আমাদের এই মধ্যম শহুরে জীবন প্রতিনিয়ত হয়ে উঠার যে চেষ্টা চলমান, আর এই চলমানতা উদ্ভূত যে দ্বন্দ্ব সেটাই তো তার গতিশিলতার বহিঃপ্রকাশ। অর্থনীতি আশ্রিত রাজনীতি আর তার ফলে সৃষ্ট বাস্তবতা আমাদেরকে যা করায় বা আমরা যা দৈনন্দিন জীবনে করি তাই তো আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের সাংস্কৃতিক চলিষ্ণুতা নিশ্চয়ই জাতির গতিময়তার লক্ষণ। সংকট হচ্ছে যে, দেশের আমজনতা অর্থনৈতিক গতিময়তার সঙ্গে তাদের খাদ্যাভ্যাস, রুচি, জীবনধারা অর্থাৎ সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে কিন্তু শহুরে সংস্কৃতির অভিভাবকরা ব্যাপারটা আমলে আনতে চাচ্ছেন না। আমাদের এই শহুরে জীবনযাত্রায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দেশিয় সংস্কৃতির বিশেষ কিছু রূপ ধারণ করছে সংগীত, নাটক, নৃত্য প্রভৃতির মাধ্যমে। এগুলোকে ‘পারফর্মিং আর্টস’ বলা হয়। এর বাইরে দিবস ও সপ্তাহ উদ্যাপনের মাধ্যমে মূলত কিছু সাংস্কৃতিক ‘এন্টিক’ প্রদর্শন করা হয়। বছরে একবার উল্টোরথে চড়ে পিছনে যেতে যত রোমাঞ্চকরই লাগুক না কেন আমাদের দৈনন্দিন গ্রামিন জীবনে পান্তা-ভাত গ্রহণ যে দৈহিক প্রয়োজনে কখনো কখনো সেই বিষয়টিকে এভাবে শহুরেপনার একদিবসিয় কর্মকাণ্ডে আনয়ন খানিকটা তাচ্ছিল্য এবং প্রতারণাপূর্ণ। গতিশিল জাতি ঐতিহ্য থেকে তার রস গ্রহণ করে, পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নতুনতর উপলব্ধিতে উৎক্রমিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের জাতিয় জীবনের নানান বন্ধ্যাত্ব জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রয়োজনিয় রসদ আমাদের সরবরাহ করেনি। আমরা মার্কস থেকে জানি পুঁজিবাদি সমাজে একমাত্র পুঁজিই হচ্ছে সার্বভৌম, আর সকল কিছুই তার অধিন, (পরিবার-সমাজ রাষ্ট্র)। যে বিশ্বব্যবস্থা পুঁজির জয় ঘোষণা করছে এবং যে রাষ্ট্র পুঁজির অধিনস্থ হবার জন্য নিজকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত সেখানে সকল ব্যাপারই যে পুঁজির আওতাধিন তাতে অবাক হবার হয়তো কিছুই নেই। কিন্তু এ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে রসদ খুঁজতে গিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের গহন গভীর থেকে আমরা নিশ্চয়ই সে সকল জিনিসই গ্রহণ করবো যেগুলো সংগ্রামের জন্য উপযুক্ত হতে পারে। বিশ্বায়নের পুঁজিতান্ত্রিকতা থেকে জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব সমুন্নত রাখবার ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো বদ্ধমূল ধারণা থেকেও সরে আসতে হবে। এটা আমার মতে জরুরি এ কারণে যে, দীর্ঘকাল এ শহুরে সংস্কৃতির রূপটা একইরকম রয়ে গেছে ভেবে আমাদের সংস্কৃতির অভিভাবকরা তদনুযায়ি ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ফলত আমাদের তরুণ-যুবক সমাজ এ প্রবাহে নিজেদের অঙ্গিভূত করছে না। আমরা বোধ হয় অনেকদিন ধরে ধীরে হলেও, পরিবর্তিত হওয়া আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারটা আমলে নিচ্ছি না। সে কারণে খানিকটা বৈসাদৃশ্যপূর্ণ গান-বাজনার প্রতি আমাদের শহুরে যুবক সমাজ ঝুঁকে পড়েছে বলা যায়। আমাদের শহুরে সংস্কৃতিবেত্তারা তাদের সংস্কৃতির একটা সীমানা নির্ধারণ করে নিয়েছেন। বিশেষ কিছু প্রক্রিয়া এবং মত তাদেরকে ‘প্রোটোটাইপ’ করে দিয়েছে। তারা নিজেদের আটকে রেখেছেন স্বসৃষ্ট এক সীমানার ভেতর। আজকের পরিবর্তিত যুবসমাজ সেই সীমার ভেতর নিজেদের রাখতে চায় না। সে ছুটছে পরিবর্তিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। আজ তাই খুব জরুরি হয়ে পড়েছে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা শহুরে সংস্কৃতির এই ‘প্যারাডাইম’ ভেঙ্গে দেওয়া।
হয়তো অনেক সংকট বা সীমাবদ্ধতা আমাদের আঁকড়ে ধরবে কিন্তু প্রচলিত এই সাংস্কৃতিক বদ্ধতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে বিশাল-বিপুল এই তরুণ প্রজন্ম যেমন বিজাতিয় সংস্কৃতির খপ্পরে পড়বে তেমনি জাতির উত্তর-পুরুষরা আমাদের ক্ষমা করবে না।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন-একটা জাতির রাজনীতি হচ্ছে সমাজের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান ও ক্ষমতা নির্ধারণের সংগ্রাম। সময়ের গতিপথে এই ক্ষমতার ভিত্তি ক্রমাধিকভাবে বিস্তারিত হতে থাকে। প্রগতিশিল রাজনীতি হচ্ছে সেই রাজনীতি যা ক্ষমতার ভিতকে বিস্তারিত হতে সাহায্য করে।
আজকে প্রগতিশিলদের এই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব অতিক্রমের যে রাজনীতি সেটার সীমা বিস্তারিত ও জোরদার করতে হবে। বর্তমান শহুরে সংস্কৃতির যে নিজস্ব রূপ রয়েছে তার সঙ্গে ঐতিহ্যের যথার্থ সংমিশ্রণই হয়তো সেই সাংস্কৃতিক রূপটি আমরা পেয়ে যাবো।