মৃত্তিকার স্বপ্নালু বিশ্বাসে মগ্ন, সবুজ গাঙেয় ব-দ্বীপের তামাটে দামাল রিসি দলাই, ভূমিপুত্রের অবিকল তার জাত্যাভিমান, কলমের তিক্ষèতায় শাণিত বোধের ধী-কে রিসি প্রস্তুত করেছেন বহুরৈখিক সময়ের আধিপত্যবাদি দানবকে প্রতিহত করতে।
কবিতায় যদি কবির মুন্সিয়ানাকে চিহ্নিত করতে যাই সেই প্রেক্ষাপটে নতুন ভাষা, নতুন সময় সৃষ্টি করা যদি হয় কবির কাজ তবে সে হিসেবে রিসি দলাই কথন- প্রবণতার কাব্যধারায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রচলিত সময়ের প্রচল দ্যোতনা ভেঙে।
আমাদের সামাজিক ভাষা যখন বহু চর্চায় চর্চিত হয়ে ক্লিশে-তখন সামাজিক ভাষার নয়া প্যারাডাইম নিয়ে রিসি দলাই সতত প্রস্তুত কুণ্ঠিত জবাবে। সাইবার জগতের ভারচুয়াল বাস্তবতাকে স্বপ্নবৎ রেখে বহুরৈখিক জটিলতাকে লজিক্যাল ক্র্যাকের মাধ্যমে রিয়ালিটি ও হাইপার রিয়ালিটির মধ্যে যে ব্যবধান তা ভেঙে স্বপ্নচালকের মুক্তমঞ্চ তৈরিতে উদগ্রিব…
ছোট কাগজ আন্দোলন ভবদিয় হিসেবে রিসি দলাই পরিক্ষিত সৈনিক। দশক পরিক্রমায় বিবেচনা করলে শূন্য দশকের অন্যতম ছোট কাগজ ‘চারবাক’-এর কাণ্ডারি রিসি। তার কবিতার শৃঙ্খলিত প্যারাডাইম রয়েছে ছোটকাগজগুলোতে। তার কাব্যপাণ্ডুলিপি ‘সময় সমগ্র অথবা আমরা যারা নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উত্তরণের স্বপ্ন দেখি’ ( গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি)। সকল সত্যিকার শিল্পি এবং শিল্পের মধ্যে রয়েছে তার পূর্বসূরির অস্তিত্ব। একই সাথে সব সৃষ্টি ও ঐতিহ্যের জীবন্তরূপ এবং স্থান ও কালের অপরিহার্য দলিল। এসব চিন্তা থেকেই আমাদের অদম্য আকাক্সক্ষা রূপ নিয়েছিল বর্তমান অভিযাত্রায়। বিচিত্রতা অর্থ সিমানা বা বিভক্তি নয়। স্থবির গৎবাঁধা এবং অনন্য প্রতিমান সংস্কৃতির বৈরি যে সহাবস্থান তাদের ভেতর বিদ্যমান ভিন্নতার মধ্যেও রয়েছে এক সম্ভাবনা যা সৃষ্টি করতে পারে তাদেরই স্থান ও কালের সঙ্গে সংলাপের এক জগৎ। তারই প্রতিভাস চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ‘মায়াহরিণ’ কাব্যগ্রন্থে। সবাইতো কবি কিন্তু কবিতা কাহারে বলি এই ভাবনায় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি কবি ও চিন্তক মঈন চৌধুরী’র এ ভাবের সঙ্গে-‘প্রচলিত জাগতিক কাঠামোতে অবস্থান করে যে ভাষা সে ভাষা নতুন প্যরাডাইমিক ও বিনির্মিত রূপ যদি কখনো আমাদের নতুন উপলব্ধি দেয় এবং সে উপলব্ধি যদি হয় নান্দনিক তবেই তাকে আমি কবিতা বলব’।
ইহাই শব্দ: পৃষ্ঠা ৮৩
চৈতন্য জাগ্রত অনিঃশেষ অভেদের সন্ধানে ভূ-রাজনীতি ও বৌদ্ধিক দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ রেখাকেও সে কবিতায় তুলে ধরতে হৃদয়গ্রাহি। তাই প্রয়োজন ওপেন এনডেড বচন। যেখানে থাকবে দ্রোহ ও দহনের আন্তঃপিপাসার আখ্যান। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব, টালিখাতায় জমা হওয়া ঋণের কথা। কবিতাকে অধিবিদ্যার ভাবমাজারে স্থাপন করে দুয়েন্দি খেলা খেলতে চান না রিসি দলাই। উত্তর-পর্বের বয়ানকারদের অবিকল তারও আস্থা যা বলতে চাই স্পষ্ট করে বলবো, বন্ধ্যা সময়ে কিসের প্রয়োজন ভণিতার? প্রপঞ্চময় জীবনের বৈচিত্র্য ছুঁয়ে যায় তার প্রতিরোধ প্রকল্পের ক্যানভাস মায়াহরিণ। তার চেতনকাঠামোর দায়বদ্ধতার কথা উঠে আসে কবিতায়। এজন্য হয়তো কোনো কোনো পাঠক অপ্রস্তুতও হতে পারেন তার কাব্যপাঠে। তবে সময়কে চিহ্নিত করার দ্যোতনায় তার কোনো খাদ নেই। পাঠক যদি এই সবুজ গাঙেয় ব-দ্বিপের ক্রাইসিস বুঝতে সক্ষম হন তা হলে রিসির কবিতা হবে বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে বোধের সঞ্চিত উত্তাপে গিতল ঢঙে গাওয়া পাখির সুরেলা কণ্ঠে বলতে না পারা তিব্র দহনের অমোঘ সংকেত।
কবি স্বপ্নবাজ সকল অন্ধকার (ড়নংপঁৎব) দূর করে আলোকিত পৃথিবীর বৈঠা হাতে আলো-আঁধারির বিপ্রতিপ গলিতে তার স্বপ্ন-যাত্রা। গভীর ধ্যানের দ্যোতনা ভেঙে নান্দনিক মেটাফর, কখনো নিজের সাথেই চলে ঢ়ধৎধফড়ী।
‘পাওয়া অথবা না-পাওয়ার বেদনা সিম্ফনি গায়। তৃতীয় দরোজা অকস্মাৎ খোলে যায়। সন্ধানি মন খোঁজে দ্বিতীয় চোখ, সে চোখে লাফিয়ে লাফিয়ে একটি স্বর্ণহরিণ ছুটে যায়। শিকারি চলে মোহের পেছনে, অথবা আনন্দ সংগিত গান করে কানে। ছুটছি আমরা একটি হরিণের খোঁজে, অথবা একটি মায়াহরিণ তাড়িয়ে নিচ্ছে আমাদের চেতনা’। মায়াহরিণ: পৃষ্ঠা দশ: মায়াহরিণ
আমাদের যাপিত জীবন-জগতের বাস্তবতাকে আড়াল করার প্রবণতা সর্বকালিন কিন্তু সৃজনশিলতা ধোঁয়াটে জটাজালে বারবার প্রমূর্ত হয়ে উঠে নিজের অবয়ব। সিমাবদ্ধতা উত্তরণের বিজ্ঞান চিরকাল থেকেছে আড়ালে। কাল-পাত্রের চূড়ান্ত অনুধ্যানে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ শুধু চোরাবালি কেন্দ্রে নির্গমন করেছে। চিন্তার শৈলি প্রতিনিয়ত ভাঙতে চায় চলমান চাকা কিন্তু ঘুরে ফিরে ৭০ডিগ্রি কৌণিক বিন্দু থেকে কেন্দ্রকে টার্গেট করে অবচেতন মনে ব্যাসার্ধ টেনে টেনে বৃত্তই আঁকি; স্বপ্ন দেখি আবার স্বপ্ন ভাঙি একই নিয়মের ঘূর্ণিতে-
‘বৃত্তের বাইরে নয় কেউ, অথবা আবদ্ধ বৃত্তে সবাই ফিরে আসা একই মুখ, একই কথা, একই অবয়ব-ভাষণ-খুঁনসুটি অথবা প্রেমের মত কিছু’
মায়াহরিণ: এন্টি হিরো: পৃষ্ঠা আঠার
গণিতের কাঠামো অনুশিলন করতে গেলে এমন একটি চিন্তা দোলা দিতে পারে যে, বিজ্ঞানের আলোচনা যে বিষয় নিয়ে তা বাস্তব জগতের জিনিস মোটেই নয়। বিশুদ্ধ চিন্তাজগতের জিনিস আর তাই দর্র্শন যদি গণিতশাস্ত্রের কাছ থেকে প্রেরণা পেতে চায় তাহলে দর্শনও বিশুদ্ধ চিন্ময় সন্ধান ছাড়া আর কি হতে পারে। এমন মনে হওয়াটা দোষের কি-না জানি না তবে ভুল মনে হওয়া স্বাভাবিক। কান্ট বলেছেন গণিত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মূর্ত জগতের অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। ব্যাপ্তি হল হেতু (middle term) এবং পক্ষ হল বহ্নি (major term)-)-এর মধ্যে সম্বন্ধ যত্রতত্র বহ্নি (universal relation), এই ব্যাপ্তি কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মানুষ বড়জোর বলতে পারে যে জায়গায় আমি ধুঁয়া দেখেছি সেই জায়গায় দেখেছি আগুন। কিন্তু আমি ও আপনি কয় জায়গাতে ধুঁয়া আগুনে পরিণত হতে দেখেছি। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সমস্ত ধুঁয়াকে কেউ কখনো দেখেনি দেখবেও না। তাই জোরগলায় বলার কোনো অধিকার কারোই নেই যে, সমস্ত ধুঁয়ার সঙ্গে আগুনের যোগাযোগ থাকতে বাধ্য। এমন ভাবনা বিন্যাসে কেন্দ্রচ্যুত হয় না মানুষ কবিতায় দৃশ্যত-
‘কেন্দ্রচ্যুত হয় না মানুষ। কেন্দ্রেই থাকে খুঁজে
ফেরে নিজস্ব অবস্থা-আয়না, মেলানো অথবা
কখনো মিলে যাওয়া’।
মায়াহরিণ: পৃষ্ঠা তেইশ: কেন্দ্রচ্যুত হয় না মানুষ
পর্ব থেকে পর্বান্তরে শিফট হয়ে গেছে কাব্যচিন্তা। আধুনিক কবি যখন বলেন,-কেউ কথা রাখেনি তার বিপরিতের রিসি দলাই কাউন্টার ডিসকোর্স ‘হয় না প্রতারক কখনো কবিরা’। সভ্যতার আলোকবর্তিকা নিয়ে কবি সবসময় থাকেন দূরে বাতিঘরের ন্যায়, সমস্ত অন্ধকারের মাঝে নাবিকরা তাকে লক্ষ্য করে খুঁজে নেয় দিক ও কূল। গভীরতম উপলব্ধি প্রেম থেকে বিচ্যুত হয়ে কবি নষ্ট হতে চান না কারণ এ বদ্ধ জটিল সময় যেখানে সময় নিজেই প্রতারক, কষ্টের অনলে পুড়ে কষ্টিপাথরে কবি যাছাই করতে চান অনুভব ও আকুতিকে।
‘প্রতারক নই পূর্বিতা, হয় না প্রতারক কখনো কবিরা,
কতগুলো মিছেমিছি কষ্ট মুক্তো হয়ে যায়।
পথের ধারে একটি গাছ টিকে যাকে অনন্তকাল, মানুষ-
পার হয়ে যায় নদিটা।’
মায়াহরিণ: পৃষ্ঠা পঁয়ত্রিশ: ধানস্বপ্ন
বিশ্ববাজার প্রকল্পের এই ধাপে এসে অর্থনীতিই কি শেষ কথা? পুঁজিবাদি বাজার অর্থনীতির পথে আর কোনো অর্থনৈতিক ভূ-খণ্ড কি নেই? বাজার এনটেনমেন্ট মনোজগতে গ্রাস করে কেড়ে নেয় মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার এনলাইটমেন্ট। আমাদের মেজাজ আজ বিজ্ঞাপনের ভাষায় নিয়ন্ত্রিত। এই কঠিন বাস্তবের খুব সামান্য অংশই ধরা পড়ে নয়া ধ্র“পদি তত্ত¡কাঠামোতে। বাস্তবকে বুঝতে হলে সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত তত্ত¡কে হাজির করে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ন্যায্যতা প্রমাণ করতে হবে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সামাজিক ক্ষমতায় টানাপোড়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতির নিয়মকে বোঝা খুবই জরুরি। বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতিকে দুই দশক বিপুলভাবে বন্দনা করেছিল সেই অর্থনীতি এখন সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আমেরিকাসহ সমস্ত উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির ধ্বংস এই বয়ানে দৃশ্যচিত্র আর রিসি’র বোধে শৃঙ্খলিত কাব্যক্রম এমন-
‘কে যে নাচায় কাকে?/মুক্তক তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক ইঁদুর শেখায় পর্নোগ্রাফি।/ লাল মানুষ, নীল মানুষ, হলুদ মানুষ অগণন মানুষের মিছিল? পুতুলগুলো নাচছে সব…/ নাচনেওয়ালি নাচ দেখায়, আমরা নাচি পণ্যপুঁজি/ উন্নতবিশ্ব, ধ্যান আসে পাখনায়/ সাধুবাবা সাধুবাবা-হরিবোল বোল হরি…।/’
মায়াহরিণ:পৃষ্ঠা ঊনচলিশ: পুতুলগুলো নাচছে
পুরাণকাব্য গ্রন্থের মধ্যদিয়ে কবিতার প্রেম-বাস্তবতা সময়ের কামনা-বাসনাসহ যাপনের সমস্ত বিন্যাসকে অবচেতন মনে শেয়ার করেছেন পূর্বিতা নামে কোনো এক অচেনা কল্প-নারির কাছে। যে নারির কাছে কবি সমর্পণ করেন তার সকল সফলতা, অক্ষমতা, ব্যর্থতা ও চিন্তাকে। বহুরৈখিক এই সময়ের দহন নিয়ে কবি আত্ম-আয়নায় টের পান কঠিন বাস্তবতার সাথে গোপনে গোপনে নিজের বিদ্রোহি সত্তাকে খাপ খাওয়ানোর কৌশলি দাগগুলো। এতসব শর্তেও উত্তর-উপনিবেশিক সময়ে রিসি দলাই’র মনোযোগ শেকড়ের আস্থায় মাঙ্গলিক শুভ- অর্চনায়। চুরমার হয়ে যাচ্ছে আত্মগত ভাস্কর্য, যতেœ গড়া প্রতিকায়িত চিত্রকল্পগুলো। কবিতা পড়া মানে যেহেতু মূল্য নির্ণয় বিবর্তনশিল পরিধির, সেহেতু পড়–য়াকে পুরনো ধরনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাঠক আজ কবিতায় বাচনিক বহিরাঙ্গে সিমাবদ্ধ থাকতে চায় না। তাই রিসি দলাই নয়া উপনিবেশিক সামিয়ানা রুখতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন নয়া ডিসকোর্স নিয়ে; বাখতিনের মৌল অনুভবে ‘হড়ঃযরহম রং ধহুঃযরহম রহ রঃংবষভ’ পুনর্গঠন ও পুনরাবিষ্কার নিজেকে এবং জগৎকে।