২০০৩ সাল। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। লেখাপড়া বিশেষ করতে হয় না। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করি। একদিন গেছি পাবলিক লাইব্রেরিতে। পাবলিক লাইব্রেরিতে অনেক ভাল বই আছে। কিন্তু আমার যাওয়ার কারণ বই না। আসল কারণ অন্য। তবে সেটা এখানে বলছি না।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। একদিন দেখি পাবলিক লাইব্রেরির নোটিস বোর্ডে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের একটা লিফলেট টানানো। লিফলেট বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। লিফলেট শব্দটার মধ্যে একটা সস্তাভাব আছে। দর্শন সস্তা ব্যাপার না।
লিফলেটে কী লেখা ছিল এখন আর ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু এই লিফলেটই সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগের মাধ্যম। লিয়াকত ভাইকে তখনও চিনি না। তখনও জানি না যে, এই মানুষটাই পরবর্তি সময়ে আমার চিন্তা জগতে এতখানি প্রভাব বিস্তার করবেন।
লিয়াকত ভাইয়ের দর্শন পাঠচক্রে আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটা এই সুযোগে বলে নেয়া যেতে পারে। প্রথম প্রথম একধরনের সংকোচ থাকে। এই সংকোচ কাটানোর জন্য আমি সঙ্গে দেবব্রতকে নিয়ে আসার অপচেষ্টা চালালাম। দেবব্রত আমার সঙ্গেই পড়ে এবং মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরিতে অংশ নেয়। অপচেষ্টা বলছি, কারণ দেবব্রত তখন টিউশানি করে। টিউশানি বাদ দিয়ে দর্শন পাঠচক্রে অংশ নেয়াটা ছোটখাট পর্যায়ের অপরাধ। তবে ছোটখাট অপরাধ করা যায়, বড় অপরাধ করাটা ঠিক না ।
কিন্তু দেবব্রতকে সঙ্গে নেয়া গেল না। দর্শন পাঠচক্রে আমি একাই এসে হাজির হলাম।
সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র পরিবাগে। এসি রুম। ঘরে কোনো চেয়ার টেবিল কিছু নাই, কার্পেট বিছানো। সবাই গম্ভির মুখে বসে আছে। লিয়াকত ভাই পড়াচ্ছেন ভিয়েনা সার্কেল। কিন্তু ভিয়েনা সার্কেল আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অন্যদের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আমার ধারণা হল অন্যরাও কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। র্যাশনালিজম জাতিয় কী একটা নিয়ে আলোচনা চলছে। সিরিয়াস আলোচনার সময় মুখে গাম্ভির্য রাখতে হয়। আমিও মুখ গম্ভির করে বসে থাকলাম।
এর দু’দিন পর দেবব্রতর সঙ্গে দেখা।
দেবব্রত জিজ্ঞেস করল, কেমন হল পাঠচক্র?
আমি বললাম, ভাল না। একটা টাক মাথা, দাড়িওয়ালা লোক কী কী সব বলে, বাকিরা ঘাড় নাড়ে। কিছু বোঝা যায় না।
দেবব্রত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সময় অত্যন্ত মূল্যবান-অপচয় করা ঠিক না।
লিয়াকত ভাইয়ের এই দুর্বোধ্য পাঠচক্রের সঙ্গে আমার স¤পর্ক এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তেমন ঘটল না। আমি কিছুদিন পর আবার গিয়ে হাজির হলাম। কেন গেলাম? এর কারণ আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট না। এই ঘটনাকে লিয়াকত ভাইয়ের উপস্থাপনার দক্ষতা হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। আমি তা করতে চাচ্ছি না। মানুষের জীবনে নিয়তি বলতে একটা ব্যাপার আছে। নিয়তি যাকে যেখানে টেনে নেয়, তাকে সেখানে যেতে হয়।
এর বছরখানেক পরের কথা। দর্শন পাঠচক্র নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এবার একদম প্রথম থেকে অংশ নেয়া শুরু করলাম। লিয়াকত ভাইয়ের কথা ততদিনে আমার কাছে সহজ হয়ে এসেছে। পড়ানো হচ্ছে থেলিস, গ্রিস, ইসলাম। সহজ কথা, সহজ বক্তব্য। না বোঝার কোনো কারণ নাই। আমি মোটামুটি দর্শন পাঠচক্রের নেশায় পড়ে গেলাম। নেশা কেন বলছি একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
পাঠচক্রের আসর বসে বৃহস্পতিবার। আমার যাওয়ার কথা ঢাকার বাইরে, বাগেরহাট। রাতের গাড়িতে। গেলে পাঠচক্রে অংশ নেয়া যাবে না। তাই যাত্রা একদিন পিছিয়ে দিলাম। পাঠচক্রে অংশ নিতে হবে। আমার এই নেশা টানা প্রায় তিন বছর ছিল।
একদিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। অংশগ্রহণকারি এসেছে তিনজন। তিনজন নিয়ে পাঠচক্র হয় না।
পাঠচক্র তখন সমন্বয় করেন মুজিব ভাই।
আমি মুজিব ভাইকে বললাম, আজকে রেইনি ডে ঘোষণা কইর্যা দ্যান। দর্শন পাঠচক্রের জন্য দার্শনিক রেইনি ডে।
মুজিব ভাই রহস্যময় ভঙিতে হাসলেন।
এই হাসির রহস্যভেদ হল একটু পরে। লিয়াকত ভাই যথারীতি দর্শন পড়ানো শুরু করলেন। আমাদের দ্বিধা হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, কোনো সিরিয়াস চর্চা কখনও খুব বেশি মানুষকে দিয়ে হয় না। এই কথাটা আমি লিয়াকত ভাইকে আরও বেশ কয়েকবার বলতে শুনেছি।
লিয়াকত ভাই পড়ান দর্শন। দর্শন উপভোগ্য বিষয় নয়। এ জাতিয় আসর বেশিদিন টেকে না। কিন্তু লিয়াকত ভাই এই আসর টিকিয়ে রেখেছেন। দর্শন পড়ানোয় তার উৎসাহ ক্লান্তিহীন। মানুষ হিসেবে আমি অলস ধরনের। লিয়াকত ভাইয়ের কর্মতৎপরতা আমার জন্য এক গভীর বিস্ময়। আমার বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। খুব সহসা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ লিয়াকত ভাইয়ের কর্মতৎপরতা এখনও থামেনি।
আজিজ মার্কেট বা টিএসসিতে পাঠচক্র খুব একটা দুর্লভ নয়। এর বেশ কয়েকটা রাজনৈতিক। কোনো কোনোটাতে আবার অংশ নিতে টাকা পয়সা লাগে। আগে টিকিট কেটে যাত্রা দেখতে হত। এখন টিকিট কেটে পাঠচক্রে অংশ নিতে হয়। লিয়াকত ভাইয়ের ব্যাপারটা সেরকম নয়। লিয়াকত ভাইয়ের পাঠচক্র হচ্ছে অবৈতনিক শিক্ষা।
আমাদের দেশে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে খুব কম মানুষ। এই দুর্লভ কাজটা লিয়াকত ভাই করে ফেলেছেন। কোনো রাজনৈতিক বিতর্কই তাকে স্পর্শ করেনি।
লিয়াকত ভাই যা পড়ান তার আলোচনা বা সমালোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্লাস সেভেনের ছাত্রের অনার্সের পাঠ্যসূচি নিয়ে আলোচনা করা এক ধরনের ধৃষ্টতা। আমি তা দেখাতে চাচ্ছি না। তবুও একটা বিষয় উলেখ করা যেতে পারে। দর্শন পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে লিয়াকত ভাই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তার সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি। সে বিষয়গুলো এখানে উলেখ করলাম না। একমত না হওয়াটা নিশ্চয় দোষের না। লিয়াকত ভাই মুক্তচিন্তার কথা বলেন। মুক্তচিন্তায় বিরুদ্ধ মতের একটা জায়গা থাকে। লিয়াকত ভাইয়ের আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে মুক্তচিন্তা আমার বিশেষ প্রিয়।
লিয়াকত ভাইয়ের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধাবোধ আমার একার নয়। আমার সমসাময়িক আরও অনেকেরই তা আছে। জীবন খুব সংক্ষিপ্ত একটা ব্যাপার। এত ছোট জীবনে শ্রদ্ধা সবার ভাগ্যে জোটে না। লিয়াকত ভাইয়ের এই সৌভাগ্য দেখলে আমার ঈর্ষা হয়।
লিয়াকত ভাইকে শ্রদ্ধা জানানোর বিশেষ সুযোগ হয়নি। এই লেখার মাধ্যমে একটা চেষ্টা করলাম। এই সম্মান লিয়াকত ভাইয়ের প্রাপ্য।