ভারতীয় উপমহাদেশে সম্পদ বলতে ছিল ভূমি আর এ ভূমিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল সামাজিক সম্পর্ক। ব্রিটিশ শাসন অধিকারের পূর্ব-পর্যন্ত এ দেশিয় ঐতিহ্যবাহি সকল ভূমিব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, যা অতীতের বিজেতা আরবি, তুর্কি, মুঘল, পাঠানদের আগমন বির্গমন ভেঙে দিতে পারেনি। কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, ‘আরবি, তুর্কি, তাতার, মুঘল একের পর এক ভারত প্লাবিত করেছে তারা অচিরেই হিন্দুভূত হয়ে গেছে, ইতিহাসের চিরন্তন নিয়ম অনুসারে বিজয়ীরা বিজিত হয়েছে তাদের প্রজাদের উন্নততর সভ্যতায়।’
কাজেই ইংরেজরা ছিল এদেশে একমাত্র ভিন্নতর বিদেশি সামাজিক শক্তি যারা এদেশের মাটিতে পা রেখেই অনুভব করেছিল একটি অনুগত বশংবদ শ্রেণীর। চতুর ইংরেজ স্থানিয় বণিক-মহাজনদের অংশিদারে পরিণত করার নীতিসহ স্বাধীনচেতা দাম্ভিক সামন্ত-অভিজাতদের প্রতিহত করে আপোষকামীদের সঙ্গে আঁতাত সৃষ্টি কৌশল গ্রহণ করে। ইতিহাসের দ্বন্ধমুখর এই সময়ে শেষপর্যন্ত বিশ্বাসঘাতক বণিক পুঁজি-সামন্ত-অভিজাতদের আধিপত্যই বিজয়ী হলে পৌনে দু’শ বছরের জন্য এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের করতলগত হয়ে পড়ে।
ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে দুর্দান্ত প্রতাপে সবকিছুই তছনছ হয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সনে ইংরেজরা দেশের ভূমিব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে স্থায়ী পদানত শ্রেণীর জন্ম দেয় তারা ছিল এ দেশে জমিদার শ্রেণী। ইতোপূর্বে একসনা, পাঁচসনা ভূমি বন্দোবস্ত যে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, স্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শোষণের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়। এ নিশ্চিতকরণই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এ ব্যবস্থায় পল্লিঅঞ্চলে জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগি ও রায়ত— তিন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। ভূমি ও উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছা শ্রেণী ও জমিদারের দ্বৈত শোষণ ইংরেজ শাসনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির সহায়ক হলেও প্রজা নিপীড়ন-নিষ্ঠুরতা সামন্ত-জমিদারদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে দেয়।
এরই আলোকে ভানুবিলের প্রজাবিদ্রোহের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বৃহত্তর সিলেটের অন্তর্গত মৌলভীবাজার জেলাধিন কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মনিপুরি অধ্যুষিত স্থানে এই বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। মনিপুরিদের মূল আবাসভূমি ভারতের ইম্ফল হলেও কিভাবে বিপুল সংখ্যক মনিপুরি এখানে বসতি স্থাপন করেছিল তার ইতিকথা জানা যায় বর্মিদের বারংবার আক্রমণ, ইংরেজ শাসন-শোষণ-নিষ্পেষণ থেকে। স্বাধীনচেতা মনিপুরিরা তা মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনচেতা বীর টিকেন্দ্রজিৎকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে হত্যা করার পর রক্তাক্ত দ্বন্ধের শেষ অংকে মনিপুরের শেষ রাজাকে ‘বন্দী’ অবস্থায় সিলেট নিয়ে আসা হয়। সিলেটের মির্জা জাঙ্গাল নামক স্থানটিকে বন্দি করে রাখা হয় তাকে। মনিপুরি রাজার অবস্থান হিসাবে তা ‘রাজবাড়ি’ নামে খ্যাত। প্রজাভক্ত রাজাকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করে সুদূর সিলেটে রাখায় দলে দলে অনুগত মনিপুরিদের বিরাট অংশ দেশ ছেড়ে এখানে এসে ভিড় জমাতে থাকে। শহরে বসবাসের অনুমতি না পাওয়াতে শেষপর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মনিপুরি জনবসতিশূন্য ‘ভানুবিল’ অঞ্চলকেই তাদের আবাসস্থল হিসাবে বেছে নেয়। জঙ্গল আবাদ করে সেখানে বসতি স্থাপন করে শত শত মনিপুরি পরিবার। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতই, পাঙ্গান (মুসলিম) এই তিন সম্প্রদায়ের মনিপুরির বসবাস এখানে।
মনিপুরিরা যারা একদিন বন কেটে বিরাট শস্যের ক্ষেত তৈরি করেছিল নিজেদের প্রয়োজনে, পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করেছিল, সেই সব নর-নারীদের বলতে গেলে কেউ আর বেঁচে নেই। জঙ্গলপূর্ণ জনপদে গড়ে তোলা তাদের জীবন বেশি দিন সুখের হতে পারেনি। নিজেদের শ্রমে-ঘামে গড়ে তোলা আবাদ, প্রজাদের শান্ত জীবন জমিদার আলি আমজদ খাঁ ও তার বশংবদদের সহ্য হয়নি। জমিদার আলি আমজদ খাঁ ছিলেন তৎকালিন লংলার পৃথিমপাশার জমিদার। এই ভানুবিল অঞ্চলটি ছিল তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। স্থানিয় অপরাপর সম্প্রদায় যেমন হিন্দু ও মুসলমানদের সঙ্গে মনিপুরিরা তাদের সহজ সরল সম্পর্ক নিষ্ঠা ও সততায় খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। হলে হবে কি, এই ভানুবিল অঞ্চল ছিল জমিদার আলি আমজদ খাঁর জমিদারী। যেমন ছিল জমিদার, তেমনি ছিল তার নায়েব-গোমস্তা কর্মচারী। তার নায়েব রাশবিহারী দাশ। এর প্রতাপ ছিল দুর্দান্ত। প্রজারা অতিষ্ঠ তার নানা হয়রানি জুলুমে। খাজনা আদায়ের দায়িত্বও ছিল এরই ওপর। জুলুমবাজ রাশবিহারী সম্পর্কে আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন রচিত পুঁথিকাব্যে উল্লেখ আছে:

পেট মোটা রাশবিহারি চলিতে না পারে,
দশ বার জনে উঠাইয়া দিলা হাতিরও উপরে।

বিরাট দেহের অধিকারী রাশবিহারী মহাশয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রজাদের রশিদপত্র না দিয়েই খাজনা আদায় করতেন। প্রজাগণ সরল বিশ্বাসে রশিদ না নিয়েই টাকা জমা দিয়ে দিতেন। কিন্তু একদিন তারা অবাক বিস্ময়ে দেখল হিসাবের খাতায় তাদের খাজনা পরিশোধের নাম নেই। আর, তাদের নামে জমিদারের পক্ষ থেকে খাজনার নোটিশ জারি করা হচ্ছে। খাজনা পরিশোধ করার পরও এভাবে শত শত কৃষকের ওপর নোটিশ জারি করা হল। একে জমিদার ও নায়েবের অত্যাচারে প্রজাসাধারণ অতিষ্ঠ, অন্যদিকে খাজনার নোটিশ সব মিলিয়ে তাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ভানুবিলে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা এভাবেই।
১৯৩০-৩১ সনে সূচিত এই বিরোধ পরে লড়াই সংগ্রামের রূপ নেয়। এ সময়ে বিশ্বব্যাপি সাম্রাজ্যবাদী সংকট, খোদ বিলাতে শাসকমহলে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ যুদ্ধ-উন্মাদনা, অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাজতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান-অভ্যুদয় স্বাধীনতা শান্তিকামি দেশসমূহে গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলন ও স্থানে স্থানে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজাবিদ্রোহ এ-সময়ের উল্লেখযোগ্য চেতনাশ্রয়ী ঘটনা। জমিদারের নোটিশ জারির বিরুদ্ধে ভানুবিলের কৃষক-প্রজারা ঐক্যবদ্ধ হল। অন্যায় নোটিশ জারির বিরুদ্ধে পাড়ায়-মহল্লায় বৈঠক আলোচনা চলতে লাগল। এদিকে জমিদারের পেয়াদা, কর্মচারিরা ঘরে ঘরে শাসানি হুমকি দিতে লাগল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈঠক করে কৃষকরা স্থির সিদ্ধান্ত নেন, তারা জমিদারের খাজনা দেবেন না। পৃথিমপাশার জমিদার (আলি আমজদ খাঁ) এই খবর পেয়ে সমাজ প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন পঞ্চানন শর্মা, বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা ও কাসেম আলি (মনিপুরি মুসলমান)। আলোচনার প্রথম পর্যায়ে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও জমিদার খাঁ সাহেব একসময় বুঝতে পারলেন, প্রতিনিধিদের তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে রাজি করানো যাবে না। তখন তিনি লাঞ্ছিত করার পথ বেছে নিয়ে তাদের কয়েদখানায় আটকে রাখলেন। বিষয়টি ভানুবিলের পুঁথিকাব্যে কবি বর্ণনা করেছেন এভাবে:
সাহেব বলেন প্রজাগণ বলি তোমাদের কাছে
ভানুবিলের বহু খাজনা বাকি পড়িয়াছে।
অল্পে অল্পে বাকি খাজনা পরিশোধ করিয়া,
নতুন কবুলিয়াত দিবায় লেখিয়া।
তারা কহে মিয়া সাহেব এমন কইবায় না
প্রাণ থাকিতে কবুলিয়ত আমরা দিব না।
যে সময়ে মনিপুরিগণ এ কথা কহিলা
বারুদের ঘরে যেন আগুন লাগাইলা।
হুকুম করিয়া সাহেব দেশওয়ালি ডাকিয়া
পিলখানাতে মনিপুরি সব রাখ বান্দিয়া।

বন্দি অবস্থায় সমাজ প্রতিনিধিদের পিলখানায় রাখা হল এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হল। অবশ্য একদিন পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল তাদের বন্দী রাখার খবর। সমগ্র ভানুবিলে, সমগ্র কমলগঞ্জে এই ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। ভারাক্রান্ত, হতাশ, ক্ষুব্ধ সমাজ প্রতিনিধিরা বাড়ি ফিরে আসেন। মনিপুরি সমাজে পুরুষের মতো মহিলারা স্বাধীনচেতা। এই ঘটনা তাদেরও আলোড়িত করল সমানভাবে। পুরুষের সাথে সংগ্রামে তারাও ঐক্যবদ্ধ হল, একাত্মতা ঘোষণা করল। ঘরে ঘরে তারা সহযোগিতার দুর্গ গড়ার শপথ গ্রহণ করে। ভানুবিলে কৃষকদের আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল একটা স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা অবশ্যই। তারা নিজেদের ও বাইরের বিপ্লবী নেতাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং সতর্কতার সাথে তাদের গোপন অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষক-শ্রমিকদের বিদ্রোহ, আন্দোলন-সংগ্রাম তখন অজানা ছিল না কারো। জাতিয় পর্যায়েও ব্রিটিশবিরোধী নানামুখি আন্দোলন চলছিল তখন। গান্ধিজির নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সিলেট তথা আসামে (১৯১৯-২৩) যারা নেতৃত্ব দান করছিলেন— মৌলানা আব্দুর রহমান শিংকাপনি, ডা. মর্তজা চৌধুরী, মৌলানা আব্দুল গফুর চৌধুরী, আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন তাদের অন্যতম। এদের অনেকে আবার খেলাফত আন্দোলনের সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন। এই আন্দোলন একটি আরেকটির সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। ভানুবিল কৃষকবিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে সিলেটের চুরখাই ও কুলাউড়ায় বিদ্রোহ ঘটে, যা ভানুবিলের কৃষকদের আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়। মনিপুরি প্রজা ও এ-আন্দোলনের সাথে যুক্ত নেতৃস্থানিয়রা তখন কংগ্রেসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কংগ্রেসের জেলা নেতা ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরি, বসন্ত কুমার দাশ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ তখন জেলে। বিরেশ মিশ্র, কৃপেশ চন্দ্র দত্ত, বীরেন্দ্র কুমার দাশ প্রমুখ দ্বিতীয় সারির নেতারা দায়িত্বে। বামঘেষা কৃষক নেতা বিরেশ মিশ্র ও কৃপেশ দত্ত মনিপুরি সমাজের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনের সাথে ভানুবিলের কৃষকআন্দোলনকে যুক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলনের সূত্রপাত করলেন। তৎকালীন শ্রীহট্ট মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আহবান জানানো হল। পূর্ণেন্দু দেব, নিকুঞ্জ গোস্বামী, দুর্গেশ দেব এই আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা দেন এবং পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত আত্মগোপনে থেকে ভানুবিল আন্দোলনে কৃষকদের নেতৃত্ব হাতে নেন। তারা জমিদারের খাজনা বন্ধের দাবির সাথে একমত পোষণ করেন। ব্রিটিশ ও জমিদারবিরোধী আন্দোলন ভানুবিলে বেগবান হয়ে ওঠে। জমিদার আলি আমজদ খাঁ দমননীতির পথ বেছে নিয়ে আরো কঠোর নির্যাতনের পথকে মনে করলেন সমাধানের একমাত্র উপায়। প্রজাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুকুম হল। আর অন্যদিকে বিদ্রোহী কৃষকরা যেখানেই জমিদারের লোকজন সেখানেই আক্রমণ এই নীতি গ্রহণ করল। জমিদারের হাতি প্রজাসাধারণের বহু ঘরবাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। প্রজারা সংগঠিত হয়ে জমিদারের হাতির বহর প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কৌশলে কৃষকরা সংগঠিত হয়ে ভানুবিলের ‘হলদের হাওর’ নামক স্থানে জমিদারের হাতির বহর তাড়া করে। শত শত কৃষক ‘মুলি বাঁশ’ চোখা করে হাতির বহরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাতি ও মানুষের যুদ্ধ হাওরের আকাশ ও মাটিকে প্রকম্পিত করে তুলল। দিনভর এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন পঞ্চানন শর্মা ও কাসেম আলি। চোখা মুলি বাঁশের ঘা খেয়ে হাতি তাল হারিয়ে ফেলে। দুঃখজনক ঘটনা হল এই যুদ্ধে জমিদারের নায়েব রাশবিহারী দাশ প্রজাদের হাতে নির্মমভাবে খুন হলেন। আশরাফ হোসেন রচিত পুঁথিকাব্যে এ যুদ্ধের একটি চমৎকার বিবরণ আছে:
বাড়ি হইতে পঞ্চানন শুনিতে পাইলা
মাং কাছিম সর্দার আসিলা
পঞ্চানন তার সাথে পরামিশ করিলা।
এক ছেদি বাড়ল বাঁশ টাকল হাতে লইয়া
মার মার কাটিয়া সব পড়িলা কুদিয়া।
হাতি ঘোড়ার শুঁড় টেং কাটিতে লাগিল
চোখা বাঁশের পাড়ে হাতি পাগল হইল।
কাটা গায়ে হাতি-ঘোড়া চঞ্চল হইয়া
ছওয়ার ফেলিয়া তারা বনে লুকায় গিয়া।

রাশবিহারি দাশ রহিলা জমিনে চিৎ হইয়া
বাহাত্তর টুকরা করিলা রাশবিহারী কাটিয়া।
এইরূপে নইমউল্লাহকে ফেলিল কাটিয়া।

জমিদারের দমন-পীড়ন প্রতিহত করে ভানুবিলে হিন্দু-মুসলিম মনিপুরি কৃষক-প্রজা প্রমাণ করলেন ঐক্যবদ্ধ শক্তির হার নেই। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা অনেক কিছুই শিখতে পারলেন এবং আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হল। কিন্তু তাতে বিরোধের পরিসমাপ্তি ঘটেনি পুরোপুরি। বরং এই আন্দোলন জমিদারবিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে।
জমিদার আলি আমজদ খাঁর মৃত্যু ঘটলে তার পুত্র আলি হায়দর খাঁ প্রজা শাসনের ভার নেন। নায়েব রাশবিহারীর স্থলে নায়েব প্রমোদ ধর জমিদারের খাজনা আদায়ে নিযুক্তি পান। প্রমোদ ধর প্রজাপীড়নে অগ্রজের পদাঙ্কই অনুসরণ করেন। তবে বিদ্রোহী কৃষকপ্রজারাও এতদিনে অনেক শিক্ষাই গ্রহণ করেছে। প্রমোদ ধর এবার প্রজাদের নিকট থেকে কৌশলে প্রাপ্য অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে গিয়ে ধরা পড়লেন। তিনি যেমন প্রজাদের ঠকাতেন, তেমনি জমিদারকেও। নায়েব প্রমোদ ধরের বাড়াবাড়ি কৃষকদের আবার বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইতোমধ্যেই জমির খাজনা কিয়ার প্রতি (৩০ শতক) দেড় টাকা থেকে আড়াই টাকায় বর্ধিত করা হয়। পূর্বে কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজনমতো গাছ কাটতে পারত, পুকুর খনন করতে পারত, সেই অধিকারটুকু জমিদার আলি হায়দর হরণ করে নিলেন। তাদের ওপর পূর্বের চাইতেও দ্বিগুণ নির্যাতন নেমে এল। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কৃষক-প্রজারা বুঝলেন, কেবল নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা করা চলবে না, বাইরের রাজনৈতিক শক্তিরও প্রয়োজন জমিদারের পুলিশ-পেয়াদা-পাইকদের রুখতে হলে। এসময়ে মৌলভীবাজার সদরে সুরমা ভ্যালি যুব সম্মেলনের অধিবেশন চলছিল। সম্মেলনে ভানুবিল অঞ্চলের একদল কৃষক জমিদারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতে যোগ দেন। তাদের সঙ্গে কংগ্রেসকর্মী দ্বারিকা গোস্বামীসহ দু’জন কমিউনিস্ট নেতাও ছিলেন। ভানুবিল অঞ্চলে কৃষকআন্দোলনে কৃষকদের সহায়তার নেতৃত্ব এক পর্যায়ে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ পাশাপাশি পরিচালনা করতেন।
কংগ্রেস সম্মেলনের আগে ভানুবিলের কৃষকদের উপর জমিদারের অত্যাচার-নিপীড়ন বিষয়ে এতটুকু সচেতন ছিলেন না তারা। সম্মেলনের ভেতর দিয়েই তাদের ওপর দায়িত্ব এসে পড়ল নতুনরূপে। এবার আন্দোলন সহিংস পন্থায় নয়, কংগ্রেস ঘোষিত নীতি অনুযায়ি অহিংস পন্থায়। জমিদারবিরোধী তীব্র আন্দোলনে নতুন রূপ, নতুন মাত্রা পায়। স্থানীয়ভাবে সেদিন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব যাদের হাতে বর্তাল তারা হলেন-বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা (মাঝের গাঁও), রূপচান সিংহ (উত্তর গাঁও), বিদ্যা শর্মা (তেঁতই গাঁও), আবুং সিংহ (কোনাগাঁও), রথ শর্মা (ছন গাঁও), খেউদল সিংহ (কোনাগাঁও), বুদ্ধিমন্ত সিংহ (উত্তর গাঁও), নবদ্বীপ সিংহ (ছন গাঁও), গৌরমনি শর্মা (উত্তর গাঁও), গিরীন্দ্রমোহন সিংহ (উত্তর গাঁও), গোবর্দ্ধন সিংহ (উত্তর গাঁও), রামেশ্বর সিংহ (উত্তর গাঁও) প্রমুখ। ভানুবিল মৌজায় উত্তর গাঁও, মাঝের গাঁও, ছন গাঁও, কোনাগাঁও, তেঁতই গাঁওসহ এই পাঁচটি গ্রামে ৭৫২টি পরিবারের বসতি ছিল। উল্লিখিত গ্রামসমূহ মনিপুরি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। ভানুবিলের ঐতিহাসিক কৃষকআন্দোলনে ৭৫২টি পরিবারের সকল নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
আন্দোলনের এ-পর্যায়ে ভানুবিলের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে জমিদারের খাজনা বন্ধ রাখলেন। সাথে সাথে নেমে এল কৃষকদের ওপর জমিদার ও সরকারের নির্যাতন। এবার সরকারও জড়িয়ে পরে। কৃষকরা জেলজুলুমের ভয় উপেক্ষা করে খাজনা বন্ধে দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখলেন। সরকারের পুলিশ, জমিদারের পাইক-পেয়াদা-লাঠিয়াল বাহিনী একত্রিত হয়ে অত্যাচার চালিয়ে কৃষকদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিল। কৃষকনেতাসহ অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল। আগুন লাগিয়ে অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। সরকার ভানুবিল মৌজার উত্তর গাঁও নামক স্থানে পুলিশক্যাম্প বসাল। এই দমননীতির প্রথম শিকার হলেন বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা ও পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত। উভয়ের দু’বছর করে কারাদণ্ড হয়। সমগ্র ভানুবিল মৌজায় নির্যাতনের বিভীষিকা নেমে আসে। বিদ্রোহীদের মধ্যে আরও গ্রেফতার হলেন বুদ্ধিমন্ত সিংহ, নবদ্বীপ সিংহ প্রমুখ। তাদের গ্রেফতারের পর আলিপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং মৌলভীবাজার জেল হাজতে পাঠানো হয় উত্তর গাঁও-এর বিদ্যা শর্মা, গৌরমনি শর্মা, গিরীন্দ্রমোহন সিংহ, রামেশ্বর সিংহ প্রমুখকে। পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত’র গ্রেফতার হওয়ার পর নেতৃত্বে আসেন কুলাউড়ার দুর্গেশ দেব, মৌলভীবাজারের আশুতোষ দেব, শ্রীমঙ্গলের সূর্যমনি দেব, কুলাউড়ার নিকুঞ্জ গোস্বামী, সিলেটের শশীপ্রভা, জোবেদা খাতুন, চারুবালা দেব প্রমুখ। পুরুষদের সঙ্গে মিলে মুসলিম পরিবারের মহিলা জোবেদা খাতুনের সংশ্লিষ্টতা ছিল এক বিরাট অনুপ্রেরণা ও দুঃসাহসের বিষয়। বৈকুণ্ঠনাথ শর্মার মেয়ে লীলাবতি ও সাবিত্রির মতো যুবতিদের সেদিন ভানুবিলের কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আর এ অংশগ্রহণের পেছনে জোবেদা খাতুন ও চারুবালাদের অনুপ্রেরণাই ছিল মূল। কংগ্রেসের অহিংস নীতিতে পরিচালিত এই আন্দোলনে সে সময়ের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বঙ্কিম মুখার্জিরও যোগাযোগ ছিল। যেহেতু আন্দোলনের ধারা গান্ধিবাদী অহিংস পথে চলবে, সেহেতু জমিদারের হাতিগুলো প্রজাদের বাড়িগুলো ভেঙে মাড়িয়ে দিতে এলে নতুন কৌশল নিতে হল। হাতিগুলো বস্তিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রোহী কৃষকরা মৃদঙ্গ করতালের প্রচণ্ড শব্দসহযোগে বাজাতে থাকেন। আচমকা এই বিচিত্র শব্দে হাতিগুলো ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে যেত। কৃষকদের গরু-বাছুর ধরে নেওয়ার জন্য জমিদারের লোকজন এলে এগুলো বাড়ি থেকে দূরে মাঠে কিংবা জঙ্গলে তাড়িয়ে দেয়া হত। এভাবে জমিদারের হাতি তাড়ানো ও গরু-বাছুর রক্ষার আন্দোলন চলতে থাকে। ভানুবিলে কৃষকদের ওপর সরকার ও জমিদারের দমন-পীড়ন নির্যাতনের খবর ভারতবর্ষের বাইরেও গিয়ে পৌঁছে। ভারতবর্ষের পত্র-পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিতর্কের ঝড় ওঠে। বৃটেনের শ্রমিকদল সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়। এই বিদ্রোহের ঘটনা সরেজমিন তদন্তের জন্য শ্রমিকদলের ৩(তিন) জন পার্লামেন্ট সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমিশন ভানুবিলে পাঠানো হল। এদের মধ্যে মিস উইল কিনসন, থ্রি ভি কে কৃষ্ণ মেনন-এর নাম জানা যায়। তারা হাতিতে চড়ে ভানুবিল এসে পৌঁছান। ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করে যে প্রতিবেদন পেশ করা হয় তাতে সরকার ও জমিদারের বর্বরোচিত নির্যাতনের চিত্র ফুটে ওঠে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করেন।
কর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় সবাই জেলে, এমতাবস্থায় আন্দোলন পরিচালনায় সংকট দেখা দেয়। এই নেতৃত্ব সংকটের দুঃসময়ে বিদ্রোহী প্রজারা আত্মসমর্পণ কিংবা মাথা নত করতে রাজি হলেন না। ঘটনার সত্যতা প্রকাশ হয়ে পড়াতে জমিদার ও সরকারের উপর চাপ বাড়তে লাগল। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হয়। ১৯৩৫ সালে ভারতশাসন আইন অনুযায়ী অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দেয়া হয়। নেতৃবৃন্দ মুক্ত হলেন। প্রজাদের বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে আসাম সরকার প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। পৃথিমপাশার জমিদার ও সরকার শেষপর্যন্ত বুঝতে পারল প্রজাদের সঙ্গে মিমাংসা ছাড়া পথ নেই। ভানুবিলে কেদার প্রতি আড়াই টাকা খাজনার পরিবর্তে দুই টাকা সাব্যস্ত হল। একটি আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হল।
কৃষকবিদ্রোহের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লেখক পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে একটি স্মারকলিপির অস্তিত্ব খুঁজে পান এবং সেই সঙ্গে প্রজাদের ওপর জারি করা ক্রোক অর্ডারের নোটিশ পত্র। বিষয়বস্তুর যতটুকু পাঠউদ্ধার সম্ভব হয়েছে অবিকল এখানে তা উদ্ধৃত হল।

মহামহিম,
পৃথিমপাশা জমিদার সাহেবান, বরাবরেষু,
ভানুবিল প্রজাদের নিবেদন এই,
আমরা ভানুবিলবাসি প্রজাগণ নিম্নলিখিত স্বত্ব মানিয়া কবুলিয়ত সম্পাদন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।

১. দেড় টাকা নিরিখের খাজনা হবে নিরিখে এবং দুই টাকা নিরিখের খাজনা দুই টাকা নিরিখে আমরা পরিশোধ করিব। এই নিরিখ ১২ ভাগের ১০ বৎসর পর্যন্ত চলিবে।
২. ১৩৩৯ সনের পূর্বে বকেয়া খাজনা আমাদিগকে মাফ করিতে হইবে।
৩. ১৩৩৯ সনের বকেয়া খাজনা ১২ বৎসরে পরিশোধ করিব।
৪. আপসের তারিখ হইতে দুই বৎসর ভিতরে বর্তমান ১৩৪০ সনের খাজনা এবং বকেয়া ১৩৩৯ সনের খাজনা এবং বকেয়া ১৩৩৯ সনের ১২ ভাগের একভাগ আমরা পরিশোধ করিব।
৫. অবিলম্বে আমাদের নলের গণ্ডগোল মিটমাট করাইয়া দিবার প্রার্থনা করিতেছি। আশপাশের নল কিংবা মৌলভীবাজারের সাবডিভিশনের অফিসারের দ্বারা সহজেই গণ্ডগোল হইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
৬. পূর্বোক্তরূপে জমি মাপ হইয়া যে পরিমাণ হইবে সেই পরিমাণের উপরেই বকেয়া খাজনা ও চলিত খাজনা আমরা পরিশোধ করিব। এবং কবুলিয়তে পরিমাণ উল্লেখ থাকিবে।
৭. কবুলিয়তের রেজিষ্ট্রি-নকল কিংবা পাট্টা আমরা পাইব।
৮. পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নাই।
৯. উচ্ছেদকৃত সমূহ ভূম্যাদি প্রজারা ফিরিয়া এবং ডিক্রিকৃত সমূহ টাকা তাহাদিগকে ফিরাইয়া দিতে হইবে।
১০. যে সকল প্রজাদের ঘরবাড়ি ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছে, বাংলার বকেয়া খাজনা মাফ করিয়া দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করিতেছি।
১১. বর্তমান সনের খাজনা সম্পর্কেও উচ্ছেদকৃত… জমিদার পক্ষ একটা বিবেচনা আশা করিতেছি।
১২. যাহাদের গরু-বাছুর মহিষ ধান ইত্যাদি ক্রোক করিয়া নেওয়া হইয়াছে, তাহাদের বিষয়ে পৃথকভাবে বিবেচনা করিতে হইবে।
১৩. অত্যধিক হদ ও হদের অবিচার অত্যাচার রদ করিতে হইবে।
১৪. তলবানা, পরোয়ানা সহ… করিতে হইবে।
১৫. ভাল ডাক্তারখানা, স্থল রাস্তা ঘাট প্রভৃতির সুযোগ সুবিধা করিয়া দিতে হইবে।
১৬. ভানুবিলের প্রজা ছাড়া অন্য কোন লোক যখন ভানুবিলের জোত স্বত্ব খরিদ করে তখন খাজনা বাড়িয়া যায়। এই সকল জোতের জমি ভানুবিলের প্রজারা পুনরায় খরিদ করিলে যেন পূর্বে নিরিখ বলবৎ থাকে।
১৭. চিৎলিয়া মৌজার বিষয় পৃথকভাবে বিবেচনা করিতে হইবে।
১৮. ভানুবিলের খাজনার নিরিখে হারাহারি মতে তাহারও খাত… দিতে হইবে।

যে সকল সুখ সুবিধা ও অধিকার বরাবর ভোগ করিয়া আসিতেছি এবং বর্তমানে যে সকল অধিকার ও সুবিধা আমাদিগকে দেওয়া হইবে, যেমন হদ, তলবানা, আবওয়ার, জরিমানা, জল, রাস্তাঘাট, স্কুল, ডাক্তার… এবং জোত স্বত্ব খরিদ প্রভৃতি সম্পর্কে এবং জমির উপরে প্রজা স্বত্বাধিকার প্রভৃতি শর্ত… উল্লেখ থাকিবে।

আজ্ঞাধীন
স্বাক্ষর (অস্পষ্ট)

ভানুবিলের কৃষকবিদ্রোহের সক্রিয়কর্মী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী ‘আমার জীবনপঞ্জির পথের পাঁচালী’ শীর্ষক রচনায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৩২-৩৩ সালের দিকে ভানুবিল প্রজা-সত্যাগ্রহের তুমুল কাণ্ড চলছিল। প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটিই সর্বপ্রথম আন্দোলন। পৃথিমপাশার জমিদারকে সাহায্য করতে আসাম সরকার নেমে আসেন। ভানুবিলে সৈন্য মোতায়েন করে, হাতির সাহায্যে মনিপুরি প্রজাদের ঘরবাড়ি ক্ষেত-খামার ভেঙে দিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন শুরু হয়। এই আন্দোলনে পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত, বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা প্রমুখ নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পূর্বেই দীর্ঘদিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, তারা কারামুক্ত হয়ে এসেই পুনর্বার আমাদের একদল সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে নিয়ে ভানুবিলে পৌঁছেন ও এক বিরাট সভার আয়োজন করেন। এরপরই পূর্ণেন্দু দা, বৈকুণ্ঠ শর্মা, সরলাবালা দেব, আশুতোষ ভট্টাচার্য, চারুশীলা দেব, লীলাবতি শর্মা প্রমুখ আমাদের প্রায় ৩০জনকে গ্রেফতার করা হয়। মৌলভীবাজার জেলখানায়ই বিচার হয়। কে.পি. স্যারার নামে এক দুর্ধর্ষ আইসিএস মৌলভীবাজারের এসডিও বিচারে পূর্ণেন্দু দার আড়াই বছর, বৈকুণ্ঠ শর্মার ২ বছর, আমার দেড় বছর, সরলাবালা দেব ও অন্যান্যদের ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়।’ কংগ্রেসনেত্রী সুহাসিনী দাশ এ-সম্পর্কে তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন, ‘সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়াও ত্রিশের দশকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত কৃষকআন্দোলনের খবরও শুনেছি। ভানুবিলের মনিপুরি কৃষক বিদ্রোহীরা প্রথমে নিজস্ব ধারায় আন্দোলন শুরু করলেও পরে কংগ্রেসকর্মীরা যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঐ সব জায়গায় গিয়ে দেখেছি ও শুনেছি জমিদারদের ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ। মনিপুরিদের বিজয় ঘোষিত হয়েছিল।’
ভানুবিলের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে চঞ্চলকুমার শর্মা ‘সুরমা উপত্যকার কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘অবশ্য ভানুবিলের প্রজাআন্দোলন থেকে কংগ্রেসের সরে যাওয়ার রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। জমিদারবিরোধী কৃষক আন্দোলনে গান্ধিজীর দৃঢ় আপত্তি ছিল এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের বড় অংশ জমিদারদের সঙ্গে সহযোগিতার পক্ষপাতি ছিলেন।’
ভানুবিলের কৃষকবিদ্রোহে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যেমন সহযোগিতা ছিল, তেমনি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের পার্থক্যও ছিল, তবু এই আন্দোলন বাংলার তথা ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে একাকার হয়ে বৃহত্তর মূলস্রোতে মিশে যেতে পেরেছিল। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সংগঠিত হয়েও তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে পড়েছিল, হতে পেরেছিল।

সূত্র
১। গ্রাম বাংলার পথে পথে : সত্যেন সেন
২। নানকার বিদ্রোহ : অজয় রায়
৩। মৌলানা আব্দুর রহমান শিংকাপনী : সৈয়দ জয়নাল আবেদীন
৪। কৃতজ্ঞতা স্বীকার : মোহাম্মদ ইলিয়াস এমপি, কৃষ্ণকুমার সিংহ, নিশীকান্ত সিংহ, খন্তল সিংহ।

চারবাক ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, আগস্ট ২০০২