবে না। লক্ষ ও আদর্শ তাঁর আছে এবং সেটা সংগঠন পর্যালোচনা করলে, তার পরিচালনা পদ্ধতি বিশ্লেষণে টের পাওয়া যায়। সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের অধিনে পরিচালিত একটি স্বতন্ত্র উইংস, যা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রসার ও প্রচারে নিবেদিত।
পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনকে মাদার অর্গানাইজেশন হিসেবে কল্পনা করা যায়, যার অধিনে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বহুমুখি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মূল সংগঠন: পথিকৃৎ ফাউন্ডেশন
প্রতিষ্ঠান: সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের সংগঠন: দর্শন ক্লাব (চিন্তার ইতিহাস), অর্থনীতি ক্লাব, অডিও-ভিজ্যুয়াল ক্লাব, শিল্প-সাহিত্য ক্লাব, আনন্দন (পারফর্মিং আর্টস ক্লাব), স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ফোরাম, প্রকৃতি ও পরিবেশ ফোরাম
যেকোন সংগঠন সফলভাবে পরিচালনা করতে, অন্যের মুখাপেক্ষি না হতে যেসব বিষয় জরুরি তাহলো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয়ের উৎস। এব্যাপারে শুরু থেকেই অধ্যাপক আলি বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো হননি। কেন্দ্রের নিজস্ব আয়ের উৎস নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন, যা সংগঠক হিসেবে তাঁর দূরদর্শিতা প্রতিপন্ন করে। লোভের কাছে নতি স্বীকার না করার প্রবণতা, সরকার বা রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎসগুলোর কাছাকাছি না থাকার চেষ্টা সংগঠক হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবি রোকেয়া আলমের কথা দিয়ে শেষ করি, ‘ব্যক্তির শরীর ও মন দুটোর উন্নতি সাধন না হলে উন্নত সমাজ গঠন সম্ভব নয়-এই বিশ্বাস থেকেই ডা. লিয়াকত জীবনের শুরু থেকে পেশার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-দর্শন চর্চার মুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নেশায় ব্রতি হয়ে ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। উভয় ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য ঈর্ষনিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এত ধৈর্য্য এবং সাহস ও কোথায় পায়, আমার মত সাধারণ মানুষের তা বোধগম্য নয়।’