এর পরে যে প্রসঙ্গটি প্রধান হয়েছে তা হল, বাংলা সাহিত্যের ভাষা কী হবে-সাধু না চলিত। কেউ কেউ ‘কথা’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন ‘চলিত’-এর বদলে, তার ফলে ‘চলিত’ কথাটির অর্থ অনেক সময় ধরে নেওয়া হয়েছে উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা-ডায়ালেক্ট-যা প্রমথ চৌধুরি আদৌ বোঝাতে চাননি। যতীন্দ্রমোহন সিংহের প্রবন্ধটি এই ভ্রান্তির শিকার। কৃষ্ণবিহারী গুপ্ত, সারদাচরণ মিত্র (যাঁর অভিযোগ ‘স্যার রবীন্দ্রনাথ’, বাংলা ভাষাকে গোলায় পাঠাচ্ছেন), প্রফুলকুমার সরকার, বীরেশ্বর সেন, মহেন্দ্রনাথ কুন্ডু-সকলেই সাধুভাষার পক্ষে। বীরেশ্বর সেন তো বলেই দেন, ‘আমার বিবেচনায় আমাদের যে সাধুভাষা আছে তাহাই আমাদের আইডিয়াল ভাষা’। বিপক্ষে, বিপরিত অবস্থানে আছেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, যাঁর কথা-‘সাহিত্যের ভাষা চলতি না হয়ে উপায় নেই।’ মন্মথনাথ বসু বলেন, ‘ভাষাতে লোক প্রাণ খোঁজে, পোষাক নহে।’ কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী ‘কথ্যভাষাতেও গভীরার্থ’ প্রকাশিত হতে পারে বলে রামপ্রসাদের ‘মন তুমি কৃষিকাজ জান না’র উদাহরণ দেন, কিন্তু সাধুভাষার পক্ষেই থাকেন। আর সুবিবেচক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দুয়েরই সুবিধা-অসুবিধা দেখিয়ে একটি মধ্যপন্থি অবস্থানে দাঁড়ান।
পবিত্র সরকার, ভূমিকা, ভাষা ঊনিশ-বিশ শতক ভাবনা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা
খ্রিস্টধর্ম চেয়েছিল পৃথিবীর সব মানুষ খ্রিস্টান হয়ে এক জাতিতে পরিণত হয়ে যাক-হয়নি। একই বাসনা ছিল বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের। প্রাগাধুনিক যুগের ঐ সকল ধর্মিয়-আন্তর্জাতিকতা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর দেখা দেয় আধুনিক আন্তর্জাতিকতার দর্শন। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সেই আধুনিকতারই সন্তান। ব্যর্থতা জুটেছে তার ভাগ্যেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আত্মস্বরূপের যথার্থ উপলব্ধি ঘটে আধুনিকতার। ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ বা UNO-র জন্ম দিয়ে সে বিদায় গ্রহণ করে। অবশেষে, এই উত্তর-আধুনিক যুগে ডাক পড়েছে ‘ভুবনিকরণ’-এর।…
পরমাভাষার সংকেত, কলিম খান, প্যাপিরাস, ঢাকা, ২০০১
ভাষা প্রশ্নে বিবাদ-বিসম্বাদ আজকের নয়, সম্ভবত যেদিন থেকে গদ্যরচনা, সেদিন থেকেই সাহিত্যের ভাষা কি হবে তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক। গঙ্গা-যমুনা-স্বরস্বতি-পদ্মা-মেঘনা কম হয়নি, কিন্তু তা থৈ থৈ…। সম্প্রতি কিছু লেখকবন্ধু পুরনো বিষয়টি নতুন করে নতুন বোতলে পরিবেশন করে অহেতুক মাঠগরম করবার কষ্টসাধ্যশ্রম নিবেদন করছেন। মনে হয় না অনেক বিষয়ের মতো এই বিষয়েও তারা কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হবেন। দুয়েকজন অতিউৎসাহি স্বঘোষিত পয়গম্বর নিজেদের লেখায় উদ্ভট সৃজনকর্মে নিয়োজিত আছেন, তাদের কর্মকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি না, কিন্তু অপকর্ম জায়েজ করার জন্য বিষয়টা যখন জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয় তখন ভেল্কি লাগে বৈকি, আশ্চর্যও হই। মন্দ লাগত না যদি প্রকৃতই তারা তাদের সমর্থনে মানসম্পন্ন কোনো লেখনি জাতিকে উপহার দিতে পারতেন, কিন্তু তা হয়নি। বিকলাঙ্গ কিছু সাহিত্য পয়দা করে তাকেই আদর্শ মানার হ্যাপা আছে, নোংরামিও কিছুটা। চলিত বা সাধু অথবা সাধু-চলিত মিলিয়ে আদর্শ উৎকৃষ্ট সৃজনকর্ম হতে পারে, তাতে বাধা দেখি না। সৃজনকর্ম লেখকের নিজস্বতা। লেখক পরিবেশন কিভাবে করবেন তা একান্তই তার। দুরূহ শব্দ জটিল বাক্যবিন্যাসেও লেখক পৌঁছে যেতে পারেন পাঠকসমিপে, উদাহরণ কম নেই। কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করেন মুখের ভাষা আর লেখনির ভাষা এক নয়। সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবনকে রঙিন চশমায় চমকিত করে উপস্থাপন করাই রীতি, কিন্তু বিপরিত মতও থাকতে পারে। সাধারণকে সাধারণ হিসেবে আঁকবার ক্ষমতা, বলবার যোগ্যতা সেটিকেও এখন বড় করেই দেখি আমরা। আঞ্চলিকতার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন কেউ কেউ তাদের জন্য তিন উল্লাস।
ভাষা-সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গটি হালে বেশ জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত, কিছুটা আতংকিতও। কেউ কেউ ভাষা প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উঁকিঝুঁকি মারছেন, আরবি-ফার্সি শব্দে বয়েত দিচ্ছেন। ইচ্ছেকৃত শব্দসাম্প্রদায়িকতার আমদানি আখেরে খারাপ নজির হয়ে যেতে পারে। আমরা সচরাচর ভুলে যাই, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আষ্টেপৃষ্টে ক্ষমতার রজ্জুই সবকিছুর নিয়ন্ত্রকশক্তি। প্লেটো থেকে শুরু করে মিশেল ফুকোর ভাবনার জগতে তাই ক্ষমতা আলাদা গুরুত্ব পায়। বিশ্বায়ন এরই মধ্যে আলাদা মহিমায় ভাবনার জগতে জায়গা করে নেয়। বিশ্বায়ন প্রশ্নে স্পষ্ট ভিন্ন ভিন্ন শিবির এখন, যদিও তথাকথিত অনুন্নত বিশ্বে বিশ্বায়ন সদর্থক অর্থ বহন করে না, নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, হচ্ছে। বর্তমান অস্থির বিশ্বে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বিষয়গুলো টের পাওয়া যায়, ম্যালা ধরনের উপাচার উপঢৌকন সামনে এসে হাজির হয়। বিপণন বণিকতার নামেই চলে এর বাণিজ্যিকিকরণ। এককালে বণিক ক্লাইভ এবং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে উপনিবেশিকতা স্থাপনের জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল, স্বদেশে নিন্দাবাদ হজম করতে হয়েছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি?-উপনিবেশিকতা স্থাপিত হচ্ছে ভিন্ন নামে ভিন্ন কৌশলে। শক্তিধর রাষ্ট্রের যোগ কমেছে সরাসরি, বেড়েছে বহুজাতিক কোম্পানির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। ভাষাও কৌশলে বহুজাতিক কর্পোরেট দুনিয়া শাসন করার ইচ্ছে পোষণ করছে, কখনো কখনো সফলও হচ্ছে। যারা ভাষা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন তাদের কেউ কেউ কর্পোরেট দুনিয়ার নিবিড় সেবাদাস হিসেবে নিজেদের যোগ্যতাকে এরই মধ্যে প্রমাণ করে বসে আছেন। অতএব দ্বিধা…
ভাষার সাথে বিশ্বায়নের কি যোগ? অথবা অন্যভাবে বললে আজকের ভূগোলোকায়নের যুগে অন্তর্জাল যেভাবে ইথারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাতে ভাষার উপর এর প্রভাব কেমন, অথবা ভেতরে ভেতরে কি হচ্ছে তা তলিয়ে দেখা জরুরি। ক্ষমতার সাথে একে টেনে আনছি কেন বিষয়গুলো বিস্তারিত হওয়া দরকার। জাতি হিসেবে আমাদের উত্তরাধিকার নিঃসন্দেহে গৌরবের। ভাষার প্রশ্নেই একটি জাতি স্বাধিন হয়েছে এমন নজির বিশ্ব-ইতিহাসে কমই আছে। দুঃখজনক বিষয় যে ভাষা বর্ণমালার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ জীবনবাজি রেখেছিলেন আজ বিশ্বায়ন গোলোকায়নের খপ্পরে সেই আমরা নিজের অজান্তেই মোবাইলে ফেসবুক অন্তর্জালে ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে চলেছি হরদম কোনো ধরনের আত্মশ্লাঘা ছাড়াই। ভুল অশুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা-ইংরেজির মিশেলে ফূর্তির জোশ দেখি রেডিও জকিদের আলাপচারিতায়, টিভি চ্যানেলের নাটকে।
এটি কিভাবে সম্ভব হলো? কোন অদৃশ্য শক্তির তোপে তোড়ে আজ আমাদের মননের এই ভগ্নদশা? বিশ্বায়ন কি তাহলে অমোঘ নিয়তি, পরাভূত দৈত্য, রাবণের রাক্ষস। ধ্বংস নেই, যার রক্তবিজ থেকে শত সহস্র রাক্ষস প্রতিনিয়ত জন্ম নেয়। মানুষের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আর সব প্রাণি থেকে প্রকৃতিরাজ্যে তাকে অনন্য করে তোলে ভাষা তার একটি নিঃসন্দেহে। আদি সংস্কৃতি কৃষি যার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতির সাথে তার খাদ্য-সম্পর্কটিও বদলে নিয়েছিল, মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে কৃষি আবির্ভাবের তাৎপর্য তাই নিঃসন্দেহে উলেখযোগ্য। ভাষা কিন্তু তারও আগের অর্জন। যা কিছু ঘটমান
বাস্তবে হাজির নেই তাকেও বাস্তবতার অনুষঙ্গ করে ফেলবার মানবিয় যে সামর্থ্য তা মানুষ অর্জন করে ভাষার মাধ্যমেই। ভাষার আবির্ভাব মানুষের প্রজাতিগত জৈবযূথবদ্ধতার সূত্র বা শর্তাবলিকে বদলে দেয়ার পরে মানুষের যূথবদ্ধতার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তি, সমাজ, সভ্যতা আর রাষ্ট্রের ইতিহাস। সাংস্কৃতিক মানুষ হচ্ছে তার প্রাকৃতিক বা জৈবিকসত্তা হতে নিষ্ক্রমণের ফলাফল আর এই নিষ্ক্রমণপথে মানুষের যূথবদ্ধ প্রয়াসের ভিত্তিকাঠামো নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক জ্ঞানের ভাষানির্ভর বিস্তার। সাংস্কৃতিক মানুষের যা কিছু ঐতিহাসিক অর্জন, ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামো জুড়ে যে বিশাল সংস্কৃতির দেহ তার শিরা-উপশিরা-ধমনি জুড়ে ভাষার স্রোত নিরন্তর বয়ে চলে বলেই তা প্রাণবান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ব্যক্তি আমি’র আবির্ভাবই ভাষা-আশ্রিত সংস্কৃতির সূত্র মুছে দিয়ে মানুষের যূথবদ্ধতার সূত্রগুলোকে বিন্যস্ত করেছিল ক্ষমতার বিন্যাসে। সাংস্কৃতিক সমস্বত্ত¡ বা বৈচিত্র্যের চেয়েও ক্ষমতার বিন্যাসই অনেক বেশি বিন্যস্ত করেছিল মানুষের আধুনিকতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রকে। পশ্চিমা সভ্যতার ছায়ায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃষ্টতম বিকাশটি উপনিবেশিকতায় ভর করে পৃথিবীর মানুষের অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়তি করে তুলেছে। যূথবদ্ধ সৃজনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের সাথে জুড়ে দেয়া হয় আরো নানা পরিচয়। ক্ষমতার ইতিহাস এই সৃজনযজ্ঞের নিয়ন্তা হয়ে উঠবার পর এই ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশিলিত অর্জন আধুনিক জাতিরাষ্ট্র। অনিবার্য আইনি পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় জাতিরাষ্ট্র, ব্যক্তি-পরিচয়ের পাশাপাশি এই রাজনৈতিক পরিচয়ের চর্চা সভ্য আধুনিক মানুষের অমোঘ নিয়তি। অনড় সংস্কৃতির প্রাচিরঘেরা অর্থনৈতিকভাবে অন্তর্মুখিন প্রাচিন ভারতিয় গ্রামসমাজের যে দিকটি কার্ল মার্কসসহ পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের ভাবনার বিষয়, তাহলো কেন্দ্রিভূত কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এই গ্রামসমাজগুলোর স্থবির নির্লিপ্ততা। গোড়ায় কার্ল মার্কস এই স্থবিরতার প্রতিষেধক হিসেবে সম্ভাব্য কার্যকরি ঔষধ বাতলেছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রের অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ শাসনকেই। ব্রিটিশ শাসনের আগে হিন্দু রাজবংশ, বা মুঘল শাসন আমলেও এই গ্রামসমাজে বসবাসকারি মানুষের রাষ্ট্রের ব্যাপারে খোঁজখবরে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। রাষ্ট্রনীতি রাজার এমন ধারণা বরাবরই এরা পোষণ করে এসেছে। বহিরাগত বা অনুপস্থিত শাসকদের খাজনা দিয়ে নিজেদের যাপিত জীবন নিরুপদ্রব রাখাটাই তাদের বিবেচনায় জরুরি ছিল। মার্কসের নিজস্ব ইতিহাসতত্ত¡ যত পরিশিলিত হয়েছে, ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর পরিচয় যত গভীর হয়েছে ততই তিনি সরে এসেছেন তাঁর পূর্ববর্তি অবস্থান থেকে।
উপনিবেশিকতা বা সা¤প্রতিক সময়ে ভিন্ন কোনো উপায়েই হোক, অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণ বরাবর দখলেরই নামান্তর। ইতিহাসের সব দাপুটে পণ্যসভ্যতাই তার ঐতিহাসিক অধিকারভুক্ত পথে মুখোমুখি হওয়া সমস্ত পূর্বাপর সমাজকে চূর্ণবিচূর্ণ করে। প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজ ও তার অর্থনীতি ধনতান্ত্রিক সমাজের বাজারের কবলে পড়ে এত দুর্বল আর শক্তিহীন হয়ে পড়ে যে নিজের সনাতন সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারে না। এই অবস্থায় টলায়মান সমাজগুলো, তার মানুষ ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকবার কসরত করতে থাকে অপেক্ষাকৃত সক্ষম সংস্কৃতির আশ্রয়ে। এই গ্রহণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়, অনেকটাই বলপ্রয়োগমূলক অথবা অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়তি। স্ট্যানলি ডায়মন্ড চমৎকারভাবে একে নামকরণ করেন, ‘পশ্চিমা সভ্যতার আবশ্যিক গ্রাহক’ বলে। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের মধ্য দিয়ে আমরা আবশ্যিক গ্রাহক হিসেবে পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান সাংস্কৃতিক মানদণ্ড গ্রহণ করেছি। ব্রিটিশ শাসন ভারতের কৃষি-উদ্বৃত্ত-নির্ভর অভিজাতদের বড় অংশেরই চিন্তা, মনন, মানসকাঠামোয় ধনতান্ত্রিক ইউরোপিয় সভ্যতাকে মোহনিয় রূপ দিতে পেরেছে। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সবচেয়ে উদ্ভিন্ন রূপটিকে স্থানিক ক্ষমতাকাঠামোতে নিজের অবস্থানের সাথে মেলাতে গিয়ে এই অংশটির মনে অবচেতনে রোপিত হয়েছে স্বাধিন আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। ক্ষমতা- কাঠামোর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অসম সামাজিক বিন্যাসের অভিভাবকত্বে এবং পরবর্তিতে ব্যক্তিমানুষের মানবিক অস্তিত্ব হন্তারক ভূমিকা পালনের কারণে আধুনিক রাষ্ট্র তার অর্জিত অবস্থান থেকে দ্রুত সরে আসে, হারায় মানবিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি, আর তা ঘটতে থাকে খোদ পাশ্চাত্যেই যারা একে মানবিকতার তকমা সেঁটে দিতে চেয়েছিল। স্বনির্ভর অর্থনীতির গ্রামসমাজ যখন ধনতান্ত্রিক বিকাশের ধারায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল, নিজের অর্থনৈতিক নিয়তিকে মোকাবেলার তাগিদ থেকেই এই মানুষেরা অংশিদার হয় এরা। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের দরিদ্রতর নিম্নবর্গিয় মুসলমান জনগোষ্ঠি ধর্মকে আশ্রয় করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু অর্জিত নতুন রাষ্ট্রে মুসলিম জাতিয়তাবাদি নেতৃত্বে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যে গতি পায়, মুখ্যত ধর্মিয় পরিচয় বড় হয়ে যায়। শাসন, আইন, অর্থনৈতিক উৎপাদন, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ রাষ্ট্রের যা কিছু অর্জন, যূথবদ্ধ মানুষের মতোই তারও যে আদি ও মৌলিক আশ্রয় ভাষা ফারসিভাষি মুঘল ও ইংরেজিভাষি ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সাথে যুঝতে গিয়ে এই উপলব্ধি সহজেই সঞ্চারিত হতে পেরেছিল। ফলে ধর্মভিত্তিক জাতিয় একাত্মবোধের ধারণা শুরুতেই হোঁচট খায়, প্রতিরোধের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠে ভাষা। ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদের মানবিক আদ্যগুণ নিয়ে উদ্ভূত আমাদের জাতিরাষ্ট্র শুরুতেই মৌলিক প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করেছে, সরে গেছে নিজস্ব অবস্থান থেকে, প্রান্তিক ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। একমেরু, ভুবনগ্রাম, বিশ্বসমাজ, বিশ্বায়নের মতো ধারণাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে এক অঘোষিত লড়াই। ধনতান্ত্রিক পণ্য সভ্যতার কারণেই হোক, মানবিকতার দোহাইয়ে হোক এরই মধ্যে অস্তিত্বসংকট, পরিচয়সংকট বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে, গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষার আদি উৎস নিয়ে মনোজেনেসিস আদিকল্পে যে একিভূত সমাজের দেখা মেলে, ইতিহাসের কালচক্রে সেই সমাজই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে মানুষের মানচিত্রকে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য এনে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রিয় পুঁজিকে পেছনে ফেলে কর্পোরেট পুঁজির বৈশ্বিক বিস্তার শেকড় ধরে নাড়া দিয়েছে সংস্কৃতির। দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য সব যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে নির্মম লড়াইটি চলছে ভাষাকে কেন্দ্র করে। জাতি মাত্রেরই সমস্ত অর্জিত সম্পদের আদি ও প্রধানতম কোষাগার হচ্ছে তার ভাষা। কোনো জাতির ভাষাকে মেরে ফেলতে পারলে সেই ভাষাহীন জাতিটিকে আর না মারলেও চলে, কারণ তার ভাষা চলে গেলে তার কীর্তি, সংস্কৃতি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-দর্শন সবই চলে যায়। নতুন অধিপতি সভ্যতায় সে তখন অনায়াসেই বিলিন হয়ে যায়। কাজেই মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার যত রকম সংগ্রাম চলছে তার মধ্যে ভাষার লড়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কলিম খান-এর জবানিতে ভাষাবিজ্ঞানিদের বরাতে এই লড়াইয়ের লোমহর্ষকর সংবাদ পাওয়া গেছে। তারা জানাচ্ছেন আগামি শতাব্দিতেই মানুষের মাঝে প্রচলিত প্রায় ৫০০০ ভাষার মধ্যে শতকরা ৯০টি অর্থাৎ ৪৫০০ ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতে বহু ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভাষাভাষির সংখ্যা দশ হাজারেরও কম এরকম বিলুপ্তপ্রায় ভাষার তালিকাটিও আশংকাজনকভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। ৫০ বছরের মধ্যেই পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা কমে অর্ধেকে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন ভাষাবিদরা। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬০০ কোটি ধরলে এর মধ্যে ৫৭০ কোটি জনসংখ্যাই কথা বলে একশটিরও কম ভাষায়। ভাষাযুদ্ধের এই চিত্র ভূ-ভাগের এই অংশেও কম ভীতিকর নয়। অবিভক্ত ভারতে প্রচলিত ১৫০০ ভাষার মধ্যে ৪৩৩টি ভাষারই নাম উঠে গেছে বিপন্ন ভাষার তালিকায়। পণ্যসভ্যতা পরিবাহিত বাজারসংস্কৃতি কোনো ভাষা তথা জাতিসত্তার টিকে থাকবার প্রশ্নে কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দেয়। পণ্যের দেহ অলংকৃত করে মুনাফা নিয়ে আসবার দাপট নিয়ে বিশ্ববাজারের ‘মাস্তান-ভাষা’গুলোর সমকক্ষ হয়ে না উঠতে পারলে কোনো ভাষারই আর অস্তিত্ববান থাকবার সম্ভাবনা নেই। বেঁচে থাকতে হলে সব ভাষাকেই হয়ে উঠতে হবে তাদের মতো সর্বত্রগামি ও সর্বজনগ্রাহ্য, হয়ে উঠতে হবে কম্পিউটার, কমোডিটি আর কনজুমার ফ্রেন্ডলি। বিশ্বায়নের শুরু থেকেই যে কায়কায়বারগুলো ফেনিয়ে বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা চলেছে ভাষা-আগ্রাসন তার একটি। ভাষাসাম্রাজ্যবাদিরা মুখিয়ে থেকে দিনের পর দিন প্রচেষ্টা চালিয়ে কর্পোরেট স্বার্থে এমন একটি ভাষাকে সারাবিশ্বের মানুষের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে করে তাদের ব্যবসা নির্বিঘœ হয়। কেননা পণ্যের ব্যবসা স¤প্রসারণ করতে হলে প্রথমেই সেই জাতির অস্তিত্বসংকট প্রকটিত করে তুলতে না পারলে, নিজস্বতা, সার্বজনিনতা ধ্বংস করে পরামুখাপেক্ষি করে ফেলতে না পারলে আখেরে ফল ভালো না হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আবার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম তো ভাষাই। তাই কৌশল চলে প্রচার-প্রচারণার। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি মিডিয়া সেবা করে যায় নিরন্তর। উন্মুক্ত অবারিত আকাশের হাতছানি আমাদের অস্তিত্ব-সংস্কৃতির জন্য যেমন হুমকি, সেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচারে ততটা সাফল্য দেখাতে পারিনি। প্রতিবেশি দেশের কালচার যেমন অনায়াসে প্রবেশ করতে পারছে, পারছে সুদূর পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও। দেশিয় মিডিয়া অথবা মিডিয়াকর্মিদের দক্ষতা যোগ্যতা অদূরদর্শিতা, ব্যবসায়িক হীন স্বার্থের বলি হচ্ছে ভাষা। ভাষাসাম্রাজ্যবাদিদের প্রচারণা-কৌশল, দীর্ঘদিনের নিবেদিত শ্রম, মেধাশক্তির কাছে ক্রমেই আমরা হয়ে পড়ছি অসহায়। দেশিয় সংস্কৃতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যে প্রচার-প্রচারণা তাতে অর্থলগ্নির পরিমাণ সামান্য নয়। অন্যপ্রেক্ষাপটে দেশিয় প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষাও হুমকিতে পড়ে যাচ্ছে প্রধানতম ভাষার কাছে, বৈশ্বিক প্রভাবতো থাকছেই। তাই লড়াইটা একতরফা হচ্ছে না। ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে, ভাষাকে ভাষাসাম্রাজ্যবাদি শক্তির বিপক্ষে দাঁড়াতে হলে, আপন ঐতিহ্যের অনুসন্ধান জরুরি, জরুরি আত্মোপলব্ধি। কেননা অন্তর্জাল কিংবা আকাশসংস্কৃতির অন্তহীন প্রচারণা অবাধ প্রবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয় কিছুতেই। বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ে যাতে নিজস্ব ভাষা হারিয়ে না যায়, নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যের সোনালি গাঁথায় প্রত্যাবর্তনই হবে একমাত্র মৌল সমাধান। আবার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল যে ভাষাকৃষ্টিসংস্কৃতি তা আমাদের অর্জন, তা কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না।
অহেতুক সময়-মেধা-শ্রম অপচয় না করে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদিদের খপ্পর থেকে রক্ষা পেতে, বিশ্বায়নের নামে চাপিয়ে দেয়া বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে প্রস্তুতি দরকার এখনই। লেখার প্রশ্নে স্বাধিনতা থাকুক, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে কতটা মানসম্মত শিল্প হবে তাতে দ্বিধা বরাবরই। ভাষার প্রবাহমানতা চিরন্তন, ব্যক্তি ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব খুব একটা আছে মনে হয় না। শক্তিমান লেখক-কবি সাময়িক বাক সৃজন করেন হয়তো, কিন্তু দীর্ঘকালিন ভ্রমণ তাতে বাধাগ্রস্ত হয় না। চাপিয়ে দিয়ে সফলতা আশা করা বোকামিই। বিশ্বায়নখপ্পর, ভাষা-সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসি লুটেরাশক্তির মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এখন থেকে নিশ্চয়ই, এবং তা আত্মশক্তির উদ্বোধন, স্বাদেশিকতা, ঐতিহ্যসচেতনতার উপরই নির্ভর করে খানিকটা।