একজন প্রশান্ত হালদার, থিয়েটার আর্ট ইউনিট এবং না-মানুষি জমিন
প্রশান্ত হালদার নাটক অন্তপ্রাণ মানুষ। পরিচয় একযুগেরও বেশি সময় ধরে। নাট্যকর্মি ও নাট্যসংগঠনের বাইরে তার আলাদা পরিচয় আছে তাহলো তিনি চমৎকার কবিতা লেখেন। উপন্যাস রচনায় এরই মধ্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘স্টুপিড কতিপয়’ নাট্যকর্মিদের অন্তর্দহন, ভাঙাগড়া, অন্তর্দ্ব›দ্ব, মানসলোক, বন্ধুত্বের দুর্নিবার প্রলোভন লেখকের নিজস্ব রসায়নে থিয়েটারের অন্তর্মহলের হাড়ির খবর অনেকখানিই চলে এসেছে। প্রশান্ত হালদারের সৌজন্যতায় থিয়েটার আর্ট ইউনিটের বেশকটি মঞ্চস্থ নাটক দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। তারই একটি স¤প্রতি মঞ্চস্থ ‘না-মানুষি জমিন’। নাটকটি মৌলিক নয়, একটি উপন্যাসের মঞ্চ উপযোগি করে নাট্যরূপ দেয়া। স্বাভাবিক কারণেই উপন্যাসের সাথে যার রয়েছে বিস্তর ফারাক। অনেকটা নতুন সৃষ্টিই বলা চলে। ‘না-মানুষি জমিনে’ আমার আগ্রহ, কৌতুহল অন্য কারণে। সিমান্তে হত্যাকাণ্ড নতুন নয়। প্রতিদিন সিমান্তে মানুষ মরছে। যার দুয়েকটি খবর দৈনিক-পত্রিকায় ছাপা হলেও, বেশির ভাগেরই কোনো খবর কোথাও ছাপা হয় না।
এরকম একটি স্পর্শকাতর, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের অবন্ধুসুলভ বৈরি মনোভাব মঞ্চের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। বন্ধু প্রশান্ত হালদার ও থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সকল সদস্যকে এরকম একটি চমৎকার কাজের জন্য ধন্যবাদ। অস্ত্রের চাইতে শিল্প অনেক বেশি কার্যকর, মানবিক, মানুষের অন্তরকে ছুঁয়ে যেতে পারে, তা থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মঞ্চস্থ নাটক আবারও প্রমাণ করলো।
প্রসঙ্গ: রামমালা গ্রন্থাগার, পাণ্ডুলিপি পাচার
কুমিলার ঈশ্বর পাঠশালায় অবস্থিত রামমালা গ্রন্থাগার একটি প্রাচিন হাতে লেখা দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহশালা। কিছুদিন পূর্বে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে হয়তো অনেকেই আহত-বিব্রত বোধ করেছেন। খবরে বলা হয়েছে, একজন বিদেশির সাথে দেশিয় আরো কয়েকজন মিলে পাণ্ডুলিপিগুলো পাচারের উদ্দেশ্যে স্ক্যানিং করছিলেন; যার মধ্যে বাংলা একাডেমির একজন কর্মকর্তাও রয়েছেন। শিল্পসামগ্রি পাচারের ঘটনা নতুন নয়। এর পূর্বেও আমরা দেখেছি জাতিয় জাদুঘর থেকে দুর্লভ শিল্পসামগ্রি পাচার হতে; এবার এর সাথে যুক্ত হলো পাণ্ডুলিপি পাচার। যাদের নাম ছাপা হয়েছে তাদের মধ্যে এমন এক বন্ধুর নাম ছাপা হয়েছে যেটা কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে এরকম প্রাচিন সংগ্রহশালা আর নেই। এরকম একটি দুর্লভ সংগ্রহশালার দিকে তাই অনেকের লোলুপ দৃষ্টি থাকবে, স্বাভাবিক। ১৯১২ সালে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগি মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ধরনের ৩০ হাজার বই, আট হাজারের বেশি প্রাচিন পুঁথি রয়েছে। এর মধ্যে ছয় হাজার পাণ্ডুলিপি সংস্কৃত ভাষায় হাতেলেখা। পুঁথিগুলো বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত। পাণ্ডুলিপিগুলো তুলট কাগজ, তালপাতা, কলাপাতা, কাঠসহ নানা উপাদানের উপরে লেখা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণে আরো দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। গবেষণারও কিছু নিয়ম পদ্ধতি আছে গবেষকরা সে নিয়মগুলো পালন করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অম্লমধুর: গোবরে পদ্মফুল অথবা মঈন চৌধুরীর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে
মঈন চৌধুরী-আমাদের প্রিয় মঈন ভাই সজ্জন মানুষ। কবি, চিত্রশিল্পি, প্রাবন্ধিক নানা পরিচয়ে গুণান্বিত তিনি। দর্শনাশ্রিত নানা পদের লেখা আছে তার। ইদানিং তিনি ফেসবুকে এধরনের কিছু স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রনাথ তর্করতœ মশাই তার বাড়ির বাইরে বাগানে বসে কেশবচন্দ্র ভট্টাচার্য্যরে সাথে সমাজ উন্নয়ন এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন। এমন সময় পণ্ডিত মশাই দূরে রাস্তায় একটি বিলেতি ঘোড়ার গাড়ি বা ফিটন দেখে কেশব বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন-‘কেশব, একটা ফিটন দেখিতেছি, ইহা কাহার? এই গ্রামে তো ফিটন আসিবার কথা নয়।’ কেশব বাবু উত্তর দিলেন-‘আর বলিবেন না পণ্ডিত মশাই, সমাজ আর সমাজ রহিল না, অই পাড়ার হারুমণ্ডলের ছেলে রমেশ বর্মাতে গিয়া ব্যবসার নামে চুরি বাটপারি করিয়া প্রভূত অর্থ উপার্জন করিয়াছে। এখন ছোটলোকের ফুটানি করিবার ইচ্ছা হইয়াছে, সাথে আমাদেরও অপমান করিবার সুযোগ পাইয়াছে, ফিটন কিনিয়াছে।’ পণ্ডিত মশাই মুখ কালো করিয়া নিজের টিকিতে একটা টান দিয়ে বলিলেন-‘ঘোর কলিকাল, ঐ শূয়রের পাল, নমশূদ্রের দলকে আমার বাপদাদারা এবং আমি খাওয়াইয়া পড়াইয়া বাঁচাইয়া রাখিয়াছি, আর এখন তাহারাই আমাদের অপমান করিতেছে। অবশ্য গোবরের মাঝে পদ্ম ফুটিলে কেহই তাহা তুলিয়া আনিবে না, পুজাতে কাজে আসিবে না, তবু ভগবানও এই অনাচার সহিবেন না, ঐ অস্পৃশ্য নমো হারামজাদারা ধ্বংস হইয়া যাইবে।’
উপরিউক্ত প্যারাতে উলেখিত ‘গোবরের পদ্মফুল’, ‘শূয়রের পাল’ আর ‘নমো হারামজাদা’ প্রবাদ-প্রবচনে বাঙালি জনগোষ্ঠির মনস্তাত্তি¡ক হিনমন্ম্যতা, অহংকারবোধ, পরশ্রিকাতরতা আর স্বার্থপরতার রূপ ও স্বরূপ পুরোপুরিভাবেই উন্মোচিত হয়েছে বলে ভাবা যায়। বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে উপরে উলেখিত তিনটি ছাড়াও প্রচুর নাস্তিবাচক বচন-প্রবচন পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা আপাতত হুজ্জুতে বাঙাল, ভাত নাই যার জাত নাই তার, বড়লোকের আস্তাকুরও ভালো, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না, অভাবে স্বভাব নষ্ট, টাকার গরম, ইতর বিশেষ, বামন-শূদ্র তফাৎ, দেবতা বুঝে নৈবেদ্য, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর, হাতের পাঁচ আঙুল সমান না আর বালস্য বালের কথা উলেখ করতে পারি। বাংলা ভাষা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় এতো নাস্তিবাচক প্রবাদ-প্রবচন নেই। ইংরেজি ভাষায় বহুল প্রচলিত ও ভথশ ুড়ঁ আর ঝড়হ ড়ভ ধ ইরঃপয (কুত্তার বাচ্চা) ছাড়া নাস্তিবাচক খুব একটা কিছু পাওয়া মুশকিল। আরও দেখা গেছে যে ইংরেজি ভাষার ইরৎফং ড়ভ ংধসব ভবধঃযবৎ ভষড়পশ ঃড়মবঃযবৎ বাংলায় এসে হয়ে গেছে নাস্তিবাচক ‘চোরে চোরে মাসতুতু ভাই’ আর ঞড়ড় সধহু পড়ড়শং ংঢ়ড়রষ ঃযব নৎড়ঃয হয়েছে ‘অধিক সন্ন্যাসিতে গাঁজন নষ্ট’। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলা ভাষায় এতো নাস্তিবাচক বচন-প্রবচন আর গালি কেনো উপস্থিত হলো? এ বিষয়ের উপর যৌক্তিক ও মনস্তাত্তি¡ক ব্যাখ্যা দেয়া যায়, আর এমন মনস্তাত্তি¡ক বিকার থেকে রক্ষা পাবার উপায়ও আছে। দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার বলেছেন-‘খধহমঁধমব রং ঃযব ঐড়ঁংব ড়ভ ইবরহম, সবহ ষরাব রহ ঃযরং যড়ঁংব.’ হাইডেগারের ভাষ্য মতে, ভাষা যদি সত্তার নিবাস হয়, মানবিকতার অবস্থান যদি সেখানেই থাকে, তবে ফ্রয়েড আর লাকার মনস্তাত্তি¡ক বিশ্লেষণে মানুষের সত্তার রূপ ও স্বরূপ তার ব্যবহৃত ভাষার মধ্যেই পাওয়া যাবে। বাঙালির পরশ্রিকাতরতা, স্বার্থপরতা, দুর্নিতি করার ইচ্ছা আর হুজুগে মেতে ওঠার মনস্তাত্তি¡ক কারণ তার ভাষাতেই পাওয়া যাবে। মনস্তাত্তি¡ক বিকারকে নিরাময় করতে হলে ভাষাভিত্তিক সোশ্যাল সাইকোথেরাপি বহু সময় ধরে দিতে হবে, আর তা করতে পারলেই বাঙালির মনস্তাত্তি¡ক বিকার দূর করা সম্ভব।
মঈন ভাই’র লেখনি ও তুলি সচল থাকুক।
বাংলাদেশের প্রত্যেকেই এখন লাখপতি!
কি-বিশ্বাস হচ্ছে না? বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের গড় আয় এখন এক হাজার ১৯০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমান ৯২ হাজার ৫৫২ টাকা। খবর হিসেবে নিশ্চয়ই বিষয়টি উপাদেয়, কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? সাম্রাজ্যবাদি কর্পোরেট বিশ্বায়ন, সিমাহিন লুটপাততন্ত্র, পাচার কিছু মানুষকে টাকার পাহাড় বানিয়ে দিয়েছে। যার রেশ টানতে হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষকে। কিছু মানুষের কাছে সমস্ত টাকা কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে, আর বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্রসিমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
পেট্রোলবোমা মারা গণতন্ত্র চাই না
সংখ্যা যখন প্রেসে যাচ্ছে তখন দেশব্যাপি চলছে পেট্রোলবোমার রাজনীতি। একবার ভেবেছিলাম সংখ্যা করে কি হবে? জিবন্ত মানুষ জ্বলসে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজনীতির নামে সাধারণ নিরিহ মানুষকে জ্বালিয়ে মারা হচ্ছে। কি হবে পত্রিকা বের করে?-পরে মনে হলো না প্রতিবাদ দরকার। যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। তাই এ সংখ্যায় সম্পাদকিয় ছাপা হলো না-প্রতিবাদের অংশ হিসেবে। গুটিকয় দল, নেতা-কর্মির কাছে পুরো দেশ জিম্মি হতে পারে না। দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিখেয়াল, স্বেচ্ছাচারিতায় বন্দি গোটা দেশ। লাম্পট্য, লুণ্ঠন, জিম্মি, জ্বালাও-পোড়াও নাটকের প্রহসন চলছে। সাধারণ মানুষ হচ্ছে এর নির্মম শিকার। বিদেশ নির্ভরতা, বিদেশি দালাল-মোসাহেবের মাতব্বরি, সাম্রাজ্যবাদি প্রবণতা, লুটেরাশক্তির উত্থান, বিদেশি শক্তির স্বার্থে কাজ করার স্থূল মানসিকতা, উর্বর মস্তিষ্ক দালাল-বুদ্ধিজীবীর কু-পরামর্শ পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একটি বড় মৌলিক (গুণগত) রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যেটি নেতা-নেত্রিরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না। বর্তমান এই অরাজক সময়ে গণতন্ত্রের নামে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারার সাম্রাজ্যবাদি লুণ্ঠনবাদি আগ্রাসি শক্তিগুলোকে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রয়োজনে বিকল্প ফ্লাটফর্ম দাঁড় করিয়ে এই অপশক্তিগুলোকে রুখে দিতে হবে। বর্বরতা বর্বরতাই, তাকে রাজনীতি বলে না।
হাওরঅঞ্চলবাসি কথকতা
হাওরঅঞ্চলবাসি কয়েক বছর ধরে টিপাইমুখ নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এ ধরনের কাজ দুরূহ। তাদের নিরলস সংগ্রামি স্পৃহাকে অভিনন্দন জানাই।