পাতাঝরা বিশালাকার একটা শিমুলের গোড়ায় বসে ময়না চারপাশটাকে দেখে নিচ্ছিল। প্রকৃতিকে দেখা এবং তাকে বুঝে নিয়ে চলতে শেখাটাও খুব জরুরি। সে এটা বোঝে, কেননা বেঁচে থাকার জন্য তার সংগ্রামটা ছিল বিভৎসকর, ভুতুড়েও বটে যা তার স্বভাবকে আমূল বদলে দিতে পারত কিন্তু শৈশবে পড়া প্রকৃতির আঁচড় থেকে সে আর সারা জীবনেও বেরোতে পারেনি। পারেনি বলেই আজো সে দৌড়ে টিকে আছে, এই নিরন্তর দৌড় আজ ময়নার যাপনের সব অর্জনটুকুও এনে দিয়েছে।
ময়না যে শিমুলগাছটার নিচে বসে আছে তার সামনে দশ-বারো বিঘার ওপর একটা পুকুর— লোকে বলে দিঘি! তার চারপাশে শ্যাওড়া ভাট ধুতরা কচু ছোট ছোট বাবলা আর বুনো লতাপাতা এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে বেড়ার মতো ঘিরে রেখেছে দিঘিটাকে। এক কোণায় বুড়ো তিনটে খেজুরগাছের গলায় মাটির ভাঁড় বাঁধা, বাতাসে চোঁয়ানো রসের মিষ্টি গন্ধ। দিঘির ওপারে ট্রেন-লাইন, একসময় কোলকাতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখন ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পেরিয়ে উত্তরবঙ্গ, সেখান থেকে কুষ্টিয়া-যশোর হয়ে খুলনায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই পথেই সে একদিন নোয়াপাড়া থেকে যশোরে এসেছিল! যদিও এই আসার পেছনে ছিল ক্ষোভ, লজ্জা আর বাঁচার জন্য অনিশ্চিত যাত্রার তাড়া— এই ভাবনা তার মুখে এক টুকরো চাপা হাসি এনে দেয়। শিমুলের গোড়ার একটা খাঁজে ঠেস দিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে বসে। আর শিমুল গাছের গোড়া কেমন হয় তা তো সবারই জানা— মূল শেকড়টা মাটি থেকে কৌণিক খাঁজ তৈরি করে তিন কিংবা চার ফুট উপরে ওঠে, তারপর খাঁজগুলো মিলে গিয়ে গোলাকার কাণ্ডটা ক্রমান্বয়ে আকাশমুখি হয়।
ফলত ময়নার দু’পাশ শিমুলের খাঁজের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলে সম্মুখের দৃশ্যটুকু খোলা থাকে আর থাকে শিমুলের চূড়া এবং ব্যাপ্ত আকাশ। শিমুলের চূড়া এবং সেই ব্যাপ্ত আকাশের দিকে চাপা হাস্যময় মুখটা তুলে ময়না একটা সিগারেট ধরায়।— আমিও এদের মতো, আমার সমস্ত আগামি স্রেফ এদের মতো নিঃশব্দে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য।
ঠিক সামনে একটা চঞ্চল ফিঙে নেমে চষা মাটির ঢেলার মধ্যে মুখ ঠেসে কেঁচোর মতো লম্বা একটা পোকা ঠোঁটে নিয়ে আবার উড়ে গেল— মুহূর্তের মধ্যে।
ধান-কাটা ফাঁকা প্রান্তরের বাতাসে ময়না আজ পাখিকে আমন্ত্রণ করেছে। প্রাণবন্ত ফিঙেকে দেখে ওর পাখিকে তীব্র এবং আসক্তভাবে মনে পড়ল। ‘আমার ব্যাপ্ত আকাশে একটা পাখি উড়বে, আমি তার সজিব ডানার ছায়ায় জীবন সাজাব’। সম্মুখে কুয়াশার পর্দায় পাখির শরীরটা যেন সত্যিই দেখতে পায় ময়না, হৃদপিণ্ডে রক্তের বিচ্ছুরণে বেঁচে থাকার সেই আনন্দের নিক্কনধ্বনি বাজে যেন।
না, পাখি তার লালসার জালে আটকানো ভিরু কোনো শিকার নয়— পাখি তার সংকল্প, তার বেঁচে থাকার আর্তি। স্বাভাবিকভাবে পাখি জানত না, জেনেছে ধীরে-ধীরে। প্রথাবদ্ধ সামাজিক প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে নিজেকে বারবার ভাঙতে হয়েছে, একই সঙ্গে নির্মাণ করেছে সে যুক্তি বিশ্বাস। মানুষের বাঁচতে চাওয়ার তুমুল আকাঙ্খার পক্ষেই তাকে দাঁড়াতে হয়েছে— সে যে-ই হোক, যেভাবেই তার আগমন ঘটুক, যেভাবেই বেড়ে উঠুক— সে যদি বাঁচতে চায়, জীবনের স্বপ্ন দেখে— কোনো যুক্তিতেই আমি তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারি না।
শীতের কাপড়ে মোড়া রায়পাড়া বলাডাঙা মুরলীর ছেলেমেয়েরা ট্রেনলাইনে হাঁটতে বেরিয়েছে— এই লাইন ধরেই কিছুক্ষণ পর পাখি আসবে। পাখির হাত ধরে ময়না আজ জীবনের যৌথ যাত্রায় পেখম মেলবে—ভাবনাটা ওর কল্পনাকে ডিঙিয়ে ফেলে আসা বিস্তীর্ণ বাস্তবতায় ছড়িয়ে পড়ে যেন-বা…
একদিন মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে বাপ আসার আগেই পালিয়ে গেল। না পালালে সে রাতে মার মরণ ছিল— কেউ ঠেকাতে পারত না! সপ্তাখানেক পরে আরেকদিন সকালে ও স্যাঁতস্যাতে মাটির মেঝেতে বসেছিল, বাঁশে হেলান দিয়ে। রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, বাজ পড়েছে। মাঝরাত পর্যন্ত ঝড় ছিল তারপর একনাগাড়ে বৃষ্টি। চালে গোলপাতার ছাউনির যেটুকু আড়াল ছিল ঝড়ের প্রথম দু’এক ঝাঁপেই শুকনো পাতার মতো বেশির ভাগটাই উড়ে গেল, চাটাই কাঁথা— বালিশ কাপড়-চোপড় মেঝের কাদা— মাটির সঙ্গে লেপ্টে নিমেষে একাকার। অন্ধকার এক কোণে ভিজতে ভিজতে ঝিমুতে ঝিমুতে ভূতের মতো রাতটা একরকম একলা পার করেছে ময়না। খিদে পেটেয় খুব কাহিল লাগছিল, এ ক’দিন ঘরে রান্নাবান্না হয়নি— কে করবে। বাপ তাকে দু’একটা করে টাকা দিলে সে শংকরপাশা খেয়াঘাটের কিনারে জাহাজ-বাঁধা লোহার থামে বসে খালি নদী দেখেছে, ভৈরব নদীর ওপারে নোঙর ফেলা জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময় কেটেছে তার। জাহাজগুলোর পেট এত বড়! সারাদিন কুলিরা পিঠে করে চাল না সার না ধান বোঝাই বস্তাগুলো গুদামে নেয়ার পরও জাহাজ খালি হয় না, পরদিন আবার পঞ্চাশ-ষাটজন কুলি ভারে কুঁজো হয়ে বস্তা বওয়া শুরু করে, সন্ধ্যা পর্যন্ত! ময়নার হাসি পায়, তার পেটটাও যেন জাহাজের মতো, দু’এক টাকার মুড়ি-চানাচুর কিংবা আচার খেয়ে কিচ্ছু হয় না। নদী পার হলেই নওয়াপাড়া বাজার, মা’র সঙ্গে কতবার গিয়েছে, খুব ইচ্ছে করে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আসতে-যেতে মাঝিকে এক টাকা দিলে তার থাকেই-বা কি আর খাবে কি! গতরাতে বাপ ঘরে ফেরেনি বলে হাতও খালি, এখন খিদে পেটেয় চুপ করে বাপের জন্য বসে থাকো— কি আর করা!
মা নেই, কোথাও হাতও পড়ে না। বাদলার দিন, ক’দিনেই ঘরটার চেহারা কেমন বদলে গেল, উঠোনে ঘাস আর বুনো উদ্ভিদের মাথা উঁকি মারতে শুরু করেছে। খিদে পেটেয় সে দেখছিল সারা উঠোনময় কেঁচোর মাটি খোঁড়াখুড়ি— মাটি খেয়ে গর্ত খোঁড়া আবার সেই গর্তেই মাথা গোঁজা-কি সুন্দর গেরস্থালি! বাপের লাথি-চড়ের ভাবনা নেই, স্কুল-পড়াশোনার বালাই নেই-কি সুখি জীবন! প্রায় সপ্তাখানেক ময়নার স্কুলে যাওয়া নেই, হবে কি করে-ময়নার মনে হয়, আমি যেন কাঁঠালগাছের সেই শালিক পাখির বাচ্চাটার মতো উড়তে শেখার আগেই ঝড় যার মাকে মেরেছে, আর দমকা বাতাস তাকেও ডাল থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলে এখন বলছে— যাও, এবার বাঁচো দেখি! সত্যি এখন আমি খাব কি, বাঁচব কি করে?
ঠিক তখনই কতগুলো পায়ের আওয়াজে ও শুধু ক্ষুধাতুর বোবা মুখটা উঁচু করে তাকায়-দ্যাখে, ভাড়া-খাটা মটরসাইকেল স্ট্যান্ডের ট্যারা সামসু, সাইকেল স্ট্যান্ডের কানাই আর খেয়াঘাটের ডাক-নেয়া নুরু মোল্লা বড় বড় কদমে, যেন মার্চ করে তার সামনে এসে হল্ট করে দাঁড়াল। পাট-ভাঙা সাদা লুঙ্গি বাহাতে তুলে ডান হাতে ফিল্টার সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে নুরু মোল্লা ফাসফ্যাসে চিকন গলায় বলে ওঠে, মড়ার ভান ধরে বসে রইচিস, ভুত কোনকের। কি করবি বুঝতি পারতিচিস নি-না? উঠ ছোঁড়া, উঠি দাঁড়া… কথা বলার সময় কুচকুচে কাল মুখে ছাই-রঙা মোচ শুয়োপোকার মতো কিলবিল করে ওঠে।
সামসু-কানাই দু’জনই হাত কচলাতে কচলাতে হেসে ফেলে-চেহারাখান দ্যাখ, সত্যি বাঁদর একখান। নে চল, ঘাটে চল।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা দু’জন ময়নাকে চ্যাংদোলা করে ঘাটে এনে ধপাস করে ফেলে দেয়। ঘাটের এবড়ো-খেবড়ো ইটের কোণা মাথায় লাগে ওর— দুর্বল শরীরে তখনই কেমন ঝিম ধরে অনুভূতিশূন্যতা ভর করে। নুরু মোল্লা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাতটা ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দু’চোয়ালে দুটো চাটি মারে— ঘড়িটা কোথায় রাখিচিস বল, তুই-তো নিচিস, নিসনি বল?
মুহূর্তেই ঘাট ভরে ওঠে। পারাপারের লোক, দোকানি, মেছো, চাষাভূষা, মাঝি সবার কানাকানিতে বৃত্তান্তটা আবছা বোঝা যায়— নুরু মোল্লা দামি একখান ঘড়ি হারিয়েছে। কোথায় হারিয়েছে, কিভাবে খোয়া গেছে কিছুই মনে নেই। ছোড়াটাকে বেঘোর ক’দিন ঘুরতে দেখে, নিজের ঘাটের লোহায় প্রতিদিন বসে থাকতে দেখে ওকেই ওর সন্দেহ হয়েছে। তাই, আর কিছু না।
ছোট বাচ্চা ছেলে, মারটা তাই জমল না। তবু ভিড়ের মধ্যে থেকে অপরিচিতদের দু’একটা হাত এগিয়ে এসে ওর পিঠে মুখে ধুপধাপ করে পড়ছিল। শরীরটা ঝিম ধরে থাকাতে ময়না এসবের তীব্রতা অনুভব করতে পারছিল না। ওর শুধু মনে আছে ভিড় ঠেলে ছোট্ট একটা মেয়ে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর, নুরু কাকা তুমি ওকে চিনতি পারনি। এ তো আয়শা খালার ছেলে, ঘরেতি খালা নি, কোতায় গেচে কি জানে, ওর বাপও কাল ফিরিনি, ভ্যান রেকে কোথায় যেন গিচিলো, ভ্যানটা খোয়া গেচে, মহাজন তারে বেন্দে রাখিচে। কাল ও খাতি পায়নি-আর তোমরা ওকে মারতিচ
ও আমার ঘড়ি চুরি করেচে
তুমি দেখিচো?
নুরু মোল্লা মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়, কিছু বলতে পারে না।
ভিড়ের মধ্যে থেকে ময়নাকে বের করে মেয়েটি আবার তাকে সেই উঠোনে নিয়ে আসে সকালে সে যেখানে বসেছিল। মাথাটি থেঁতলে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। শরীর ঝিমঝিমের সঙ্গে এখন বমি লাগছে। মেয়েটা বুঝতে পারে না কি করবে। ময়না ভিজে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে। তোমার খিদে লেগেচে না?
মেয়েটি দৌড়ে চলে যায়। ময়নাদের পড়শি, বাবা প্রাইমারির শিক্ষক, মা সূচকর্মী। আগে যাতায়াত ছিল, প্রতি রাতগভীরে ময়নার বাপের মাতলামি গালাগালি মারধোর, ময়নার মার কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে ময়নারা এক রকম একঘরে হয়ে আছে। মেয়েটি কেবল মাঝেমধ্যে আসে। একই স্কুলে পড়ে ওরা, ময়না ফাইবে, মেয়েটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে। মেলামাইনের প্লেটে ভাত ডাল আর সম্ভবত ছোট মাছের চচ্চড়ি… ময়নার স্পষ্ট মনে পড়ে খাওয়ার পরই ও স্বচ্ছন্দে উঠে বসেছিল। অদ্ভুত এক শরীরী অবশতা থেকে সে মুক্তি পেয়েছিল। তারপরই হঠাৎ করে শরীরটা গরম হয়ে ওঠে এবং তীব্র জ্বরে ও জ্ঞান হারায়। পাঁচ দিন পর ময়না আবার উঠে দাঁড়ায় মেয়েটির বাড়িতে।
অবেলায় কোত্থেকে একটা কাক এসে শিমুলের ডালে চেঁচাতে চেঁচাতে, বোধ করি, পা পিছলে একেবারে মাটিতে ধপাস করে পড়ে যায়। ঢিল ছুঁড়লে কাকটা আবার কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠে দু-একবার ডানা ঝাপটায় কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, উড়েও যায় না। ময়না কাছে গেলে ডানা ঝাপটাবার চেষ্টা করে কাকটা থেমে যায়। ক্ষুদে কাল চোখজোড়া চিকচিক করে। দাঁড়কাক সম্ভবত, কি প্রচণ্ড শরীর, থর থর করে কাঁপছে বুকটা, ছড়ানো ডানাও গুটিয়ে আসে। হয়ত ইলেক্ট্রিক তারে বসেছিল, কোনো রকমে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। ও এখন মরবে।
ময়না ওর মৃত্যুকে প্রত্যক্ষে রেখে ভাবে— ক্ষুধা এবং সে রাতের প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে এতটাই কাবু করে ফেলেছিল যে সম্ভ্রমহানির লজ্জা কিংবা শারীরিক যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে তাকে প্রায় পাঁচদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং জ্বর থেকে ওঠার পর ময়না মেয়েটির প্রতি কিংবা মেয়েটির বাবা-মার প্রতি দৃষ্টি বিনিময় করতে গিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যদিও মেয়েটির বাবা অদ্ভুত ব্যথিত স্বরে ময়নার বিভ্রান্তকর বাস্তবতার একটা সমাধান দিতে চেয়েছিলেন, যেহেতু তীব্র স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ময়না পড়াশোনার সুযোগ না পেয়েও ক্লাশে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্থানটি অবধারিতভাবে নিজের আয়ত্তে রেখেছিল। এহেন ছেলেটির জ্বরের ঘোরে বারবার ‘না, আমি চোর না, আমি তোমার ঘড়ি নিই নি’ চিৎকার তাকে বিপন্ন করে তোলে। বলেন, শালার নিজের কান কাটা— সেদিক খেয়াল নি, চোর ধরি বেড়ায়! পোটের মাল চুরি করে বিক্রি করা এই তো ওর ব্যবসা! সন্ধ্যে হলি মদ গাঁজা তাড়ি নিয়ে বটতলায় কুদুমি আর মাঝরাতে হৈহৈ কততি কততি মহল্লার মানষির ঘুম ভাঙিয়ে ঘরে ফেরা— ও আবার চোর পিটায়, বেজম্মা কনেকার!
ঠিক সেই মুহূর্তে সবার চোখের আড়াল এবং নিরুদ্দেশের হাওয়া ময়নার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে। কোনো সান্ত্বনাই তার অভিমানক্ষুদ্ধ কোমল ক্রন্দনশিল হৃদয়চাঞ্চল্যকে প্রশমিত করতে পারে না। মায়ের পলায়ন, বাপের অনুপস্থিতি, ঝড়ে ভাঙা বাসঅযোগ্য ভুতুড়ে ঘর ময়নাকে টানে না। বরং স্কুলশিক্ষকের কথার মধ্যে থেকে দু-একটি ইশারা নিজের মতো করে সে তার তৃতীয় চোখে গেঁথে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে। মেয়েটিকেও সে গেঁথে নেয় চোখে, ঝড়ের ভিতরে ঢুকে ঝঞ্ঝার কবল থেকে সে তাকে উদ্ধার করেছে। এম্নিতেই সে তার চেনা, একই স্কুলে পড়ে, তবু… এবং এই শংকরপাশা গাঁও, খেয়াঘাট, তার জন্মভূমি, আশৈশব পরিচিত যারা আজ তাকে চুরির দায়ে বেদম পিটাল! আশ্চর্য, দারিদ্র্য কি উলঙ্গ, তার শেকড় নেই, বাকড় নেই, সামাজিকতা নেই, যেন মানুষ নয়— সে বরং মানুষের অবয়ব পাওয়া নিরেট একটা কিট কিংবা বোবা প্রাণি হয়তো-বা। তোমার ইচ্ছার দাসত্ব যার নিয়তি! ইচ্ছা হয়েছে তাই ওকে মার, গুঁতোও, কনুই দিয়ে ঠেলা মার, হাস, ইয়ার্কি কর, ‘কি শান্ত দ্যাখ, গুঁতোয় না’ বলে পিঠে কষিয়ে চাপড় বসাও এবং সটান এক লাথিতে দূরে ঠেলে কাপড়ের না লাগা ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে মশগুল হয়ে চলে যাও! বাহ্
মৃত দাঁড়কাকের ডানা ধরে দিঘিপাড়ের ঝোপে ফেলে আসে ময়না। অনেকক্ষণ ধরেই সে তার মৃত্যু দেখছিল— শেষবারের মতো পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে দেয়ার সময় ধূসর কাল বুকটা তার কেঁপে ওঠে, ঠোঁটটাও মৃদু ফাঁক হয় এবং সম্ভবত তখনই সবকিছু তার ইচ্ছা শক্তির বাইরে চলে যায়। পা-ডানা কুঁকড়ে বুকের কাছে চলে আসে আবার, শান্ত কাল ক্ষুদ্র চোখ দুটো বুঁজে যায়…
সিগারেট ধরিয়ে শিমুলের খাঁজে হেলান দিতে দিতে ময়না শীত-বিকেলের কুয়াশায় ঘোলা, প্রায় আড়াল চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয়। ভাবে, তবুও তো মৃত্যু, সামান্য ভুলের মাশুল মৃত্যু দিয়ে শোধ করতে হল, আমিওতো স্রেফ বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছাড়া বাকি সবকিছু গোঁয়ারের মতো ভুল পথ ধরে সমাধানে গেছি, কি দিয়ে মাশুল দেব আমি!
তখন মোবাইলে শিষ দিয়ে ওঠে পাখি: দেরি হয়ে গেল, বুঝলে, এবাড়ি-ওবাড়ি করতে করতেই সময় গেল, এখন বেরুচ্ছি
সেই শংকরপাশা গ্রাম, সেই খেয়াঘাট, মানুষের অসংলগ্ন হুল্লোড় চেঁচামেচির মধ্যে মার খাওয়া, চেনা মুখগুলোর অচেনা অভিব্যক্তির মাঝখানে সেই ছোট মেয়েটি… পাখির স্বর শুনলেই এই হু হু স্মৃতিমেদুরতা তাকে বিহ্বল করে তোলে। এত স্পষ্ট, এত বেশি প্রত্যক্ষ, যেন বহমান জীবনের পাশে পাশে আরেকটি জীবন যা তার শৈশব— সে বহন করে চলে। ময়না চলে, সঙ্গে সঙ্গে সেও চলে পরিত্রাণহীন।
চোখ বুঁজলে ও দেখতে পায় বার-তের বছরের একটি ছেলে মেয়েটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার দক্ষিণে বাঁশঝাড়ের ভেতরে ঢোকে, বাঁশবনের প্রান্তে, ভরা ভৈরবের গা-ঘেঁষা সেই বটগাছ, শেকড়-বাকড় ঝরা বাঁশপাতায় ঢেকে আছে, তার মধ্যেই কাঁচের বোতল, চিপস চানাচুরের প্যাকেট ছড়ানো। ছেলেটি পা দিয়ে বাঁশপাতাগুলো সরায় এবং অল্প একটু খোঁজাখুঁজির পর পায়ের বুড়ো আঙুলে একটি ঠাণ্ডা ঝকঝকে ইস্পাতের স্পর্শে আহ্লাদিত হয়ে ওঠে। নুরু মোল্লার ঘড়িটা যে এখানেই পড়ে থাকবে কেমন করে যেন মেয়েটির বাবার কথার মধ্যে থেকে ময়না নিশ্চিতভাবে জেনে গিয়েছিল। ঘড়িটা হাফপ্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে তার চোয়াল শক্ত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে— শুধু ঘড়ি নয়, নুরু একদিন তোকেও আমি নেব! মাথা নিচু করে ময়না সোজা ঘাট পেরিয়ে নোয়াপাড়া রেলস্টেশনে গিয়ে দাঁড়ায়। পকেটে এক টাকা এবং খুচরো কিছু পয়সা মাত্র। বাপ একবার একটা শাড়ি আর একটা লুঙ্গি কিনে এনেছিল মনিহারের সামনে থেকে, ওগুলো চোরাই, অল্প দামে বিকোয়, আপাতত ময়নার গন্তব্য ওটাই! আর যেতে হবে বিনে পয়সায়। সামনে একটা মালট্রেন, অনেকগুলো ওয়াগন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছে ট্রেনের ড্রাইভার। জিপসাম বোঝাই একটা খোলা ওয়াগন টার্গেট করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, ট্রেন ছাড়লে ওখানে উঠে ময়না নিজেকে আড়াল করে যশোর পৌঁছুবে…
পুনর্বার পাখি শিষ দেয়, এটা পাখির জন্য নির্ধারিত রিং টোন। বলে, জান, এক্কেবারে খালি একটা নৌকা চলন্ত জাহাজে ধাক্কা খেয়ে এইমাত্র ডুবল! ঠাণ্ডা পানি সাঁতরিয়ে মাঝি কিনারে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে, ওর অবস্থা দেখে হো হো করে হাসছে ঘাটের দু’পাশের লোক, ব্যাচারি! শংকরপাশা ঘাটে এমন কাণ্ড কখনো ঘটেছে বল…
বড়দের আশপাশ ঘিরে ছোটরা খেলছে, তাদের হুল্লোড়ে লাইনের পাথর তুলে পাথরের ওপর বাড়ি মারার পাথুরে শব্দ কিছুটা ম্লান হয়ে কানে আসে ময়নার।
একটানা তিনদিন এবং দু’রাত মনিহার তাকে ফাঁকি দেয়। দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত মুড়ি বিস্কুট পানি জুটলেও তৃতীয় দিন তা-ও হয় না। পকেটে শুধু ঘড়িটা… ক্ষিদেয় অস্থির, পাকস্থলি ছটফটিয়ে ওঠে। মনিহারের খোলা উঠোনের এক পাশে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে… চোখ ভিজে ওঠে। রাত তখন কত কে জানে। টোকাই হকার ভিখিরি রাস্তার কুকুর সবাই গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ দৈবি একটা শব্দ যেন ওকে জিজ্ঞেস করে, কিরে কাঁদছিস কেন?
প্রায় সমবয়সি একটি ছেলে কখন কোত্থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে, ও টেরও পায়নি। গায়ে হাফ-হাতা শার্ট, পিঠটা ছিঁড়ে দু’টুকরো হয়ে ঝুলছে। পরনে নেতার মতো চেক লুঙ্গি, ধুলোবালি মাখা শ্যামলা মুখে আমড়ার মতো বড় বড় দুটো চোখ: আমার নাম সিরাজ, নবাব সিরাজুদ্দৌলা, বাংলা বিহার উড়িষ্যার… বলে ও হেসে ওঠে। ওর চোখে সমিহ আর আন্তরিকতা, ময়না কোনো রকম ছলনা করে না: পেটে খুব ক্ষিদে, কিছু খাওয়াতি পার
পরিচয়ের প্রথম পর্বে এমন প্রস্তাবে সিরাজ যেন হকচকিয়ে যায়। বিজ্ঞের মতো খানিকক্ষণ ময়নাকে পর্যবেক্ষণ করে, আয়। কাউন্টারের পাশে অন্ধকার এক গলিতে বেঞ্চ পাতা, তাতে একটা বালিশ, সম্ভবত ও ঘুমায়। বেঞ্চের নিচেও একটা ছেলে ঘুমাচ্ছে, পাশে ঝালমুড়ির টিন। বেঞ্চিতে একটা কাগজে সিরাজ মুড়ি চানাচুর তেল দিয়ে মাখায়: নে, আগে খা। পয়সা নাম পরিচয় কোনো কিছুর ধারে না গিয়ে সিরাজের এই তাৎক্ষণিক স্পষ্ট আচরণ ময়নাকে আত্মবিশ্বাসি করে তোলে। পেট শান্ত করে পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে ও সিরাজকে দেয়: এটা বেচতি হবে
বেশ ভার তো, ঘড়িটা দামি মনে হচ্ছে, ওস্তাদরে দিলি হবে না। কাল সকালে আমি তোরে দিদির কাছে নে যাবো। এখন ঘুমো।
যশোরের নিষিদ্ধ জগতের বিশাল একটা অংশের আবরণ সিরাজ খুব দ্রুত উন্মুক্ত করে দেয় ময়নার সম্মুখে।
সিরাজের দিদি থাকে দিদিদের পাড়ায়, আরো অনেক দিদির সঙ্গে। সিরাজের আপন কেউ নয় অবশ্য।
চারদিকে ছোট ছোট ঘর, প্রতি ঘরে একটা করে দরজা, পাশে শিক দেয়া সবুজ রঙ করা কাঠের জানলা। চোখ ঘোরাও, দেখবে একটা দরজা একটা জানলা, তারপর একটা দরজা একটা জানলা… তারপর আবার, একতলা দু’তলা, তিন তলা।
নক করতেই সিরাজের দিদি ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে দরজা খোলে, ভাবটা এখনই বিছনা থেকে উঠল: পরনে ঘাঘরা, ব্লাউজের বিকট গলার ঘের থেকে পুরো বুকটাই বেরিয়ে আসবে যেন! ময়নার বিভ্রম দেখে দিদি হেসে ওঠে: কি রে, দেখিসনি কোনোদিন?
ময়না ঘড়িটা সিরাজের হাতে তুলে দেয়। দিদির পছন্দ হয়েছে। অনেকগুলো পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে ওরা ফেরে।
পাখি আবার শিষ দিয়ে উঠলে ময়না হকচকিয়ে ওঠে যেন পাখি ময়নাকে আধ-ন্যাংটো দিদির ঘরে দেখে ফেলেছে!
কি রকম বিড়ম্বনা বল দেখি, একটার পর একটা বাস আসছে, চলেও যাচ্ছে। ভিড় না যেন পিঁপড়ের চাক! তুমি থাক, হ্যাঁ শিমুল গাছ দিঘি রেল লাইন আমার খুব শখ ওগুলো দেখি, কতবার বলেছ। আমি আসছি…
মোবাইলটা রেখে ময়না আরেকটা সিগারেট ধরায়
আশৈশব একটা পাখি ছাড়া ওর আর কেই-বা আছে দৈনন্দিনের খোঁজ নেয়। একটা পাখির কলতান, পতিত জীবনের কত ক্লেদ থেকে মুহুর্মুহু তাকে উদ্ধার করেছে!
সিরাজের কাছে আমি ঋণি, এমন নির্লোভ কলহাস্যমুখর সরলতা, সুতো কাটা ঘুড়ির মত হাওয়ায় ওড়া মানুষ জীবনে দ্বিতীয়টা আর দেখিনি, ভাগ্য আমার। ঘড়ি বেচার বকসিশ দূরের ব্যাপার, রাতে মুড়ি খাওয়ার টাকাটা পর্যন্ত নিল না। বলল: চল্, ওস্তাদের সঙ্গে আলাপ করায় দি। না-কি বাড়ি যাবি?
বললাম, তাড়া নেই, যাব যেদিন মন চাবে। তোমার খবর কি?
সিরাজ হো হো করে লাফ দিয়ে ওঠে। ঐ যে আকাশ দেখতিচো ওটা আমার ছাদ, আর এই যে মাটি এটা হচ্চে বাড়ির মেজে, আমার বাড়ির কোনো দেয়াল নি, বুজতি পাললি। হ্যাঁ, ময়না দেয়ালের কি দরকার বল! দুনিয়া-জোড়া বাড়ি!
অতবড় বাড়িতে আমি হারায় যাব, ছোট বাড়ি দরকার। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। তুমি আমার ওস্তাদ, অন্য ওস্তাদে কাজ নি
হাতে অনেক টাকা। শলাপরামর্শে দিন গেল এক রকম। সিরাজ শেখেনি এমন কোনো কাজ নেই, করতে বাকি রেখেছে এমন কিছু ও মনে করতে পারে না।
কৌতূহল সর্ববিষয়ে, শুধু চাহিদা কম, পকেটে কিছু থাকলে ও আর নতুন সন্ধানে বের হয় না।
সেই রাত্রি গভীর হলেও সিরাজের কথা ফুরায় না: নতুন বই ছেড়েচে হলে, প্রথম শো, টিকিটের লম্বা লাইন, লাইনের বাইরে মানুষে ভিড়। সিরাজ নিজেই পনেরটা টিকিট পকেটে রেখেছে— সময় ঘনিয়ে এলে চড়া দামে ছাড়বে। তার আগে ওস্তাদের নির্দেশে প্রথম পকেট কাটতে গিয়ে চামড়ায় ব্লেড বসিয়ে দেয় এবং ভয়ে নিজেই চিৎকার দিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে কেটে পড়ে। সেদিনই প্রথম শোনে: যে পূর্ণিমা এত সুন্দর, সেও শত্র“ নিশিজীবী চোরের কাছে! অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার তাদের অভয়রাজ্য, তখন টর্চের মুখে কাঁপা ফিট করে কাঁপার ছিদ্রপথে টর্চের চিকন আলোয় গৃহির ঘর খালি করার কৌশল। আর থাকে ছিপ, দিনরাত্রি যে কোনো সময়ের সঙ্গি। যে কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে তুমি হেঁটে যাও কারো বলার কিছু নেই-তুমি মৎস্যশিকারি! সুতরাং প্রতিটি গৃহের খোলা দরজা-জানলা পরখ করতে করতে তুমি যাও এবং সুযোগ বুঝে গৃহস্তের ঘরে ছিপ ফেল। বড়শিতে আটকিয়ে পছন্দসই জিনিসটা বের করে আন। সিরাজের অভিজ্ঞতা ব্যাপক, রাত গভীর হলে ময়না অকস্মাৎ জিজ্ঞেস করে, তোর দিদি কেমন?
সিরাজ প্রশ্নের ধরন বুঝতে না পেরে সরাসরি বলে ফেলে শরীর-বেচা দিদিরা যেমন হয় কেন, লাগবে? ময়না শান্ত স্বরে বলে, দিদিকে লাগবে। শুধু চুরি করে চোরেরা, আমরা চুরি করব যাতে একদিন আর চুরি করতে না হয়, বুঝলে। দিদির কাছে পয়সা রাখলে সেফ থাকবে তো!
বেশ্যা বলে অবিশ্বাস করিস নি। রাখবে কি-না চল জিজ্ঞেস করে আসি।
রাত তখন দ্বিতীয় প্রহর শেষ। দিদি ঘুমিয়ে পড়েছিল, ডাক দিতে আধ-ন্যাংটো শরীরে হাই তোলে, ময়নার প্রস্তাব শুনে দিদি কাপড় সামলাতে গিয়ে হেসে ওঠে, গায়ে কাপড় দিয়ে শুলি গরমে ঘুম আসে নারে। ঠিক আছে রাখা যাবিনে কিন্তু এত রাত্তিরে কোথায় যাবি তোরা? নে শুয়ে পড়, চিন্তা করিস নি।
বিভ্রান্ত ময়না দিদির দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়ে। সিরাজ ফিসফিস করে কি বলে, দিদি হাসে। একবার পিছনে উঁকি দেয়: কোলবালিশের মতো সিরাজকে জড়িয়ে দিদি হাসছে, আর ও দিদির খোলা বুকে মুখ গুঁজে কথা বলছে।
সেই আমার দ্বিতীয় জীবনের প্রথম দিন! নোওয়াপাড়ার বন-বাদার মাঠ-ঘাট নদী শান্ত প্রান্তরে পরিবারের নিঃস্বতায় ম্লান একটা শিশুর লাজুক চলাফেরা, একা একা কথা বলা, ক্ষেতের আল কিংবা শংকরপাশার ঘাটে নোঙর ফেলা জাহাজের দিকে তাকিয়ে থাকার জীবন থেকে পালিয়ে দিদির ঘরে রাত্রি যাপন— ঘুম আসে না। আঁচলের গিঁট খুলে একটা রুটি কি একটা কলা, ভাঙা পিঠের টুকরো ময়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মা—কামলা-খাটা মানুষ, হয়ত কেউ খেতে দিয়েছিল-মনে পড়ে। আর কি দেখা হবে! চোখ জ্বালা করে ওঠে। ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে, দিদি পাশ ফিরে ময়নার বুকে হাত তুলে দেয়, নীল আলোয় শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দিদির উদোম বুক ওঠানামা করে… দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে…
আমি আজো বুঝি না দিদির সঙ্গে সিরাজের কি সম্পর্ক! সিরাজ তার চেয়ে দু’পাঁচ বছরের বড় হবে, দিদির বয়স সম্পর্কে তার কোনো ধারণা হয় না।
পরদিন ভোর থেকেই শুরু হল আমাদের দৌড়, নেশার মতো একটানা… যতক্ষণ-না আঘাত এসে আমাদের পথরোধ করল… আঘাত হানল সিরাজের ওস্তাদ, ভুলটা আমাদের।
তালা খোলা-লাগানোর কৌশল কিছু দিনের চেষ্টায় রপ্ত করে আমরা অমাবস্যার একরাতে অভিযানে নামলাম। মার্কেটের নৈশ প্রহরির সঙ্গে সিরাজ খাতির করেছে চা-অলা হিসেবে। চা-বিড়ি আর বাউল গানে প্রহরিকে ব্যস্ত রাখে সিরাজ। শতখানেক ঘড়ির একটা থলে ছেঁঁড়া কাগজের বস্তায় নিয়ে কাঁধে ফেলে টোকাই আমি দিব্যি বেরিয়ে আসি।
এত ঘড়ি বেচব কোথায়, আমাদের বড় কোনো দল নেই। মনিহারের হকার কিংবা ওস্তাদের চেলাচামুণ্ডাদের কাছ থেকে আমরা দূরত্ব বজায় রেখে চলি। দিদি তার কাস্টমারদের কাছে দু’শ তিন’শ পাঁচ’শ যার কাছে যা পায় দু’একটা করে বেচে। কিন্তু আমরা খেয়াল করিনি ঘটনাটা শহরে চাঙাড় হয়ে গেছে! ঘড়ির দোকান লুট, প্রহরির বাউলসঙ্গীত, স্থানিয় সংবাদপত্রে বড় হেডিঙে ছাপা হলে সিরাজের ওস্তাদের বুঝতে দেরি হয় না! তিন দিনের মাথায় সে সিরাজ আর আমাকে তার টিনশেডের রিক্সা গ্যারেজে হাজির করে। জংপড়া লোহার একটা চেয়ার আর টেবিল গ্যারেজের এক কোণে, পনের-বিশটা রিক্সা লোহার শেকলে লাইন দিয়ে বাঁধা, গ্যারেজে আর কেউ নেই। পকেট থেকে টেবিলে একটা পিস্তল শুইয়ে রেখে সে সরাসরি সিরাজের দিকে তাকায়, তোরে চিনতি ভুল করিচি, মনে হয়, গান করিস, হৈহৈ করে ঘুরে বেড়াস, ভালই তো ছিলি, বেঈমানি করলি কেন?
আমার ভয় হচ্ছিল সিরাজ আবার চেতে না ওঠে। ওকে বলেছিলাম তর্কে যাবি না, যা বলবে চুপচাপ স্বীকার করে বেরিয়ে আসবি, তারপর দেখা যাবে।
সিরাজ মাথা নামিয়ে রাখে, কথা বলে না। ওস্তাদ পিস্তলটা হাতে নিয়ে সিরাজের কপাল বরাবর তাক করে আগের মতোই স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে: কাল ঠিক এই সময় ঘড়িগুলো এই টেবিলে হাজির করবি, তোকে যা দেবার আমি দেব। ভুল করিস নে, যা।
সিরাজ-আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঘড়ি ওকে দিয়ে দেব কিন্তু অর্থ এবং ওস্তাদ দুটোকেই আমরা আত্মসাত করব। অবিশ্বাসি তৃতীয় পক্ষ রাখব না।
সূত্র অনুযায়ি টাকার লেনদেন বিশ হাজার। খোশ মেজাজে ওস্তাদ আমাদের নিয়ে রেল লাইনের সমাগমশূন্য একটা জায়গায় গিয়ে বসল। সীমানার হিসেবে জায়গাটা চাঁচড়ার মধ্যে পড়ে। নিজের জন্য কেরুর একটা ছোট বোতল, সেভেন আপ আর চানাচুর, আমাদের জন্য শিক আর রুটি। সিরাজ চোখ বুঁজে গান ধরল: নেশা লাগিল রে / বাঁকা দু’নয়নে নেশা লাগিল রে/ হাসন রাজা পেয়ারির প্রেমে মজিল রে… হঠাৎ অনেক দিন পর নোওয়াপাড়ার সেই মেয়েটির জন্য আমার বুক কেমন করে ওঠে। আমি ছটফট করে উঠি। সেই সময় ওস্তাদ আমাদের দু’জনের হাতে দুটো করে পাঁচশো টাকার নোট গছিয়ে দেয়: ভাবতিছিলি ওস্তাদ ফাঁকি দেবে, ওস্তাদের কলজে অত ছোট নয় বুজতি পাললি, বেঈমানি করবি না সিরাজ, কক্ষনো বেঈমানি করবি না, বেঈমানি আমার পছন্দ নয়, ঠিক আছে। ওস্তাদ আমাদের দিকে পেছন ফিরে মুততে থাকে আর বিড়বিড় করে। পকেট থেকে সিন্থেটিক দড়ি বের করে মুহূর্তেই ওস্তাদের গলায় জড়িয়ে দড়ির দু’প্রান্তে দু’জনের টানে ওস্তাদ জন্তুর মতো ছটফটিয়ে শুয়ে পড়ে, টানের জোরে গলা কেটে দড়ি প্রায় হাড়ে গিয়ে ঠেকে। পকেট থেকে টাকার তোড়া আর পিস্তলটা নিয়ে ওস্তাদকে ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে আমরা কারো মুখোমুখি না হয়ে নিরাপদে সরে আসি।
সে রাতে জ্বর আসে আমার। সিরাজ দিদির কাছে নিয়ে যায়। দিদি আমার মাথায় পানি ঢালে, প্যারাসিটামল খাওয়ায়। দিদির অসংলগ্ন পোষাক আমার বিরক্ত লাগে। জ্বরতপ্ত গলায় আমি বেফাঁস বলে ফেলি: দিদি বুকটা ঢাকো না, আমার ভাল্লাগতেচে না!
দিদি খাড়া হয়ে দাঁড়ায় যেন কেউ তাকে চাবুক মেরেছে। ঘণ্টাখানেক তাকে আর দেখি না। জ্বরের ঘোরে আমি নোওয়াপাড়ার সেই মেয়েটিকে দেখি, নুরু কাকা তুমি এরে চেন না, ও আয়শা খালার… দিদি এসে দাঁড়ালে আমি উঠে বসি, জ্বরটা কমেছে। খিদে লেগেছে, দিদি একটা কমলা দেয়; সুতি শাড়িতে দিদিকে তখন ঘরের মেয়েদের মতো লাগে। আমার মায়ের নাম আয়শা, সেও কি দিদির মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কোথাও বাঁচতে গেছে! কে জানে… কমলাটা নিয়ে দিদির সামনে দাঁড়াই: আমি যুদ্ধে নেমেছি বাঁচব বলে, পঙ্গু হয়ে ঘষটে ঘষটে মরার জন্য নয়।
পরদিন ময়না নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে নতুন আদলে নোওয়াপাড়া পৌঁছুল।
ছুটি হয়ে গেছে, স্কুলমাঠে পাখি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই ওর নজর কাড়তে পারছিল না। একটা ঢিল ছুঁড়ে ও পাখির পায়ে মারলে পাখি আসে, হা করে তাকিয়ে থাকে। কোথায় ছিলে এতদিন? আর পড়বা না? আব্বা তোমার কথা অনেক বলে… পাখি যেন কলকলিয়ে ওঠে, কি ব্যাপার তুমি কিছু বলছ না যে! ময়নার কথা আসে না, তোরে খুব দেখতি ইচ্ছা হল, তাই আলাম। তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ।
তুমিও তো কম বড় হওনি, তোমার বন্ধুরা টেস্ট দিচ্ছে, ক’দিন পর ম্যাট্রিক পরীক্ষা।
গরিব মানষির পড়াশোনা হয় বল, কোথায় থাকব, কি খাব, কে আমার খরচ দেবে। আমার তো বাঁচতি হবে আগে।
গাম্ভীর্য এসে ওর মুখে ভর করে তখন, হয়ত অনেক কিছু মনে পড়ে, মুখে তার ছায়া। ময়না জিজ্ঞেস করে, চকলেট খাবে, তোমার জন্য চকলেট আনছি।
অনেকগুলো চকলেট তুলে দেয় ময়না: কাউকে বলো না আমি আসছিলাম। আবার আসব, তোমার সঙ্গে কথা বলতি, ঠিক আছে?
পাখির শিস বেজে ওঠে: জান সকালে থেকে বাবা কিন্তু খুব অস্থির, কি করবে যেন ঠিক বুঝতে পারতেচে না। একটু আড়াল হলেই মাকে ধমকাচ্চে— গেল কনে মেয়েটা, একটু কতা বলব, তার জো নেই— আবার সামনে গিলি বলে, ও তুই আচিস, আচ্ছা ঠিক আচে, বস। কি যে কাণ্ড, তুমি যদি দেখতে…
মাঝে মধ্যে সত্যি ময়না খেই হারিয়ে ফেলে। পাখির দ্বৈত উপস্থিতির কোনটিকে সে দেখছে, কার সঙ্গে কথা বলছে! এই যে কুয়াশার আবরণের ওপারে আবছা দৃশ্য, এ যেন তার স্মৃতির আরেক রূপ। বর্তমানের সঙ্গে শৈশবটাও ওভাবেই তার চোখে আবছা নড়াচড়া করে।
দিদি সিরাজ ময়না ক্রমান্বয়ে সংঘবদ্ধ হয়। অদ্ভুতভাবে ওরা তিনজনই নিজেদের অপরাধি না ভেবে বরং প্রাণবন্ত স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে দেয়। এই ভাবনা একটা খেলা হয়ে উঠেছে যেন, কেননা এই খেলা থেকেই ওরা দু’একটা করে পরবর্তী করণিয় ঠিক করে নেয়! দিনে দিনে জমে ওঠা বিপুল অর্থ দিদির কাছে এভাবে থাকাটা সমিচিন মনে হয় না কারো কাছেই। এ পাড়ার দামি মেয়েদের একজন দিদি, তার প্রভাবও তো কম নয়। ময়নার নামধাম ঠিকানা সবই আছে। ময়না সিরাজের সঙ্গে দিদিরও একাউন্ট হয় ব্যাংকে।
ইতোমধ্যে, একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে এক বিশাল দান মেরে নিজেরাই থ’ মেরে গেল ওরা। ঢাকায় ত্রিদেশিয় ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে, ভারত পাকিস্তান এসেছে, ওরা মাঠে বসে খেলা দেখবে: টিকিট কেটে পরিবহনের বাসে ঢাকায় যাচ্ছে। ঘাটে গাড়ি থামল যথারীতি, তখন সন্ধ্যা, হঠাৎ দু’জন আনসার নিয়ে এক পুলিশ গাড়িতে উঠে চেক করতে করতে এক লোকের সঙ্গে বচসা শুরু হল। শেষ পর্যন্ত লোকটা গাড়ি থেকে নামলে পুলিশটাও তার পেছন পেছন গেল। ময়নারা গন্ধ পেয়ে গেছে, সিরাজ প্রায়ান্ধকার গাছের আড়ালে মোতার ভান ধরে বসে হঠাৎ শুনতে পায়— স্যার চেপে যান, পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত ওপরের নির্দেশ আছে, পুরোটাই দিচ্চি, আপনি বাঁচেন আমিও বাঁচি। যশোরের রুই-কাতলারা এর সঙ্গে আছে মনে রেখেন— ধরতি পারলি তারা কিন্তু আপনারেও ছাড়বি না… লোকটা অন্ধকারে টাকার তোড়াটা পুলিশের হাতে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। আনসারগুলো তখন ঘাটে গাড়ির সিরিয়ালের কি জটলা বেধেছে, থামাতে গেছে। লেনদেন ওরা দেখেনি। ঘাটের পশ্চিমে ড্রেজিং করা বালিতে ভরাট জায়গার শেষ মাথায় ঢোলকলমির ঝোপ, ওদিকে লোকজনও নেই, অবেলার আয় পকেটে ভরে পুলিশটা ওদিকেই পেচ্ছাব ফিরতে গেল। ঘাটের চলাচলের জায়গা থেকে লোকটিকে দেখা যাচ্ছিল না এটুকু নিশ্চয়তা পেয়ে রুমালে ক্লোরোফর্ম ঢেলে ময়না পেছন থেকে লোকটার নাকমুখ প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরে। যতক্ষণ না শরীরটা এম্নি এম্নি ঢলে পড়ে। বান্ডিলটা বের করে ময়না বিলম্ব করে না, যশোরমুখি একটা চলন্ত বাসে সিরাজকে নিয়ে সোজা দিদির কাছে!
আচ্ছা, শোন-শিস দিয়ে পাখি আবার বলে ওঠে— আব্বার কথা বলছিলাম, জান আজ কি ঘটেছে। তোমাদের সঙ্গে আমাদের জমির যে সীমানা প্রাচীর মানে বেড়া, ওই হল আর কি, বাবা ওটা ভেঙে ফেলেচে। বলে কি জান, ওটার আর কি দরকার! তুমি হাসছ, ভাল হয়েছে? তোমরা পুরুষরা এত রোমান্টিক না…
ট্রেনের হুইসেলে লাইনে ক্রিড়ারত ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে ওঠে— দারুণ দেহভারে মাটি কাঁপিয়ে ট্রেনটি আবার সুদূর কুয়াশায় লুকায়। পাখি তখন বড় হয়েছে, আমরাও পরিকল্পিতভাবে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছি নিজেদের। বাউল গান সিরাজের চরিত্রকে অনেক নমনিয় করেছিল। অদ্ভুতভাবে আমরা পরস্পরকে প্রভাবিত করেছি— সচারচার যা ঘটে না। একদিন সিরাজ দিদির টুঁটি টিপে ডান হাতে দা উঁচিয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে, তুই আমার সামনে ঘরে লোক তুলিস— তোর মরণ হয় না!
দিদি থ’মেরে চুপ হয়ে যায়, কোনো তর্ক নেই, চিৎকার নেই, ঝগড়া নেই— মাথা নিচু করে বসে থাকে। সিরাজ ছটফট করতে করতে শেষ পর্যন্ত গান ধরে।
কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বেঁকে বসে পাখি। আমি কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারি না— জগতে একটি মানুষও নেই যে একবেলা খেতে দেবে আমাকে। বেঁচে থাকা শুধু একটা জৈবিক ব্যাপার নয়, পরিচয়শূন্য একটি মানুষ যে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় তার সঙ্গে স্বাভাবিকতার মিল খুঁজতে যাওয়া মানে তাকে ফের পচা নর্দমায় ফেলে দেয়া! কারো কাছে হাত না পেতে আগে আমাকে বাঁচতে হবে তো
তা বলে এই ভাবে?
যে কোনোভাবে, যে কোনো দৌড়ে কেউ আমাকে প্রথম জায়গাটা ছেড়ে দেবে না— যতক্ষণ না সবাইকে পেছনে ফেলে আমি সেটা দখল করি
তোমার দখল করার প্রক্রিয়াটাই তো নোংরা
আমি জানি, তোমাকে বলছি শোন, অন্যদের নোংরামির সঙ্গে আমার মৌলিক পার্থক্যটা তোমাকে বুঝতে হবে— অন্যেরা ওখানেই নিজেদের শেকড় গাড়ে, সাম্রাজ্য বানায়, নিজেরা হয়ে ওঠে ডন, নিজের বানানো রাজ্যের রাজা হয়ে তারা ছড়ি ঘোরায়। আর আমি? আমি জানি যে ওটা আমার জায়গা না, ওদের সঙ্গে আমার যায়ও না, ওখানে আমি কখনো দাঁড়াতে চাইনি! তোমাকে শংকরপাশাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি বেঁচে থাকার।
তোমার বাঁচা যখন নিশ্চিত হল তখন তুমি কি করবে?
তখন আমি বেঁচে থাকার আত্মিক অনুষঙ্গগুলো খুঁজব
কিন্তু ততদিনে তুমি তো পশু হওয়ার সমস্ত কৌশল রপ্ত করে ফেলেছ
হ্যাঁ, একই সঙ্গে আমি বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখেছি! ক্ষিদে আর বাপের মার সইতে না পেরে আমার মা পালিয়েছে, দরিদ্র বাবা নষ্ট হতে হতে একদিন আর বাড়িই ফিরল না, আমি ক্ষিদে পেটেয় পড়ে থাকি, ক্ষুধার্ত শরীরে আমি পাড়ার চেনা মানুষের হাতে মার খেয়ে উঠোনে পড়ে থাকি, আমার শরীর আমার মন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, কেউ ছিল না কাকে বলব! সত্যিই তো, সেদিন তুমি আমাকে না দেখলে হয়ত খিদেতেই মরতাম… তুমিতো জান, জান না? তোমার মনে নেই? আমাকে এভাবে বল না, তাহলে আমার আর কিছু থাকে না
তুমি ফিরবে কিভাবে
যুদ্ধ শেষে মানুষ যেভাবে ফেরে
পাখি উঠে চলে যায়। আমি ফিরে আসি। নুরু মোল্লাকে মনে পড়ে। দু’চোয়ালে তার মার এখনো দগদগে ঘা হয়ে বসে আছে— এত খুঁজি, পাই না।
সে না-কি যশোরে চোরাই ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে বিশাল ব্যাপার হয়ে উঠেছে। তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।
একদিন এক মজা হয়, মজাটা যে এত সুদূরপ্রসারি হয়ে উঠবে প্রথমে বোঝা যায়নি।
এক বোরখাওয়ালিকে মটরসাইকেলে নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট এক লোক গহনার দোকানের সামনে নামল। দোকানের বাইরে রাস্তায় সবেদা, পেঁপে নিয়ে ফেরিওয়ালারা বসে আছে— আমি সবেদা দামদর করি, এক হালি নিয়ে সময় কাটাই। ঘণ্টাখানেক পর ওরা বের হয়ে মটর সাইকেলে চলে যায়। মোবাইল ফোন তখন স্বল্পবিস্তার ছড়িয়ে পড়েছে। ক্যামেরা মোবাইলের অনেক দাম— চুরি করতে তো পয়সা লাগে না। পকেটে ক্যামেরা মোবাইল, সঙ্গে সাইকেল— ফলো করে বাড়ি পর্যন্ত হাজির। লোকটা বোরখাওয়ালিকে নামিয়ে আবার ফিরে গেল।
বাড়িটা দু’তলা, নতুন। পাশে একতলা একটা প্রাচীন বাড়ি, অশ্বত্থের অত্যাচারে বাড়িটা একরকম তলিয়ে গেছে, জানলাগুলো বহু বছর কেউ খুলেছে মনে হয় না। প্রায় পোড়ো এই বাড়িটার ছাদে উঠে দেখি জানলার একপাশ খোলা, পর্দা সরানো। সেখানে চোখ রাখতেই বুকটা ধক করে ওঠে— জানলার পাশে ড্রেসিং টেবিলে একটা নেকলেস— হাত বাড়িয়ে নেয়া যায় এমন— দরোজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া, বোরখা সালোয়ার ব্রা তিনটেই খাটের ওপর পড়ে আছে। ময়নার দিকে খোলা পিঠ, ওয়ার্ডরোব থেকে আরেকটি গহনার বাক্স এনে বোরখাওয়ালি, আক্ষরিক অর্থেই অর্ধনগ্ন, ড্রেসিং টেবিলে রাখল— সুন্দর নিটোল মেয়েটি খোলা বুকে তখন ময়নার মুখোমুখি!
উদ্ভ্রান্ত মেয়েটি মুহূর্তেই দুহাত বুকের কাছে এনে চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়, ততক্ষণে ময়না মোবাইলে ক্লিক করে হুমকি দিয়ে ওঠে— চিৎকার করলেই বোরখাওয়ালির আসল চেহারা মহল্লায় ছড়িয়ে দেব, একদম চুপ।
খুব সম্ভব মেয়েটি এ্রম্নিতেই চিৎকার করত না, সে নিশ্চয়ই চাইবে না বোরখা পরে হুজুর হয়ে ঘোরা মেয়েটিকে কেউ এভাবে দেখে ফেলুক— সুযোগটা ময়না নেয়। ড্রেসিং টেবিলের গহনা পকেটে ভরে ময়না বাক্সটা খুলতে বলে। মেয়েটি গহনার বাক্সটা খুলতে গেলে তার স্তন আবার হাতের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। ওয়ার্ডরোবে আর নেই? মেয়েটি আরো দু’সেট গহনা বের করে এবং শেষ পর্যন্ত মেয়েটি কেঁদে ফেলে: নুরু মোল্লা আমাকে মেরে ফেলবে, ভয়ংকর মানুষ ও, আর চেও না প্লিজ।
কি করে ও
সোনার ব্যবসা
কোত্থেকে কেনে
আমি জানি না
তোমার মতো সুন্দরির কাছে সে কিছু গোপন করবে, মনে হয় না। বলে ফেল
সত্যি বলছি, আমি ওসবের খোঁজ রাখি না
কি নাম বললে?
নুরু মোল্লা
একটু চমক লাগে, আমি যেমন শুনেছি তাতে ঠিক মোটরসাইকেলে বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াবার অবস্থায় সে আর নেই এখন
ওর বাড়ি কোথায় জান?
মেয়েটি চুপ করে থাকে
আমি যাচ্ছি। চেঁচাবা না— সর্বনাশ করে দেব কিন্তু
সপ্তাখানেক পরে একদিন মেয়েটিকে আমি বোরখা-পরা অবস্থায় রাস্তায় সনাক্ত করি। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করি: কেমন আছেন?
মেয়েটি গালাগালি করে হুমকি দেয়: চলে যা কুত্তা, চিৎকার করে লোক জড়ো করব বলে দিলাম
সংগে সংগে মোবাইলে ছবি বের করে সামনে ধরলে ও শান্ত হয়। কিন্তু কেমন করে যেন আমাকে ও ধরিয়ে দেয়।
দড়াটানা মোড়ে আমি আপেল কিনছিলাম। সিরাজ সিগারেট নিতে পাশের দোকানে, দু’জন দু’পাশ থেকে এসে পিঠে ছুরি ঠেকিয়ে রিক্সায় ওঠাল— সিরাজ সম্ভবত খেয়াল করেনি। এসব করি বটে, কিন্তু আমাদের গ্যাং নেই, আমি কোনো গ্যাংমাস্টারও না। একটু ভয় লাগল। রিক্সা থেকে নামিয়ে আমাকে নিয়ে গেল সেই ঘরে যার ছাদে উঠে আমি মেয়েটির গহনা ছিনতাই করেছিলাম।
চোয়ালের মাংশ ফেটে রক্ত ঝরা না পর্যন্ত ট্যারা সামসু গাঁড়লের মতো ঘুষি চালাল, এক সময় মেয়েটির ইশারায় থামলে আমি খুব দীনহীন মলিন দৃষ্টিতে মেয়েটির চোখে চোখ রাখতে চেষ্টা করলাম, বুঝতে পারছিলাম না ওরা কত জন। মেয়েটির স্বামি যদি সোনা স্মাগলার হয় তবে ওদের গ্যাং বিরাট। এখান থেকে বেরুতে না পারলে পরিণতি কোথায় ঠেকবে— আমি বিভ্রমে পড়ে যাই। কেননা গ্যাংলিডারদের চৌপাশ থেকে সচেতনভাবে আমরা দূরে থেকে দান মারি। ওদের খপ্পড়ে পড়লে নেশা এতো দূর বিস্তৃতি পায় যে মৃত্যু ছাড়া শেষ পর্যন্ত মুক্তি মেলে না— আমি সিরাজ শুরুতেই টের পেয়ে নিজেদের পৃথক রাখি, আন্ডারওয়ার্ল্ডে কাজ করেও তাই আমরা আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাসিন্দাদের কাছে অপরিচিত থেকে যাই! এটাই আমাদের কৌশল, এখানেই আমাদের জিত। ‘বস আসলি তো আড়ায় লটকায় দেবেনে, তার আগে এটটুসকুনি বুঝায় দি ম্যাডাম’— কানাই চেবাতে চেবাতে বলে।
বেশ খানিকক্ষণের পর্যবেক্ষণে হতবাক হয়ে গেলাম, সম্ভবত আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, ওরা আমাকে চিনল না। খেয়াঘাটে চেংদোলা করে যারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল— সেই ট্যারা সামসু আর কানাই! কপাল, ওরা চিনতে পারেনি। ‘ম্যাডাম’ প্রথমেই পকেট হাতড়ে আমার মোবাইলটা বের করল।
মেয়েটি সেদিন নুরু মোল্লার নাম বলেছিল, নুরু মোল্লাই ওদের বস— আমি নিশ্চিত হয়ে যাই। মেয়েটি এগিয়ে আসে। তোরা ঐ কোণায় গিয়ে বস, আমি দেখচি।
ওরা চলে গেলে মেয়েটি আমার মুখোমুখি হয়: তুই কি বাঁচতি চাস, শয়তান কোথাকার… কোথায় মাথা ঢুকায়চিস তুই বুঝিসনি কিন্তু
আমি আর্ত চোখে মেয়েটির দিকে তাকাই— সম্ভবত মায়া হয় ওর। আমি করুণ সুরে বলি দুটো গয়নার জন্য শুয়ায় দেবে!
ছবিগুলো ফ্যাল
আমি দ্রুত ছবিগুলো ফেলে দিই। অভাবনিয়ভাবে মেয়েটি বলে উঠে— বেরোয় যা, নুরু মোল্লা ভয়ংকর, তার কান পর্যন্ত গেলি তোরে পাঁচ মিনিটও বাঁচায় রাখবে না, বুঝিস কিন্তু। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি, এত সুন্দর মেয়েটিকে নুরু মোল্লা শাসন করে! মোবাইলটা ফেরত দেয়, আমার পকেটে ক্রিস্টাল পাথরের ঈগল পাখির একটা চাবি রিং ছিল— বিদেশি, খুব সুন্দর। কি মনে করে আমি ওটা মেয়েটির হাতে দিয়ে বেরিয়ে আসি। কানাই-সামসু বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পুনর্বার পাখির শিস: দুপুরে তোমার হেসেলে মা আজ রান্না করেছিল, কেন জান, রান্নাঘরে কিসের কুমতি আছে তাই দেখা! হ্যাঁ? তদন্তে কি বেরুল? বেরুল একটা কুলো, পেঁয়াজ রসুন রাখার একটা পাত্র আর ভাতের মাড় গালার একটা গামলা, হেস না, মোটেই হাসির ব্যাপার না! আচ্ছা শোন, তোমার অফিসটা কিন্তু আমার দেখা চাই, সত্যি বলছি দেখাবে তো?
বেলা পড়ে আসছে, শিমুলের চূড়া কুয়াশায় ডুবেছে। বাতাস শীতার্ত, এত সুন্দর দিনটা নিম্নচাপের ধাক্কায় কি বিদঘুটে হয়ে গেল! পাখি নামবে মুড়লীর মোড়ে, একলা একলা হেঁটে আসবে এখানে, ঠিক হবে কি! দেখা যাক
সামসু-কানাইকে আমি পেয়েছি কিন্তু নুরু মোল্লা! সেদিন বোরখাওয়ালির সঙ্গে মটরসাইকেলের লোকটিকে স্মরণ করতে চেষ্টা করি। পোশাক সাদা ছিল এটুকু মনে পড়ে, আসলে লোকটিকে আমি তেমন খেয়াল করিনি।
ইতোমধ্যে আমরা অনেক গুছিয়ে ফেলেছি। মনিহার নীলগঞ্জ ফেলে বগচরে গাড়ির পার্টসের দোকান সাজিয়ে বসেছে সিরাজ, ভাল চলছে। দিদিকে নিয়ে ওরা একটা বড় ঘর ভাড়া করেছে, তার এক রুমে আমি থাকি। ওদের সম্পর্কের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক রহস্যময়তা আছে যা আমি বুঝি না। দিদি নতুন সংসার পেয়ে একেবারে অন্য চেহারায়, সারাদিন রান্নাবান্না এবং সংসার গোছাতেই যত ব্যস্ততা। উৎসাহের আরো একটা দিক আমাকে বিহ্বল করে দিল: ডাইনিং রুমে খাওয়ার টেবিল না নিয়ে ওরা শতরঞ্জি পেতে তাতে বালিশ ফেলেছে, রুমের মাঝখানে। চারপাশে প্রায় আট-দশটা একতারা, একেকটার ধাঁচ একেক রকমের, একটা হারমোনিয়াম। কত রকমের যে বাঁশি সংগ্রহ করেছে সিরাজ! টাকার হিসেবে আগাগোড়াই সে ছেলেমানুষ, আমি আর দিদি ওর হিসেব সামলাই।
সবই ঠিক কিন্তু পাখি উদ্ভ্রান্ত, আমার নিষিদ্ধ জীবনকে সে মেনে নিতে পারে না। আমার আহত আত্মাকে যে আরো বিক্ষত করে। আমি আমার আকাশ অন্তরিক্ষ খুলে দেখাই, নোওয়াপাড়ার ক্লাস ফাইবে পড়া ছেলেটিকে আমি ওর সামনে তুলে ধরি। বলি দ্যাখ, পাখি আর পাখির স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নেই আমার… ও খুঁড়ে খুঁড়ে আমারই অনুপুঙ্খ আমাকে দেখায়! আমি তখন ভিজে বর্ষার মেঘ, নিঃশব্দ বর্ষণে সিক্ত হই কেবল। মাথা নিচু করে ফিরি। রক্তে আগুন জ্বলে…
বোরখাওয়ালির সঙ্গে আবার দেখা করি, হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ঢঙে বলি কথা আছে। সে আমাকে এক রেস্তোরাঁর কথা বলে। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে দেখি ছোট এক কেবিনে সে বসে আছে। বোরখার পর্দা সরানো, খোসা ছাড়া বাদামের মতো মুখ— উজ্জ্বল, খাড়া নাক, পেছনে আঁচড়ানো কোঁকড়া চুল, বিস্তৃত কপালে কাল টিপ, শান্ত স্থির চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করলাম: তুমি কে, তোমার চারপাশে এরা কেন!
মেয়েটি চুপ করে থাকে
মটরসাইকেলে ওই লোকটি কে
মেয়েটি মাথা নামায়।
তুমি মুখ না খুললেও আমি জানতে পারব— সময় লাগবে এই যা। তবে জানতে হবে আমাকে আর একটা কথা, তোমাকে ভয় দেখিয়েছিলাম, ওভাবে দেখব কল্পনাও করিনি, হঠাৎ মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি এল, ওরকম করি না কখনো
মেয়েটি প্রশ্ন করে: তুমি কে?
আমি কেউ না, সত্যি আমি কেউ না, কখনো কেউ হয়ে উঠতেও চাইনি
তাহলে তুমিই-বা এখানে কেন?
শুনবে? শুনলে বলতে পারি… তিন-চার সেট গহনা নেয়ার এক পর্যায়ে মেয়েটি ডুকরে কেঁদে উঠেছিল— মনে পড়ে। সরাসরি ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলি, অনেকক্ষণ ধরে, নোওয়াপাড়া, খেয়াঘাট, ঘড়ি, মনিহার… বাদ রাখি না কিছু, নুরু মোল্লা সামসু কানাই সিরাজ দিদি সবকিছু, এমনকি পাখি প্রসঙ্গও… সব, আমার স্বপ্নটুকুসমেত। বলি, শহরের ডন হওয়ার চাইতে শান্ত পুকুর আমার প্রিয়, নিরিবিলি জীবনের কাছে ফেরার স্বপ্ন… কেনো বললাম জানি না, সম্ভবত আমার চেনা, কথা বলার মানুষের গণ্ডি খুব ছোট তাই।
গহনাগুলো একটা কাপড়ে মুড়ে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা ওর সামনে রাখি। ও খুলে দেখে আবার ঠেলে দেয় আমার দিকে। আমি মাথা নাড়াই, বোরখার বোতাম খুলে ও আমাকে দেখায়, প্রায় তিন সাড়ে তিন ভরি ওজনের একটা গহনা বুকের খাঁজ পর্যন্ত নেমে গেছে। বোতাম লাগাতে লাগাতে ও বলে, তিনজনকে একত্রে পেয়েছ, কি করবে?
আমার খেলা প্রায় শেষ… এই খেলাটা সেরে আমি পাখির কাছে ফিরে যাব… কিন্তু মাঝখানে একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল, তুমি বললে না তোমার অবস্থানটা কি, সায় না পেলেও আমি এগুবো, তোমার জন্য খারাপ লাগবে।
আমার বাবা কলেজের শিক্ষক, আমি অনার্সের পরীক্ষার্থী ছিলাম, কলেজের আসা-যাওয়ার পথে ও আমাকে দেখেছিল হয়ত, আমি খেয়াল করিনি। একদিন ও মটরসাইকেলে উঠিয়ে সোজা কাজির কাছ থেকে সার্টিফিকেট বাগিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এল। আমাকে আনার পরদিন ও বাবাকে হুমকি দিয়ে এসেছে যেন বাড়াবাড়ি না করে।
বোরখা কেন
আমি চাই না কেউ আমাকে ওর সঙ্গে দেখুক
ওর দলের লোকজন তোমাকে চেনে
না, আমি বের হই না। নুরু ভয়ানক হিংস্র, একেবারেই অশিক্ষিত গোঁয়ার টাইপের। টাকার গরমে এখন যশোরের কিংদের সঙ্গে উঠবোস করে। এই আর কি, আমি নেহায়েতই ওর খেলার সঙ্গি।
মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি আমি, দু’হাতে ও মুখ ঢেকে ফেলে বলে: তোমার নম্বরটা কাগজে লিখে দাও।
ওর নম্বরটাও আমি মোবাইলে সেভ করে নামের জন্য তাকাই, মহিমা— ওর ঠোঁট কেঁপে ওঠে! চোখ নামিয়ে নিই, আগ্রহ নেই নিশ্চিতভাবে বুঝে গহনায় মোড়া কাপড়টা পকেটে ঢুকিয়ে নিঃশব্দে আমি বেরিয়ে আসি।
সিরাজ সব শুনে বলল চেনা শত্র“কে সময় দিও না বন্ধু, সব তাল কেটে যাবে। সুতরাং পরদিনই রাত ন’টা দিকে আমরা প্রস্তুত হয়ে বেরুলাম। সিরাজ এখন এমনিতেই বাবু, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, বাউলদের মতো ঘাড় পর্যন্ত নামানো কোঁকড়া চুল, ছোট ছোট গোঁফ টিপিক্যাল ভদ্রলোক। সকালে বাউল সুর গুনগুন করতে করতে দাঁত ব্রাশ গোসল তারপর চা-নাস্তা সেরে বেরিয়ে যায় দোকানে। ফকিরি গানের যত বই পাওয়া যায়, সংগ্রহ করেছে। কাজ না থাকলে সেগুলো নিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে।
ওর দোকানের পাশে আরেকটা ঘর নিয়ে আমি অফিস করেছি। মাঝবয়েসি দু’জন ড্রাইভার পেয়েছি, ট্রাক চালানোর অভিজ্ঞতা ওদের দীর্ঘদিনের। পুরোনো দুটো ট্রাক কেনার কথা চলছে, পরিবহনের ব্যবসা যশোরে ব্যাপক জনপ্রিয়, সিরাজের উৎসাহের কমতি নেই। দিনরাত্রি দৌড়ঝাঁপ লেগেই আছে, এর মধ্যেই আবার মাঠে নামা! দিদিকে বলা হয়নি, সে জানে আমরা সবকিছু থেকে সরে নতুন উদ্যোগে মেতেছি। জীবনের আড়ালের অংশটা কমবেশি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে উত্তেজনা ও শংকা ঘাড়ে হাত দিয়ে সহাবস্থান করে! টানাপোড়েনে খুব অসহায় বোধ করি। সিরাজের দিকে তাকাই, ও কি বোঝে জানি না, বলে চিন্তা করিসনে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সেই একতলা প্রাচীন বাড়িটার কাছে পৌঁছালে ভেতর থেকে ধুমসে গান, হাততালি আর চুটকি বাজানোর শব্দ আসে কানে, জনা পাঁচেকের উপস্থিতি অনুমান করি। ঘরের পেছনে জানলার মতো একটা খোলা দেয়াল-ভাঙা গহ্বর, ওদিকটা অনেকদূর পর্যন্ত বসতিশূন্য, আল দেয়া প্লটগুলোয় জঙলি গাছপালা মাথা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। গহ্বরে চোখ রাখলে দেখা যায় ওরা বাংলা নিয়ে জম্পেশ উৎসবে মেতেছে। কানাই মধ্যমণি, নিজে খাচ্ছে, সবাইকে ঢেলেও দিচ্ছে। খা বাবা, পৃথিবীতে তোদের অন্তিম খাদ্য হিসেবে এটাই যখন বরাদ্দ, ভাল করে খেয়ে নে; আমরা অপেক্ষা করি।
মফস্বলের শহর, রাত গভীর হতে বেশি সময় নেবে না। ওপরে দোতলার সেই জানলায় সেদিনের মতো আলো জ্বলছে, পর্দা সরানো। ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংযত করি। গলির ঠিক মুখটায় চা-পান-সিগারেটের একটা টংঘর, আড়া থেকে টিমটিমে একটা হারিকেন ঝুলছে, সামনে বেঞ্চি পাতা, বসে চা খাই। সিরাজ দোকানের কথা তোলে, পার্টসের নামধাম জানে না ঠিকমতো, সমস্যা হচ্ছে, একটা ভাল ছেলে দরকার বেচাবিক্রির জন্য। বললাম দেখছি, পাওয়া যাবে।
দোকানদার খদ্দের সামলাতে সামলাতেই ভেতরে বসা বউ-এর সঙ্গে কি নিয়ে বকবক করেই চলেছে। আমাদের কথাবার্তা তার চিৎকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
মাথার ওপরে হলুদ কাস্তের মতো চাঁদ, গতকাল অমাবস্যা গেছে। ঘনিভূত অন্ধকারে দেখি তিনজন মাতাল হিন্দি গানের সুর তুলে টলতে টলতে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ পর আমরা উঠলাম।
ঘরের মাঝখানে ঝুলন্ত তারে চল্লিশ ওয়াটের নিরুজ্জ্বল আলো। পেছনের জানলায় চোখ রেখে মনটা ভাল হয়ে গেল, এতটা আশা করিনি, চৌকিতে দু’জনেই চিৎ— উবু হয়ে উল্টাপাল্টা শুয়ে বেঘোর ঘুমাচ্ছে। সিনথেটিক দড়ি আমাদের প্রধান অস্ত্র, কিন্তু পরাতে গেলে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা। সিরাজ বলল দরকার নেই, পারে যখন নিবিই তখন সহজভাবে নে। সলিড আধলা দুটো ইট নিয়ে সপ্তর্পণে আমরা কাছে গেলাম। স্মৃতিতে আমার শৈশবপর্বটি ভয়ংকর লজ্জাতুর, মনে পড়লেই নিজেকে দেখি সামসু-কানাই আমাকে চ্যাংদোলা করে ঘাটে নিয়ে, যেন কাঠের বোঝা কিংবা আলুর বস্তা, সজোরে ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়ছে! কিছু বলার সাহস কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই আমার ছিল না! সিরাজ চিৎটার মাথা, আমি উবুর ঘাড় বরাবর সজোরে এক সঙ্গে, ওরা শব্দ করার কোনো সুযোগই পেল না। দ্রুত গলায় দড়ি পরিয়ে ওদের মৃত্যু নিশ্চিত করে আমরা বেরিয়ে আসছি এমন সময় মটরসাইকেলের আওয়াজে চমকে উঠলাম।
বেরিয়ে পেছনের সেই জানলার পাশে দাঁড়ালাম, হৃদপিণ্ডে অনিশ্চিত উত্তেজনা আমাদের।
পাখির শিস আজ কেবলি চমকে দিচ্ছে! মানুষ কমায় গেলে না-কি আমৃত্যু জীবন দ্যাখে— ময়নার ভাবে—আমিও কি সচেতন কমায় পাখি হয়ে শৈশব ভ্রমণে বেরিয়েছি! শোন, পদ্মবিল পেরুলাম, বাসটা যে কি-না, গরুর গাড়িরও অধম। আচ্ছা কবি’টা তুমি পড়েছিলে? পড়নি, গিলেছ? বেশ, একেবারে গিলে ফেল না, বইটা কিন্তু বাবার। ক্যামন লাগল, আচ্ছা, সেজন্যই বুঝি রেললাইনের পাশে আমাকে আসতে বলেছ! বাব্বাহ, দেরি হচ্ছে, একটু তো উত্তেজিত বটেই, চিন্তা হচ্ছে, এলোমেলো, টুকরো টুকরো, তালগোল পাকানো বুঝলে, কিন্তু, দেখলে— দিনটা যেন কেমন হয়ে গেল, তাই না? ঠিক আছে…
দু’তলার কলাপ্সিবল গেটে মটরসাইকেল থেকে নেমে লোকটা কি মনে করে থামল, তারপর হনহন করে পুরোনো বাড়ির ভাঙা দরোজায় মুখ ঢুকিয়ে কানাই-সামসু দু’জনকেই ডাকল, শুয়োরের বাচ্চার গলাটা একই রকম আছে দেখি! ফ্যাসফ্যাসে চিকন স্বর! আদি উচ্চারণ এখনো বদলায়নি কিছু।
উত্তেজনায় ইট দুটো মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, গলায়ও রশি প্যাঁচানো। নুরু ইট দেখে কপাল কুঁচকে কয়েক পা এগুলো এবং আঁচ পেয়ে মুহূর্তেই প্রাণপণ দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। সিরাজের গ্যারেজ— ওস্তাদের পিস্তলটা আমার কাছে, সিরাজের কাছে ছুরি। যে যারটা হাতে নিয়ে আমরা ওর পিছু নিলাম। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় ছিল ওকে ধরতে হবে, গুলি করা যাবে না। শব্দে সব কিছু ভণ্ডুল মেরে যাবে। কিন্তু ও গন্ধ টের পেয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। একদম হাত ফস্কে ও মটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। মটরসাইকেলের মুখটা ছিল আমাদের দিকে, লাইটের তীব্র আলোয় আমাদের মুখের আদল শুয়োরটা কতটুকু চিনল কে জানে। আমরা দেরি না করে ফিরে এলাম।
রাত দেড়টার দিকে সেই মেয়েটি রিং করল, কি করেছ এসব, তোমাকে ও মাটি খুঁড়ে বের করবে-তা জান?
জানি, তুমি ভেবো না
তোমার কপাল ভাল, সামসু-কানাই তোমার কথা নুরুকে বলেনি। যদি বলত আমার চামড়া তো ছিলতই, তোমরা এতক্ষণে কাক-শকুনের খাবার হয়ে কোথায় পড়ে থাকতে আল্লা জানে!
তুমি কি সিওর ওরা বলেনি
মোটামুটি। ও এত গোঁয়ার বুঝলে, কিছুরই ধার ধারে না। সামসু-কানাই তোমার কথা বললে ও সঙ্গে সঙ্গে এসে আমার চুল ছিঁড়ত, কিল-লাথি মেরে সবই ঠিক বের করার চেষ্টা করত
ঠিক আছে, তুমি সাবধানে থেকো। কললিস্ট থেকে আমার নাম্বার ফেলে দাও। আর শোন, ওকে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তুমি যশোরের বাইরে কোথাও চলে যাবে। নিশ্চয় অনেক আত্মিয় স্বজন আছে তোমাদের।
তুমিও সাবধানে থেকো। ঠিক আছে
সারারাত ঘুম হল না। ছটফট করে বেড়ালাম। দিদি আমাদের অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করল: কি হয়েছে, এ রকম করছ কেন তোমরা। সিরাজকে বলল: ভক্তিরসের গান ধর, মন শান্ত হবে!
সিরাজ সত্যিই চোখ বুঁজে গান ধরল, এমন মানব-জনম আর কি হবে। যা কর মন ত্বরায় কর / এই ভবে… শুনতে শুনতে দড়ি টানার মুহূর্তে সামসুর মুখটা মনে পড়ল আমার। সিরাজের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে দেখলাম। কোন রাশিতে জন্ম আমাদের, কোন পৃথিবীতে বাস করছি, সত্যিই কূল পাই না। সিরাজকে এসবে আর টানা যাবে না, এসব সহ্য করার মতো ধাত ওর আর নেই অথচ আমার টার্গেট এখনো শেষ হয়নি, তবু।
মটরসাইকেলে নুরুর পালিয়ে যাওয়া বার বার প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।
পরদিন সকালে সিরাজ বেরুবার আগে আমি ওকে আটকে ফেলি, চুল দাড়ি কাটো, একটা শূন্য পাওয়ারের চশমা লাগাও বুঝলে, তারপর দোকানে যাবে।
প্রান্তে এসে আমি মাঝি হারাতে চাই না। এই প্রথম মৃত্যুভয় আমাকে পেয়ে বসে। বুঝে উঠতে পারি না কি করব। চেহারায় সাজসজ্জায় যতটুকু আড়াল করা যায় নিজেকে ততটুকু সতর্কে রেখে চলি। শুয়োরটাকে আর পাই না। মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, পাই না। দিন কেটে যায়…
সামনে একটি মাত্র টার্গেট— নুরু মোল্লা, এছাড়া আমরা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি।
দিদিকে বলি জ্যান্ত একটা খেলনা আনো, সংসারটা ভরে উঠুক।
সিরাজের সঙ্গে থেকে দিদির মনেও ভাব ধরেছে যেন। বলে: শরীর ভরা পাপ রে, চোখ বুঁজলে শরীর রিরি করে ওঠে এখনো, এর মধ্যে ফুলের ব্যবসা? আরো সময় লাগবে বাপু!
দিদির কত সময় লাগবে জানি না। আমার ওসবে সায় নেই। ক্ষেতে নষ্ট গাছ থাকলে ফসলের ক্ষতি হয়, চাষির কাজই তাকে উপড়ে ফেলা। আমি যদি কিছু করে থাকি তা-ই করেছি। তারপরও শান্তি পাই না।
পাখিকে একদিন বাসায় এনে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। আমার জীবনযাত্রা সম্পর্কে আক্ষরিক অর্থেই পাখি অন্ধকারে ছিল। দিদির সাজান ঘর দেখে পাখি খুশি হয়েছে বোঝা যায়। আমার রুমে ঢুকে ও একটু অবাক, আমি ফ্লোরিং করি, চারপাশে কাঠের আসবাব-ফার্নিচারের নতুন গন্ধ। ও আমাকে অনেক দিনের পুরোনো একটা উপন্যাস ‘কবি’ বাবার আলমারি থেকে নিয়ে পড়তে দিয়েছিল। বইটা পড়ে তারাশঙ্করের আরো কতকগুলো বই কিনেছি, ওগুলো বিছানায় ছড়ানো। অফিসেও তেমন কাজ থাকে না আমার। মোবাইলে ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা হয়, কে কোন দিকে মাল নিয়ে গেল, কখন ফিরবে ইত্যাদি। একেকটা ট্রিপ শেষে অফিসে টাকা দিয়ে যায় ওরা। বাকি সময়ে পড়ি।
বইগুলো বিছানা থেকে তুলে সুন্দরভাবে ওয়ার্ড্রবের ওপর গুছিয়ে রাখতে রাখতে ও বলে, বাবার আলমারিতে প্রচুর বই, তুমি যদি ওতে হাত দাও, একটু ধুলোবালি ঝাড়ো, একটা বই খুলে পড়তে বস, সে এত খুশি হয়ে উঠবে তুমি ভাবতেই পার না।
উড়তে শেখা পাখির কাছে এই আমার প্রথম কমপ্লিমেন্টস— মুহূর্তে দুনিয়াটা ব্যাখ্যাতীত রকম রঙিন হয়ে উঠল যেন। পাখির সামনে দাঁড়াবার দুরন্ত সাহসটাও যেন সেই প্রথম অনুভব করলাম। মনে হল, স্বপ্ন নয়, ও শংকরপাশার সেই মেয়েটি-ই, খেয়াঘাটে মানুষের জঙ্গল থেকে যে আমাকে তুলে এনেছিল, ভৈরবের জলের মতোই যার গায়ের রঙ, আলো পড়ে পানি যেমন চিকচিক করে, মুখে তেমনি চিকচিক চাপা হাসির চপলতা নিয়ে ওয়ার্ডরোবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছে চোখে চোখ রেখে। নীল সালোয়ার-কামিজ, ওড়নাটা ফিরোজা, তার ওপরে পড়ে আছে কুচকুচে চুল।… তুমি অপরাজিতা, আমাকে জিতলে তুমি আজ, তাই আমি তোমাকে পেলাম— এত অফুরন্তভাবে।
বাসে উঠিয়ে দিলাম, ও চলে গেল। আর তখনই মনে হল শংকরপাশায় আমার জন্মভিটেতে ছোট একখান বাড়ি থাকলে কি ভাল না হয়!
সারাদিন শুয়ে-বসে পার করলাম। সন্ধ্যায় সিরাজ এসে বলল-তোর নুরু মোল্লা গত রাতে পিস্তলসমেত ধরা পড়েছে। চিন্তা করিস না, আমাদের টার্গেট করার মতো কোনো ক্লু ওর হাতে নেই।
স্থানিয় কাগজে লিখেছে রেলগেটের আশেপাশে প্রতিপক্ষের আস্তানায় দলবল নিয়ে হামলা করতে গিয়েছিল, ওরা খবর পেয়ে ততক্ষণে কেটে পড়ে ইনফর্মার দিয়ে আবার পুলিশে খবর দিয়েছে। সবাই পালাতে পারলেও বিশাল শরীরের নুরু মোল্লা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। একদিন মানিকের একটি উপন্যাস নিয়ে বসে আছি অফিসে। মহিমা রিং করল, বলল: জান, ও প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব চাকেই ঢিল ছুঁড়ে ও সবাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছে। চারদিকে শত্রু ওর— ধরা পড়ে বেঁচে গেল।
তোমার খবর কি?
বুঝতে পার না, রাস্তার কুকুরও আমার চাইতে ভাগ্যবান। যদি কোনোদিন মুক্তি মেলেও, তোমার কি মনে হয় স্বাভাবিক চোখে কেউ আমার দিকে তাকাবে আর?
কেঁদো না বন্ধু, বাঁচতে শেখো, জীবনের প্রথম দাবি বাঁচতে শেখা, আমি তাই ভাবি, অবশ্য আত্মপরিচয়শূন্য মানুষের ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু কে জানে!
মেয়েটি চুপ করে থাকে, মাঝপথে নিয়তি ওর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, এখন কাৎরাচ্ছে। কি করতে পারি আমি? তবু জানা কথাটি ওকে বলি: শুয়োরের বাচ্চার ঘর-সংসার রয়েছে নোওয়াপাড়ায়, চার-পাঁচটা ছেলেপুলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে, পড়াশোনা করেনি একটাও। তিনটে ছেলের দুটো হিরোঞ্চি। ছোটটা নাইনে পড়ে, ক্লাসে ফার্স্ট হয়— পরিবারে ভিন জগতের বাসিন্দা যেন! তোমার মতো আর কেউ আছে ওর, জান?
আমাকে বলেনি। শুধু জানতে চায় আমার কি কি দরকার। বাদ দাও।
কানাই-সামসু ওর গাঁয়ের লোক তো, আঁতে লেগেছে। শোনো, ওর সাঙ্গপাঙ্গরা কোথায়, তোমার বাড়িতে আর কেউ থাকে, পাহারায়?
না, কেউ না, এখানে আর কেউ আসে না। নিচে ভাড়া দেয়া। এ বাড়ির খবর মনে হয় সামসু-কানাই ছাড়া ওর বাড়ির লোকও জানে না।
দলের বাকিরা?
আমি জানি না।
রাস্তায় হেঁটে দেখ তো, কেউ ফলো করে কি, কিংবা যখন বেরুবে আমাকে বলবে, আমি দূর থেকে খেয়াল করব।
না, কোনো কাজ হল না। বসের গ্রেপ্তারে বাকিরা এখন আত্মগোপনে। নুরুর জন্য খুব অশান্তিতে থাকি। সব কিছু চলছে ঠিকঠাক, পাখি আগের চাইতে আরো নমনিয়। ওকে এখন ছোঁয়া যায়। পরিবারে ও খুব আদুরে। এ যে ছিল… দিয়ে পরিবারের ও আমার জন্য একটা ভিত তৈরির উপাখ্যান ফেঁদেছে-ওর কথায় এমন ধারণা পাই। সত্যি বলতে কি, প্রকৃত জীবনকে ছোঁয়া বাস্তবের লোকজন নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়লে অক্ষরের পরতে পরতে আমি যেন নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই— হারানো মা বাবা, নদীর পাড়, জাহাজ ঘাট, মাঠের আলে নিজের শৈশব ভেসে ওঠে বইয়ের পাতায়, বুক ভারি হয়ে ওঠে। আরো বেশি বই আঁকড়ে ধরি। এটাকে ও আমার পরিবর্তনের একেকটি ধাপ হিসেবে ধরে নিয়েছে কিন্তু আমি তো আসলে এমনই।
নোয়াপাড়া গেলেও আমি কোনোদিন ভিটেতে উঠিনি, মনে হয় সবাই যেন বলে উঠবে: ওকে চিনতে পারলে না, আরে ও তো সেই ময়না, নুরুর ঘড়ি চুরি করে ঘাটে যে মার খেল!
একদিন কিছু টাকা দিয়ে বললাম: ভিটের জঙ্গল সাফ করে ফেল, দেখা যাক কি করা যায়। একদিন ও নিজেই প্রস্তাব করল তুমি ওখানে জন্মেছ, ভিটেটাতো তোমাদেরই, স্থায়ি ঠিকানাটা আরেকটু পোক্ত করা দরকার না? মনে মনে আমি তৈরি হয়েই ছিলাম। বল্লাম সামলাতে পারবে, অনেক ঝামেলা। বলল, আমার উপাখ্যানের চরিত্রটা শুধু দেশ বিজয় করে সুদূরেই যায় না, ঘরেও ফেরে, রাজপুত্র থাকবে কোথায়! বাবাকে কাহিনি সূত্রে গেঁথে আলাদা একটা চাকরি ধরিয়ে দেই।
ট্রাক থেকে মন্দ আসছে না তবু সিদ্ধান্ত নিলাম পুরোনো ট্রাক আর না, এবার নতুন একটা দেড়টনি পিক-আপ নেব। সিরাজ কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় যাতায়াত শুরু করেছে। সপ্তাহ খানেক থেকে ফিরে আসে।
পাখি শিস দিয়ে জানায় বাসুন্দিয়া পার হচ্ছে, জানলার কাছে বসায় বাতাসে কাঁপুনি এসে গেছে।
কাঁপুনি আসারই কথা। শেষ বিকেলে লাইনে আরো ছেলেমেয়েরা জড় হয়েছে। তুলোতলা রেলক্রসিং থেকে বাচ্চাদের চিৎকার কানে আসে। বাড়িটা শেষ হলে আমি ওকে প্রস্তাব করি: একদিন এসে আমাকে নিয়ে যাও। আমরা শুরু করি। পাখি প্রায় মাস তিনেক সময় নিয়ে পরিবারের সমস্ত আয়োজন শেষ করল। ওর বাবা, প্রাইমারির শিক্ষক, সব কিছু মেনে নিয়েও সমস্ত দায় ওর ওপরই চাপিয়ে রাখল— সংসারে মন এবং বিবেচনা দুটোই দরকার। সাবধানে এগোয়।
পাখি তাই সাবধানে আসছে।
জায়গাটা আমার খুব পছন্দের। একলা হাঁটা— একলা বসার অভ্যাস আমার ছোটবেলার— শিমুলগাছটাকে ওভাবেই একদিন খুঁজে পাওয়া। রেললাইনের পাশে মোটা মতো এক মহিলা বাদাম নিয়ে কাঁথা সেলাই করতে বসে। পাখির আসতে আরো কিছু সময় লাগবে ভেবে বাদাম নেবার জন্য উঠতে গেলে বুঝি পায়ে ঝিঁ ঝিঁ লেগেছে, অন্য পায়ে ভর রাখতে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে শিমুলের খাঁজে হেলে পড়ি, তাতে শরীরটা পেছনে বেঁকে যায়, ঠিক নাক এবং কপালের সামনে দিয়ে তিন-চারটে গুলি এসে শিমুলের নরম বাকলে গেঁথে গেল! হাত-পা ছড়িয়ে খাঁজের আড়ালে পড়ে যাই অনিচ্ছুক তৎপরতায়, নড়ি না একটুও। হৃদপিণ্ডে মুগুরের মতো চাপা শব্দের আলোড়ন ওঠে! হঠাৎ গুলির শব্দে কুয়াশার আড়ালে পাখিরা ডেকে ওঠে; আমি যেমন, লাইনের ছেলেমেয়েরাও থতমত খেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে। পরপর আরো দুটো গুলির আওয়াজ হলে ওরা দৌঁড়ে পালায়। আমি মড়ার মতো নিঃশব্দে পড়ে থাকি। আমার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ও কাছে আসবে কি-না বুঝতে পারি না। চোখ খুলে সন্তর্পণে খাঁজের আড়াল থেকে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। ঝিঁঝিঁকে ধন্যবাদ, সোজা দাঁড়িয়ে থাকলে সব ক’টা গুলি আমার চোয়াল এবং মাথা চূর্ণ করে বেরিয়ে যেত। লোকটাও সম্ভবত তাই ভেবেছে— গুলি খেয়েই আমি গাছে পড়ে গেছি। লোকটা তুলোতলা রেলক্রসিং-এর দিকে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দারুণ কুয়াশায়ও ওর ছায়া দেখে এই প্রথম বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে এবং আকস্মিকতার রেশ ঝেড়ে তখনি মহিমাকে রিং করি: কি ব্যাপার, নুরু বেরিয়ে এসেছে। আমাকে জানাও নি?
তোমার ফোন এনগেজ ছিল, কয়েক বার চেষ্টা করেছিলাম। কেন?
আমাকে খুন করে এখন ও পালাচ্ছে!
সামনে ফাঁকা মাঠ, শীত আর ঘোলাটে কুয়াশায় একাকার, বিশ হাত দূরের বস্তুও সুনির্দিষ্টভাবে চেনা যাচ্ছে না। শালের ব্যাগটা নিয়ে ওর পিছু লাগি: ওকে আমি দাবড়ে বেড়াব, পানিতে চুবিয়ে মারব।
আশ্চর্য, একমাত্র পাখি ছাড়া আর কেউ জানে না আমি এখানে, ও কিভাবে আমার খোঁজ পেল!
সেদিন রাতে আমাদের মুখে মটরসাইকেলের আলো ফেলেছিল শুয়োরটা, আমি ভাবি, মহিমাকে নিয়ে যে হোটেলে বসেছিলাম সেখানে কি নুরুও যায়, জানি না। মনে পড়ে, আজ দুপুরে দড়াটানার বটতলায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল, একটা মটরসাইকেল মোড় ঘুরে অতি দ্রুত বেরিয়ে গেল, দূর থেকে পেছনটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। সে কি ও-ই? তখন থেকে পিছে লেগে আছে— হতে পারে!
ওকে রাস্তায় উঠতে দেব না, খোলামাঠ, ক্ষেতের মধ্য দিয়ে তাড়িয়ে বেড়াব, ভারি শরীর নিয়ে ও বেশিক্ষণ খেলতে পারবে না।
তারপরও শংকা জাগে, পাখির জন্য তৈরি হয়ে এসেছি, নুরুর জন্য নয়। আমি এখন সত্যিই অস্ত্রহীন এবং একা, ওর কাছে পিস্তল, আর ক’টা গুলি আছে? জানা দরকার। ওকে লক্ষে রেখে দূর থেকে আমি সড়কে উঠি, রেল ক্রসিং থেকে বেশখানিক দূরে একটা মটর সাইকেল। গায়ে আমার জ্যাকেট, দুপুরে পাখির জন্য একটা শাল কিনেছিলাম, ভেবেছিলাম শিমুলতলায় ওকে পরিয়ে দেব, সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব; শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে ভাল করে চাদরটা পেঁচিয়ে নিই। সাইকেলের ওপাশে মেহগনি, মাঝখানে দাঁড়াই, গুলি করলে গাছের পেছনে চলে যাব। ঢাল বেয়ে সড়কে উঠলে ও আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়ায়; পকেট থেকে পিস্তল বের করে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে কাগজের ব্যাগটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত ব্যাগের পেছনে এমনভাবে লুকাই যেন ওখানে কিছু আছে। কৌশলটা কাজে দেয়। সড়কের ঢাল বেয়ে নেমে ও দৌড়াতে শুরু করে, আমি সেটাই চাচ্ছিলাম। এবার আমার পালা। গাছ, ঝোপ মাটির ঢিবি আর আলের আড়ালে নিজেকে সেফ রেখে ওর পিছু নিলাম। সম্ভবত পিস্তলটা অর্থহীন, গুলিশূন্য। একজনের জন্য ছ’টা গুলি যথেষ্ট, বোকাচোদা সবগুলো খুইয়েছে।
চারপাশে চষা জমি, মাঝেমধ্যে মাছের ঘের, এখানে ওখানে দু’একটা খেজুর আর তাল আকাশমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের পশ্চিমে কাজিপুরের বলাডাঙা গ্রাম, মূল সড়কের খাদ বেয়ে ও উত্তরে দৌঁড়াচ্ছে। দৌঁড়াক, শীতের বেলা তার ওপর কুয়াশার প্রাবল্য, সাতক্ষীরা বেনাপোলের গাড়িগুলো সামনের লাইট জ্বালিয়ে মন্থর গতিতে চলে যাচ্ছে। মিনিট দশেক কাটল এভাবে। এরপর শুরু হবে মাছের ঘের, একের পর এক, তারপর চাঁচড়া বাসস্ট্যান্ড। মাছঘেরে লোকজন থাকে পাহারায়, বিপদ আসতে পারে। ক্ষেপিয়ে তুলতে ওকে আমি গালাগালি দিই, নাম ধরে টিটকারি মারি, সামসু-কানাই-এর বাপ বলে সম্বোধন করি, কাজে দেয়! ও থামে, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসি। পেছন ফিরে ও দেখে, আমি আবার তাড়া করি, গায়ের চাদরটা সম্ভবত বাবলা কাঁটায় জড়িয়ে ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে, এবং শিশির ভেজা মাটিতে পিছলে ও নিচে গড়ায়, আরো নিচে শুকনো কাদার ডোবা, ডোবায় পড়ার আগে দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর শরীরে।
ফোনটা বেজে ওঠে! বাজুক, মোটা শরীরটাকে আয়ত্তে আনতে কষ্ট হয়, প্রাণপণে ওকে উবু করে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে পিঠে বসে পড়ি, ঘাড়টাকে কাৎ করে আমার দিকে ফেরাই— দ্যাখতো, চিনতে পারিস আমাকে?
ও হাঁপায়, চোখ ডুমুরের মতো আকৃতি নিয়ে বেরিয়ে আসে যেন, শ্বাসকষ্ট হয়, ঘোঁত ঘোঁত করে।
ফোনটা আবার বেজে ওঠে। আমি চারপাশে তাকাই, না, শুধু পেছনের সড়ক বেয়ে হুস হুস গাড়ি চলে যাচ্ছে। আমি ঘাড়টা উল্টো দিকে প্রচণ্ড শক্তিতে ঘুরিয়ে ঝাঁকানি দিই, কটমট করে ক’টা শব্দ হয়। শরীর থিতিয়ে না আসা পর্যন্ত চেপে বসে থাকি। সবগুলো পকেট হাতিয়ে মটরসাইকেলের চাবিটা নিয়ে দ্রুত সড়কে উঠি। চাঁচড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে চাবি সমেত সাইকেলটা রেখে রিক্সা ধরি।
বুকটা ধড়ফড় করছে তখনও। ফোন বেজে ওঠে, হ্যাঁ শোনো, আমি বলি, পাখি তুমি মনিহারে নেমে দেবু সুইটস-এ গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি। না, না, আজ আর শিমুল দিঘি হবে না, দেখছ না কুয়াশায় সব ডুবে গেছে। হ্যাঁ? কি যে বল, হাঁপাব কেন? শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছি! আচ্ছা, ঠিক আছে, এসো…

চারবাক, বর্ষ ৯, সংখ্যা ১৩, ফেব্রুয়ারি ২০১০