004744
Total Users : 4744
Charbak magazine logo
sorolrekha logo

লেখক তালিকা

জন্ম. ২৩ নভেম্বর ১৯৭৫, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে। সম্পাদনা করছেন ‘চারবাক’ ও ‘সরলরেখা’। যুক্ত আছেন সাপ্তাহিক সাহিত্য আড্ডা ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও প্রদর্শন কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: মায়াহরিণ, কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, চারবাক, বুদ্ধিজীবীর দায়ভার, সম্পাদনা ২০০৯, সংবেদ, পক্ষ—প্রতিপক্ষ অথবা শত্রু—মিত্র, প্রবন্ধ ২০১০, চারবাক, নির্বাচিত চারবাক, সম্পাদনা ২০১১, চারবাক, নাচঘর, কবিতা, ২০১২, চারবাক, ভাষা সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্রাজ্যবাদি খপ্পর, প্রবন্ধ, ২০১৩, চারবাক এবং মুখোশ, কবিতা, ২০১৬, চারবাক, করোনাকালে, কবিতা, ২০২২, চারবাক।
View Posts →
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
View Posts →
প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ
View Posts →
বাংলাদেশের উত্তরউপনিবেশি ভাবচর্চার পথিকৃৎ ফয়েজ আলম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসাথে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। তার কবিতায় তিনি মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তার কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সাথে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সাথে ইশক’ যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সাথে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সাথে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরো শব্দের আশা’। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২)।
View Posts →
কবি ও গল্পকার। যুক্ত আছেন চারবাক সম্পাদনা পরিবারের সাথে।
View Posts →
কবি। জন্ম মৌলভীবাজার জেলায়।
View Posts →
প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে প্রান্তীয় কৃষক-মধুচাষি, বেতবাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন নিয়ে কাজ করছেন।
View Posts →
জন্ম— জুন, ০৬, ১৯৭৭। জন্মস্থান— উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। (শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে। প্রকাশিত কবিতার বই— ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)। প্রকাশিতব্য বই— অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)। সম্পাদক— চারবাক।
View Posts →

সম্পূর্ণ লেখক তালিকা

বোর্হেস ও সাবাতোর কথোপকথন

বোর্হেস : কবে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম? একটু দাঁড়াও… সময়ের হিসাব ভুলে গেছি। কিন্তু মনে হয় বিঅয় কাসারেসের বাড়িতে। ‘উনো ই এল উনিভেরাসো’র সময়ে।

সাবাতো : না বোর্হেস। বইটা বের হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। পরিচিত হয়েছিলাম বিঅয়ের বাড়িতে। তবে কয়েক বছর আগে, খুব সম্ভব ১৯৪০-এ।

বোর্হেস : (চিন্তিত) হ্যাঁ, ওই দিনগুলোতে… সারারাত সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে আলাপ হত। ওটা ছিল এক অন্য জগৎ। এখন আমাকে ওরা বলে, রাজনীতির আলাপ করতে। আমার বিশ্বাস ওদের মনোযোগ হচ্ছে রাজনীতিবিদে, বিমূর্ত রাজনীতিতে নয়। আমাদের মনোযোগ ছিল অন্য কিছুতে।

সাবাতো : আমি বলব ওসব আড্ডায় আমাদের আলাপের বিষয় ছিল এমন কিছু, যা আমাদের সবাইকে আকর্ষণ করত। তোমাকে, বিঅয়কে, সিলভিনাকে এবং আমাকেও। বলতে গেলে যা ছিল শুধুই সাহিত্য আর সংগীত। তার মানে এই নয় যে, রাজনীতিতে আমাদের অবহেলা ছিল। আমার তো নয়ই।

বোর্হেস : আমি বলব, সাবাতো, আমাদের আলাপে দৈনন্দিন স্ফুলিঙ্গের স্থান একেবারেই ছিল না।

সাবাতো : হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমরা শাশ্বত বিষয়গুলো ছুঁয়ে যেতাম। দৈনন্দিন জীবন সাধারণ স্রোতে ভেসে যায়। আজ যেটা নতুন, কাল সেটাই পুরোনো।

বোর্হেস : অবশ্যই ডায়রির লেখা স্মরণ করার কথা কেউ ভাবে না। ডায়রিতে যা লেখে তা ভুলে যাওয়ার জন্যই। অবশ্যই ভোলার জন্য।

সাবাতো : সবচেয়ে ভাল হত প্রতি বছর বা প্রতি শতাব্দিতে একটি খবরের কাগজ বের হলে অথবা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলে : ‘জনাব ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছে’— আট কলামের হেডিং।

বোর্হেস : (হাসতে হাসতে) হ্যাঁ… খুব সম্ভবত, হ্যাঁ।

সাবাতো : গুরুত্বহীন ঘটনাগুলো কিভাবে প্রতিদিনই ঘটে?

বোর্হেস : বড় ব্যাপার হচ্ছে, আগে থেকে কেউ জানে না কোনগুলো গুরুত্বহীন। যিশুকে ক্রুশে ঝোলানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল অনেক পরে, ঝোলানোর সময় নয়। এর জন্যই এমারসনের পরামর্শে আমি ডায়রি পড়ি না।

সাবাতো : কে?

বোর্হেস : এমারসন— যিনি বলতেন বই পড়তে, ডায়রি না পড়তে।

সাবাতো : যদি আমায় বলতে দাও… সেই সময় যখন বিঅয়…

বোর্হেস : হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বলছ সেই সময়ের কথা। যেন কত যুগ আগের কথা। হ্যাঁ, সত্যি। সময়ের হিসাবে ওটাই সত্যি। কিন্তু মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। আর আমরা মিলিত হয়েছিলাম মাত্র কয়েকবার।

সাবাতো : সময়ের অস্তিত্ব নেই, তাই না?

বোর্হেস : বলতে গেলে মানসিকভাবে এখনও আমি ওই সময়েই আছি… আর আমার অন্ধত্বও আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে।
(দীর্ঘ সময়ের নিরবতা) মনে পড়ছে বোয়েদো-ফ্লোরিদাকে নিয়ে বিতর্কের কথা। যেন আজই ঘটে গেছে, যা ছিল রবের্তো মিরিয়ানি আর এরনেস্টো পালাসিওর পরিকল্পিত রসিকতা।

সাবাতো : কিন্তু বোর্হেস, ওটা তো আমার সময় ছিল না (রসিকতা করে বললেন)।

বোর্হেস : হ্যাঁ, জানি। ফ্লোরিদা আর বোয়েদোর রসিকতাটা মনে পড়ে গেল। আমাকে লড়তে হয়েছিল ফ্লোরিদার হয়ে যদিও আমার পছন্দ ছিল বোয়েদোকে। কিন্তু ওরা আমাকে বলেছিল, দলবিভক্তি আগে থেকেই হয়ে আছে, (সাবাতো উপভোগ করে) এবং আমি কিছুই করতে পারিনি। শুধুই মেনে নিয়েছি। আরো অনেকে যেমন রবের্তো আরলট, নিকোলাস ওলিভারি অংশগ্রহণ করেছিল দুই দলেই। সবাই জানতাম যে, ওটা ছিল নিতান্তই এক রসিকতা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রভাষকই এ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে লেখাপড়া করেন। সমগ্র আয়োজনটা ছিল খুবই বিতর্কের জন্য। এরনেস্তো পালাসিও বলছিল, ফ্রান্সে এ ধরনের সাহিত্যিক বিতর্ক প্রায়ই হয়। আর আমরাই-বা ওদের থেকে পিছিয়ে থাকব কেন। এখানেও ও রকম করা উচিত। আর এভাবেই ‘রসিকতা’ রূপান্তরিত হল আর্হেন্তিনো সাহিত্যের এক অধ্যায়ে।

সাবাতো : মনে আছে বোর্হেস, সাহিত্য আর দর্শন ছাড়াও তোমার আর বিঅয়ের গভীর কৌতূহল ছিল অংকশাস্ত্রে? চতুর্থ মাত্রা, সময়… ডান আর ক্রমিক ব্রহ্মা- নিয়ে সেই আলোচনা…

বোর্হেস : (দুই হাতে ছড়ি আরো শক্ত করে ধরে একটু ঋজু এবং আবেগদিপ্ত হয়ে) আরে হ্যাঁ, অবশ্যই… নম্বরের পরিবর্তিত রূপ, কান্তর…

সাবাতো : চিরন্তন প্রত্যাবর্তন, নিটশে, ব্ল্যাংকি।

বোর্হেস : আর আগের কতকগুলোতে, পিথাগোরাস বা এসতইকোস।

সাবাতো : আপোরিয়াস, অ্যাকিলেস আর কাছিম… হ্যাঁ, মনে পড়ে বিঅয় যখন নতুন চুলো থেকে বের হওয়া গরম গরম বুস্তোস দোমেকের আখ্যানগুলো পড়ে শোনাত আমরা ভীষণ উপভোগ করতাম। কিন্তু সিলভিনার ওগুলো পছন্দ ছিল না, খুব গম্ভীর হয়ে থাকত।

বোর্হেস : হ্যাঁ, সিলভিনা এগুলোকে পড়তে চাইত অসংযমি আর জননিসুলভ বিরক্তি নিয়ে। আমার বলতে গেলে বুস্তোস দোমেকের আখ্যানগুলো পড়ে হাসিই পেত।

সাবাতো : মনে পড়ে স্টিভেনসন আর ওঁর ‘সিলেনসিওস’ নিয়েও অনেক আলাপ হত। অনেক সময় নিরবতাই ব্যাখ্যার চেয়ে হত বেশি অর্থপূর্ণ।

বোর্হেস : অবশ্যই। স্টিভেনসনের নিরবতাগুলো… আর চেস্টারটনও, হেনরি জেমস… না, খুব সম্ভব জেমস কম কথা বলতেন।

সাবাতো : এ ব্যাপারে যার খুব আগ্রহ ছিল তিনি পেপে বিয়াংকো।

বোর্হেস : হ্যাঁ, ও অনুবাদ করেছিল ‘দি টার্ন অফ দি স্ক্রু’। শিরোনামটি অনেক ভাল হয়েছিল এটা সত্যি। স্ক্রুর প্যাঁচের চেয়ে স্ক্রু আরেক প্যাঁচ তো অবশ্যই ভাল। তাই না?

সাবাতো : এই শিরোনাম ভাবার্থকে আরো বেশি স্বচ্ছ করে দেয়। পক্ষান্তরে সেন্ট এক্সুপেরির ‘তেরে দে হোম’ বইটির অনুবাদ হয়েছে পুরুষের পৃথিবী নামে। যেন বলা হচ্ছে পৌরুষের পৃথিবী। মনে হয় যেন কিরোগা অথবা জ্যাক লন্ডনের কোনো বইয়ের নাম। যখন আসলে বোঝাতে চাচ্ছে, ‘এই মানুষের পৃথিবী’ (আক্ষরিক অর্থেও তাই), সেসব হতভাগাদের যারা এই গ্রহের বাসিন্দা। এই অনুবাদক শুধু ফরাসিই জানে না— তাই নয়, এমনকি সেন্ট এক্সুপেরিকেও সে বোঝেনি। এবং তার সমগ্র কাজও বোঝেনি। কিন্তু বোর্হেস, মনে পড়ে অনেক আগে ভার্জিনিয়া উলফের ‘ওর্লান্ডো’র অনুবাদ আমার মনোযোগ কেড়েছিল…

বোর্হেস : (বিমর্ষ ভঙ্গিতে) হ্যাঁ, আমার মা অনুবাদ করেছিলেন, আমি সাহায্য করেছিলাম।

সাবাতো : কিন্তু এটা তো তোমার নামে। অধিকন্তু যা বলতে চাচ্ছি, তা হল দু’টো বাক্য আমি দেখেছিলাম যা আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। যেটা ছিল বোর্হেসিয় কিংবা আমার ওই রকমই মনে হয়েছিল। প্রথম বাক্যটি মোটামুটি এ রকম যে ওর্লান্ডোর বাবা ‘এক বিশাল প্রতারকগুলোর’ গলা কেটেছিল এবং অপরটি হচ্ছে যখন ওই লেখক ওর্লান্ডোর কাছে ফিরে আসে এবং ‘এক খসড়া ওকে ছোট বানিয়ে ফেলে’। এই বাক্যগুলো, বোর্হেস, এতটাই তোমার মতো মনে হচ্ছিল যে, আমি মূল বইটি খুঁজে বের করেছিলাম। আমার স্মৃতিশক্তি যদি দুর্বল না-হয়ে থাকে, তাতে লেখা ছিল এ রকম : প্রেজেন্টেড হার এ রাফ ড্রাফট।

বোর্হেস : (হাসতে হাসতে) হ্যাঁ, এ-ও তোমার নজরে পড়েছে।

সাবাতো : এটা মন্দ নয়। এতে কেবল এই বোঝায় যে, সব সময়ই একজন লেখক অনূদিত হবে এমন একজন মাঝারি মানের লেখক দ্বারা যার ছাপ পড়বে কম এবং তার ভূমিকা থাকবে নৈর্ব্যক্তিক, তাই না?
মনে পড়ে, অনেক আগে ‘ম্যাকবেথ’-এর মঞ্চায়ন দেখেছিলাম। অনুবাদটা ছিল একেবারে বাজে। যেমন ছিল অভিনেতা, তেমনই এর সেট ডিজাইন। কিন্তু রাস্তায় বের হয়েছিলাম ট্রাজিক প্যাশনটাকে বের করে দিয়ে। শেক্সপিয়র তার অনুবাদককে জয় করতে পেরেছিলেন।

বোর্হেস : অনেক অনুবাদই হতচকিত করে দেয়। … ইংরেজি একটা সিনেমা আছে যার আসল নাম হচ্ছে ‘দি ইমপারফেক্ট লেডি’, এখানে সেটা অনূদিত হয়েছে এভাবে ‘বেশ্যা’। সমস্ত আকর্ষণই হারিয়ে গেছে। আসলে এইভাবে একটা শিরোনাম বদলানো, যেখানে লেখক সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন এবং শিরোনামটি যখন পছন্দ করেছেন, তখন এ নিয়ে অনেক চিন্তা করেছেন। কারোরই, এমনকি অনুবাদকেরও উচিত না পরিবর্তনে বিশ্বাস করা।

সাবাতো : শিরোনামটাই কি একটা বইয়ের মুখ্য রূপক নয়? বলা যায়, কোনো বইয়ের ফিলোসফিক্যাল সিস্টেমগুলোকে শিরোনাম দিয়েই নিশ্চিত করা যায়। প্রায় সব সময়ই ওগুলো হচ্ছে এক কেন্দ্রিয় রূপকের বিকাশ : হেরাক্লিটাসের নদী, পারমেনাইডিসের পরিমণ্ডল…

বোর্হেস : অবশ্যই, যদি ধরা হয় শিরোনামগুলো ক্যাজুয়াল নয়। বেশ তাহলে বইগুলোও নয়, তাই না? (অতীতে বোর্হেসের এই খুঁজে বেড়ানো এবং লক্ষ করার মতো স্বগতোক্তি সাবাতো সম্ভবত অনুমান করতে পারছেন। অনেক ঘণ্টা বাকি আছে, সামনে অনেক সময়।)
বই সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথম দিকে যারা বই সম্পর্কে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, তারা হচ্ছেন হোসে এরনান্দেস আর এনরিকে লাররেতা। পরে হিরন্দো। এসব বইয়ের মধ্যে স্মরণিয় হচ্ছে কাকতাড়ুয়া এবং ফ্লোরিদার রাস্তায় ওরা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে এক গাড়িতে মিছিলও করেছিল। অপরদিকে কিছু সময় আছে, লুগোনেস ও গ্রোসাকের বই ছাপানোর সময় যেগুলো ছাপিয়ে কেবল লাইব্রেরিতে বিতরণ করা হত। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা খুব একটা ভিন্ন নয়। আমার বাবা ৩০০ পেসো দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমার প্রথম বইয়ের ৩০০ কপি ছাপতে পেরেছিলাম। বন্ধুদের মধ্যে সেগুলো বিতরণ আর উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিই-বা করার ছিল? বোর্হেস নামে এক লোক কবিতা লেখে এ আর কার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ?

সাবাতো : লেখক আর প্রকাশনার সম্পাদকদের মধ্যে সবসময়ই একটা খিটমিটি লেগেই আছে। যেকোনো সূচনাতেই এটা কঠিন করে তোলে। তারপরও বলব আমাকে যা বিস্মিত করেছে তাহল যে কেউ বই দোকানের তাকগুলোতে দেখতে পাবেন শিরোনামের দখলদারিত্ব। খুব সম্ভবত পাঠকের চেয়ে লেখকই বেশি। অন্য আরেকটা জিনিস হচ্ছে নিউজস্ট্যান্ড। আগে, ৩৫ সালের দিকে আর্লট কেবল রাস্তায় বিক্রি হত।

বোর্হেস : (বিস্ময়ের সঙ্গে) নিউজস্ট্যান্ডে বই!

সাবাতো : (হাসতে হাসতে) হ্যাঁ, তোমারগুলোও : এল আলেফ, ফিকসিওনেস এবং ক্লাসিকগুলো। (বোর্হেস মাথাটি একটু উঁচু করে যেন আরো একটু বেশি বিস্মিত হয়ে, চোখে-মুখে এবং অভিব্যক্তিসহ যেন আরো কিছু খুঁজছেন)। হ্যাঁ, এবং আমার ভালই লাগে। তোমার বই ওই ফুটপাতে। পাঠকের প্রতি পদক্ষেপে।

বোর্হেস : তবে আগে এরকম ছিল না। অবশ্যই…

সাবাতো : যা হোক, এক সময় ছিল যখন মাঠের গুদামগুলো ওদের ক্রয়পত্রে ঘাসের বস্তা আর কৃষি-যন্ত্রপাতির সঙ্গে ‘মার্টিন ফিয়েররো’র বইও চাইত।

বোর্হেস : এরনানদেস নিজেই এটা ছড়িয়েছে বা কল্পনা করেছে। গ্রামের লোকগুলো ছিল নিরক্ষর। (নিরংকুশ নিরবতাকে গ্লাসের মৃদু শব্দ যেন বিরক্ত করছিল। গরম কিন্তু মনে হয় আমরা সবাই তা ভুলে গেছি। শেষ শব্দটা বাতাসে ভাসছে)। মার্তিন ফিরেররো… কবিতা শিল্প হিসেবে তারিফ করার মতো কিন্তু চরিত্র নয়। (সাবাতোর চোখগুলো এখন বোর্হেসের মুখে কিছু একটা খুঁজছে। বোঝা যায়, কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন কিন্তু অপেক্ষা করেন তিনি)।

বোর্হেস : ফিয়েরতো ছিলেন এমন এক দলত্যাগি যিনি সামরিক বাহিনিকে মিথ্যে গল্প শুনিয়ে আনন্দিত করেছেন। কিন্তু তুমি যদি এসব কোনো বোদ্ধাকে বল তবে সে রাগ করবে। আর্হেন্তিনোর সাহিত্যের ইতিহাসে রিকার্দো রোহাস পর্যন্ত
অস্তিত্বহীন তর্কের মাধ্যমে ওর পক্ষ নেয়। ওর পক্ষ নিয়ে বলে, বইতে দেখা যায় মরুভূমিকে জয় করে শহর গড়ে তুলেছে। খোলামেলাভাবে বলতে গেলে কেউ এগুলোর একটি শব্দও পড়েনি।

সাবাতো : ফিয়েররো ছিলেন সিমান্তের কাজ-কর্মের বিপক্ষে এক ক্রুদ্ধ, এক বিদ্রোহি এবং তার কালের অন্যায় কর্মকা-ের বিপক্ষে। (বোর্হেস তার চোখ দু’টো বন্ধ করেন এবং খোলেন। তাঁর দাম্ভিক কিন্তু অনুদ্ধত ভঙ্গিটি অক্ষুণ্ন রেখে একটু নড়াচড়া করলেন)।

বোর্হেস : না, আমার তা মনে হয় না। মার্তিন ফিয়েররো বিদ্রোহি ছিল না। ওকে ঠিকমতো পারিশ্রমিক দেওয়া হত না বলে সে দলত্যাগ করে এবং খারাপ একটা কাজ করে লাভবান হওয়ার আশা নিয়েই সে শত্রুপক্ষে যোগ দেয়। তবে লেখকও বিদ্রোহি ছিল না। হোসে এরনানদেস ছিল উঁচুতলার লোক। লিঞ্চ ও উদাওন্দোদের আত্মীয়। ওকে যদি গাউচো বলা হত তবে রাগ করত। গাউচো তো সাধারণ কিন্তু মার্তিন ফিয়েররো ছিল ব্যতিক্রম। কারণ সে হচ্ছে এক পিস্তলবাজ আর এই কারণে খানিকটা মনে আছে : ওরমিগা নেগ্রা সম্ভবত ১৯০৫ সালে মারা গেছে। পিস্তলবাজ গাউচো যেমন একটা ব্যতিক্রম, তিন বন্ধুর মধ্যে সুদর্শন বন্ধুটি যেমন ব্যতিক্রম তেমনি গাউচো পিস্তলবাজও। আমাদের দাদি ৭২/৭৩ বছরের যোদ্ধাদের এক ট্রুপে দেখেছিল। এরনানদেস্ ওগুলো কিছুই জানত না। ওর বন্ধু মানসিয়ার তথ্য, একটা বইয়ের ওপর ভিত্তি করে এরনানদেস এটি লিখেছেন। যে কারণে সে কোনো দিনই মার্তিন ফিয়েররোকে সামাজিক প্রতিবাদের একটা ম্যাসেজ হিসেবে মেনে নেয়নি, অধিকন্তু ফিয়েররোকে নিয়ে যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বিতর্ক ছিল। সাবাতো, আমার মনে হয় না এরনানদেস একটা নতুন সামাজিক বিন্যাস চাইত।

সাবাতো : এরনানদেস উঁচুতলার ছিল গ্লাাসের— এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, সেন্ট সাইমন, মার্ক্স, ওয়েন, ক্রোপোকিন— ওরাও অভিজাত কিংবা বুর্জোয়া শ্রেণির লোক ছিল। এরনানদেস যে গেভারার মতোই লিঞ্চের আত্মীয় ছিল তা তো জানতাম না। মার্তিন ফিয়েররো সম্পর্কে আমার ধারণা হচ্ছে, নিজের মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত এই গাউচো। আর এরনানদেস ওকে নিুবর্গের মানুষের জন্যই তৈরি করেছে। এই লেখার পিছনে এরনানদেসের উদ্দেশ্যটা কি ছিল তা আমার জানা নেই। আর ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়। কারণ, তুমি জান, যেকোনো কাজের শৈল্পিক মূল্য ওর উদ্দেশ্যকে সব সময়ই অতিক্রম করে যায়। রাশিয়ায় মদ্যপানের বাড়াবাড়ির বিপক্ষে ‘মাতালগুলো’ নামে যে বইটি আছে, দস্তয়েভস্কি সেটা কতটা দেশপ্রেম নিয়ে লিখেছে তা আর কেই-বা মনে রাখে : এরই প্রকাশ হচ্ছে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’।

বোর্হেস : অবশ্যই ‘দন কিহো’তে যদি শুধুমাত্র সেকালের বীরগাঁথাগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রুপাত্মকই হত তাহলে ওটা আর ‘দন কিহো’তে হত না। কোনো শিল্পকর্ম শেষ হওয়ার পর লেখক যদি মনে করে সেটা একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে করেছে, তাহলে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

সাবাতো : খুব সম্ভবত উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে ট্রাম্পোলিনের মতো যা পানির গভীরে লাফ দেওয়ার জন্য এক অবলম্বন মাত্র। মনের সচেতন স্তরের চেয়ে আরও শক্তিশালি এবং জ্ঞানময় অবচেতন মন কাজ শুরু করে আর অবশেষে ওই অবচেতন শক্তিই বৃহত্তর সত্যকে প্রকাশ করে। মার্তিন ফিয়েররো প্রসঙ্গে আমি তোমার সঙ্গে কিছুটা একমত : ওকে প্রতিবাদের সাক্ষ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। কিংবা বলা যায়, বইটিকে শুধুমাত্র প্রতিবাদের বই হিসেবে দেখা উচিত না। কারণ এ ক্ষেত্রে এর নৈতিক মূল্য যাই থাক না কেন, এটা শৈল্পিক মান স্পর্শ করতে পারত না। আমার মনে হয়, মার্তিন ফিয়েররোর মূল্যটা এখানেই যে এই বিদ্রোহ থেকেই সে উঁচুতলায় জায়গা করে নেয় এবং যেকোনো কালের, যেকোনো মানুষের বিশাল আধ্যাত্মিক সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে : একাকিত্ব এবং মৃত্যু, অন্যায়, প্রতিক্ষা এবং সময়।

বোর্হেস : (সাবাতোর দিকে মুখ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন) স্বীকার করি অনেক বাস্তব মানুষকেই যেমন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায় ফিয়েররো হচ্ছে সে রকমই এক জীবন্ত চরিত্র, আমি এভাবেই দেখেছি।

সাবাতো : এর ফলে অনেক ব্যাখ্যাই বেরিয়ে এসেছে। সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, অধিবিদ্যক।

বোর্হেস : (ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে) কিন্তু আমি তো এর বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলিনি…

সাবাতো : এ সম্পর্কে তোমার মন্তব্যপূর্ণ লেখা আছে… আমার মনে হয় এ বিষয়টি পরিষ্কার হলে ভাল হয়।

বোর্হেস : ‘ম্যাকবেথ’কে ইংরেজদের মডেল হিসেবে প্রস্তাব করাটা যেমন ভুল তেমনি মার্তিন ফিয়েররোকেও আদর্শ চরিত্র হিসেবে প্রস্তাব করাটা ভুল। তাই না? ট্রাজেডি হিসেবে আমার মতে, এটা প্রশংসনিয়। কিন্তু নৈতিক মূল্যবান চরিত্র হিসেবে নয়।

সাবাতো : এতে প্রমাণিত হয় যে, বড় লেখক মানেই ভাল চরিত্র নির্মাণ, তা নয়। রাসকলনিকভ বা হুলিয়েন সোরেল, এদের কাউকেই ভাল ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়িত করা যাবে না। মহৎ সাহিত্যে এ রকম চরিত্রের প্রায় কেউই নেই।

বোর্হেস : কি অদ্ভুত! এখন মনে পড়ছে মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের একটা তত্ত্ব যেটা আমার মতে ভুল। তিনি বলতেন উপন্যাসের সব চরিত্রকেই নৈতিকভাবে নিখুঁত হতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে সংঘাত ছাড়া, কিছু লেখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ত… তার ভিত্তি এই ধারণায় : ‘মহাকাব্যের আদর্শ আর্কিটাইপ’।

সাবাতো : আমার কাছে ঠাট্টার মতো মনে হয়।

বোর্হেস : না। সে আসলেই বলত। বেশ, যদি সে রকমই হত তাহলে আর উপন্যাসই হত না, তাই না?

সাবাতো : উপন্যাসের মহৎ চরিত্রগুলো নিয়ে যথেষ্ট হয়েছে। চরিত্রগুলো সব সময়ই প্রান্তিয়, নিয়মবিহীন আউটসাইডার।

বোর্হেস : কিপলিংয়ের একটা বাক্য আছে, যা তিনি শেষ জীবনে লিখেছিলেন : ‘একজন লেখকের অধিকার রয়েছে একটা গল্প লেখার, নীতি নয়।’ এই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য কিপলিং যে উদাহরণ দিয়েছেন সেটা সুইফটের গালিভার। উনি এটি মানবজাতির উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। কিন্তু বইটি হয়ে গেছে বাচ্চাদের জন্য। তার মানে ঠিকই বেঁচে আছে কিন্তু লেখকের উদ্দেশ্য পূরণ করে নয়।

সাবাতো : একই সঙ্গে এক বিস্ময়কর গল্প এবং বাচ্চাদের অভিযানের গল্প হওয়া খুবই জটিল এই দ্ব্যর্থকতা উপন্যাসে প্রায়ই দেখা যায়।

অনুবাদ : আনিসুজ্জামান খান

বর্ষ ৩, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৪

শেয়ার করুন: