কথাশিল্পে উদ্দেশ্যবাদি প্রবণতা বিষয়ক দুয়েকটি কথা বলা জরুরি, প্রাসঙ্গিক মনে করি। স্মৃতিশক্তি যদ্দুর সহায়তা করে তাতে বিষয়টি পরিষ্কার উদ্দেশ্য অথবা সচেতন রাজনৈতিক, নৈতিক বিলাস এর পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি, গোপন বাসনাও হয়তোবা। আদতেই শিল্পের ক্ষেত্রে সচেতন উদ্দেশ্যবাদিতা-লক্ষ প্রাধান্য পেলে কদ্দুর শিল্প হয়, অন্যভাবে বললে তাতে সারবস্তু কিছু থাকে কি-না তা নিয়ে বিস্তর শ্রম, মেধা, অর্থ অপচয় হয়েছে, উত্তর মেলেনি। চোখের সামনেই তো ম্যালা ম্যালা দৃষ্টান্ত। ভলতেয়ার এর ‘কাদিদ’, হেরমেন হেসের ‘সিদ্ধার্থ’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, সৈয়দ ওয়ালিউলাহ’র ‘লালসালু’। রবি ঠাকুর যখন ‘শেষের কবিতা’, ‘গোরা’ লেখেন তখনও পেছনে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন ছিলো সন্দেহ নেই, শিল্পমানে খামতি ঘটেছে এমন অভিযোগ শোনা যায় নি কোনো তরফেই, বরং প্রশংসিত হয়েছে লেখকের মুন্সিয়ানা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’য় যখন রোহিনিকে অন্যায়ভাবে নির্মম পরিণতি বরণ করতে হয় লেখকের পক্ষপাতদুষ্ট বিমাতাসুলভ আচরণে তখনও বিষয়টির মিমাংসা হয় না। ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?’- বিভ্রান্ত মনে হয় নিজেকে। বিভ্রান্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে যখন চারপাশটা নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে যায় অজান্তেই। উল্টোস্রোতে পথচলা বিষয় হিসেবে যদিও কঠিন, নিজস্ব টিকে থাকায় তবু কখনো কখনো বিপরিত স্রোতই আঁকড়ে ধরেন কেউ কেউ।
‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’-আখতারুজ্জামান ইলিয়াছের কথাসাহিত্য বিষয়ক একটি প্রাসঙ্গিক লেখায় এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। প্রশ্নটি এবং এই সময়ের প্রেক্ষাপটেও সম্ভবত তার মর্যাদা হারায়নি। তাবৎ কথাশিল্প এলাকার এই দৈন্য প্রকট হচ্ছে ক্রমশ পালা দিয়ে। এই অবসরে দু’টি সম্পাদিত বইয়ের খবর বলে নেয়া যাক। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠগল্প অথবা সমকালিন গল্প শিরোনামায় দু’টি বই দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। একটির সম্পাদক জাকির তালুকদার, অন্যটির রাশেদ রহমান। সম্পাদিত গ্রন্থ প্রণয়ন নতুন নয়। কু-কীর্তিটি সম্ভবত বাংলা-সাহিত্যে আমদানি করেন বুদ্ধদেব বসু ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ শিরোনামায়। বাংলাদেশে হুমায়ূন আজাদ নষ্টামিকে খানিক উস্কে দেন তার আধুনিক কবিতা বিষয়ক গ্রন্থ সম্পাদনায়। অবশ্য হুমায়ূন কৈফিয়তনামায় কিছু কথা বলে তার অপকর্মকে হালাল করতে চেয়েছেন। হুমায়ূন অনুসৃত পথে নষ্টামিতে আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনার দুঃসাহস দেখান সাজ্জাদ শরীফ। ব্যক্তিগতভাবে আমি শরীফকে ‘কবি’ মনে করি না তাই তার সম্পাদনা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু জাকির তালুকদার বাংলাদেশের একজন অবশ্যম্ভাবি কথাসাহিত্যিক। এই অপকর্মটি তিনি না করলেও পারতেন, তুলনায় স্বল্পপরিচিত রাশেদ রহমানের সম্পাদনা গ্রন্থটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
দুই
‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’ উল্টোস্রোতের লেখক কথাশিল্পি সেলিম মোরশেদ প্রণিত এবং যুবকাল প্রকাশিত গ্রন্থ। প্রকাশকাল ২০০৫। দীর্ঘ ৮বছর পর বইটি পুনরায় নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কতগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে, ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে। একটি বই পুনপাঠে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়, সমকালিনতা নিয়ে ভাবতে প্রলুব্ধ করায়। আর লেখক যদি তার সময়কে সচেতনে তুলে আনতে চান সেক্ষেত্রে বিষয়গুলো কেমন হতে পারে, কি কি উলেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে পুনপাঠ অথবা লেখকের পুনবয়ানে।
সেলিম মোরশেদ কি লেখেন? তার ভাবনার জগৎ ব্যপ্তি বিশালত্বের জায়গা কোনটি?
সাধারণ আটপৌঢ়ে মধ্যবিত্তের বয়ানকার মোরশেদ। সাদাচোখে যতটুকু মানুষকে চেনা যায়, সম্পর্কের বুনটে, লাম্পট্যে-প্রতারণায়, একাকিত্ব-হতাশায়, পরিপার্শ্ব শিতলতা, জিঘাংসা অথবা সংগমের জটিল আবর্তে ঠিক ততটুকুই ধরতে চান তিনি। তবে মোরশেদের গ্রন্থ পাঠে ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধা আছে সেটি স্বীকার করা ভালো। সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবনের যে মানুষগুলো নিয়ে মোরশেদের সংসার সেই মানুষগুলো কখনো সখনো রক্তমাংসে প্রায়শই জীবন্ত হয়ে যায়। শহিদুল আলম পিন্টু তাই সহজে হয়ে যায় শহিদুল আলম, সাগর নীল খান দীপ তার সমস্ত ভালোমানুষি উপস্থিতি নিয়ে হাজির হয়ে যান। আমির খসরু আর আমির খসরু থাকেন না হয়ে যান খসরু ভাই। প্রিসিলার ছাতার প্রিসিলা আর গল্পের প্রিসিলা থাকে না রক্তমাংসের প্রিসিলায় পর্যবসিত হয়। সেটা আমার নিজস্ব সমস্যা, হয়তো তাই। আরেকটা সমস্যা আছে সেটা হলো লেখকের (প্রবল) নিজস্ব শারীরিক উপস্থিতি। খেই হারিয়ে ফেলি মনে হয় গল্পের চরিত্র নয় স্বয়ং সেলিম মোরশেদ তার সমকালিনতা নিয়ে কথা বলছেন। চলতি পন্থার রাজনীতি, সামাজিক রিরংসা, রাগ, দ্বেষ, প্রচল সময়, সাহিত্যিক নোংরামি ইত্যকার বিষয়ে।
তিন
‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’ নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। লেখক নিজেও এই ক্ষুদ্রায়তন ৪টি গল্পের বিষয় নিয়ে সম্ভবত সংকুচিত। প্রকাশিত হয় বইমেলায়। তো যদ্দুর মনে পড়ে বইটি হাতে আসার পর এর ক্ষুদ্রাকৃতির কারণেই ভালো লেগেছিল। আর ভাল লেগেছিল ‘মহান সূর্য আর অভিমানী মেয়েটি এবং তুচ্ছ বালির গল্প’ বিষয়ক গ্রন্থের শেষ গল্পটি।
সেলিম মোরশেদকে অনেকে কমলকুমার মজুমদার ঘরাণার বলতে চান। কমলকুমারিয় বাক্যগঠনশৈলির সাথে তুলনা করেন তার। কথাটি যে সত্য নয় সেটি কমল এবং সেলিম মোরশেদিয় রচনা পাঠ করলেই টের পাওয়া যায়। বিষয়টিকে এভাবে না বলে বলা ভালো সেলিম মোরশেদের সাথে কমলকুমার মজুমদার কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের আত্মিয়তার যোগ আছে অন্য জায়গায় সেটা প্রচলিত সময় সমাজের সাথে নিরাপোষ মানসিকতায়; দ্ব›দ্ব দ্বৈরথে তারা বেছে নিয়েছেন উল্টোরথ। আর একথাতো স্বীকার করতেই হবে সেলিম মোরশেদ জীবনে যাপনে মুভমেন্টে তার নিজস্ব অবস্থানে পরিক্ষিত-স্থিত, আপস করেননি।
ক. তুলনা
‘তবু এবার একবার সে চেষ্টা করল, ছোট টিনের ল্যাম্পের মধ্যে তেল ছিল বা। ছোট একটু আলো হল, তখন সে ছোট ঘরটার চারিদিকে চাইল, অন্ধকার নেই, আবছায়া হয়েছিল, তেকোণা হয়ে যাওয়া খড়ের ছাওয়া বহুখানে সরে গেছে; সমস্ত ধান জলে ভিজে গিয়েছিল, তা দিয়েও কিছু চাল পেয়েছে, কিন্তু এখন শূন্য;-যেমন আছে-এইভাবে যতœসহকারে তবু সে চতুর্দ্দিকে চেয়ে ছিল। ঠিক তেমনি ভাবেই এর পরপর সে বসেছিল। ল্যাম্পের আলোয় তার হাতটা সে দেখছিল, শীর্ণ, পদদ্বয়-তাই। এবং নিজের পরনের কাপড় নড়লে-চড়লে যেমন খসে পড়বে এরূপ সে হয় রুগ্ন, সে বাহিরের দিকে চাইলে, বাহিরে ক্রমাগত অন্ধকার, যত দেখ তখন মনে হয় ভয়ঙ্কর! নোনা জলের উপর অন্ধকার ভয়ঙ্কর আর যদি ঝিলির শব্দ-তাও ছিল। ফতিমার বুক দুরু দুরু করে উঠল-এ জল কবে সরবে?’ (জল, কমলকুমার মজুমদার)
খ. তুলনা
‘হাত বুকের সঙ্গে লেগে থাকলে বুক দেবে যায়; সে-ইচ্ছাশক্তি দিয়ে হেমাঙ্গিনী তার হাত নিস্পৃহ করে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলো-সে-ইচ্ছাশক্তি দ্বিগুণ করেও হেমাঙ্গিনী তার হাতকে সচল করতে পারলো না। ফলত খুপরির ভেতর বিষাক্ত সাপের অবস্থান তাকে হীনমন্য করলো। বড় রাস্তার ধুলো কেটে কেটে হেমাঙ্গিনীর চলাচল। শহরে ভিখিরিদের সংখ্যা কমে গেছে। গভমেন্ট ভিখিরি পুনর্বাসন নামক এক আস্তানা করেছে, সেখানে ওদের খাওয়া-দাওয়া নি-রা-প-ত্তা-র ব্যবস্থা আছে। ধিঙ্গি বললো-হেমাঙ্গিনী, ওদিক আমি যাব নানে, খাওয়া পরার নামে ওরা আমাদের মেরে ফ্যালবেনে, মেরে ফেলে ফকির কুমোবে ওরা। সে আরও বললো, দু’তিনশো ফকির নাকি গ্রামের দিকে চলে গেছে। হেমাঙ্গিনী এসব শুনলো, গেলো না কোথাও, খুপরির ভেতরেই সে নির্বিঘেœ মরবে।’ (কাটা সাপের মুণ্ডু, সেলিম মোরশেদ)
চার
সেলিম মোরশেদের গল্প নিয়ে আলোচনায় অনিবার্য তার সময়; অর্থাৎ তিনি যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন, যাপন করেছেন, লিখেছেন তার প্রেক্ষাপট জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্যও নানা কারণেই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যময়। ষাট স্বাধিনতা প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা, সত্তর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক; জাতিয় জীবনেতো বটে, বিশাল নাগরিক মননে তার ঘাত-প্রতিঘাত, ভাঙচুর, বিনির্মাণ সন্দেহাতীত সত্য। এসময়ে জাতিয় আকাক্সক্ষার নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। একটি পরাধিন মনন স্বাধিনতা প্রাপ্তিতে যে ক্ষয়, রক্তপাত, মেধা হারিয়েছে পারস্পরিক সমঝোতা-বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেবার প্রচেষ্টায় একধাপ এগিয়ে যায় নিসন্দেহে এসময়। ফলে অভিঘাত অবশ্যম্ভাবি ছিল রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে। শিল্পসাহিত্য তাই এসময়ে বিশৃঙ্খল, শ্লোগানসমৃদ্ধ, কখনো কখনো উচ্চস্বরের আস্ফালন। আশিতে জাতিয় মনন স্থিতু হয়। নিজেকে নিজের আয়নায় উল্টেপাল্টে দেখার অবকাশ ঘটে। একথা জোর দিয়েই বলি, বাংলাদেশের জাতিয় জীবনের যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু সৃষ্টিধর্মি তা এই আশিতেই শুরু হয়; শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেতো বটেই। সেলিম মোরশেদ এই আশির দশকেরই লেখক। আরেকটি কারণেও এই সময়ের জাতিয় জীবন গুরুত্বাবহ। সামরিক শাসন। গণতন্ত্র তখন সামরিক ঊর্দির তলে নির্বাসিত। জীবন অস্থির। আর কিছুদিন পর পৃথিবীতে ঘটবে একটি মহাদুর্যোগময় ঘটনা, যার অস্পষ্ট লক্ষণ সবে দেখা দিতে শুরু করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন। সমাজতন্ত্রের পতন। একটি বুকভাঙা ট্রাজেডি। আবার যে মধ্যবিত্ত নাগরিক সেলিমের ঈপ্সিত সে মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণি গড়াপেটার সময়ওতা এই আশিই। একটা শ্রেণির হাতে আসছে প্রচুর অবৈধ টাকা; ফলত সমাজে যার পড়ছে অবশ্যম্ভাবি প্রভাব, নীতি-নৈতিকতা মার খাচ্ছে দারুণভাবে।
পাঁচ
সেলিম মোরশেদ কি রাজনৈতিক লেখক? অর্থাৎ রাজনৈতিক অনুষঙ্গগুলো কি তার রচনায় প্রবলভাবে বিক্ষুদ্ধ, হতাশাব্যঞ্জক সাম্যে স্থিত। না-কি নিছক শিল্পের জন্যই শিল্প রচনা করেন তিনি। অদ্ভুত কারণে খেয়াল করেছি সেলিম মোরশেদ সে অর্থে রাজনৈতিক লেখক নন; কারণ তার রচনায় সময়ের অনুষঙ্গ যেমন মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভাঙচুর কোন এক নির্মোহ কারণে অনুপস্থিত। অবাক হয়ে খেয়াল করেছি শুধু সেলিম মোরশেদ নন, তার সময় অর্থাৎ আশির প্রায় সব লেখকই কমবেশি রাজনৈতিক অঙ্গনের এই অনুষঙ্গগুলো নিতে পারেননি তাদের লেখায়, বঞ্চিত করেছেন পাঠককে। সে খেদ থেকেই কি সেলিম মোরশেদ লিখলেন ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’? রাজনীতি আশ্রিত বিষয় নিয়ে লেখা- সন্দেহ, অবিশ্বাস, আত্মদহন, পরাজয় কিংবা গ্লানি। তবে রাজনীতির আলগা উক্তির অভাব নেই সেলিমের রচনায়।
ছয়
কথাশিল্পির প্রধান শক্তি সামর্থ্য বিবেচিত হয় চরিত্র-চিত্রণে সেখানে সেলিম মোরশেদ চরিত্র চিত্রণে কতটা পারঙ্গম-দক্ষ? ‘প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে ধরাপড়া ছিনতাইকারীকে নিয়ে জটলা, পুলিশের সামনে মিলন চা বানাতে-বানাতে হঠাৎ দোকান রেখে ছুটে গিয়ে ছিনতাইকারীর নাকে একটা ঘুষি দিয়ে এলো।’ এতো জীবনের চলমান বাস্তবতা। অথবা মধ্যবিত্ত সময়ের ভাঙচুর- ‘নৈতিকতার নৈর্ব্যক্তিক গ্লানিটা তার এই কাজের ক্ষেত্রে কোনো ছাপ ফেলে না যতোটা সে উৎকণ্ঠায় থাকে কেউ যদি দেখে ফেলে সেই ভেবে।’ ‘দুপুরে পৌরসভা থেকে লোক এসেছিল-ঘরভাড়া দেয়া হলে কর বেড়ে যাবে। দুঘর ভাড়াটে আছে পিন্টুদের। টাকা গুঁজে দিয়েছে পিন্টু। পৌরসভার লোকরা রিপোর্টে লিখবে নিজেদের ব্যবহার ছাড়া আর কোনো ঘর এদের নেই-এরা ভাড়া দেয় না।’ নিছক সংবাদ পরিবেশন স্টাইলে কিশোরি মনন তুলে ধরেন লেখক-‘নাসরিন নামের সে বোনটা তরুণী থাকাকালে ওয়াহিদ মুরাদের ছবি কেটে ফাংশনাল ইংলিশ বইটার ভেতর রেখে দিতো-একটা লালা গাড়ি কয়েকদিন আগে তাকে চাপা দিয়েছে।’ তখন একবুক চাপা কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে। তবে ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’ নাম গল্পের ‘আর আবারো সন্ধ্যা হয় আর স্টিকে গাঁজা ভরে নদীর ধারে পিন্টু হাঁটে আনমনা।’ এখানে কিন্তু গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। এরপর আরো কয়েক লাইন কেন অতিরিক্ত সংযোজন সেটা বোধগম্য হয় না। ‘প্রিসিলা একটু ভিজে উঠে গিয়ে সরে গেলো দোকানটার কাছে; এধরনের আলোচনায় এতো খোলাখুলি কথা সে পছন্দ করে না; তার আভিজাত্যে বাঁধে।’ ‘ভারী মিষ্টি গলা, জামার বোতাম গলা পর্যন্ত আঁটকানো। পেছনে চুলগুলো ছাড়া, কখনো-কখনো বেণী বাঁধে। মা সুন্দরী। জন্মের আগেই বাবা-মা কুচবিহার থেকে চলে আসে। শৈশবে কি খরগোস ছিলো? ডালিম দানার মতো লাল চোখ, কিসে ভয় ছিলো তার।’ ‘মেয়েদের সাজতে হবে এরকম চাপিয়ে দিলেই খারাপ লাগে।’ এমন নানা আটপৌঢ়ে কথামালা আছে। ‘একজন আধুনিক মানুষ কি পবিত্র হতে পারে?’-শুনে প্রিসিলা বললো, ‘কেউ যদি কোনো মূল্যবোধ নিয়ে থাকতে চায়, তাতে সে যদি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেখানে পবিত্র-অপবিত্রের প্রশ্ন অবান্তর।’ এমনতরো নৈতিকতা-অনৈতিকতার বিষয় হরহামেশাই আড্ডায় উঠে আসে যা অপূর্ব মুন্সিয়ানায় লেখক গল্পের চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন। আছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাবার হতাশা। ‘রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার সূচনালগ্নে সে তখন ওখানে থাকায় নিজেদের ভেতর দায়-দায়িত্বের মানবিক দিকগুলো ততোটা যৌথভাবে সে দেখে না।’ আবার ‘সুগঠিত দেহের মেয়েদের দুঃখী হওয়া ভাতে দেয়া সিদ্ধ হওয়া পেঁপের মতো।’ অনেকদিন মনে রাখার মতো উক্তি। আছে মধ্যবিত্তের সংস্কার-‘সাবরিনার ধর্ম তাকে বিশ্বাসী হতে শিখিয়েছে। সাবরিনার সংস্কৃতি তাকে সমাজের বিপক্ষে গিয়ে শ্যামল মিত্রের সাথে ঘুমুতে চাওয়া শিখিয়েছে।’ শেষ গল্প ‘মহান সূর্য আর অভিমানী মেয়েটি এবং তুচ্ছ বালির গল্প’। গল্পটি লোকজ অনুষঙ্গ থেকে নেয়া, ধার করা যার বিষয় আশয়। কিন্তু লেখকের বর্ণনার ঢং নিজস্ব। একটি চমৎকার গল্প। সেলিম মোরশেদের এপর্যন্ত লেখা কোনো রচনার সাথে যার মিল নেই। এধরনের একমাত্র অনন্য প্রথম এবং শেষ লেখা। একটি প্যারা টুকে নেয়া যাক। ‘ভোরবেলা ঘুম ভাঙে মেয়েটির। আশ্চর্য হয় সে। একি দেখছে। সে একটা ঘরের ভেতর। চারপাশ থেকে আসছে রোদ আর রোদ। সারারাত ধরে তুচ্ছ বালি নিরলস পরিশ্রমে নিজেকে আতশ কাচে রূপান্তরিত করে একটা কাচের ঘর বানিয়েছে। যার ভেতর দিয়ে সূর্যরশ্মি ভেদ করে মেয়েটিকে সূর্যমুখী করছে আর তার ভিজে চিঠিগুলো শুকিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি চারপাশে খোঁজে। কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য কোথাও একটা কণা বালিও সে দেখে না। অভিমানী মেয়েটি মহান সূর্যের দিকে তাকিয়ে তুচ্ছ বালির কথা ভাবে। কোনোদিন সে আর একটি বালির কণাও দেখতে পায়নি।’
সাত
‘উলুখড়’ বইয়ের দোকান, সাগর নীল দীপ সারাদিন ধরে যা বিক্রি করতো, সন্ধ্যায় সেই টাকা নিয়ে বারে গিয়ে মদ খাওয়া। এটাই একটা নিয়ম যেন আইন।’ ‘পুলিশ আসলে বলবেন আপনার লাইসেন্স আছে। আপনার নাম করুণাময় গোস্বামী। আপনার বাবার নাম হিমাংশু গোস্বামী। আপনি মুসলমান এটা জানাবেন না। পুলিশ আপনাকে কিছু বলবে না তাহলে।’ এগুলো তো নিজস্ব যাপন আটপৌঢ়ে কথামালা; সময়ের ফ্রেমকে অক্ষরের ছাচে আবদ্ধ করে ফেলা। সেলিম মোরশেদ সেই কাজটাই করছেন দক্ষতার সাথে। দিয়েছেন কিছু চেনা চরিত্রকে অপরিমেয় ঐশ্বর্য। সঙ্গে মধ্যবিত্তসুলভ দ্বিধা, সংকোচ। আছে পিছু হটে যাবার কায়দা রপ্ত করার অপূর্ব কৌশল। সিদ্ধান্ত নিতে না জানা অথবা না পারার বিষয়গুলোও যুক্ত হয়ে যায় এর সাথে। সেলিম মোরশেদ খুব বেশি লেখেননি। আবার একেবারে কমও নয়। নিজেকে সজিব সচল রেখেছেন তার কর্মকাণ্ড দিয়ে। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ দিয়ে শুরু করে লিখেছেন ‘সাপলুডু খেলা’, ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’, ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ ও ‘মানুষউত্তম’। বেরিয়েছে ‘সেলিম মোরশেদের নির্বাচিত গল্প’ ও ‘সেলিম মোরশেদের রচনা সমগ্র’। মধ্যবিত্তের নাগরিক কথক কথাশিল্পি সেলিম মোরশেদ প্রচল সময়ে দাঁড়িয়ে তার চলমান আন্দোলন-ভাঙচুর অব্যাহত রাখবেন আশা করা যায়। ‘প্রিসিলার ছাতা মাথার ওপর, অস্থির, সে যাবে না দাঁড়াবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না।’ অস্থির রাজনীতি বহুপ্রদ সাম্রাজ্যলিপ্সা রাষ্ট্রের নৈতিক স্খলন দাঁড়াবার জায়গাগুলোকে ক্রমশ করে দিচ্ছে সংকুচিত, সিমাবদ্ধ। অনেক সময়ই আমরা বুঝতে পারি না দাঁড়িয়ে থাকবো, না চলমান গতি রাখবো অব্যাহত… থেমে যাওয়া মানে তো মৃত্যুই… এই আপাত রুখে দেয়া, ঠেঁকিয়ে দেয়ার নাম জীবন। জয়তু সেলিম মোরশেদ, জয়তু তার পথচলা।