006473
Total Users : 6473
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

বিকাশ কেন্দ্র-আমার অসমাপ্ত গল্প!

আমার জীবনে বিকাশ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা বা ভূমিকা ঠিক কিরকম সে কথা লিখতে বসে কিছুটা বিপাকেই পড়লাম। কি লিখব? কোথা থেকে শুরু করবো? বিকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক এতোই নিবিড় এবং অবিচ্ছেদ্য যে বিকাশ কেন্দ্র সম্পর্কে কোনও নিরপেক্ষ মন্তব্য করা আমার পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব এবং বিকাশ কেন্দ্রের কোন রকম প্রশংসা করাটাও আমার জন্য অত্যন্ত বোকামিসুলভ, অনেকটা যেন নিজের গিত গাইবার মতো ব্যাপার। আমি বরং কেবল আমার গল্পগুলোই কিছু কিছু বলবো। বিকাশ কেন্দ্র সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, সেটা আসলে বিকাশের বারান্দাতে আর ক্লাসরুমে বেড়ে উঠবার সময়টাতে আমার নিজেরি কিছু গল্প। আমার জন্য সবচেয়ে ভাল ঠিক এই মুহূর্তে যেই অবস্থানে আছি সেই জায়গা থেকেই আমার গল্প বলা, আর সেই পুরোনো গল্পগুলো পাঠকের সাথে ভাগ করে নেয়া।

জীবনের শুরুর দিকে কখনোই ভাবিনি দর্শনের মতো খটোমটো বিষয়ের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ জন্মাতে পারে। অথচ আজকে সেই বিষয়টাই আমার প্রাণের কত নিকটের একটা বাস্তবতা। শৈশব থেকে এমন একটা ধারণাইতো পেয়ে আসছিলাম যে দর্শন একটা খুবই ভারি এবং মাথার উপর দিয়ে যাবার মতো বিষয়। তার কিছু যদি বোঝা যায় তবে বুঝতে হবে যে যিনি বুঝেছেন তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সাধারণ মানুষের থেকে তার বুদ্ধিমত্তা অনেকটাই উচ্চ স্তরের। অর্থাৎ দর্শন সাধারণ মানুষের এখতিয়ারের ভেতরের কোনও বিষয়ই নয়। নিজেকে সাধারণের বেশি কিছু ভাবতে চাওয়ার মতো কোন ঘটনাই যেহেতু তখন এবং এখন কখনোই ঘটেনি… তাই আমরা কয়েকজন ধরেই নিয়েছিলাম এইসব বড়দের ব্যাপার; আমাদের কখনও জানা হবে না। লিয়াকত ভাইয়ের কথায় পরে আসব। এই সুযোগে বিকাশ কেন্দ্রকে একটা ধন্যবাদ জানাই। বিকাশ কেন্দ্র একটা কাজ অবশ্যই করেছিল, আমাদের মতো কিছু সাধারণ মেধার মানুষদের জন্য দর্শনের মতো একটা আপাত দুর্বোধ্য বিষয়কে জলের মতো সহজ না করলেও অন্তত বোধগম্যতার সিমার ভেতরে নিয়ে এসেছিল।

বিকাশে প্রথম কবে এলাম কি কারণে সেই গল্পটা না বললেই নয়। সেটা এখন থেকে প্রায় বছর বারো আগের কথা। এমন একটা বয়স ছিল যখন অন্তরে প্রচণ্ড ক্ষুধা জগতের রহস্য খুব দ্রুত বুঝে ফেলবার। কিন্তু এই বুঝতে গিয়ে খুব একটা গবেষণা করে সময় ব্যয় করতে মন রাজি নয়। মনের মতিগতি তখন এমন ছিল যে অনেকটা যেন বুঝতে চাওয়ার চেয়েও বোঝাতে চাওয়ার দিকেই ঝোঁক বেশি। জ্ঞান অর্জনের চেয়েও জ্ঞান জাহির করাটাই বড় নেশা আর কী! বন্ধুদের কাছে বিকাশের গল্প শুনে মনে হয়েছিল বিকাশ হতে পারে একটা যথার্থ শর্টকাট। সেইরকমই একটা ভেজালমিশ্রিত মানসিকতা বা নিয়ত নিয়ে আমি বিকাশ কেন্দ্রে এসেছিলাম আমার বন্ধু সামিওর সাথে।

এরপরের গল্পটা তাহলে এখন প্রসঙ্গত বলতেই হবে। ক্লাস করতে যখন শুরু করলাম তখন প্রথমদিকে তেমন একটা কিছু বুঝতে না পারলেও এক ধরনের নেশার মতো লাগত ক্লাসগুলো। হয়তো সেটা লিয়াকত ভাই’র পড়ানোর কায়দাগুলোর জন্যেই বেশি। আর তখন মনে হতো আমি বুঝি খুব একটা সিরিয়াস কিছুর মধ্যে আছি। এইভাবে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। প্রথম দুই একবছর কিছুই তেমন পোক্ত করে বুঝতে পারিনি সেটা এখন স্বীকার করার সুযোগটা নিলাম। তবে আস্তে আস্তে নেশা এবং ভয় দুটোই কাটলো। দর্শনশাস্ত্রের ভারি ভারি সব মানুষদের নাম সহজে বুকের কাঁপুনি ছাড়াই উচ্চারণ করতে শিখলাম। তাঁদের কাজগুলোকেও কিছু মাত্রায় জানবার সুযোগ হলো। আমার সেই কচি বয়েসে যেইসব প্রশ্ন আমাকে জ্বালিয়ে মারতো, বলবো না যে তার সবগুলোর উত্তরই আমি পেয়ে গেছি। বলবো না যে জগতের রহস্য এখন জলের মতো পরিষ্কার, অতএব আমার দর্শনচর্চার যাবতিয় প্রয়োজন অবশেষে ফুরিয়েছে। সেসব কিছুই নয় বরং এখনো আমি আরো বেশি আকৃষ্ট বিষয়গুলোর প্রতি। জীবনের নতুন নতুন ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায় আমি সেই ব্যাপারগুলোকে এখন আরো ভাল করে সম্পৃক্ত করতে চাই। দর্শন চর্চাটা তাই আমার জীবনে একটা জীবনব্যাপি প্রয়োজনই বলতে পারেন।

কিন্তু আমার নিজের কিছু মৌলিক পরিবর্তনের কথা আমি বলতে চাই। এই কেন্দ্র থেকে যে পরিবর্তনগুলো জীবনে যোগ হলো। পাঠচক্র থেকে মানুষ হিসেবে আমার চরিত্রে এমন কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে যেগুলো আমার জীবনকে প্রতিদিন প্রভাবিত করে। বিকাশ কেন্দ্র থেকে যখন আমি অনেক দূরে থাকি, নানা কাজের চাপে ইদানিং যখন দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রে যাওয়া হয় না, তখনো এখান থেকে পাওয়া এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সুফল আমি আমার ব্যক্তিজীবনে পাই। এতসব ভেঙে বলার পরিসর এখানে অনুপস্থিত। তবু আমার সেইসব প্রাপ্তির থেকে দুই একটা কথা না বললেই নয়।

বলছিলাম যে হাজার রকম প্রশ্ন নিয়ে একদিন হাজির হয়েছিলাম বিকাশ কেন্দ্রে খানিকটা জ্ঞানি হবার উদ্দেশ্যে। জ্ঞানি হওয়াও আমার হয়নি। আবার প্রশ্নগুলোর উত্তর বলতে সাধারণ অর্থে যা বোঝায় তাও যে আমার খুব মিলে গিয়েছে তেমনো নয়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনটাকে কোন পথে খুঁজবো তার একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে। জীবনে কোন কোন প্রশ্ন রয়েছে যেগুলোর একাধিক উত্তর থাকতে পারে এবং সবগুলোই সমানভাবে সঠিক বলে প্রতিয়মান হতে পারে এবং সবগুলোই সমানভাবে সঠিক বলে প্রতিয়মান হতে পারে, প্রশ্নকর্তার সামনে তখন একটা বিরল সুযোগ উপস্থিত হতে পারে, তার সামনে একগুচ্ছ উত্তরমালা থেকে যেকোন একটি বেছে নেবার বা একাধিক উত্তরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করার। এই যে আমরা সারা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ জগতের সত্যের একটি মাত্র রূপকে একান্তভাবে কামনা করি… এই মানসিকতার অন্তর্ভুক্ত থেকেই প্রথম প্রথম এই একই প্রশ্নের হাজারো উত্তরের সম্ভাবনাকে প্রচণ্ডভাবে অসম্ভব এবং সত্যের সঙ্গে প্রতারণা বলে মনে হতো। আস্তে আস্তে নিজের মস্তিষ্কের গ্রহণ ক্ষমতা বেড়েছে এবং এই অসম্ভব আসলে কত সহজেই সম্ভব… আমি তার সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়েছি।

আমার আরেকটি অর্জনের কথা না বললেই নয়। প্রশ্নের উত্তরের কথা তো গেল। আরেকটি কঠিন পরিস্থিতি হলো উত্তরহীনতার মধ্যে বাঁচতে শেখা। কখনো কখনো কোন প্রশ্নের যেমন একাধিক উত্তর থাকে, আবার কোন কোন প্রশ্ন আসলে ঠিক প্রশ্নের মর্যাদা পাবার যোগ্যই নয়। কোন কোন প্রশ্নের আসলে কোন উত্তর নেই। কেননা প্রশ্নগুলো প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি। এই যে একটা অসুবিধা জানতে না পারার, এই যে একটা নিরূপায় পরিস্থিতি… যেখানে আমি একরকম বাধ্য… এই অসম্পূর্ণতা নিয়ে বাঁচতে… এর সঙ্গে সমঝোতা করা একটুও সহজ ছিল না। কিন্তু এই কঠিন কাজটাকে সহনিয় করতে আমি বিকাশ কেন্দ্রের সহযোগিতা পেয়েছি; যদিও ব্যাপারটা এমন নয় যে বিকাশ কেন্দ্রে এই বিষয়গুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শেখানো হয়। কিন্তু আমি আমার মতো করে আমার যা ধনরতেœর প্রয়োজন ঠিকই তা নিয়ে নিয়েছি। জীবনে নিজের বৃত্তের কেন্দ্রে নানাবিধ অসুবিধা আর অসম্পূর্ণতার মধ্যে স্থির হয়ে বাঁচতে পারার যেই শিল্প, তার সন্ধান আমি বিকাশ কেন্দ্র থেকেই প্রথম পেয়েছিলাম। এটা এমন এক সম্পদ প্রতিদিনের নানাবিধ চর্চার মধ্য দিয়ে যেটাকে ধরে রাখতে হয়। সেই চেষ্টাটা আমি নিজের স্বার্থে এখনো চালিয়ে যাচ্ছি। কখনো বা নিজের অজান্তেই সেই পথেই চলছি, এইসব প্রাপ্তি আমার স্বভাবেরই মজ্জাগত উপাদান।

আমার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বলতে আমি যেটা বুঝি তাহলো নিজের এইটুকু ‘বুঝ’ যে পৃথিবীতে একটাই বিষয়ে সদর্পে নানান মতের অস্তিত্ব থাকতেই পারে। তার কোনোটাকেই ভুল বলাটা আমার পক্ষে ভুল হবে। একটা কোন বিষয় সম্পর্কে আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যেই মত তার স্বপক্ষে আমি অবস্থান নিলেও আমার সম্পূর্ণ বিপরিত অবস্থানের মানুষটির সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেও তার প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ এবং ব্যবহার বজায় রাখতে পারাটা আমার যুক্তিবোধের পক্ষে একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়েই দেখা দিয়েছিল। মত থাকুক মতের জায়গায় আর মানুষ থাকুক মানুষের জায়গায়, তার পূর্ণ মর্যাদায়- এই সহজ অবস্থানের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রমাণ করার কঠিন দায়িত্বকে স্ব-আগ্রহে নিজের জীবনে নিয়েছি। এখানেও বিকাশ কেন্দ্রের কথাই বলবো। আমাদের শিক্ষক লিয়াকত ভাই আমাদের এমন অনেক বিজ্ঞ মনিষিদের লেখার চুম্বক অংশ পাঠ করে শুনিয়েছেন এবং বুঝিয়েছেন যে নিজস্ব একটা মত গড়ে উঠবার পাশাপাশি মতের অনৈক্য হয়ে উঠেছিল একটা নৈমিত্তিক বাস্তবতা। নিত্যদিন যখন আমরা নানা মতের কথা শুনতাম তখন দ্বিমত বা ত্রিমত হয়ে গিয়েছিল একটা স্বাভাবিক বিষয়। আমার শিক্ষকের কাছে আমি এই জায়গাটাতে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। উনি আমাদের শেখাতে চেষ্টা করেছেন সবসময় ধৈর্য্য নিয়ে শুনতে, জীবনে চলতে।

যেই দর্শন চর্চা শুধুই পুঁথিগত ব্যক্তিজীবনে যার কোন ভূমিকাই আমরা রাখি না, আমাদের বিকাশ কেন্দ্রের দর্শন চর্চা আমার কাছে কখনোই তেমন কোন দূরের বিষয়, পুস্তকি বিষয় বা অধরা বিষয় হয়ে থাকেনি। বরং যখন যেমনটা শিখেছি তার একটা সম্পৃক্ততাকেই খুঁজেছি- আমাদের সাধারণ ডাল-ভাতের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যা কিছু শিখেছি তার সারকথাকে সবসময় মিশিয়ে দিতে চেয়েছি আমাদের ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিনতায়। অন্যদের কথা জানি না, আমার নিজের তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হতে পারেনি। আমার জীবনের উপভোগ তাতে শতগুণে চমকপ্রদ হয়েছে। বিকাশ কেন্দ্রের দর্শন ক্লাব আমাকে কোন মনিষির জ্ঞানদান করেনি কিন্তু সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বরাতে পাওয়া আমার যে একটা জীবন তাকে ষোলআনা আনন্দে বেঁচে নিতে হলে কি কি করতে হবে তার কিছু বাস্তববুদ্ধি আমি সত্যিই সেখান থেকে পেয়েছিলাম।

এগুলো সবই কৃতজ্ঞতার কথা। আমার ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কথা। লিয়াকত ভাই’র কথা কিছু বলি। মানুষটি আমার শিক্ষক। যখন নিয়মিত ক্লাস করেছি, যতদিন করেছি, যদি কোন কারণে তার ডান অথবা বাম দিকের আসনে বসতে না পারতাম তার কাছাকাছি তো মনে একধরনের অভাব বোধ করতাম। তাঁকে আমার শিক্ষক বলে ভাবতেই ভাল লাগে। যদিও গুরু বলে যদি কাউকে মেনে থাকি কখনো, তবে গুরু-আসনের সবচেয়ে নিকটতম অবস্থানে মনে মনে এই মানুষটাকেই চিরদিন আমি কল্পনায় দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তার শিক্ষার ধরনটাই এমন যে কখনো ঠিক গুরু-শিষ্যের যেই চিরাচরিত সম্পর্ক- আমার এই গুরুর মধ্যেও কখনো তার প্রত্যাশা দেখিনি, আবার তাঁর তথাকথিত শিষ্যরাও ঠিক সেরকম করে তাঁকে দেখে ভয়ে কাঁপতে শেখেনি। ভক্তির চেয়ে ভালবাসা আর শ্রদ্ধাটাকেই অনেক বেশি আমরা বুঝতে শিখেছি। আমাদের শিক্ষক সম্পর্কে একটা কথা আমি খুব জোর গলাতেই বলবো- উনি কখনো উনার নিজস্ব ভাবনায় আমাদের প্রভাবিত করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়নি। উনি বরাবরই চেয়েছেন আমরা যারা উনার কাছে ক্লাস করেছি, আমরা প্রত্যেকেই যেন নিজেদের মত, কর্ম ও জীবনপথের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসি হই, স্বনির্ভর হই। একসময় ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও সেইসব শিক্ষাকে নিজেদের ভেতরে ধারণ করতে চাওয়ার যেটুকু চর্চা আমরা আজো করি, সেগুলোই আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক সম্পদ। সেদিনের পাওয়া আত্মবিশ্বাস আমি এখনো ভেঙে রোজ খাই, এই শহরে।

এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলাম আমার প্রাপ্তির কিছু মনোগত দিক সম্পর্কে। কিন্তু এখানেই সব নয়। জীবনের কিছু হাল্কা ব্যাপার রয়েছে, যেগুলোর মর্মকে খালি চোখে অনেক সময় আমরা খাটো করে ফেলি, বুঝতে পারি না বলে। কিন্তু প্রতিদিন পলে পলে সেই সব সম্পদ আনন্দের উৎস হয়ে আমাদের প্রত্যেকদিন ভরিয়ে রাখে, সমৃদ্ধ করে। আমার কাছে সেইসবের মূল্য অনেক।
বিকাশ কেন্দ্রে দর্শন ক্লাবটাই মূল আকর্ষণ হলেও এর বাইরেও আরো কিছু ব্যাপার ছিল। সেখানেও আনন্দের অভাব কখনোই ঘটেনি এখনো ঘটে না। বিকাশ কেন্দ্রের বারান্দাতে সুখে দুঃখে বারো মাস যেইসব আড্ডা মেরেছি, সবুজ নিল চেয়ারগুলোতে বসে জীবনকে কল্পনাতে যতখানি সাজিয়েছি, সেগুলো শুধু আর কেন্দ্রের ভেতরে সিমাবদ্ধ নেই, মিশে গেছে আমার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেও। বিকাশ কেন্দ্রের প্রতি বছরের পিকনিক, পহেলা বৈশাখের সারাদিনব্যাপি অনুষ্ঠান, লাগাতার লাগামহীন অসংযমি খাওয়া-দাওয়া, গানের আসর সেইগুলো আমাদের জীবনে উৎসবের মতো ঘটনা। একুশে ফ্রেব্র“য়ারির রাতে প্রভাত ফেরিতে গিয়ে রাত ভোর করে দুপুর পর্যন্ত আড্ডা আমি জীবনে আর কোথাও দিয়েছি বলেও ঠিক মনে পড়ে না। তার উপর রয়েছে প্রত্যেক ঈদের পরের দিন বিকালে লিয়াকত ভাই’র বাসায় তুমুল খানাদানা এবং আড্ডা আর গান-বাজনা। দু-একবার তো স্রেফ গান গাইতে হবে এই ভয়ে আমি ভাবির সেই খাওয়াকে কুরবানি দিয়েছি না গিয়ে। (অবশ্যই কাজটা বোকামি হয়েছে।)

এগুলো তো আমাদের নির্ধারিত নিয়ম করা অনুষ্ঠান। এগুলোর বাইরেও যেসব দিন রঙ্গিন সেসব হলো অনির্ধারিত দিনগুলো, যখন কোন কারণ ছাড়াই আড্ডায় বসে গেছি আমরা। কিংবা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পরে আটকে গেছি, ব্যস এখন আড্ডা। মনের কোণায় একটা মেকি দুশ্চিন্তা- কি করে বাড়ি ফিরবো। অথচ ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, তো তিনি নিশ্চয়ই জানেন আন্তরিকভাবেই কেউ চাইতাম না বৃষ্টি থামুক আর আড্ডা ভাঙুক।

কোনো কোনোদিন আশির্বাদের মতো হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো। তখন ক্লাস বানচাল। লিয়াকত ভাই বললেন- ‘আজকে আমরা আড্ডা দেবো। সঙ্গে মাহফুজা আপার মুড়ি আর চা।’ কোনো কোনোদিন বরাতের জোর- চা-মুড়ির পাশাপাশি পিয়াজু, মিষ্টি ইত্যাদি কিছু বাড়তি জুটে যেতো। সেগুলোর কৃতিত্ব অবশ্য বিশেষভাবে মাহফুজা আপাকেই দিতে হবে। যিনি শুধু আমাদের বিকাশের ক্যাণ্টিনটাই সামলান… তাই নয়… মোটামুটি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সবই তার ডিপার্টমেন্টে পরে। লিয়াকত ভাই’র আড্ডার সঙ্গে সেই বাড়তি খাবারগুলো তখন সাক্ষাত স্বর্গবাস হয়ে উঠতো।

আমার আরেকটা স্বভাব ছিল সেশনগুলো রেকর্ড করার। লিয়াকত ভাই’র অসংখ্য ক্লাস আমার কাছে রেকর্ড করা আছে। কিছু কিছু আড্ডাও আছে সেগুলোর মধ্যে। অনেক মানুষের অনেক কটাক্ষকে উপেক্ষা করেও বছরের পর বছর আমি এই কাজটা চালিয়ে গেছি। এমন নয় যে আমার খুব রোজ রোজ সেইসব রেকর্ডিং শোনা হয়। কিন্তু আমার পার্থিব যত ধনসম্পদ আছে তার মধ্যে এই রেকর্ডিংগুলো আমার অত্যন্ত প্রিয়।

একটা দুঃখের কথা বলি। লিয়াকত ভাই আমাদের সবার খুব প্রিয়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রিয় তাঁর প্রাণের এই জায়গাটি। তাঁর বিকাশ কেন্দ্র। আমাদের বিকাশ কেন্দ্র। যেখানে আমরা জীবনটাকে আনন্দে উপভোগের মন্ত্রটাকেই পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। জীবনের কাছে আমি এখনো অনেক অনেক কৃতজ্ঞ… যে আমাদের শিক্ষক এখনো আছেন, এখনো গেলে তার ক্লাসগুলো পাই। কিন্তু উনি যখন থাকেন না- নানা কারণে তাঁকে যখন দেশের বাইরে যেতে হয়, তখন ক্লাসগুলো থেমে থাকে। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা। আমরা যারা তাঁর পুরনো ছাত্র-ছাত্রিরা আছি, আরেকটু সংশ্লিষ্ট হলেই নিজেরাই অনেক দায়িত্ব নিতে পারতাম। কিন্তু আমরা কেমন স্বার্থপরের মতো নিজেদের জীবনে ডুবে আছি। যদিও লিয়াকত ভাই সবসময় আমাদের নিজেদের কাজেই ফোকাস রাখবার শিক্ষা দিয়েছেন। তারপরেও এই জায়গাটাতে তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পারলেই নিজের বিবেকের প্রতি সুবিচারটা বেশি করতে পারতাম।

এখনো সময় আছে। বিকাশ কেন্দ্র আমাদের প্রাণের জায়গা। এখান থেকে দূরে থাকা মানে নিজের প্রাণের সঙ্গে দূরত্ব। সেই দূরত্ব খুব খুব টের পাই, তখন একেকদিন সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে ছুটে যাই। লিয়াকত ভাই’র ক্লাসে ঢুকে আমার পুরনো জায়গাটাতে অন্য কাউকে সরিয়ে দিয়ে বসি জেদি শিশুর মতো। আমার শিক্ষক অনেকদিন পরে আমাকে দেখে হেসে বলেন, ‘আজকে অনেকদিন পরে ‘হারানি’কে পাওয়া গ্যাছে।’ আমার প্রাণ ভরে ওঠে। মনে হয় এখানেই বারেবারে ফিরে আসি না কেন? কেন এত ব্যস্ততার মধ্যেও এই সময়টুকু নিজের জন্য করতে পারছি না? কেন নিজেকে এরকম করে আমরা ঠঁকাই? প্রাণের ডাকগুলো শুনি না কেন? সময় যে নেই, তা জীবনের দোষ হতেই পারে না। তা আমারি দোষ।

আশা করি, আমার সুমতি ঘটবে। একদিন এই কেন্দ্রে আমার যেই শিকড় গজিয়েছিল, তার যে এখনো সেখানেই আছে, সব অমূলক সন্দেহ দূর হয়ে, নিজের প্রাণের ভেতরে সেই কথাটাই পরিষ্কার করে জানবো। আশা করি, আগের মতোই বারবার করে আমি সপ্তাহে দু-একটা দিন সব ভুলে আবার আমার বিকাশের বারান্দায় ছুটে যাবো। নিজের জন্য জীবন থেকে এইটুকু ভাগ আমাকে বের করে আনতেই হবে। নিজের কাছে এইটুকু প্রার্থনা রেখে এই লেখাটিকে এখানেই অসমাপ্ত রাখলাম। অসমাপ্ত বলছি এই জন্যে… কারণ… বিকাশ নিয়ে আমার যত গল্প, তা এখনো আমার অন্তরের অন্দরে বয়ে যাওয়া শান্ত নিশ্চুপ প্রবাহমান নদির মতো, তার কোন সমাপ্তি টানা আমার পক্ষে অসম্ভব।

শেয়ার করুন: